০১-০৫. প্রহর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ

আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলি চাষী।

গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এখানেই সরলরেখায় গ্রাম-গ্রামান্তরের দিকে চলিয়া গিয়াছে। ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই সরু গ্রামের পথ। কয়েক মিনিট হাঁটিলেই প্রথমে পড়ে আলী আজহার খাঁর বস্তি। সম্মুখে একটি বড় দহলিজ। বাম পাশে ছোট ডোবা। পূর্বধারে প্রতিবেশীদের খড়োঘর। কয়েকখানা কলাগাছের নীলাভ পাতা চালের ভিতর উঁকি মারিতেছে। উঠানে কেহ বোধহয় কলাগাছ রোপণ করিয়াছিল। আসন্ন বৈকালে এই অঞ্চল ভয়াবহ ঠেকে। জনবিরল গ্রাম। অরণ্যানীর ছায়াভাস আগাছার জঙ্গলে সর্বক্ষণ কালো দাগ আঁকিয়া রাখে। বর্ষাকালে পথঘাট দুর্গম। ঝড়ে পাতাপুতি, হেলানো বাঁশবনের কঞ্চি আর কাদায় রাস্তা চলা বিপজ্জনক। বেতবনের ঝোপ-নিষ্ক্রান্ত বিষাক্ত সাপ দিনেও আশেপাশে বিচরণ করে।

আলী আজহার খাঁকেও এই পথে হাঁটিতে হয়। লাঙল কাঁধে হালের বলদ দুটিকে ভর্ৎসনার আহ্বান দিতে দিতে বহুদিন দেখা গিয়াছে সে আনমনে পথ হাঁটিতেছে।

আজ এই খাঁ-পরিবারের কোনো ছেলেকে দেখিয়া বুঝা মুশকিল, একশ বছর আগে তাহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙালি ছিলেন না। আলী আজহার খাঁর চেহারা পাট্টা জোয়ানের। রঙ ফর্সা। শুধু এই অবয়বে অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে সে বৈশিষ্ট্য-পৃথক। নচেৎ কিষাণ-পল্লীর ভিতর তার অন্য কোনো মাহাত্ম্য-গুণ নাই, যার জন্য শতজনের মধ্যে সে প্রথমে কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে।

আলী আজহার খাঁ জানে, তার পূর্বপুরুষেরা এই গাঁয়ের বাসিন্দা ছিলেন না।

দহলিজের ডোবার পাশ দিয়ে আর একটা সরু সড়ক কিছুদূর সোজাসুজি পশ্চিমে জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার মধ্যে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছে। ভিটার তিনদিকে ঘন ফণীমনসার কাঁটার ঝোঁপ। আর একপাশে বেউড় বাঁশ আর বেত এবং অন্যান্য আগাছার রাজত্ব। ভিটার আশেপাশেও বহু খণ্ড আর চুর্ণ ইট পড়িয়া রহিয়াছে। অতীতে এখানে ইমারত ছিল তার প্রমাণ ইট ছাড়া আরো বহু উপাদান আছে, গ্রামের জনপ্রবাদ-ইতিহাসকে নানা রঙে যা সঞ্জীবিত রাখে। দুপুরে সাপের ভয়ে এইদিকে কেউ আসে না। খাঁ-পরিবারের লোকেরা অবশ্য ভয় করে না। জ্বালানির জন্য এই ভিটার ঝোঁপঝাড় শুধু তাহারাই সাহস করিয়া কাটে। ইহা আর কাহারো সহ্য হয় না। কোনো-না-কোনো বিপদ জড়াইয়া আসে এই রাজ্যের জ্বালানির সঙ্গে। মহেশডাঙার শেখেরা একবার একটি চারা অশথগাছ তুলিয়া তাহাদের উঠানে রোপণ করিয়াছিল। চার বছর পর সেই বাড়ির মুরুব্বি নাকি বজ্রাঘাতে উঠানেই মারা যায়। আরো বহু দুর্ঘটনার জন্য খাঁ-পরিবার এই রাজ্যচ্যুতির আশঙ্কা হইতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ভিটার চাতালের গাছপালা তাহারাই ভোগ করে।

ভিটা সংলগ্ন একটি বড় পুষ্করিণী ছিল। বর্তমানে মজা পুকুর মাত্র। পাড়ে কাঁটাবন দুর্ভেদ্য। কয়েক বছর আগেও পদ্মপাতায় পুকুরের সামান্য পানিও দেখা যাইত না। বর্তমানে জীবনের দ্বিতীয় নামও অন্তর্হিত হইয়াছে। খাঁর পুকুরে পীরের কুমির ছিল। সেই প্রবাদ এখনও মুখে মুখে ফেরে।

আলী আজহার খাঁর নাম পিতৃ-প্রদত্ত। নামের মাহাত্ম্য তারা বোঝে। আজহার খাঁর পিতা আলী আসগর খা সামান্য লেখাপড়া জানিতেন। তবে পারসিতে তার দখলের যথেষ্ট সুনাম ছিল এই অঞ্চলে। আজহার খাঁ পিতার এই মহিমা-গুণ কিছুই পায় নাই। তার পিতামহ আলী আমজাদ খাঁ নাকি আরো পারদর্শী পণ্ডিত ছিলেন। সওয়া-শ বছর আগে তাঁর প্রপিতামহ মজহার খাঁ এই গ্রামে অকস্মাৎ নাজেল হইয়াছিলেন। এই বংশের তিনিই আদি-পিতা। শান্-শওকত দবৃদবা তাঁর আমলেই ছিল। তারপর স্ব-পরিবারের অধঃপতনের যুগ। ইমারতের আকাশ হইতে আলী মজহার খাঁর বংশধরেরা আজ খড়োঘরের মাটিতে নামিয়াছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সব নিরুদ্দিষ্ট। মাটির কাছাকাছি আসিয়া আলী আজহার খাঁও অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ইতিহাসের স্বপ্ন তার কাছে ধূসর মরীচিৎকার মতো মাঝে মাঝে জীবন-সংগ্রামের নিরাশাক্লিষ্ট ক্ষুব্ধ মুহূর্তে ভাসিয়া আসে বৈকি!

আলী আজহার খাঁর রক্তে পূর্বপুরুষদের যাযাবর নেশা আছে যেন। আবাদের পর আর কোনো কাজ থাকে না। ফসলের অনিশ্চয়তা নীড়ে কোনো মোহ জাগায় না। আজহার তাই রাজমিস্ত্রির কাজও শিখিয়াছিল। তখন সে দূরে ভিন গাঁয়ের দিকে কন্নিক আর সূতা হাতে চলিয়া যায়। এমনি আজহার খাঁ নিরীহ। প্রতিবেশীদের কাছে সে সাধু ও সজ্জন নামে খ্যাত। আলী মজহার খাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষের একটি যুবক নির্জীবতার জন্য নিরীহ এমন অপবাদ দেড়শ বছর আগে কেহ মুখে উচ্চারণেও সাহস করিত না। কর্মময় জীবনের ক্ষেত্রে, সাংসারিকতার নাগপাশ, দাসত্বের বেড়ি, পলিমাটির অদৃশ্য যোজনাশক্তি, কোথায় কিরূপ এখানে কাজ করিয়াছে, কেহ তার ইতিহাস জানে না।

আলী মজহার খাঁর রক্তেও কি এমন ধরা-দেওয়া নির্জীবতার ধারা ছিল?

অতীতের সঙ্গীত-তরঙ্গ কলধ্বনি তুলে। সব সেখানে একাকার হইয়া যায়। বিরাট সমুদ্র-স্তনিত পৃথিবী, স্থাবর-জঙ্গমের গতিশীল যাত্রাধ্বনি, শত-মন্বন্তরের পদক্ষেপ, মানুষ আর মানবীর কীর্তিত মিছিল, কালের প্রান্তর-মর্মর। তবুও ভবিষ্যৎ দিচক্রবালের মতো মানুষের নয়নপটের সম্মুখে আঁকা। তাইত এই পথ চলা– যে-পথের বার্তা অতীত বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎ, ত্রিকালের সমাহারে অপূর্ব সমারোহ-ধ্বনি ভাঙা-গড়ার খঞ্জনিতে বাজায়।

আলী আজহার খাঁর সাতবছর বয়সের পুত্র আলী আমজাদ খাঁও হারানো বাছুর খুঁজিতে আসিয়া স্তিমিত বৈকালে তারই হানা-রেশ পাঁজরের গলিতটে বারবার যেন শুনিতে পায়।

গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই রাজপথ। শেরশার বিজয় বাহিনীর যাত্রাপথ। পাঠান সম্রাট আর নবাবদের ঐশ্বর্য-দ্রষ্টা ধূলি সড়ক। সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ আত্মগোপন করিতেছে। পত্রপুষ্পের আবরণে দিনের আলো বাধাপ্রাপ্ত। অন্ধকার অবোধ বালকের মুখেও ছায়া ফেলে। দূরে মলিন আকাশ আর দেখা যায় না। শীতের হিমাচ্ছিন্ন রাত্রির আবাহনী শিরীষের ডালে বাজিয়ে থাকে।

এই রাজপথ বাহিয়া সওয়া-শ বছর আগে আলী মজহার খা পনেরো জন সহচর, আরো কয়েকটা ঘোড়া লইয়া মহেশডাঙার অন্ধকারে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। চারিদিকে গাছপালার অরণ্য। ইংরেজ শাসকদের অস্ত্র-বর্ম-সজ্জিত কোনো প্রহরী অন্তত কিছুদিন তাহাদের সন্ধান পাইবে না। বিরাট কর্তব্যের অনুশাসন চতুর্দিকে, মজহার খা বোর শ্লথ করিয়াছিলেন ঘোড়ার। কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে অশ্বপৃষ্ঠে। শুষ্ক রুটি ও ছোট মশকের পানি মাত্র আহার। বিহারের কাছে কোম্পানির একদল সিপাহী তাহাদের পশ্চাৎ অনুসরণ করিয়াছিল। মজহার খা ভীরু নন। পাঠানের সন্তান বুদিল হয় না কোনোদিন। অনেক সময় আত্মগোপন নিজেকে বিরাটরূপে বিকাশেরই প্রাথমিক উপায় মাত্র। মজহার খাঁ তাই সেদিন পনেরো জন অনুচরসহ বহু জনপদ ও দুর্গম পথে পাড়ি দিয়াছিলেন। বাংলা মুলুকে হয়ত বহুদিন কাটাইতে হইবে। বাংলার মুসলমানের সঙ্গে তাঁর অনেক বুঝাপড়া আছে।

অন্ধকার রাত্রি, শীতের হিম-হাওয়া পথে পথে বাজিয়া যায়। ঘোড়াগুলিকে ঘাস খাইতে দিয়া মজহার খাঁ ও তাঁর সঙ্গীরা রুটি সেঁকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রতি কার্যে অসম্ভব রকম ক্ষিপ্রতা। আহার সমাপনান্তে মজহার খা একবার ঘোড়র উপর উঠিয়াছিলেন,আবার অবতরণ করিয়াছিলেন তখনই।

মজহার খাঁ বলিয়াছিলেন, ভাইয়ো, ঠৈরকে, মাই আতা। হাঁটু অবধি নাতিদীর্ঘ পাজামা পরিধানে, কোমরে তলোয়ার, বাম বাজুর দিকে গাদা-বন্দুক। মজহার খা মহেশডাঙার অন্ধকারে একাকী ঝাপাইয়া পড়িয়াছিলেন।

সঙ্গী দু-একজন অনুগমন করিতে চাহিল, তিনি বাধা দিলেন। আসহাব, মাই খোদ্ জানে-ওয়ালা।

মহেশডাঙার এইসব অঞ্চল তখন জনবিরল। মুসলমান পরিবার নিতান্ত নগণ্য। আলী মজহার খাঁকে অনিশ্চয়তা বোধ হয়, সেদিন দৈব কিছু সাহায্য করিয়াছিল নচেৎ আকস্মিকভাবে তিনি আরিফউদ্দীন মুনশীর বাড়িতে প্রথমে পৌঁছিয়াছিলেন কিরূপে?

গ্রামে পশ্চিম-দেশীয় ব্যক্তি মাঝে মাঝে আসে। অগাধ রাত্রে মুনশী আরিফউদ্দিন দহলিজে আসিয়া বিস্মিত হইলেন। জনবিরল অঞ্চলে দস্যুর প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিক। মুনশী সাহেব নবাব দপ্তরে বহুদিন কাজ করিয়াছেন। পারসি জবানেই মজহার খাঁর পরিচয় গ্রহণ শুরু হইয়াছিল। এক প্রহরের মধ্যে দুই বিদেশী মুসলমানে অন্তরঙ্গতা আরম্ভ হইয়াছিল। একজন যুবক আর একজন বৃদ্ধ। মুনশী সাহেবের যুবক-পুত্র শরিফউদ্দিন পিতার নিকট উপস্থিত হইলেন।

রাত্রির মধ্যে আয়োজন চলিতেছে। কিসের আয়োজন?

মুনশী সাহেব বলিলেন, মেরা এহি এক ল্যাড়াকা। ওয়াস্তে দীন-কে। খোদাকে রাহ্ পর। আহ্বানে কি সেই তৃষ্ণা মিটিয়া গেল? একটি নারীর কাঁকনের কনকন ধ্বনির স্রোতে কি জিন্দানের সহস্র কোটি জিঞ্জিরের আওয়াজ স্তব্ধ করিয়া দিল?

নীড়ের বন্ধন স্বীকার করলেও আলী মজহার খর দিগন্তের পিপাসা কোনোদিন নিবৃত্ত হয় নাই। সে অন্য কাহিনী। ইংরেজ সিপাহীর সঙ্গে আবার তাঁহার মোকাবিলা ঘটে। শহীদি কবরগাহেই তাঁর শেষ সমাধি খোদিত হইয়াছিল।

.

আলী মজহার খাঁর অধঃস্তন পঞ্চম পুরুষ আলী আমজাদ খাঁ বাছুর খুঁজিতে আসিয়া শহীদি কবরগাহের সম্মুখে হঠাৎ দাঁড়াইল। আনমনা সে এই পথে চলিয়া আসিয়াছে।

চারদিকে আগাছা আর খেজুরের জঙ্গল। আলী মজহার খাঁ এইখানে শুইয়া আছেন। তারই পূর্বপুরুষ। রক্তে ছিল যার সিংহের বিক্রম, বুলেটের আঘাতে তাঁর শহীদ রুহ, এইখানে বিশ্রাম লাভ করিতেছে। আলী আমজাদ খাঁ তা জানে না। আলী মজহার খার রুহ কোনোদিন মাগফেরাত প্রার্থী নয়। গিধড় অধঃস্তন বংশধরদের ধিক্কার ও অভিশাপ দেওয়ার জন্য অন্তত তার মাগফেরাতের কোনো প্রয়োজন হইবে না।

.

০১.

প্রহর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ।

উঠানের উপরে রান্নাঘর। উপরে কোনো খড়ের ছাউনি নাই। কয়েকটি বাঁশের খুঁটি ও কঞ্চির ছায়ারেখা আগুনের ঝলকে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। আরো একটি রান্নাঘর আছে উঠানের দক্ষিণে। গ্রীষ্মের দিনে কুঁড়েঘরের ভিতর রান্নার কাজ কষ্টকর। আজহার খাঁ তাই দরিয়াবিবির জন্য উঠানের উপর চালহীন রান্নাঘর তৈরি করিয়াছিল। কয়েকদিন আগেকার ঝড়ে তালপাতা উড়িয়া গিয়াছে। শুধু চালার ফ্রেমটি এখন অবশিষ্ট।

দরিয়াবিবি চুলায় জ্বাল দিতেছিল। হাঁড়ির ভিতর চিড়চিড় শব্দ ওঠে। দমকা বাতাসে আগুনের হলকা বাহির হইয়া আসে। দরিয়াবিবির মুখ দেখা যায়। কপালের চারিপাশ ঘামিয়া উঠিয়াছে।

আমজাদ মার পাশে বসিয়া রান্না দেখিতেছিল। অন্যদিকে খড় কুঁচকাইতেছিল আজহার খাঁ।

আমজাদ।

কি আব্বা?

এক আঁটি খড় বঁটির মুখে রাখিয়া আজহার একবার কপালের ঘাম মুছিবার চেষ্টা করিল।

অনেক দূর খুঁজেছি, আব্বা। ভারি বজ্জাত। গাইও তেমনি। বাছুর হারায়।

কঞ্চির ঝুড়ির ভিতর আজহার কুঁচানো খড় রাখিতেছিল। প্রায় পূর্ণ ঝুড়িটি দমকা। বাতাসে হঠাৎ আড় হইয়া গেল। কুঁচো খড় হাওয়ায় উড়িতে থাকে। আজহার বঁটি ছাড়িয়া বলে, আমু, ধর বাবা ধর।

আমজাদের কচি মুঠি নাগাল পায় না। দরিয়াবিবি স্বামীর সাহায্যে অগ্রসর হয়। তার বয়স তিরিশের কাছাকাছি। দোহারা বাঁধন শরীরের। গোলগাল মুখটি গাম্ভীর্যে টইটুম্বুর।

আমজাদ কুঁচো খড়ের পিছনে এদিক-ওদিক দৌড়ায়।

ঐ দ্যাখো আব্বা, উড়ে যাচ্ছে।

খড়কুটো বাতাসের বেগে উপরে উঠতে থাকে।

দরিয়াবিবি ভারী শ্রান্ত হইয়া বলে, কী ছিরি তোমার কাজের।

দরিয়াবিবি স্বামীর দিকে তাকায়।

আজহার শান্তকণ্ঠে জবাব দিল, আচমকা হয়ে গেল। আর কোনোদিন এমনটা হয়েছে?

বাতাসে দরিয়াবিবির চুল এলোমেলো, হঠাৎ একমুঠো খড় হাতে সে ডাকে, আমু, এদিকে আয় তো বাবা, আমার চোখ কী পড়েছে দ্যাখ।

দরিয়াবিবি ততক্ষণ বসিয়া পড়িয়াছে। আমজাদ মার কাছে ছুটিয়া যায়।

এই খড়গুলো ঝুড়ির ভিতর রেখে আয়।

আমজাদ এক মিনিটে মার আদেশ পালন করিল।

ভারি করকর করছে চোখটা।

দরিয়াবিবি কাপড়ের খুঁটে মুখের ভাপ দিতে থাকে।

ভালো হল, মা?

দাঁড়া বাবা, খামাখা বকাসনি।

আমজাদ ফালি লুঙি পরিয়াছিল। মার দেখাদেখি সে-ও লুঙির খোঁট মুখের ভিতর ঢুকায়।

তরকারিটা বুঝি পুড়ে গেল!

দরিয়াবিবি এবার লাফ দিয়া চুলার কাছে পৌঁছাইল।

আমু, একটু পানি দে, বাবা।

আমজাদের সাহায্য চাওয়া বাতুলতা।

দরিয়াবিবি দৌড়িয়া ঘরের দিকে ছোটে। কলস তো সেখানেই।

এক মালসা পানি হাঁড়ির মধ্যে ঢালিতে ঢালিতে বলে, বাপবেটায় এক হুজুগ নিয়ে এলো। চোখটা এখনও করকর করছে।

আজহার একটি খড়ের বিড়ার উপর বসিয়াছিল। হাতে নারকেলি হুকা।

দরিয়াবিবি, চুলোতে আগুন পড়েছে?

চুলোর মুখে বসিয়া দরিয়াবিবি এলোচুল বিন্যস্ত করিতেছিল।

আগুন পড়বে না? কত সিঁদরে কাঠ জ্বালাচ্ছি।

আজহার দরিয়াবিবির দিকে তাকায়। তার ফরসা রং মুখে এখনও শ্রান্তির ছায়া আঁকা। স্বামীর উৎসাহ নিভিয়া আসে। ককেটা আজহার খাঁমোখা মাটির উপর ঘুরাইতে থাকে।

তুমি জানো, পাতার আগুন। এতে আবার ভালো আগুন পড়ে? কাঠ-পোড়ানো। নসিবে লিখেছে আল্লা?

ঐ আগুন-ই দাও।

তা দিচ্ছি। পাতা ঝেটোনোরও হাঙ্গামা কত। ও-পাড়ার সাকেরের মা বলে, আমাদের গাছের পাতা আর ঝেটিয়ো না, খায়ের বৌ। (পরে ঈষৎ থামিয়া) খড় সব বেচে দিলে?

আজহার ভারি তামাক খায়। তার নেশা চটার উপক্রম, আর ধৈর্য থাকে না, নিজেই কলকে হাতে দরিয়াবিবির সম্মুখে দাঁড়াইল।

খড় না বেচলে, খাজনা দেওয়া হল কোথা থেকে?

বেশ, ভালোই করেছ। থাকলে গরু-বাছুর খেয়ে বাঁচত। পোয়ালটা পুড়ানো চলত। যা জ্বালানির কষ্ট।

স্বামীর দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি ঘোমটা টানে। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। নিঃশব্দেই সে আজহারের হাত হইতে কলকে গ্রহণ করিল।

বাবা আমু, একটা খাপরা নিয়ে এসো।

আজহার জিজ্ঞাসা করে, খাপরা কী হবে?

ভারি মোলায়েম কণ্ঠ এবার দরিয়াবিবির। –বাতাসে ফিকি ছুটলে আর রক্ষে আছে! আগুন লেগে যাবে।

সাবধানে কলকের মুখে আগুন দেয়ার পর দরিয়াবিবি খারাটা উপরে চাপ দিয়া বসাইল।

যা দমকা বাতাস, গাছের পাতাপুতি আর ওসুল হবে না। চুলোর হাঙ্গামা পোয়াতেই অস্থির।

ফুড়ুক-ফুড়ুক শব্দ হয়। চক্ষু বুজিয়া আজহার হুঁকা টানে।

দরিয়া-বৌ, পুকুরপাড়ে কটা গাছ আছে, কাটালে হয় না? কয়েক মাসের জ্বালানোর জন্যে আর ভাবতে হয় না।

না, ওসব কাটলে, তারপর? কোনো কাজকর্ম নেই আর? ছেলেদের বিয়েশাদি নেই?

আমজাদ মার পাশে বসিয়াছিল। সে বলে, কার বিয়ে হবে, মা?

আমার। বলিয়া দরিয়াবিবি মৃদু হাসে। গম্ভীর মুখাবয়বে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলিয়া যায়।

পরে সে আজহারের দিকে চাহিয়া বলে, ছেলেটা কোনো কথা বলতে দেবে না। ঘরকন্নার কথার সময় কিছু ভালো লাগে না।

তোর আব্বার বিয়ে হবে, আমু।

আজহার নিঃশব্দে তামাক খায়। কয়েক বিঘা জমি। সে আজ নিজেই হাল করিয়াছে। দরিয়াবিবির কথা তার কাছে পৌঁছায় না। তন্দ্রায় নেশা জমিতেছিল তার তামাকের ধোঁয়ায়।

সুপ্তোত্থিতের মতো সে বলে, কার বিয়ে দিচ্ছ?

তোমার, আমার, গোটা গাঁয়ের।

দরিয়াবিবি হাসে। আজহার তার মুখের দিকে একবার তাকাইল মাত্র। আবার গুড়ুক টানার শব্দ হয় উঠানে। আজহার খাঁ স্বভাবতই নিরীহ। দৈনন্দিনতার সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু তাকে সহজে স্পর্শ করে না।

দরিয়াবিবি পার্শ্বে উপবিষ্ট পুত্রকে বলে, তোর বাবাকে ডাক্। জেগে আছে তো?

বাবাজি!

আজহার জবাব দেয়, কী আমু?

দরিয়াবিবি স্বামীকে অনুরোধ করে, এখনি রান্না শেষ হবে। আমুর সাথে গল্প করো।

মা!

কি রে!

দ্যাখ না গোয়ালঘরে, বাছুরটা এসেছে তো!

ভারি মনে করি দিলি, বাপধন! ওগো বাছুরটা দেখো না।

আজহার খাঁ বাছুরের জন্য কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না।

দেখো, কাল সকালে ঠিক আসবে।

আমজাদ দরিয়াবিবিকে চুপিচুপি বলে, এখন গোয়ালে দেখে আসতে বলো না।

এখন যাও না একবার গোয়ালডাঙায়।

থাক আজ।

শাদা বাছুর। আমজাদের ভারি প্রিয়। মার কাছে ফরিয়াদের আর অন্য কোনো কারণ নাই।

মা, বাছুরটাকে যদি শেয়ালে ধরে।

অতবড় বাছুর আবার শেয়ালে ছুঁতে পারে? আজহার খাঁ আবার সন্দেহ প্রকাশ করে।

আজকালের শেয়াল।

আজকালের শেয়াল তো একবার যাও না। কৃত্রিম রাগান্বিত হয় দরিয়াবিবি।

আমু, বাছুর খুঁজতে তুমি কতদূর গিয়েছিলে?

মাঠের দিকে গিয়ে কত ডাকলুম। কবরস্থানের কাছে–

দরিয়াবিবি একটি হাঁড়ি নামাইয়া রান্নাঘরের দিকে গেল। উঠানের পশ্চিমদিকে দুখানি খড়োঘর। ছিটেবেড়ার তৈরি। শোয়া-বসা চলে দুই ঘরে। পাশে রান্নাঘর।

হাঁড়িকুড়ি তৈজসপত্র এইখানে থাকে।

রান্নাঘরে হাঁড়ি রাখিয়া দরিয়াবিবি ফিরিয়া আসিল।

তুই গিয়েছিলি পুরানো কবরস্থানের দিকে?

শহীদি কবরগাহের নাম পুরাতন কবরস্থান। হাল-আমলের অন্য গোরস্থান আছে।

বারবার মানা করব, আমার কথা তো শুনবি নে।

আমার ভয় লাগেনি তো, মা।

নেই লাগুক। দাঁড়া, একটু বড়পীরের পানি-পড়া আনি। দরিয়াবিবি একটি বোতল ও মাটির পেয়ালা সঙ্গে আনল।

আজহার খাঁ অন্ধকারে ঝিমাইতেছিল। শরীর খুব ভালো নয় তার। এতক্ষণ সে মাতাপুত্রের গতিবিধির দিকে লক্ষ্য রাখে নাই।

কী আনলে, দরিয়া-বৌ।

বড়পীরের পানি-পড়া, একটু ছেলেটাকে খাওয়াব।

আজহার খাঁ তীরবেগে ছুটিয়া আসিল তাহাদের নিকট।

কর কী, দরিয়া-বৌ। এসব কি?

কেন কী হয়েছে?

এসব কী! পানি-পড়া খাওয়াচ্ছ? ওহাবীর ঘরে এসব বেদাৎ। লোকে কী বলবে?

দরিয়াবিবি বাজখাঁই গলায় বলে, বসো। তোমার বেদাৎ (শাস্ত্রনিষিদ্ধ) তোমার কাছে থাক।

ভালো কথা নয়, দরিয়া-বৌ।

আজহার শান্তস্বরেই জবাব দিল।

এসব নিয়ে কেন গোলমাল বাধাও? ছেলেদের রোগ-দেড়ী আছে। আমি খাচ্ছি। নাকি?

দরিয়াবিবির হাতের কামাই নাই। পেয়ালার পানিতে এতক্ষণ আমজাদের কণ্ঠ ভিজিয়া গেল।

আজহার খাঁ সাধারণত বেশি কথা বলে না। সে গুম হইয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল।

দরিয়াবিবির উপর কোনো কথা চলে না।

আজহার আবার হুঁকা হাতে নিজের জায়গায় ফিরিয়া গেল।

দরিয়াবিবি অনুভব করে, স্বামী রাগান্বিত। পরিবেশ আবার স্বাভাবিক করা দরকার। আমজাদকে বলে, তোর আব্বার কাছে গিয়ে একটু গল্প কর। চুলোর আঁচটা দেখি।

আমজাদ ইতস্তত করে।

গুড়ুক টানার আওয়াজ হইতেছিল। আজহার খাঁ নিস্তব্ধ। আমজাদ পিতার নিকট গিয়া ধূলার উপর বসিল।

আজহার খাঁ এইবার কথা বলে, ধুলোয় বসলি আমু? আয়, আমার কোলে বস।

দরিয়াবিবি চুলোর নিকট হইতে জবাব দেয় : আমিও যাব নাকি?

এসো না, আম্মা।

আজহার খাঁ পুত্রকে কোলে বসাইয়া গুড়ুক টানে।

থাক বাবা, আমার গিয়ে দরকার নেই।

আজহার খাঁ দেখিতে পাইল, দরিয়াবিবি তরকারি নুন চাখিবার জন্য হাতের তালু। পাতিয়াছে। মুখে পুঞ্জ হাসি রেখায়িত।

চুলার আগুন নিভিয়া আসিতেছে। রান্না প্রায় শেষ। দরিয়াবিবির মুখ আর চোখে পড়ে না। কানে তার হাসি ভাসিয়া আসে।

সারাদিন খেটেপুটে চুপচাপ সবাই। দুঃখ তত চিরকাল। ছেলেটাকে নিয়ে একটু গল্প করো না।

আজহার খাঁ মাঝে মাঝে অতীতের বংশ-কাহিনীর কথকতায় মত্ত হয়। সব দিন নয়। আজ সে কোনো জবাবই দিল না। নিঃশব্দে তামাক সেবন করিতেছিল, তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না।

সারা উঠানময় নিস্তব্ধতা। পুত্র পিতার কোলে আসীন। মা হাঁড়ি লইয়া ব্যস্ত।

চুলা প্রায় নিভিয়া গিয়াছিল। সামান্য কাজ বাকি আছে। দরিয়াবিবি আবার একরাশ পাতা আনিয়া চুলার মুখে জড়ো করিল।

অশথের কাঁচা পাতা সহজে ধরে না। ধোঁয়ায় উঠান ভরিয়া গেল। বাঁশের চোঙা দিয়া দরিয়াবিবি ফুঁ দিতে থাকে। একটু পরে চুলা জ্বলিতে লাগিল। পাছে আবার নিভিয়া যায়, নিঃশঙ্ক হওয়ার জন্য দরিয়াবিবি আরো পাতাপুতি খুঁজিয়া দিল। দাউদাউ শিখা আবার উঠানের চারিদিকে তার আলো ছড়ায়।

প্রাঙ্গণের উপর একটা অতর্কিত ছায়া পড়িল। ছায়ার কায়া দেখা গেল কয়েক মুহূর্ত পর। একটা তিন বছরের উলঙ্গ মেয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখে পিঁচুটিভরা। সে ভালোরূপে চোখ মেলিতে পারিতেছে না। অভ্যাসের সাহায্যে চেনা উঠানের খবরদারি করিতে বাহির হইয়াছে যেন।

তার উপর প্রথম দৃষ্টি পড়িল আজহার খাঁর।

আয় মা, আয়। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

সকলের নজর পড়ে মেয়েটির উপর।

আমজাদ চিৎকার করে : ঐ ভূত-বুড়ি এসেছে।

দরিয়াবিবি পিছন ফিরিয়া হাসিয়া উঠিল : বুড়ি, এতক্ষণে ঘুম ভাঙল?

আজহার খাঁ ডাকে, নঈমা এদিকে আয়।

দরিয়াবিবির ছোটমেয়ে নঈমা। সন্ধ্যার সময় কাজের ঝামেলা থাকে। বড় বিরক্ত করে তখন সে। কান্না জুড়িয়া দেয় রীতিমতো। আজ বিকালে তাকে ঘুম পাড়াইয়াছিল দরিয়াবিবি নিজে।

নঈমা আজহার খাঁর নিকট গেল না। সোজাসুজি মার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল।

একটু দাঁড়া, মা।

দরিয়াবিবি একটি হাঁড়ি চুলার উপর হইতে নামাইয়া নঈমাকে কোলে বসাইল, আঁচলের খুঁট দিয়া চোখের পিঁচুটি মুছাইয়া দিল।

কোনো কথা বলে না নঈমা। হাই উঠে তার ঘুম যেন গা-মতো হয় নাই।

কি রে, আরো ঘুমোবি, মা?

নঈমা কথা বলে না। মার বুকে মুখ গুঁজিয়া সে আরাম পায়।

আর একটু সবুর কর, মা! তারপর তোর আব্বাকে ভাত দেব, তোর আমু-ভাই খাবে, তুই খাবি।

ভাতের কথায় নঈমা উশখুশ করে মার কোলে।

এশার নামাজ তবে পড়ে এসো। আর দেরি করে লাভ নেই, নঈমার চোখে এখনও নিদ রয়েছে।

আজহার খাঁকে লক্ষ্য করিয়া দরিয়াবিবির উচ্চারণ।

স্বামী জবাব দিল, এদিকে আমুরও ঘুম পেয়েছে। আমার কোলে শুয়ে বেশ নাক ডাকাচ্ছে।

বিড়ার উপর বসিয়া আমু ঢুলিতে থাকে। দুই চোখ ভরিয়া গোটা রাজ্যের ঘুম আসিয়াছে।

দরিয়াবিবি এক বা পানি আনিয়া দিল।

এক কাজ করো না, ওজু করতে একটু ডানধারে সরে যাও। কতগুলো ছাঁচি কদুর বীজ পুঁতেছিলাম, কড়ে আঙুলটাক গাছ বেরিয়েছে। পানি তো রোজ দিই। আজ একটু ওজুর পানি পড়ক। আর হুজুরের কদম-ধোওয়া পানি।

আজহার খাঁ কোনো কথা না বলিয়া উঠানের দক্ষিণদিকে ওজু করিতে বসিল। দরিয়াবিবির এত হাসি তার ভালো লাগে না।

রান্না শেষ। চুলার ভিতর পাতার আগুন। দরিয়াবিবি একটা হাঁড়ি চুলার মুখে বসাইয়া দিল, পাছে বাতাস ঢোকে। রাত্রির মতো দরিয়াবিবির কাজ চুকিয়াছে।

আর এক লোটা পানি আনিল সে। আমু খেয়ারে ঢুলিতেছিল। তার মুখে পানির ছিটা দিয়া দরিয়াবিবি বলিল, একটু হুঁশ কর বাবা, আর দেরি নেই। আজ তো একটু পড়তেও বসলি নে।

নঈমা তখনও খুঁতখুঁত করিতেছে।

একটু সবুর কর মা। ঘাট থেকে মুখে-হাতে পানি দিয়ে আসি।

আজহার খাঁর নামাজ-পড়া শেষ হইয়াছিল। নামাজের ছেঁড়া পাটি গুটাইতে লাগিল সে।

অন্ধকারে নামাজ-পড়া ভালো দেখায় না। দরিয়াবিবি আগেই একটি টিনের ডিপা জ্বালিয়াছিল চুলার নিকট। নামাজের পাটির দুর্দশা আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়।

দরিয়াবিবি বলে, নূতন নামাজের পাটি আর কেনা হল না? সব কাজেই খোদাকে ফাঁকি।

হলো কই! মেলায় গেলাম। একটা পাটি দেড় টাকা চায়।

দরিয়াবিবির তর্ক শেষ হইয়া যায়। তবু সহজে সে দমে না।

ছেঁড়া পাটি। সেজদায় যাওয়ার সময় মাথায় ধুলো লাগুক। কপাল ক্ষওয়া দেখলে লোকে বলবে, খুব পরহেজগার (ধার্মিক)!

পাটি গুটানো শেষ করিয়া আজহার খাঁ মুখ খোলে, আল্লাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে আজহার খাঁ নামাজ পড়ে না। আমার পর-দাদা আলী আসজাদ খাঁর নাম সবাই জানে। সেই বংশের ছেলে আমি।

পর-দাদা লেখাপড়া-জানা মৌলবী মানুষ। আমার আর লেখাপড়ার দরকার আছে? দরিয়াবিবি টিপ্পনী কাটিল।

আজহার খাঁ বংশের খোঁটা সহ্য করিতে পারে না। নিরীহ ভালো মানুষটি থাকে না তখন আজহার খাঁ। আপাতত চুপ করিয়া গেল সে।

তুমিও তো ঐ পাটিতে নামাজ পড়ো! তোমারও পরহেজগার হওয়ার শখ আছে।

তা আছে বৈকি! তোমাদের পায়ের তলায় আমাদের বেহেশত। তুমি যদি ঐ পাটি ব্যবহার কর, আমার জন্য বুঝি তা খুব দোষের ব্যাপার?

আজহার খাঁ এই মুহূর্তের জন্য অন্তত উষ্মা প্রকাশ করে। আর কোনো জিনিস চেয়ো না। পাটি একটা, যত দামই হোক কিনে আনব।

অত রাগের কাজ নেই। নামাজের পাটিতে কপাল ক্ষয়ে গেল, একটা পাটি কেনার আওকাত (সঙ্গতি) আল্লা দিল কৈ?

আজহার খাঁ চুপ করিয়া থাকে। দরিয়াবিবির কথা তাহার বুকের ভিতর তোলপাড় তুলে। এমন নাফরমান (অবাধ্য) বান্দা সাজিতেছে সে দিন-দিন। তৌবাস্তাগুফের পড়িল আজহার খাঁ তিনবার। তারপর গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

ছেলেদের দিকে দেখো, আমি ঘাট থেকে আসি।

দরিয়াবিবি চলিয়া গেল। সারাদিনের পর অবকাশ মিলিয়াছে। চৈত্রের বাতাস বহিতেছিল ঝিরিঝিরি। বস্তার নিচে আগাছা-জঙ্গলে নামহীন কুসুম ফুটিয়াছে কোথাও।

খুব তাড়াতাড়ি দরিয়াবিবি পুকুরঘাট হইতে ফিরিয়া আসিল।

আজহার ছেলেদের লইয়া উঠানে বসিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করে সে, এত তাড়াতাড়ি এলে?

দরিয়াবিবির অবয়বে ব্যস্ততার ছাপ।

বকরিটার বাচ্চা হবে বোধ হয়। ভারি ভ্যাবাচ্ছে, রাত বেশি হয় নি। ঘরে এনে–

না, না দেরী আছে।

আশঙ্কিত দরিয়াবিবি বলে, না, থেকে-থেকে ভারি ভ্যাবাচ্ছে। রাত্রে যদি বাচ্চা হয়, যা উঁদে বাছুর রয়েছে, লাথিয়ে মেরে ফেলবে কচি বাচ্চা।

বাড়ি-সংলগ্ন ছোট উদ্বাস্তু। তারপর পুকুর আর পুকুরঘাট। পশ্চিম-উত্তর কোণে গোয়ালঘর। গরু-বাছুর-ছাগল একই জায়গায় রাখা হয়। পাড়ের দুপাশে বুনো ঘাস। সাপের আড্ডা। আজহার খর তাই কাজের কোনো চাড় ছিল না।

দরিয়াবিবি বাক্যালাপ না করিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিল। ব্যঞ্জনাদি পেয়ালায় পরিবেশনের সময় সে উৎকর্ণ হইয়া রহিল। ছাগলের ডাক ঘন ঘন শোনা যাইতেছে।

এবার ছেলেদের নিয়ে এসো।

ডাক দিল দরিয়াবিবি। কণ্ঠস্বরে ক্রোধ চাপা রহিয়াছে।

নঈমা নিজের হাতে খায় না। দরিয়াবিবি সকলের খাবার দেওয়ার পর তাকে কোলে তুলিয়া লইল। তার ঘুম যেন সম্পূর্ণ ভাঙে নাই। মার আঙুলের অন্ন সে নিঃশব্দে খাইতে লাগিল।

দরিয়াবিবির কান সদাসর্বদা খাড়া রহিয়াছে। ছাগলের চিৎকার মুহূর্তে শোনা যায়। অভাব-ছোঁওয়া সংসারে এই মূক পশুরাই তাহাদের সম্বল। গত বছর গোয়ালঘরে ছাগলের বাচ্চা হইয়াছিল। দুটিই গরুর গুঁতোয় মরিয়া যায়। তার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। সেই ছানা দুটি থাকিলে এই বছর চড়া দামে বিক্রি হইত! ব্যাপারীরা সেদিনও খোঁজ লইয়াছিল।

খাওয়াদাওয়া চুকিয়া গেলেও দরিয়াবিবির অবসর অত সহজে আসে না। আকাশে মেঘ জমিয়াছে। ভোররাত্রে যদি বৃষ্টি নামে! উঠানের পশ্চিমকোণে ঘুঁটে মেলা আছে। আজ ভিজিয়া গেলে কাল আর চুলা জ্বলিবে না! গাছের ঝরাপাতা লইয়া পাড়ায় মেয়েদের কোন্দল বাঁধে। দরিয়াবিবি ঝোড়ায় খুঁটেগুলি তুলিবার জন্য ছুটিয়া গেল। হাত-পা ধুইয়া আসিয়াছিল, আবার ঘুঁটে ছুঁইতে হইল। দরিয়াবিবি সহজে পরিশ্রান্ত হয় না। তবু আজ খারাপ লাগে তার।

আমজাদ মার কাছে শোয় না। তার আসর অন্য ঘরে। আজহার খাঁর দূর-সম্পর্কীয় এক বুড়ি খালা আছে। আসেকজান। সে চোখে ভালো দেখে না, শ্রবণ-শক্তিহীন। তার আর কোনো আশ্রয় নাই। এখানেই কোনোরূপে মাথা খুঁজিয়া থাকে। ঈদ, মোহররম ও অন্যান্য পর্বের সময় গ্রামের অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা খয়রাত করে, জাকাত দেয়– তারই আয়ে কোনো রকমে দিন চলে। সন্ধ্যার পূর্বেই সে ঘরে ঢুকে, আর বাহির হয় না। খাওয়ারও কোনো হাঙ্গামা নাই তার। আমজাদ তার পাশে ঘুপটি মারিয়া শুইয়া থাকে।

বড় পাতলা ঘুম আসেকজানের। দৃষ্টিশক্তি অল্প বলিয়া আমজাদের খবরদারি সে করিতে পারে না। দরিয়াবিবি তাই অনেক রাত্রে উঠিয়া গিয়া দেখিয়া আসে। কামরার সংলগ্ন ছিটেবেড়ার ঘর। মাঝখানে একটি বাঁশের চোরা-টাটি আছে। যাতায়াতের কোনো অসুবিধা নাই। আমজাদের শোয়া খারাপ। গড়াইতে গড়াইতে হয়ত ধুলোর উপর শুইয়া থাকে। ডিপা হাতে আজও দরিয়াবিবি আমজাদকে দেখিতে আসিল। না, সুবোধের মতো সে ঘুমাইতেছে।

পা-তালির শব্দে আসেকজানের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল।

কে, আজহার?

না, আমি দরিয়া, খালা।

এত রাত্রে কেন, বৌ!

এমনি এলাম।

সারাদিন কাজ। যা, ঘুমো গে, বাছা।

আচ্ছা, যাই।

আসেকজান আবার সাড়া দেয় : বৌ, এলে যখন একটু পানি দাও না, মা। বুড়ো মানুষ আঁধারে হাতড়ে মরব।

আসলে আসেকজানের খুব কষ্ট হয় না অন্ধকারে। দুই ঘরে ডিপা জ্বালানোর কেরোসিন ব্যয় এই সংসারের পক্ষে দুঃসাধ্য। আসেকজান পীড়াপীড়ি করে না। সব তার অভ্যাসের কাছে পোষ মানিয়েছে। আঁধারে আঁধারে সে পুকুরঘাট পর্যন্ত যাইতে পারে।

দরিয়াবিবি কলসের পানি ঢালিয়া দিল।

বৌমা, কাল একটু ও-পাড়া যাব। কেউ যদি একটা কাপড় দেয়। সেই আর বছর ঈদে কখন মোসলেম মুনশী একখানা দিয়েছিল। আল্লা তার ভালো করুক।

দরিয়াবিবি মাঝে মাঝে ভারি কঠিন হয় বুড়ির উপর। এত রাত্রে আর গল্পের সময় নাই। দরিয়াবিবির অন্তর্ধানে আবার ঘরটি অন্ধকারে ভরিয়া উঠিল। শব্দের ভারসাম্য রাখিতে পারে না আসেকজান, নিজে বধির বলিয়া। সে চেচাঁইয়া বলিতে থাকে, মড়ার দিনকাল কী হল? একটা একটাকা পাঁচসিকের কাপড়ও লোকের সত্যেয় ওঠে না। আখেরি জামানা! দজ্জাল আসতে আর দেরি নেই। চৌদ্দ সিদির (শতাব্দী) আমল, কিতাবের কথা কি আর ঝুট হবে?

অনেকক্ষণ পরে আসেকজান বুঝিতে পারে, ঘরে কেহ নাই। তখন নিজেই স্তব্ধ হইয়া যায়। শাদা চুলের উকুন বাছিতে বাছিতে আসেকজান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।

অখ্যাত পল্লীর নিভৃতে মানুষের আহাজারি-বুকে নৈশ বাতাস একটানা বহিয়া যায়।

দরিয়াবিবির আশঙ্কা অমূলক নয়। নিশুতি রাত্রে আবার ছাগলের অবিশ্রান্ত চিৎকার শোনা গেল।

দরিয়াবিবির পক্ষে বিছানায় পড়িয়া থাকা মুশকিল। যদি সত্যই ছাগলটির বাচ্চা হয়। সে একা সামাল দিতে অপারগ। স্বামীকে জাগাইতে হইল।

ঐ শোনো। ছাগলটা আকুলিবিকুলি করছে।

আজহার খাঁ উঠিয়া পড়িল।

না, গিয়ে দেখাই যাক। ডিপাটা জ্বালো।

দরিয়াবিবি স্বামীর আদেশ পালন করিল।

টাঁটি খুলিয়া আজহার খাঁ দেখিল, আকাশে দ্রুত মেঘ জমিতেছে। দমকা বাতাস হু। হু শব্দে বহিতেছে।

দরিয়া-বৌ, ডিপা নিয়ে যেতে পারবে? খুব বাতাস।

ঘরে কোণায় একটি ধুচনি ছিল। ডিপাটি তার মধ্যে রাখিয়া স্ত্রী জবাব দিল : চলো, আমি বাতাস কাটিয়ে যেতে পারব।

পুকুরের পাড়ের পথ তত সুবিধার নয়। দুপাশে ঘন জঙ্গল। সাবধানে পা ফেলিতে হয়। ধুচনির ভিতর ভিজা আলো তাই স্পষ্টভাবে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে না। ছাগলের চিৎকার আর যেন থামা জানে না।

জোর ঝড় উঠিতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। পুকুরপাড়ের গাছপালা ভাঙিয়া পড়িতেছে। নিশুতি বনভূমির প্রেতাত্মা খলখল হাস্যে উন্মাদ নৃত্য-তাণ্ডবে মাতিয়াছে যেন। চারিদিকে গোঙানির শব্দ ওঠে।

দরিয়াবিবি ভয় পায় না। ডিপা হাতে সাবধানে পা ফেলে সে।

না, এবার থেকে গোল ঘর সরিয়ে আনব ভিটের কাছে।

আজহার খাঁ বলিল। কথার খেই সে আবার নিজেই অনুসরণ করে : জায়গা পাব কার? তবু রায়েদের ভালোমানুষি যে, পুকুরপাড়ে গোল করতে দিয়েছে।

দরিয়াবিবি ডিপা সামলাইতে ব্যস্ত। কোনো কথা তার কানে যায় না। পাড়ের উপর শেয়াকুলের ঝোঁপ আড় হইয়া পড়িয়াছিল। আজহার ভাঙা পিঠুলির ডাল দিয়া কোনোরূপে পথ পরিষ্কার করিল। অতি সন্তর্পণে পা-ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। কাঁটাকুটিতে পথ বোঝাই হইয়া গিয়াছে।

আরো দমকা বাতাস আসে। গাছপালাগুলি যেন মাথার উপর ভাঙিয়া পড়ে আর কী।

এইখানে পথ বেশ পরিষ্কার। দরিয়াবিবি দ্রুত পা চালায়।

গোয়ালঘরের সম্মুখে আসিয়া তারা হাঁপ ছাড়ে। ছাগমাতার চিৎকারও আর শোনা যায় না।

গোয়ালের টাঁটি খোলা-মাত্র একটা শাদা বাছুর সম্মুখের তালবন হইতে ছুটিয়া আসিল।

হতভাগা, কোথা ছিলি সাঁজবেলা?

