গোলাম মোস্তফা অস্থির বোধ করছিলেন।
সে সময় স্বপ্নের ভেতর মরিয়মের শরীর থেকে রক্ত ঝরা শুরু হয়। তা ধাপে ধাপে। দুধদাঁত তোলা দিয়ে যার শুরু। থুতুর সঙ্গে জিবের নোনা স্বাদ জড়িয়ে থকথকে রক্তের দলা বাইরে আসে। সে মন্টুকে অঞ্জলি মেলে দেখায়। মন্টু নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে। তারপর দাঁতটা ফেলার জন্য ভাইবোন হন্যে হয়ে একটা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে। ইন্দুর ইন্দুর, আমার বোনের বিশ্রী দাঁতটা নিয়া তোমার সুন্দর দাঁতটা দেও। ইন্দুর ইন্দুর–মায়ের চোখে বিস্ময়। মেয়েটার এত তাড়াতাড়ি মাসিক হলো! পেসাবের রাস্ত য় রক্ত! শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণতা ঝরছে। কালো, খয়েরি, গোলাপি থোক থোক রং জমাট বাঁধে পায়জামায়। এটা কী অসুখ, মা? পায়ের কাছে শীত যে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকাতে শুরু করেছে! এ সময় কাপড় ভাঁজ করে তলপেটে গরম সেঁক দিতে হয়। তাতে যন্ত্রণা কমে। হারিকেনের সলতে উসকে দিতে কাঁচের চিমনির ভেতর লম্বা জিহ্বা মেলে আগুন। গনগনে উত্তাপে এক টুকরো কাপড় মায়ের হাতে নিঃশব্দে পোড়ে। রক্তের স্রোত নালা উপচে গেট পেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে পল্টন ময়দানে। জমা হয়। ওখানে বিশাল জনসভা। আবেদ মঞ্চে ওঠে। শ্রোতারা করতালি দেয়। মেরি বাচ্চা প্রসব করে। অবয়বহীন, রক্তপিণ্ড, বাবাছাড়া।
তখন যে বাস্তবতা, তা যুদ্ধের। প্রচণ্ড জোরে অদূরে একটা গোলা ফাটে। জানালার শার্সি ভাঙার ঝনঝন আর্তনাদে মরিয়ম ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তখনো সে চলাচলের শক্তিরহিত, চেতনাহীন। খাটের তলার জমাট অন্ধকার যেন কোল পেতে বসে রয়েছে। আরেকটা বোমা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে অবয়বহীন রক্তপিণ্ড পেছনে ফেলে মরিয়ম অন্ধকারের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ঢাকা তখন জ্বলছে।
০৩. অপারেশন সার্চলাইট
২৫ মার্চের রাতে ঢুকে পড়েছে মুক্তি। তা অন্ধকার-বেহুলার নিচ্ছিদ্র বাসর যেন, মনসার প্রতিশোধের উষ্ণ নিঃশ্বাসে যার মোম-বন্ধ ফুটোটা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেরকম এক সুচ-ছিদ্র পথ দিয়ে কথা বলতে বলতে দুজন অসমবয়সি নারী সেই কালরাতে প্রবেশ করে। বয়স ছাড়াও তাদের মধ্যে মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি। দৃষ্টিভঙ্গিতেও ফারাক বিস্তর। মরিয়ম তখন ছিল খাটের তলায় চেতনাহীন। কয়েকটা বোমার শব্দ ছাড়া সেই রাতের কোনো স্মৃতি নেই। মুক্তি দেখতে চাচ্ছে, মেরি ওরফে মরিয়মের রূপান্তর-পর্বটি, আটাশ বছর আগেকার এক যুদ্ধ যার পূর্বপরিচয় গা থেকে ছাল ছাড়ানোর মতো খসিয়ে গলায় বীরাঙ্গনার বকলেস ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আপন। মহিমায় সেটি কিছুদিন ঢং ঢং বেজেছে।
