’৭২ সালে পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে মরিয়মদের যখন চাকরি দেওয়া হয়েছিল রেডক্রস বিল্ডিংয়ে, সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগে থাকত ওখানে। ‘কী ব্যাপার? কী চান আপনারা?’ জিগ্যেস করলে বলত, ‘আমরা বীরাঙ্গনা দেখতে আইছি।’ মানুষের কৌতূহলে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কিছু মেয়ে তখন চাকরি ছেড়ে দেয়। মাত্র চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বীরাঙ্গনাদের প্রতি! নাকি এ দেশে যে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, তা-ও তারা ভুলে গেছে?
বছর শেষ হওয়ার আগে এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেল। মরিয়মের বেতন দ্বিগুণ হওয়া দূরে থাক এক কানাকড়িও বাড়েনি। একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ বলেই, জামান সাহেব উঠতে-বসতে মনে করিয়ে দেন, একাত্তরের ধর্ষিতাকে তিনি মাসে মাসে বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য কেউ হলে কবেই গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিত!
কাঁচের ঘরে মরিয়মের দিন কাটে, মাস ঘুরে বছর শেষ হয়। তার হাত থেকে টিকিট কিনে মানুষ কোথায় কোথায় চলে যায়। কলেজের বান্ধবী রিনা, সাপলুডু খেলতে খেলতে যুদ্ধের বছর যে প্রেমে পড়েছিল, সে মরিয়মের কাছ থেকে টিকিট নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল কাতার চলে গেল। যাওয়ার সময় গভীর আবেগে বলেছিল, ‘মেরি, তোর জন্য আমার দুঃখ হয়। কত দিন আর আইবুড়ো থাকবি? সারা দিন হাটের মধ্যেই তো বসে থাকিস। দেখেশুনে এইবার একটা বিয়ে কর!’ আবেদ জাহাঙ্গীর বছরে তিন-চারবার আসে পিআইএর টিকিট কিনতে। সঙ্গে বউ-বাচ্চা কখনো শ্বশুর-শাশুড়ি। ম্যানেজারের রুমে বসে তারা কোক-ফানটা খায়। আর ছেলের স্কুলে ভর্তি, মেয়ের দাঁত পড়ে দাঁত ওঠা, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ যে হাজার গুণ পিছিয়ে আছে, করাচির শানশওকত না দেখলে তা বিশ্বাস হয় না–এমন সব খুচরা আলাপ করে চলে যায়। দেশে-বিদেশে মমতাজের চিহ্নমাত্র নেই। বীরাঙ্গনাদের কখনো প্লেনের টিকিট কাটতে দেখা যায় না। পাচারকারীর হাত দিয়ে তারা হয়তো বর্ডার পার হয় রোডে। পুনর্বাসনকেন্দ্রের নেত্রীরা সেমিনার-ওয়ার্কশপে বা প্রবাসী ছেলেমেয়ের আমন্ত্রণে বিদেশ ভ্রমণ করেন। টিকিট নিতে এসে মরিয়মের সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়। তখন একে অন্যকে তারা না-চেনার ভান করে। যেন এভাবে অচেনা। থাকাটাই বীরাঙ্গনা সমস্যার আসল সমাধান। যারা অতিরিক্ত সময় মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকেন, মরিয়ম কাজের ফাঁকে তাদের দিকে চোরা চোখে তাকায়। সবার বয়স বাড়ছে। বয়সের ভারের চেয়েও চোখেমুখে বাড়তি যে ক্লান্তিবোধ, তা হয়তো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমানের খাল কাটার বিপ্লবে শরিক হতে হচ্ছে বলে। বা কোনো ফাংশনে সভাপতিত্ব করতে গেলে এখন যে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়-এ কারণেও হতে পারে। কত চড়া মূল্যে স্বাধীনতা এসেছে-মরিয়মকে দেখে পুনরায় তারা তা স্মরণ করেন। এ থেকে বিবেকদংশন অনুভব করেন কেউ কেউ। তারা তো দিব্যি হেসেখেলে দিন গোজার করছেন, বছরে তিন-চারবার বিদেশ সফর করেন, শিক্ষা বা সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপদেষ্টা হয়েছেন কেউ কেউ, মাঝখান থেকে কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট হলো। তারা উঠে যাওয়ার সময় ফোন নম্বর লেখা এক টুকরো কাগজ মরিয়মের সামনের টেবিলে এমনভাবে ফেলে যান, যেন তাদের এলোমেলো স্বভাবের কারণে ব্যাগ থেকে কাগজটা হঠাৎ পড়ে গেছে। আর চোখ দিয়ে বলেন, ‘মেয়েরা, তোমরা কে কোথায় আছো, কেমন আছো আমাদের জানাও। এর নিরিখে ভবিষ্যতে বিচার হবে, বীরাঙ্গনা পুনর্বাসনে আমরা কতখানি সার্থক হয়েছিলাম।’
