‘মেরি, আপনার কী মনে হয়?’
‘কোন ব্যাপারে?’
‘এই ধরেন, বিয়ের ব্যাপারটা। মানুষ কি ভালোবাসা থেকে বিয়ে করে, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে বিয়ে করার পেছনে?’
‘আমি জানি না।’ মমতাজকে মরিয়ম বিয়ে করেছিল, কারণ সমাজে তার পুনর্বাসিত হওয়ার দরকার ছিল। নাকি সে বাচ্চা চেয়েছিল? অথবা স্বামী? সবার যেমন থাকে? তাহলে তো নিজের মা আর বোনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনাত্মীয় পরিবেশে এভাবে জীবন যাপন করতে হয় না।
‘অবশ্য,’ মরিয়ম আগের কথার সঙ্গে যোগ করে, ‘একটা বিয়ের পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাক, বিয়েটা কিন্তু দরকার।’
‘আপনি জানেন না,’ দেবাশিস হাসি হাসি মুখ করে বলে, ‘আমি কিন্তু জানি।’
‘কী জানো তুমি?’
‘আমি জানি, আশিক বিয়ে করেছে জার্মান সিটিজেনশিপ পাবার জন্য। সে মেয়েটিকে ভালোবাসে না।’
ভালো ভালো। এভাবে ভাবতে পারলে খুব ভালো। জীবনটা অনেক সহজ হয়। দেবাশিস ভাবছে, আশিকের বিয়েটা ভাড়া করা। ওখানে অনেক মেয়ে টাকা নিয়ে যেমন বিদেশি ছেলে বিয়ে করে, তেমনি ভালোবেসেও করে। কোনটা সত্য–এত দূরে বসে দেবাশিস তা জানবে কী করে। তাকে তো গত দুই বছরে এক লাইন চিঠিও লিখেনি আশিক। বিয়ের খবরটাও সে জানতে পেয়েছে আশিকের মায়ের কাছ থেকে।
দিনটা কাজের ভেতর আর দুরাশায় কাটে। রাতে মরিয়মের সঙ্গে চলে তার রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা। বেঁচে থাকলে যে ঘরে মন্টু থাকতে পারত, সেখানে শুয়ে। দেবাশিস স্বপ্ন দেখে বিশ্বের গোলাকার মানচিত্রের। এর গা বেয়ে সে ভারত-পাকিস্তান আফগানিস্তান হয়ে ইরানে প্রবেশ করে। মধ্যপ্রাচের তেলের খনি থেকে দুধের নহর বইছে। দেখতে দেখতে জায়গাটা গ্রেসিয়ারে পরিণত হয়। যে পর্বতশৃঙ্গ থেকে সবেগে পানির ঢল নামছে, দেবাশিস তার পাদদেশে। জায়গাটা সবুজ সবুজ, শ্যাওলা পড়া। পিচ্ছিল ভয়ানক। আশিকের কাছে পৌঁছতে হলে তাকে এই পিচ্ছিল, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ওই চূড়ায় উঠতে হবে। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, এ বাবদে মানুষ আর পিঁপড়ায় কোনো ফারাক নেই। সে তখন পিঁপড়া হয়ে ডোঙায় চেপে বসে। পিঁপড়া পিঁপড়া কয়টা নাও/ সাতটা আটটা নয়টা নাও। সব কটি নাও স্রোতের এক ধাক্কায় যাত্রীদের নিয়ে উল্টে যায়। অন্ধকারে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে দেবাশিস। বুঝতে পারে না, সে এখানে কেন। তার শরীরটা মানুষের না পিপড়ার। অনেকটা পথ এগিয়ে জার্মানির দোরগড়া থেকে তাকে ফিরে আসতে হলো! ফের শুয়ে পড়ে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে সেদিকে এগিয়ে যাওয়া নিরর্থক। আশিক খন্দকার স্ত্রী নিয়ে সুখে সংসার করছে। নৌকাডুবির দৃশ্যটা ভাবতে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে ওঠে।