আটাশ বছর–সিকি শতাব্দীরও অধিক সময়। মুক্তির বয়সও এখন আটাশ। ছাত্র-জনতা যখন গাছের মোটা মোটা ডাল কেটে, পরিত্যক্ত জলের ট্যাংক জড়ো করে। ফুলার রোডের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছিল, সে তখন এসবের একশ গজের ভেতর মেডিক্যাল কলেজের গাইনি ওয়ার্ডে, মায়ের গর্ভের অন্ধকার বিবর ছেড়ে বেরোনোর পাঁয়তারা করছে। পরদিন সকালে তার জন্মের সময় মায়ের পাশে একজন বৃদ্ধা আয়া ছাড়া কেউ ছিল না। লেডি ডাক্তার রোগীর হাতে লেবার পেইনের ড্রিপ লাগিয়ে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগেভাগে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে যান। মুক্তির জন্মদিন যে ২৫ মার্চ না হয়ে ২৬ মার্চ সকাল পর্যন্ত গড়াল, মা বলতেন, এর আসল কারণ ডাক্তারের অনুপস্থিতি। বাকিটা আল্লাহর মর্জি। সেই রাতে প্রসববেদনায় কাতরাতে কাতরাতে ডাক্তারকে অভিশাপ দিলেও মা পরে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তির আব্বাকে করেননি। ২৭ মার্চ সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নিলে বাবা হাসপাতালে আসেন। বাইরে ততক্ষণে নরক গুলজার। মুমূর্ষ রোগীতে হাসপাতালের বেড ভর্তি। বারান্দায়, করিডরে পা ফেলা যায় না। আশপাশের কোয়ার্টার আর বস্তি থেকে বাক্স-পেটরাসহ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মুক্তির আব্বা ভেবেছিলেন, জগন্নাথ হল আর শহিদমিনারের সঙ্গে হাসপাতালটাও বুঝি ২৫ মার্চ রাতে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর সুস্থ-সবল স্ত্রী ও ফুটফুটে নবজাতক দেখে তার চেহারা আরো ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্ত্রী-কন্যা তো বোঝা। মুক্তির মা কেবিনের দরজায় স্বামীকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখলেন। তার ডান পাটা কিছুটা সময় চৌকাঠের বাইরেই ছিল। স্ত্রী যে শুধু চোখ নয়, পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে পরখ করছে, তা বুঝতে পেরে তিনি রুমে ঢুকলেন। মা ও শিশুর দিকে ফিরেও তাকালেন না। থোকা থোকা আঙুর ফলের নকশাদার থার্মোফ্লাস্কটা ছিপি খুলে টয়লেটের বেসিনে খালি করলেন। যাতে বোঝাটা হালকা হয়। আর স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন, বাচ্চাসহ তাকে অনুসরণ করতে। এই মুহূর্তে শহর না ছাড়লে মা ও শিশুর সঙ্গে তাকেও যে বেঘোরে মরতে হবে, যা তিনি চান না–তাও খোলাখুলিই জানালেন।
যুদ্ধটা মায়ের কিছু বাড়তি দুঃখ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য ছিল শুধু কষ্টের, গৌরব ছিল না তাতে। হাসপাতাল থেকে ত্যানা-জড়ানো বাচ্চা কোলে তারা এক কাপড়ে পথে নেমেছিলেন। থেকেছেন অন্যের বাড়ি। বেবিফুডের তখন দারুণ সংকট। হাতে টাকাকড়িও নেই। ফিডারে ভাতের ফ্যান ভরে বাচ্চাকে খাওয়াতে হতো। এর মধ্যে কখন তার দু-দুটি দাঁত গজাল, মুক্তির আব্বা-আম্মা খেয়ালও করেননি। যেদিন দেশ স্বাধীন হয়, তারা হাসপাতালের ত্যানা খুলে মেয়েকে নির্ভয়ে মাটিতে ছেড়ে দেন। মা-বাবা নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে তখন মায়ের দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাড়ি। তারা সোমত্ত গৃহস্থ। উঠোন ঘিরে উঁচু উঁচু ধানের স্তূপ। এসবের ফাঁকে ইঁদুরের গর্ত। পাশে ঝুরঝুরে বালির ঢিবি। মেয়েটা বসার আগেই হামা দিল। মুঠো ভরে ঝুরঝুরে মাটি মুখে পুরে ফেলল কেউ কিছু বোঝার আগেই। মুক্তির আব্বা-আম্মার কাছে হঠাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার মতোই আশ্চর্য ব্যাপার–মেয়ের হামা দেওয়া, বিজয়ের দিনে মুঠো ভরে বাংলার পবিত্র মাটি খেয়ে ফেলা। তারা অনেকদিন পর একসঙ্গে হাততালি দিয়ে হেসে উঠলেন। নয় মাস বয়সের মেয়ের নাম রাখলেন মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের ভালোবাসার একমাত্র স্মারক, যুদ্ধের নামে মেয়ের নাম।