মরিয়ম ভুলেও সমাজকর্মীদের ফোন করে না। সে শুধু মতিঝিল, দিলখুশা, ফকিরাপুর এলাকার এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আরেক ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি বদল করে। সর্বত্র সেই কাঁচের ঘর, টাইপরাইটার আর একই ধরনের টেলিফোন সেট। বসদের মধ্যেও তেমন কোনো তারতম্য নেই। একজন ছাড়া সবাই তার কাজের খুঁত ধরে। সেই ব্যতিক্রমধর্মী লোকটা ছিল মাঝবয়সি। বউ পাগল। বাসা থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্বামীকে সে টেলিফোন করত। আর ফোনে না পেলে বাসার কাপড় পরে অফিসে চলে আসাটা ছিল মহিলার পাগলামির অন্যতম লক্ষণ। মরিয়ম হিসাবে ভুল করুক তাতে ক্ষতি নেই, লোকটার একটাই চাওয়া ছিল, ছুটির পর কিছুটা বাড়তি সময় সে যেন অফিসে থাকে। মতিঝিল অফিসপাড়া যখন নির্জন, বেশিরভাগ বিল্ডিং ফাঁকা হয়ে গেছে, তখন সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর দু’পা ফাঁক করে লোকটা বসত তার বেলে মাছের মতো লুলুতে নির্জীব পুরুষাঙ্গটি বের করে। মরিয়ম চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কয়েক বছর পর লোকটি ফুসফুস ক্যানসারে মারা যায়। মৃত্যুশয্যায় বারবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও তার যাওয়া হয়নি। গেছে একেবারে শেষাবস্থায়। মরিয়মই ছিল সেদিনের প্রথম ভিজিটর, যে চাদরের তলা থেকে হাত উঠিয়ে দেখে পালস নেই। উনি মারা গেছেন।
একের পর এক অফিস বদল করতে করতে কখন যে বীরাঙ্গনার লেবাস গা থেকে খসে পড়েছে, মরিয়ম নিজেও জানে না। সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দিয়ে পুনর্বাসনকেন্দ্রের সুনির্দিষ্ট পেশা থেকে সে বহু আগেই সরে এসেছিল। তাকে তাঁতের শাড়ি, লম্বা হাতার ব্লাউজে আর দেখা যেত না। তখন কাঁচের খোপে পায়রার মতো বসে থাকা আর দশটা মেয়ের সে-ও একজন। সাজ-পোশাকও তাদের এক রকম। মাথার চুল হেনা রঞ্জিত, মুখের ভাঁজে ঘন সাদা পাউডারের প্রলেপ, ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক, এক গজ কাপড়েও ব্লাউজ হয় না, মাংস-চর্বির মোটা ভাঁজ শিফন বা জর্জেট শাড়ির স্বচ্ছতা ভেদ করে বাইরে গড়িয়ে পড়ে। মরিয়মদের মুখোমুখি চেয়ারে বসে টিকিট ক্রেতারা সময় নষ্ট করার কোনো কারণ দেখে না। যতই লিপস্টিক রাঙা ঠোঁট নেড়ে মোলায়েম সুরে কথা বলুক, তারা নিশ্চিত মহিলাগুলো বিবাহিত, তাদের স্বামীরা হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী, ছেলেপেলে কলেজে পড়ছে আর মেয়ের যৌতুকের জন্য আগাম সোনার গয়না কেনা হচ্ছে ঈদ বোনাস দিয়ে। একজন ক্রেতা এর মধ্যে ব্যতিক্রম। সে মরিয়মের বীরাঙ্গনা খেতাব আবিষ্কারের আগেই জানতে পারে যে, তার হাই ব্লাডপ্রেসারের স্বামী নেই, ছেলে কলেজে যায় না বা ঈদ বোনাস জমিয়ে সে মেয়ের বিয়ের সোনাদানাও খরিদ করে না। ছেলেটিকে অবশ্য ক্রেতা না বলে ভিজিটর বলাই ভালো। কারণ সে টিকিট কিনতে আসে না, মাসের বেতন পেয়ে টিকিটের দাম জানতে আসে। সব সময় তার না-কেনা প্লেন টিকিটের গন্তব্যস্থল বার্লিন।