ইয়াকুব প্রস্তাব শুনিয়া হাসিয়া বলিল, ভাবী, আপনার যা দরকার, আমাকে বলেন না কেন?
ভাই, তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। আমার বলতেও লজ্জা লাগে।
কোনো লজ্জা করবেন না। আপনার মুখের হাসি আমি দেখতে চাই।
হাসি কি সহজে আসে!
মন নরম থাকলে আসে বৈকি।
ইয়াকুব দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া আবার মৃদু হাসিল। বৈধব্যের পর দরিয়াবিবির শরীরের তেমন পরিবর্তন ঘটে নাই। চেহারায় আর একটু রুক্ষতার ছাপ লাগিয়াছে। মাত্র। তার ফলে আরো আপ্তরমণীর মতো দেখায় দরিয়াবিবিকে। হঠাৎ কারো চোখে পড়িলে মনে হইবে, যেন কত দেমাকী। কিন্তু দরিয়াবিবি নিজের দিকে চাহিয়া আর কিছু দিশা করিতে পারে না। সে যেন আসেকজানের মতো হইয়া যাইতেছে। ভয়ে বিবর্ণ হইয়া যায় তখন দরিয়াবিবি।
না ভাই। বাইরে থেকে আমি দেখতে অমন। খুব মোলায়েম সুরে দরিয়াবিবি জবাব দিল।
আপনি কষ্ট পান খামাখা। আমাকে বললেই হয়। পনেরো টাকা আমি মাস-মাস দেব। আপনি যাওয়ার সময় তিন মাসের আগাম চেয়ে নেবেন।
আল্লা তোমার মঙ্গল করুক, ভাই। ধনে-দৌলতে তিনি তোমাকে আরো বাড়ান। প্রায় গদগদভাবে দরিয়াবিবি উচ্চারণ করিল।
আপনার দোয়া। তারপর ইয়াকুব আবার নির্লজ্জের মতো তাকাইয়া বলিল, আপনার হাসির দাম লাখ টাকা।
খামাখা লজ্জা দাও, ভাই। আমরা গরিব-দুঃখী, আমাদের আবার হাসি– তার আবার দাম! ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া দরিয়াবিবি বাক্য সমাপ্ত করিল।
ইয়াকুব হাসি ছাড়িয়া বোধহয় আর কিছু মূল্য যাচাইয়ের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। দরিয়াবিবি তার সুযোগ দিল না। ওদিকে হাঁড়ি চড়িয়ে এসেছি, এঁচে গেল, গন্ধ উঠেছে– বলিয়া দরিয়াবিবি রান্নাঘরের দিকে ছুটিল।
ইয়াকুব দরিয়াবিবির ছন্দময় দেহাবয়বের দিকে পশ্চাৎ হইতে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল ও মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
উপবাস এই সংসারে দরিয়াবিবির জন্য অচেনা কিছু নয়। মাঝে মাঝে কোনোদিন ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েরা হাঁড়িতে ভাত থাকা পর্যন্ত আর ক্ষান্ত হয় না। দরিয়াবিবি তখন পরিবেশন করিয়াই খুশি। এই চালাকি মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। তখন আমজাদ লজ্জিত হয়। নঈমা, শরীফা কি-বা বোঝে। আমিরন চাচির কাছে ধরা পড়িলে দরিয়াবিবি খুব বকুনি খায়। একদিন তো চাচি অভিমান করিয়া চলিয়া গেল। বলিয়া গেল, আমরা তো আত্মীয়-স্বজন নই, আমাদের কাছে কেন কিছু বলবেন, বুবু। দুমুঠো চাল কি তরকারী আমজাদকে দিয়ে আনালে কি আমি অসুবিধায় পড়তাম?