আজহারের গা ঘেঁষিয়া বাছুরটি লেজ দোলায়। মানুষের ভর্ৎসনা বোধহয় আদরের পূর্বলক্ষণ। দরিয়াবিবি বাছুরের গলায় দড়ি পরাইয়া দিতে লাগিল। নচেৎ সব দুধ শেষ করিয়া ফেলিবে।

প্রথমে গরুর কুঠরি ছাগলের কুঠরি একঘরে। ওই দিকটা আরো অন্ধকার। গোয়ালের চালে ঝড় খুব কম লাগে। চারিদিকেই প্রায় ঘন চারা তালগাছের সারি। বাতাস এই দুর্গ সহজে ভেদ করিতে পারে না।

দরিয়াবিবি ডিপা লইয়া ছাগলের কুঠরিতে ঢুকিল। আনন্দে তাহার দুই চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠে। অসহায় ছাগমাতা দণ্ডায়মান। সম্মুখে দুইটি কালো ছাগশিশু। পশুমাতা গা লেহন করিতেছে শিশু দুইটির।

এখনও ফুল পড়ে নাই। দরিয়াবিবি তাই বলিল, এক কাজ করা যাক, ফুলটা আমি ফেলে দিই, না হলে বাচ্চাগুলোর কী দশা হবে যদি ফুল খেয়ে বসে থাকে? দুধ কিনে বাচ্চা বাঁচানোর পয়সা আছে আমাদের?

দরিয়াবিবি আর বিলম্ব করে না। ধাত্রীর কাজ সে নীরবেই সম্পন্ন করিল।

চলো, আরো ঝড় উঠতে পারে। তুমি ধাড়িটাকে কোলে নাও। আমি বাচ্চা দুটো আর ডিপা নিই।

আজহার ইতস্তত করিতেছিল। সদ্যপ্রসূত ছাগীর সংস্পর্শ তার ভালো লাগে না।

অত বাবুয়ানি যদি করতে চাও করো। ছেলেদের মানুষ করবে, না নিজের মতো গরুর লেজ-মলা শেখাবে?

যাক না রাত্রের মতো। খালি বাচ্চা দুটো নিয়ে যাই।

দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বর ঝংকৃত হয় : নাও তুমি বাচ্চা দুটো, আমি ধাড়িটা কোলে নিচ্ছি।

দরিয়াবিবির অবয়বের বাঁধন ভালো। ছাগলটিকে সে সহজেই বহন করিতে সমর্থ হইবে। আনন্দে তার কর্মব্যস্ততা আরো বাড়িয়া যায়।

কয়েক কাঠা জমি অগ্রসর হওয়ার পর মুশকিল বাধিল ডিপা লইয়া। আজহার খাঁর বুকে ছাগশিশু দুইটি। ডিপা আবার ধুচনির ভিতর সাবধানে না রাখিলে চলে না। একটু হাত কাঁপিলে বাতাসে নিভিয়া যাইবে।

ভয়ানক রাগিয়া উঠিল দরিয়াবিবি। শেয়ালকুলের ঝোঁপ পার হওয়ার পর দমকা বাতাসে ডিপা নিভিয়া গেল।

ঐ কাজ তোমাকে দিয়ে হয়! বাচ্চা দুটো আমাকে দিতে কী হয়েছিল?

আজহার খাঁ আর জবাব দেয় না। অন্ধকারে কোনো রকমে দুইজন অগ্রসর হয়।

কালো মেঘের পঙ্গপাল হুড়ুম-দুড়ুম গ্রামের উপর ভাঙিয়া পড়িতেছে। বৃষ্টি নামিলে দুরবস্থার আর অন্ত থাকিবে না।

অন্ধকারে দরিয়াবিবি বারবার আল্লাহর নাম করে। নঈমা একা ঘরে শুইয়া রহিয়াছে। পচা ছিটেবেড়ার ঘর। দরিয়াবিবির সমস্ত রাগ আজহার খাঁর উপর। চোখে তার জল আসে। এমন অবোধ মানুষকে লইয়া তার সংসার!

দরিয়া-বৌ, আর বেশি দেরি নেই।

বিদ্যুতের আলোকে পথ দেখা গেল। পুকুরপাড় শেষ হইয়াছে।

এইবার নামিল ঝমঝম বৃষ্টি। চেনা সরল পথ। আজহার খাঁ দৌড় দিল। ভারী ছাগ দরিয়াবিবির কোলে, সে ঝড়-বৃষ্টি মাধায় সন্তর্পণে চলিতে লাগিল।

উঠানে আসিয়া দরিয়াবিবি দেখিল, টাটি বাতাসে খুলিয়া গিয়াছে। ইন্তার পাতাপুতি ঢুকিতেছে ঘরে। নঈমা অন্ধকারে হাউমাউ জুড়িয়াছে। আসেকজান চেঁচাইতেছে। তার কথার কোনো হদিশ নাই।

ছাগলটিকে মাটির উপর রাখিয়া দরিয়াবিবি ধূলার উপর উপবেশন করিল। জায়গার বাছবিচার নাই তার। বড় শ্রান্ত সে।

আজহার খাঁ ডিপা জ্বালাইয়া মাদুরের উপর বসিয়া পড়িয়াছিল। তেলচিটা দাগ-লাগা বালিশের একপাশ হইতে কালো তুলা বাহির হইয়া পড়িয়াছে। শুইয়া পড়িল আজহার খাঁ।

ক্লান্ত দরিয়াবিবি করুণ দৃষ্টিতে বারবার স্বামীর মুখ অবলোকন করিতে লাগিল।

.

০২.

এক পশলা বৃষ্টি হইয়াছিল রাত্রে। আজহার সকালেই লাঙল কাঁধে মাঠে চলিয়া গিয়াছে। এক মাইল দূরে তার জমি। দুপুরের রৌদ্রে বাড়ি ফিরিয়া খাওয়াদাওয়া করা যায়; কিন্তু আবার মাঠে ফিরিয়া আসা পণ্ডশ্রম। এইজন্যে আমজাদ দুপুরের ভাত মাঠে লইয়া যায়। দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে না। আমজাদের মখতব যাওয়া হওয়া না। লেখা-পড়া নষ্ট। অন্য উপায়ও নাই। দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজ করিতে পারে। পর্দানশীনা মেয়েদের মাঠে যাওয়া সাজে না।

আমজাদের কিন্তু এই কাজ খুব ভালো লাগে। দহলিজের একটেরে বসিয়া থাকা ভারি কষ্টকর। মাধা ধরে, হাই ওঠে, তবু মৌলবী সাহেব ছুটির নাম করেন না। এখানে ইচ্ছামতো দেদার মাঠে ঘুরিয়া বেড়ানো, তার চেয়ে আনন্দের আর কি আছে পৃথিবীতে!

ঠিক মাঝামাঝি দুপুরে আমজাদ নিজে খাইতে বসে। ছেলেমানুষের বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো দিন দুপুর ঢলিয়া যায়।

আজহার অবশ্য তার জন্য রাগ করে না। আমজাদ মাঠে পৌঁছাইলে হাসিমুখেই সে বলে : আমু, এত দেরি কেন, ব্যাটা?

রাঁধতে দেরি। আর আমি জোরে হাঁটতে পারি না।

আজহার গামছায় ঘর্মাক্ত কচিমুখ মুছাইয়া বলে, থাক, তার জন্যে কী হয়েছে! আমার ভারি পিয়াস পেয়েছে, একটু পানি আনো তো নদী থেকে।

জমির পাশেই নদী। দরিয়াবিবি আমুর হাতে একটা ছোট বদনা দিতে ভোলে না। অন্য সময় আজহার আঁজলা করিয়া পানি পায়। খাওয়ার সময় এই হাঙ্গামা পোষায় না।

আমজাদ পিতার আদেশ পালন করে। দুপুরের চড়া রোদ। সেও কম ক্লান্ত হয় না। মতবের জেলখানা হইতে সে রেহাই পাইয়াছে, এই আনন্দে নিজের শ্রান্তির কথা ভুলিয়া যায়।

কয়েত-বেলের গাছের ছায়ায় আজহার খাঁইতে বসে।

বন্যার সময় দুইটি কয়েত-চারা ভাসিয়া আসিয়াছিল পাঁচবছর আগে। আজহার নিজের হাতেই বানভাসি চারা দুইটি রোপণ করিয়াছিল। ঝকড়া গাছের ছায়ায় অন্যান্য বিশ্রান্ত কিষাণদের গুলজার মজলিশ বসে। জমির আর এক কোণে কলার গাছ। ভালো কলার গাছ রোপণ বৃথা। রাত্রে চুরি হইয়া যায়। এইজন্যে মাঠে কেউ ভালো কলার গাছ লাগায় না। পূর্বে কলাপাতার ছায়ায় আজহার মধ্যাহ্নভোজন করিত। গাঁয়ের আরো কিষাণ মাঠে আসিয়া বাস করিতেছে। তারা সকলেই বাগদী, তিওর শ্ৰেণীর। আজহারও মাঠে বসবাস করিতে চায়। ফসলের খবরদারি ভালো হয়, ইচ্ছামতো পরিশ্রম করা যায়। দরিয়াবিবি রাজি হয় না। বেপর্দা জায়গায় ইজ্জত রাখা দায়। তার উপর পুষ্করিণী নাই। নদীর তট এই দিকে উঁচু। গ্রীষ্মকালে পানি ঢালু তটের দিকে সরিয়া যায়। মুমিনের ঘরের মেয়ে এতুটুক বেপর্দা হইতে পারে না। বাগদী তিওরেরা কোনো অসুবিধা ভোগ করে না। মার সঙ্গে উলঙ্গ কুঁচো ছেলের দল দুপুরের স্নান করিতে যায়। রসিক বাদীর দুইটি ছেলে কয়েক বছর আগে বন্যার সময় ভিটার উপর হইতে স্রোতে পড়িয়া গিয়াছিল। তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। ভিটে-ত্যাগের কথা উঠিলে দরিয়াবিবি এই কাহিনী খুব ফলাও করিয়া বলে, আজহার খাঁর উৎসাহ থাকে না আর।

আমজাদ এক বদনা পানি পিতার সম্মুখে রাখিয়া বলে : পানি তেতে উঠেছে, কাল থেকে সকালে বা এনে রেখো।

আজহার খাঁ এক লুকমা ভাত গালে তুলিয়াছে, চোয়াল নাড়িতে নাড়িতে জবাব দিল : হোক, ক্ষতি নেই বাপ। আজ ভুক লেগেছে জোর।

এক আঁটি খড়ের উপর বসিয়া আমজাদ বাবার আহার-পদ্ধতি নিরীক্ষণ করে। তরকারি ভালো নয় আজ। সামান্য ডাল আর চুনোমাছের শুরুয়া।

আমজাদ মাঠের চারিদিকে তাকায়। ধু ধু করিতেছে দূরের মাঠগুলি। নদীর দুই পাশে সবুজ রবি-ফসলের ক্ষেত। সেখানেও রঙ বিবর্ণ। চৈত্রের বাতাস ঝামাল তোলে। বালু ধূলিকণা অন্য গাঁয়ের দিকে উড়িয়া যায়। পাতলা একখণ্ড রঙিন ধোঁয়া যেন পাড়ি জমাইতেছে গ্রামান্তরে।

এই বছর আজহারের লাউ ছাড়া অন্য রবি-ফসল নাই। কুমড়ার লম্বা ডগা সাপের মতো জড়াজড়ি করিয়া রৌদ্রে ঝিমাইতেছে। মাটির ঢেলার উপর একটি কুমড়া দেখা যায়। সবেমাত্র পাক ধরিয়াছে। হলুদ-ধূসর একরকমের রং চোখ-ঝলসানো আলোয় আরো স্পষ্ট হইয়া উঠে। আমজাদের চোখ বারবার সেই দিকে আকৃষ্ট হয়।

আব্বা!

আজহার খাঁ মুখ তোলে। রৌদ্রে মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে। তার উপর কালো একগোছা দাড়ি! কয়েকটা ভাত লাগিয়া রহিয়াছে ঠোঁটের এক কোণে। সেদিকে চাহিয়া আমজাদের হাসি আসে।

ঐ কুমড়াটা পেকেছে।

খুব পাকেনি।

তুমি সেবার বললে, ঘরে তুলে রাখলে পেকে যায়।

আজহার খাঁ মুখে একগাল ভাত তুলিল। একটু থামিয়া সে বলে, পাকবে না কেন?

পুত্রের জিজ্ঞাসার হেতু আজহার খাঁ উপলব্ধি করে।

কুমড়াটা ঘরে নিয়ে যেতে চাও?

হ্যাঁ। খুব লজ্জিত হয় আমজাদ, যেন সে কত অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছে।

না, এখন থাক, বাবা। সামনে হপ্তায় একশ কুমড়া গঞ্জে দেওয়ার কথা আছে। কিছু বায়না নিয়েছি।

পুত্রের মুখের দিকে চায় এবার আজহার খাঁ। কচি শিশুর মুখের উজ্জ্বলতা নিভিয়া গিয়াছে।

আরো কয়েক মুঠি ভাত থালায় পড়িয়া রহিল। আজহার খাঁ বিষণ্ণ হইয়া যায়। একশ কুমড়া এই সপ্তাহে জমি হইতে উঠিবে কিনা সন্দেহ, হয়ত অন্য চাষীর নিকট হইতে কেনা ছাড়া উপায় থাকিবে না। ছেলেদের সামান্য আবদার রক্ষা করাও তার ক্ষমতার বাহিরে। পাইকের আসিয়াছিল গত সপ্তাহে। অগ্রিম বায়না লইয়াছে সে। ওয়াদা-খেলাফ খা পছন্দ করে না। নচেৎ খুব ক্ষতি হইবে তার। অন্য সময় মাঠে কুমড়া পচিতে থাকিবে, পাইকের চুঁইয়া দেখিবে না পর্যন্ত।

আজহার ছেলের মুখের দিকে তাকাইতে সাহস করে না। মুখ নিচু করিয়া বলে, ওদিকের মাঠে তরমুজ হয়েছে খুব। তরমুজ খাবে?

হাসিমুখে আমজাদ পিতার মুখের দিকে চায়। তরমুজের নামে তার ঠোঁটে-মুখে আনন্দ রেখায়িত হয়।

আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি নদী থেকে। বসো, বাবাজি।

নদীর পাড়ের নিচে আজহার ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া গেল। পিতার বলীয়ান ছায়া মূর্তির দিকে আমজাদ চাহিয়াছিল, সেইদিকেই দৃষ্টি মেলিয়া দিল। মাঠে বাতাস আছে, তাই দারুণ গ্রীষ্মে কোনোরকমে সহ্য করা যায়। গাভীদল নির্বিবাদে মাঠে চরিতেছে। দূরে একটি কুঁড়ের পাশে পাকুড় গাছের তলায় কতগুলি ছেলে খেলা করিতেছিল। তাহাদের হল্লা আমজাদের কানে গেল। আবার চোখ ফেরায় সে। একটু পরে সে শুনিতে পাইল, কে যেন শিস দিতেছে। কোনো পাখির ডাক বোধহয়। আমজাদের চেনা পাখি নয়। অদ্ভুত ধরনের শিস। আমজাদ এদিক-ওদিক ইতস্তত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

হঠাৎ শিস থামিয়া গেল।

কাদের ছেলে রে?

চমকিয়া ওঠে আমজাদ। কলাগাছের আড়াল হইতে হঠাৎ একটা লোক বাহির হইয়াছে। যাক্, ভয়ের কিছু নাই। লোকটির মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কালো কুচকুচে গা। হাতে একটি কাস্তে ও নিড়েন-দেওয়া দাউলী।

আবার শিসের জোয়ার ছোটে। এই লোকটি শিস দিতেছিল তা-হলে! ডাগর চোখ তার ঘন-কালো। লম্বা-চওড়া জোয়ান। ভয় করে আমজাদের।

তার দিকে চাহিয়া সে বলে, কাদের ছেলে? তরমুজ চুরি করতে বেরিয়েছ, না?

ভয়ে জড়সড় হইয়া যায় আমজাদ। আজহার কাছে নাই। নদীতে বৃথা বিলম্ব করিতেছে সে।

চুরি করতে বেরিয়েছ?

না। আমি ভাত এনেছি।

লোকটা অকারণ হাসিয়া উঠিল, আবার শিস দিতে দিতে সে গান গায় :

সর্ষে ক্ষেতের আড়াল হল চাঁদ,
চোখে তার মানুষ-ধরা ফাঁদ
ও উদাসিনী লো–

মাথার বাবুরি চুল গায়কের বাতাসে উড়িতেছিল। গান থামিল কয়েক কলি দোহারের পর।

ভাত এনেছ?

আমজাদ ম্রিয়মাণ বালকের মতো উত্তর দিল : আব্বা সব খেয়ে ফেলেছে।

তাহলে আমার জন্যে রাখোনি কিছু। বাহ্।

মুখ সামান্য নিচু করিয়া আমজাদের দিকে সে দুষ্টুমির হাসি হাসে আর তাকায়। ঠোঁট বাঁকাইয়া সে চোঁ চোঁ শব্দ করে।

একটুও ভাত রাখলে না বাপ-ব্যাটা মিলে! হি-হি।

সর্ষেক্ষেতের আড়াল হল চাঁদ,
চোখে তার মানুষধরা ফাঁদ
ও উদাসিনী লো —

আমজাদের ভ্যাবাচ্যাকা লাগে। হয়তো লোকটা পাগল। এইবার সে কোমরের উপর বাম হাত রাখিয়া একটু বক্রভাবে দাঁড়াইল। তারপর ঠোঁটের একপাশে অন্য হাত চাপিয়া লোকটা জোরে চিৎকার করিয়া উঠিল : এই, তরমুজ ক্ষেতে কে?

আমজাদ নদীর আশেপাশে জমির দিকে তাকায়। সেই ছেলেগুলি খেলা করিতেছে। মাঠে জনপ্রাণীর আভাস নাই। গরুগুলি জাবর কাটিতে ছায়ার আশ্রয় সন্ধান করিতেছে।

তবু লোকটা চিৎকার করে। অদৃশ্য উদাসিনীর উদ্দেশ্যে বোধহয়। একটা চুমকুড়ি দিয়া সে ছায়ায় বসিয়া পড়িল। একদম আমজাদের পাশে। তাড়ির গন্ধ উঠিতেছে মুখে। আমজাদ একটু সরিয়া বসে।

আরে লক্ষ্মী, সব ভাত খেলে, আর চাচার জন্যে–তারপর সে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উঁচু করিল।

আজহারকে নদীর পাড়ের উপর দেখা গেল। হাত-মুখ, থালা ধোওয়া শেষ হইয়াছে।

নূতন উৎসাহ পায় লোকটা। আরো জোরে গান ধরে সে। কুমড়াক্ষেতের ওপাশে আজহারকে দেখিয়া সে জোরে ডাকে : ও ভাই খাঁ।

নিকটে আসিল আজহার : কে চন্দর?

লোকটা মহেশডাঙার চন্দ্র কোটাল। মাঠেই বসবাস করে সে। ভাড়-নাচের দল আছে তার। ভিন-গাঁ হইতে পর্যন্ত ডাক আসে পূজা-পার্বণের সময়। গাঁয়ের লোকের সঙ্গে তার সম্পর্ক কম। জ্ঞাতিদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করিয়া কয়েক বছর আগে সে পল্লী পরিত্যাগ করিয়াছিল। প্রতিবেশীর নিঃশ্বাস তার ভালো লাগে না। কিন্তু মাঠে সকলের সঙ্গে তার সদ্ভাব খুব। কয়েক বিঘা জমি দূরে তার কুঁড়ে। স্ত্রী এলোকেশী আর একটি মেয়ে সংসারের সম্বল। বহু ঝড়-আপদ গিয়াছে তার উপর দিয়া। বসন্তে একই মাসে দুটি মেয়ে মারা গেল পাঁচবছর পূর্বে। চন্দ্র কোটাল স্ফুর্তিবাজ দিলখোলা লোক। কুঁড়ের পাশে কয়েকটি তালগাছ। আজহারের জমির প্রাঙ্গণ হইতেও তালসারি দেখা যায়। বাঁশ আর তাড়ির ভাঁড় সারাবছর এই গাছে লাগিয়া থাকে। গ্রীষ্মের দিনে চন্দ্র কোটালের মরশুম পড়ে।

ও খাঁ, শিগগির এসো।

চন্দ্র আমজাদের দিকে ফিরিয়া বলে, বুড়ো দাড়িওয়ালা কে?

আমার আব্বা।

কী করে জানো?

চন্দ্র গোঁফে আঙুল চালায় আর মুচকি হাসে।

আমার আব্বা তো। আমি জানিনে!

দূর হইতে সংলাপ কানে যায় আজহার খাঁর। নিকটে আসিয়া বলে, চন্দর, আজ কষে হারাম গিলেছ। খুব-যে গান ধরেছিলে। তৌবা!

এই তো খাঁ–ভাই, তুমিও গাল দেবে?

আজহার খাঁকে চন্দ্র সমীহ করে। সজ্জন ব্যক্তি। তাছাড়া খাঁয়েদের প্রাচীন বংশ মহিমার কাহিনী এই গাঁয়ের সকলের পরিচিত। তার দাম চন্দ্রও দিতে জানে।

মাছ কেমন ধরছ?

চন্দ্রের কুঁড়ের সম্মুখে দুইটি খালের মোহনা। বারোমাস পানি থাকে। বর্ষাকালে চন্দ্র চাষের দিকে ভালো মন দেয় না। মাছে খুব রোজগার হয় তখন। কাঠি-বাড় দিয়া খালের মোহনা ঘিরিয়া রাখে সে।

না ভাই, দিন-কাল ভালো নয়। একটু তামাক দাও।

আজহার খাঁ বাসন-লোটা নিচে রাখিল। কয়েত-বেলের গাছে ঠেস দিয়া সে নারিকেলি হুঁকা রাখিয়াছিল। হাতে তুলিয়া লইল।

আচ্ছা, তামাক খাওয়াচ্ছি, ছেলেটাকে একটা তরমুজ দাও। এ বছর আমার ক্ষেতে নাদারা।

চন্দ্র কোটাল আমজাদের কচি থুতনি হাতের তালুর উপর রাখিয়া জবাব দিল, আরে ব্যাটা, এতক্ষণ আমাকে বলিনি কেন?

উঠিয়া পড়িল চন্দ্র। বিঘে দুই জমির পাড়ি। আবার শিস দিতে লাগিল সে। আনুষঙ্গিক গানও রেহাই পায় না।

জমি বেচে দুয়োর বেচে
গড়িয়ে দেব গয়না।
ডুমুর তলার হলুদ পাড়
আমারে হায় চায় না।

আজহার খাঁ আমজাদকে বলে, পাগল চন্দর।

পুত্র পিতার মন্তব্যে হাসে।

আমাকে এতক্ষণ বলছিল, সব ভাত শেষ করলে, আমার জন্যে রাখলে না?

তুমি কী জবাব দিলে?

কিছু না। চুপচাপ বসেছিলাম। ভয় পেয়েছিল।

আজহার খাঁ হাসে।

পাগল চন্দরকে ভয়ের কিছু নেই। আচ্ছা আসুক।

ফিরিয়া আসিল চন্দ্র কোটাল। শিস দিতে দিতে দুটি বড় তরমুজ মাটির উপর রাখিল। আমজাদের দুই চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে।

আজহার খাঁ বলে, দুটো বড় তরমুজ আনলে কেন?

তাতে কী।

আজ বাদ কাল গঞ্জ। এবার চালান দেবে না?

চন্দ্র ঘাম মুছিতেছিল।

না, এবার চোরে চোরে শেষ। এই হাট ফাঁক গেল।

দুইটি তরমুজ বেশ বড়। একটির রঙ ঘন সবুজ। অপরটি সাদা। মাঝে মাঝে কালো ডোর-টানা, যেন চিতাবাঘের গা।

চন্দ্র কোটাল আঙুলের টোকা দিয়া তরমুজ দুটি পরীক্ষা করিল।

এই সবজে রঙের তরমুজটা খুব পেকেছে। এখনই কাজ চলবে।

চন্দ্র কাস্তের নখ তরমুজের উপর বসাইতে গিয়া থামিয়া গেল। তোমার নাম কী, চাচা?

আমজাদ।

রাগ করো না। আর একটু দাঁড়াও, চাচা।

চন্দ্র আবার উঠিয়া পড়িল। নদীপথের দিকে তার মুখ। বাধা দিল আজহার। সে জিজ্ঞাসা করে, কী হলো চন্দর?

সারাদিন রোদ পেয়েছে, তরমুজ খুব গরম। ছেলেটার খেয়ে আবার শরীর খারাপ করবে।

আজহার ঈষৎ বিরক্ত হয়।

এখন তবে কী করবে?

নদীর হাঁটুজলে বালির তলায় পাঁচ মিনিট রাখলেই, ব্যাস।

একদম বরফ। ব-র-ফ।

আজহার দ্বিরুক্তি করে না। চন্দ্র জমির আল ধরিয়া নদীর দিকে চলিয়া গেল।

আজহার পুত্রের দিকে তাকায়।

দেখলে? চন্দরটা পাগল।

এবার পিতার কথায় আমজাদ সায় দিতে পারে না। সে নদীর দিকে চাহিয়া থাকে।

বড় ভালো লাগে চন্দ্র কোটালকে তার। শাদা ডোর-টানা তরমুজের দিকে সে আর একবার লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

দুই বছর কয়েত-বেল ধরে না। রোজগারের এই একটি পথ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আজহার খাঁ আফসোস করে।

মাঠে এলে, বাবা দুটো বেলও গাছে হয়নি।

আমজাদ এই কথায় কোনো সাড়া দেয় না। সে চন্দ্র কোটালের প্রতীক্ষা করিতেছে। সময় যেন আর শেষ হয় না।

সূর্যের কিরণে দহনসম্ভার নাই। পড়ন্ত বেলার সূচনা আরম্ভ হইয়াছে। ঈষৎশীতল বায়ু কয়েত-বেলের বনে মর্মর তোলে। গাভীদল দোদুল কোকুদে আবার ঘাসের সন্ধানে বাহির হইয়াছে।

এই, তরমুজ ক্ষেতে কে?

নদীর পাড়ে দণ্ডায়মান চন্দ্র। হাতে নদীমাত তরমুজ। টপটপ পানি পড়িতেছে।

আমজাদ আশ্বস্ত হয়।

আজহার তামাক সাজিতেছিল। চন্দ্র নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।

এইবার শুরু করা যাক। ফিকফিক হাসে চন্দ্র।

অমন হাঁকছিলে খামাখা। তোমার ক্ষেতে তো লোক নেই।

রাত্রেও মাঝে মাঝে হাঁকতে হয়। লোক নেই, চোর জুটতে কতক্ষণ।

হুঁকার মাথা হইতে কল্কে লইয়া চন্দ্র এলোপাথাড়ি টান আরম্ভ করিল।

তুমি তরমুজটা কেটে দাও ছেলেকে।

আমজাদ বিছানো খড়ের উপর বসিয়াছিল। তার পাশে বসিল চন্দ্র। ভকভক গন্ধ বাহির হয় মুখ হইতে। আমজাদ অসোয়াস্তি বোধ করে। একটু সরিয়া বসে।

চন্দ্র বলে, ভয় পেয়েছ বাবা?

না।

আজহার অভয় প্রদান করে।

ভয় কী। তোর চন্দর কাকা, আমু।

আমু চাচা, শুরু করো।

আজহার তরমুজ কাটিয়া দিল। লাল-দানা শাদা শাঁসের ভিতর দিয়ে উঁকি মারে। তরমুজ খুব পাকা।

তুমি একটু নাও, চন্দর।

না, না। আমি একটু রসটস গিলেছি। আর না। চন্দ্র ধোঁয়া ছাড়ে।

আমু চাচা, খেতে পারবে সব?

পারব, চন্দ্র কাকা।

বেশ কথা বলতে পারে তো।

চন্দ্র আমজাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

বড় কষ্ট হয় আজের-ভাই। বড় মায়া দেয় মুখগুলো। কিন্তু খামখা।

আজহার কোটালের কথা সম্পূর্ণ বুঝিতে পারে না। বলে, কী বলছ?

এই ছেলেপুলের কথা। বড় মায়া দেয়। কিন্তু সারাজীবন তো খেটেখেটে বিনি আহার বিনি-কাপড়ে যাবে আমাদের মতো। চাষীর ছেলে!

কেন?

এখনও বুঝলে না, অজের-ভাই! মানুষ করা সাধ্যিতে কুলাবে?

কথাটা আজহারের মনঃপূত হয় না। পুত্রের জীবন সম্বন্ধে সে এত নৈরাশ্য পোষণ করে না।

খোদা নসিবে লিখে থাকলে মানুষ হবে!

ফের কপালের কথা তুলেছ। এই দ্যাখো, আমার সঙ্গে পাঠশালে সেই যে হরি চক্কোত্তির ছেলেটা ছিল, একদম হাবা, কত কান মলে দিয়েছি, মানসাঙ্ক পারত না, সেটা হাকিম হয়েছে। গায়ে তোর আর আসে না। সেটা হল হাকিম! আর আমি? পাঠশালার সেরা ছেলে মজাই তাড়ি আর নেশা, মাঠে মাথার ঘাম পায়ে–।

শঙ্কার ছায়া জাগে আজহার খাঁর মনে। আমজাদের কানে এইসব কথা যায় না। সে আনন্দে তরমুজ খাইতে ব্যস্ত।

ওর বাবা শহরে ছেলেকে নিয়ে গেল। পেটানো গাধা একদম মানুষ। হাকিম!

চোখের তারা উপরে তুলিয়া কল্কে হাতে চন্দ্র ভঙ্গি করে।

তুমি বলল নসীব- কপাল! ছো-ছো। হরি চক্কোত্তি বছর বছর জমির খাজনা সাধতে আসে। আমার বাবাকে না খাজনা দিতে হত, আমাকে না খাজনা দিতে হয়, আয়-উপায় বাড়ে, দেখি কোন্ দিকের জল কোন দিকে গড়ায়। কার কপাল কত চওড়া হয়, দেখা যাক।

আজহার চন্দ্রের কথা মন দিয়া শোনে। কোনো উত্তর দিতে পারে না। এই ধরনের কথা বলে দরিয়াবিবি। কারো সঙ্গে আজহারের মিল নেই। এদিকে আমজাদের তরমুজ খাওয়া পুরোদমে চলিতেছে। পুত্রের ভবিষ্যৎ একবার মাত্র উঁকি দিয়া গেল আজহারের মনে। চকিত ছোঁয়াচ মাত্র। উল্টোপাল্টা কথা তার ভালো লাগে না। উঠিয়া পড়িল আজহার।

চন্দর, এবার কল্কেটা দাও। এখনও বিঘেখানেক জমি মই দিতে বাকি।

দুইবার টান দিয়া কল্কে ফিরাইয়া দিল আজহার।

কয়েত-বেলের গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা বলদ দুইটি চোখ বুজিয়া রোমন্থন করিতেছিল। আজহারের আগমনে উঠিয়া দাঁড়াইল। কর্তব্য সম্বন্ধে পশু দুটি যেন সর্বদা সচেতন!

মই জুড়িয়া আজহার জমির উপর নামিল। জমিতে শকরগঞ্জ আলু দিবে এইবার আজহার খাঁ।

আমজাদের তরমুজ খাওয়া সমাপ্ত। সে হাতমুখ গামছায় মুছিয়া ধন্যবাদ জানাইল, তোমার তরমুজ খুব ভালো, চন্দ্র কাকা।

ওই তরমুজটা নিয়ে যেয়ো তোমার মায়ের জন্য। ভাবী আজ কী বেঁধেছিল।

আমজাদের বয়স সাত বছর। সাধারণ দীন ব্যঞ্জন। লোকের কাছে তা প্রকাশ করতে নাই। বালক সে-বিষয়ে সচেতন। কোনো জবাব দিল না সে।

বেশ, আমায় একদিন নেমন্তন্ন করো।

অস্ফুট আচ্ছা শব্দে জবাব দিল আমজাদ।

আজের-ভাই, ছেলে আমার তরমুজ-ক্ষেত দেখে আসুক, তোমার তো বাড়ি যেতে দেরি আছে?

আচ্ছা, যাক। দেরি করো না, আমু।

দেরি করব না, বাবাজি।

চৈত্রের বৈকাল। আকাশে খণ্ড মেঘেরা মন্ত্রণারত। সমগ্র প্রান্তর আবার কর্মকলরবে জাগিয়া উঠিতেছে। ঝড় না উঠিলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রবি-ফসলের ক্ষেতে কাজের কামাই নাই। শুক্লা সপ্তমী। চাঁদের আলোয় খরা-ভীত কিষাণেরা বহুক্ষণ মাঠ গুজার করিয়া রাখিবে আজ।

অবাক হইয়া চারিদিকে তাকায় আমজাদ। মাঠের নিবিড়ে সে কোনোদিন প্রবেশপথ পায় নাই চেনাশোনা সড়ক ছাড়া। আজ চন্দ্ৰকাকার সঙ্গে জলা-জাঙালের পথ ভাঙিতে লাগিল সে।

পটল-বাড়ির মাঝখানে তামাকের গাছ উঠিয়াছে। হাত দুই দীর্ঘ। শাদা ফুল ফুটিয়াছে তামাক গাছে। আমজাদ সেদিকে চায় না। পটলক্ষেতের ধারে ধারে লঙ্কাগাছ অনেক। একটা গাছের কাছে আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।

এমন লঙ্কা সে আগে দেখে নাই। লাল রঙের লঙ্কা আকাশের দিকে পা তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তারই মতো ডিগবাজি দিতেছে যেন। চন্দ্র আগে-আগে ছিল। পেছনে তাকায় সে।

আরে আমু চাচা, দেখছ কী?

এগুলো কী লঙ্কা, চন্দ্র কাকা?

অবাক হয় কোটাল।

চাষীর ছেলে হয়ে এই লঙ্কা চেনে না? সুজজু-মুখী লঙ্কা। তুলে নাও কতগুলো। আমজাদ ইতস্তত করে। পরের জমি।

চন্দ্র নিজেই কতগুলো লঙ্কা আমজাদের হাতে তুলিয়া দিল। নীল পাতা ভেদ করিয়া লাল রঙের ফুটকি সূর্যমুখী ছাড়া আর অমন কী গাছ আছে? অবাক হইবারই কথা। আমজাদ লঙ্কাগুলি লুঙির একদিকে বাঁধিয়া রাখিল। কিন্তু ফসলের উপর হইতে চোখ সে সহজে ফিরাইতে পারে না। পরদিন মাঠে আসিলে সে এই ক্ষেতের কথা বিস্মৃত হইবে না।

ঝিঙে-বাড়ির চারপাশে চাষীরা বাবলা কাঁটা দিয়াছে। ইতঃক্ষিপ্ত কাঁটারও অভাব নাই। আমজাদ চন্দ্র কোটালের পেছনে সন্তর্পণে হাঁটিতেছিল। চন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইল।

দাঁড়াও, আমু।

দুইজনের মধ্যে একফালি জমির ব্যবধান। এখানে তামাকে ক্ষেত খুব ঘন। আমজাদ চন্দ্র কাকার সমগ্র অবয়ব দেখিতে পায় না। কোটালের কথামতো সে থামিয়া দাঁড়াইল।। আমজাদের কানে যায়, চন্দ্র বলিতেছে : জমিটা হারান মাইতির, তাই এত কাটা, যেমনি প্যাচালের লোক। দূর করে দিতে ইচ্ছা করে।

এক মুহূর্তে চন্দ্রকে আমজাদের পাশে দেখা গেল।

বেশ করেছ। তোমাকে আর হাঁটতে হবে না।

আমজাদকে আর কোনো কথা বলিতে দিল না চন্দ্র, তাকে কাঁধে তুলিয়া লইল সটান।

আমজাদ প্রথমে অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল, এখন ভালো লাগে তার। চন্দ্ৰকাকাকে ভয় নাই কিছু। কাঁধে চড়িয়া দূরের গ্রাম আর কিষাণপল্লী অপরূপ দেখায়।

ক্ষেত পার হইবার পর বুনোঘাসের পথ। ফড়িং উড়িতেছে চারিদিকে। চন্দ্র আনমনে চলে। নির্বিকার, নিঃশঙ্ক। শিসের জোয়ার আসে আবার।

আমার মাথাটা আঁকড়ে ধরিস, বাবা! পড়বার ভয় করো না।

ইহার পর কল্পিত একটা বাঁশি দুই হাতে ধরিয়া চন্দ্র শিস দিতে লাগিল। আমজাদের ভয় লাগে। টাল সামলানো দায় তার পক্ষে।

দম ভরিয়া শিস দেয় চন্দ্র। বোধহয় গান মনে ছিল না, তাই মেঠো সঙ্গীতের রেশ ওঠে না কোথাও।

আমজাদ নিচের দিকে চাহিয়া দেখে, বুনোঘাসের সীমানা আর শেষ হয় না। তার প্রতি চন্দ্ৰকাকার অনুকম্পার কারণ এখন বুঝিতে পারে।

আমজাদ তাদের জমির দিকে চাহিয়া দেখিল, আব্বা আর চোখে পড়ে না। কতগুলি তালগাছের আড়াল হইয়া গিয়াছে সব। ক্ষীয়মাণ সূর্যরশ্মি চিকচিক করিতেছে তালের পাতায়।

চন্দ্রের শিস এইমাত্র থামে।

চাচা, কাঁধে চড়ে কষ্ট হচ্ছে না তো?

না।

সংক্ষিপ্ত জবাব আমজাদের।

চন্দ্র আবার কল্পিত বাঁশি ঠোঁটে রাখিয়া আঙুল নাচাইতে নাচাইতে হঠাৎ থামিল।

ঠিক চাচা, কাঁধে ভালোই লাগে। দুনিয়ার রংই ফিরে যায়। জমিদার সেজে বসে থাকো, চাচা।

আমজাদ চন্দ্ৰকাকার হেঁয়ালি বুঝিতে পারে না। উঁচু-নিচু মাটির উপর পা ফেলিতেছে কোটাল। তাই তার ঝাঁকড়া চুল আরো কষিয়া ধরে আমজাদ।

ঐ যে আমার কুঁড়ে দেখা যায়।

চকিতে চোখ ফিরাইল আমজাদ। দুই ছোট নদীর মোহনা। নদী নয়, একটু বড় খাল। আরো কয়েকটা কুঁড়ে পাশাপাশি। সম্মুখে বড় বালির চাতাল। উঁচু ঢিবির উপর ঘরগুলি। সম্মুখে যোজন-যোজন অভিসারযাত্রী প্রান্তর। ওয়েসিসের মতো চোখে পড়ে মাটির সন্তানদের আবাসভূমি।

আমজাদের কৌতূহল বাড়ে। চাতালের উপর কতগুলি ছেলেমেয়ে হল্লা করিতেছে, কয়েকজন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ঢিবির উপরে। চন্দ্ৰকাকা শিস দিতে আরম্ভ করিয়াছে। ছেলেদের ভেতর কলরব আরো বাড়িয়া যায়।

শাদা চত্বরের নিকট আসিয়া চন্দ্র জোরগলায় ডাক দিল, এলোকেশী-এলোকেশী!!

ছেলেদের মাঝখানে চন্দ্র কোটাল। ঝটকা স্তব্ধতা আসে একবার। চন্দ্র হাঁকে, এলোকেশী!

ভিড়ের ভেতর হইতে একটা ছেলে বলিল : চন্দ্ৰকাকা আজ আবার মাতাল হয়ে এসেছে।

ঢিবির উপর হইতে একটি মাঝবয়সী মেয়ে বাহির হইল। চাষীগেরস্থ ঘরের মেয়ে। ঈষৎ স্থূল-তনু। রোগ-শোক-দীর্ণ মুখ। পরনে ময়লা ন-হাতি কাপড়।

চন্দ্র এইবার সঙ্গীত পরিবেশন করে। ক্রীড়ারত শিশুদের মধ্যে স্তব্ধতা আরো বাড়িয়া যায়। কয়েকজন মুচকি হাসে।

এলোকেশী চন্দ্রের স্ত্রী। নিচে নামিয়া আসিল।

কাঁধে কার ছেলে গো?

আমার। যাও যাও শিগগির। মুড়ি-টুড়ি আছে?

আমজাদের পা ও ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়া ছোট শিশু দোলানোর মতো চন্দ্র এক ভঙ্গি করিল। একটি শিস, সুইৎ শব্দে থামার সঙ্গে সঙ্গে মাটির উপর বসিয়া পড়িল আমজাদ। ভিড় জমে চারপাশে। নদীর ওপারের ছেলেরা এইখানে খেলা জমায় প্রতিদিন। জোয়ারে হাঁটুজল হয় না, তাই পারাপারের কোনো অসুবিধা নাই।

খোকা, এসো আমার কাছে।

এলোকেশী দুই হাত বাড়াইল।

.

০৩.

আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল নবমীর।

আমজাদ পিতার অনুসরণ করে। বলদ দুটি তারও আগে। লাঙলের আবছায়া পড়ে মাটির উপর।

পৃথিবী ক্রমশ বিস্তীর্ণ হইতেছে। মাঠে গ্রামছাড়া হতভাগ্য বহু মানুষ বাস করে; কিন্তু তারা এমন মানুষ, আমজাদ কোনোদিন জানিত না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মা তাকে মিশিতে দেয় না। রাখাল ছেলেরা অনেক দূর মাঠে মাঠে গোচারণে যায়। আমজাদের সে সৌভাগ্য হয় না। অবাধ শিশুমনের অপূর্ব পুলকের সাড়া পড়ে। চাঁদের আলো আরো উজ্জ্বল হইতেছে। দিগন্তে ঝাঁপসা বনানীর রেখা, রবি-ফসলের প্রান্তর স্বপ্নের বার্তা বহিয়া আনে। কিসের স্বপ্ন? আমজাদ হদিশ করতে পারে না। মার উপর হঠাৎ বিক্ষোভ জাগে তার। পাড়ার ছেলেরা বদ, তাদের সহ্বৎ (সংসর্গ)) ভালো নয়, তাই দূরে-দূরে থাকিতে হয় তাকে। মখতবের পর মার কাছে হাজিরি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

আমজাদের মনে পড়িল এলোকেশীর কথা, চন্দ্ৰকাকার কথা। আরেক জগতের মানুষ তারা। তাদের ঘর-দোর, খাওয়া-পরা, চাল-চলন অনেকখানি সে দেখিয়া আসিয়াছে অল্প সময়ের মধ্যে।

এলোকেশী মুখ ভার করিয়া বলিয়াছিল, খোকা, এমন অদিনে এলে! ঘরে মুড়ি ছাড়া আর কী আছে, বাবা!

আমজাদ মুড়ি খাইতেছিল। চন্দ্ৰকাকার মেয়ে ধীরা সম্মুখে দাওয়ায় দাঁড়াইয়া তার খাওয়া দেখিতেছিল। ধীরার চোখে দুনিয়ার বিস্ময়।

গরিব চাচা, ঘরে কিছু নেই আমু। মার কাছে বদনাম করো না।

চন্দ্ৰকাকা হাসে আর কথা বলে। চোখ পিটপাট করিয়া পা নাচাইতেছিল সে। লাজুক আমজাদ মাথা নিচু করিয়া মুড়ি ঠোঁটে তুলিতেছিল।

খাঁয়েদের বাড়ির ছেলে না?

এলোকেশীর জিজ্ঞাসা।

হ্যাঁ। আমার বাড়িরই ছেলে বলতে দোষ কী?

দোষ আর কী!

এই বংশের কত গল্প যে শুনেছি ঠাকুরমার কাছে। কী হল কলিকালে।

আমজাদ এলোকেশীর চোখের দিকে চায়। পাছে ধরা পড়ে, দৃষ্টি নামিয়া আসে সেইজন্য।

আর নূতন খাঁয়েদের কাহিনী শোন নি?

মহেশডাঙা বর্তমানে দুই জমিদারের অধীন। ছআনি আর দশ আনি জমিদার। ছয় আনার মালিক হাতেম বখ্শ খাঁ। দশ-আনির অধিকারী রোহিনী চৌধুরী। মালিকেরা সংখ্যায় তিন-চারিটি পরিবার। একটি নূতন পাড়ার পত্তন করিয়াছে ইহারা। গ্রামের লোকের কাছে তারা নুতন-খা নামে বিদিত।

আরে দূর ছাই। কিসে আর কিসে। রহিম খায়ের বাবাকে কে না জানত? সুদখোর। সুদের পয়সায় জমিদার-।

চন্দ্র কোটাল বাধা দিয়াছিল এই সময় : তোমরা জানো না, গরুর গায়ে ঘা হলে নটা সুদখোরের নাম লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিতে হয়। পোকা পড়ে যায়। আগে পেরতম নাম লিখত জায়েদ খার–রহিমের বাবার। তোমাদের গরু কটা ঠিক আছে তো চাচা?

