: মদের দাম কত?
: এক লিটার দুই শ।
: দুই শ! সোনাগাছি সে কবে গেছিল?
: এইডা বাহাত্তুরে। তারপর সেখান থেইকে এক দালালে নিয়া আসে। তুমি একটা ভালো বংশের মেয়ে, তোমায় বিয়েটিয়ে দিয়ে দিব। আইস্যা ফরিদপুর বেইচ্যে থুয়ে গেল, ফরিদপুর থে আসলো এই জাগায়।
: তারপর?
: তারপর আর কী।
: এত যে মদ খায় বলছেন, ওনার কোনো অসুখ-বিসুখের ঝামেলা নাই?
: ওর কোনো ব্যাধি নাই। লবণ দে ডিরিং করে। দশ দিন যদি আপনি লবণ দিয়া ডিরিং করেন, আপনার লিভার পচে বাইর হয়ে যাবে। রাধারানী হাত দেখে না, তয় কার কী ভবিষ্যৎ সঠিক বুইলে দিতে পারে। নিজের পরমায়ু হেইদিন কইলো, একশ বছর। আপনেগর শুভ কামনায়, মেদেনিপুরের হুজুরের দোয়ায়, বড় পিরের আশীর্বাদে রাধারানী একপ্রকার ভালো আছে।
মুক্তি এনজিওকর্মীর সঙ্গে কুসুমকলির ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসে, তখন বিকাল হয়ে গেছে। আকাশ ঝলমলে পরিষ্কার। পদ্মার ওপর সাদা সাদা মেঘ ডানা মেলে দিয়েছে। ‘ইশ্ আপনের কাপুড়চুপুড় এক্কেরে কাদায় মাখামাখি,’ এনজিওকর্মী চিন্তিত। ‘এই পইরা ঢাকা যাইবেন?’ মুক্তি অপাঙ্গে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। রাধারানীর সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো হতো। কোনো কথাই হলো না–এটা কেমন। অন্যের কথা দিয়ে কি গবেষণার কাজ চলে? ‘আপনে মনে করেন কুসুমকলি সত্য কথা কইছে?’ এনজিওকর্মী ভিড়ভাট্টা ঠেলে মুক্তিকে বেশ্যাপল্লির বাইরে আনতে আনতে বলে, ‘আমি কিন্তু অদের কানাকড়ি বিশ্বাস করি না।’
যে বেশ্যাদের কনডম জোগায়, এর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে, সে কি জানে খদ্দেররা কনডম ব্যবহার করে কি না? বেশ্যারা দিনের বেলায় দুয়ার খোলা রেখেও খদ্দের। বসায়। ইচ্ছা থাকলে খদ্দেরের পরনে কনডম আছে কি নেই–দেখতে বাধা নেই। তা তো তারা করে না। একটা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভর করে বছরের পর বছর বেশ্যাদের কনডম বিলিয়ে যাচ্ছে, রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছে, কেসহিস্ট্রি নিচ্ছে। অথবা বিশ্বাস না করেই এসব করে যাচ্ছে। মুক্তি তাদের বিশ্বাস করবে কি করবে না? রাধারানী যে বীরাঙ্গনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অচিরেই তার একটা সাক্ষাৎকার নিতে আসবে সে।
সেই যাওয়া সম্ভব হয় আরো দুই বছর পর। দৌলতদিয়া থেকে ফিরে মুক্তি যায় মহিলা অধিদপ্তরে বেবির কাছে। ফলত পদ্মার ওপারে বঁড়শি ফেলে সে নিজে ধরা পড়ে। আরেক বিস্তৃত জালে। জায়গাটা ঢাকার পশ্চিম প্রান্তের গিঞ্জি এলাকা রায়েরবাজার। বাঁশঝাড় দূরে থাক, ততদিনে হাস্নাহেনার চিহ্নমাত্রও নেই, এমন একটা বাড়ি। তবে বাড়ির নেমপ্লেট তখনো ঠিক ছিল। আর লোহার ভারী পাল্লাটাও আলিবাবার চিচিং ফাঁক বলার মতো একবারেই খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে মুক্তির হয় সাত চোরের দশা। সেখান থেকে জাল গুটিয়ে বেরোতে বেরোতে পাক্কা দুই বছর। কারণ রায়েরবাজারের। বাড়িটার প্রায় তিন যুগের বাসিন্দা, সেখানে যে কিশোরী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছে, সে গত এক বছর ধরে মুক্তির অপেক্ষায় ছিল।
২৭. বিয়ে
: তোমার বয়স কত, মেয়ে?