প্রত্যেক রাতে কাঁথা-বালিশ নিয়ে এঘর-ওঘর টানাটানি, মরিয়ম ঘ্যানঘ্যান করে, এত বড় ছেলে একা ঘরে ঘুমাতে পারে না, লোকে কী ভাববে। ঠিকা ঝি রোজ সকালে দেবাশিসকে মরিয়মের ঘর থেকে বেরোতে দেখছে। হাজির বাড়ির দোতলা থেকেও নজর রাখা হচ্ছে, এ বাড়ির ওপর। তবে মরিয়মের বয়স এখন চল্লিশ। ঘাট ছেড়ে নৌকা চলে গেছে বহুদূর, ঘাটে আর ফেরা হবে না। সংসার হলো না, স্বামী হলো না, সন্তান হলো না। সমাজে থেকেও নেই। নিজদেশে পরবাসী। পাড়াপড়শি নিয়ে অযথা ভাবতে যাবে কেন সে? অনেকগুলো বছর ভাবনা-চিন্তা করে খালি খালি সময় নষ্ট করেছে। ছেলেটা মন্টুর ঘরে থাকতে ভয় পাচ্ছে, এখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাক। তার নিজেরও ঘুম দরকার। সকালে দুজনেরই অফিস।
একদিন সকালে গেট খুলে দিতে ঠিকাঝির বদলে সাত-আটজন লোক বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দেবাশিস কলতলায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল। মুখভর্তি পেস্টের ফেনা । তাকে কুলি করারও সময় দেয় না লোকগুলো। এ অবস্থায় পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। কী হচ্ছে কী হচ্ছে, তোমরা কে? এ আমার বাড়ির মেহমান। মরিয়মকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় একজন। গেট দিয়ে মৌলবি নিয়ে ঢোকে হাজির ছেলে। ‘দেখেন তো ভাইজান…’ মরিয়ম বিচার দেওয়ার আগে বিচারক, হাজি সাহেবের ছেলে বলে ওঠে, ‘পাড়ায় বেলাল্লাপনা চলবে না। মৌলবি সাহেব আপনে রেডি হন।’
মরিয়ম কি দুঃস্বপ্ন দেখছে? দশ বছর আগে হলে না-হয় কথা ছিল। এ বয়সে এমন কেলেঙ্কারি! নাকি লোকগুলো ঠাট্টা করছে? এ কেমন মশকরা যে, ঘণ্টা খানেক পর মরিয়ম আর দেবাশিসকে যখন অফিসে যেতে হবে, তার মধ্যে এমন উদ্ভট কাণ্ডকারখানা। হাজির ছেলে বলে, ‘অফিস-টফিস সব বন্ধ। পাড়া চলবে এখন থাইক্কা আমার নির্দেশে।’
বটে! বাপের পর তিনি নেতা হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দশ বছর পর আরেক ১৫ আগস্টের ভোর রাতে হাজি সাহেব এন্তেকাল করেন। তবে তার স্বাভাবিক মৃত্যু। ত্যাজ্যপুত্র ফিরে এসেছে পৈতৃক ভিটায়। সত্তর-একাত্তরে সে ছিল বাঙালির স্বাধিকারের পক্ষে। অষ্টাশিতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কায়েম করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শরিয়া আইনে দেশ চলছে না। অথচ হাজির ত্যাজ্যপুত্র মরিয়মের উঠোনে পা ঠুকে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘এহানে গর্ত খুড়ো। পুইত্তা ফালাও বেলাজ-বেশরম মাগিরে। বিয়েতে রাজি না থাকলে একশ এক পাথর মারা হবে। হুজুর আপনে রেডি?’
পাত্থর মারার ফতোয়া শুনে হাজির বৃদ্ধা স্ত্রী ছুটে আসেন, ‘মা তোর আল্লাহর দোহাই, রাজি হইয়্যা যা। ছেলেডা আমার পাগল। বাপের স্বভাব পাইছে।’