সংলাপের গুঞ্জন ওঠে আমজাদের চারপাশে। চন্দ্ৰকাকার হাসির মাদকতা বাতাসে ভাসিয়া আসে।

আজকের পথ-চলা বড় আনন্দদায়ক। থাক তরমুজের বোঝ। তবু। বড় তরমুজ আমজাদের পক্ষে বোঝা বিশেষ। বারবার ফেরি করিতেছিল সে। পিতার পদক্ষেপ দ্রুত নয়, এইটুকু যা সুবিধা।

আমজাদ শেষে মাথায় তুলিল তরমুজটি।

একফালি মেঘ পাতলা আবরণে হঠাৎ চাঁদের মুখ ঢাকিয়া দিল। প্রান্তরের উপর ঈষৎ স্লানিমা। মাকড়া অন্ধকার জমিয়া ওঠে সড়কের উপর।

আজহার খাঁ আজ খুব ক্লান্ত। চন্দ্র কোটাল আমজাদকে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাইয়া দেয় নাই। অপেক্ষা করিয়াছিল কিছুক্ষণ আজহার খাঁ। খামাখা বসিয়া থাকা আর তামাক ধ্বংস করা তার ধাতে পোষায় না। তাই সে আবার কাজে লাগিয়াছিল। জমির টুকিটাকি কাজে অনেকক্ষণ কাটিয়াছে। তারপর আসিল চন্দ্র আর আমজাদ। সুতরাং আরো বিলম্ব হইয়াছিল। চন্দ্র কোটাল কত কথাই না বলে। নেশা কাটিয়া গিয়াছে তার। সুখ-দুঃখের কথায় রাত্রি বাড়ে। জোছনা রাত্রি, আজহার খাঁর কোনো তাড়া ছিল না। চন্দ্র আজ আর বাড়ি ফিরিবে না। তরমুজ ক্ষেত পাহারায় তার রাত্রি কাবার হইয়া যাইবে।

ছেলেটাকে আবার মাঠে এনো, আজহার ভাই।

শিস দিতে দিতে মাঠে নামিয়াছিল চন্দ্র। তার অপরূপ চলার দুলকি ভঙ্গি আমজাদের সামনে স্পষ্ট। পিতার উপর আবদারের জোরটা এবার বিফলে যাইবে না, কোটাল কাকার মতো মুরব্বি রহিয়াছে যখন।

আবার চাঁদের মুখ দেখা যায়। মেঘেদের নেকাব খুলিয়া গিয়াছে। সড়কের উপর উজ্জ্বল দিনের আলো ঝরে যেন। আমজাদ গ্রামের প্রবেশপথে একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল। দিগন্তের মেঘলা আলো অন্ধকার প্রান্তরের বিবাগী সীমানা আঁকিয়া দিতেছে। রবিফসলের ক্ষেতের উপর বহু বাঁশ-ডগালির ছায়ারেখা উঁচানো। পেচকের দল ঘুরিয়া ঘুরিয়া তার উপর বসিতেছে। জোছনার আলোয় মেঠো ইঁদুর-শিকার দেখা যাইত। আর একটা কৌতূহলের উঁকি আমজাদের মনে। দিনের আলোয় অন্ধ পেঁচা ইঁদুরের মতো চতুর প্রাণী শিকার করিতে পারে, তার বিশ্বাস হয় না। চন্দ্ৰকাকার কাছে সঠিক সংবাদ পাওয়া যাইবে।

অবোধ বালকের পশ্চাতে প্রান্তরের ইশারা মাথা কুটিতে থাকে। গ্রামের সরু সড়ক। আশেপাশে প্রতিবেশীদের ঘর। জনপদের জীবনে এখনও কোলাহল থামে নাই। প্রথমেই পড়ে নূতন খাঁয়েদের পাকা দহলিজ। ছেলেরা হল্লা করিয়া পড়িতেছে। জমিদারি সেরেস্তার কারখানায় নায়েব পাইকেরা কোন মন্ত্রণায় মাতিয়াছে। মহবুব মৃধার মুদিখানায় এখনও খরিদ্দার আছে। টিমটিম আলো জ্বলিতেছে। মহবুব বসিয়া আছে একটা চৌকির উপর দাঁড়িপাল্লা হাতে। সন্ধ্যার পর গ্রামের চাষী-মজুরদের সওদা আরম্ভ হয়। এক পয়সার তেল, আধ পয়সার লঙ্কা, সিকি পয়সার নুন। ছোট মুদিখানা, তার খরিদ্দারগণের চাহিদাও অল্প। দিনের বেলা ফুরসৎ থাকে না কারো। অবেলা সন্ধ্যায় সওদা শুরু হয়। মহবুবের মুদিখানায় এখনও আলো জ্বলিতেছে, তা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

আজহার খাঁ লাঙল মাটির উপর নামাইয়া রাখিল।

ঝিরঝির বাতাস দিতেছিল। সে মাটির উপর বসিয়া গামছা দোলাইতে লাগিল। আজহার খাঁ রীতিমতো ঘামিতেছে।

হাউ।

বলদ দুটি অগ্রসর হইতেছিল। আজহার খাঁর ডাকে থমকিয়া দাঁড়াইল।

বাবা আমু, তরমুজটা রাখ। একবার দোকানে যা।

আমজাদ পিতার আদেশমতো তরমুজ সাবধানে মাটির উপর রাখিল, হাত ফসকাইলে চৌচির হইয়া যাইবে।

এই নে বাবা, দুটো পয়সা। আমি একটু জিরোই। লাঙলটা দিনদিন ভারী হয়ে যাচ্ছে।

কী আনব, আব্বা।

দুটো পয়সা। দেড় পয়সার বিড়ি আর আধ-পয়সার দেশলাই।

তারপর একটি খালি দেশলাইয়ের খোল আজহার লুঙির ট্র্যাক হইতে বাহির করিল।

এই নে খোলটা। গোটা কুড়ি কাঠি দেবে। গুনে নিস্, বাবা। পয়সা হাতে লইয়া আমজাদ ইতস্তত করে।

দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

আমি যাব না আব্বা।

কেন?

আধ- পয়সার দেশলাই, লজ্জা লাগে।

হঠাৎ ক্লান্তিজনিত বিরক্তি বোধ করে আজহার খাঁ।

এইজন্য মনে করি আর মখতবে পাঠাব না তোকে। গরিবের ছেলে বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশে মেজাজ এমনি হয়ে যায়।

আমজাদ দোকানে এক পয়সার লজেস কি কড়ি-বিস্কুট কিনিতে আসে। গেরস্থালির সওদা কোনোদিন করে না। প্রথমদিনের কর্তব্য বোঝা ঠেকে তার কাছে।

যা।

মোলায়েম নয় কণ্ঠস্বর আজহার খাঁর। যার যেমন পয়সা তেমন কেনে, লজ্জা কিসের?

পিতার শেষ বাক্য আমজাদের কানে প্রবেশপথ পায় না, সে দোকানের দিকে অগ্রসর হইল।

বলদ দুটি সম্মুখে। লেজ দোলাইয়া মশা তাড়াইতেছে। আজহার খাঁ আর একবার হাঁকিল, হাউ।

ফিরিয়া আসিল আমজাদ। কাঁচুমাচু মুখ।

আব্বা, দেশলাই ফুরিয়ে গেছে। মোটে দশটা কাঠি আছে। আর সিকি পয়সার নুন দেবে, দোকানি বললে।

যা, তাই নিয়ে আয়।

এইখানে কাঠা-দুই ফাঁকা খামার। চারপাশে পাড়ার গাছপালা। বাতাস আসে না বেশি। আজহার খাঁ প্রতীক্ষা করে।

এই নাও, আব্বা।

আজহার খাঁ কাঠি গনিয়া দেখিল। নুনের প্যাকেট, দেশলাই, বিড়ি গামছার খুঁটে বাঁধিয়া বলিল, চল বাবা।

তরমুজ যেন ভারী হইয়াছে দশগুণ। আমজাদের মনে বিস্বাদ জমিয়া উঠে। মাঠে বিচরণের আনন্দ উবিয়া গিয়াছে তার। পিতার দিকে চাহিয়া তার নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। দুটি বলদের সঙ্গে আর একটি পশু যেন হাঁটিতেছে লাঙল কাঁধে। ঘৃণার সর্পিণীরা ক্রুদ্ধশ্বাস ফেলিতেছে কচি বুকের ভেতরে।

মুখ ভার করিয়া পিতার পেছনে পেছনে চলে আমজাদ।

খাঁয়েদের সড়ক আরো সংকীর্ণ। দুপাশে বেত আর হেলঞ্চ-ঝোঁপ ঘন। চাঁদের আলো গাছের ফাঁক দিয়া সন্তর্পণে মাটির উপর নামে। ভালোরূপে সড়ক দেখা যায় না। লাঙলের ফলক পাছে লতায় জড়াইয়া যায়, আজহার খাঁ পদক্ষেপ তাই আরো মুথ করে।

বাবা, আমু, আমার ঠিক পেছনে আয়।

আমজাদ বাবার কণ্ঠস্বর চেনে। আশঙ্কা স্নেহ-বাৎসল্য রসের প্রস্রবণরূপে জোছনার মতোই ঝরিতেছে যেন।

আমজাদ ভয় পায়। পিতার নিকটে আসিয়া সে সোয়াস্তি অনুভব করে। বুক হাল্কা হইয়া যায়।

আমু।

আব্বা।

রাগ করেছিস আমার উপর?

আমজাদ হঠাৎ জবাব দিতে পারে না। পিতা কি তার মনের গতিবিধি বোঝে?

না, আব্বা।

লাঙলের ফলা হেলঞ্চ-লতায় জড়াইয়া গিয়াছিল। আজহারকে দাঁড়াইতে হয়।

এক হাতে লতাটা সরিয়ে দাও, বাবা।

আমজাদ অতিকষ্টে লতা-মুক্ত করিল ফলাটি। আরো সাবধানে পা ফেলে আজহার।

কুঞ্চিত চাঁদের মুখ। বনরাজ্যে ভেদ করিয়া স্পষ্ট আলো এদিকে আসে না।

আজহার খাঁ বলে, গরিব বলে মন খারাপ করতে নেই। সব আল্লার ইচ্ছা। না হলে খোদা নারাজ হন।

আমজাদ কোনো জবাব দিল না। সে শুধু শোনে।

ঝিল্লিস্বর বিজন গ্রাম-ভূমির উপর প্রহর-কীর্তন করিতেছে। বড় বকুলগাছে চাঁদের আলোয় হনুমান-দল এখনও জাগিয়া রহিয়াছে। ছানাগুলোর কিচকিচ শব্দ শোনা যায়। লাফালাফির হট্টরোল উঠে বকুল-ডালে।

এই পথে একা-একা চলা আমজাদের সাহসে কুলায় না। পীরের মাজার রহিয়াছে। বকুলতলায়। গাঁয়ের লোকেরা প্রতি জুম্মার রাত্রে মানত শোধ করিয়া যায়। আজদাহা সাপের পিঠে আরোহণ করিয়া দরবেশ সাহেব গভীর রাত্রে গ্রাম-ভ্রমণে বাহির হন। বড় মেহেরবান পরলোকগত এই দরবেশ, শাহ্ কেরমান খোরাসানী। সকলের দুঃখের পশরা তিনি একাকী বহিয়া বেড়ান। সামান্য অসুখ-বিসুখে পীরের মাজার একমাত্র আশ্রয়।

কুড়িহাত বেড় মোটা বকুলের গুঁড়ির দিকে চোখ পলক মাত্র নিবদ্ধ করার সাহস হইল না আমজাদের।

গুঁড়ির উপরে মোটা দুটি ডাল। তার মাঝখানে একটি বিরাট গহ্বর। আজদাহা সাপ এইখানে বাস করে। মাঝে মাঝে দিনে বাহির হয়। কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।

কিংবদন্তির অন্ত নাই। কত কাহিনী না দরিয়াবিবির কাছে আমজাদ শুনিয়াছে। গা। ছমছম করে তার।

জাগ্রত দরবেশ। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সকলেই মানত করে এই মাজারে।

টুপটাপ পাকা বকুলফুল পড়িতেছে। আমজাদ এই শব্দ চেনে। কাল খুব ভোরে বকুল কুড়াইতে আসিবে সে।

পড়ো ভিটে সম্মুখে। বর্ষাস্নাত ঘরের দেওয়াল এখনও খাড়া রহিয়াছে। আলো অন্ধকারে বিজন, বেত আর বনতুলসীর ঝোপে ভয়াবহ, প্রতিবেশীদের আভাসভূমি মহাকালের প্রতীক্ষা করিতেছে।

আর সামান্য পথ। এই সড়কটুকু শেষ হইলে দহলিজে পৌঁছাইবার রাস্তা।

আমজাদের মন আনন্দে নাচিয়া উঠে। শাদা-কালো রেখাসমন্বিত তরমুজের দিকে সে বারবার চায়। মা আজ খুব খুশি হইবেন। গুমোট মনের আবহাওয়া এতক্ষণে কাটিয়া যায়।

নবমীর চাঁদ পশ্চিম গগনের সিঁড়ি বাহিয়া ধীরে ধীরে দিক মেঘলার দিকে অবতরণ করিতেছে। আকাশের এই কোণটা শাদা মেঘের আলিঙ্গনে দিঘির মতো মনে হয়।

দহলিজের সড়কে আসিয়া আমজাদ আর পিতার পেছনে পড়িয়া থাকে না। পাশ কাটাইয়া অগ্রবর্তী হইল সে। এইসব জায়গা তার মুখস্থ। বন-জুয়ানের ছোট তরুলতা কোথায় ফুটিয়া আছে, তাও সে চোখ বুঝিয়া বলিতে পারে।

দহলিজের প্রাঙ্গণে আসিয়া আমজাদের ভয় লাগে। একটা ছায়ামূর্তি যেন সরিয়া গেল তার সম্মুখ হইতে।

বাবার কাছে কোনো আভাস দিল না সে। একবার মাত্র থমকিয়া দাঁড়াইল। আবার পশ্চাদ্বর্তী আমজাদ।

আজহার খাঁর দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। পুত্রের গতিবিধি সে লক্ষ্য করে নাই।

একটু দাঁড়া, আমু। লাঙল আর বলদ দুটো নিয়ে যা দেখি।

আমজাদ তরমুজ দহলিজের দাওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাখিল। বাবাকে ভয় করে সে। নচেৎ ঘরে ঢুকিয়া মাকে অবাক করিয়া দেওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। এমন সুন্দর বড় তরমুজ কে কবে আনিয়াছে এই সংসারে?

খড়ো দহলিজ। একপাশে মাচাঙে বর্ষার সময় খড় তুলিয়া রাখা হয়। লাঙল, কোদাল, চাষের যন্ত্রপাতি থাকে এককোণে। কোনো মেহমান আসিলে বাকি দুই কোণ দখল করে।

আজহার খাঁ লাঙল কোণে দাঁড় করাইয়া ফিরিতেছে। তাহার মনে হইল কে যেন দহলিজের কোণ হইতে পূর্বদিকে চলিয়া গেল একদম দাওয়ার পাশে।

কে গো!

কোনো জবাব আসে না, ছায়ামূর্তি অনড় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

কে গো!

আমজাদ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়াছিল, ভয় পায় সে। জ্বি আসিয়াছে দহলিজে! মার কাছে জ্বিনের গল্প শুনিয়াছে সে। দহলিজে কোরান শরীফ আছে একখানি। রাত্রে তাহারা নাকি কোরান মজিদ পড়িতে আসে।

আজহার খাঁ ছেলেদের নিকট এই গল্প করিলে খুব চটিয়া যায়। তারও মনে খটকা লাগিয়াছিল।

জোরেই হাঁকিল সে, কে গো?

দাওয়া হইতে সে প্রাঙ্গণে লাফাইয়া পড়িল পাঁচন-বাড়ি হাতে।

ছায়ামূর্তি এবার ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে।

আজহার আমজাদকে ডাকে, এখানে আয়, আমু।

কে গো?

উলঙ্গ একটা ছোট মেয়ে। আবছা আলোয় আজহার চিনিল, তারই মেয়ে নঈমা।

নমু, তুই এখানে?

কোনো জবাব দিল না সে। তার ফোঁপানি কান্না বাড়িয়া যায়।

এত রাত্রে তুই এখানে?

আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথা?

দহলিজে আজহার খাঁ শোরগোল তোলে। অন্দর হইতে বাহির হইয়া আসিল দরিয়াবিবি।

এত গোলমাল কিসের?

আজহার খাঁ স্ত্রীর সম্মুখীন হইয়া বলে, দুধের মেয়েটা এই রাত্রে অন্ধকারে-কোনো খোঁজ রাখা দরকার মনে করো না?

খুব দরকার। মনে করেছে।

দরিয়াবিবি এবার নঈমার দিকে চড় তুলিয়া অগ্রসর হয়।

দাঁড়া হারামজাদী।

তিন বছরের মেয়ের মুখে রা নেই। কলহোন্মুখ স্ত্রীর সম্মুখে দাঁড়াইল আজহার খাঁ।

কী হয়েছে, খুলেই বল না।

এতবড় ধাড়ি মেয়ে, ফালি-কাপড়টা হারিয়ে এল।

আজহার জিজ্ঞাসা করে, কোন্ ফালি-কাপড়টা?

সেদিন যেটা গঞ্জ থেকে কিনে আনলে।

ইশ! আজহার অস্ফুট শব্দ করে।

আর এমন হাবার ঘরের হাবা, কী করে হারাল বলতে পারে না।

আজহার কথা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।

তার জন্যে খুব মার মেরেছ বুঝি?

দরিয়াবিবি ঝঙ্কার তোলে : আমি জানি, আমার হাত জানে আর জানে ওর পিঠ।

আজহার নঈমাকে কাছে টানিয়া পিঠের উপর হাত বুলাইতে লাগিল।

করেছ কী? এত দাগ!

মারবে না। সংসার নিয়ে আমি বুঝি অভাবের তাড়না। আর ওরা সুদ্ধ আমাকে জ্বালাবে।

আজহার খাঁর রাগ বাড়ে প্রতিবেশীদের উপর।

এমন চোরের পাড়া। হয়ত ছোটমেয়ে সব সময় কাপড় পরে না। কোথাও ফেলেছিল, ব্যাস আর কী চোর তো সব।

দরিয়াবিবি যোগ দিল : সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কারো মুখে না ছাড়া হা শব্দ নেই।

যাক, আর উপায় কী। নঈমাকে কোলে নাও।

আজহার বাথানে বাঁধিয়া বলদ দুটিকে কয়েক আঁটি খড় দিল।

নঈমা পিতার সঙ্গ ছাড়ে না। দরিয়াবিবি তাকে কোলে তুলিয়া লওয়া মাত্র সে ফেঁপাইয়া কান্না জুড়িল। মা মেয়ের মুখে চুম্বন করিয়া বলিল, কে ফালিটা নিল, মা?

নঈমা কাঁদে শুধু।

ঘরে চলো। আর দাঁড়িয়ে লাভ কী। আমি মুখ-হাত ধুয়ে আসি।

আমজাদ তরমুজ হাতে মার সঙ্গে চলে। এতক্ষণ সে কারো চোখে পড়ে নাই, বড় দুঃখ তার। গর্বের আনন্দ মাঝমাঠে মারা গেল।

ঘরে ঢুকিয়া আমজাদ মার সম্মুখে তরমুজ রাখিয়া নিতান্ত অপরাধীর মতো ধীরে ধীরে বলিল, মা তরমুজ।

দরিয়াবিবির চোখেমুখে হাসির ঝিলিক খেলিয়া যায়।

আরে আমু-চাচা, কে দিল রে এতবড় তরমুজ?

উই মাঠের চন্দ্ৰকাকা।

বেশ পাকা তরমুজ তো। দরিয়াবিবি আমজাদের দিকে চাহিয়া হাসে।

এতক্ষণে ভালো লাগে আমজাদের সবকিছু।

দরিয়াবিবি নঈমাকে বলিল, ঐ দ্যাখ, কাল তরমুজ খাবি। কয়েকটি টোকা মারিল দরিয়াবিবি তরমুজের উপর।

খুব খারাপ নয়, বাবা। দুদিন ঘরে রাখতে হবে।

নঈমার মুখেও হাসি ফোটে।

মা, আমি খা-আ-বো।

হ্যাঁ, তুমিও খাবে।

পা মেলিয়া দরিয়াবিবি মাদুরের উপর বসিয়া আমজাদকে সে তারই পাশে উপবেশন করিতে বলিল। আমজাদ মাঠের কাহিনী বর্ণনা করে মার নিকট।

কিন্তু মাঠে এত দেরি ভালো নয়। তোমার পড়া হল না কিছুই। আজ একটু পড়ে নাও।

দরিয়াবিবি মাটির ডিপা আর করঞ্জ তেল আনিল। কেরোসিন সবসময় কেনার পয়সা থাকে না। দরিয়াবিবি খুব ভোরে উঠিয়া করঞ্জ ফল কুড়াইয়া আনে। তাই কলুর ঘানি হইতে তেল হইয়া ফেরে।

পড়ে নাও, বাবা। তোরা সকালে যাস্ খেজুর পাড়তে, বকুল কুড়াতে। চাট্টি করঞ্জা কুড়িয়ে আনতে পারিস না?

নঈমা বহু লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াছে, ঘুমাইয়া পড়িয়াছে সে।

আজ মার খেয়ে পেট ভরল। আর রাত্রে খাবে, ওর যা ঘুম।

আমজাদের ভালো লাগে না এত রাত্রে পড়া। মার সামনে কোনো অভিযোগ চলে না। টিমটিম ডিপার আলোয় সে পড়িতে বসিল। দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজে উঠিয়া গেল।

পাড়ার আরো কয়েকজনের কাপড় চুরি গিয়াছিল। কেবল ছেলেদের কাপড় চুরি যায়। দরিয়াবিবির বড় লাগিয়াছে আজ। মাত্র বারো গণ্ডার পয়সার জিনিস। তার বহু। পরিশ্রমের ফল, উপলব্ধি করে সে।

দরিয়াবিবি সহজে দাগটা মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না।

নৈশভোজনের পর আজহার গুড়ুক খুঁকিতেছিল দাওয়ায় বসিয়া।

আমজাদ একপাশে নিজের কল্পনা লইয়া ব্যস্ত। শিমুলতুলার দানা বাছাই করে দরিয়াবিবি।

দ্যাখো, এমন সব চোর, খালি ছেলেদের কাপড় চুরি করবে।

আর কার কাপড় চুরি হয়েছে?

প্রশ্নকর্তা আজহার।

মতির ছেলের ধুতি, সাকেরের মেয়ের ছোট শাড়ি, আরো অনেকের।

একরাশ ধোঁয়া ছাড়িল আজহার খাঁ।

একদম ছোটলোক ইতরের পাড়া হয়ে যাচ্ছে। খাঁয়েদের নাম-ইজ্জত আর থাকবে না।

দরিয়াবিবি ঈষৎ ঠোঁট বাঁকায়। আজহার তা লক্ষ্য করে না।

আজহার বলিতে থাকে, হালফিল যারা পয়সাওয়ালা তাদের চালচলন আর বনেদি বংশের চালচলন দ্যাখো।

দরিয়াবিবি স্বামীকে আজ চটাইতে রাজি নয়। সে পাঁজ করিয়া তুলা একটি কুলোর উপর রাখিতেছিল।

থাকবে কী করে বংশের ইজ্জত, গরিব যে সবাই।

দরিয়াবিবি হঠাৎ যেন কথাটি খুঁড়িয়া ফেলিয়াছে এমন ভাব করে মুখের।

খালি পয়সা থাকলেই বংশের ইজ্জত থাকে না। মহেশডাঙার খাঁয়েদের নাম এখনও দশ-বিশ খানা গাঁয়ে পাওয়া যায়।

তা পাওয়া যায়।

দরিয়াবিবি সায় দিল।

কিন্তু পয়সা না থাকলে ইজ্জতও আস্তে আস্তে সরে পড়ে।

এবার চুপ করে আজহার খাঁ।

স্বামীর আচমকা নীরবতা দরিয়াবিবি পছন্দ করে না। কথার সূত্র সে অন্য টানা পড়েনের মধ্যে রাখে।

কাপড়-চোর আমার হাতেই ধরা পড়বে, দেখো।

কত কষ্টে কাপড় কেনা, আর চোর শয়তানেরা এমন দাগাবাজি করবে!

দরিয়াবিবি ডাকিল, আমু।

কী মা?

দেখো কাপড়চোপড় হারিয়ো না, বাবা।

না মা।

আমজাদ শিমুলতুলার ছিন্ন অংশ বাতাসে ফুঁ দিয়া উড়াইতেছিল।

না মা, আমার কাপড় হারায় না।

আসেকজান বেলাবেলি ঘরে ঢোকে। আজ তার ব্যতিক্রম হয় নাই। কানে সে কম শোনে। মাঝে মাঝে পরের কথা সে এমনভাবে বুঝিতে পারে, মনে হয় না সে বধির। অনেকের কাছে বুড়ি তাই সেয়ান-কালা নামে পরিচিত।

স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন তার কানে গিয়াছিল। ভরা সাঁঝে বিছানায় আশ্রয় লইলেও বুড়ির ঘুম হয় না। চোখ বুজিয়া রোমন্থনরত গাভীর মতো অতীত-জীবনের জট খোলে সে। ভোররাত্রির দিকে আসেকজান কয়েক দণ্ড ঘুমায় মাত্র।

হঠাৎ আসেকজান বাহিরে আসিল। দাওয়ার উপর খালাকে দেখিয়া আজহার জিজ্ঞাসা করিল, কী হল, খালা?

বৃদ্ধা খালার উপর আজহারের মমতা বেশি। শুধু একটা ঘর দখল করিয়া আছে, নচেৎ কী আর এমন খবরদারি করে সে। তারই সংসার অচল হইয়া পড়ে মাঝে মাঝে।

এই এলাম, বাবা। বলিয়া আসেকজান দাওয়ার উপর বসিয়া পড়িল।

তারপর কথা পাড়ে আসেকজান।

তোমাদের সংসার কী ছিল সাবেকি আমলে! না-হলে আমার এত কষ্ট! দরিয়া-বৌ তো সংসার চালাচ্ছে। লক্ষ্মী মেয়ে।

যার উদ্দেশ্যে প্রশংসা বর্ষিত হইতেছিল, সে একবার ভ্রুক্ষেপও করিল না।

তোমাদের কষ্ট আমি নিজের চোখে দেখছি।

দরিয়াবিবি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল এইবার। স্বামী-স্ত্রী সংসার লইয়া হাজার মন্তব্য করে। কিন্তু অপর কেউ সংসারের বেআব্রু এলাকা লইয়া আলোচনা করুক, দরিয়াবিবি তা আদৌ পছন্দ করে না।

আসেকজানের বক্তব্য শেষ হয় নাই। সে পুনরায় বলে, আজকাল দীন-ঈমানও ঠিক নেই। দীন-দুঃখীদের দিকে কেউ চায় না!

বৌমা।

দরিয়াবিবির জবাব সংক্ষিপ্ত : কী।

তোমার কাপড়ের টানাটানি। দুটো কাপড় পেয়েছিলাম।

আসেকজান তারপর আঁচল-ঢাকা দুটো কাপড় বাহির করিয়া বলিল, দুটো কাপড় তুমিই পর। আমার যা আছে চলে যাবে।

দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বর চাচাছোলা : কোথা থেকে পেলে শুনি?

ও পাড়ার ইজাদ চৌধুরীর মা ইন্তেকাল করেছিল, কাল মিসকিন খাওয়ালে আর কাপড় জাকাত দিলে।

জাকাত-জাকাত! দরিয়াবিবি হঠাৎ আগুন হইয়া উঠিয়াছে। দাঁত চাপিয়া সে আবার উচ্চারণ করিল, জাকাত!

জাকাত! আমি নেব জাকাতের কাপড়? আমার স্বামী বেঁচে নেই? ছেলে নেই? মুখে তোমার আটকাল না?

লাথি দিয়া একজোড়া কাপড় দরিয়াবিবি দাওয়ার নিচে ফেলিয়া দিল।

আজহার হঠাৎ ব্যাপারটা উপলব্ধি করিতে পারে না। কাপড় দুটো দাওয়ার নিচ হইতে সে কুড়াইয়া আনিল।

খবরদার! এমন কথা মুখে আনবে না। বের করে দেব আমার ঘর থেকে। তোমার জাকাতের মাথায় সাত পয়জার।

ধর্মভীরু আজহার খাঁ এমন কটুবাক্য পছন্দ করে না।

দরিয়া-বৌ, খেপে গেলে নাকি! এসব কী বকছ?

চুপ করো। যারা জাকাত নেয় তারা আর মানুষ থাকে না। জানোয়ার হইনি এখনও। আল্লা আমার হাত-পা দিয়েছে। মড়ার পেটের জন্যে হাত পাবে না কোনোদিন।

নিরীহ আজহারও বেশ চটিয়া যায়।

কাল থেকে তাহলে লাঙল ধরো মাঠে।

দরকার হলে তাও ধরব।

আজহার খাঁ চুপ করিয়া গেল। দরিয়াবিবি সমস্ত সংসার ঠিক রাখিয়াছে। অনিপুণ গৃহিণী ঘরে থাকিলে সে সংসার ছাড়িয়া দরবেশ হইয়া যাইত এতদিন।

তোমাকে ভালো মুখে বলছি, খালা এসব কথা কোনোদিন মুখে এনো না। আমরাও গরিব। দুমুঠো যা-হোক করে চলে যাচ্ছে।

তোমার দরকার নেই? জানো না, তোমার জাকাতের চাল আমরা পয়সা দিয়ে– কিনে নিই!

আসেকজান স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে পাষাণমূর্তির মতো। ধূলা-লাগা কাপড় দুটো বুকে করিয়া সে কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল, তারপর সন্তর্পণে ঘরে ঢুকিয়া পড়িল।

আমজাদের হাই উঠিতেছিল। সে ঘুমাইতে চায়।

হাতের তুলায় দ্রুত পাঁজ দিয়া দরিয়াবিবি বলিল, ও ঘরে শুতে যাসনি। আমার কাছে শো।

আমজাদ আর পা বাড়াইল না। আজহার খাঁ চুপচাপ বসিয়া রহিল। অকস্মাৎ দমকা ঝড় বহিয়া গিয়াছে যেন দাওয়ার উপর।

মাঝরাত্রে দরিয়াবিবির ঘুম ভাঙিয়াছিল। তার পাশে আমজাদ নাই। শয্যা শূন্য। কোথায় গেল আমজাদ?

ডিপা জ্বালিয়া সে আসেকজানের ঘরে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করিল। আমজাদ তার পরিচিত জায়গায় মাদুরের উপর অঘোরে ঘুমাইতেছে। আর আসেকজান উবু হইয়া বসিয়া গিয়াছে। হাঁটুর উপরে অবনত মুখ। শণের মতো শাদা চুল সম্মুখে-পেছনে লুটাইয়া পড়িয়াছে। ফোঁপানির শব্দ উঠিল। কাঁদিতেছে বৃদ্ধা আসেকজান? দরিয়াবিবি সেই দিকে চাহিয়া রহিল। দারিদ্র্যের নারী-প্রতীক যেন ওই গৃহকোণে আশ্রয় লইয়াছে। আল্লার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবন। এই তার পরিণতি! দরিয়াবিবি অসোয়াস্তি অনুভব করে। দারিদ্র্যের দাবানলে সংগ্রাম-বিক্ষুব্ধ জীবনের সমগ্র ঐশ্বর্যসম্পদ ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে। লোলচর্ম কোটরাগত চক্ষু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মানুষের আত্মার দিকে চাহিয়া আছে মাংসলোভী কুকুরের মতো।

দারিদ্র্যের উলঙ্গ রূপ দরিয়াবিবির চোখে যেন এই প্রথম ধরা দিল। সে কেন এখানে আসিয়াছে স্বর্ণপুরী হইতে নির্বাসিত রাজনন্দিনীর মতো? সে কেন এখানে আসিয়াছে? পোড়া ক্ষতের জ্বালা অনুভব করে সে। তার চোখেও অশ্রুর প্লাবন নামে।

ফুৎকারে ডিপা নিভাইয়া দরিয়াবিবি অন্ধকারে আসেকজানের কাছাকাছি আসিয়া ডাকিল, খালা!

.

০৪.

গোধূলি বেলা।

উঠানে নঈমা ছাগলছানা লইয়া খেলা করিতেছিল। আজ বেলাবেলি আজহার মাঠ হইতে ফিরিয়াছে। অবসর সময়টুকু এইখানে কাটে তার। বড় নিঃসঙ্গ আজহার। অন্যান্য প্রতিবেশীদের মতো তাস-পাশা খেলিয়া সে সময় অপব্যয় করিতে জানে না। সাংসারিক কথাবার্তা হয় দরিয়াবিবির সঙ্গে। যখন কোনো কাজ থাকে না, একমনে সে গুড়ুক ফোঁকে। আমজাদ দহলিজে থাকিলে কথা বলিবার কোনো ছুতা পাওয়া যায় না। নঈমার সঙ্গে বাক্যালাপের কোনো বিষয় নাই।

ফুটফুটে ছাগলছানা। কালো মিশমিশে গায়ের উপর অস্তমিত সূর্যের লালিমা পড়িতেছে। রঙের পিণ্ড যেন সঞ্চরণশীল। ধাড়ি ছাগলটি খড়ের উপর শুইয়া রহিয়াছে। নঈমা তাই ব্যস্ত।

আরো চঞ্চল ছানা দুটি। একবার মার কাছে ছুটিয়া যায়। দুধের বাট টানে কিয়ৎক্ষণ, তারপর ম্যাঁ-ম্যাঁ শব্দে প্রাঙ্গণে ঘুরিয়া বেড়ায়। পশ্চাতে ছোটে নঈমা। হয়ত সহজে ধরা দিল না। রাগে সে মার কাছে অভিযোগ করে। তখন কৌশল অবলম্বন করিতে হয়। নঈমা আনমনা অন্যদিকে চাহিয়া একটি ছানার উপর জোরে হাত রাখে। ভীত চিৎকার ক্ষণিক। তারপর আদরে গলিয়া যায় ছাগশাবকরা। নঈমা ছানা বুকে করিয়া গায়ের উপর নরম হাত বুলাইতে থাকে। ছাগমাতা ছুটিয়া আসিলে নঈমা সরিয়া যায়।

আজহার খাঁ মেয়ের লীলা-চপল ভঙ্গি দেখে। শুঢুকের ধোঁয়ায় চোখ ফ্যাকাশে। কোনো মন্তব্য তার ঠোঁটে আসে না। দরিয়াবিবি গেরস্থালির অন্যান্য কাজে ব্যস্ত।

একটু পরে আসিল আমজাদ। বগলে একগাদা তালপাতা। মতব হইতে এইমাত্র সে ছুটি পাইয়াছে। দিনের আলোক থাকা পর্যন্ত মৌলবী সাহেব ইলেম-দানে কার্পণ্য করেন না। চপলমতি বালকেরা এই সময় খুব করিয়া নামতা পড়ে।

অনেকক্ষণ পূর্বে আসিত আমজাদ। ছুটির পর তালপাতা থোয়া–আর এক কাজ। রোজ রোজ তালপাতা দপ্তর হারাইলে মা বড় বিরক্ত হয়। কালির দাগ সহজে ছাড়ে না। ডোবার পানি ভালো নয়। এমনি দেরি হইয়া যায়। শুধু ভয়ে আমজাদ কোনো প্রতিবাদ করে না। মখৃতবে যারা কাগজে লেখে তাদের সঙ্গে ইদানীং নিজের তুলনা করিতে শিখিয়াছে আমজাদ।

মন বিষণ্ণ। তাই উঠানে আসিয়া সে চুপিচুপি আজহার খাঁর পাশে বসিয়া পড়ে। মার সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ হইল না। কিন্তু নঈমার খেলা দেখিয়া সে সব ভুলিয়া যায়। নিজেও এই খেলায় সানন্দে যোগ দিল।

এইবার ছাগশিশুরা ভীত। আমজাদের সঙ্গে দৌড়পাল্লায় তারা অক্ষম। মা মা শব্দ করে শুধু। ভাইবোনে উঠান মাৎ করিয়া রাখে।

বোধহয় ফুরসৎ পাইয়াছিল দরিয়াবিবি। সেও বাতাসে আসিয়া বসিল।

আমু!

কী মা? জবাব দিল আমজাদ।

বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিসনি, ন্যাটা হয়ে যাবে বাচ্চাদুটো।

না মা, আমি তো বেশি ছুঁইনি।

নঈমা প্রতিবাদ করে : মা, আমি তো খেলা কচছি।

হ্যাঁ, খেলা করো।

সন্ধ্যা নামিতেছে ধীরে ধীরে। উঠানে অন্ধকার ঘন হইয়া আসে। দরিয়াবিবি চুল মেলিয়া দিল বাতাসে। সারাদিনের ক্লান্তি ঘামে আর পরিশ্রমে। হাওয়া লাগুক একটু গায়ে।

উঠানে অন্ধকার। নঈমা ও আমজাদের মাহেন্দ্রক্ষণ। এখন ইচ্ছামতো বকরি ছানাকে আদর করা চলে। যতই জোরে পিঠে দমক দাও না কেন, মার চোখে পড়িবে না কিছুই। কিন্তু ছানাগুলি যা বজ্জাত! আদরের নামে একটু জোরে কোথাও টিপ দিলে বড় ম্যাঁ ম্যাঁ শব্দ করে। মার ধমক দিতে তখন বিলম্ব হয় না।

দরিয়াবিবি বলে, আরে বাবা চৌদ্দপুরুষ, একটু আস্তে ছুটোছুটি কর।

মা, ভারি ডরুক ছানাদুটো। কাছে গেলেই ম্যাঁ ম্যাঁ।

ছাগলের ডাক অনুসরণ করিতে লাগিল আমজাদ। অন্ধকারে আজহার খাঁ নীরবে হাসে। তার অস্তিত্ব সবাই বিস্মৃত হইয়াছে! ঘরের দাওয়ায় ডিপা জ্বলিতেছিল। অস্পষ্ট আলো উঠানে সামান্য পৌঁছায়। ছায়ামূর্তির উপনিবেশ। কেউ কারো মুখ দেখিতে পায় না।

উঠানের নিচে আগাছার বন। খুব ঘন নয়। প্রতিবেশীদের কলাগাছের ঝাড় তারপর কয়েক কাঠা জুড়িয়া। আজহার খাঁ সামান্য সরুপথ পৈঠার সাহায্যে অতিক্রম করে। এই দিকে বিশেষ কোনো কাজ থাকে না। বর্ষার দিকে কতগুলি ডোবায় রাত্রে মাছ ধরিতে যাওয়ার খুব সুবিধা। সেইজন্য পথটুকু।

ছাগলছানারা শ্রান্ত। যা দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। দরিয়াবিবি চুপচাপ বসিয়াছিল।

আজহার খাঁ নিজেই ডিপা হইতে কয়লা ধরাইয়া আনিল। সে ফরমাশ-করা ভুলিয়া গিয়াছে নাকি? হাসে দরিয়াবিবি অন্ধকারে।

পরক্ষণে বড় বিরক্তি লাগে তার ছেলেদের হল্লা।

এই, চুপ কর তোরা।

আমজাদের কোলে একটা ছাগলছানা চিৎকার করিতেছিল। ভয়ে সে বাচ্চা মাটির উপর ফেলিয়া দিল। নূতন প্রাণ পায় ছাগশাবক, মার কাছে এক দৌড়ে ছুটিয়া যায়।

দরিয়াবিবির পাশে ভাইবোন শান্ত হইয়া বসে। অন্ধকার থমথম করে।

মা কোনো কথা বলে না, আমজাদ আরো ভয় পায়। ক্ষুণ্ণ স্বরে সে ডাকে, মা।

কী?

মার কোলে মাথা রাখিয়া সে উঠানে পা ছড়াইয়া দিল। প্রশ্ন করার কিছুই ছিল না, আমজাদ চুপ করিয়া থাকে।

উঠানে নিস্তব্ধতা।

পাঁচ মিনিট পরে দরিয়াবিবি আমজাদকে প্রশ্ন করে, ঘুম পায়নি তো?

না, মা।

তোর আব্বাকে ডেকে দেখ তো, জেগে আছে?

ফিসফিস্ কণ্ঠে কথা বলে সে।

আব্বা! আমজাদ হাঁকে।

কী আব্বা?

জেগে আছ তুমি?

হ্যাঁ।

দরিয়াবিবি পিতা-পুত্রের সংলাপ শোনে।

আর একবার জিজ্ঞেস কর, শিমুলে গিয়াছিল বিকেলে?

শিমুলিয়া গ্রামের নাম।

আব্বা, তুমি শিমুলে গিয়েছিলে বিকেলবেলা?

জবাব দিল আজহার খাঁ, না।

এইবার দরিয়াবিবি সোজাসুজি স্বামীর সঙ্গে কথা আরম্ভ করিল।

বাচ্চাদুটোর যা হয় করো। পাঁঠা না হয়ে যায়। খুনকারদের ডেকে এনো।

পাঁঠা হবে কেন, ভারি তেজি বাচ্চা।

খবরদার, বেচে ফেলো না যেন মাঠ থেকে। দুজন ব্যাপারী তোমার খোঁজ করছিল।

না।

আজহার খাঁর কণ্ঠস্বর উত্তাপহীন। তামাকের নেশায় ঝিমোয় সে। নঈমা ঘুমে ঢুলিতেছিল, দরিয়াবিবির লক্ষ্য পড়িল তার উপর। ছাগলছানা দুটি উঠানে দৌড়াদৌড়ি করে। আমজাদের লোভ হয়, মার ভয়ে সে চোরা-চাউনি ছোড়ে। আর একটু খেলতে পেতাম, মা, ভারি বজ্জাত। ঠোঁট বাঁকায় আমজাদ।

উঠানের কিনারায় ছানাদুটি কয়েকবার থমকে দাঁড়ায়, কেউ লক্ষ্য করে না।

একটু পরে হঠাৎ একটি লাল জন্তুর ছায়া পড়ে। এই সময় মা শব্দে সকলে চমকিত হইয়া উঠিল।

হতভম্ব হইয়া আজহার চিৎকার দিতে থাকে, শেয়াল, শেয়াল। আ-তু, আ-তু।

কুকুর ডাকে সে প্রাণপণে। একটি ছানা বাড়ির কোলে ফিরিয়া আসিল।

পলকে কী ঘটিয়া গেল, দরিয়াবিবি সহজে উপলব্ধি করিতে পারে না। পাড়ার দুটি কুকুর ছুটিয়া আসিল। কয়েকবার মাটি শোকার পর তারাও উঠানের নিম্নবর্তী জঙ্গলে উধাও হইয়া গেল।

শেয়ালে নিয়ে গেল ছানাটা? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে।

লাঠি দাও, আমি পুকুরপাড় দেখে আসি।

উঠানে বাঁশের টুকরা পড়িয়াছিল। আজহার অন্ধকারে আড়াল হইয়া গেল।

প্রাঙ্গণে কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ মাত্র। ডিপা আলোয় দরিয়াবিবি বারবার দেখিতে লাগিল। নঈমা, আমজাদ তার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

বড় বিরক্ত হয় দরিয়াবিবি, সরে যা। হাঁ করে কি দেখছিস সব?

তারপর মা খেদোক্তি আরম্ভ করে। শিয়ালের বংশ উদ্ধার হয় গালিগালাজে। ধাড়ির পাশে যে-ছানাটি ফিরিয়া গিয়াছে সেটা কৃশ। আরো আপপোস করে দরিয়াবিবি। ভালো খাশি ছানাটাই মড়ার শেয়ালের চোখে পড়ল।

আজহার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, পাতি পাতি করে খুঁজেছি। ছোট ছানা। মুখে করে দৌড় মেরেছে শেয়াল।

এত কষ্টই সার হল। আর বছর চার-পাঁচ টাকার মাল হত। খামখা গতরের মেহনত।

নঈমা কান্না জুড়িয়া দিল।

দরিয়াবিবি তার দিকে আদৌ ফিরিয়া চাহিল না।

ছেলেগুলোই বদ। রোজ বিকেল-বিকেল তুলে দিই। আজ ভাবলাম। ছেলেরা খেলা করছে, থাক এখন।

আরো কাল্পনিক সম্ভাবনার কাহিনী আওড়ায় দরিয়াবিবি। শ্রান্ত আজহার ধোঁয়া সেবনে বসিয়া পড়িল পুনরায়।

ছোট ছাগল-শিশু। তবু কারো মনে আনন্দ নাই এই পরিবারে। নৈশ-আহারে আরো বিলম্ব হইল। দরিয়াবিবির মেজাজ বড় কড়া। আমজাদ পর্যন্ত খাওয়ার কথা উত্থাপন করিতে ভয় পাইল। নঈমার কপালে রাত্রে ভাত জোটে না প্রায়ই। আজও তার ব্যতিক্রম দেখা গেল না।

ছাগমাতা উঠানে চিৎকার শুরু করিয়াছে।

দরিয়াবিবি খড় খাওয়াইতে লাগিল ছাগটিকে। অনেকক্ষণ আনমনা কাটিয়া যায়।

দরিয়াবিবির মুখ গম্ভীর। চোখের পাতায় ঢাকা অবনত চোখ দৃষ্টির অগোচরে।

আমজাদ মার কাছে দাঁড়াইয়া থাকে। বক্তব্য মুখ হইতে বাহির হয় না। সে-সাহস নাই তার। হাই তুলিয়া সে করুণ চোখে মার দিকে চাহিয়া রহিল।

তোর ঘুম পেয়েছে? চল, ভাত দিই।

আজহার খাঁ এই সুযোগে সান্ত্বনা দিল : আল্লার কাছে শোকর, দুটো নিয়ে যায়নি।

দরিয়াবিবি ব্যঙ্গ স্বরে বলে, ওই মুখে ফুলচন্দন দিতে ইচ্ছে করে!

