আবেদ জাহাঙ্গীর দিনরাত ঘরে লুকিয়ে থাকে আর পকেট থেকে টাকা বের করে। মরিয়ম সেই টাকা দিয়ে বাজার করে কেরোসিনের স্টোভে রান্না চড়ায়। খাওয়ার মতো সুখ কিছুতে নেই। এদিকে পেটটা বড় হচ্ছে। আবেদ মরিয়মের গর্ভপাতের খরচ বহন করে। আর দিন গোনে। অক্টোবর মাসটা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। নভেম্বরের ৩ তারিখ আবেদ গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে কু হয়েছে। শোনা যায়, তিনি আওয়ামী লীগের সাপোর্টার আর ভারতপন্থি। যদিও তার তদারকিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সেদিনই বিমানযোগে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবেদ জাহাঙ্গীর ৪ নভেম্বর বিজয় মিছিল থেকে ফিরে এসে মরিয়মকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মেরি, ইতিহাস থেকে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আমরা সুখী হব।’ পরদিন সেন্ট্রাল জেলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতার খুন হওয়ার বিলম্বিত সংবাদ আসে। দুদিন পর আরো খারাপ খবর। ক্যান্টনমেন্টে সিপাহিরা বিপ্লব করেছে–সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। অথচ খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে তারা ক্ষমতায় বসায় জিয়াউর রহমানকে, যিনি সেপাই নন। দেশে এসব কী হচ্ছে! আবেদ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বিয়ের ব্যাপারে আর উচ্চবাচ্য করলেও ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সে এ বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে শুরু হয় তার বাইরে ঘোরাঘুরি। ‘দেশ স্থিতাবস্থার দিকে যাচ্ছে, মেরি’, একেক দিন ফিরে এসে আবেদ বলে, ‘রক্তারক্তির পর পরিস্থিতি মনে হয় শান্ত হচ্ছে। তবে কখন কী হয় বলা যায় না।’
মরিয়মের বুকে খালি বুটের দুপদাপ আওয়াজ। একদল বেরিয়ে যায় তো আরেক দল ঢোকে। যদিও দেশ নিয়ে সে ভাবে না, আবেদের বিয়ের প্রতিশ্রুতিতেও তার আস্থা নেই, তবে তার অন্নদাতা যেভাবে বাইরে ঘুরাঘুরি করছে, সে যে দিন শেষে ফিরে আসবে ভরসা কী। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এত দিন পর মরিয়ম নিজেকে হঠাৎ এতিম ভাবে। ‘তোরা আমার মা, তোরা বীরাঙ্গনা।’ পুতুলমাস্টারের অনুপস্থিতিতে ঝুলকালি মাখা পরিত্যক্ত পুতুলের দশা হয়েছে ওর। কোনোদিন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় জনসমক্ষে আর নাচা হবে না। ঘরের কোণে পড়ে পড়ে জীবনটা শেষ হবে।
‘মেরি, আজ আমার বাসায় গিয়ে দেখলাম আড়শোলা-চামচিকা নেত্য করছে । দুজন লোক লাগাতে হলো বাড়িটা মানুষ করার জন্যে।’ আবেদের বাড়ি সাফ করার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনতে শুনতে মরিয়ম জনসমক্ষে নাচতে না-পারার দুঃখটুকুও ভুলে যায়। এই লোকটা চলে গেলে তো না খেয়ে মরতে হবে তাকে। পরাজিত সেনাপতিরা সব কি মরে গেল, আরেকটা পাল্টা কু হচ্ছে না কেন? আবেদ তাহলে গা-ঢাকা দিয়ে এ বাড়িতেই থাকত। আর মরিয়ম টাকা হাতে চলে যেত বাজারে–চাল-ডাল তরিতরকারি সওদা করে খুশিতে ডগমগিয়ে ফিরত। দেশ যাক রসাতলে। জীবনে খাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবনা নেই। এ সময়টায় মরিয়ম গায়ে-গতরে এত মোটা হয় যে, ব্লাউজের সেলাই খুলে পরতে হচ্ছিল। যা হোক, সে আরেকটা কুয়ের আশঙ্কার কথা বলতে আবেদ হাসে, ‘না মেরি, তার আর সম্ভাবনা নাই। গতকাল কাকডাকা ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়ে গেছে।’ এবার সে মরিয়মের ওপর বিরক্ত হয়। ‘সারা দিন ঘরে বসে কী করো? খবরের কাগজটাও ঠিকমতো পড়ো না দেখি! জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে বসেছেন। ব্যবসার লাইনঘাট ঠিক করার এখনই সময়।’
ব্যবসার লাইনঘাট করে আবেদ নিজের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। ‘আমার কী হবে, আবেদ?’ মরিয়ম ওর জামা খামচে ধরে, ‘আমার জীবন কাটবে কীভাবে?’ আবেদ বলে, ‘জামা ছাড়ো, মেরি। এমন আচরণ বাজে মেয়েরা করে। চিন্তা কারো না। তোমার চাকরির জন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছি।’
