- বইয়ের নামঃ তালাশ
- লেখকের নামঃ শাহীন আখতার
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. জলাভূমির গোলকধাঁধা
তালাশ – শাহীন আখতার
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১০ পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস
TALASH (a novel) by Shaheen Akhtar. Published by Ahmed Mahmudul Haque of Mowla Brothers 39/1 Banglabazar, Dhaka 1100. Cover Designed by Dhruba Esh.
.
উৎসর্গ
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী / মুক্তিযুদ্ধের আড়াল-করা-দরজা দিয়ে যিনি আমাকে অন্দরমহলে ঢুকিয়েছিলেন।
.
সবিশেষ কৃতজ্ঞতা
আসক-এর কথ্য ইতিহাস প্রকল্প
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র
মাহবুব আলমের গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে
এবং
নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি
.
জলাভূমির গোলকধাঁধা
যখন তার জীবনের কথা কেউ জানতে চায় কিংবা সে নিজে যখন স্তব্ধ জলাশয়ের মতো দেহ-মন স্থির রেখে বসে ভাবে, তখন ঘোলাজলের ঘূর্ণাবর্তে কচুরিপানা যেন, মরিয়মের চোখের সামনে বহু বছর আগেকার কয়েকটি মুহূর্ত ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠে। সে মরিয়ম, প্রকারান্তরে মেরি, তখন তার ডান হাত ছিল কাপড় শুকোনোর দড়ি খামচে ধরা, আরেক হাত শরীরের বাঁ পাশ ঘেঁষে ঝুলছে। এক পা আধখানা ইটের ওপর, আরেক পা শূন্যে–তিন ইঞ্চি নিচের মাটির আশ্রয়ের জন্য কাতর। মরিয়ম আধা নিরালম্ব, যেন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মন্টুর কাঁদতে কাঁদতে চলে যাওয়া দেখে। আসলে সে দেখে না। গেট খোলার শব্দে বোঝে যে, মন্টু চলে যাচ্ছে। দড়ি হাতড়ে গামছায় নাক ঝেড়ে, চোখ মুছে সে যখন তাকায়, ততক্ষণে মন্টু–তার ছোট ভাই–গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে সময়টায় মরিয়মের চোখ জলে ঝাপসা ছিল। সে দৃষ্টিহীন ছিল। সে কিছু দেখেনি, শোনেনি। লোহার গেট খোলার ধাতব শব্দটি ছাড়া। এই অদৃষ্ট-অশ্রুত সময়, তার অজান্তেই জঠরে ধারণ করেছিল এক ভয়াল বিস্ফোরক। যার ধূমল উদ্গিরণে মন্টু চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়। মরিয়ম হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর নিজের হয়নি।
সে শুধু যুদ্ধ বলে নয়, যুদ্ধহীন সময়েও নারীর জীবনকে যদি ভাবা হয় চার চাকার গাড়ি, তবে দেহ তার সারথি। নিয়মের বাঁধানো সড়ক থেকে দেহ একচুল সরে গেলে। আস্ত গাড়িটাই গর্তে, আবর্জনায় মুখ থুবড়ে পড়ে। জীবনের পতন ঘটে। নারী পতিত হয়।
মরিয়ম এখন সময়-সময় এ-ও ভাবতে চায় যে, সেদিন মন্টু আর সে ঘরে তালা লাগিয়ে, টিউবওয়েলের জল-কাদায় মাখামাখি ইটের সারির ওপর সতর্ক পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। পেছনে তাদের পরিত্যক্ত বাড়ি আর সামনেই গ্রাম। সে সময় শহরের লোকেরা মিটিং-মিছিল-স্লোগান-গুলিবর্ষণ আর ক্ষমতার পালাবদলের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। শিশুরা ছিল পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। তাদের ড্রয়িং খাতার বটের নিবিড় ছায়া, দুপুরের ভাঙা হাট, সন্ধ্যার স্নিগ্ধ নদীতীর, পালতোলা নৌকার সারি আর জ্যোৎস্নাভাসা তেপান্তরের মাঠ প্রাপ্তবয়স্কদের পথ দেখায়। তাদের অনেকেই বোঁচকা বেঁধে সেসব জায়গায় চলে যায়, অনেকেই যায় না। কেউ কেউ আবার দু-চার দিন পর নিজেদের বালখিল্যতায় বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে। মরিয়ম জোরজবরদস্তি মন্টুকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে শহরের উত্তাল তরঙ্গ আঁকড়ে পড়ে থাকে। তার যত ভয় উঠতি বয়সের ছোট ভাইকে নিয়ে, যে লোহার রড হাতে উতরোল জনতরঙ্গে ইতিহাস রচয়িতাদের একজন হতে চেয়েছিল। মরিয়ম সেই। সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করছে–মন্টু তর্ক জুড়ে দেয়। অনশন করে। মরিয়ম নাছোড়। কথা-কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটির পর সদ্য গজানো দাড়ি-গোঁফের নব্য বিপ্লবী ইতিহাসের প্রসববেদনা নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
মরিয়ম ভাবে, পথে খণ্ড খণ্ড লড়াই যদি বাধে, তা মানুষে মানুষে। তখনো তার ভয় কেবল ভূত আর জিনপরির। মানুষে তখনো সে বিশ্বাস হারায়নি। তাদের হিংস্রতার দৌড়, তার চেতন-অবচেতনে বড়জোর মাথা ফাটাফাটি পর্যন্তই ছিল। মাথায় বাড়ি না-পড়লে আজ চলন্ত বাসেই মন্টুর রাতের এক প্রহর শেষ হবে। তারপর বাড়ি পৌঁছানোর আগে মাইলতিনেক দীর্ঘ, দুই-আড়াই মাইল প্রশস্ত সুন্দরীর জলা। বেলাবেলি পারাপার না হলে পথিক তাতে পথ হারায়, ভূতের আছরে তাদের দাঁতকপাটি লেগে যায়। বর্ষাকালে সওয়ারির সঙ্গে নৌকার মাঝিমাল্লারা থাকে। পথ হারানোর প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলানোর দায় তাদের। বাকি রাত চালক আর সওয়ারি মিলে হাল বায়, হুক্কা টানে, গালগপ্প করে। একসময় জলাভূমির আকাশ ফরসা হয়, পাখপাখালি জেগে ওঠে। শীতের মৌসুমে জলার বুকে আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ। তখন দোজখের নানান চিত্রে বিচিত্র এ জলাভূমি। এরকম এক সময়, একাত্তর সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সুন্দরীর জলায় মন্টু একা। ভাবতেই মেরির সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
এর মাত্র তিন বছর আগে ভাইবোন সুন্দরীর জলায় যে নরক-দর্শন করেছিল, সেটি যেন আজীবন তাদের সঙ্গে চলে। একজনকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরেকজনকে করে ইতিহাসের নিগ্রহের শিকার।