দপ্ করিয়া নিভিয়া গেল আজহার খাঁ। কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য করিল না।

অপর ছানাটির গায়ে দরিয়াবিবি হাত বুলাইতে লাগিল। কল্পনা রঙিন হইয়া উঠিল তার।

এমন আনমনা বসিয়া থাকা দুঃখ উপশমের ভালো পথ। শুধু আমজাদের জন্য দরিয়াবিবি ছাগল ও ছানা লইয়া রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইল।

রাত্রে ঘুম আসে না দরিয়াবিবির। সারাদিনের ক্লান্তি, তবু চোখে ঘুম নাই একফোঁটা। আজহার খুব অল্প সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল।

শৃগাল-ভুক্ত ছাগলছানার কথা দরিয়াবিবি সহজে ভুলিতে পারে না। হারাম হইয়া গেল তাহার এত মেহনতের ফল! একটা বকনা গরু দুবছর টানা হইতেছে। তার বাছুরের সঙ্গে কোনো দেখা নাই। কোনোদিন মাঠ হইতে চুরি হইয়া গেলেই বা কী। কোন্ চারা আছে তার? আরও আশঙ্কার জাল দরিয়াবিবি নিজেই বোনে। লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইত সংসার, সে-ও ভালো ছিল। দুঃখের অকূল পাথারে নিমজ্জনের আনন্দ দরিয়াবিবি এই মুহূর্তে অনুভব করে। ঘুমের ঘোরে নাঈমা হাত-পা ছুঁড়িতেছে। বাম হাতের কনুই মায়ের বুকের উপর পড়ে। অন্যদিন হইলে সাদরে ধীরে ধীরে হাত সরাইয়া দিত। আজ দরিয়াবিবি জোরে কচি কনুই ও-পাশ করিয়া দিল। কারো প্রতি কোনো দয়া নাই তার। জানোয়ারের মত ঘুমাইতেছে আজহার। স্বামীর বিছানার আর-একপ্রান্তে সরিয়া আসিয়াছে দরিয়াবিবি। আনমনা সে নঈমার কনুইয়ে আবার হাত বুলাইতে থাকে। মেয়ের ঘুম ভাঙে না।

আমজাদ আসেকজানের কাছে চলিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি বড় হয় না কেন গরিবের ছেলেরা? সংসারের দুঃখ ঘুচিবে সত্ত্বর। আমজাদের মতবের পড়া কবে যে শেষ হইবে! শেষ হইলেও ভাবনার দায় হইতে রেহাই নাই। কাছে কোনো স্কুল নাই। চার মাইল হাঁটিয়া এই দুধের বাচ্চারা ইলেম অর্জন করিবে? নঈমা বড় বাড়ন-সার। গরিবের মেয়ের পক্ষে যা বিপজ্জনক। বিবাহের বয়সের আগেই আবার বিবাহের হাঙ্গামা। দরিয়াবিবি বিভীষিকার পুতুল ভাঙে আর গড়ে।

বাইরে আদিগন্ত অন্ধকারের নৈরাজ্য।

দরিয়াবিবি একবার বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। আমজাদ ঠিকমত ঘুমাইতেছে কি? আলস্য বশ্যতা মানে না। আবার শুইয়া পড়িল দরিয়াবিবি।

স্মৃতির রোমন্থন আর কোন সান্ত্বনার প্রলাপ নাই অন্ধকারে।

হঠাৎ প্রথম স্বামীর কথা মনে পড়িল দরিয়াবিবির। শুধু কী প্রথম স্বামীর কথা? মোনাদির-মোনাদিরকে সে ভুলিয়া গিয়াছে? মোনাদির হোসেন খাঁ। স্বামী-পুত্রের বড় লম্বাচওড়া নাম রাখিয়াছিল। আকিকার সময় দরিয়াবিবি এই নাম পছন্দ করে নাই। তবুও শেষপর্যন্ত নামটা বড় ভালো লাগিয়াছিল।

দরিয়াবিবির দীৰ্ণ চোখে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জমিতে থাকে। মোনাদির চাচার আশ্রয়ে এখনও কি সাদরে প্রতিপালিত হইতেছে? নিজের সন্তান, তবু এতটুকু অধিকার রহিল না তার।

সঙ্গতিপন্ন কৃষকের পুত্রবধূ। তিনখানা লাঙল চলে। লাখেরাজ জমি অল্প ছিল না। ভাতের অভাব পরিবারে উপলব্ধি করা কারো পক্ষে মুশকিল। একান্নবর্তী সংসারে কাজ সব সময় লাগিয়া থাকিত। সারাদিন পরিশ্রমের পর তবু সেখানে বিশ্রামের আনন্দ ছিল। জোওয়ান স্বামীর মুখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে দরিয়াবিবির সম্মুখে। সংসার রচনার কত কল্পনাই না জমা হইয়াছিল বুকে। বর্তমানে ভবিষ্যৎ শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছু চেনে না।

তোমার কোন কষ্ট নেই তো, দরিয়া?

না।

চাষিবাসীর সংসারের ঝঞ্ঝাট বেশি।

তা থাক।

খোকাটা বড় ঘুমায় তো, দরিয়া।

কাঁদে ভুক পেলে। ঘুমায় তো বাপের মতো। মাথা কুটলেও সাড়া থাকে না।

অন্ধকারে হাসির ঝন্ঝনা বাজিয়াছিল সেদিন।

বড় হোক, ছেলেকে আমি শহরে পাঠাব লেখাপড়া শিখতে। মানুষ হোক, আর কিছু চাইনে। আল্লার কাছে দিনরাত দোয়া মাগি।

শহরে কত খরচ!

তা হোক। এখানে বাজে-খরচা সব কমিয়ে দেব।

তিন বছরের শিশুকে লইয়া এত কল্পনা।

ভাবীদের সঙ্গে তোমার বনে না, এই যা মুশকিল।

ওর বড় ছোট-মন। সারাদিন কত কাজ করি, তবু মার কাছে গিয়ে লাগাবে, তোমার বউ পটের বিবি হয়ে শুয়ে থাকে।

বলুক। তা নিয়ে ঝগড়া ভালো নয়।

স্বামীর কণ্ঠ অন্ধকারে এখনও বাজে। সে-ই শেষ রাত্রি। পরদিন সে গঞ্জে গিয়াছিল। পথে সর্প-দংশন। বাড়ি পৌঁছাইবার পূর্বেই গ্রামের হাটতলায় তার শেষ নিশ্বাস পড়িয়াছিল। প্রাণবান স্বামীর মৃত্যু কোনো বজ্রাঘাত সূচনা করে নাই। মোনাদির বক্ষে ছিল বলিয়া সব সহ্য করিতে শিখিয়াছিল দরিয়াবিবি। শ্বশুর তখনও জীবিত, তাঁর স্নেহ-মমতার আশিস ছিল সান্ত্বনার আর-এক দিক। বৃদ্ধ জবেদ হোসেন মোনাদিরকে মাটিতে নামাইতে দিতেন না। মৃতপুত্রের শোকাগ্নি নিবারণের শেষ উপায়। কিন্তু তিনিও এক ভুল করিয়া গিয়াছিলেন জীবনে। তারই প্রায়শ্চিত্ত দরিয়াবিবি এখনও বহন করিতেছে। শাশুড়ি জীবিত থাকিলে কোনো বিপত্তি দেখা দিত না। দুই মাসের মধ্যে শ্বশুরও জবেদ হোসেনের পথ অনুসরণ করিয়াছিলেন! এক বছর পরে রুক্ষ শক্ত ভূমিতে দাঁড়াইতে হইয়াছিল দরিয়াবিবিকে। যৌথ সম্পত্তি বণ্টন হইতেছে ভাইয়ে ভাইয়ে। কিন্তু এক কানাকড়িরও অধিকার নাই তার। স্বামী পিতার কোলে ইন্তেকাল করিয়াছেন। শরিয়ৎ মত শ্বশুরের সম্পত্তির উপর তার বা মোনাদিরের কোন অধিকার নাই। স্বামীর অন্যান্য ভাইদের নিকট দরিয়াবিবি শেষ আবেদন জানাইয়াছিল, মোনাদিরের ভরণপোষণ কিরূপে নির্বাহ হইবে। কর্ণপাত করে নাই তারা। দরিয়াবিবি মরহুম শ্বশুরের অজ্ঞতার উপর হাজার লানৎ বর্ষণ করিয়াছিল। তিনি জীবিত অবস্থায় এই বণ্টন-ব্যবস্থা করিয়া গেলে পথের ভিখারিনী হইত না সে।

তার কয়েক দিন পরেই দরিয়াবিবি স্বামীর ভিটা পরিত্যাগ করিয়াছিল। দাসীবৃত্তির জীবন তার জন্য নয়। অন্যান্য ভাশুর এবং দেবরেরা তখন চণ্ডালের মতো ব্যবহার করিয়াছিল। মোনাদিরকে তাহারা জোর করিয়া ছিনাইয়া লইল। সেদিনের মর্মান্তিক দৃশ্য দরিয়াবিবির চোখে অগ্নিসহ বিদ্যুতের মতো খেলিয়া বেড়ায়। সারা দুপুর তুমুল কলহের পর সে এক বস্ত্রেই পুত্রসহ স্বামীর ভিটা পরিত্যাগে প্রস্তুত ছিল। পালকির কোনো প্রয়োজন নাই তার। খাট যার ভাঙিয়াছে, ভূমিশয্যা ছাড়া তার আর কী গত্যন্তর আছে?

মোনাদিরকে কোলে করিয়া সে পথে নামিয়াছিল।

একজন দেবর এই সময় ছুটিয়া আসে, ভাবী–ভালো হচ্ছে না। আমাদের বংশের ইজ্জত নষ্ট করছ তুমি।

ইজ্জত? যাদের বিচার নেই, তাদের আবার ইজ্জত?

তুমি এখানে থাকো, কে তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে!

এমন করে আমার থাকার দরকার? তোমাদের বিবিজানদের বাদী হয়ে থাকবার কোনো দরকার নেই। না-খেয়ে দিন কাটবে?

তোমার খাওয়ার অভাব হবে না।

পরের হাত-তোলা খাওয়ার দরকার নেই আমার। রাস্তা ছাড়ো। আমার সম্পত্তি আছে?

কোরান-কেতাবে যা হুকুম আছে, সেইমতো কাজ করছি, আমাদের দোষ দাও কেন? বাপের কোলে বেটা মরলে তার ওয়ারিশানদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকে না।

ওসব হাদিস কালাম আমার কাছে শোনাতে এসো না। মানুষকে পথের ভিখিরি। করতে আল্লা বলে দিয়েছে?

আরো কথা কাটাকাটি।

তবে, ছেলে দিয়ে যাও।

তোমাদের চাকরের অভাব আছে বোধহয়।

বড়ভাবীর ছেলেপুলে নেই, সে মানুষ করবে।

অত ছোটছেলে তো চাকরের কাজে অক্ষম। তা মানুষ করতে হবে বৈকি!

তারই চোখের সামনে মোনাদিরকে ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি আর মুখ পশ্চাতে ফিরায় নাই। অতীতের সমস্ত সম্বন্ধ চুরমার হইয়া যাক। যেন কোনো ক্ষোভ নাই তার।

বংশের ইজ্জত!

আপ্ত রমণীর মতো দরিয়াবিবি সেদিন গর্জন করিয়াছিল।

ইহাদের মুখে চুনকালি দেওয়ার আর কোনো পথ সে অনাবিষ্কৃত রাখিবে না। পাঁচ মাস পরে বিপত্নীক আজহার খাঁকে নেকাহ্ করিল দরিয়াবিবি।

চোখ বুজিয়া নিস্তার নাই। দরিয়াবিবির সম্মুখে অতীতের বিষধর ফণা চক্র দোলাইয়া কুটি ছড়াইয়া যায়। কত মুখ ভাসিয়া আসে– জবেদ হোসেন-আহাদ হোসেন মোনাদির।…মোনাদিরের কপালে একটা কালো দাগ ছিল জন্মাবধি। গৌর চেহারায় জ্বর উপরে গোল দাগ… চুম্বনে চুম্বনে মুছিয়া গিয়াছে কি দাগ? এখনও শ্মশান পাহারায় রত চণ্ডালের অট্টহাসের মতো অন্ধকারে ঝন্ঝনা বাজিয়া যায়।

নঈমার কচি মুখের উপর দরিয়াবিবি তার অশ্রুসিক্ত ঠোঠ চাপিয়া ধরিল। জ্বালা ধরে দুই চোখে। নিরবচ্ছিন্ন বিস্মরণ-পিপাসু পীড়িত হৃদয়-কোণ মমতাময়ী শিয়রে জাগিয়া দাঁড়াক একবার। দরিয়াবিবি তারই প্রতীক্ষা করে!

.

০৫.

কয়েকদিন পরে দরিয়াবিবি আসেকজানের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল বুড়ি চুপচাপ বসিয়া আছে, জাকাতের পাওয়া কাপড় দুটি নাড়াচাড়া করিতেছে। নিঃশব্দে আসিয়াছিল দরিয়াবিবি। বুড়ি কিছুই টের পাইল না।

খালা ডাক শুনিয়া সে নিজের আঁচলের ভেতর কাপড় দুটি ত্রস্ত তুলিয়া লইল, যেন চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে।

কোনো জবাব দেওয়ার পূর্বেই দরিয়াবিবি বলিল : খালা, রাগ করো না। একটা কাপড় আমাকে দাও। পরে দাম দিয়ে দেব।

বৃদ্ধাকে নিছক সন্তুষ্ট করিবার পন্থা মাত্র। দরিয়াবিবি নিজেও জানে, ছয় মাসের পূর্বে আর সে দাম চুকাইয়া দিতে সক্ষম হইবে না।

ফোগলা দাঁতে হাসি ফোটে। আসেকজান শশব্যস্ত কাপড় দুটি বাহির করিল।

যেটা ভালো, সেটা বেছে নাও, মা। দেখো দিকি, কোন্‌টার জমিন বেশ ভালো।

মাদুরের উপর বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি।

খালা, তোমার শরীর ভালো তো?

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আসেকজান।

না, মা। দুদিন থেকে বড় মাথা ধরেছে। চোখ ধোঁয়া ধোঁয়া।

অনুতপ্ত হয় দরিয়াবিবি। ইহা তারই নিষ্ঠুরতার পরিণতি, তা উপলব্ধি করিয়া বড় ব্যথিত হয়।

তুমি বাইরে চলো, ঠাণ্ডা পানিতে মাথাটা ধুইয়ে দিই। আজ আর কোথাও বেরিয়ো না।

ও পাড়ায় দাওয়াৎ ছিল। দুপুরে যাব কষ্ট করে।

কিসের দাওয়াৎ?

জলিল শেখের ওখানে। আজ ওর ছেলের চল্লিশে কিনা।

দরিয়াবিবি জানে, জলিল শেখের রোজগারী জওয়ান ছেলে কিছুদিন আগে ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগিয়া ইন্তেকাল করিয়াছে। তার মুখটি মনে পড়িয়া গেল দরিয়াবিবির। বলিল, আহা!

অনেক লোক খাওয়াবে। আমজাদকে সঙ্গে নিয়ে যাব?

কে যেন বিছুটি চালায় দরিয়াবিবির সর্বাঙ্গে।

আজ কিন্তু ক্রোধের কোনো চিহ্ন নাই তার মুখে।

শান্ত কণ্ঠেই সে বলে, না খালা, তার গিয়ে কাজ নেই। তুমিও আজ কোথাও যেয়ো। এখানেই খাবে।

আসেকজান প্রায়ই গাঁ হইতে এইরূপ দাওয়াৎ পায়। ধনীদের বাড়িতে চর্ব-চোষ্যের বহু আয়োজন হয়। আসেকজান শুধু নিজের উদরপূর্তি করিয়া আসে না। অনেক সময় নানা খাবার সঙ্গে আনে। অন্ধকার ঘরে তার অংশগ্রহণ করে আমজাদ অথবা নঈমা। দরিয়াবিবির চোখে কয়েকবার ধরা পড়িয়াছে তারা। আসেকজানও তার জন্য তিরস্কার ভোগ করে।

পরলোকগত ব্যক্তির চল্লিশার খাবার সঙ্গে করিয়া আনিতে আসেকজানের কোনো দ্বিধা নাই। দরিয়াবিবি ছেলেদের অমঙ্গল চারিদিকে যেন দেখিতে পায়। খুব সাবধানী সে। আজ ঝগড়ার কোন সূত্রপাত দেখা গেল না।

দরিয়াবিবি শুধু অনুরোধ করিল মাত্র : আজ কোথাও যেয়ো না, খালা।

জলিল শেখ পাটের ব্যাপারী। নৌকা আছে তিন-চারখানা। বেশ অবস্থাপন্ন ঘর। সেখানকার আয়োজন কল্পনাই করা চলে। আসেকজানের লোভ হয় খুব। কিন্তু দরিয়াকে সে ভয় করে। চুপ করিয়া গেল সহজে। তার কল্পনা-নেত্র কিন্তু তারপর তৃষিত হইয়া উঠিতেছিল।

কাপড় দুটি দরিয়াবিবি আধ-অন্ধকারে বারবার তুলনা করিয়া বলিল, এই লাল সরু পাড়টা নিলাম, খালা।

বেশ, বেশ! আমার কি আর এসব মানায়, মা! শাদা কাফন পরে কবরে যেতে পারলেই ভালো।

বাজে কথা কেন মুখে, খালা? এই সকালে আর কোনো কথা মুখে আসে না বুঝি। চলো বাইরে। মাথাটা ধুইয়ে দিই।

দুইজনে দাওয়ায় আসিয়া পৌঁছিল।

দরিয়াবিবি এক বদনা পানি লইয়া বৃদ্ধার শণের মতো শাদা চুলের উপর ঢালিতে লাগিল।

চুপচাপ বসো। আরো তিন-চার বদনা ঢালতে হবে।

বসছি, মা। একটু তেল দিয়ে দিস বউ।

দরিয়াবিবি চুলের ভিতর আঙুল চালাইয়া বদনার নল দিয়া ধীরে ধীরে পানি চোয়াইতে ব্যস্ত।

আসেকজানের শরীর ভারমুক্ত হইতেছে। আহ্ শব্দে তার আনন্দ ধরা পড়ে। নারিকেল তেল আনিল দরিয়াবিবি। চুলের গুছির ভেতর বেশ চুকচুকে করিয়া দিতে লাগিল।

খালা, দশ ঝন্ঝাটে শরীরটা জ্বলে গেল। মেজাজ ঠিক থাকে? কখন যে কাকে কী বলি–হদিশ থাকে না।

মা, জানটা আসান হলে। আল্লার দোয়া লাগুক তোমার শরীরে।

তেল দেওয়ার অজুহাতে দরিয়াবিবি আসেকজানের মাথাও টিপিয়া দিল খানিকক্ষণ। কোরা কাপড়খানা একটি চটির উপর পড়িয়াছিল, দরিয়াবিবির চোখ সেদিকে বারবার আকৃষ্ট হইতে ছিল।

রান্না চড়িয়েছ বউ?

সে আর বাকি আছে, মা? আমুর পেট খারাপ। আজ পান্তা খেতে দিইনি। মতব থেকে এসে একবার ভাত খাবে।

এমন সময় আমজাদের গলা শোনা গেল। ভিটের নিচে হইতে সে চিৎকার করিতেছে মা-মা-।

দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হয়। না, এক পা বাড়ানোর পূর্বেই স্বয়ং আমজাদকে উঠানে দেখা গেল।

মা।

এক হাত উঁচু করিয়া সে আবার চিৎকার করে, মা!

দরিয়াবিবির চোখে সূর্যের আলো পড়িয়াছিল। পুত্রের সর্বশরীর চোখে পড়ে না।

বাড়িটা যে মাথায় তুলে চেঁচাস। কি—

এই দেখো।

হাত তুলিয়া আমজাদ ধেই ধেই নৃত্য করে।

নিকটে পৌঁছানো মাত্র দরিয়াবিবি দেখিতে পায়, আমজাদের হাতে দশ-বারোটি বড় চিংড়ি মাছ। দাঁড়াগুলি তার মুঠোর মধ্যে। লাল সরু শুড় রৌদ্রে চকচক করিতেছে।

দরিয়াবিবির ঠোঁটেও হাসি উপচিয়া পড়ে।

কোথা পেলে, বাপ?

বলছি। বলিয়া আমজাদ এক লাফে দাওয়ার উপর উঠিল।

মাঠের চন্দ্ৰকাকা দিয়েছে। আমাদের মতবে গিয়েছিল। মৌলবী সাহেব তাইতো ছুটি দিলে।

বেশ বড় চিংড়ি রে!

একটা ডাগর চিংড়ি বাহির করিয়া আমজাদ বলিল, এইটা আমার, যা লাল মগজ আছে ভেতরে!

দরিয়াবিবির আর আনন্দ ধরে না। কচি শিশুদের মুখে খুব কম দিনই ভালো ব্যঞ্জন জোটে।

খালা, আজ তোমারও ভালোই হল। ভাবছিলাম, খাওয়ার কষ্ট হবে।

আসেকজান এতক্ষণ নির্বিকার ছিল।

কী বৌমা?

আমু চিংড়ি এনেছে। দুপুরে খাওয়াটা ভালোই হবে। মাঠের কোটালরা দিয়েছে।

আমজাদ মার হাতে মাছগুলি সোপর্দ করিয়া বলে, তাড়াতাড়ি পান আর চুন দাও, কাকা দহলিজে বসে আছে।

তবে এতক্ষণ বলিসনি?

দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে ছোটে। অন্যদিকে আসেকজান আমুর সঙ্গে তখন ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করে।

নিয়ে যা, বাবা। তোর কাকা তামাক খায়?

আরে বাব্বা তামাক খায় না? তামাক-ক্ষেত খেয়ে ফেলে।

দরিয়াবিবি আবার তামাক সংগ্রহে ছুট দিল।

দহলিজে একটি বিড়ার উপর চন্দ্র কোটাল বসিয়াছিল। হাতের কামাই নাই। গোটা পান, চুন, সুপারি দিয়াছিল দরিয়াবিবি, তাহাই সে সাজিয়া লইতেছিল।

চন্দ্র কোটাল একটি খাটো ধুতি পরিয়াছিল মাত্র। কোমরে কাস্তে গোঁজা রহিয়াছে। পান-সাজার সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ খুলিল।

তোমার বাপ কোথা, চাচা?

আজ তো কোথাও যায়নি। গাঁয়েই আছে। বোধহয় পাড়ার দিকে গেছে।

দেখা করতে এলাম। কথা ছিল।

একটু বসো না, কাকা।

চন্দ্র কোটাল চারিদিকে তাকাইল। আরো কয়েকবার সে খ-পাড়ায় আসিয়াছে। বর্ষাকালে নদীর ধার হইতেই মাছ বিক্রয় হইয়া যায়। কালেভদ্রে পাড়ায় আসিতে হয়।

নূতন লোক দেখা মেয়েদের সাধারণ কৌতূহল। দহলিজের খিড়কির দিকে ঘোমটার আবছায়া দেখিয়া চন্দ্র ঠিক অনুমান করিয়াছিল, আমজাদের মা আসিয়াছে।

মুখে পান খুঁজিয়া জোর গলায় বলে, চাচা, তোমার মা দুপুরবেলা খাওয়াবে?

আমজাদ বাড়ির ভিতর চলিয়া যাইতেছিল। দহলিজের পেছনেই দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়াছিল, হাত-ইশারায় পুত্রকে আহ্বান করিল।

আমজাদ মার কাছে দাঁড়াইয়া জোরগলায় বলে, গরিব মানুষ, ডাল-ভাত আছে।

চন্দ্র হাসে। আরো জোর গলায় বলিল, আমরা রোজ ঘোড়ার মাথা খাই। ডাল-ভাত হলে চলবে না। রোজ রোজ অশ্বমেদ জগৃগি করে চন্দ্র কোটাল।

তারপর প্রাণ-মাতানো হাসি। মস্ত দহলিজ গুঞ্জরিত হয়।

চাচা, খাওয়ার আগে তোমার মাকে তামাক দিতে বলো। নেশা চটে গেল।

পাঁচ মিনিট পরে কল্কে আনিয়া দিল আমজাদ। কাঠকয়লায় বোঝাই। আমজাদের কচি হাতে উত্তাপ লাগে।

শিগগির আমার হাতে দাও।

চন্দ্র দুই তালুর মাঝখানে কল্কে চাপিয়া তারপর দম দিতে থাকে। দুই চক্ষু বুজিয়া আসে নেশায়।

আমজাদ বিস্ময়ে এই লোকটির দিকে বারবার তাকায়। অতিকষ্টে হাসি চাপিয়া রাখিতে হয়।

একটু পরে চক্ষু খুলিল কোটাল।

দহলিজের সম্মুখে দুইটি নিমগাছ বাতাসে দুলিতেছিল। একটি চারা তালগাছ কোটালের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ছোট ছোট কচি মোচা বাহির হইয়াছে গাছটির।

কল্কে দাওয়ার উপর রাখিয়া চন্দ্র কহিল, চাচা, তালগাছটা তোমাদের?

আমজাদ মাথা দোলায়।

আহ্ খাসা মোচা বেরিয়েছে। বাঁশগাছ আছে তোমাদের?

কত আছে। দুটো ঝাড়ে পঞ্চাশখানা বাঁশ, সেদিন বাপ গুনছিল।

তা হল বটে–তোমার বাপ বেরসিক। কী মিঠে তাড়ি হয় এই গাছের, চাচা। বাঁশ লাগিয়ে আগডালে উঠে ভাঁড় বাঁধতে যা মজা। কিন্তু তোমার বাপ… হতাশ হইয়া চন্দ্র মাথা দোলাইল।

আমাদের যে তাড়ি খেতে নেই।

গোঁপে তা দিয়া চন্দ্র ঠোঁটে হো শব্দ করে।

বড় হলে খেতে আছে, বাবা। তোমার বাবা একটা আস্ত—

আমজাদ প্রতিবাদ করিল না।

আর একবার কল্কে তুলিয়া লইল চন্দ্র। তারপর এলোপাথাড়ি টান। আমজাদের চোখে ধোঁয়া লাগে। বিরক্ত হইয়া সে চোখ বুজিল।

তোমার বাবা

এই বার চোখ খুলিল আমজাদ।

তোমার বাবা, আজ আর আসবে না।

বিশ্বাস হয় না : আমজাদের।

শিশুসুলভ কণ্ঠে সে বলিল, না, বাপ এবার কোথাও বিদেশে কাজে যাবে না। গাঁয়ে গেছে, এখনই ফিরবে।

চন্দ্র কোটাল শিস দিতে দিতে গুনগুন শব্দ করে। এককালে ভাঁড়-নাচের দলে ছিল। তার প্রহসন-লীলায় হাসির চোটে দর্শকদের নাকি দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হইত।

চন্দ্র গান করে গুনগুন শব্দে।

আমজাদের কৌতূহলের অন্ত নাই। এই লোকটিকে তার ভয়ও লাগে। তবু সে নিঃশব্দে চন্দ্র কোটালের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিল।

চাচা!

উচ্চকিত আমজাদ জবাব দিল, কী চাচা?

তোমার বাবা ঘরে আছে তো?

হ্যাঁ। ভিনগাঁয়ে যায়নি, বলছি তো বারবার।

তবু একটু অপেক্ষা করি। আর এক কল্কে সেজে আনো।

আমজাদ দ্বিরুক্তি করিল না।

যথাশীঘ্র সে ফিরিয়া আসিল।

উল্লসিত হয় চন্দ্র। আবার পান-সুপারি আনিয়াছে আমজাদ।

দুইজনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপের বিনিময়ে মশগুল।

এমন সময় আজহার আসিয়া উপস্থিত হইল।

চন্দ্র তামাক যুঁকিতেছিল চোখ বুজিয়া। আজহারকে সে দেখিতে পায় নাই।

আমজাদ আনন্দিত হইয়া ডাকে, ঐ আব্বা এল।

এসো, এসো, খাঁ সাহেব —

চন্দ্র আজ সম্মান দেখাইতে তৎপর। বিড়া ছাড়িয়া সে উঠিয়া পড়িয়াছে। আজহার খ হাসে।

কি চন্দর, হঠাৎ কী মনে করে?

কখন থেকে বসে আছি। ডুমুর ফুলের খোঁজ নেই।

আজহার চন্দ্রের নিকট হইতে কল্কে লইয়া টান দিতে লাগিল।

ঘরে বসে থাকলে চলে, ভাই? পেটের ধান্দায় সকাল থেকে থেকে ঘর-ছাড়া।

কোথা গিয়েছিলে, শুনি?

খাঁ সাহেব জমিদারদের বাড়ি। হাতেম বখশ খ একটা কবর তৈরি করাবে নিজের। কত ইট-চুন লাগবে–তাই ডেকেছিল।

ওটা কি মরবে নাকি শিগগির?

কোনো জমিদারের পেছনে এমন অসম্মানসূচক কথা আজহার পছন্দ করে না। একটু বিরক্ত হয় সে।

একটু খাতির রেখে কথা বলো। ওটা কী বলছ?

যেন কত অনুতপ্ত, তারই ব্যঙ্গ-অনুসৃত কণ্ঠে চন্দ্র বলে, হ্যাঁ, মুরুব্বি লোক, পঞ্চাশ ষাট বয়স, খাতির করবো বৈকি। সত্যি মরবে?

রাখো তোমার মশকরা। সবাই মরবে। আমি কি মরব না?

তুমিও তবে আগে থেকে কবর খুঁড়ে রাখো।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আজহার। সে সৌভাগ্য তার নাই।

বহুত টাকা খরচ করবে, ভাই। তিন দিকে ইট, একদিকে শাদা মার্বেল পাথর।

তা তো করবেই। আমাদের বেঁচে খরচ করতে প্রাণ যায়, ওরা মরেও আমাদের জন্য খরচের রাস্তা তৈরি করে রাখে।

আজহার খাঁর মাথায় এত প্যাঁচওয়ালা কথা সেঁধোয় না। নির্বোধের মতো সে বলে, প্রায় দুহাজার টাকা খরচ। তারপর আবার বাগান হবে চারিদিকে। সেও আর এক হাজার।

বিস্মিত হয় চন্দ্র। বিজ্ঞের মতো জবাব দিল সে : আমার মণখানেক কাষ্ঠ দরকার। ব্যাস। আর নদীর ধারে একটা দেশলাইয়ের কাঠি খরচ। যদি অপঘাতে মরি– তাও খরচ নেই। স্বজনদের মেহনত খরচ হবে খানিকটা।

বাজে কথা রাখো। কেমন মাছ ধরছ জোয়ারে?

সেইজন্যে তো এলাম। মাছ ধরে কী হবে। এবার বর্ষায় দেখবে খুব মাছ পড়বে। কিন্তু সব তো নিয়ে যাবে পাইকের। ওদের অবস্থা দেখো। আমরা মাছ ধরি, পেটে ভাত জোটে না, ওরা পাকা দালান তোলে।

কী করতে চাও?

জিজ্ঞাসু নয়নে চন্দের দিকে তাকায় আজহার।

কিছু পুঁজি দরকার, ভাই। তাহলে আমি নিজেই রেল ইস্টিশনে গিয়ে মাছ বেচে আসতাম। পাঁচ-সাত সের মাছ নিয়ে খরচ পোষায় না। আরো দশটা লোকের মাছ জড়ো করলে এক মণ দু-মণ মাছ নিয়ে বেশ লাভ পাওয়া যেত।

আজহারের মুখের উপর দিয়া কালো রেখা পড়ে।

পুঁজি–পুঁজির কথা বলছ? সেই তো মুশকিল।

বেশি টাকার দরকার নেই। পঞ্চাশ হোলেই চলে। তুমিও কিছু দাও, খা ভাই। ভাগে ব্যবসা করা যাক।

ভয়ানক উৎসাহিত চন্দ্র।

কয়েক মিনিট চুপচাপ বসিয়া রহিল আজহার। কোনো জবাব নাই তার মুখে।

কী খাঁ ভাই, কিছু বলছ না যে

একরূপ সন্দেহার্ত দৃষ্টি ফেলে চন্দ্র।

কি আর বলব! পঁচিশ-তিরিশটা টাকা থাকলে কি চুপ করে যাই? আমাদের অবস্থা দেখছ না? হাত জানে তো মুখ জানে না।

এইবার চন্দ্রও চুপ হইয়া যায়।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে।

আমারও তো ঐ দশা।

আজহার কথার সূত্র সংক্ষিপ্ত করে হঠাৎ।

তোমার এই ঝোঁক ধরল কেন? চাষ করে, ফুরসৎ পেলে মাছ ধরে বেশ তো দিন কাটছিল।

তা আর হবার জো নেই। চাঁদমণি ফিরে এসেছে।

চন্দ্রমণি কোটালের কনিষ্ঠ সহোদরা।

তোমার এখানেই থাকবে নাকি?

আরে যা ভাবছ তা নয়। স্বামী মরে গেছে। তিনটি ছেলে কোলে।

আজহার ইহার বিন্দুবিসর্গ জানিত না। সহানুভূতিপূর্ণ দুইচোখে কারুণ্য ফুটিয়া ওঠে।

কী হয়েছিল?

জ্বর ও বিকার।

ও। আজহার ঐ সংক্ষিপ্ত শব্দ তুলিয়া চুপ করিল।

তাই ভাবছি। রোজগারের পথ তো দেখতে হবে। ঘরও একটা বেশি নেই যে, মাথা গুঁজে থাকব। আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখতে পার না? কটা টাকা হলে দুজনেরই ভাগ্যপরীক্ষে হয়।

কে ধার দেবে, তাই ভাবছি। এত টাকা বিশ্বাস করবে কি?

দেখো চেষ্টা করে। আমরা মাছ ধরি, পাইকেররা তা শহরে বেচে পয়সাওয়ালা। যত টাকাপয়সা কি শহরে গিয়ে জমেছে?

তাই তো দেখছি!

চন্দ্র মাথা দোলাইল : আমার কাছে একটা ধাঁধা মনে হয়। আমরা ফসল করছি, গতর পুড়িয়ে মাছ ধরব, সব সেরা জিনিস শহরে ছুটছে। আমাদের পয়সাও হয় না, ভালো খাবারও জোটে না।

এই প্রশ্নের জবাব হঠাৎ আজহার খাঁর মাথায় খেলে : শহর থেকে যে কাপড় আসে, আরো কত জিনিস আসে তা দেখছ না? গাঁয়ের ফসল যায় শহরে। শহরের জিনিস আসে গাঁয়ে।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু তারা সুখে থাকে, আর আমাদের এই দশা কেন? আমরা কি মেহনত করি না? না গতর খাটাই না? আমরা যদি চাল না দিই, শহরের ব্যাটারা। খাবে কী?

আজহার উত্তেজিত চন্দ্রের দিকে চাহিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, তুমি তাহলে ন্যাংটা থেকো।

ন্যাংটা থাকব কেন? গাঁয়ে তাঁতিরা কাপড় বুনবে।

সেদিন আর নেই ভায়া। ঐ তো কঘর তাঁতি আছে, তাদের কাপড় কেউ ছোঁয়? অবস্থা দেখছ না তাদের? সব কপালের ফের!

চন্দ্র চুপ করিয়া গেল। তার মাথায় স্টেশনের পাইকাররূপে মাছ-বিক্রেতা হওয়ার স্বপ্ন তখনও মুছিয়া যায় নাই।

শহরেই তো সব। গাঁয়ের জমিদারের চেয়ে ঐ ব্যবসাদারদেরই টাকা বেশি। তালেব চৌধুরী লোহার কারখানা করে দেখছ ফেঁপে যাচ্ছে। হাতেম খাঁকে দশবার কিনতে পারে।

আজহার সায় দিল মাথা দোলাইয়া, কোনো মন্তব্য করিল না।

দুইজনে নিস্তব্ধ। নীরবতার দুঃসহ শাসন কেউ যেন আর অবহেলা করে না।

আমজাদ এতক্ষণ দুইজনের কথোপকথন শুনতেছিল, সেও কোনো কথা বলিতে সাহস করে না।

হঠাৎ উঠিয়া পড়িল চন্দ্র। সে বলে : আমার অনুরোধটা ভেবে দেখো, খা ভাই। বেলা হয়ে গেল, যাই–

নিরাশাক্ষুব্ধ কণ্ঠ চন্দ্র কোটালের। আজহার বহুদিন এমন দীনতা দেখে নাই তার। কোনো জবাব দিল না সে।

আজহার নীরবে দাঁড়াইয়াছিল। চন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া টান দিল, একটু এগিয়ে দাও, চাচা।

গাঁয়ের সরুপথে ডোবার উপর বহু শাপলা ফুটিয়াছিল। চন্দ্র কয়েকটি আমজাদের হাতে তুলিয়া বলিল, এবার বাড়ি যাও, ভারি রোদ্দুর উঠেছে।

আমজাদ বাড়ির পথ ধরিল। মাঠের সড়কে অগ্রসর হইতেছে চন্দ্র। তার শিসের শব্দে আমজাদ মুখ ফিরাইয়া দেখিল, হেলিয়া-দুলিয়া মন্থর চালে চন্দ্র হাঁটিতেছে। বোধহয় ফুর্তিতেই শিস দিতেছে। পৃথিবীতে যেন কোনো কিছু ঘটে নাই।

০৬-১০. আজহার প্রতিবেশী সাকের

সকালে আজহার প্রতিবেশী সাকেরের খোঁজ লইতে গেল।

পাশের পাড়া। ভিটা ছাড়িয়া সামান্য কলাবাগান হইতে বেশি সময় লাগে না। আজহার ভাবিতেছিল, সাকেরের কাছে টাকা আছে। সে পেশাদার লাঠিয়াল। খা বংশের মহিমা বরং একমাত্র সে বজায় রাখিয়াছে। চোয়াড়ে প্রকৃতির চেহারা সাকেরের। লম্বা ঘন গোঁপের উপর ভাটার মতো দুই চক্ষু শিশুর আতঙ্কের পক্ষে যথেষ্ট। এই সময় তার কাছে টাকা থাকা সম্ভব। মাত্র দুইদিন আগে রোহিণী চৌধুরীর কোনো তালুকে প্রজা ঠেঙাইতে গিয়াছিল সে। জমিদারদের কল্যাণে তার অবস্থা অন্যান্য প্রতিবেশী অপেক্ষা ভালো। দাঙ্গার জন্য আরো ভিন গায়ে তার ডাক পড়িত।

চোয়াড়ে হোক সাকের, কিন্তু আজহার খাঁর সম্মুখে সে ভারি বিনয়ী, খুব মোলায়েম কণ্ঠে কথা বলে। আজহারের ধারণা সাকের তাকে শ্রদ্ধা করে। কোনোদিন তার কাছে টাকা হাওলাত করিতে যায় নাই। মুখের কথা সে অবহেলা করিবে না সহজে। আর চন্দ্রও যেমন বেয়াড়া! তার সঙ্গে বন্ধুত্বের জুলুম সহ্য করিতে কোনো কষ্ট হয় না।

সাকের ঘরে ছিল না। তার মা আজহারকে দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বলিল, আমার পেটে এমন ডিংরে ছেলে জন্মল, বাবা। আর পারি নে। লাঠিখেলা কেন যে শিখেছিল। এক দণ্ড শান্তি নেই। ও দাঙ্গা করতে যাবে, আর এদিকে আমাদের শাশুড়ি-বৌয়ের পেটে ভাত সেঁধোবে না।

সাকের কোথা গেছে, চাচি?

কাল সন্ধ্যায় বেরিয়েছে আর দেখা নেই।

উদ্বিগ্ন আজহার প্রশ্ন করে, দাঙ্গায় যায়নি তো?

না। লাঠিটা ঘরে রয়েছে। ঐ বাঁধানো লাঠি ছাড়া সে বেরোয় না। কিন্তু কোথা যে গেল!

আজহার নীরব। নিরাশার আঘাতে বারবার চন্দ্রের মুখ তার মনে পড়িতে থাকে। চন্দ্রটা এমন–

সাকেরের মা সংসারের কথা জুড়িল।

ছেলেমানুষ বৌটা তেমনি হয়েছে। ভয়েই মরে। চাষবাস করে খেতে বল, নিজের মানুষকে হাত কর। তা না। খালি দিনরাত ছেলের জন্য কান্না। কাঁচা বয়েস। ছেলে হওয়ার সময় কি পার হয়ে গেছে, বাবা?

হঠাৎ সুপ্তোত্থিতের মতো আজহার জবাব দিল : না, আমাদের হাসুবৌর আর কত বা বয়েস। কুড়ি পেরোয়নি।

এখনই ছেলের জন্যে হাঁপাহাঁপি। দোয়া তাবিজ আমি কি কম করতে বাকি রেখেছি! তবে মাস দুই হল নিস্তার। কপালে যদি থাকে।

সব আল্লার মরজি, চাচি। তোমার আমার মতো গোনাগার বান্দা আর কী করতে পারে?

না বাবা, আল্লা মুখ তুলে চেয়েছে। তারপর চাচি জোর গলায় হাসিল।

জানো বাবা, অভাগীর বেটি বলে কী—

আজহার জিজ্ঞাসু নয়নে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।

বৌমা বলে, ছেলের মুখ না দেখলে ওসব লোক আর সংসারী হবে না। ও জোয়ান হওয়া অব্দি ভয়ে ভয়ে সারা জনমটা গেল। কি দিন কি রাত, বেঁচে সুখ নেই বাবা।

আজহার চুপ করিয়া শোনে, কোনো মন্তব্য করে না। তার দৃষ্টি প্রাঙ্গণের উপর। হঠাৎ মুখ অন্যদিকে ফিরাইতে সে বাধ্য হইল। সাকেরের স্ত্রী ঘাট হতে কলস কাঁখে ফিরিতেছিল। ভাশুরকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠানের লাউগাছের ঈষৎ আড়ালে আড়ঘোমটা টানিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

নিজকে বিব্রত মনে করে আজহার খাঁ। সত্যই বড় কাঁচাবয়স সাকেরের স্ত্রীর। মুখখানা ভারি করুণ মনে হয়। পূর্ণ যুবতী, তবু মুখের আদলে সজীবতা নাই। যৌবনের শ্যামস্পর্শ যেন ক্ষণেক উঁকি দিয়া বিদায় লইয়াছে।

উঠানে লাউগাছের মাচাঙ। সূর্যের আলো সেঁধোয় না, নিচে এমন ঘন লতার পরিবেশ। দুই-একটি লাউ ঝুলিতেছে মাথার উপর। গোড়ার দিকে দশ-বারোটি সর্পিল রেখার আলিঙ্গন মাটির বুকের সহিত। সাকেরের স্ত্রীর কাপড়ের কোনো কোনো অংশ দেখা যায়।

আজহার যেন কত বিপদে পড়িয়াছে। বেগানা আওরতের সম্মুখে এমনভাবে বসিয়া থাকা শোভন নয়। সে উঠি-উঠি করিতেছিল। কিন্তু সাকেরের মার কথা আর ফুরায় না।

দোয়া করো, বাবা। বৌমার নিয়েৎ পুরা করুক খোদা।

আল্লার দোয়া। বান্দার কথায় আর কী হয়? মাঠে কাজ আছে, চাচি। আজ আর বসতে পারব না।

উঠিয়া পড়িল আজহার।

আচ্ছা, এসো বাবা। দরিয়াবৌকে এদিকে আসতে বলো। বৌমার মাস দুই হল, দরিয়াবৌর সাথে কতগুলো কথা আছে।

সাকের বাড়ি ফিরলে আমাকে একবার খবর দিও।

দুইপাশে কঞ্চির বেড়া। এই পথে কলাগাছের ছায়ান্ধকার জমিয়া উঠিতেছে। সূর্য উঠিতেছে তেজে। চারিপাশের আলো প্রখরতায় অস্পষ্ট জায়গায় অন্ধকার আরো ঘন মনে হয়। আজহার খাঁর মন নানা সন্দেহে দোলে। সকালটা কোনো কাজে আসিল না।

হঠাৎ চাচির খন্‌খনে গলার আওয়াজ শোনা যায়। ঘুলি-পথের উপর উৎকর্ণ আজহার থমকিয়া দাঁড়াইল। হ্যাঁ, চাচিরই গলার আওয়াজ বটে, দূর হইতেও স্পষ্ট বোঝা যায়।

হারামজাদী, ঘরে টাকাপয়সা নেই, সে বাড়ি থাকতে বললি নে কেন? মুখের হ্যাঁদা বুজে গেছে বুঝি?

আরো গালিগালাজের অগ্ন্যুৎপাত। চাচি আদৌ বৌকে দেখিতে পারে না, আজহার জানে। কিন্তু আজ সেজন্য বিশেষ মাথাব্যথা নাই তার। সাকেরের ঘরেও টাকা নেই। বুকটা দমিয়া গেল আজহার খাঁর। চাচিকে শান্ত করিতে সে আর একবার ফিরিয়া আসিত, সে উৎসাহও ধীরে ধীরে নিভিয়া গেল।

গোয়ালঘরে সামান্য কাজ বাকি ছিল। আজহার খাঁ আজ যন্ত্রচালিতের মতো তাহা সম্পন্ন করিল। চন্দ্র কোটালের কাছে একবার খবর দেওয়া দরকার। সে আশায় আশায় থাকিবে। পাড়ার আর কারো কাছে হাত পাতা নিরর্থক। গফুর খাঁর গঞ্জের দোকান দিন দিন ফাঁপিয়া উঠিতেছে। তার পুরাতন ঋণ দুই বছরে শোধ হয় নাই। সে পথও রুদ্ধ। আরো কয়েকজন সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিবেশীর কথা মনে পড়িল আজহার খাঁর। কিন্তু চারিদিকে খটকা।

দরিয়াবিবি পূর্বতন শ্বশুরবাড়ির দুইটি দুল আনিয়াছিল। গত বৎসর আমজাদ ও নঈমার অসুখে তা-ও পোদ্দারের দোকানে বাঁধা পড়িয়াছে।

চন্দ্র হুঁশিয়ার লোক। ব্যবসায় কপাল-খোলা বিচিত্র নয়। কিন্তু রুদ্ধ অদৃষ্টের কপাট খুলিতে সামান্য কুঞ্জিকার কথা, আজহার ভাবিতে পারে না।

মাঠের পথে চিন্তা-ভারাক্রান্ত মনে সে উপায়ের কল্পনা করিতে লাগিল। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমিয়াছে। সূর্যের আলো পলাতক। বর্ষাকাল, যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামিতে পারে। এই মনে করিয়া আজ গরু মাঠে ছাড়িয়া দেয় নাই আজহার।

সে কোটালের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়াছে এমন সময় দমকা বৃষ্টি নামিল। দুপুরে গোসল করিতে হইবে, তাই বৃষ্টির কোনো তোয়াক্কা রাখে না আজহার। সোজাসুজি সে গাঙের ধারে আসিয়া থামিল। চতুর্দশীর জোয়ারের সময় চন্দ্র ঘরে থাকার বান্দা নয়। তা ছাড়া মাছ ধরা একটা নেশা কোটালের।

খালের দুই ধারে ঝাপসা গাছপালা। ঝমঝম বৃষ্টি ঝরিতেছে। কোনো জনপ্রাণী চোখে পড়ে না। সকলেই বোধহয় আশ্রয়ে ঢুকিয়াছে। বামে ডিঙি নড়ার ঠকঠক শব্দ শোনা গেল। উৎফুল্ল হইয়া ওঠে আজহার। চন্দ্র ছোট্ট পিনিসের উপর দাঁড়াইয়া জাল গুটাইতেছে। নৌকার গলুই একটি বাঁশের সঙ্গে বাঁধা। স্রোতের টানে বাঁশ ও কাঠের সমবায়ে একরূপ ঘর্ষণধ্বনি বৃষ্টির আওয়াজকে ছাপাইয়া উঠিতেছে।

আজহার হাঁকিল, চন্দর!