সপ্তাহ খানেক পর একটা ভালো খবর, আরেকটা খারাপ খবর নিয়ে আসে আবেদ। একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে মরিয়মের চাকরি প্রায় হয়েই গেছে বলা যায়। দুই মিনিটের ছোট্ট একটা মৌখিক ইন্টারভিউয়ের পর সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগপত্র দিয়ে দেবে। বেতন শুরুতে বারো শ’। এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেলে পরের বছর বেড়ে দ্বিগুণ হবে।
কতগুলো টাকা মাস শেষে! আহা এজেন্সিটা দাঁড়ায় যেন। মরিয়ম চেয়ার এগিয়ে দিলেও আবেদ বসে না, দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। কীসের যেন তাড়া ওর। চলে যাওয়ার আগে জরুরি ভিত্তিতে শুধু বলে যায়, তিন দিন হয় স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে ফিরেছে পাকিস্তান থেকে। এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আবেদের বাসায় মেরির যাওয়াটাও শোভন দেখাবে না। তার আরেকটা কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যেরকম উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে, তার শ্বশুর শাশুড়ি যে-কোনো সময় এখানে চলে আসতে পারেন। ‘আসলে বাড়ি-ব্যবসা সব তো ওনাদের,’ আবেদ বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘আমি হেফাজতকারী মাত্র।
আবেদ চলে যাওয়ার পর মরিয়ম একবার হাসে আরেকবার কাঁদে। ইতিহাসের প্রহসন আর তার ব্যক্তিগত জীবন মেশিনের ববিনের সুতোর মতো জড়িয়ে গেছে। তবে উপযুপরি হাসি-কান্নার পর তার মনে হয়, বিয়ের চেয়ে চাকরিটাই ভালো। বাহাত্তর সালে মরিয়ম তো চাকরি চাইতেই আবেদের কাছে গিয়েছিল। তাকে সে ঠকায়নি। চার বছর পর ঠিকই জোগাড় করে দিয়েছে। মতিঝিলে অফিস। সুয়িং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে ছিমছাম কক্ষ। মেঝেতে পুরু কার্পেট। গদি-আঁটা সোফা। কাঁচ ঢাকা টেবিল। স্টাফ মাত্র পাঁচজন। মরিয়ম ছাড়া আরেকটা কমবয়সি মেয়ে আছে। তাদের দুজনের কাজ কাঁচের ঘরে বসে টিকিট বিক্রি করা, টেলিফোন ধরা বা টাইপ করা। আবেদের বন্ধু জামান সাহেব এজেন্সির মালিক কাম ম্যানেজার। মরিয়ম একটা ভুল করে তার কাছে দশটা ধমক খায়। অথচ অন্য মেয়েটিকে তিনি বকাঝকা তো করেনই না, প্রায় দিন কাফে ঝিলে বা স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলায় লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যান। লোকটা প্রথম দিন থেকেই মরিয়মের ওপর বিরক্ত। একদিন ক্লায়েন্টকে ভুল করে দশ টাকা বেশি দিয়ে ফেলে মরিয়ম। অঙ্কে লেটার পাওয়া মেয়ে, তার কেন বারবার হিসাবে ভুল হয়? অথবা হিসাবে তার ভুল হবে না তো কার হবে? মাঝখানে গোনা-গুনতির বাইরে এমন সব ঘটনা ঘটে গেছে, একদিন যে লেটার মার্ক পেয়েছিল, সে মেয়ে আর এ মেয়েতে আজ আকাশ-পাতাল ফারাক। তার ওপর যুদ্ধের বছর সার্টিফিকেট, মার্কশিট খোয়া গেছে। চাকুরি ঠিক করার সময় আবেদ এসব কথা ভেঙে বললেও ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার তা আধাআধি বিশ্বাস করেছেন। ধর্ষণের রগরগে চিত্র তার শরীরে উত্তেজনা জোগালেও পরমুহূর্তে জ্বালা ধরায়। সেই জ্বলুনি থেকে। মেয়েটার অন্য গুণাবলিসহ তিনি খারিজ করে দেন প্রমাণহীন অঙ্কে লেটার মার্ক। ‘ফলস–ভুয়া।’ সেদিন জামান সাহেব দশ টাকার জন্য অফিস মাথায় তুললেন। ভালোমানুষ পেয়ে একাত্তরের ধর্ষিতাকে তার ঘাড়ে চাপিয়েছে আবেদ। ‘এ অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব!’ মরিয়মের কান গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু অফিসে সশরীরে একজন বীরাঙ্গনা আছে শুনেও অন্য স্টাফদের ভাবান্তর হয় না। ঘাড় গুঁজে একমনে টকটক শব্দে টাইপ করে যাচ্ছে। নিঃশব্দে হিসাব মেলায় কেউ, আরেকজন কানে ফোন চেপে ব্যক্তিগত আলাপ সেরে নেয় এই ফাঁকে।