কিন্তু দরিয়াবিবি আরো অভিমানী। কোনো কিছু যাঞ্জার বেলা সে যেন মর্মে মর্মে মরিয়া থাকে। নিজের অতীতের দিকে চাহিয়া সে নিজেকেই আর বিশ্বাস করে না। আত্মবিশ্বাস ক্রমশ অন্তর্হিত হইয়াছে। পর্বে অন্নহীন দিন এমন বিষণা বোঝা মনে হইত না।
সেইদিন রাত্রে আমজাদ ও নঈমার জন্য দরিয়াবিবির ঠোঁটে আর ভাত উঠে নাই। সকালে শরীর বড় ঝিমঝিম করিতেছিল। ইয়াকুব আসিল সেই সময়। রাজগীর কমতি নাই তার। ভালো চাল, মাছ শাক সজি, ঘি কিছু বাদ পড়ে নাই তার আড়ম্বর-লীলায়।
দরিয়াবিবি অগত্যা রান্নায় বসিল। তারপর সকলের শেষ খাওয়া। দরিয়াবিবি অভুক্ত শরীরে সেদিন আহার করিল। রীতিমতো আহার। পর্বে অপরের দেওয়া অন্ন সম্মুখে, সে আসেকজানের চল্লিশার খাওয়ার কথা স্মরণ করিত। আজ অতৃপ্তির কোনো বালাই ছিল না। ক্ষুধার্ত জঠর বাকিটুকু পরিবেশন করিল।
দুপুরের পর আমজাদ চন্দ্ৰকাকার কাছে কাজের তল্লাশে গেল। নঈমা শরীকে কোলে করিয়া হাসুবৌর বাড়ি পৌঁছিল। আগের দিন বৌ তাহাদের দাওয়াত করিয়া গিয়াছিল। নূতন ছাঁচিলাউ কাটা হইয়াছে, ক্ষীর রান্না হইবে আজ।
হাতে বহু কাজ। হাঁড়িপাতিল মাজা হয় নাই, গৃহপালিত আগল-পাগলদের খবরদারী বাকি আছে। তবু ভরা খাটে খোয়ারী ধরিয়াছিল। একটু গড়াইয়া উঠিয়া পড়িবে, এই আশায় শোয়ামাত্র কিন্তু দরিয়াবিবির বেশ ঘুম পাইল। অভুক্ত শরীর মাঝে মাঝে যদি ছুটি চায়, তা বিচিত্র কিছু নয়।
বাইরে বৈশাখের উত্তপ্ত দিন। এখানে ঝোঁপ-জঙ্গল ভেদ করিয়া গরম ঝামাল আসে না। তাই ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা মনে হয়। জানালার পাশে কাঁঠাল গাছে ঘুঘু ডাকিতেছিল। একটানা স্বরে। আজ কোনো উদ্বেগ দরিয়াবিবির-ক্লান্ত ভার শরীরে হানা দিতে পারে না। বেশ ঘুম ধরিয়া গেল।
কিন্তু ঘুম তাহার আবার আচমকাই ভাঙিল। দরিয়াবিবি হঠাৎ অনুভব করে, কার যেন গভীর আলিঙ্গনে সে একদম নিষ্পিষ্ট। চোখ খুলিয়া দেখিল, ইয়াকুব। দরিয়াবিবি প্রথমে ঘরের খোলা টাটির দিকে চাহিল। বাঁশের দরজা খোলা ছিল, এখন বন্ধ। দরিয়াবিবির মনে হয় হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছে তার সমস্ত শরীর। আর একজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস শুধু নাকে লাগিতেছে। একবার উঠিতে গেল সে। কিন্তু দুর্দান্ত দৃঢ়তায় আর একজন তাহাকে সাপটিয়া বাঁধিতেছিল। নিস্তেজ নিথরতায় দরিয়াবিবি চুপ করিয়া রহিল। আর চোখ খুলিল। সে যেন অন্ধ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত পৃথিবী তাহার নিকট নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে আবৃত।
বাহিরে পুত্র-হারা ঘুঘু জননী এক মনে শুধু ডাকিয়া খুন হইতে লাগিল।
.
৩৭.
সন্ধ্যায় আহারের সময় আমজাদ বলিল, মা, ইয়াকুব চাচা হঠাৎ চলে গেল। কাল তো যাবার কথা।
দরিয়াবিবি প্রথমে জবাব দিল না। পরে হঠাৎ আগুন হইয়া বলিল, খাচ্ছিস, খা। তোর আবার এত কথা কেন? আমজাদ মার দিকে একবার চাহিয়া আবার আহারে মনোনিবেশ করিল।