খালের দুই পাড়ে তার প্রতিধ্বনি ছড়াইয়া পড়ে।

সামান্য বৃষ্টির প্রকোপ মন্দীভূত। মেঘ হুড়ম-হুঁড়ম করিতেছে।

বোধহয় হাঁক চন্দ্র শুনিতে পায় নাই। আজহার নিজেই তার কাছে আগাইয়া আসিল। লম্বা বেড়াজালে জোয়ারের পূর্বে খালের মুখ ঘিরিয়াছিল চন্দ্র। ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার জাল গুটাইতেছে। বড় শান্ত সে। দুই বাহুর পেশি স্পষ্ট ফুলিয়া উঠিয়াছে। তার দৃষ্টি শুধু জালের দিকে।

চন্দ্র চোখ না তুলিয়াই বলিল, খাঁ ভাই, একটু দাঁড়াও।

জাল গুটানো সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আফসোস করে, না ভাই, মজুরি পোষাল না। অনেকক্ষণ খাটছি।

মাত্র সের দুই মাছ পড়িয়াছে। দশ-বারোটি তপসে মাছ কেবল চন্দ্রের চোখে আনন্দের প্রলেপ টানিয়া যায়।

ভাবছিলাম, খিয়ে জাল দিয়ে আর একটু চেষ্টা করা যাক। না, তুমি এসেছ ভালোই হল।

দুজনেই বাড়ি অভিমুখী। চন্দ্র শীতে কাঁপিতেছিল। অনেকক্ষণ সে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়াছে। কোটাল-পুত্র তাই নির্বাক। মাছভরা খালুই হাতে দ্রুত হাঁটিতেছিল সে।

পা চালাও, খাঁ। একটান তামাক না টানলে আর নয়। জননী-৫

পিছল পথে সাবধানে পা ফেলে আজহার। বৃষ্টি এখনও সম্পূর্ণ থামে নাই। পাখির পাখনা-ঝাড়া ধোঁয়ার মতো ইলশেগুঁড়ি আকাশ হইতে ঝরিতেছে।

উঠানে হাঁকাহাঁকি করে চন্দ্র : সাজো, সাজো।

হাসিমুখে এলোকেশী ও চন্দ্রমণি বাহির হইয়া আসে।

দাদা যেন যুদ্ধের হাঁক ছাড়ছে।

এলোকেশী বোঝে, কী সাজিবার হুকুম কোটাল রাজার। সে আর দাঁড়ায় না, দাওয়ায় চন্দ্রমণিকে একটি আসন আগাইয়া দেওয়ার হুকুম দিয়া সে চলিয়া গেল।

এই চন্দ্রমণি! আজহার অবাক হইয়া যায়। মাঠে আসিয়া সে বহুদিন চন্দ্রের এই সহোদরাকে দেখিয়াছে। পাতলা চেহারার গঠন, ফরসা রঙ, বয়সে সে চন্দ্রের অনেক ছোট। অগ্রজই বহু চেষ্টা করিয়া তার বিবাহ দিয়াছে। কিন্তু এ কী ছিরি হইয়াছে তার। পাটকাঠি বা পাকাটির মানবিক সংস্করণ যেন গায়ে নাজেল হইয়াছে।

আমার কাপড়চোপড় ভিজে গেছে মণি, খড়ের বিড়েটা আর নষ্ট করব না। এমনি বসছি। কিন্তু তুই এমন হয়ে গেছিস্ কেন?

কপাল ভাঙলে আর কার গতর ভালো থাকে, দাদা!

আজহার চুপ করিয়া গেল। পঁচিশ পার হয় নাই, ওই কচি মেয়েটা আল্লার কাছে কী গোনাহ্ করিয়াছিল, যার শাস্তি এমন নির্মম! আজহার এদিকে ধর্মপ্রাণ বুদ্ধি দিয়া যার নাগাল পায় না, সেখানে আল্লার মক্করের সন্ধান সে সহজেই লাভ করে।

জ্বর হয় তোর, মণি?

আজহারও মুষড়াইয়া যায়। আল্লার বান্দার বেশিরভাগ এই একই দশায় উপনীত! গাঁয়ের দশটা ঘর খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল, অভাব-অনটনপ্রসূত কোনো ঝঞ্ঝাট যেখানে অনুপস্থিত।

ম্যালেরিয়া জ্বরে দুমাস ভুগছি। তবে শরীর আগে থেকেই খারাপ।

দাওয়ার এককোণায় চন্দ্রমণি বসিয়া পড়িল। শাদা থানকাপড় পরনে। তার ফ্যাকাশে রক্তহীন শরীরের সঙ্গে রঙের ভালো সামঞ্জস্য হইয়াছে।

দুইটি উলঙ্গ কালো ছেলে চন্দ্রমণির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আজহার ইহাদের। আগে দেখে নাই।

পিতৃহীন অনাথদের পরিচয় তার অনুমানের কাছে অজানা নয়। তবু সে জিজ্ঞাসা করে : তোমার ছেলে না, মণি?

হ্যাঁ, দাদা। বড় গোপালের বয়স মোটে পাঁচ। যোগীন তিন বছরের। ওদের নিয়েই তো আমি জ্বলেপুড়ে মরলুম। একটা কানাকড়ি যদি বিধবা হওয়ার সময় রেখে যেত–

চন্দ্রমণির কোটরাগত নিষ্প্রভ চক্ষু হইতে টস্ট পানি পড়ে। গোপাল ও যোগীন মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া থাকে।

চন্দ্রমণি আচ্ছন্ন চোখেই আবার বলিল, দাদা ছিল বলে মাথা গোঁজার ঠাই আছে। কিন্তু দাদার অবস্থা তো দেখছ, ছেলেপুলে মরে গেল। তার ওপর আবার আমার বোঝা।

শুকনা গামছা পরিয়া কল্কেয় দম দিতে দিতে চন্দ্র বাহিরে আসিল। তার চোখ পড়ে মণির উপর।

এই আবার প্যানপ্যান শুরু করেছিস। এই মণি, অমন করবি তো যা নিজের জায়গায়। দেখ না আজহার ভাই, ওর হয়েছে কী। আমি তো মরে যাইনি।

চন্দ্র ধমক দিল আবার : যা উঠে, কিছু হয়নি। খেটে খেটে আমাদের জন্য শরীরটা কী হচ্ছে!

ভাগ-ভাগ– আর মুখ খুলিস নি। কী হয়েছে আমার শরীরের?

আজহারের হাতে কল্কে দিয়া চন্দ্র হাতের পেশি ফুলাইয়া বলে : দ্যাখ, মণি দ্যাখ। ঘুষি মেরে কোন্ বাপের ব্যাটা এটা নোয়াক দেখি।

মলো যা-যা রান্নাশালে।

গোঁফে তা দিয়া চন্দ্র ঠোঁট বাঁকাইল।

এলোকেশী চন্দ্রমণির হাত ধরিয়া টান দিল। সে বলিল : চলো না ঠাকুরঝি। ভাইবোনে আর সতীনের ঝগড়া দরকার নেই।

মৃদু হাসি এলোকেশীর ঠোঁটে।

যা-যা, নিয়ে যা শিগ্‌গির।

যোগীন মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে থাকে।

তুমি হাসছ! দেখি পাঞ্জা ধরো তো।

তিন বছরের শিশু। ভয় পায় না সে। কচি পাঞ্জা বাড়াইয়া দিল যোগীন।

গোপাল বড় নীরিহ। সে ছোটভাইয়ের খেলা দেখে। ভয়ে গোপাল মামার কাছে ঘেঁষে না।

এইরকম করে লড়তে শেখ বেটা। বড় হলে ডাকাতি করবি।

আজহার ঠোঁট হইতে কল্কে নামায়।

বেশ তালিম দিচ্ছ ভাগনেকে।

চন্দ্র লম্বা গোঁপে তা দিল একবার।

সত্যি, ডাকাত করব ছেলেগুলোকে। লুটেপুটে খাবে, খেটে তো খেতে পাবে না। নিজেও ডাকাতের দলে ঢুকব।

আজহার ভাবে, চন্দ্রের মাথায় ছিট আছে। তবু চুপ করিয়া যায় না সে।

তুমিও ডাকাতি করবে?

করব না? এত মেহনত করে লাভ কী? ধম্ম-উম্ম-ভগবান ওসব মানিনে। খেটে খেতে না-পাওয়ার চেয়ে চুরি করায় পাপ নেই।

আজহারের চোখ কপালে উঠিতেছে যেন।

কী সব বকছ, চন্দর!

সত্যি বলছি, মনমেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। তুমি বিশ্বাস করো ভগবান আছে, আল্লা আছে?

তৌবা, তৌবা, তৌবাস্তাগফের।

আজহার মনে মনে দরুদ শরিফ পড়িতে লাগিল।

যোগীন মাতুলের সঙ্গে তখনও পাঞ্জা লড়িতেছে।

চন্দ্র কোটালের মুখ বন্ধ থাকে না : আমরা খেটে খেতে পাই না। ওরা বসে-বসে তামাক ফোঁকে, গদিতে শুয়ে খেতে পায়। বলে, ভগবানের ইচ্ছে, কপাল! তেমন অবিচারী ভগবানে আমার দরকার? লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা।

গঞ্জে মেড়ো ব্যবসায়ীদের নিকট চন্দ্র হিন্দি জবান শোনে। আজ তার সুযোগ গ্রহণ করিল।

চন্দ্র যোগীনকে তাল দিতে শেখায়। গান করে সঙ্গে সঙ্গে : লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা। লুট করেঙ্গা

আজহার খাঁর মুখাবয়বের উপর চন্দ্রের দৃষ্টি পড়ামাত্র গান থামিয়া গেল।

গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিয়াছে আজহার খাঁ।

হাত বাড়াইয়া দিল চন্দ্র তার দিকে। বলিল, রাগ করছ? আচ্ছা, এখন আসল কথা পাড়া যাক।

জিজ্ঞাসা করে আজহার, কী কথা?

কী বলেছিলাম?

সে-প্রশ্ন এতক্ষণ আজহার খাঁর মনে কোনো চিহ্ন বজায় রাখে নাই। নিতান্ত নির্বোধের মতোই সে উত্তর দিল।

কী বলেছিলে?

একচোট হাসিয়া লইল চন্দ্র।

তা আর মনে থাকবে কেন। মাছ-ব্যবসা তোমার সঙ্গে?

আরো অপ্রতিভ হয় আজহার খাঁ।

লজ্জায় সে অস্পষ্ট কণ্ঠেই জবাব দিল, জানো তো আমার অবস্থা। টাকাও ধার পাওয়া গেল না।

খামাখা এতক্ষণ আমার সঙ্গে তর্ক জুড়েছিলে। চোখে চেয়ে দ্যাখো না। পেট চলে, ব্যবসা করব। তা একটা কানাকড়ি পুঁজি নেই।

তারপর চন্দ্র চুপ করিয়া গেল। চন্দ্রমণি নিঃশব্দে আসিয়া তাহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। সে-ই নীরবতা ভাঙিল।

–দাদা, মাছের ব্যবসার জন্য যোগীনের বাবারও খুব ঝোঁক ছিল।

চন্দ্র হুঁ শব্দে সায় দিল মাত্র।

যোগীনের মামার সঙ্গে খেলা বন্ধ। সে অভিমানীর মতো বসিয়া আছে। চন্দ্র তার দিকে দৃষ্টি ফেলিয়া জোরে হাসিয়া উঠিল।

এই ছোটমামা, আমাদের যুক্তি আঁটাই রইল। না, আর ব্যবসা করব না। চাষবাষ করব না।

আজহার মনে করে চন্দ্র তার উপর বিরক্ত। খটকা মুছিয়া ফেলিবার জন্য সে সরস কণ্ঠেই বলিল, আমার উপর রাগ করো না, চন্দর। গেল দুবছর কী করে যে সংসার চালিয়ে নিয়ে আসছি, আমিই জানি।

চন্দ্র যোগীনের মাকে আর এক কল্কে তামাক আনিবার জন্য আদেশ করিল।

তোমার উপর রাগের কী আছে। রাগ সব ওই-যে তুমি কী বলো–কপাল, কপালের উপর।

আজহার ভিজা কাপড়ে বসিয়াছিল। সে যেন কত অপরাধ করিয়াছে। সহজে চন্দ্রের দাওয়া হইতে উঠিতে পারিতেছিল না।

চন্দ্রমণি গগনে এক কল্কে আগুন লইয়া হাজির হইল। আজহার নির্জীবের মতো দুএক টান দিয়া কল্কে আবার প্রত্যর্পণ করিল।

খাঁ, চলো, জমির ধানগুলো দেখে আসি। তুমিও বাড়ি যাবে।

দুজনেই সড়ক ধরিয়া অগ্রসর হয়। চন্দ্রের হাতে দুটি লালগোঁফ তপসে মাছ। আজহার আনমনা, কোনো দিকে তার দৃষ্টি নাই। কোটালের কোনো সাহায্য করিতে পারিল না, এই চিন্তা তার মনে কোথায় যেন বিধিতে থাকে।

চন্দ্র বেপরোয়া। সে তার স্বকীয় পদক্ষেপের ভঙ্গি বিস্মৃত হয় না।

বৃষ্টির পর দিগন্তের আবিলতা মুছিয়া গিয়াছে। শাদা বকের দল বিলের ধারে কোলাহলরত। খালের তীরে নলখাগড়ার ঝোঁপের পাশে একটি মাছরাঙা বাসা হইতে গলা বাড়াইয়া আবার সন্ত্রস্ত নীল আকাশে মিশিয়া গেল নিমেষে। চন্দ্র কোটালের চটুল চাহনি এক জায়গায় স্থির থাকে না।

আজহার পেছনে-পেছনে হাঁটিতেছিল। হঠাৎ চন্দ্র পাশ ফিরিয়া চাওয়ামাত্র আজহার ধরা-গলায় বলে : চন্দর, মনে করিসনে কিছু, ভাই। আমারও বরাত। কপাল তো খুলল না। ব্যবসা করে একবার দেখা যেত।

চন্দ্র কোটাল অবাক।

নিশ্চয় রাগ করব। তপসে মাছদুটো যদি ছেলেপুলে নিয়ে ভেজে না খাও, রাগ করব না?

হাসিমুখে চন্দ্র আজহারের হাতে মাছদুটি খুঁজিয়া দিল।

চন্দ্র কোটালের মনে চন্দ্রমণি, সংসার, যোগীন, পোপাল সকলে এক-একবার উঁকি দিয়া যায়। দুঃখের পশরা যেন হালকা হইয়া গিয়াছে। আজহারের সঙ্গ তার আরো ভালো লাগে।

আজহার ভাই, তোমার সঙ্গে একবার বিদেশে যাব। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখিয়ে দাও সামান্য।

আজহারের নিকট হইতে কোনো জবাব আসিল না। চন্দ্র তার বিষণ্ণ মুখের দিকে একবার মাত্র চাহিয়া নীরবে হাঁটিতে লাগিল।

একটা শাদা গাঙচিলের তীক্ষ্ণ স্বর প্রান্তরে মূছীহত স্বপ্নিল আবেশের মতো বিলীন হইয়া যায়।

.

০৭.

কয়েক কাঠায় আউশ ধান দিয়াছিল আজহার।

বর্ষার মাঝামাঝি পাকা রঙ ধরিয়াছে আউশের ধানে। হঠাৎ সে রাজমিস্ত্রির কাজে কনিক ইত্যাদি লইয়া ভিনগায়ে চলিয়া গেল। সমস্ত সংসার রহিল দরিয়াবিবির উপর। পূর্বে বিদেশে যাওয়ার আগে আজহার খাঁ শলাপরামর্শ করিত স্ত্রীর সহিত। এবার কোনো কথা সে উচ্চারণ করে নাই। দরিয়াবিবি আজহারকে যন্ত্রপাতি লইতে দেখিয়াছিল। কোনো ভিনগাঁয়ে যাইতেছে সে, এমন ধারণা দরিয়াবিবির মনে ঘুণাক্ষরে উদিত হয় নাই। পরে আমজাদ আসিয়া খবর দিয়াছিল। পিতার বিদেশযাত্রার সংবাদ শুধু সে-ই প্রথমে অবগত হয়।

তুই ঝুট বলছিস, আমু।

না মা। আব্বা বললে, কোথায় নিয়ামতপুর আছে, সেখানে কাজে যাচ্ছে।

অবেলা সঙ্গীদের সঙ্গে আমজাদ তেপান্তর-জরিপে বাহির হইয়াছিল। আকস্মিক সাক্ষাৎ পিতা-পুত্রে। নিতান্ত দৈবাতের যোগসাজশ মাত্র।

দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এমনও লোক সংসারে আছে! বিদেশে যাইতেছে, তা-ও বাড়ির লোকদের একটু খবরমাত্র দেওয়া প্রয়োজন মনে করিল না।

হুই ইস্টিশনের দিকে গেল। মা, আব্বাকে দেখলে একটা পাগল মনে হয়। মুখে কথা নেই। মাথা গুঁজে চলেছে তো চলেছেই। হুঁসগুস নেই।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে এতটুকু দাগ পড়িল না।

মা, কী হাসি লাগে আব্বার ছিরি দেখলে। লুঙিটা পর্যন্ত ভালো করে পরতে জানে না। কোনোরকমে কোমরে গুঁজলেই বুঝি কাপড় পরা হয়? তার উপর ছেঁড়া পিরহান।

দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল দরিয়াবিবি।

যা, আর কথার খৈ ফোঁটাতে হবে না।

আমজাদ কেঁচো বনিয়া গেল।

দরিয়াবিবি লক্ষ্য করে, সন্ধ্যা নামিয়া আসিতেছে। ঘন কৃষ্ণপক্ষ। আজ আর চাঁদ উঠিবে না সড়কের উপর। ইস্টিশনের পথ অনেক দূর।

তোকে আর কিছু বলেনি, তোর আব্বা?

আমজাদের ত্রস্ত-সঙ্কুচিত চিবুক ছুঁইয়া দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল। পিতৃহীন কোনো অনাথের চিবুক যেন স্পর্শ করিতেছে দরিয়াবিবি। কণ্ঠ তার নুইয়া পড়ে ভাবাবেগের আতিশয্যে। হঠাৎ এমন দীনতার প্রলেপ তার মনে ও শরীরে! অসোয়াস্তি অনুভব করে জননী। বালকপুত্রের জবাব আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিশিয়া যায়।

খলিল বলিল, আমু, কাজে যাচ্ছি নিয়ামতপুর।

নিয়ামতপুর কোথা মা?

দরিয়াবিবি কোনো উত্তর দিল না। আজ ক্ষোভ হয় তার। হিংসা-উদ্ভূত ক্ষোভ। সমস্ত সংসারকে এমনই নির্বিকার চিত্তে সে দেখিতে পারিত! রাত পোহাইলে শত কাজ, মনের চারিদিকে আরো সহস্র বেড়ির সর্পিলতা।

আমজাদ সম্মুখে না থাকিলে অবোধ বালিকার মতো কাঁদিয়া ফেলিত দরিয়াবিবি। দৃষ্টি নেপথ্যে মিলাইয়া, বালকপুত্রের উপর ঈষৎ ভর দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল সে স্থাণু প্রতিমার মতো।

নঈমা পিতার ন্যাওটা। পাড়ার কোনো বালকের মুখে সে বাবার বিদেশযাত্রার ৭০

কথা শুনিয়াছিল। তার কান্না আর থামে না। রোদন-আতুর কন্যার কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙিল দরিয়াবিবির।

মা, আমাকে আব্বা নিয়া গেল না। নঈমা চিৎকার করে।

চুপ। না হলে মার খাবি।

মার ধমকে নঈমা শান্ত হয়।

দরিয়াবিবি বলে, আমু, ওকে তোমার মতবের বইয়ের ছবি দেখাও।

তখনও সন্ধ্যা দেওয়া হয় নাই, দরিয়াবিবির খেয়াল ছিল না। তাই আবার বলিল, আমি ডিপে জ্বেলে দিচ্ছি, একটু সবুর কর বাবা।

নাচ-দুয়ারে প্রদীপ দেখাইতে আসিয়া দরিয়াবিবি গরুগুলির চেহারাও একবার দেখিয়া লইল। যদি বৃষ্টি না হয়, কিছুক্ষণ চরাটের জন্য ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। আমু ছেলেমানুষ। অপরের ফসলে না পড়ে, সে ভয়ও আছে। খোয়াড়ের পয়সা যোগানের ক্ষমতা যাদের আছে তাদের গরু-বাছুর ছাড়া থাকে ফসলের দিনেও।

নিমগাছের নিচে পোয়াল-খড়ের গাদাটি বড় অদ্ভুত ঠেকিল আজ দরিয়াবিবির। নিঃসঙ্গ মনে হয় ভিটের আশপাশ। প্রদীপ দেখাইয়া তাই তাড়াতাড়ি সে পুত্র-কন্যার নিকট ফিরিয়া আসিল।

একজোড়া পেঁচা উড়িয়া গেল। অমঙ্গলের আশঙ্কায় দরিয়াবিবির বুক দুরুদুরু করে। ছেলেদের কাপড় চুরি গেল কয়েকটি। হাত-ছাচড়ের উপদ্রবে রাত্রির ঘুম ব্যাহত হয়। পুরুষমানুষ ছিল ঘরে, তবু ভরসা। নিঃসঙ্গতা আর একবার হানা দিয়া গেল। বেলাবেলি গেরস্থালির কাজ শেষ হইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি আমজাদের পাশে বসিয়া তার পড়া শোনে : একদা দিল্লী নগরীর পথে।

নঈমা হি হি শব্দে হাসে : দিল্লী-বিলী হি-হি।

চুপ করে শোন্। গোলমাল করিসনে, নঈমা। বড় সজাগ আজ দরিয়াবিবির কান।

আমু পড়াশোনা করিতেছে, তার গোলমাল নেহাত কম নয়। তবু বেড়ার ধারে কি পৈঠার কাছে সামান্য শব্দ হইলে দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হইয়া পড়ে।

ধূসর ভবিষ্যৎ যোজন-বিসারী প্রান্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে। তার চারিদিকে শুধু রুক্ষতা; সবুজ রঙের ফিকে আভাস পর্যন্ত নাই। দৃষ্টি মেলিয়া দিলে চাচর বালুর অকরুণ হাসিই একমাত্র সত্যরূপে প্রতিভাত হয়।

দরিয়াবিবি কোনোদিন বাস্তবের সম্মুখে ভাঙিয়া পড়িতে শিখে নাই। আজ সামান্য ব্যাপারটুকু কেন্দ্র করিয়া এতকিছু ঘটিয়া গেল।

সপ্তাহ কবে শেষ হইয়া যায়, আজহার খর কোনো খবর নাই। পিয়নকে আমজাদ অনর্থক বিরক্ত করে। দরিয়াবিবিও চিন্তিত হয়। অবশ্য আউশ ধান কাটা বাকি আছে। তার পূর্বে আজহার খাঁ নিশ্চয় বাড়ি ফিরিয়া আসিবে, দরিয়াবিবির মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

ধীরে ধীরে আরো দুই সপ্তাহ কাটিয়া গেল। সাকেরকে ডাকিয়া দরিয়াবিবি বহু খেদোক্তি করিল। জওয়ান মরদ বিদেশে গিয়াছে, তার জন্য এত ভাবনাচিন্তা ভালো নয়। এই উপদেশ দিয়া সে সরিয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি চারিদিকে অন্ধকার দেখে। হাত-খরচ শেষ হইয়া গিয়াছে। ছোট ছেলে আর মেয়ের মুখে দৈনন্দিন আহাৰ্যটুকু কি শেষে যোগাইতে পারিবে না, ধার-কর্জ করিয়া কতদিনই চলিবে?

দরিয়াবিবি উপায়ের খোঁজে অন্ধকারে হামাগুড়ি দিতে থাকে। ছাগলছানা দুটি থাকিলে দুর্দিনে কাউকে বিক্রয় করা যাইত। সে পথেও আল্লা বাধ সাধিয়াছেন। পুরুষমানুষ ঘরে থাকলে কোনো-না-কোনো পথের হদিশ মিলিত। বর্ষাকাল, পাড়া-প্রতিবেশীরা। কোনোরকমে দিন গুজরান করে। বীজধান খাইয়া অনেকে শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। এই সময় জন-মুনিশ লোকে কম খাটায়। চারিদিকে বিপদের বেড়াজাল। প্রত্যেকে আত্মবিব্রত। গরিব কৃষক-পল্লীর ভেতর সহানুভূতি বুক-ফাটা নিঃশ্বাসের রূপ ধরিয়া বাতাসে ধ্বনিত হয়। আর তিন-চার দিনের খোরাক আছে। তারপর?

পরদিন সাকেরের মার সঙ্গে দরিয়াবিবি দেখা করিতে গেল। বৃদ্ধার গণ্ডস্থল আনন্দে স্বচ্ছ হইয়া উঠে। হাসুবৌর নিয়ত আল্লা পুরা করিয়াছে এতদিনে। আনন্দে সাকেরের মা এই বয়সেও অস্থির হয়। দরিয়াবিবি ঠাট্টাচ্ছলেই দাওয়াতের কথা পাড়িয়াছিল। বৃদ্ধা শুধু রাজি হইয়া গেল না, রীতিমতো পীড়াপীড়ি শুরু করিল। দরিয়াবিবি আজ সরলচিত্তে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিতে পারে না। কোথায় যেন মনে ব্যাপারটা বেঁধে। ঘরে ভাত নাই, এমনদিনে দাওয়াত স্বীকার করিলে পাড়াপড়শীরা হীনচোখে দেখিবে। তবু রাজি হইয়াছিল দরিয়াবিবি। এক বেলার খোরাক অন্তত বাঁচিয়া গেল। আসেকজানও সেইসঙ্গে নিমন্ত্রিত হইয়াছিল।

এতদিন আসেকজানের প্রতি দরিয়াবিবির একরূপ করুণা-মিশ্রিত অবজ্ঞার ভাব ছিল। ইদানীং অন্য চোখে দেখে এই বৃদ্ধাকে। সংসারে নিজেদের অসহায়তার সঙ্গে আসেকজানের দশা সমান পাল্লায় ওজন করা চলে, দরিয়াবিবি তা গভীরে উপলব্ধি করিতে শিখিয়াছে। পূর্বে তার কোনো খোঁজখবরই সে লইত না। কখন খায়, ঘুমোয় বা অভুক্ত থাকে তার হিসাবের প্রয়োজন ছিল না দরিয়াবিবির। বর্তমানে মনের এই বোঝাবাহী প্রবৃত্তির তাড়না সে নিজেই অনুভব করে।

বর্ষায় আসেকজান বাহির হইয়া যায়। দাপাদাপি বৃষ্টি তোড় চলিতেছে, সে কিন্তু থামে না। হয়তো তার দাওয়াত থাকে অথবা থাকে না কিন্তু দাওয়াতের বাহানা সে যোলো আনা করে।

ঘরে চাল শেষ হইয়া আসিতেছে। আসেকজান সব খবরই রাখে। এই বিষয়ে আমজাদ তার সহায়। রাত্রিবেলা ঘুমাইতে গেলে আসেকজান খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া সব জিজ্ঞাসা করে।

জালায় আর বেশি চাল নেই, দাদি। মা কত রাগ করছিলেন আব্বার উপর।

আসেকজান প্রশ্নের জবাবে চুপ করে কিছুক্ষণ, আবার বলে : আজ পেটপুরে ভাত খেয়েছ?

হ্যাঁ, দাদি। মা কিন্তু ভালো করে খায় না।

আসেকজান স্তব্ধ হইয়া গেল আবার।

এমন সংলাপের বিনিময় চলে।

পরদিন জালার ভেতর হঠাৎ বেশি চাউল দেখিয়া দরিয়াবিবি আমজাদকে ডাকাইল।

দরিয়াবিবি : জালায় চাল এল কোথা থেকে?

আমজাদ : আমি কী জানি, মা।

দরিয়াবিবি ব্যাপারটা সহজে আন্দাজ করে। অন্যদিন হইলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র বাধিয়া যাইত। সকা-জাকাতের চালে তার শিশুদের জঠর-সেবা চলিতে পারে না। আজ দরিয়াবিবি নিজেই অন্যদিকে কথার স্রোত ফিরাইল।

তুই পিয়নকে জিজ্ঞেস করেছিলি, টাকা বা চিঠি কিছু নেই?

আমি রোজ জিজ্ঞেস করি, মা।

কাল আর একবার যাস।

মার কণ্ঠ এত মোলায়েম হইতে পারে, আমজাদের বিশ্বাস হয় না।

বড় মিষ্টি মনে হয় মার গলা : আমু, ধান পেকেছে নাকি দেখে আসবি কাল। মুনিশ করে কাটাতে হবে আর কী।

আমজাদ মাথা দোলাইয়া সায় দিল।

রান্নার জন্য মা চাউল মাপতে আসিয়াছিল। হঠাৎ আমজাদকে আদর করিতে আরম্ভ করিল দরিয়াবিবি। যেন কত কথা আছে আরো, তা আজ বলিয়া শেষ করা যায় না। তাই স্নেহের ছোঁয়াচে সমাপ্তি-রেখা টানা হইতেছে। মার চুম্বনে বিব্রত হয় আমজাদ।

বাইরে বাঁশবনে মির্মির শব্দ শোনা যায়।

পরদিন দুপুরে আমজাদ স্তম্ভিত হইয়া গেল। সামান্য অন্যায়ে মা এমন শাস্তি দিতে পারেন। মক্তবের বেতন চাহিয়াছিল সে। হয়তো মার মেজাজ ভালো নয়, সেইজন্য চাওয়া উচিত হয় নাই; কিন্তু জননী এমন বেদেরেগ হাত চালাইতে পারে, তার জানা ছিল না।

মার খাইয়া দাওয়ায় বসিয়া সে নীরবে অশ্রুপাত করিল বহুক্ষণ। নঈমা পাশে দাঁড়াইয়াছিল। অনুতপ্ত জননীকে যদি একটিবার পাওয়া যায়। দরিয়াবিবি শত কাল্লাম জুড়িয়াছিল। আজহার ও তার চৌদ্দপুরুষের চল্লিশার আয়োজন হইতেছিল দরিয়াবিবির ঠোঁটে। আমজাদ আনমনা অলক্ষিতে ভিটা হইতে সরিয়া পড়িল।

মাঠে আসিয়া সে শান্তি পায়। আজহারও এই প্রান্তরের বুকেই দীর্ঘশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারে। রক্তের শৃঙ্খলে বোধহয় আমজাদ বাঁধা পড়িয়াছিল।

সে অনেকক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল মাঠে মাঠে। আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল না। ঘুরিয়া বেড়াইতে কোনো বাধা নাই।

বেলা ঢলিয়া পড়িতে তার ভয়ানক ক্ষুধা লাগিল। বর্ষাকালে ধান ছাড়া অন্য চাষ নাই মাঠে। গ্রীষ্মের দিন হইলে তরমুজ-শশা খাইয়া আমজাদ মার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করিত। অদৃশ্য হাতের টানেই সে চন্দ্র কোটালের কুঁড়ের দিকে অগ্রসর হইল।

নদীর মোহনার কাছে একটা পিঠুলি গাছের তলায় বসিয়া আমজাদ আবার আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিল। চন্দ্রাকার বাড়ি সোজাসুজি যাইতে আজ বাধে। মনের আবহাওয়া অতটুকু খোকাও সহজে মুছিয়া ফেলিতে পারে না। চন্দ্রমণি একবার কলস-কাঁখে খালের ধারে আসিয়াছিল। আমজাদকে দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, এখানে বসে আছ যে–?

আমজাদ জবাব দেয় না। তার মুখ শুষ্ক। চোখের পাতার নিচে কান্নার শুষ্ক ছাপ।

রাগ করে এসেছ বুঝি বাড়ি থেকে?

চন্দ্রমণি ঠিকই আন্দাজ করিয়াছিল।

চলো, তোমার কাকা ঘরে আছে। কী হয়েছে?

আমজাদ শুধু মাথা হেঁট করিয়া থাকে। চন্দ্রমণির অনুরোধ সে রক্ষা করে না।

এই সময় চন্দ্র কোটালও আসিয়া উপস্থিত হইল।

কি রে চাঁদমণি। এই দ্যাখো না, দাদা। তোমার বন্ধুর ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে।

চন্দ্র আমজাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিল। সে নির্বাক নিশ্চল। তার কচি সুন্দর দুই চোখও দূরে উদাও।

হাসিয়া ফেলিল চন্দ্র।

আরে চাচা, গাছের তলায় শেষে তপ করতে বসেছ নাকি? তোমার বাবা বড় নামাজি-মুসল্লি। তার ছেলে।

আমজাদ কারো দিকে চায় না।

কোটালরা দুই ভাইবোনে খুব হাসিতে থাকে।

সিস দিয়া চন্দ্র গান ধরিল–

কথা কয় না।
আমার ময়না।

তবু আমজাদের ঠোঁটে কোনো আভাস নাই। চন্দ্র এইবার একটা সিস দিয়া সুৎ শব্দ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমজাদকে পাঁজাকোলা করিয়া একদম কাঁধে তুলিয়া লইল।

মৌনী বাবা এবার ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কান্না শুরু করিল।

কথা কয় না।
আমার ময়না,
হায়, হায় রে ….

চন্দ্র খালের সড়কে হাঁটে।

চন্দ্রমণি ডাকে, ও দাদা, ছেলেটাকে দুটো মুড়ি খাইয়ে নিয়ে যাও।

মাথা দোলায়।

হ্যাঁ, বড় কথা মনে করেছিস, মণি।

কোটাল আবার ঘরের দিকে মুখ ফিরাইল।

.

০৮.

বৃষ্টি ঝরিতেছিল অঝোরে। মাঠের খোলা জায়গায় জমাট টুইটম্বুর পানির উপর আকাশের ছায়া পড়ে। বর্ষা থামিলেই শালিখ-চড়াই আসিবে স্নানের লোভে ছুটিয়া।

দরিয়াবিবি সদর ছাড়িয়া সড়কের ঘুলি-পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। জীবনে আর কোনোদিন সে এতদূর আসে নাই, মাথায় চটের থলি টোকার মতো করিয়া দেওয়া। পায়ের তলায় বৃষ্টিস্রোত বহিয়া যাইতেছে। চটের থলি পানি রোধ করিতে পারে না। ইতিমধ্যে উপরদিক ভিজিয়া গিয়াছে।

দরিয়াবিবি নির্বিকার দাঁড়াইয়াছিল। বেশ ঠাণ্ডা লাগিতেছে, তবু খেয়াল নাই। কার প্রতীক্ষায় সে দাঁড়াইয়া আছে?

সড়কের একপাশে গাছপালার নৈরাজ্য অল্প, তাই দূরে মাঠ দেখা যায়। অন্যান্য দিকে আকাট লতা আর গাছপালার জঙ্গল। মেঘমেদুর আকাশের আচ্ছাদনে নীরব নিবিড় পল্লীর এই বিজন কোলটুকু ভয়াবহ, প্রেতায়িত– সামান্য শব্দে চমক লাগে।

সড়কে দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া থাকে। চঞ্চল চোখ বারবার সড়কের দূরতম রেখায়। তার গম্ভীর মুখাবয়ব আকাশের বাদল যেন।

হঠাৎ দরিয়াবিবির দুই চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠে। দূরে একটি বালকমূর্তি দেখা গেল। আমজাদ দ্রুত পা ফেলিয়া অগ্রসর হইতেছে। একটিমাত্র লাল গামছা তার মাথায়।

বৃষ্টির পতন-রেখার ভেতর দিয়া তার বালকমূর্তি অপরূপ দেখায়। একটি পুতুল লাফাইয়া চলাফেরা করিতেছে।

দরিয়াবিবি আকস্মিক উৎফুল্ল হইয়া উঠে। আমজাদ তার নিকটে পৌঁছিবার পূর্বেই জিজ্ঞাসা করে, শৈরমীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

বৃষ্টিস্নাত তার সমগ্র শরীর। শীতে আমজাদ কাঁপিতেছিল। সহজে জবাব দিতে পারে না।

মার কাছে ঘেঁসিয়া সে হাঁফ ফেলে কিছুক্ষণ, তারপর বিষণ্ণমুখেই জবাব দেয় : না গো মা। তবে শৈরমী-ফুফুর জা বললে, সে মাঠ থেকে তোদের বাড়ি যাবে।

শৈরমী জাতে বাগদী। কৈবর্তপাড়ার ঠেস ছাড়াইয়া গেলে জনপদের একটেরে বাগ্‌দীদের বাস। শৈরমীর সংসারে একমাত্র পঙ্গু পুত্র জীবিত। বহুদিন পূর্বে তার স্বামী পরলোকে। গণেশ দীর্ঘকাল রোগে ভুগে পরে হঠাৎ অকেজো হইয়া পড়ে। সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না, এক হাত বাঁকিয়া গিয়াছে। বৃদ্ধ বয়সেও শৈরমীকে এই পুত্রের ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। পাড়ায় সে ঘঁটে দেয়, মাঠের শাক তুলিয়া বেচে, কারো বাজার-সওদা কিনিয়া আনে। ফাঁইফরমাশেই তার জীবিকা সংগ্রহ হয়। জওয়ান পুত্রের এই দুরবস্থা। কায়িক পরিশ্রমের চাপেই শৈরমী তা সহ্য করিতে শিখিয়াছিল। দরিয়াবিবির সঙ্গে কয়েক বছরের পরিচয়। শৈরমী এই বাড়ি ঘুঁটে দিয়া যায়। সেই সূত্রেই হৃদ্যতা গড়িয়া উঠিয়াছিল। শৈরমী গ্রামেরই ঝিউড়ি বলিয়া সে দরিয়াবিবিকে ভাবী সম্বোধন করিত।

আমজাদ শীতে কাঁপিতেছিল। সেদিকে দরিয়াবিবির লক্ষ্য নাই। কাদার উপর দাঁড়াইয়া থাকিতে যেন কত ভালো লাগে।

বিষণ্ণ-মুখ পুত্র ও জননী।

বৃষ্টি একটু কমিয়াছিল। গাছে-পাতায় মৃদু নিনাদে অহর্নিশ বাজিতেছে। পাখির ভিজে পাখনা-ঝাড়ার শব্দ এবার শোনা যায়।

যদি না আসে। নীরবতা ভাঙিল দরিয়াবিবি।

না গো মা, আসবে। ঘরে চলো, আমার শীত পেয়েছে।

হুঁশ হয় যেন দরিয়াবিবির। আঁচলের একপাশ শুষ্ক ছিল, তা দিয়া সে আমজাদের মাথা মুছাইয়া দিল।

এখানে মুছে কি হবে মা, বিষ্টি পড়ছে যে!

গৃহকর্মে নিপুণ দরিয়াবিবির কোনো কাজে যেন সুডৌল নাই। বৃষ্টি পড়িতেছে, এখন চুল মুছাইয়া দেওয়া বৃথা, এই কথাটুকু সে যেন উপলব্ধি করিতে পারে না।

একটা অশথ গাছের গোড়ায় অনেক ব্যাঙ লাফাইতেছে। শীতে কাঁপিতেছে, তবু মজা লাগে বেশ আমজাদের। খপ খপ করিয়া একটি ব্যাঙ সড়কের উপর বসিয়া বাদল পোকা খাইতেছে নীরবে।

আমজাদ জোরে এক সুট দিয়া বলিল : মা, দ্যাখো ফুটবল খেলছি।

ধপাস শব্দে কয়েক হাত দূরে ব্যাঙটি আবার মাটির উপর পড়িল। চার হাত-পা ছাড়িয়া ফোক-ফোক শব্দ করে ব্যাঙের বাচ্চা।

দরিয়াবিবি এই সময় হাসি চাপিয়া রাখিতে পারে না।

আরে আমু, তোর ছেলেমি আর যায় না।

নিজের কৃতিত্বে আমজাদ গম্ভীর হইয়া যায়। মাথা দোলাইয়া সে বলে, ঘরে আমাকে কিন্তু গরম ভাত খেতে দিতে হবে। এত ভিজেছি, আমার বুঝি খিদে লাগে না।

দরিয়াবিবি চুপ করিয়া গেল। তার মুখের হাসি নিভিয়া যায় তখনই।

আরো আকাশে মেঘ জমিতেছে। আরো কতদিন বর্ষা লাগিয়া থাকিবে বাংলাদেশের গ্রামে?

নঈমা কোথাও যায় নাই, আসেকজানের সঙ্গে সে বাগ-বিতণ্ডা করিতেছিল। দুজনে মাঝে মাঝে কৃত্রিম বিবাদ চলে। গতকাল আলেঙ্কান কিছু চাল ভিক্ষা করিয়া আনিয়াছিল। তারই সঙ্গতি হইতেছে।

পান্তাভাত ছিল সকালের। দরিয়াবিবি রান্নার আয়োজন করে নাই। আমজাদ ঝাঁকিয়া বসিল, সে পান্তাভাত খাইবে না।

মেজাজ খারাপ, তবু দরিয়াবিবি আজ চুপ করিয়া গেল। অভিমানে আমজাদ কিছুই স্পর্শ করিল না। বিছানায় শুইয়া শুইয়া ক্ষুধার্ত জঠরেই ঘুমাইয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি ভিজা কাপড় ছাড়িয়া বসিয়া রহিল। গোয়ালে গরুগুলি খড় চিবাইতেছে। আজ আর কোনো হাঙ্গামা নাই। কত নিশ্চিন্ত যেন দরিয়াবিবি। নঈমা আসেকজানের ঘরে খেলা করিতেছিল, তার আওয়াজ কানে পৌঁছায়।

বৃষ্টির কামাই নাই।

নিদ্রিত আমজাদের দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি বুকে শত তরঙ্গের আলোড়ন চলিতেছিল। বাহিরে তার প্রকাশ নাই। দরিয়াবিবি চুপচাপ বসিয়া। বহুদিনের যেন অবকাশ মিলিয়াছে। কর্মক্লান্ত জীবনে খুঁটিনাটি দিনগুলি তাই স্মরণে গাঁথা হইতেছে।

সামান্য পান্তা ভাত ছিল। দরিয়াবিবি খাওয়ার কথা সহজেই ভুলিয়া যায়। তারও ঘুমে চোখ বুজিয়া আসে। দেওয়ালে ঠেস দিয়া দরিয়াবিবি ঢুলিতে থাকে।

কোথা গো ভাবী, শব্দে চমকিয়া উঠিল দরিয়াবিবি।

সত্যই শৈরমী আসিয়াছে। ভিজে কাপড়। হাতে একটি ন্যাকড়া কাপড়ে বাঁধা শাকের পুঁটুলি।

দাওয়ার উপর বোঝা রাখিয়া শৈরমী বলিল : কেন ডেকেছিলে, ভাবী?

দরিয়াবিবি শৈরমীর কাছে যেন ছুটিয়া আসে। ঘুম উবিয়া গিয়াছে তার।

এই রাস্তায় যে ছায়া পড়ে না আর দিদির।

শৈরমীর রং কালো। বৃদ্ধ বয়সে চামড়া লাল হইয়া গিয়াছে।

রেখা-সংবলিত শরীরে আবার বৃষ্টিপাত শৈত্যের জুলুম। কুঁকড়াইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে শৈরমী। বড় কুৎসিত দেখায় তার শরীর।

কিন্তু তার কণ্ঠে হৃদয়ের অপূর্ব আভাস বাজে : কত কাজে থাকতে হয়, তোমার কাছে কি অজানা ভাবী। বর্ষাকালে ছেলেটাকে নিয়ে কষ্টের সীমা নেই।

এইবার রীতিমতো হাঁপায় শৈরমী।

দরিয়াবিবি গণেশকে কোনোদিন দেখে নাই। তবু শৈরমীর দুর্দশা তার কাছে বাস্তব। কোনো কল্পনার প্রয়োজন হয় না তার।

নসিব, বোন। তোমার অমন রোজগারী পুতের এমন অসুখ দিলে, আল্লা।

শৈরমী বুকে দুই হাত রাখিয়া উত্তাপ খোঁজে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে চায় না সে। দরিয়াবিবি সহজে কোনো কথা পাড়িতে দ্বিধাগ্রস্ত, কেবল দেরির বাহানা তার।

পুঁটলিতে কী আছে, দিদি?

শৈরমী জবাব দিল : ভাবী, কটা শাক আছে। একটু তেল আনন, একদম চান্ করে ঘরে ঢুকব।

দরিয়াবিবি ঘরের ভেতর হইতে সরিষার তেলের ভাঁড় আনিল।

শৈরমী তখন পুঁটলি খুলিতেছে। সে একরাশ শাক দাওয়ার উপর রাখিয়া দরিয়াবিবির মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল।

আর দেব, ভাবী?

না, এত মেটে শাক কী খাওয়া যায়! আর কি আছে পুঁটলিতে?