: আটাশ।
: তুমি আমার মেয়ের বয়সি।
: আপনার মেয়ে আছে? সে কোথায়?
: নিরুত্তর।
: বললেন না তো আপনার মেয়ে কোথায়!
: নাই। অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খাওয়াতে নষ্ট হয়ে গেছে।
: অহ্। কিন্তু ঘুমের ওষুধে বাচ্চা নষ্ট হয়?
: হয় বোধ হয়। আমার নাম দেখো মরিয়ম, ডাকনাম মেরি। মরিয়ম বা মেরিদের বিয়ে হলে বাচ্চা হয় না। বাচ্চা হলে বিয়ে হয় না।
মমতাজের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ছাড়াও মরিয়মের আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়েটা তাকে ধরেবেঁধে দেয় মহল্লার লোকজন একটা ভুল লোকের সঙ্গে। আবেদ সামিরকে আটকে রেখে কাজি এনে বিয়ে পড়ালে তা-ও কথা ছিল। তাহলে আজ ২৪ বছরের একটা সন্তান থাকত মরিয়মের। তবে বললাম না আমার ভালো নাম মরিয়ম, ডাকনাম মেরি!
মরিয়ম পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টের পর বুঝতে পারে তার পেটে বাচ্চা এসেছে। তখন সে কপর্দকশূন্য। ভাত খাওয়ার টাকা নেই, গর্ভপাত করাবে কী দিয়ে। খিদায় আর দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অন্ধকারে ঘর-বাহির করে। ঠিক ২৫ মার্চের আগের দিনগুলোর মতো–মন্টু বাড়ি চলে গেছে আর মেরি অপেক্ষা করছে আবেদ জাহাঙ্গীরের। চারপাশটাও তখনকার মতো থমথমে। হাজি সাহেবের বাড়ির সামনের ইলেকট্রিক পিলারে বাঁধা নতুন আরেকটা কুকুর সারা রাত চিৎকার করত। দেশে সামরিক শাসন চলছে। মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ। সাড়ে চার বছর পর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবেদ জাহাঙ্গীর কুকুরের চিৎকার উপেক্ষা করে কালো গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। লোহার পাল্লায় টোকা দিয়ে ডাকে–মেরি!
মরিয়ম জেগেই ছিল। সে ভাবে দরজায় টোকা মারছে যে, সে আবেদ সামিরই হবে। কাব্যসাধনার পথ বড় পিছল। তাই পিছলে পিছলে ফের এ বাড়ির দরজায় চলে এসেছে। মরিয়মের আনন্দ হয়, স্বস্তিও লাগে। সে শুয়ে শুয়ে সুখ উপভোগ করে। কিন্তু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যে, তার মনে সুখ নেই। সামান্য বিলম্বে সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। সে অধৈর্য হয়ে বারবার ডাকে–মেরি! মেরি! গলাটা এবার মনে হয় অচেনা। এত রাতে আবার কে আসলো। আমি আবেদ, আবেদ, মেরি! একটানে মরিয়ম গেটের হুড়কো খুলে দিতে যে লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাস্নাহেনার ঝোঁপের পাশে এসে দাঁড়ায়, সে আবেদ সামির নয়, আবেদ জাহাঙ্গীর। এটা কি ১৯৭১ সাল, না ’৭৫? মরিয়ম মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়।