- বইয়ের নামঃ জননী
- লেখকের নামঃ শওকত ওসমান
- প্রকাশনাঃ ময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. প্রহর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ
আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলি চাষী।
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এখানেই সরলরেখায় গ্রাম-গ্রামান্তরের দিকে চলিয়া গিয়াছে। ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই সরু গ্রামের পথ। কয়েক মিনিট হাঁটিলেই প্রথমে পড়ে আলী আজহার খাঁর বস্তি। সম্মুখে একটি বড় দহলিজ। বাম পাশে ছোট ডোবা। পূর্বধারে প্রতিবেশীদের খড়োঘর। কয়েকখানা কলাগাছের নীলাভ পাতা চালের ভিতর উঁকি মারিতেছে। উঠানে কেহ বোধহয় কলাগাছ রোপণ করিয়াছিল। আসন্ন বৈকালে এই অঞ্চল ভয়াবহ ঠেকে। জনবিরল গ্রাম। অরণ্যানীর ছায়াভাস আগাছার জঙ্গলে সর্বক্ষণ কালো দাগ আঁকিয়া রাখে। বর্ষাকালে পথঘাট দুর্গম। ঝড়ে পাতাপুতি, হেলানো বাঁশবনের কঞ্চি আর কাদায় রাস্তা চলা বিপজ্জনক। বেতবনের ঝোপ-নিষ্ক্রান্ত বিষাক্ত সাপ দিনেও আশেপাশে বিচরণ করে।
আলী আজহার খাঁকেও এই পথে হাঁটিতে হয়। লাঙল কাঁধে হালের বলদ দুটিকে ভর্ৎসনার আহ্বান দিতে দিতে বহুদিন দেখা গিয়াছে সে আনমনে পথ হাঁটিতেছে।
আজ এই খাঁ-পরিবারের কোনো ছেলেকে দেখিয়া বুঝা মুশকিল, একশ বছর আগে তাহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙালি ছিলেন না। আলী আজহার খাঁর চেহারা পাট্টা জোয়ানের। রঙ ফর্সা। শুধু এই অবয়বে অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে সে বৈশিষ্ট্য-পৃথক। নচেৎ কিষাণ-পল্লীর ভিতর তার অন্য কোনো মাহাত্ম্য-গুণ নাই, যার জন্য শতজনের মধ্যে সে প্রথমে কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে।
আলী আজহার খাঁ জানে, তার পূর্বপুরুষেরা এই গাঁয়ের বাসিন্দা ছিলেন না।
দহলিজের ডোবার পাশ দিয়ে আর একটা সরু সড়ক কিছুদূর সোজাসুজি পশ্চিমে জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার মধ্যে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছে। ভিটার তিনদিকে ঘন ফণীমনসার কাঁটার ঝোঁপ। আর একপাশে বেউড় বাঁশ আর বেত এবং অন্যান্য আগাছার রাজত্ব। ভিটার আশেপাশেও বহু খণ্ড আর চুর্ণ ইট পড়িয়া রহিয়াছে। অতীতে এখানে ইমারত ছিল তার প্রমাণ ইট ছাড়া আরো বহু উপাদান আছে, গ্রামের জনপ্রবাদ-ইতিহাসকে নানা রঙে যা সঞ্জীবিত রাখে। দুপুরে সাপের ভয়ে এইদিকে কেউ আসে না। খাঁ-পরিবারের লোকেরা অবশ্য ভয় করে না। জ্বালানির জন্য এই ভিটার ঝোঁপঝাড় শুধু তাহারাই সাহস করিয়া কাটে। ইহা আর কাহারো সহ্য হয় না। কোনো-না-কোনো বিপদ জড়াইয়া আসে এই রাজ্যের জ্বালানির সঙ্গে। মহেশডাঙার শেখেরা একবার একটি চারা অশথগাছ তুলিয়া তাহাদের উঠানে রোপণ করিয়াছিল। চার বছর পর সেই বাড়ির মুরুব্বি নাকি বজ্রাঘাতে উঠানেই মারা যায়। আরো বহু দুর্ঘটনার জন্য খাঁ-পরিবার এই রাজ্যচ্যুতির আশঙ্কা হইতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ভিটার চাতালের গাছপালা তাহারাই ভোগ করে।