কিছু নেই।

কৌতূহলের ছলে দরিয়াবিবি শাকে হাত দেওয়া মাত্র তার নিচে শামুক দেখিতে পাইল।

বেশিদূরে সে অগ্রসর হইল না। দরিয়াবিবি বুঝিতে পারে, শৈরমী তো খুব সুখে নাই। হাঁসের জন্য শামুক লইয়া গেলে এমন গোপনের কী আছে। আর বেশি কথা জিজ্ঞাসা করিল না দরিয়াবিবি।

ভাবী, এবার উঠি।

আর একটু বসো। বুড়ো হাড়ে কি এত শীত ঢুকেছে?

কৃত্রিম কোপনতার সঙ্গে বলে দরিয়াবিবি।

শৈরমী অনুনয় করে : ভাবী, আর একদিন এসে গল্প করে যাব। যাই, ছেলেটাকে বর্ষায় ঘরে একা রেখে মন মানে না। পাছে কিছু হয়।

দরিয়াবিবি কিয়ৎক্ষণ কোনো জবাব দিল না। সিঁড়ির উপর বসিয়াছিল মাথা নিচু করিয়া, তেমনই বসিয়া রহিল। মুখের উপর কালো ছায়া পায়চারি করে তার।

হঠাৎ এক দমকা নিশ্বাসে দরিয়াবিবি বলিয়া ফেলিল : দিদি, তোমার গুণধর ভাই তিন হপ্তা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে মুখ কালা করে। ঘরে বড্ড টানাটানি। একটা পুরাতন ঘড়া আছে– রেখে যদি কেউ পাঁচটা টাকা দেয়। আমি সুদ দেব মাসে মাসে।

শৈরমী বিশ্বাস করে না। মিছামিছি বলছ, ভাবী।

দরিয়াবিবি হৃদ্যতার জন্যই শৈরমীকে কোনোদিন কোনো দুঃখের কথাই বলে নাই, বরং শৈরমীকে এক-আধটা পয়সা দিয়া সাহায্যের চেষ্টা করিয়াছে, আধ পয়সার শাক এক পয়সায় কিনিয়াছে।

হৃদ্যতার এই আর এক সোপান।

আজহারের উপর দরিয়াবিবির ক্রোধের অন্ত থাকে না।

দ্যাখো না, দিদি। ঘর ছেড়ে পালাল। আমিও বয়েস থাকলে কাউকে নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। এমন লোক ভূ-ভারতে না জন্মায়। এমন–

শৈরমী ধমক দিয়া বলিল, কী-সব অনাছিষ্টির কথা মুখে আনছ অবেলায়, ছিছি! তুমিও দিদি, সামান্য বাতাসেই হেলে পড়ো?

দরিয়াবিবি স্তব্ধ হইয়া যায় হঠাৎ।

আচ্ছা, ঘড়াটা দাও। অধর সাঁতের মার কাছে রেখে পাঁচটা টাকা আন্‌ব। বুড়ি দু পয়সা সুদ চায় মাসে।

তাকেই দিও।

ধীরে কথা বলে দরিয়াবিবি। দুই চোখ ছলছল করে তার।

বাবাজি বিয়ের সময় যৌতুক দিয়েছিল। আগে কপাল ভেঙেছিল। সেখান থেকে অতিকষ্টে ঘড়া আর পেতল-কাঁসার কটা জিনিস এনেছিলাম।

সজল ডাগর দুইচক্ষু দরিয়াবিবির বাম্পায়িত। থমথমে আকাশের মতো মুখাবয়ব বড় সুন্দর দেখায়। পরিশ্রম-মলিন গৌর রঙ বিদ্যুতের আভাসের মতো খেলিয়া গেল।

শৈরমী দুঃখ প্রকাশ করে : দাদার এমন উচিত হয়নি। ভালো ঘরের বউড়ী বাইরে বেরোয় না, সংসার দেখবে কে?

তুমি-ই বলল দেখি, দিদি।

দরিয়াবিবি কয়েক মিনিটের জন্য ঘরে ঢুকিল। যখন বাহির হইল তার হাতে একটি পুরাতন পিতলের ঘড়া।

মাটির উপর রাখামাত্র ঠুন শব্দ হয়।

শৈরমী বারবার ঘড়াটি পরীক্ষা করিতে লাগিল।

দেখব ভাবী, যদি দুএক টাকা বেশি দেয়। যে মজবুত জিনিস।

বৃষ্টি থামিয়াছিল কিয়ৎক্ষণের জন্য।

দরিয়াবিবি একটি পান শৈরমীর হাতে দিয়া বলিল : দিদি, আঁচলের আড়ালে নিয়ে যাও। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন বলল না, আমাদের ঘড়াটা। দিব্যি রইল, দিদি।

ভাবী, এতদিনে আমাকে এমন কাল কেউটে ঠাওরালে। অদেষ্ট খারাপ না হলে ঘরের লক্ষ্মী পরের ঘরে কেউ রেখে আসে?

শৈরমী উঠিয়া পড়িল। আবার বৃষ্টি শুরু হইয়াছে। দরিয়াবিবি তখনও ঘড়াটা নাড়াচাড়া করে। কত অনিচ্ছার প্রতিরোধ মনে, তবু ধীরে ধীরে পিতলের সামগ্রী শৈরমীর হস্তে তুলিয়া দিতে হইল।

কাউকে বলো না কিন্তু, দিদি। আমার মাথার দিব্যি।

শৈরমী চলিয়া গেল।

সামান্য চাল আছে, আমজাদের জন্য ভাজা হইবে। রাত্রে আর কিছুর ঝঞ্ঝাট নাই দরিয়াবিবির।

দূরে মেঘ-গর্জন প্রান্তর হইয়া ভাসিয়া আসে। সবুজের বন্যায় তরুলতা লুটোপুটি খায়। অবেলার মৌন আকাশ দরিয়াবিবির মুখের উপর বার বার ছায়া ফেলে।

***

এই দুর্দিনে চন্দ্র কোটাল অনেক সাহায্য করিল। একটা কানাকড়ি সে দেয় নাই। গতরে মেহনত আর সহানুভূতির কোনো মূল্য নিরূপণ করা যায় কী? আরো দুই হপ্তাহ কাটিয়া। গেল। আজহারের কোনো পাত্তা নাই। বর্ষায় গোবর হইয়া যাইত এতদিন পাকা আউশ ধান। চন্দ্র কোটাল মুনিশ করিয়া নিজে সব খড় আজহার খাঁর ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া গেল। এবার ভালো ধান ফলে নাই। তবু বর্ষার পর দুমাস কোনো রকমে কাটিয়া যাইবে। দরিয়াবিবি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বুক বাঁধে। চন্দ্র কোটালের উপদেশেই সে কোনো দেনা শোধ করিল না। দুমাসে যদি আজহারের সংবাদ না আসে– যদি আর কোনো দিনই না আসে। কুটিল হতাশার চক্ররেখায় নিষ্পিষ্ট হইতে থাকে দরিয়াবিবি।

আমজাদ একদিন মতব হইতে ফিরিয়া বলিল : মা, মৌলবী সাহেব মাইনে চেয়েছে। দরিয়াবিবি বিরক্ত হয় : থাক্ রোজ রোজ তাগাদা করতে হবে না মৌলবী সাহেবকে। কাল থেকে আর মতবে যাসনে।

আমজাদের মুখ শুকাইয়া যায়।

দরিয়াবিবি একরাশ খুদের কাঁকর চয়ন করিতেছিল। আমজাদের দিকে চাহিয়া তার বিরক্তির ছায়া অদৃশ্য হয়। মুখ গম্ভীর করিয়া দরিয়াবিবি বলে : মৌলবী সাহেবকে বল, আমার বাপ এলে সব চুকিয়ে দেব।

আমজাদ তবু নড়িল না। সে জানে, মা ঐ এক বাক্যে বহুদিন মৌলবী সাহেবকে স্তোক দিয়াছে।

সাহসের উপর দিয়া আমজাদ মার কথার প্রতিবাদ করিল : তুমি তো রোজ ঐ কথা বলো।

দরিয়াবিবি অবনত মুখে কাঁকর বাছিতে থাকে, আমজাদের দিকে আর চাহিয়াও দেখে না।

আমজাদ গুটিসুটি মারিয়া গতিবিধি লক্ষ্য করে শুধু।

বহুক্ষণের নিস্তব্ধতা জগদ্দল ঠেকে আমজাদের নিকট। উশখুশ করে সে।

দরিয়াবিবি তার পুত্রের অস্তিত্ব যেন বিস্মৃত হইয়াছে।

মা হঠাৎ ডাকিয়া ফেলে; আমজাদ। আড়ষ্ট ঠোঁট হইতে কোনোরকমে নিঃসৃত।

গম্ভীর দুই নেত্র প্রসারিত করিয়া দরিয়াবিবি একবার পুত্রের দিকে চাহিল মাত্র।

মা।

আমজাদের সম্বোধন আরো বাড়িয়া যায়।

এবার তীক্ষ্ণস্বরে জবাব আসে, কী?

না। কাল থেকে আর মখৃতবে গিয়ে কাজ নেই। ঢের হয়েছে লেখাপড়া।

আমজাদ মনে মনে উল্লসিত হয়। মতবের ছেলেদের ভালো লাগে। মতব তার আদৌ ভালো লাগে না।

তবে কী করব, মা?

ব্যঙ্গস্বরে জবাব দিল দরিয়াবিবি : কী করবি আবার! চাষার ছেলে জাতব্যবসা ধরবি।

আমজাদ এইবার মাথা হেঁট করে। কৃষির মতো কঠোর পরিশ্রমে কোনো সম্মান নেই।

মুখের হাসি অম্লান রাখিয়া সে জবাব দিল : আমি এই আট বছর বয়সে লাঙল ঠেলতে পারব?

তোর ঘাড় পারবে।

আমজাদ ভয় পায়, মা রীতিমতো ক্রুদ্ধ।

এমন সময় হঠাৎ চন্দ্র কোটালের ডাক শোনা গেল দহলিজে।

আমজাদ হাঁফ ফেলিয়া বাঁচিল।

এমনি আসিয়াছে কোটাল। আজহারের কোনো সংবাদ পাওয়া গেল কিনা। নিয়ামতপুরে ধানব্যবসায়ীরা প্রায়ই যায়। তারা কোনো খোঁজ দিতে পারে নাই। অতবড় গঞ্জে আজহার খাঁর মতো নগণ্য মানুষের তালিকা কোথাও লেখা থাকে না।

আমজাদ কোটালের সঙ্গে আলাপ জুড়িয়া দিল। একটু পরে দহলিজের আড়াল হইতে দরিয়াবিবি নিজেই কোটালকে ডাকিয়া বলে : কোটাল মশায়, আমজাদের একটা বন্দোবস্ত করে দিন।

চন্দ্র অবাক হইয়া যায়। আজ পর্দানশীনা দরিয়াবিবি নিজেই কথা বলিতেছে।

লজ্জায় চন্দ্র কোটালের কণ্ঠস্বরে তার স্বাভাবিক গমক থাকে না।

কেন, কী হল, ভাবী?

গরিবের ছেলে, খামাখা মখতবে মাইনা গুনে লাভ কী?

চন্দ্রের স্বাভাবিক রসিকতা-পটু কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল সে।

তা ঠিক। তবে দুই-এক বছর দেখা উচিত। ঐ তো কচি ছেলে।

না, যখন বেশিদূর টানতে পারব না। খামাখা টাকা খরচ করে লাভ নেই।

চন্দ্র আর কোনো আপত্তি উত্থাপন করিল না।

ভাবী, বরং আমার সঙ্গেই থাকুক। মাছ-ধরা নৌকা বাওয়া শিখুক।

দরিয়াবিবি রাজি হইয়া গেল। ঐটুকু ছেলে এখনও সাঁতার শেখে নাই! সে নৌকা বাইবে? চন্দ্রের উপর সব নির্ভর করা চলে।

পান খাইয়া আমজাদকে একটু আদর করিয়া চন্দ্র কোটাল গায়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিল।

পরদিন সকালে আমজাদ অবাক হইয়া গেল। একটি ছোট লগী হাতে মা কোটালের নিকট পুত্রকে প্রেরণ করিতেছে। সত্যই নৌকার জীবন আরম্ভ হইবে নাকি!

মার দৃঢ় মুখাবয়ব দেখিয়া আর কোনো আপত্তি করিল না আমজাদ। সামান্য মুড়ি কোঁচড়ে সে নদীর পথ ধরিল।

দু-বছর আগেও দরিয়াবিবি এমন ঘটনাস্রোতের কল্পনা করে নাই। কত স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে শিশুপুত্র লইয়া!

তুমি কি আর স্বপ্ন দেখো না, দরিয়াবিবি?

.

০৯.

মৌন মহিমায় বর্ষার আকাশে জাগিয়াছিল তারা ক্ষত অন্তর লইয়া।

মফস্বল শহরের অন্তঃপাতী গণ্ডগ্রাম। সড়কের একটেরে আজহার ও কয়েকজন রাজমিস্ত্রি বাসা ভাড়া লইয়াছিল।

স্টেশনে যাত্রী পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য এ অঞ্জলের শেষ বা বহুক্ষণ সড়কের উপর টায়ারের দাগ আঁকিয়া গিয়াছে।

আজহার একমনে তখনও নারিকেলি হুঁকা টানিতেছিল। কল্কের দমের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ফুলকি ওড়ে বাতাসে। কিয়ৎক্ষণের জন্য অন্ধকার সরিয়া যায়। বাসার দরজা চোখে পড়ে। আজহার চৌকাঠের উপর।

বাসার আয়তন সংকীর্ণ। একদিকে মাত্র ছোট জানালা। মাটির দেওয়ালে চুন-বালি ছোপানো কোথাও রঙ ধসিয়া গিয়াছে। মেঝে সুসমতল নয়। তারই উপর মাদুর পাতিয়া আজহারের সঙ্গী ঘুমাইতেছিল। সারাদিন বৃষ্টির পর ভ্যাপসা গরমে ঘরের ভেতর আজহারের দম বন্ধ হইয়া আসিতেছিল। কিছুক্ষণ পূর্বেই বিছানা ছাড়িয়া সে চৌকাঠে ধোঁয়ার আসর জমাইতে মগ্ন হইয়াছিল।

সড়কের পাশে একটি ডোবায় ব্যাঙ ডাকিতেছিল। এই অঞ্চলে ভয়ানক মশা। খালিগায় শোয়া-বসার উপায় নাই। নিস্তেজ ক্লান্তির ছায়ায় কল্কে টানিতে টানিতে তার চোখ বুজিয়া আসে। আশেপাশে মশা ভন্‌ভ করে। এক-একবার গামছার ঝটকা মারে আজহার, আবার ধোঁয়ার সঙ্গে মিতালি চলে।

সড়কের গাছপালায় অন্ধকার জমিয়া রহিয়াছে। শীতল রাত্রির ডাকে জোনাকিদের চোখ নিদ্রাহীন। পানা-পুকুরের ধারে এই নিরীহ পতঙ্গের দেয়ালি উৎসবে কোনো ছেদ পড়ে না।

ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে আজহার নীরবে চারিদিক অবলোকন করে। পঙ্গু মন তার নিঃসাড় হইয়া গিয়াছে। চিন্তার এলোমেলো জটাজাল অন্ধকারে হামাগুড়ি দেওয়া পর্যন্ত বিস্মৃত। কোনো কিছু মনে পড়ে না আজহার খাঁর।

নিয়ামতপুরে দুদিন ছিল সে মাত্র। কাজ জুটিয়াছিল ভালো। কয়েক সপ্তাহ কাজ চলিত স্বচ্ছন্দে। জায়গাটা খুব পছন্দসই নয়। ইতর মাতালদের আড্ডা তার ভালো লাগে নাই। এখানের অন্যান্য রাজমিস্ত্রি বড় বদ-চরিত্রের। সামান্য দুদিনের রোজগার তাঁকে খুঁজিয়া আজহার পথে পাড়ি দিয়াছিল। কাজ কোথা-ও-না কোথাও জুটিবেই, সে ভরসা ছিল তার। সড়কের পথেই নতুন ইমারতের কাঠামো দেখিয়া সে আশান্বিত বুকেই এখানে গৃহস্বামীর উমেদার হইয়াছিল। সঙ্গী মিস্ত্রিরা লোক মন্দ নয়। রোজ কম। তবু আজহার কোনো প্রতিবাদ করে নাই, সহজেই সে কাজে লাগিয়াছিল।

গ্রামের নাম শাহানপুর। দু-মাইল দূরে স্টেশন। তারই আবহাওয়ায় গ্রাম ও শহরের যৌথ লীলাভূমিরূপে জায়গা মন্দ নয়। আজহারও আকর্ষিত হইয়াছিল।

রেলস্টেশন মাত্র বছর-দুই আগে ভোলা হয়। এখনও বহু ব্যবসার ভবিষ্যৎ এই গ্রামে উঁকি মারিতেছে। কয়েকদিন অবস্থানের পর আজহার তাহা নীরবেই উপলব্ধি করিয়াছিল। যদি কোনো পুঁজি জমানো যায়! আজহার তাই কায়ক্লেশে রীতিমতো কৃচ্ছসাধন আরম্ভ করিয়াছিল।

সারাদিন খাটুনির পর আজ শরীর ভালো না, তার উপর বাসার ভেতর ভ্যাপসা গরম। সব মিলিয়া বড় অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল আজহার। তার কোনো স্পষ্ট চেতনা কিন্তু দাগ কাটে না কোথাও। নীরবে তাই হুঁকা পানই করিতেছিল। কয়েকবার হাই উঠিল।

আজহার খাঁ নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকে। তামাক প্রায় নিঃশেষ। অন্যদিকে কার আওয়াজের কামাই নাই।

স্মরণের প্রান্তর নিঃশেষে মুছিয়া দিয়াছে কালো অন্ধকারের প্রলেপ। শিরার দ্রুত কম্পন রাত্রির তরঙ্গশীর্ষে ঈষৎ ঝিলিকের রেখা টানিয়া আবার শান্ত হইয়া আসে।

প্রাগৈতিহাসিক বর্বরের আলস্যমুখর অদ্ভুত বিরাম আকাক্ষা আজহার খাঁর মেরুদণ্ডে ঘা দিয়া গেল।

এইবার জোরে কল্কে ফোঁকে আজহার। তামাক-না-দারাৎ। অসন্তুষ্ট চিত্তে সে কল্কে চৌকাঠের কোণে রাখিয়া দিল।

আর এক ছিলিম পাইলে মন্দ হইত না। সে হাই তুলিল। হঠাৎ আজহার তার পাশেই আর একজনের উপস্থিতি অনুভব করে। অন্ধকারে অপরিচিত মানুষটি।

আজহার মৃদুকণ্ঠে ডাকে : কে?

আমি, চাচা।

একটি বালকের কণ্ঠস্বর অন্ধকারে ঢেউ তোলে।

খলিল, এত রাত্রে বাইরে এসেছ?

জিজ্ঞাসা করে আজহার।

ঘুম ধরে না, চাচা।

ফোঁপানির শব্দ আসে আজহার খাঁর কানে।

খোয়ারি ভাঙিয়া যায় তার। কার কণ্ঠনালী-দুমড়ানো এই শব্দ, প্রথমে আজহার স্থির করিতে পারে না।

নিবিড় অন্ধকার। চৌকাঠের অপরদিকে আজহার হাত বাড়াইয়া দিল। খলিলের নাগাল পায় সে। হাঁটুর ভেতর মাথা খুঁজিয়া সে বসিয়া আছে। এতক্ষণ এই অবস্থায় সে ধীরে ধীরে জবাব দিতে ছিল তবে।

আজহারের সঙ্গী মিস্ত্রির নাম ছিল ওদু। তারই ভাইপো খলিল। বয়স বারো হইবে কিনা সন্দেহ। বালক-বয়সেই চাচার সঙ্গে মিস্ত্রির কাজ শেখার জন্য এই প্রবাস-জীবনের গ্লানি বহন করিতেছে।

আজহার খলিলের নিকটে সরিয়া আসিল। তার গায়ে ঈষৎ নাড়া দিয়া সরস কণ্ঠে আজহার সম্বোধন করে : কী হয়েছে, চাচা? .

খলিল মাথা তুলিতে চায় না। হাঁটুর ভেতর মাথা খুঁজিয়া যেন বিশ্বের সমস্ত কলঙ্কের নিকট হইতে পরিত্রাণ চায় সে।

কিছু হয়নি তো, চাচা?

আবার আজহার নাড়া দিয়া বলিল : মাথা তুলে কথা বলো না, কী হয়েছে?

খুব মৃদুস্বরেই আলাপ বিনিময় চলিতেছে। ঘরের ভেতর সকলে দিনমজুর। কারো ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

খলিল নীরব।

আজহারের কৌতূহল মিটিল না। সে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিল।

খলিল এইবার কোনো জবাব দিল না। আদুল গায়েই সে বসিয়াছিল। আজহারের হাত নিজের পিঠের উপর ধীরে রাখিয়া আবার খলিল ফোঁপাইতে লাগিল।

আজহার আঙুলের ডগায় যেন বিছা দংশন করিয়াছে। সে তড়িৎগতি খলিলের পিঠ হইতে হাত তুলিয়া লইয়া সচিৎকার জিজ্ঞাসা করে : তোমার পিঠে এত দাগ?

খলিল আজহারের মুখে হাত চাপিয়া নিদ্রিত ব্যক্তিদের দিকে তাকায়। না, কারো কানে আজহারের চিৎকার পৌঁছায় নাই।

আজহার খলিলকে বুকের কাছে টানিয়া লইল।

বারবার হাত বুলায় সে খলিলের পিঠে।

কুয়াশানিদ্রিত প্রান্তর আবার জাগিয়া উঠিতেছে। মনে পড়িল বৈকি আজহারের আমজাদের কথা, নঈমার মুখ, মহেশডাঙার জলাজাঙ্গাল। আর দরিয়াবিবি? না, আজহারের মানসপটে পরিশ্রমপটু, সংসার-অভিজ্ঞ, সুঠাম-তনু দরিয়াবিবির কোনো ছায়া ভাসিয়া উঠে না। হয়তো ভাসিয়া উঠিয়াছিল ক্ষণিক আলোর মলিন রেখায়। নিবীর্য একরকমের অস্থিরতা আজহারকে ব্যথিত করে বলিয়া সে তখন ছায়ার অন্যান্য জনতায় চিন্তার প্রহরীদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাইল।

কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া আজহার জিজ্ঞাসা করল : কেউ মেরেছে বুঝি?

হ্যাঁ চাচা।

হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া উঠিল আজহার।

কচি গায়ে কার এমন আজারে হাত উঠল?

খলিল কোনো জবাব দিল না। নীরবে বসিয়া রহিল।

কে মেরেছে?

আজহার অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল।

খলিল অন্ধকারে চারিদিকে দৃষ্টি মেলে। তারপর আজহারের কানে কানে সে বলিল: ওদু চাচা চেলাকাঠ দিয়ে

ঢোক গিলিয়া খলিল আবার ফোঁপাইতে থাকে।

এ্যাঁ, ওদু এমন কড়া-জান?

খলিলের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে আজহার বলিয়া যায় : কী করেছিলে তুমি যে, এমন করে হাত চালায়?

গহর মিস্ত্রির সুর্মী ভেঙে ফেলেছি। ইটের উপর পড়ে গেল কিনা।

গহর রাজমিস্ত্রি। সে-ও বাসার ভেতর নিদ্রিতের দলে। পাছে তার কানে কোনো শব্দ যায়, ধরা-গলায় খলিল জবাব দিয়া চুপ করিল।

ছোট একটা সুর্মী ভেঙেছ, তার জন্য এত মার মারলে?

ফোঁপাইয়া কান্না আরম্ভ করিল খলিল।

আড়ষ্ট উচ্চারণের মধ্যদিয়া বোঝা যায় তার আবেদন : আমি চাচার সঙ্গে বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম কিনা।

ওদু আজ বাড়ি গেছে?

হ্যাঁ, চাচা!

আজহার সান্ত্বনা দিতে চায় ওই অবোধ বালককে।

ওদু যাক না বাড়ি। আমরা রয়েছি, তোমার কোনো ভয় নেই।

চৌকাঠের একপাশে কখন সরিয়া গিয়াছে খলিল। আবার হাঁটুর মধ্যে তার মাথা গোঁজা। বিভীষিকাময়ী পৃথিবীর অবলোকনের সাহস তার নাই।

একটু পরে ঘাড় গুঁজিয়াই খলিল জবাব দিল : আমার মন টেকে না চাচা।

ব্যাটাছেলে, কাজ-কাম না শিখলে চলবে কেন? বিদেশ তো ব্যাটাছেলেদের জন্যই। তা মন অমন এক-আধটু খারাপ করে।

নিঃসাড় হইয়া গেল খলিল। কোনো জবাব আসে না তার নিকট হইতে।

তোমার বাপ বেঁচে আছে, চাচা?

জিজ্ঞাসা করিল আজহার।

খলিল অন্ধকারে মাথা তোলে না। ক্লান্ত স্বর তার বাইরে আর্তনাদের মতো শোনায় না!

আবার মাথা গুঁজে বসে আছ? ভাবনা কিসের? আমরা তো রয়েছি। ওদু কাল-পরশু ফিরে আসবে।

আজহার খলিলের দিকে হাত প্রসারিত করে। খলিল ধীরে ধীরে খার পাশে সরিয়া আসিল। ক্লান্ত দুইচোখ তার সড়কের দিকে।

পরে আজহারের মুখোমুখি দৃষ্টিপাত করিয়া সে বলিল : আজ দুমাস এসেছি, চাচা। মার জন্যে মন কেমন করে-যে। ওদু-চাচা এইবার নিয়ে চারবার ঘরে গেল।

বিদেশে থাকতে শেখো। কাজ শিখলে তবে তো বড় মিস্ত্রি হবে। দুঃখ ঘুচবে। এই দ্যাখো না, আমরা দেশে চাষবাস করতাম, শহরে আসিনি। কুকুরের হাল।

কোনো আশ্বাস পায় না খলিল।

পেট-ভাতায় ছমাস কাজ শিখলে তবে নাস্তার পয়সা বেরোবে। মাকে এক পয়সাও দিতে পারিনি। নাস্তার পয়সা বেরোলে তা বাঁচিয়েও কিছু পাঠাতে পারতাম।

আজহার খাঁ বিগলিত হৃদয়ে ওই দুগ্ধপোষ্য বালকের দিকে চাহিয়া থাকে। এত অল্প বয়সে পৃথিবীর রঙ চিনিতে শিখিয়াছে সে। এমন ছেলের উন্নতি আল্লা নিশ্চয় দেবেন। নসিব খুলবে বৈকি।

পুনরায় সরব হয় আজহার : আর কটা মাস, চাচা। তারপর নাস্তার পয়সা বেরোলে তোমার মাকে টাকা পাঠিয়ো। কেন, তোমার মা কিছু করেন না?

ধান কুটে ভাত জোটাতে হয়।

কথা সমাপ্ত করিয়া বড় লজ্জিত হয় খলিল। কুটুনীর ছেলে সে, এমন পরিচয় দিতে মাথা কাটা যায়। আবেগের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল খলিল।

আজহার আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদে মত্ত হয় না। নিঝুম সেও বসিয়া থাকে। এতটুকু ছেলে মার দুঃখের সঙ্গী। তিন-চার বছর পরে আমজাদ কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে কে জানে?

মাত্র এক পলকের জন্য আমজাদের মুখ মনে পড়িল আজহারের। চন্দ্র কোটাল তাকে স্বপ্ন দেখিতে শিখাইয়াছে। তার কুয়াশা-আবর্তিত ফেনিল পটে কারো মুখ আর স্থিতি পায় না। স্টেশনের নিকট বর্ধিষ্ণু এই গ্রামে ব্যবসা-পত্তনের অশেষ সুযোগ রহিয়াছে। খোদা কি মুখ তুলিয়া চাইবেন না একটিবার?

অজানিত ভীতির ফুকার আজহারের চিত্ত আরো অস্থির-উন্মত্ত করিয়া তোলে। তিনবার বুকে কুলহু আল্লা পড়িয়া ফুঁক দিল সে।

খলিলের ঘন ঘন হাই উঠিতে ছিল, আজহারের খেয়াল হয়। তার দিকে ফিরিয়া সে বলে : চাচা, আবার সকালে কাজে বেরোতে হবে। ঘুমিয়ে পড়ো।

তুমি ঘুমোবে না, চাচা?

অবোধ কণ্ঠের নিনাদ বড় লাগিল আজহারের কানে।

না, চাচা। আর এক ছিলিম খেয়ে শোব।

খলিল বাসার ভেতর প্রবেশ করিল। আজহার নূতন ছিলিম সাজে।

ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে থাকে শেষরাত্রে। খণ্ড মেঘ ছড়াইয়া পড়ে গ্রাম-বনানীর উপর।

আকাশের মুখ কালো হইয়া গেল এক নিমিষে।

.

আজহার খাঁর সিদ্ধান্ত স্থির ছিল।

সপ্তা দুই পরে এই বাসার নিকটে বাসস্ট্যান্ডের নিকট সে তিন টাকা দিয়া একটি ছোট চালাঘর ভাড়া লইল। ঘরের বারান্দা দুইহাত মাত্র প্রস্থে। তারই একপাশে সঙ্গী ছুতারের সাহায্যে সে একটি শেল্ফ তৈয়ারি করিল। দোকানের ঘটা ছিল বেশি। অবশ্য মাল খুব পর্যাপ্ত নয়। আজহার কোনোরকমে গোটা পঁচিশেক টাকা জমাইয়াছিল। তিন টাকা লইল মিস্ত্রি। বাকি বাইশ টাকায় সঁচ-সুতো, মেয়েদের টিপ, স্কুলের ছেলেদের পেনসিল, লজেন্স– এই জাতীয় ছোটখাটো মনিহারী পণ্যসম্ভারে সে দোকান সাজাইল।

পানের দোকান সঙ্গে রাখিবারও ইচ্ছা ছিল আজহার খাঁর। আরো কয়েকটি পানওয়ালা পূর্বেই আসর জমাইয়া রাখিয়াছে। তবু লোভ আছে খার। ভবিষ্যতে যদি নসিবে জৌলুশ লাগে, আরো নতুন পণ্যের দোকানঘর চমকাইয়া দিবে সে।

কয়েকদিন ভয়ানক মেহনতে কাটিয়া গেল। স্টেশন হইতে চার মাইল দূরে গঞ্জের উপর গোলদারী দোকান। একজন মাড়োয়ারী খুব বড় ব্যবসা ফাদিয়াছে। তার নিকটে এইসব জিনিস পাওয়া যায়। চার-পাঁচ মাইল হাঁটার কসরৎ বাড়ে। সঙ্গী মিস্ত্রির ধরনা দিতে হয়। শত অনুরোধে সে রাত্রি-রাত্রি পরিশ্রম করিয়া শেলফ তৈয়ারি করিয়া দিয়াছে।

গহর মিস্ত্রি ব্যাপারটা সোজাভাবে গ্রহণ করিল না। আজহার চলিয়া যাইতেছে, বাসা ভাড়া বেশি লাগে। সে নিরুৎসাহ করিবার বাগ্‌অস্ত্র নিক্ষেপ করিল শত শত। একটু হিংসাও হইতেছিল বৈকি তার। গহর জানে না, পঁচিশটি টাকা জমাইতে আজহার কত নিপীড়ন সহ্য করিয়াছে। বাউণ্ডেলের মতো সংসারের কোনো খোঁজ নাই। তার উপর কায়িক জুলুম। এত সহ্যের ক্ষমতা কয়জনারই বা আছে?

গহর বলিল, মিস্ত্রি তাহলে শেষে এইখানে দোকান ফাঁদলে। দেখো, যদি পাকা বাড়ি ওঠে।

আজহার নিরীহ বেচারা। কোনো জবাব দিল না। কিন্তু কথাটা সোজাসুজি তার মর্মে বিধিতে থাকে।

কিছু করে-কষ্মে খেতে হবে তো ভাই। তাই মন গেল, একটা দোকান করলাম।

গহরের রঙ ফরসা দীর্ঘতায় তালগাছ। কিন্তু ভয়ানক পাতলা শরীর। অবশ্য বাঁধন মজবুত। দাঁতগুলি খুব পরিষ্কার। সে পান খায় না।

না, তাতে আর কী। আচ্ছা, একটা বিড়ি দাও।

আজহার সহজে রাগে না। কিন্তু গহরের কথার ঝাল সে-ও আজ অনুভব করিল।

বিড়ি নেই, ফুরিয়ে গেছে।

মিথ্যা কথা বলিতে বাধে না আজহারের।

উঠিয়া পড়িল গহর।

চালাও দোকান, যদি পাকা বাড়ি ওঠে। একসঙ্গে কাজ করেছি বলে একদিন এসে থাকা যাবে।

গহরের পদক্ষেপের দিকে চোখ ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া যায় আজহার। মনে মনে বলিল, আমার মতো হাভাতে গরিবকেও হিংসা করার লোক আছে পৃথিবীতে।

লজেঞ্চুসের বোতলের পাশে পিঁপড়া উঠিতেছিল, আজহার সেদিকে মনোনিবেশ করিল।

একটু পরে আসিল খলিল। ভারি উৎফুল্ল সে।

চাচা, আপনার দোকাটা বেশ সুন্দর হয়েছে। যখন তোক রাখবে, আমাকে মনে করো।

আজহার স্তিমিত হাসি হাসে।

দোয়া করো, বাবা। আল্লার দোয়া লাগতে কতক্ষণ।

অনেক সামগ্রী খলিল কোনোদিন গাঁয়ে দেখে নাই। সে বিস্মিত-চোখে চারদিকে তাকায়।

চাচা, একা লোক আমি। গোসল করতে গেলে দোকান বন্ধ করতে হয়। তুমি মাঝে মাঝে এসে বসো।

হ্যাঁ, বসব চাচা। বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ওদু চাচা এবার নিয়ে যাবে বলেছে।

বেশ, বেশ।

দাওয়ার একপাশে খলিল উপবেশন করিল।

পাশাপাশি সাজানো শিশি-বোতলের দিকে সে সাগ্রহে দৃষ্টিপাত করিতে থাকে।

আনমনা লজেঞ্চুসের বোতল হাতে তুলিয়া খলিল নাড়াচাড়া করে।

এতে কী আছে, চাচা?

লজেঞ্চুস।

খেতে কেমন লাগে?

খুব মিষ্টি। একটার দাম দুপয়সা।

আজহারের কথা শেষ হওয়ামাত্র খলিল বোতল শেফের কোণে রাখিয়া দিল। তার হাতে শতরাজ্যের আড়ষ্টতা।

আজহার তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। দোকানদার সে। দোকান খুলিয়াছে। একটু ইতস্তত করিয়া সে বলে : একটা খাও না, চাচা।

লজ্জিত খলিল জবাব দিল : না।

আজহার আর বিলম্ব করে না। নিজেই দুটি মিষ্টান্ন বাহির করিয়া খলিলের হাতে দিল। আড়ষ্টতা কাটে না খলিলের : না চাচা, আমি মিষ্টি খাই না। আমার কাছে পয়সা নেই।

খাও। খেয়ে ফেলো ব্যাটা।

তোমার দোকান চলবে কী করে?

এতটুকু ছেলে, সংসারের মারপ্যাঁচ এত বোঝে। অবাক হইয়া যায় আজহার খাঁ।

হাসিমুখে মিষ্টি খায় খলিল।

তুমি একটু বসো, আমি মাগরেবের নামাজ পড়ে আসি।

খলিল হঠাৎ কর্তা বনিয়া যায়। গম্ভীরমুখে সে বসিয়া থাকে। খরিদ্দারের সঙ্গে। আলাপ করে। খুব হাসি পায় তার। এমন একটা দোকান যদি দিতে পারত সে।

আজহার ফিরিয়া আসিলে সে সড়কের পথ ধরিল।

ছোট ডিপা জ্বলে দোকানের এককোণে। দেখা যায় খলিল পথ হাঁটিতেছে। পার্শ্ববর্তী গাছপালার ছায়ায় ঢাকা সড়ক।

এতটুকু ছেলে।

আমজাদ কি অভিমান করিয়া মহেশডাঙায় ফিরিয়া যাইতেছে?

.

১০.

শৈরমী পাড়ায় কলমিশাক বিক্রয় করিয়া দরিয়াবৌর সঙ্গে গল্প জুড়িয়াছিল। গণেশের শরীর ভালো নয়। কয়েকদিন পূর্বে দাওয়া হইতে পড়িয়া গিয়াছিল। পঙ্গু বামহাত একদম অচল হইয়া গিয়াছে। শৈরমীর সামান্য অবসর পর্যন্ত নাই।

দরিয়াবিবি দরদের সঙ্গেই এই বিধবার করুণ প্রাত্যহিকতার কাহিনী শুনিতেছিল। আজকাল বারবার তারও মনে দোলা লাগে, এই জীবনের পরিণতি কোথায় পৌঁছিবে, কে জানে। আমজাদ ও নঈমার মুখের দিকে চাহিয়া দরিয়াবৌর মুখ শুকাইয়া যায়। আজহার খাঁ কোনো খবর দেয় না, কয়েক মাস হইয়া গেল।

সাকেরের মা আসিয়া জুটিল এই সময়। দরিয়াবৌ একটি পিঁড়া আগাইয়া দিল।

বৌ যে আমাদের দিকে পা বাড়াও না, মা।

দরিয়াবিবি এক সপ্তাহ সাকেরের বাড়ি যায় নাই। লজ্জিত হয় সে।

কত কাজ, দেখছেন না, মা। ফুরসৎ নেই, মা।

বৌ নিয়ে হাঁড়-মাংস পুড়ে ছাই হতে বসেছে।

শৈরমী এই প্রসঙ্গে যোগদান করিল : কী হয়েছে?

দিন মাস পার হয়ে গেল, এখনও খালাস হওয়ার নাম নাই। কবরেজ ডাকব, বৌর তাতেও দশ অছিলা।

দরিয়াবৌ সন্দেহ প্রকাশ করে : দশ মাস হয়ে গেছে! না মা, তোমাদের হিসেবে ভুল আছে।

সাকেরের মা জোর দিয়া বলিল : না, দশমাসের বেশি হবে তো কম নয়।

শৈরমী জবাব দিল : ভাবী, অনেকের এগারো মাস লেগে যায়।

দরিয়াবিবি মুখে আঁচল চাপা দিয়া হাসিতে লাগিল।

এগার মাস কেন, আঠার মা লাগে।

সাকেরের মার মুখ কালো হইয়া যায়।–কি হাসছো বৌ, আমার পেটে ভাত সেঁধোয় না। ছেলেটা দিনদিন বিগড়ে যাচ্ছে। দাঙ্গা করতে কোথায় চলে যায়। ছেলের মুখ দেখলে হয়ত ঠাণ্ডা হোত।

ও ব্যাটাছেলেদের দস্তুর। তোমার ভাসুরপোর কোনো খোঁজ নেই। একদিন ঝুপ করে এসে পড়বে। কী আর উপায় আছে, বলো।

শৈরমী ভরসা দিল : ঘাবড়ে যেও না, সাকেরের মা। ভগবান সুফল দিয়েছে নিশ্চয়।

তোমার মুখে সুবন (সুবর্ণ) বষুক, শৈরমী। আমার ঘুম হয় না চিন্তায়।

দরিয়াবিবি শৈরমীর দেওয়া কলমিশাক বাছিতে বাছিতে কথা বলিয়া যায়।

হাসুবৌকে বিকেলে দেখে আসব।

এসো একবার!

আবার সাকেরের মা বলিল : বৌটার মনের হদিশ পাওয়া মুশকিল। ছেলে-ছেলে করে গেল। আজকাল আর আমাকে ছাড়া কোথাও শোয় না। ছেলেটা এইজন্যেই বুঝি আরো বিগড়েছে। আমিও ভাবি অয়লা-পয়লা বার এবার। পাছে কোনো কষ্ট না হয়। বৌটা গোসল পর্যন্ত করে না, পাছে জ্বর হয়।

হাসুবৌর উদরস্ফীতির আয়তন সম্পর্কে দরিয়াবিবি প্রশ্ন উত্থাপন করিল।

দশ-মেসে পোয়াতির মতো, বৌমা। সদাই হাইফাই করছে। হাসুবৌ বলে, তার পেটে খুব ব্যথা। তাই হাত পর্যন্ত দিতে দেয় না। একবার দাইকে ডেকে পাঠালাম। পেটে আঙুল পর্যন্ত ছোঁয়াতে দিলে না।

সুফল দিয়েছে, চাচি। তুমি দেখো। হয়-নয় শৈরমী বাদিনী বলেছিল। গণেশের মা মন্তব্য করে। বৃদ্ধা বিশেষ আশ্বস্ত হয় না। বরং দরিয়াবিবি যেন একবার পাড়া-ভ্রমণে বাহির হয়, তার অনুরোধ জানাইল সে।

আজ হাতে অনেক কাজ আছে, মা। কাল বিকেলে ঠিক গিয়ে তোমার বৌর রোগ ধরে আসব।

শৈরমী আফসোস করিতে লাগিল : কলিকাল, দরিয়াভাবী মানুষের খারাবির শেষ নেই।

দরিয়াবিবি মুখ নিচু করিয়া শাক বাছিতে লাগিল। সে নিজের চিন্তায় মশগুল ছিল।

সাকের ভাই এলে একবার পাঠিয়ে দিয়ে। তার ভাইয়ের খোঁজখবর নিয়ে দেখুক। মনে করি চুপচাপ বসে থাকব। আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামাব না।

এমনও লোক হয় সংসারে! ছেলেপুলের মায়া পর্যন্ত নেই।

শৈরমী তোপড়া গালে হাত রাখিয়া দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া রহিল। এই সহানুভূতি ভালো লাগে না দরিয়াবিবির। মেজাজ তার রুক্ষ হইয়া উঠিতেছে হঠাৎ।

একবার এসো, বৌমা।

সাকেরের মা চলিয়া গেল। শৈরমী এইবার ফিসফিস কণ্ঠে বলে : ভাবী, আধখান পচা সুপুরি দেবে, আজকাল গা মাটি-মাটি লাগে, ভাত খেয়ে কিছু মুখে দিতে পাইনে।

দরিয়াবিবি ঘরের ভিতর হইতে শুধু সুপুরি নয়, তেলের বোতলও বাহির করিয়া আনিল।

শৈরমী দিদি, মাথায় একটু তেল দিয়ে যাও।

শৈরমী তার রেখাঙ্কিত করতালু প্রসারিত করিল।

মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে সে বলিয়া যায় : ভাবী, এই পাড়ায় এলে একটু মন ঠাণ্ডা হয়। কোঠা-বাড়িওয়ালা বামুনদের ওখানে গিয়ে দূর-ছি ছাড়া অন্য কথা শুনিনে। কপাল ধরিয়ে এসেছিলাম ভগবানের কাছে। ছেলেটার সুদ্ধ ভগবান হাত-পা ভেঙে ফেলে রাখলে।

দরিয়াবিবি জবাব দিল : সব জেতে (জাতিতে) ঐ এক ব্যাপার। রহিম বখশ জমিদার বলে সেবার তোমার দাদাকে কত অপমান করে গেল শুনেছিলে তো? গরিব হিদু আর মুসলমান নিজের জেতের কাছেই হোক আর অপরের জেতের কাছেই হোক, একই রকম মান-মজ্জিদে পায়।

আচ্ছা ভাবী, আমার মাথার কিরে–দাদার কোনো খবর পাওনি? তবে চুপচাপ বসে আছ?

আর খবরের কোনো দরকার নেই।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে দরিয়াবিবি জবাব দিতেছিল।

শৈরমী চুপ করিয়া গেল। আঁচলে আধখানা সুপুরি বাঁধিয়া উঠিয়া পড়িল।

জাওলা পাঁকাল মাছ পেলে নিয়ে এসো, শৈরমী দিদি, ছেলেটার পেট গরম রেখেছে।

শৈরমী এইবার হাসিয়া উঠিল।

আমাকে পাগলী ঠাওরালে, ভাবী!

দরিয়াবিবি লজ্জায় মুখ নিচু করে। ঘড়া প্রসঙ্গে তার মর্যাদা কোথায় যেন আহত হইয়াছে।

না। তবে এমনি বলে রাখা ভালো।

শৈরমী আড়াল হইলে দরিয়াবিবি ঝরঝর কাঁদিয়া ফেলিল। চোখের পানি স্বতই রোধ মানে না। প্রাঙ্গণের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া ফেলিল দরিয়াবিবি। আসেকজান পাড়ায় বাহির হইয়া গিয়াছে। কথাবলার কোনো লোক আর নাই। দরিয়াবিবি শাক বাছিতে লাগিল।

আমজাদের ডাক কানে না গেলে হয়তো দরিয়াবিবি সারাদিন শাক লইয়া বসিয়া থাকিত। আনমনা ঘোর তার কাটিয়া যায়।

মা, এই দ্যাখো, আব্বা চিঠি আর কুড়ি টাকা পাঠিয়েছে।

আনন্দে যেন নৃত্য করিতে পাইলে আমজাদ সন্তুষ্ট হইত। বগলে মতবের দপ্তর, একহাতে টাকা আর মনিঅর্ডারের কুপনের অংশ। দশদিন মাত্র আমজাদ চন্দ্র কোটালের সহযোগীরূপে কাজ করিয়াছিল। দরিয়াবিবির আদেশেই আমজাদ এখন মvতবের পড়ুয়া।

দরিয়াবিবির দুই চোখ বিস্ময়ে ভরিয়া যায়।

সত্যি টাকা পাঠিয়েছে, কে দিল তোকে টাকা?

পিয়ন এসেছিল। আমার নামে আব্ব টাকা পাঠিয়েছে। আমার টিপসই নিল পিয়ন।

দরিয়াবিবি উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। নোট দুটি পুত্রের হাত হইতে লইয়া সে নাড়াচাড়া করে।

ঠিকানা দিয়েছে?

