‘কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন না, কেন খালি খালি আমার সময় নষ্ট করছেন?’ অন্য টিকিট বিক্রেতারা যখন ছেলেটিকে আসতে দেখলেই সিট থেকে উঠে যায়, মরিয়ম তাকে বিমানবন্দর শুল্ক, ভ্রমণকরসহ আনুষঙ্গিক হিসেব বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকে কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্নটা করে। ছেলেটি যে জার্মানি যাচ্ছে না, তা সে মানতে রাজি নয়। উত্তেজিত হয়ে রংচটা কাপড়ের ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে সে বের করে ততধিক রংচটা একটা ফটোগ্রাফ। তাতে শপিং সেন্টারের এসক্যালেটরে চড়ে একদল লোক ওপরে উঠছে। ভিড়ের মধ্যের কালো চুল আর বাদামি চামড়ার ছেলেটিই তার বন্ধু। নাম আশিক খন্দকার। আর ছেলেটির নিজের নাম হচ্ছে দেবাশিস দত্ত। আশিক খন্দকার আর দেবাশিস দত্ত ছোটবেলার বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়কার রুমমেট, আর করতও তারা একই রাজনৈতিক দল। ছয় বছর আগে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম নিয়ে আশিক জার্মানি চলে গেছে। দেবাশিস অপেক্ষা করছে ভিসার। ‘ভিসা পেলেই’ দেবাশিস দত্ত বলে, ‘আপনার কাছ থেকে আমি টিকিট কিনব।’ কারণ মরিয়মের মতো এ দুনিয়ায় খুব কম লোকই আছে, যারা অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে বা বুঝতে পারে।
মরিয়মকে ছবিটা দেখানোর পর থেকে দেবাশিসের কথা আর শেষ হয় না। বিষয় একটাই–ছোটবেলার বন্ধু, হলের রুমমেট কমরেড আশিক খন্দকার, যে প্রবাসে গিয়ে প্রাণের বন্ধু দেবাশিসকে ভুলে গেছে।
‘আচ্ছা মরিয়ম, আপনার কী মনে হয়?’
‘কোন ব্যাপারে?’
‘এই যে এক বছর ছয় মাস আট দিন হলো, আশিকের কোনো চিঠিপত্র পাচ্ছি না?’
‘হয়তো ব্যস্ত আছে। অথবা কাজ পাচ্ছে না–বেকার। বিদেশের জীবন তো খুব টাফ।’
‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু!’
‘কিন্তু কী?’
‘ওর মাকে তো নিয়মিত লিখছে।’
‘মাকে তো সবাই লেখে।’ কথাটা বলেই মরিয়মের মনে পড়ে, মনোয়ারা বেগমকে তার বহুদিন চিঠি লেখা হয় না। কফিলউদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন আজ দশ বছর হতে চলল। তার মৃত্যুটা ছিল সবার জন্য স্বস্তির। তিনি জমিজমা বেচে প্রায় শেষ করে গেছেন। আর বছর দুই বাঁচলে ফুলতলির ভিটেবাড়িসহ রায়েরবাজারের বাসাটাও বেহাত হয়ে যেত। শুরুতে বৈধব্য মেনে নিলেও মনোয়ারা বেগম দিনে দিনে কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন। রত্না স্বামীর সঙ্গে থাকে সৌদি আরব। ছন্দা মন্টুর নামের স্কুলটার হেডমিস্ট্রেস। বিয়ের পর সে-ও দূরে চলে যাবে। মা তখন একা। কিন্তু ঢাকা এসে মরিয়মের কাছে তিনি থাকতে নারাজ। সেই আট মাস এখনো তার কাছে। বিভীষিকা। তিনি বোধ হয় তখন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে কথা নেই বার্তা নেই একজন সম্মানিত ব্যক্তির স্ত্রী বাড়ির বাইরে এসে এমন বেলাল্লাপনা করবে কেন? অথবা নিজের স্বামীকে কেউ লিখতে পারে ‘৭৫ সালে মা হবো না!’ সব দোষ মেরির। এমন মেয়ে সে, যে নিজের মায়েরেও নষ্ট করে। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে মনোয়ারা বেগম এখনো দু’গালে থাপ্পড় মেরে তওবা কাটেন। আল্লার দরবারে কেঁদে কেটে আরজি জানান, যেন ছন্দার বিয়ের আগেই তার মরণ হয়। মেরি চিঠি লিখলে তিনি নিজে জবাব না দিয়ে ছন্দাকে বলেন কিছু একটা জানিয়ে দিতে। তাকে বাড়ি যেতে কখনো বলেন না। বীরাঙ্গনা মেয়ের প্রতি এতটাই বিমুখ মা।
‘আশিকের মা কেমন?’
‘কেমন মানে?’
‘মানে ছেলেকে ভালোবাসেন?’
দেবাশিস মরিয়মের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সন্তানকে ভালোবাসে না, এমন মা সারা দুনিয়াতেই বিরল। তার নিজের মা অবশ্য চিঠির পর চিঠি লিখে ইদানীং খুব বিরক্ত করছেন। তার একটাই কথা, হয় নিজের পছন্দে বিয়ে করো, না হয় মেয়ে পছন্দ করতে দাও আমাদের। তবে পাত্রীকে অবশ্য অবশ্য হিন্দু কায়স্থ হতে হবে। দেবাশিস ঠিক করেছে, জীবনে সে কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে না, তা আবার হিন্দু আর কায়স্থ। কিন্তু আশিকের কী হলো?
জার্মানিতে আশিকের বিয়ে করার খবর শুনে দেবাশিস মাঝরাতে রায়েরবাজারের বাসায় হাজির। মরিয়মের চল্লিশ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কেউ বিপদে না। পড়লে এ বাড়িতে মধ্যরাতে ছুটে আসে না। কিন্তু একটা ছেলে কেন আরেকটা ছেলের বিয়ের খবরে ভেঙে পড়বে? তবে চোরের যা উপদ্রব, রাতে পাশের ঘরে থাকার একজন লোক পেয়ে সে খুশিই হয়। মন্টু বেঁচে থাকলে যে ঘরে থাকতে পারত, যেখানে ছোট একটা পরিবার পাঁচ বছর সাবলেট থেকে গত মাসে মরিয়মের সঙ্গে তুচ্ছ কথা-কাটাকাটির পর ঝগড়া বাধিয়ে চলে গেছে, সেই ঘরের তালা খুলতে দেবাশিস ভয়ে পিছিয়ে আসে। ‘মরিয়ম, আপনার পায়ে পড়ি, আজ রাতটা অন্তত আমাকে একা থাকতে বলবেন না! আপনার ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে আমি শুয়ে থাকব, প্লিজ।’
আজ যাচ্ছি, কাল যাব করে মরিয়মের বাড়ি ছেড়ে দেবাশিসের আর যাওয়ার নাম নেই। জার্মানিতে আশিক বিয়ে করে তাকে একদম বেদিশা করে দিয়েছে। চাকরির টাকা তিলে তিলে জমিয়ে তার যখন বার্লিনগামী প্লেনের টিকিট কেনার সামর্থ্য হয়েছে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিয়ের খবরটা এসে পৌঁছায়। এখন টাকা দিয়ে কী করবে সে। চাকরি করাও অর্থহীন। তবে মরিয়মকে কাছ থেকে দেখে দেবাশিসের বিশ্বাস জন্মায় যে, মৃত্যুর অভাবে মানুষ বেঁচে থাকে এবং এভাবে বছরের পর বছর বাঁচা যায়। সে তাই অফিস ছুটির পর মরিয়মের কাছে ফিরে আসে।