ভিটা সংলগ্ন একটি বড় পুষ্করিণী ছিল। বর্তমানে মজা পুকুর মাত্র। পাড়ে কাঁটাবন দুর্ভেদ্য। কয়েক বছর আগেও পদ্মপাতায় পুকুরের সামান্য পানিও দেখা যাইত না। বর্তমানে জীবনের দ্বিতীয় নামও অন্তর্হিত হইয়াছে। খাঁর পুকুরে পীরের কুমির ছিল। সেই প্রবাদ এখনও মুখে মুখে ফেরে।
আলী আজহার খাঁর নাম পিতৃ-প্রদত্ত। নামের মাহাত্ম্য তারা বোঝে। আজহার খাঁর পিতা আলী আসগর খা সামান্য লেখাপড়া জানিতেন। তবে পারসিতে তার দখলের যথেষ্ট সুনাম ছিল এই অঞ্চলে। আজহার খাঁ পিতার এই মহিমা-গুণ কিছুই পায় নাই। তার পিতামহ আলী আমজাদ খাঁ নাকি আরো পারদর্শী পণ্ডিত ছিলেন। সওয়া-শ বছর আগে তাঁর প্রপিতামহ মজহার খাঁ এই গ্রামে অকস্মাৎ নাজেল হইয়াছিলেন। এই বংশের তিনিই আদি-পিতা। শান্-শওকত দবৃদবা তাঁর আমলেই ছিল। তারপর স্ব-পরিবারের অধঃপতনের যুগ। ইমারতের আকাশ হইতে আলী মজহার খাঁর বংশধরেরা আজ খড়োঘরের মাটিতে নামিয়াছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সব নিরুদ্দিষ্ট। মাটির কাছাকাছি আসিয়া আলী আজহার খাঁও অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ইতিহাসের স্বপ্ন তার কাছে ধূসর মরীচিৎকার মতো মাঝে মাঝে জীবন-সংগ্রামের নিরাশাক্লিষ্ট ক্ষুব্ধ মুহূর্তে ভাসিয়া আসে বৈকি!
আলী আজহার খাঁর রক্তে পূর্বপুরুষদের যাযাবর নেশা আছে যেন। আবাদের পর আর কোনো কাজ থাকে না। ফসলের অনিশ্চয়তা নীড়ে কোনো মোহ জাগায় না। আজহার তাই রাজমিস্ত্রির কাজও শিখিয়াছিল। তখন সে দূরে ভিন গাঁয়ের দিকে কন্নিক আর সূতা হাতে চলিয়া যায়। এমনি আজহার খাঁ নিরীহ। প্রতিবেশীদের কাছে সে সাধু ও সজ্জন নামে খ্যাত। আলী মজহার খাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষের একটি যুবক নির্জীবতার জন্য নিরীহ এমন অপবাদ দেড়শ বছর আগে কেহ মুখে উচ্চারণেও সাহস করিত না। কর্মময় জীবনের ক্ষেত্রে, সাংসারিকতার নাগপাশ, দাসত্বের বেড়ি, পলিমাটির অদৃশ্য যোজনাশক্তি, কোথায় কিরূপ এখানে কাজ করিয়াছে, কেহ তার ইতিহাস জানে না।
আলী মজহার খাঁর রক্তেও কি এমন ধরা-দেওয়া নির্জীবতার ধারা ছিল?
অতীতের সঙ্গীত-তরঙ্গ কলধ্বনি তুলে। সব সেখানে একাকার হইয়া যায়। বিরাট সমুদ্র-স্তনিত পৃথিবী, স্থাবর-জঙ্গমের গতিশীল যাত্রাধ্বনি, শত-মন্বন্তরের পদক্ষেপ, মানুষ আর মানবীর কীর্তিত মিছিল, কালের প্রান্তর-মর্মর। তবুও ভবিষ্যৎ দিচক্রবালের মতো মানুষের নয়নপটের সম্মুখে আঁকা। তাইত এই পথ চলা– যে-পথের বার্তা অতীত বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎ, ত্রিকালের সমাহারে অপূর্ব সমারোহ-ধ্বনি ভাঙা-গড়ার খঞ্জনিতে বাজায়।