হ্যাঁ গো মা, এই তো লেখা রয়েছে।

আমজাদ জননীকে কুপনের অংশ দেখাইল, যেন মার অক্ষরজ্ঞান কত গভীর। দরিয়াবিবি কুপন হাতে লইয়া চক্ষুর দৃষ্টি সহজ করিল। অক্ষর-পরিচয়ের মূল্য তার নিকট এই প্রথম কঠিন সত্যরূপে ধরা দিল।

নঈমা কখন চুপিসারে দুইজনের কথাবার্তা শুনিতেছিল, সে ফুট কাটিল, মা, টাকা দিয়েছে, চিঠি দিয়েছে।

দরিয়াবিবি নঈমাকে কোলে তুলিয়া চুম্বন করিতে লাগিল।

হ্যাঁ। তোমাকে ময়রার দোকান থেকে মিঠাই কিনে দেব।

আমজাদ মুরুব্বির মতো মন্তব্য করিল : এই তো কমাস পরে মোটে কুড়িটা টাকা। তার চেয়ে গায়ে থেকে জন খাটলে লাভ। জানো মা, আমাদের জমি ছাড়িয়ে নিতে পারে। আব্বা এসে চাষ না দিলে লোকে জমি রাখে?

পুত্রের সংসার-অভিজ্ঞ সিদ্ধান্ত দরিয়াবিবির কাছে ভালো লাগে না, যদিও সে মায়ের কথার প্রতিধ্বনি করিতেছিল।

তুমি আর অত ফফর-দালালি করো না। যা করার আমি দেখে নেব।

আমার মাইনে দু-মাসের বাকি আছে। গম্ভীর হইয়া আমজাদ জবাব দিল।

নূতন নোটের গন্ধ শুকিতে লাগিল দরিয়াবিবি। বাইরে দুপুরের সূর্য টলমল করিতেছিল। বাস্তুর নিচে তেঁতুলের বন অলস সমীরে উল্লসিত।

নোট আঁচলে বাধিয়া দুটি খুচরা পয়সা দরিয়াবিবি আমজাদের হাতে দিয়া বলিল, দোকান থেকে দুজনে বিস্কুট কিনে খা।

নঈমা মার কোল হইতে নামিয়া পড়িল।

আসেকজান পাড়া হইতে ফিরিয়া আসিল। চৌধুরীপাড়ার কার যেন ফাতেহা ছিল আজ। আসেকজান খালিহাতে ফিরিয়া আসে নাই, তার আঁচলের নিচে অবস্থিত পুঁটুলি দেখিয়া তা বোঝা যায়।

বৌমা, তোমাদের রান্নার আগেই এসেছি। ছেলেরা আমার সঙ্গে খাবে। অনেক গোস্ত আর ভাত আছে।

না, আমাদের রান্না হবে এখনি।

খামাখা চাল নষ্ট করবে, মা।

নঈমা তখন চিৎকার করে বুড়ির আঁচল ধরিয়া।

ও দাদি, বাবাজি টাকা পাঠিয়েছে।

বৃদ্ধার চোখ আনন্দে সজল হইয়া ওঠে।

সত্যি বৌমা, খবর পাওয়া গেছে ছেলের?

হ্যাঁ, খালা। টাকাও দিয়েছে।

আমজাদ বৃদ্ধাকে আশ্বাস দিয়া বলিল, ঠিকানা পাওয়া গেছে। আমি একদিন যাব বাপজির কাছে।

দরিয়াবিবি কথা-কাটাকাটি পছন্দ করে না, আসেকজান আনন্দবিহ্বলতায় বিস্মৃত হইয়াছিল।

বৌমা, ছেলেরা আমার সঙ্গে খাবে দুপুরে।

না। দোকানে যা আমজাদ। নঈমা, তুইও সঙ্গে যা।

বৃদ্ধা ক্ষুণ্ণমনে নিজের ঝুপড়ির দিকে অগ্রসর হইল। মনে মনে রাগিয়াছিল। আজ টাকার লোক, সাকার, খাবারে এত ঘৃণা, ইশ। বৌমার রোখৃ সে জানে। সহজেই নীরব হইয়া গেল বৃদ্ধা।

দরিয়াবিবি আসেকজানের গমনপথের দিকে চাহিয়া বারবার ভ্রকুটি নিক্ষেপ করিল।

.

কয়েক মাস পূর্বে নঈমার একটি ফালি কাপড় হারাইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি বেদম প্রহার করিয়াছিল সেদিন নঈমাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় আবার সে একটি কাপড় হারাইয়া বাড়ি ফিরিল। দরিয়াবিবি আজ কিছুই উচ্চবাচ্য করিল না। একে সংসারে হাজার রকমের টানাটানি, তার উপর এইসব ঝামেলা পোহাইতে দরিয়াবিবি হিমসিম খাইয়া যায়। মাঝে মাঝে অগত্যা ললাটলিপির উপর সমস্ত ক্রোধ খারিজ করিতে হয়।

সাকেরের মার অনুরোধে পরদিন বিকালবেলা দরিয়াবিবি অবসরের ফাঁকে পাড়া বেড়াইতে গিয়াছিল। সাকের কয়েকদিন হইতে বাড়িতেই আছে। রোহিনী চৌধুরী বোধহয় প্রজা ঢিট করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন।

পাড়ার প্রবেশপথেই তার সঙ্গে দরিয়াবিবির সাক্ষাৎ হইল।

এই যে ভাবী সাহেব, হঠাৎ।

সাকের গোঁয়ার ও চোয়াড় বলিয়া খ্যাত। দরিয়াবিবির সঙ্গে তার ব্যবহার ভারি মধুর। চোখাচোখি দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া সে কথা বলে না পর্যন্ত। কণ্ঠস্বর তার সম্মুখে নরম হইয়া আসে। অথচ বিনয় সাকেরের স্বভাববিরুদ্ধ বিশ্লেষণ।

দরিয়াবিবি মাথার শ্লথ ঘোমটা টানিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি সাকের ভাই। মাথাভাঙা কাজ নেই বুঝি এখন, তাই দেখা হয়ে গেল।

আপনিও লজ্জা দেন ভাবী! লাঠি যখন চালাই, মাথা ভাঙে বৈকি। কিছু করে খেতে হবে তো। চুপচাপ বসে থাকলে কেউ চালডাল যোগাবে?

তোমার বড়ভাই চুপচাপ বসে নেই! সফরে বেরিয়েছে, দেখি কত মালমাত্তা নিয়ে ফেরে।

সাকের বিস্মিত-উল্লাসে জিজ্ঞাসা করে, বড়ভাইয়ের খবর পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ। কোথা জাহানপুর, সেখানে আছে।

মাশায়াল্লাহ। এমন লোক, ডুব দিয়ে এতদিন কাটিয়ে দিলে।

তার ঘরে চাল-ডাল যোগানো আছে, ভাই। সে প্যাকল মাছ সেজে বসে না থাকলে আর কে থাকবে।

সাকের হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল।

গুণধর ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হাসি পায় সকলের।

দরিয়াবিবি ঠোঁট দাঁতে চাপিয়া জবাব দিল।

ভাবী সাহেব, চটে গেলেন। মরদ মানুষদের আপনারা ঐরকম ভাবেন। চাল-ডাল জোটাতে তারা কম চেষ্টা করে না। চাল-ডাল না থাকলে তো মুখ বেঁকে নদীর চড়া হয়ে যায়। তাই মাথা ভাঙি, না মাথা পেতে দিই— এসব দেখবার কি সময় আছে। বড়ভাইকে খামাখা দোষেন।

দরিয়াবিবি হাসি মুখে বলিয়া যায় : তুমি ভাই বেড়াতে বেড়িয়েছ। যাও। আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। বড়ভাইয়ের হয়ে আর ওকালতির দরকার নেই।

জো হুকুম ভাবী সাহেব। কুর্নিশের ভঙ্গিতে সাকের কিছুক্ষণ পিছু হটিয়া অন্য পথে আড়াল হইয়া গেল।

দরিয়াবিবির হাস্যধ্বনি পাড়ার ঘুলি-পথে গুঞ্জরিত হয়। একটু দূরেই সাকেরের উঠান আর লাউ মাচাঙের প্রাঙ্গণ।

সাকেরের মা হাসির শব্দ শুনিয়া কৌতূহলবশত এইদিকে অগ্রসর হইয়াছিল।

দরিয়াবিবিকে দেখিয়া সে আনন্দিত হয়। তুমি, বৌমা! হঠাৎ রাস্তায় এমন হাসছ?

সাকের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। সে কোনো দোষ গায়ে মাখে না। বড়ভাইয়ের মতোই। আমাকে জবাব দিল, ঘাড় না ভাঙলে কেউ খেতে দেবে? সাধে কি আর লাঠি ধরি!

ওর কথা ছাড়ো, মা। কান ঝালাপালা হয়ে গেল ওই এক কথা শুনে-শুনে। এসো, মা।

হাসুবৌ শাশুড়ির গলা শুনিয়া মাচাঙের নিচে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। বড় শীর্ণ হইয়া গিয়াছে তার শরীর। মুখ পাংশু। চোখের কোণে রক্তিমতা আছে কিনা সন্দেহ। চোখদুটি সদ্য-আরোগ্য রোগীর মতো ভাসা ও বিষণ্ণতাক্লিষ্ট।

শাশুড়ী হাসুবৌকে দেখিয়া জ্বলিয়া উঠিল।

ওই যে অভাগীর বেটি, দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে কি আর আল্লা দেবে। সাকের না। হলে আমাদের এত জ্বালাবে কেন?

হাসুবৌ কোনো জবাব দিল না। ক্লান্ত দুই চোখ মাটির সমতলে কী যেন খুঁজিতে লাগিল।

খামাখা রাগ করো কেন, চাচি। এমন কচি বয়স, ছেলেমানুষ। পোয়াতিকে এমন ফজিয়ৎ করলে রোগে পড়বে যে।

রোগটা নেই কোনখানে?

দরিয়াবিবি হাসুবৌর নিকট অগ্রসর হইবামাত্র আতঙ্কিত চোখে সে একটু সরিয়া দাঁড়াইল।

হাসু। দরিয়াবিবির ডাক।

জি, বড়বুবু।

তোমার শরীর ভালো তো আজকাল?

না। সংক্ষিপ্ত নম্র উত্তর।

কদিনে এমন হয়ে গেছ।

দরিয়াবিবি পুনরায় প্রশ্ন করিল, তুমি দিনের হিসেব রেখেছিলে?

লজ্জায় হাসুবৌ চোখ নামাইল।

এগারো মাস হোয়ে গেল। পেটে ব্যথা করে খুব নাকি?

জি।

দেখি একবার।

জি না, থাক্।

দরিয়াবিবি সাকেরের মার দিকে ফিরিয়া প্রশ্ন করিল : চাচি, তুমি পেটে হাত দিয়ে দেখোনি ছেলে নড়ে কিনা? মরা ছেলে পেটে থাকলে, শেষে পোয়াতি নিয়ে ভারি টানাটানি হবে।

আমাকে ছুঁতে দেয় না, মা।

হাসুবৌ ঘরের দিকে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, কোথা যাস্ হাসু?

পিয়াস লেগেছে, বড়বুবু।

পানি খেয়ে শিগ্‌গির আয়। শাশুড়ি আদেশ দিল। দরিয়াবৌ বিজ্ঞের মতো সায় দিতে লাগিল সাকেরের মার মন্তব্যের উপর।

বুড়ো বয়সে সংসারের ঝনঝাট ভাল লাগে না, মা। কোথা নামাজের পাটিতে বসে আল্লা-আল্লা করব, ওদের জন্য দোওয়া মাঙব; না, তা আর হবে না। এইসব ঝামেলা এই বয়সে পোষায়?

দরিয়াবিবির সহানুভূতি প্রকাশ পায় অন্যরূপে।

তা কী করবে চাচি। এইটুকু হাবাগোবা মেয়ে, তুমি না দেখলে সংসার চলে?

হাসুবৌ ঘর হইতে আর বাহির হয় না। বাহিরে দুইজন অপেক্ষা করিতে লাগিল। অবশ্য তাহাদের সময় অন্য কথাবার্তায় কাটিতে থাকে।

তুমি একটু দেখে যাও, মা। সত্যি পেটে যদি মরা ছেলে থাকে, মুশকিল।

তোমার বৌকে ডাকো, চাচি।

শাশুড়ির ডাকে হাসুবৌ আবার মাচাঙের নিচে দাঁড়াইল।

অবেলার অন্ধকার আসন পাতিয়াছে লাউ-মাচার সরস মাটির উপর। কয়েকটি চড়ুই নীলপাতার বনে কিচিরমিচির করিতেছিল।

হাসুবৌ অবনত মুখে ফোঁপাইয়া ফোপাইয়া কাঁদিতেছিল।

দরিয়াবিবি তার শীর্ণ হাত নিজের করতালুর উপর রাখিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিতে লাগিল : হাসু, কান্না কিসের! আমিও মেয়েমানুষ, তোর দুঃখ বুঝি। স্বামী বাউণ্ডেলে হলে কোনো মেয়েই সুখী হয় না।

সাকেরের মা দরিয়াবিবির সান্ত্বনা গ্রহণ করিল না।

মা, বাঁজা মেয়ে, কবছর বিয়ে হল, একটা ছেলে হলে সাকেরের চালচলন বদলে যেত।

দরিয়াবিবি হাসুবৌর রক্তশূন্য আঙুলের দিকে চাহিয়া কহিল : আমারও দুটো ছেলে, চাচি। কৈ, তোমার ভাসুরপোর বাউণ্ডেলগিরি গেল? আর জোয়ান ছেলের এমন কচিবৌ করেছিলে কেন?

শাশুড়ি কোনো জবাব দিল না।

হাসু, তোমার পেটটা একটু দেখি। যদি কপাল তোর ভাঙে, ছেলেটা পেটেই মরে থাকে, তাকে বাঁচাতে হবে তো।

আরো জোর কান্নার সঙ্গেই জবাব দিল হাসুবৌ।–আমাকে মরতে দাও বুবু। আমি সকলের গলার কাঁটা। আমি গোরস্তানে গেলেই ভালো।

দরিয়াবিবি তার চিবুকে হাত দিয়া বলিল : মুখে যা-তা কথা আনিসূনে। দুসাঁঝ এক। দেখি তোর পেট।

তোমার পায়ে পড়ি, দরিয়া বুবু, তোমার পায়ে পড়ি।

তীব্র ক্রন্দনের উচ্ছ্বাসে হাসুবৌর গলা বুজিয়া আসিতেছিল। দুই হাত প্রসারিত করিয়া সে নিজের কক্ষপট আবৃত করিল, চিলের নখর হইতে যেন বিহঙ্গিনী শাবক রক্ষা করিতেছে।

একটুও লাগবে না। একবার দেখব।

হাসুবৌ আরো পিছাইয়া যাইতেছিল।

দরিয়াবৌ ক্ষিপ্রগতিতে তার জঠরের কাপড় তুলিয়া একটান দিল।

এ কী! একরাশ বস্ত্রখণ্ডের ঢিবি যেন ধসিয়া পড়িতেছে। একটু জোর টানের সঙ্গেই। একগাদা ফালি ছেঁড়া টুকরো কাপড় হাসুবৌর স্ফীত জঠরদেশ হইতে নামিয়া আসিল। নঈমার ফালি, লাল গামছা, আরো পাড়ার অপহৃত অনেক শিশুর কাপড় তার ভেতর।

এক নিমিষে মাচাঙের নিচে মূৰ্ছিত হইয়া হাসুবৌ পড়িয়া গেল। স্বাভাবিক তার জঠরদেশ–স্ফীতির কোনো চিহ্ন নাই সেখানে।

কাপড়ের স্তূপের সম্মুখে ফ্যালফ্যাল নেত্রে হতভম্বের মতো দাঁড়াইয়া রহিল সাকেরের মা ও দরিয়াবিবি।

১১-১৫. আজহার হিসেবি বটে

আজহার হিসেবি বটে, কিন্তু পরিবেশের কোনো উপাদান সে তলাইয়া দেখিতে শেখে নাই কোনোদিন। কপাল-ঠোকা গাণিতিক বিদ্যা দোকান করার পূর্বে তার একমাত্র ভরসা ছিল। পদে পদে নিজের ভুল দেখিতে পাইয়াছিল আজহার। সংসার-অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এইসব ব্যাপারে তবু চোখ বুজিয়া বিধাতার দিকেই বারবার চাহিয়া থাকে।

স্টেশন হইতে সড়ক ধরিয়া বহু যাত্রী গ্রামের দিকে হাঁটিয়া যায়। তাহাদের অধিকাংশই শহর-প্রবাসী। মনিহারী দ্রব্য নগরে শস্তা পায় বলিয়া কেউ এইসব অঞ্চলে খরিদ করে না। যারা নিজ গ্রামে থাকে, তারা সামর্থ্যহীন। এক মাস দোকান চালানোর পর আজহার তা নির্মমভাবেই উপলব্ধি করিয়াছিল। ভবিষ্যতের অন্ধকারে মায়াময় হাতছানি লুকাইয়া থাকে; আজহারের মতো নামাজি পরহেজগার ব্যক্তি এই কুহকের রঙকে মনে করিত ঈমানের অঙ্গ। সুতরাং সর্বব্যাপারে নির্বিকার। দোকান খুলিয়া অবসর যাপনই একমাত্র দিন গুজরানের শ্রেষ্ঠ পন্থা। আজহারের সামান্য পুঁজি ছিল, ইতিমধ্যে সে বাড়িতে একবার টাকা পাঠাইয়াছে, অবশিষ্ট মূলধন ভাঙাইয়া ভবিষ্যতের দিগন্ত জরিপ ছাড়া আর কোন্ পথ খোলা আছে?

মাঝে মাঝে হাট-ফেরত পসারিণীরা আজহারের দোকানে ভিড় করে। তারা কোনোদিন শহর দেখে নাই, শহরের জিনিসের জন্য লোভ বেশি। কপয়সার সওদা বা তারা আঁচলে তুলতে পারে? একটা শস্তা স্যালুলয়েডের চিরুনি, দু-পয়সার রঙিন। ফিতা, সঁচ-সূতা অথবা এক ডিবা আল্তা। কেবল গঞ্জের দিনে এই মহিয়সীদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আজহারের ধ্যানধারণা, কল্পনার সৌধ এই দোকানকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিতেছিল। ঈমানদার লোকের দিন আটকাইয়া থাকে না, আজহার এই মূলমন্ত্রটি সহজে বিস্মৃত হইত না। তাহারও দিন অতিবাহিত হইত বৈকি! কোনোদিন রান্নাই হইল না। ময়রার দোকান হইতে দুপয়সার মুড়ি ও বাতাসায় নৈশভোজ সমাপ্ত হইত। নিজেকে লইয়া আজহার খর কোনো লোভ ছিল না বলিয়া সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস এক মুহূর্তও টলিত না।

শুক্রবারে দুপুরবেলা শাদা লুঙি পরিয়া কিস্তি টুপি মাথায় সে তিন মাইল দূরে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়িতে যাইত। এই সময় দোকান বন্ধ থাকিত মাত্র। নচেৎ শেষ বাস স্টেশনে যাওয়া পর্যন্ত দেখা যাইত, আজহারের দোকানে চিনিওয়ালা ছোট দেওয়ালির বাতি জ্বলিতেছে।

দুই মাস কাটিয়া গেল। দোকানে কোনো আয় নাই দেখিয়া আজহার আবার মিস্ত্রিদের কাজে জুটিল। গহর মিস্ত্রী সেদিন খুব হাসিয়াছিল। আজহার তার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। করিয়াছে। এমন হিংসাতুর মন কোথা হইতে আপদের মতো তার সঙ্গ লইয়াছে অকস্মাৎ, আজহার কোনোদিন তা ভাবিয়া দেখে নাই। সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যায় আবার দোকান খোলা হইত। গঞ্জের দিন কাজে যাইত না আজহার। সেদিন দু-পয়সা বিক্রি হয়, তাই।

গহর মিস্ত্রি একদিন অযাচিতভাবে আলাপ আরম্ভ করিল।

আজহার ভাই, আমার সঙ্গে কথা বলো না। সাধে আমি রাগ করি? কপালে মুগুর মেরে এসেছি-ভাই, এ জন্মে আর কিছু হবে না।

আজহার তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। গহর বলিয়া যায় : পয়সা কামাবার হেকমত আছে, ফিকির আছে, ফন্দি আছে, তা যদি না জানো, দোকান দিলেই কি পয়সা হয়?

গহরের সহানুভূতি আদৌ খাদ মিশ্রিত নয়, আজহার বুঝিতে পারে।

তুমি তো কথা বলবে না, খা। আমিই বলে যাই, শোনো, দোকান খুলে খদ্দের ঠকাতে হবে। তার কত ফন্দি। কথায় কথায় হলফ করো, সাতবার মাইরি বলো। বলল, কেনা দামে বেচছি, হুজুর। যদি লাভ নিই তো হারাম শুয়োর খাই। এমনি করে সাতশ শুয়োর খেলে তবে পয়সা হয়। পয়সা হলে হয়তো হাজিসাহেব হোয়ে আসতে পার। মক্কা-মদিনা ঘুরে এলে, ব্যাস। সব সাফ।

গহরের শরীর পাতলা বলিয়া কথার ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার পায়ে চাঞ্চল্য খুব। বেশি ফুটিয়া উঠে।

আজহার এইবার মুখ খুলিল : লাভ না নিলে কারবার চলে, ভাই?

তা হলেই মিথ্যে কথা বলতে হবে। আর যদি সাচ্চা কথাই বলো, বেশি লাভ হবে, হয়তো একদমই হবে না। তাতে সংসার চলে না।

কথাগুলি আজহারের খুব মনঃপূত। ভয়ানক ছোট হইয়া যায় সে। তবু যেন গোলক ধাঁধা হইতে পরিত্রাণ পাইতে তার মন আকুলিবিকুলি করে।

ঈমানদার হলে সংসার করা দায়।

শুধু দায়, চৌদ্দপুরুষ জড়িয়ে পড়ে সুদ্ধ। বলিয়া গহর একটি বিড়ি ধরাইল।

বাসায় আরো মিস্ত্রি কাজ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। আজহার আজ দোকান খুলিতে যায় নাই। বাসার আড্ডা তার ভালো লাগিতেছিল।

গহর ডাকিল : ওদু। আছিস

ওদু-মিস্ত্রি বাসার এককোণে শায়িত অবস্থায় গল্পের দিকে কান খাড়া রাখিয়াছিল।

কি রে! সে জবাব দিল।

তোর মনে আছে, সে-বার, বেলেঘাটার আড়ৎদারের কাজ করি। এক ব্যাটা চামার আমাদের কী ঠকান না ঠকালে।

ওদুর শরীর ক্লান্ত, তাই সে ঘুমাইবার চেষ্টা করিতেছিল। এইবার উঠিয়া বসিল।

গহর, সেই আড়ৎদারের নাম-ডাক কত জানিস, দুটো মসজিদ তৈরি করে দিয়েছে এবার। অথচ আমাদের খাটনির দামটা দিলে না। কত টাকা বাকি ছিল, গহর?

চৌদ্দ টাকা ছ আনা।

গহর বিড়ির ছাই টোকা দিয়া ফেলিয়া পুনরায় কহিল, ব্যাটা চৌদ্দ বছর দোজকে জ্বলবে।

আজহার জবাব দিল : তা কি আর হয় ভাই। কেরামিন-কাতেবিন আমাদের গোনা আর নেকির কথা লিখছে। হাশরের ময়দানে যেদিন বিচার হবে, দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখবে নেকি আর বদীর কোন্ পাল্লা ভারি। চৌদ্দ টাকা মেরে মসজিদ দিলে কোনো গোনা থাকে না, নেকির পাল্লা ভারি হয়ে যায়।

গহর ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল : আজহার ভাই, তোমার ওয়াজের থলিমুখ বন্ধ করো। চৌদ্দ টাকায় মসজিদ হয়? কত চৌদ্দজনের কত টাকা মেরেছে তার খবর রাখো?

আজহার সায় দিল : ঠিক বলেছ, ভাই! আমি অন্য কথা ভাবছিলাম কিনা।

ঐরকম ভাবলে আর দোকান চলে না। মজিদওয়ালা আড়ৎদারের মতো ভাবো, জাল-জোচ্চোরি শেখো, কপাল খুলবে।

তৌবা!

গহর মিস্ত্রি খিলখিল শব্দে হাসিয়া উঠিল। মুখ তার বন্ধ থাকে না।

তবেই তুমি কারবার চালিয়েছ। জুম্মার দিনে দেখি তোমার দোকান সারাদুপুর বন্ধ পড়ে থাকে। খদ্দের যা আসে তা ওই সময় আসে। তখন দোকান বন্ধ রাখলে চলে?

আজহার সহসা উত্তেজিত হয় না। আজ ঝোঁকের মাথায় সে প্রতিবাদ করিয়া বসিল : এ কী কথা তোমার মুখে, গহর ভাই! এবাদতের চেয়ে পেট এত বড়!

অত ঈমানদার হলে ফকিরি নিতে হবে।

আবার ব্যঙ্গের হাসি গহরের কণ্ঠে। একটু দম লইয়া সে ডাক দিল : খলিল চাচা, একটু তামাক সেজে আনো।

বাসার এক কোণায় রান্না চলিতেছিল। খলিল তরকারির হাঁড়িতে জ্বাল দিতেছিল। বয়সে ছোট বলিয়া বাসার সকলের ফাঁইফরমাশ তাকে শুনিতে হয়।

দিচ্চি, চাচা।

গহর অবশ্য খলিলের চাচা নয়, ওদুর সঙ্গে একত্র কাজ করে বলিয়া সে আত্মীয়তা গুছাইয়া লইয়াছে।

ধোঁয়া দে বাবা, ধোঁয়া দে। আর এসব ভালো লাগে না।

খলিল তামাক সাজিয়া আনিল।

গহর কল্কে আজহারের হাতে দিয়া বলিল : খায়ের পো, তুমিই প্রথমে আরম্ভ করো।

থাক, তুমি শুরু কর। নরম সুরে জবাব দিল আজহার।

গহর অত্যন্ত বিনয়ী এখন, কল্কে গ্রহণ করিল না।

আজহার কয়েক টান দিয়া ধোঁয়া ছাড়িতেছে আরামে চোখ বুজিয়া। তখন গহর সহাস্যে আবার বলিতে থাকে : বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁ দাও, খায়ের পো। বড় কঠিন ঠাই দুনিয়াটা।

নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল আজহার। সে চোখ বুজিয়া ধূমপান করিতে লাগিল।

ওদুও কল্কের প্রত্যাশী, আজহারের মুখের দিকে সে চাহিয়াছিল। খলিল কর্তব্যস্থলে ফিরিয়া গিয়াছে। চুলায় চেলাকাঠ জ্বলিতেছিল, আগুনের আভায় দেখা যায় তার মুখ ঘামিয়া উঠিয়াছে।

গহর কল্কে হাতে লইয়া কথাবার্তা শুরু করে। জীবনের অভিজ্ঞতা তার অফুরন্ত। ব্যবসাজগতের বহু মানুষ, মিস্ত্রীরূপে সে দেখিয়া আসিয়াছে। উপনীত মন্তব্য তার সব জায়গায় এক; ঈমানদারের জায়গা নাই সংসারে।

আজহারের পকেটে তবি থাকে। ঠোঁটের এত তোড়ের মধ্যে সে এক-একটি দানা টিপিয়া লইতেছিল। অবাক হইয়া যায় আজহার, এই বয়সে এত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। করিয়াছে গহর!

ওদু!

ওদু আবার আড় হইয়া শুইয়াছিল বিছানার উপর। সে নিদ্রিত কিনা তারই পরীক্ষা লইল গহর!

কে রে।

ওদু, শোনো একটা মজার গল্প। সেবার আমি হাওড়ায় থাকি। এক ব্যাটা এসে বলে, মিস্ত্রি, আমার কাছে তোমার পাঁচ-সাত দিনের কাজ হবে, ফুরোনে ঠিক করে নাও। পাঁচ টাকা রফা হল। আমি টাকা চাইতে বলে এই তো, কাছেই আমার বাড়ি। দশটাকার নোট আছে, খুচরো নেই। তুমি পাঁচটা টাকা দাও, আমি দশটাকা বাড়ি থেকে দিয়ে দেব। আমার সঙ্গে এসো। যো হুকুম। পাঁচটা টাকা তার হাতে দিলুম। মিনিট দশেক দুজনে হাঁটার পর সে বললে, ঐ আমার বাড়ি। তুমি দাঁড়াও বাইরে, আমি টাকা আনি। মুসলমানদের বাইরে চটের পর্দা ঝুলছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই রইলাম। এক ঘণ্টা গেল, সে আর আসে না। শেষে চেঁচামেচি জুড়ে দিলাম। একটা আধবয়সী মেয়ে বেরিয়ে এল ডিপা হাতে। কাকে চাও? বাড়িওয়ালাকে, জবাব দিলাম। মেয়েটা হেসে বলে, এখানে বাড়িওলী থাকে, বাড়িওয়ালা থাকে না। ভেতরে আসবে নাকি? আমি তো অবাক! একদম বেউশ্যে পাড়া। গলির ওপাশ দিয়ে রাস্তা আছে, আমার বাড়িওয়ালা সে পথে পগার পার।

ওদু রস-নিষিক্ত গল্পের মহিমায় বোধহয় আবার উঠিয়া বসিল। মৃদু হাস্যে সে বলে, তারপর?

তারপর ঘোড়ার ডিম। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকা।

বাড়িওয়ালীর কাছে অপেক্ষা করলে না?

শুধু হাতে আর অপেক্ষা চলে না। শোনো, আরো আছে। বছর সাতেক পরে পোস্তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, দেখি একটা বড় কারবারি বসে আছে। আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। সেই লোকটা গদির উপর, আর কত কর্মচারী চারপাশে।

ওদু তুড়ি মাড়িয়া বলিল, শেষে টাকা আদায় করলে বলো তা হলে।

আদায়! অবিশ্বাসের হাসি গহরের কণ্ঠে।

ভয়ে পালিয়ে এলাম। আমার ময়লা চিরকুট কাপড় আর এই চেহারা, সেখানে থু দিতে পারি?

আজহার তসবি টিপিলেও গহরের দিকে তার মোল আনা খেয়াল ছিল।

লোকটা ঠিক চিনেছিলে?

আলবৎ। কাবলীদের মতো চোখ। অত ভুল হয় না খায়ের পো। ঐরকম জুচ্চোরী ফন্দি এঁটে শেঠ হয়ে বসেছে এখন। ঈমানের কাল আছে আর?

তাহলে বেঈমান না হলে দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যায় না। আর কোনো উপায় নেই?

আর্তনাদের মতো শোনায় আজহারের প্রশ্ন। গহরের মুখের দিকে এমন বিষণ্ণ দৃষ্টি ফেলিয়া সে চাহিয়া রহিল যে, গহর চোখ ফিরাইতে বাধ্য হইল। সেও এবার গম্ভীর হইয়া যায়, কণ্ঠে তার আভাস ফুটিয়া উঠিতেছিল।

উপায় যদি জানতুম, তাহলে এই দশা! আমার বিদ্যেতে কুলোয় না।

হতাশার তীব্র ব্যঞ্জনা মানুষের কণ্ঠস্বরে এমন করিয়া সহজে বাজে না। রূপকথা শুনিতে শুনিতে তার বাস্তব পদক্ষেপ যেন কাহিনীকার ও শ্রোতার সম্মুখে হঠাৎ উপস্থিত হইয়াছে, রূপকথা তাই আর জমিতেছে না; সভায় বোবার মতো সকলে দুই চোখ খুলিয়া কেবল চাহিয়া রহিয়াছে–যার কাজল গহনে শুধু বিস্ময়, ভয়, আর ভঙ্গুর মানস বুদ্বুদের জনতা।

সকলেই চুপচাপ। ঘরের কোণে জ্বলন্ত চুলার উপর হাঁড়ির ভেতর ছুঁই ছুঁই শব্দ উঠিতেছিল কেবল।

আজহার যন্ত্রচালিতের মতো তসৃবির দানা এক এক করিয়া টিপিয়া যাইতেছিল। দ্রুত চলে তার আঙুল। গহর পর্যন্ত কেন নির্বাক হইয়া গিয়াছে? সেও জবাব দিতে পারে না।

খলিল বাহিরে গিয়াছিল ভাতের ফ্যান গড়াইতে। তার অদ্ভুত চিৎকার শোনা গেল। আজহার ঈষৎ তড়িৎস্পৃষ্টের মতো হঠাৎ বলিয়া ওঠে : গহর, বাইরে কী হল?

স্ব স্ব পৃথিবীতে সবাই যেন আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। ওদু, গহর, আজহার তাড়াতাড়ি বাহিরে ছুটিয়া আসিল।

খলিল তখন ফোপাইয়া কাঁদিতেছে। একপাশে ভাতের হাঁড়ি বসানো।

কী হয়েছে? সকলের মুখে ওই এক কথা।

আমার হাত পুড়ে গেছে। ও, মা গো

বয়সে ছোট বলিয়া সকলেই খলিলের মেহনতে নিজেদের বিশ্রামের আরাম খোঁজে। গহর এইদিকে বারোআনা গড়িমসি করে। নিজের ভাইপো বলিয়া ওদু একদম নবাব বনিয়া গিয়াছে।

আজহার অতি ব্যস্ততার সহিত বলিল, ঘরের ভেতর চলো। আলোয় দেখা যাক। একটু সাবধান হতে হয়, বাবা।

ওদু ধমক দিতে আরম্ভ করিল, এতবড় ছেলে, একটু উঁশগুশ নেই। পরের ছেলে নিয়ে এসে মুশকিল!

গহর অন্যান্য দিন নাবালকের উপর ওদুর তবি উপভোগ করে। আজ সে পর্যন্ত চটিয়া গেল।

ওদু, যা মুখে আসে তাই বলছিস! ওইটুকু ছেলে, দেড় সের চালের ভাত পসানো চাট্টিখানি কথা নাকি? নিজে তো ছমাসে একবারও হাঁড়ি ছুঁসনে।

ওদু গজর গজর করিতে লাগিল। গহরের কুঁড় ভয়ানক ধারালো, ওদু আর কথা বলিতে সাহস করিল না।

হুকুমজারি কণ্ঠেই গহর বলিল : আমরা দেখছি ওকে, হাঁড়িটা নিয়ে যাও ঘরে। না, কুকুরের মেহমানদারি হবে আজ।

ওদু নীরবে আদেশ পালন করিল। কিন্তু সে এমন চটিয়াছিল যে, খলিলের দিকে আর চাইয়াও দেখিল না।

খলিলের ডানহাতের আঙুলের আগাগুলো ফোস্কায় ভরিয়া উঠিয়াছে। গহর বারবার আপসোস করিতে লাগিল।

চুলায় জ্বাল দাও, দিয়ো। এসব কাজে আর হাত দিয়ো না, বাবা।

গহরের মুখে এমন সুমিষ্ট বাণী। খলিলের দগ্ধ আঙুলের যন্ত্রণা সামান্য উপশম হয় যেন। তাড়ি গিলে এসেছে নাকি গহর, হঠাৎ এমন কথাবাতা?

আজহার বলিল, আমি আলু বেটে দিচ্ছি। ফোঁসকার উপর জ্বালা বন্ধ হয়ে যাবে।

চটপট আলু বাটিতে বসিল আজহার। ততক্ষণে গহর ফোস্কার উপর তালের পাখার বাতাস করিতে লাগিল। তরকারি এখনও রান্না হয় নাই। হাঁড়ি লইয়া পড়িয়াছিল ওদু। এদিকে সে নির্বিকার।

ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়া আলুর পুলটিশ বাঁধিয়া দিল আজহার। হাতের যন্ত্রণা কমিয়া আসিতেছে ধীরে ধীরে।

আজও কৃতজ্ঞতার সহিত খলিল আজহারের মুখ অবলোকন করিতে লাগিল।

নিজের মনেই সে প্রশ্ন করিল : চাচা, তোমার দোকানটা বড় হলে আমাকে দোকানদার করবে?

আজহার তার মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিল, কোনো জবাব দিল না।

সম্মতির এই আর এক নূতন পদ্ধতি মনে করিয়া আরো উৎফুল্ল হইয়া উঠিল খলিল।

আমার এই কাজ ভালো লাগে না।

ওদু খলিলের দিকে একবার চাহিয়া আবার রান্নায় মন দিল। দৃষ্টির ভেতর তার কী ছিল দেখা গেল না।

গহর এখনও হাত হইতে পাখা ফেলে নাই। মাঝে মাঝে খলিলের মুখ হইতে আহ্ উহ্ শব্দ উচ্চারিত হইতেছিল। জ্বালা থামিলেও কব্জি পর্যন্ত টনটন করিতেছিল তার।

আজহার চাচা, আল্লা আপনার দোকানটার বাড় দিত!

আজহার জবাব দিল : তোমার মুখে সুবন (সুবর্ণ) বষুক, চাচা।

গহর কোনো মন্তব্যের দিকে গেল না। পাখা রাখিয়া উঠিয়া পড়িল সে। তার হাত মুখ ধয়া দরকার। আজহার আবার বাতাস করিতে লাগিল।

ওদুকে যমের মতো ভয় করে খলিল। চাচা ভাইপোয় কদাচিৎ প্রাণ খুলিয়া বাক্যালাপ হয়।

দ্বিধা দ্বন্দ্বে দুলিয়া তবু বলে : ওদু চাচা, আমার মাকে খবর দিও না, সে বড় কাঁদবে। ওদু প্রথমে জবাব দিল না। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিল, না, কাল-পরশু বাড়ি রেখে আসব তোকে। এখানে খামাখা বসে বসে খোরাকি খাওয়া।

প্রথমে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল খলিলের মুখ, চাচার শেষ কথাগুলো তার সারা শরীরে কালি লেপিয়া দিল।

না চাচা, কাজ না শিখে আর ঘরে যাব না।

আচ্ছা তাই হবে, আর ডাল হবে, বলিয়া ওদু দুই ঠোঁট চাপিয়া তরকারির হাঁড়ির ঢাকনি খুলিল। শোঁ শোঁ শব্দ উঠিতেছিল, খলিল ক্লান্ত দৃষ্টি সেইদিকে মেলিয়া দিল। গহর ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় পাখা হাতে লইল। সন্ধ্যার আড্ডা তার মেজাজ খারাপ করিয়া দিয়াছে, সহজে না কোনো বাঁকা কথা, না বাঁকা হাসি তার মুখে নিঃসৃত হইতেছিল।

রান্নার পর খলিলের বাসনে ডাল তরকারি মাখিয়া দিয়াছিল গহর। আজহার নিঃশব্দে এক লুমা তার মুখে তুলিয়া দিতে লাগিল। দগদগে হইয়া উঠিয়াছিল এতক্ষণে খলিলের আঙ্গুলের ফোসকা।

.

জুম্মার দিন। আজহার দুপুরের আগেই ভিনগায়ে নামাজ পড়িতে গিয়াছিল। দোকান বন্ধ রাখিতে হয় নাই, খলিল বিপত্তির জন্য কাজে বাহির হইতে অক্ষম। তাই সে-ই দোকান তদারক করিতেছিল। বসিয়া বসিয়া খোরাকি খাওয়া চাচা পছন্দ করে না, তাই আজহারের নিকট সে দুআনা মজুরি চাহিয়াছিল। অবশ্য নানা অনুনয়ের ত্রুটি করে নাই খলিল। গরীব বলিয়া সে এমন নির্লজ্জ প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছে। এ-কথা সে বারবার বলিয়াছিল। মজুরি লইয়া খলিল বাসায় খাইতে গিয়াছে, আসরের নামাজের সময় সে দোকানে আসিবে। আজহার চুপচাপ বসিয়াছিল। আজ খরিদ্দার বিশেষ নাই। সকাল ঝোঁক যা সামান্য বিক্রয় হইয়াছে। জোরে বাতাস বহিতেছিল। রাস্তার ধুলোয় জিনিসপত্র সাফ রাখা মুশকিল। আসবাবপত্র আজহার পরিষ্কার করিয়া আবার বিশ্রামে রত হইল।

দোকানের পশ্চাতে ঝাঁকড়া শিরীষের ডালে শশন্ শব্দ উঠিয়াছিল। মেঘের রং ঈষৎ কাজল, হয়তো ঝড় উঠিতে পারে। নিরুদ্দিষ্ট আকাশের যাত্রীদের সঙ্গী হইয়াছিল একঝক শীতের পাখি। আজহার তার কোনো সংবাদ জানিল না।

আনমনা বসিয়া থাকিলে নানা রাজ্যের চিন্তা আসিয়া ভিড় করে, সোয়াস্তি পায় না আজহার।

বাতাসের স্রোত হঠাৎমন্দীভূত হইয়া গেল। একটি কোকিলা কর্কশ শব্দ করিয়া সম্মুখের বাঁশবনের ঝোপে আসিয়া বসিল। একটু পরে পথের মোড়ে শিসের শব্দ শোনা গেল।

আরো নূতন পাখি আসিল নাকি? শিসের শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে লাগিল।

সড়কের দিকে মুখ ফিরাইয়া আজহার অবাক হইয়া গেল।

চন্দ্রের সর্বাঙ্গে দৃষ্টি বুলাইবার পূর্বে সে সুইৎ শব্দে শিসধ্বনির সমাপ্তি-রেখা টানিয়া আজহারের দোকানের সম্মুখস্থ বাঁশের উঁটির উপর বসিয়া পড়িল।

কোটাল, তুমি?

কৌতূহলে চন্দ্র কোটালের চক্ষুতারকা নাচিতে থাকে। আবার শিস দিয়া সে গুনগুন করিতে লাগিল :

মথুরায় ফিরে এসে
ভুলে গেছ বিন্দাবনের কথা।
আমি তোমায় চিনেছি শ্যাম,
খাইনি চোখের মাথা।

আজহার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উন্মুখ। কোটালের গান আর থামে না।

চন্দর, একটু থামো ভাই। জোর গলায় ডাকিল আজহার।

আগে বিড়ি দাও।

পা নাচাইতে থাকে চন্দ্র।

বিড়ি পান তামাক সব দিচ্ছি। বাড়ির ছেলেপুলেরা কেমন আছে?

গোঁফে তা দিয়া কোটাল জবাব দিল না, মুখ নিচু করিয়া বিড়ালের হাসি হাসিতে লাগিল।

অধৈর্য হইয়া উঠিয়াছিল আজহার, সব ভালো আছে?

আবার গোঁফে লম্বা তা। মাথা দোলাইয়া চন্দ্র জবাব দিল, আমি তার কী জানি?

হাতের তালু প্রসারিত করিয়া চন্দ্র মিটিমিটি হাসিতে লাগিল।

ছেলেরা ভালো আছে?

আসরের নামাজের সময় নিকটবর্তী। খলিল দোকানের সম্মুখে আসিয়া নীরবে দাঁড়াইল। এই লোকটিকে দেখিয়া সেও হতবাক। মনে মনে ভয়ানক হাসি পাইতেছিল তার।

খলিলের দিকে নজর পড়িল চন্দ্র কোটালের।

কার ছেলে, আজহার ভাই? ও বাবা, এখানে তাহলে সংসার পেতেছ? নিকে করলে নাকি ছেলেসুদ্ধ?

খলিল লজ্জায় মরিয়া যাইতেছিল। আজহার অসোয়াস্তি প্রকাশ করিয়া বলিল : চন্দর, থাম্ একটু। ও দোকান দেখেশোনে মাঝে মাঝে। আমাদের এক মিস্তিরির ভাইপো।

তাই ভালো। ঘরেও সব ভালো। আগে একটা বিড়ি দাও, তবে সব খুলে বলব।

আজহার জবাব দিল : কোটাল, একটু মিষ্টি আনিয়ে দিই, তারপর বিড়ি খাও।

না, ওসব দরকার নেই।

অগত্যা আজহার বিড়ি-দেশলাই বাহির করিয়া দিল।

চন্দ্র কোটাল নিশ্চিন্তে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল : সব ভালো আছে, ভগবানের দিন তো আটকে থাকে না কারো জন্য। তবে কখনো কখনো দুপায়ে চলে আর কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো চার হাতপায়ে চালাতে হয়।

প্যাঁচ কষা কথা আজহারের সহজে বোধগম্য হয় না, আজ অবশ্য পরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে নির্দয়ভাবে সবকিছু উপলব্ধি করিল।

খাঁ এইদিকে চতুর। মনের হঠাৎ-জাগা কোনো বেদনা সে অন্য কথায় ঢাকিতে চায়।

অনেক দূর থেকে এসেছ। চলো, একটু ঠাণ্ডা হয়ে মিষ্টি খাও। আর কোনো কাজ আছে?

কাজ! চন্দ্র কোটাল ভ্রুকুটি করিল। অনেক কাজ। দোকানটার মালপত্র গুটিয়ে এখনই মহেশডাঙা রওনা হতে হবে।

আজহার যেন সব ঘুলাইয়া ফেলিতেছে।

শিগগির কেন? দোকানটা কিছুদিন দেখব।

চন্দ্র এবার সত্যই গম্ভীর হইয়া উঠিল। ভয়ানক তিক্তকণ্ঠেই সে জবাব দিল : ওসব রাখো। আর লাখ টাকা কমাতে হবে না। কমাসে ঘরের কী দুর্দশা হল দেখে আসবে চলো। জমি কবিঘে পর্যন্ত রহিম বখশ নিয়ে নিল। কদ্দিন ফেলে রাখবে সে। দরিয়াভাবী বলে সংসার চলছে, আর কেউ হলে ঢি ঢি করে ছাড়ত।

আজহার লজ্জায় মাথা নিচু করিল, চোখের কোণ তার সজল হইয়া উঠিয়াছে।

হাঁড়ির খবর আর হাটে ভেঙে লাভ নেই। তোমার চাদর দিয়ে এইতো কটা জিনিসপত্তর–বেঁধে নিয়ে, চলো সরে পড়ি।

খলিল বোবা অবোধ শিশুর মতো আগন্তুক খ্যাপা লোকটির গতিবিধি আড়চোখে লক্ষ্য করিতেছিল।

ঢের উপায় হয়েছে বিদেশে। চলো মহেশডাঙা। শাকপাতা খেয়ে চোখের উপর তবু সংসারটা দেখতে পাবে।

শিকড়-বশীভূত সাপের মতো আজহার আর মাথা তুলিল না।

চন্দ্র সত্যই নাছোড়বান্দা। আজহার মৃদুভাবে নানা আপত্তি জানাইল, কিন্তু কিছুই টিকিল না। এক ঘণ্টার মধ্যে চাঁদরে মনিহারী পণ্যগুলি বাঁধা পড়িল। চন্দ্র নিজে সড়কের ওপাড়ে এক পানওয়ালার নিকট কাঠের শেফ কটা বিক্রয় করিয়া দিল। ক্ষতি হইল এক পয়সা। সে তো আজহার খাঁ নয়।

কেমন বর্বর মনে হয় চন্দ্র কোটালকে খলিলের নিকট। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সুগোল, গুম্ফবিশিষ্ট কোনো দৈত্য নয়, হঠাৎ শাহানপুরে আসিয়া সব লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়া গেল।

আজহার প্রদত্ত একমুঠো মুড়ি-লজেঞ্চুস যা একমাত্র সান্ত্বনা।

বাসায় তখনও মিস্ত্রিরা ফিরিয়া আসে নাই। কারো সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজনও ছিল না আজহার খাঁর। নিজের সূমি কন্নিকা-পাটা গুছাইয়া লইবার জন্য সে একবার বাসায় গিয়াছিল। খলিলের মনমরা ভাব দেখিয়া সে সত্যই ব্যথিত হইল।

একবার সময় এলে আমাদের গায়ে এসো। মহেশডাঙা, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে।

আচ্ছা, চাচা।

অনেক দূর আগাইয়া আসিল খলিল। জল্লাদখানার গহ্বরে সে একজন সমব্যথী হারাইল।

চন্দ্র কোটাল দোকানের মালপত্র পিঠে ঝুলাইয়া লইয়াছিল।

হাঁটিতে হাঁটিতে সে বলিল : ঘাবড়ে যেও না, খা ভাই। সামনে পুন্য মতে পীরের মেলায় সব বিক্রি হয়ে যাবে।

আজহার ছোট একটি পুঁটলি লইয়া হাঁটিতেছিল, কোনো জবাব দিল না।

পড়ন্ত দিনের শেষভাগ। রৌদ্র মরিয়া গিয়াছে। গাছপালা ছায়া দীর্ঘতর হইয়া সড়কের উজ্জ্বলতা মুছিয়া দিতেছে।

জনপদ ছাড়াইয়া চন্দ্র গান ধরিল :

মথুরা ছেড়ে কোটাল যমালয়ে চলে,
মাঠে মাঠে গোপিনীরা ভাসে চোখের জলে,
ও-ও-ও-ও-ও।

আজহার হাসিয়া উঠিল। বলিল : চন্দর, আবার ভাড়-নাচের দলটা জমাও। গান বাঁধতে এখনও বেশ পারো।

চন্দ্র মাথা দোলায়, সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের বোঝা দুলিতে থাকে।

দেশে মানুষের দশা ভালো থাকলে চন্দরকে কি আর এত বোঝা বইতে হয়!

ঘাড়ের বাম দিকে বোঝা ঝুলিতেছিল, কোটাল ডাহিনে লইয়া একবার ঝাঁকুনি দিল।

শুয়ো ওয়ো-ওয়ো_শ্যাম, এত দুক্ষু দাও রে
ধিকিধিকি তুষের আগুন মাঠের উদাস বাও রে

সড়কের সর্পিলতা দূরে নিয়ামতপুরে গিয়া মিশিয়াছে। আরো দশমাইল দূরে মহেশডাঙা। দ্বাদশীর চাঁদ আকাশে বহুক্ষণ আগেই আসর জুড়িয়াছিল। প্রান্তরের হাহাশ্বাস বাতাসের মূচ্ছনায় বিলীন কোনো দিনের ইতিহাস যোজনা করিতেছিল। শব্দায়িত বিষণ্ণতা জলা-জাঙালে।

চন্দ্র শিস দিতে লাগিল, শ–ওয়ো–ওয়ো–ওয়ো—

.

১২.

অঘ্রান মাসের ভোরবেলা। দরিয়াবিবির ঘুম ভাঙিয়াছিল অনেকক্ষণ। ধান সিদ্ধ করিবার জন্য রাত্রির বিশ্রামটুকু বহু আগেই তাকে বিসর্জন দিতে হইয়াছে।

সামান্য শীত পড়িয়াছিল। তরল কুয়াশায় আচ্ছন্ন গাছপালার উপরে নিষ্প্রভ তারকার দ্যুতি তখনও মিটিমিটি জ্বলিতেছিল।

মোটা শাড়ির আঁচলে পুরু করিয়া বুক ঢাকিয়া দরিয়াবিবি সিদ্ধ ধান আঙিনার একদিকে ঢালিয়া রাখিতেছিল। ডাবা হইতে ভিজে ধান হাঁড়ি-ভর্তি করার সময় ভয়ানক শীত ধরে। চুলার নিকটে অবশ্য উত্তাপ পাওয়া যায় কিছুক্ষণের জন্য।

রাত্রে ভালো ঘুম হয় নাই। বারবার হাই উঠিতেছিল দরিয়াবিবির। আজহার-নঈমা ঘুমাইয়া রহিয়াছে। আসেকজানের কাছে আমজাদ এখনও নিদ্রায় অচেতন। দরমায়। মাঝে মাঝে মোরগ ডাকিতেছিল। বড় কর্কশ মনে হয় তার শব্দ।

চুলায় জ্বাল দিতে দিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল দরিয়াবিবি। মাস চার পরে নূতন সন্তানের জননীর শিরোপা মিলিবে, এই চিন্তা বারবার পীড়া দিতেছিল তাকে। স্ফীত জঠর লইয়া পরিশ্রমের কামাই নাই। দরিদ্রের গৃহে ইহারা কেন ভিড় করিতে আসে? নঈমার চোখের পিচুটি ভালো হইতেছে না। যদি অন্ধ হইয়া যায় সে। গরিব মেয়ের হয়তো বিবাহই হইবে না। সদরের দাঁতব্য হাসপাতাল পাঁচ মাইলের পথ। অতদূর কচিমেয়ে হাঁটিয়া যাইতে পারিবে? আমজাদের মতবে পড়া শেষ হইয়া যাইবে এই বৎসর। তার আগামী শিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত নাই। চন্দ্র কোটাল জমিগুলি নিজের নামে বিলি করিয়া লইয়াছিল বলিয়া তবু চাষাবাদের জীবিকার সম্বল রহিয়াছে–নচেৎ তা-ও ধূলিসাৎ হইত।

হঠাৎ ফিক ব্যথা ধরিয়াছিল দরিয়াবিবির জঠরে। চুলার আগুনে তার ফ্যাকাশে পাষাণ-স্তব্ধ মুখটি আরো কালো হইয়া গেল। পেটের কাপড় খুলিয়া চুলার উত্তাপ লাগাইতে রত হইল দরিয়াবিবি। আরো আঁকিয়া আসে ব্যথা। এখনও দু-হাঁড়ি ধান সিদ্ধ করিতে হইবে। দরিয়াবিবির মুখে কোনো আর্তনাদের শব্দ উত্থিত হইল না। উঠানে সিদ্ধ ধানের স্থূপ, তখনও উত্তপ্ত ধোঁয়াটে বাষ্প উখিত হইতেছে। দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি তারই উপর ঈষৎ জঠর চাপিয়া শুইয়া পড়িল। বারবার আশঙ্কিত হইতে লাগিল, এখনই সে অজ্ঞান হইয়া পড়িবে।

একটু আগে শীতে কাঁপিতেছিল। এখন সর্বাঙ্গ ঘামিয়া উঠিয়াছে। কপালে স্বেদবিন্দু চকচক করিতেছিল।

দরিয়াবিবি চারিদিকে চোখ ফিরাইল। বাস্তুর নিচে গাছপালা স্তব্ধতায় ভোরের আলোক পান করিতেছে। নীল কলাবনের উপরটার শুকতারা অন্য দিনের চেয়ে আজ উজ্জ্বলতর মনে হয়। তবু ধূসর আকাশের চত্বরভূমি।

অকস্মাৎ সটান হইয়া ধানের স্তূপ আলিঙ্গন করিয়া শুইয়া পড়িল দরিয়াবিবি। অসহ্য বেদনায় তার পা কাঁপিতে থাকে। একবার শব্দ করিয়া দাঁতে দাঁতে চাপিয়া নিশ্চল পড়িয়া রহিল উলঙ্গ ইভের প্রতীক বহনকারিণী ভূলুণ্ঠিতা জননী।

সিদ্ধধানের উত্তাপে বেদনার কিঞ্চিৎ উপশম হইলে আবার চুলার মুখে আসিয়া বসিল দরিয়াবিবি। ধান টিপিয়া দেখিল, এইবার নামাইবার সময় হইয়াছে। দ্রুত হাত চালাইতে লাগিল সে।

এমন কর্মোন্মত্ত কেন দরিয়াবিবি? সংসারে শুধুমাত্র তারই স্কন্ধের জন্য! তার স্বামী নাই, আজহার নাই?

এক হাঁড়ি নামাইবার পর চুলায় জ্বাল দিতে দিতে দরিয়াবিবি পুনরায় চিন্তাস্রোতে মগ্ন হইয়া যায়। জগদ্দল প্রস্তর-শিলার বুকে প্রস্রবণের বুদ্বুদ উপল-রেখায় মৃদু তরঙ্গে সমাহিতি চায়।

চোখ বুজিয়া আসিতেছে ঘুমে, তবু কর্তব্যের বেড়ির নাগপাশ শিথিল করিবার কোনো উপায় নাই। ধীরে ধীরে চুলায় জ্বাল দিতে লাগিল দরিয়াবিবি। উবু হইয়া বসার ফলে শিরদাঁড়া টনটন করিতেছে। একটি পিড়া সে টানিয়া আনিল ঘরের দাওয়া হইতে।

দিগ্বলয়ে প্রভাতের আলোর জোয়ার আরম্ভ হইয়াছে মাত্র। বনানীর নিঃসঙ্গে রাত্রি চরা পাখি বিশ্রামের জন্য ঠাই খুঁজিতেছে। প্রত্যুষের মনোহরণ ঝঙ্কারে জাগিয়া উঠিতেছে পশু-পাখি তরু-লতা কিষাণ-জনপদের অধিবাসীরা। গ্রামান্তর হইতে মুয়াজ্জিনের আল্লাহু আকবর ধ্বনি-মূর্ঘনার রেশ রাখিয়া গেল মহেশডাঙার জলা-জাঙালে।

খাঁ-পাড়ার আশেপাশে স্নানার্থী যুবতী-বধূ ছাড়া আর বোধহয় কেহ জাগে নাই। আরো কত না রাত্রি দরিয়াবিবি একাকী জাগিয়া এমন সাংসারিকতায় নিজের সামান্য বিশ্রামটুকু বিসর্জন দিয়াছে। কোনো ক্ষোভ নাই মনে। নিপ্রাণ লৌহকঠিন পাথরের মূর্তির মন ঝাক্ষুব্ধ প্রহরে বর্ষণের আঘাত নীরবে সহিয়া যাওয়া শুধু, প্রান্তরের দিকে ভাস্করের দূরপ্রসারী দৃষ্টির ছায়া মেলিয়া দিয়া। আজও তেমনই নীরবতায় নিজেকে আবৃত করিয়াছিল দরিয়াবিবি। অলক্ষিতে কখন চোখের কোণে অশ্রু জমিয়াছে, তারও খোঁজ রাখে নাই সে। পেশি, স্নায়ু আর মনের মিতালি অজানিতেই আসিয়াছে।

গণ্ডদেশে তপ্ত একফোঁটা অশ্রু-পতনে দরিয়াবিবি সজাগ হইয়া উঠিল। চোখ মুছিয়া চারিদিকে করুণা-বিহ্বল দৃষ্টির সাহায্যে অবলোকন করিতে লাগিল।

দাওয়ার পাশে রান্নাঘর, তার পাশে টাটির বেড়া। গোয়ালঘরে যাওয়ার পথ। ভিটের ধারে গাছপালা আছে বলিয়া এইদিকে এখনও অন্ধকারের ভিড়। চুলার আলোর ঝলকানি তার ঠোঁটের উপর পড়িয়াছিল। হঠাৎ মানুষের ছায়া দেখিয়া দরিয়াবিবি দৃষ্টি আরো সজাগ করিল। মানুষের শিরোদেশের ভাঙা-ভাঙা ছায়াই তো বটে!

সকালে চোর আসে না, দরিয়াবিবিও ভয় পাওয়ার পাত্রী নয়; সে উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু অগ্রসর হওয়ামাত্র ছায়া সরিয়া গিয়াছে। টাটি খুলিয়া দরিয়াবিবি চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। না, কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নাই। মনে একটু খটকা লাগিল। আনমনা দরিয়াবিবি আবার চুলাশালে ফিরিয়া আসিল।

এইবার চোখকে অবিশ্বাসের কিছু নাই। সেই ছায়া তেমনই অবিকল টাটির উপর। কিন্তু অগ্রসর হওয়ামাত্র মিলাইয়া গেল।

ভয়ানক ধাঁধায় পড়িয়াছিল দরিয়াবিবি। জিন-ভূতের ব্যাপার নয় তো। একটু ভীত হইল আজহার-পত্নী। কিন্তু তৃতীয়বার টাটি খুলিয়া দেখিল, একটি দশ-বারো বছর বয়সের বালক কাঁঠালগাছের ছায়ায় দাঁড়াইয়া আছে। ভোরের আলো তখনও এখানে অপরিচিত, ছেলেটির মুখে উজ্জ্বলতা পড়ে নাই।

এই খোকা। দরিয়াবিবি ডাক দিল। ছেলেটি ভোরের আলোকের ছায়ায় পা-পা করিয়া কিছুদূর আগাইয়া গেল।

দাঁড়াও। আপ্ত রমণীর কণ্ঠ ধ্বনিত হয়। ছেলেটির গমন নিরস্ত, হঠাৎ মুখ ঢাকিয়া সে ফোঁপাইতে লাগিল।

দরিয়াবিবি ছেলেটিকে কোলে টানিয়া বলিল : কাদের ছেলে, খোকা? বাপ মরেছে বুঝি? পালিয়ে এসেছ?

সে কোনো জবাব দিল না। ফোঁপাইতেছিল, এখন স্তব্ধ হইয়া গেল। মাঝে মাঝে তবু ফোপানির শব্দ ভোরের বাতাসে আলোড়ন তোলে।

কাদের খোকা তুমি? দরিয়াবিবি তাকে তপ্ত বক্ষের পাশে গভীরে টানিতে লাগিল অচেতন স্নেহে।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে হাসি খেলিয়া যায়। বেশ ছেলে তো। জবাব দেবে না?

এখনও এখানে অন্ধকারের ঘোর কাটে নাই। গাছের পাতায় অলস সমীরণের কানাকানি ধ্বনিত হয়।

আবার ফোঁপাইতে শুরু করিয়াছে ছেলেটি। কোনো জবাব নাই তার মুখে।

অগত্যা দরিয়াবিবি বলিল : তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি নে, চলো আমাদের ঘরে।

মন্ত্র-মোহিতের মতো বালকটি দরিয়াবিবির বাহুবেষ্টনে থাকিয়া হাঁটিতে লাগিল।

উঠানে ভোরের আকাশ থামিয়া পড়িয়াছে। মানুষের পরিচয় স্বচ্ছ দৃষ্টির কাছে অগোচর থাকে না।

খোকা, তোমার নাম কী।

বালকটি দরিয়াবিবির ডাগর চোখের দিকে নিজের আকৰ্ণবিস্তৃত দুই নয়ন মেলিয়া দিল। গভীর মমতাময়ী আঁখিপল্লবের অন্ধকার দূর হইতে-না-হইতে দরিয়াবিবির চোখে পড়িল বালকের জ্বর উপরে কালো দাগ।

বিস্মৃতির তিমির কে যেন এক নিমেষে মুছিয়া দিল।

মোনাদির, আমার মুনি! অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে কয়েকটি কথা আধস্পষ্ট গুঞ্জরিত শুধু হয় নাই। সেইখানে বালকটিকে গভীরে বুকে বাঁধিয়া অকস্মাৎ বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি। তারপর শুরু হইল অঝোর আঁখির উৎসমুখের প্রস্তর-বিদারণ।

ডুকরাইয়া কাঁদিতে লাগিল মোনাদির মার কোলে মাথা খুঁজিয়া। বাইরের প্রভাত স্নিগ্ধ আলো আর বায়ুতে আজ আর এতটুকু মমতাও ছড়ানো নাই।

একটু বসো, বাপ আমার।

সিদ্ধধান একটু আঁচ ধরিয়াছিল, পোড়া গন্ধ উঠিতেছে। দরিয়াবিবি মোনাদিরকে বসাইয়া রাখিয়া তাড়াতাড়ি হাঁড়ি নামাইল।

ধান ঢালা হইল যথাশীঘ্র। মোনাদির মাঝে মাঝে ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে। অপরিচিত পরিবেশে তার চোখ কৌতূহলের কোনো নেশায় ডুবিয়া যায় না। সে মার মুখের দিকে বারবার চাহিয়া থাকে।

কাজ শেষ হইয়া গেল, সে মোনাদিরের কচি মুখ তুলিয়া তার ডাগর চোখের দিকে চাহিয়া রহিল।

গরিব দাসীমাকে এতদিনে মনে পড়ল? ধরা-গলায় কথা শেষ করিয়া দরিয়াবিবি কচি ঠোঁটে-মুখে বারবার চুম্বন করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে সে-ও ঊর্ধ্ব-নিবদ্ধ নয়নে নীলিমার প্রশান্তি চয়ন করিবার উদ্দেশ্যে বোধহয় আকাশের দিকে মুখ ফিরাইয়াছিল।

বেশ ভালো ছিলে, মুনি?

মুনি সলজ্জ কণ্ঠে জবাব দিল : হ্যাঁ, মা।

দরিয়াবিবি তাহাকে কোলে তুলিয়া খুঁটিনাটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

একটু পরে আসিল আজহার। ফজরের নামাজ শেষ করিয়া সে দহলিজ হইতে ফিরিতেছিল। দরিয়াবিবির কোলে একটি অপরিচিত বালক দেখিয়া সে বিস্মিত।

কার ছেলে কোলে?

মাথায় তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া দিয়া দরিয়াবিবি নম্রকণ্ঠে জবাব দিল, আমার ছেলে এসেছে।

বাঃ, বেশ সুন্দর ছেলে তো। কী সুন্দর চোখদুটো।

দরিয়াবিবির মুখ রাঙা হইয়া উঠিতেছিল।

বাপ মুনি, তোমার আব্বাকে সালাম করো।

যন্ত্রচালিতের মতো মোনাদির আজহারের পায়ে কদমবুসি শেষে আবার মার কোলে ফিরিয়া আসিবার উপক্রম করিল।

তোমাকে যেতে দেব না।

আজহার চিবুক ধরিয়া তার মুখ নিরীক্ষণ করতে লাগিল।

তুমি আমার বাবাজি আজ থেকে। আমি তোমার ছেলে।

নিজের রসিকতায় আজহার হাসিতে থাকে। তার স্বভাবের রীতিমতো ব্যতিক্রম।

তোমার নাম বলল।

মোনাদির লজ্জায় মাথা নিচু করিল। জবাব দিল দরিয়াবিবি, মোনাদির হোসেন খাঁ। আমি মুন ডাকতাম।

বেশ, বেশ। আমার মুনি বাবাজি।

হঠাৎ আজহার চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, আমু-নঈমা-আমু

তারা বিছানা ছাড়িয়া সকলে ছুটিয়া আসিল কয়েক মুহূর্তে। ভোরের বেলা বিছানায় জাগিয়া কল্পনা করিতে আমজাদের খুব ভালো লাগে।

দেখে যা আমু-নঈমা, তোদের বড়ভাইকে দেখে যা।

তারা বিস্মিত নয়নে শিশুসুলভ বিহ্বলতায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

আজহারের উচ্ছ্বাস দেখিয়া দরিয়াবিবি মনে মনে আনন্দিত হয়। তার কোলে মোনাদির উপবিষ্ট বলিয়া নঈমা আমজাদ দূরে দাঁড়াইয়াছিল।

আয়, কাছে আয়, তোদের বড়ভাই।

মোনাদির কোনো কথা বলিল না। আমজাদের হাত নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। তার সস্নেহ দৃষ্টি নঈমার উপর পড়িলেও পিচুটি-ভরা চোখের জন্য কেমন যেন লাগিতেছিল তাকে।

দরিয়াবিবি নৈরাশ্য-ক্লান্তি নিমেষে কখন ভুলিয়া গিয়াছে। ফল্গুধারার মতো আনন্দের অন্তঃস্রোত তার পাঁজরে নূতন মেঘের মতো খেলিয়া যায়।

তুমি ছেলেদের সঙ্গে ভাব করিয়ে দাও। একটা কলার কাঁদিতে রঙ ধরেছে দেখে। এসেছিলাম কাল, আজ পেকে গেছে নিশ্চয়। সকালবেলাটা ছেলেদের ভালো নাস্তা হবে।

দরিয়াবিবি দ্রুতগতি চলিয়া গেল। মোনাদির মার গমনপথের দিকে চাহিয়া থাকে।

আজহার বলিল : তোমরা খেলা করো, আমি হুঁকোটা ধরিয়ে আনি। আমজাদ, তোর আজ মক্তবে গিয়ে কাজ নেই।

আনন্দে সে উঠানময় ছুটাছুটি করিতে লাগিল।

.

১৩.

হঠাৎ নূতন কর্মোদ্যম ফিরিয়া আসিয়াছে দরিয়াবিবির। আজহার অবাক হইয়া যায়। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর সংসার-যাপনের যুগ্ম-বন্ধন থাকিলেও, এতদিন বড় ফাঁকা ঠেকিত সবকিছু। দরিয়াবিবি পাষাণই তো বটে। আজকাল হৃদ্যতার নব মুকুল প্রস্ফুটিত হইতেছে কিষাণ-দম্পতিকে ঘিরিয়া। স্নেহযত্নের আতিশয্যের কোনো কূল-কিনারা করিতে পারে আজহার।

মোনাদির কয়েক দিনেই অপরিচয়ের বেড়াগুলি ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। আজহার আমজাদ অপেক্ষা মোনাদিরকেই যেন বেশি স্নেহ করে। কোনো ফাঁই-ফরমাশ তাকে। খাঁটিতে হয় না। গাঁ হইতে এক মাইল দূরে মাইনর স্কুলে আজহার তাকে ভর্তি করিয়া দিয়াছে। মাইনাপত্র যোগাইবার সাহস আছে তার। দরিয়াবিবির উৎসাহ কম নয়। পুরাতন দিনগুলির স্মৃতি কিছুটা উত্তাপ অবশ্য হ্রাস করিয়া ফেলে। আমজাদের মতবের পড়া আর দুমাস পরে শেষ হইয়া গেলে দু-ভাইয়ে একসঙ্গে স্কুল যাইবে। এখনও দুমাস। একা একা মোনাদির স্কুলে যায়, দরিয়াবিবি তার জন্য খুব উতলা হইয়া পড়ে। নদীর ধারে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করিতে করিতে একদিন তার বাড়ি ফিরিতে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল, সেদিন সকলের খাওয়াদাওয়া সারিতে রাত্রি বারোটা বাজিয়া গেল। বিকালে দরিয়াবিবি রান্না চড়ায় নাই।

মোনাদির আসেকজানকে দুচোখে দেখিতে পারে না। তার নোংরামির নানা কীর্তন করে সে মায়ের কাছে। আমজাদ অবশ্য কোনো বিপত্তি তোলে নাই। ঘর মাত্র দুখানা। মোনাদির আসেকজানের কাছে ঘুমাইতে নারাজ।

বুড়ির মাথায় যা উকুন। অগত্যা দরিয়াবিবি নিজের ঘরেই তাকে স্থান দেয়। এখানেও উশখুশ করে মোনাদির। তার সহজে ঘুম হয় না, সে উপলব্ধি করিয়াছিল। এইজন্য আর একটি চালা তৈরির বায়না ধরিয়াছিল দরিয়াবিবি। ঘরে চালের সঙ্গে চাল বাড়াইয়া একটি ছোট ছোট বেড়ার কামড়া প্রস্তুত করিয়া ফেলিল আজহার। চন্দ্র কোটাল শুধু তার গতরের মেহনত নয়, খড়ও দিয়াছিল দশগণ্ডা। এই ঘরে মোনাদির আর আমজাদ। লেখাপড়া করে, বইপত্র রাখে। পাশে উদ্বাস্তু এলাকা, গাছপালায় ভরা। জোছনা রাত্রে আমজাদ মোনাদির দুইজনে প্রাণ খুলিয়া গল্প করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়ে। আসেকজান এইজন্য আফসোস করে নাই। আমজাদ তার কাছ হইতে সরিয়া গিয়াছে। কোনো কোনো রাত্রে বুড়ি হামাগুড়ি দিয়া তাদের কামরায় প্রবেশ করে। হয়তো এতক্ষণ গল্প চলিতেছিল, বুড়ির আগমনে চুপ হইয়া যায় দুই ভাই। মোনাদিরকে বুড়িও খুব ভালো। চোখে দেখে না। বুড়ো পাখি কী পোষ মানে বৌমা, চাল-ছোলা খাওয়ানোই সার। দরিয়াবিবির ধমকে আসেকজান আর এমন কথা কোনোদিন মুখে তোলে নাই। সে মনে মনে তুষের আগুন ধোঁয়াইয়া রাখিয়াছিল। আমজাদকে একা পাইলে বুড়ি নানা মন্ত্রণা দিয়া মনের ঝাল মেটায়। আমজাদও সহজে আসেকজানের ছায়া মাড়ায় না। তোমার ব্যাটা, দরিয়াবৌ, মদ্দ হয়ে গেছে, আর আমার কাছে শোবে কেন? ক্ষোভ মিশিয়া থাকে কথাটায়।

তবু মোনাদির এই সংসারে এক ব্যাপারে অনাত্মীয়। দারিদ্রের কোনে ছায়া তার। চোখে পড়ক, দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে না। স্বামী-স্ত্রী ফিফিস্ করিয়া দেনা-পাওনার কথা বলে। ঘরে চাল বাড়ন্ত হইলে দরিয়াবিবি পূর্বের মত আর হৈ-চৈ করে না স্বামীর সঙ্গে। পাছে কথাটা মোনাদিরের কানে পড়ে। হয়তো তার ফলে একদিন আবার চলিয়া যাইবে সে। পরাশ্রিত, তবু নিশ্চয় এমন গরীব হালে সেখানে মোনাদির দিন কাটায় নাই। আজহার খাঁর লুঙি ছিঁড়িয়া গিয়াছিল। নামাজ শুদ্ধ (সহীহ) হয় কি না সন্দেহ। সিজদার সময় হাঁটু বাহির হইয়া পড়ে। সে নিজে লুঙি না কিনিয়া মোনাদিরের হাফপ্যান্ট ও শার্ট কিনিয়া দিল। বালক হইলেও মোনাদির সংসারের শ্রী সম্পর্কে সচেতন। মার অনাত্মীয়ভাব সে কোনোদিন তলাইয়া দেখে নাই। মার সঙ্গীই তো আশীবাদের সমান। অন্য কিছু নিষ্প্রয়োজন।

মোনাদিরের সবচেয়ে ভাব হাসুবৌর সঙ্গে। মাত্র কয়েকদিনে এমন আপন করিয়া লইয়াছে সে দরিয়াবিবির এই সন্তানটিকে। যেদিন স্কুল থাকে না, সারাদুপুর কাটে সাকেরের বাড়িতে। আমজাদ আর মোনাদির বইয়ের গল্প পড়িয়া শোনায়। অসহায় এই বধূটি নূতন করিয়া প্রাণপ্রাচুর্যের সন্ধান পায়। সাকেরের সঙ্গে মোনাদিরের মাখামাখি। আরো বেশি। আমজাদ পূর্বে সাকেরকে এড়াইয়া চলিত। সে-ও আজকাল মোনাদিরের দেখাদেখি সাকের চাচার সঙ্গে সখ্য পাতাইয়াছে। মোনাদিরকে সে লাঠিখেলা শেখায়। দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে নাই। তার সুন্দর কিশোর পুত্র চোয়াড় না হইয়া যায়।

জলা-জাঙাল, গোঠ-মাঠ নূতন ভাষা খুঁজিয়া পাইয়াছে। আমজাদও ফাঁইফরমাশ শুনিতে চায় না, কেবল মোনাদিরের সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতে ভালোবাসে। আজহার বর্তমানে পরিশ্রমের মাত্রা বাড়াইয়া দিয়াছে সংসারে একজন প্রাণী বাড়িয়াছে বলিয়া। আমজাদকে এই সময় তার বেশি দরকার। সে কিন্তু ধরাছোঁয়া দেয় না।

চন্দ্র কোটালের সঙ্গে আজহার খাঁ শকরগঞ্জে আলুর চাষ করিয়াছিল। কচি লতায় নদীর চর পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। গোড়ায় আলু ধরে নাই তখনও। মোনাদির আমজাদের সঙ্গে এই কচি গাছ তুলিয়া মূলের মিষ্টতা আস্বাদ করিতে খুব ভালোবাসে।

একদিন চন্দ্র কোটাল দুইজনকে হাতেনাতে ধরিয়া ফেলিল।

সব আলুমূল খাওয়া হচ্ছে।

এক বাবলা বনের আড়ালে তাড়ি গিলিয়া শুইয়াছিল কোটাল। কিশোর কণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভাঙিয়া গেলে তার চোখে পড়িল এই অপচয়-দৃশ্য। চোখ আরো বড় করিয়া গোঁফ ফুলাইয়া সে গম্ভীরকণ্ঠে বলিল : আলুমূল খাওয়া হচ্ছে, চৌকিদার চৌকিদার

এমন চিৎকার করিতে লাগিল, যেন গ্রাম জুড়িয়া ডাকাত পড়িয়াছে।

আমজাদ ভয় পাইয়াছিল। মোনাদির পূর্বে এই লোকটিকে দেখিলেও এমন মূর্তি আর দেখে নাই।

না কোটাল চাচা, তুলে দেখছিলাম। আলু হয়েছে নাকি।

আলু হয়েছে নাকি আসুক চৌকিদার। পালিয়ো না, খবরদার।

আমজাদ ওকালতি করিতে আসিল, ও আমার বড়ভাই।

তুমিও চোর। চৌকিদার দুজনকেই ধরবে।

মোনাদির ভয়ে এতটুকু হইয়া গেল, তার চোখে প্রায় পানি আসিয়া পড়িয়াছে।

চারিদিকে মাঠের প্রসারণ নীল-সবুজ রঙের মোহনা রচনা করিয়া চলিয়াছে। অবেলার মেঘে বর্ণ-কেলির সমারোহ নূতনতর মনে হয়।

কোটাল চারিদিকে চাহিয়া একবার হাই তুলিল।

চৌকিদার আসছে না, তাহলে আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। দুই চোর। চলো আমার সঙ্গে

আমজাদ থ বনিয়া গেল। তার পা আর নড়ে না।

আমি নাছোড়বান্দা। গোঁফে তা দিতে লাগিল কোটাল।

তোমরা পায়ে হেঁটে যাবে না। ও, বুঝেছি। তারপর চন্দ্র উবু হইয়া বসিয়া পড়িল ও বলিল : আচ্ছা, দুই চোর আমার কাঁধে ওঠো।

মোনাদির অগত্যা কী বা করিতে পারে। সুশীল-সুবোধ ছেলের মত দুইজনে চন্দ্র কোটালের কাঁধে চড়িল। ভয় হয় তাহাদের, পাছে পড়িয়া যায়। দুইজনে কোটালের বাবরি চুল কষিয়া ধরিল।

ওরে বাবা, সব পাঠানের বাচ্চা, একদম ঘোড়া-চড়া করেছে–বলিয়া চন্দ্র হাঁটিতে লাগিল। আরোহীদের ভয়ের অন্ত নাই। আমজাদের চোখে পানি গড়াইতেছে। মোনাদির চুপচাপ।

কোটালের বপুর দোলনে আরোহীরা আনন্দ পায় না।

হঠাৎ হি হি শব্দে হাসিয়া উঠিল চন্দ্র কোটাল।

–এই চোর চাচারা, চল্ সব চাচীর থানায়। এলোকেশী ঘরে আছে নাকি কে জানে?

মোনাদির ও আমজাদ মাথার উপর চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুইজনের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিতে লাগিল।

চন্দ্র কোটাল গান ধরিল, দুজনের ঠোঁটে হাসি আর ধরে না।

প্রাণ যদি দিলে তুমি
প্রাণ-চোর শেষে।
কোকিল কেন রেখে গেলে
এমন পোড়া দেশে।

মেঠো বাউলের সুরে প্রান্তরের বুক ভরিয়া উঠিতে থাকে। আমজাদ ও মোনাদির দূরে দূরে দৃষ্টি ছড়াইয়া অবেলা উপভোগ করিতে লাগিল।

মোনাদির বলিল : চন্দ্র চাচা, আমাদের নামিয়ে দাও।

না, সেটি হবে না। তোমার চাচির থানায় চলো, লাল আলু আছে, সারারাত আলু খাওয়াবে।

আমজাদ সব চিনিতে পারে। খালের সেঁতো পার হইয়া তালগাছের সারি, শেষে চন্দ্র চাচার ঢিবি। সেইদিকেই কোটাল অগ্রসর হইতেছে। ধীর-সমীরে খড়ি বনে শ্যুশন শব্দ উত্থিত হয়। কোটালের কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। বিরহিণী কোকিলের ডাকে জর্জরিত হৃদয়, তারই বিলাপোক্তি কণ্ঠে বাজিতে থাকে শুধু।

ঢিবির উপর এলোকেশী চন্দ্রমণির উকুন বাছিতেছিল। উঠানে খেলাব্যস্ত যোগীন ও গোপাল। তারা এই দৃশ্য দেখিয়া হাসিয়া খুন।

চন্দ্রমণি ডাকিল : ও দাদা, পায়ে পড়ি, নামিয়ে দাও। পরের ছেলে পড়ে গেলে জোরে হাঁকিল চন্দ্র, পড়ে গেলে পণ্ডিত হয়ে যাবে।

মোনাদির এইবার খিল খিল করিয়া কাঁধের উপর হাসিতে লাগিল।

ও বাবা–থানার কাছে এসে চোরেদের আবার হাসি দ্যাখো, চলো, চাচির থানায়, খাওয়াবে লাল আলু।

আমজাদও হাসিতে থাকে।

চন্দ্রমণি বলিল, দাদা, ভিটের উপর কাঁধে নিয়ে চড়ো না, তোমার ঘাড়টা ভাঙবে

খামাখা ভাঙবে। অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া দুই-তিন লাফে চন্দ্র একদম ঢিবির শীর্ষে পৌঁছিল।

কোটালের কাঁধ হইতে নামিয়া মোনাদির বড় লজ্জিত হয়। এই মাঠে সে আর কোনোদিন আসে নাই। অপরিচিত জায়গা বলিয়া সে বিব্রত, নচেৎ অন্য কোনো খটকা। তার মনে নাই।

চোখ নামাইয়া গান করিতে লাগিল কোটাল। এলোকেশী চন্দ্রমণির উপর কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করিয়া বলিল : ঠাকুরঝি, তোমার মাথায় রাজ্যের উকুন।

দাদার মগজে আর বোনের মাথায়।

গান থামাইল চন্দ্র।

আমার মগজে? কই, বেছে দাও না।

তখন এলোকেশীর হাসি থামে না।

মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মগজ দেখা যাবে কেন?

একটি মুগুর পড়িয়াছিল উঠানে। সেটি নির্দেশ করিয়া চন্দ্র কপট-কোপন জবাব দিল।

ঐটা দিয়ে দাও এক ঘা। মগজ বেরিয়ে যাক।

চন্দ্রমণি ভারি রাগিয়া যায়।

দাদা, তোমার মুখে যা আসে তাই বলো, ভারি অনাছিষ্টি।

নে, আবার নাকিকান্না। লাল আলু থাকে তো ছেলেগুলিকে খাওয়া।

আমজাদ যোগীন-গোপালকে চেনে, সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করিয়া দিল বাস্তুর উপর।

হুঁকা-কল্কের সদ্ব্যবহার করিতে লাগিল চন্দ্র।

লাল আলু আনিয়াছিল কোটাল গঞ্জ হইতে। এলোকেশী বাঁশের ডোলে মুড়ি ও সেদ্ধ আলু মোনাদির-আমজাদকে খাইতে অনুরোধ করিল।

বড় লাজুক মোনাদির এইসব ব্যাপারে। তবু ধীরে ধীরে ঠোঁট সঞ্চালন বন্ধ থাকে না।

কোটালের চোখের তারা বারবার নাচে।

মিষ্টি আলু খাও যত পারো, আর গাছের কাছে যেও না। এবার ঠিক খোঁয়াড়ে দিয়ে আসব।

গোপাল মামার কথার প্রতিবাদ করিল, লোককে আবার খোঁয়াড়ে দেয়, মামা!

দেয় বাবা, দেয়। আমজাদের দিকে ফিরিয়া কোটাল বলিল, তোমার বাবাকে খোঁয়াড়ে রেখে আসব। ভারি ঘর ছেড়ে পালায়।

ধেৎ।

আমজাদ মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে ঠোঁট বাঁকাইল। মোনাদির মুচকি হাসিল শুধু। বেলা-শেষ ধরিত্রীর বুকে সন্ধ্যার পূর্বরাগ শব্দে-বর্ণে-কুহর-কূজনে। ভিটার উপর হইতে দূরান্তের আবছা গ্রামগুলি এমন দেখা যায়, মোনাদির কোনোদিন কল্পনা করে নাই। লাল আলু মুখে দিতে দিতে সে আনুমনা হইয়া যায়। তার সুন্দর ডাগর চোখের চাহনি নিকটস্থ কোনো বস্তুর উপর ক্ষণেকের জন্য আলোকতরঙ্গ ছড়ায় না। ছবির মতো স্তব্ধ তালগাছের সারি, নিচে শাদা গেঁয়ো পথ, হয়তো দুএকটি পথিক, পথশ্রান্ত শাদা বাছুর, মেঘ আর পাখির ঝাঁক, তার বালকমনের পর্দায় বিচিত্রার ইশারা রাখিয়া যায়।

চন্দ্র সকলের সঙ্গে তুড়ি দিয়া জমাইতেছিল। আনমনা কেবল মোনাদির।

মুনিভাই, সাঁঝ হয়ে এল, চলো বাড়ি যাই। আমজাদ তার চমক ভাঙাইল।

আর একটু বস্ না। চাঁদনী রাত আছে, না-হলে চন্দর চাচা পৌঁছে দিয়ে আসবে।

অসম্মতি জানাইল চন্দ্র। না চাচা, আমার অনেক কাজ। গরু-বাছুর, তোলা হয়নি। এই শীতে মুগরী-পাংগুলো রাখতে হবে। জোয়ার আসতে বেশি দেরী নেই।

আমজাদ কহিল, মরা গাঙে মাছ পড়ে?

চন্দ্র : না চাচা, রান্নাটা চলে যায়।

মোনাদিরের গায়ে শার্ট ছিল। বাতাসে শীতের আমেজ তাকে তেমন কাবু করে না।

আমজাদের জন্যই অগত্যা উঠিতে হইল। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে দূর গ্রাম-সীমানা। গৃহবাসীর স্নেহের প্রতীক্ষায় গোঠে বাঁধা গাই হাম্বা-স্বরে আবেদন জানাইতেছিল।

দুই কিশোর হৃষ্টমনে গাঁয়ের পথ ধরিল। মোনাদির যেন বোবা হইয়া গিয়াছে। মাঠের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তো সে কোনোদিন আসে নাই।

হঠাৎ সে মুখ খুলল : চন্দর চাচা একটা পাগল।

আব্বাও ওই কথা বলে।

কিশোর-মনের সিদ্ধান্ত এত সুনিশ্চিত যে, প্রৌঢ়জনও হার স্বীকার করিবে–এই সাফল্যের গৌরবে যেন দুই ভাই খিলখিল শব্দে হাসিতে লাগিল।

আমজাদ বলিল : মুনিভাই, তুমি গান জানো না?

গান আমি গাইতে পারি, লজ্জা করে।

একটা গান গাও, মুনিভাই।

মোনাদির চাচার আশ্রয়েও কারো তোয়াক্কা রাখিত না। রাত্রে সকলে ঘুমাইয়া গেলে, সে গঞ্জের যাত্রাশালে সারারাত্রি কাটাইয়া দিত। তবি চলিত পরদিন।

মোনাদির রামপ্রসাদী বাউল ঢঙের গান আরম্ভ করিয়াছিল। তার অর্থ সে আদৌ বোঝে না। কণ্ঠের মিষ্টতায় কেবল মূৰ্ছনা অপূর্ব পুলকাবেশ সৃষ্টি করে কিষাণ-পল্লীর প্রেয়সীদের বুকে। আমজাদ জানিত না মোনাদিরের কণ্ঠ এত মিষ্টি।

মুনিভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা আরো বাড়িয়া যায়।

গান শেষ হইলে সে বলিল : মুনিভাই, তুমি চন্দ্র চাচার কাছে গান শেখো না কেন?

গান জানে চন্দ্র চাচা?

ভাঁড়-নাচের দল ছিল, আর গান জানে না? শুনলে না, কেমন গায়?

বেশ, ভালো লাগে। আমি বলব আর একদিন।

আব্বা কিন্তু গান পছন্দ করে না। বলে, ওসব শিখলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়।

দূর-র-র! আমি কিন্তু গান শিখব।

আমজাদ মাথা দোলাইয়া অন্ধকারে সায় দিল।

.

পরদিন পড়ন্ত দুপুরে হাসুবৌর ঘরে আড্ডা জমিয়াছিল।

মোনাদিরের মতে, চন্দ্র কোটাল নামে এই গ্রামে একটি পাগল আছে। তার কাহিনী ফলাও করিয়া সে বর্ণনা করিতেছিল। আমজাদও এই বিষয়ে একমত। হাসুবৌ তো অন্য কোনো মতই দিতে পারে না।

সাকেরের মা ঘরে ঢুকিতে গল্পস্রোত মন্দীভূত হইয়া গেল।

মোনাদিরকে লক্ষ্য করিয়া সে বলিল, বেশ ছেলে বৌমা। থাকো ভাই-মার কাছে। পর কী কখন আপন হয়?

মোনাদির এই কাহিনী শুনিতে প্রস্তুত ছিল না।

সাকেরের মা বকিয়া যায় : জানো বৌমা, একেই বলে খুনের টান। চাচা সোনাদানা দিয়ে মানুষ করত, শেষে একটা শ্লেট ভেঙে ফেলেছিল তা সইল না। তোমার চাচা কী করে, ভাই?

মোনাদির স্তব্ধ হইয়া যায়।

থাকো, মায়ের কাছে থাকো। পাঁচ-সাত বছর মায়ের কাছ-ছাড়া বলে কি আর মা পর হয়ে যায়?

ভয়ানক বিরক্ত হয় মোনাদির মনে মনে। হাসুবৌ শাশুড়িকে দজ্জাল আখ্যা মনে মনেই দিতে থাকে। কাঠকুড়োনী বুড়ি বলিলে তবে আমজাদের গায়ের রাগ যায়।

সাকেরের মা কোন সাড়া না পাইয়া বকর বকর করিতে করিতে চলিয়া গেল। আবার ভাঙা আসর নূতন করিয়া জমিয়া উঠিল।

সাকেরের ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নাই। তৈজসপত্রই বেশি। এককোণে একটা বড় তক্তপোশ পাতা। তারই উপর একদিকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে হাসুবৌ উপবিষ্ট। বই হাতে মোনাদির। বালিশের আড় হইয়া শ্রোতারূপে আমজাদ।

আলীবাবা ও চল্লিশ দস্যুর কাহিনী পাঠ করিতেছিল মোনাদির। কাসেম রত্নগুহার মধ্যে আবদ্ধ। বাহিরে আসিবার মন্ত্র সে ভুলিয়া গিয়াছে। সিসেম খো এইটুকু শব্দ মোনাদিরের মুখে–আবার তাকে পাঠ থামাইতে হইল। সাকের চাচা ঘরে ঢুকিয়াছে।

কিগো চাচারা, গল্প পড়া হচ্ছে?

জি।

হাসুবৌ মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল। গৃহে প্রবেশকতার দিকে তার চোখ সজাগ।

মোনাদির জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাবে চাচা?

দাঙ্গার খবর আছে, লাঠি নিতে এসেছি। কোণে তার তৈল-চিক্কণ লাঠির উপর সকলের নজর গেল।

হাসুবৌ মেঝের উপর দাঁড়াইয়া অনুরোধ করিল : না, কোথাও যেতে হবে না।

না, আগাম টাকা নিয়েছি। গম্ভীর কণ্ঠ সাকেরের।

মোনাদিরও চাচির পক্ষ গ্রহণ করিল।

না চাচা, সন্ধ্যায় আমাদের খেলা শেখাবে। আজ কোথাও যেও না।

আমজাদ ওকালতির প্রথম দীক্ষা গ্রহণ করিল। লাঠি-হাতে সাকের কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। হাসুবৌর শান্ত-গম্ভীর মুখ তার চোখে পড়িয়াছিল বৈকি। কিশোর বালকগুলির জিদ বোধহয় জীবনে তাকে প্রথম জিদ-ছাড়া করিল।

বেশ, তোমরা গল্প করো। বলিয়া সাকের চলিয়া গেল।

গল্প আর পড়া হইল না। হাসুবৌ নিজেই গল্প করিতে লাগিল। মোনাদিরকে কত স্নেহ-মমতায় ডুবাইয়া রাখিতে চায় সে।

বেশ খোকা, বলিয়া হঠাৎ বিছানার উপর শায়িত মোনাদিরকে বুকে জড়াইয়া বারবার চুম্বন করিতে লাগিল। মাতৃস্নেহ যেন নূতন আধার পাইয়াছে।

মোনাদির নিশ্বাস ফেলিতে পারে না। তার ডাগর চোখ, সুন্দর গৌর কচি-ঠোঁটে যুবতীর ওষ্ঠ বিস্বাদ আনে একরকমের।

বাড়ি ফিরিবার পথে মোনাদির আমজাদকে জিজ্ঞাসা করিল : এই, হাসুবৌ চুমু খায়, না কামড়ায় রে?

কেন? অবোধ বালকের মতোই প্রশ্ন করিল আমজাদ।

এই দ্যাখ না, আমার গালে কত দাঁতের দাগ।

.

১৪.

এই গ্রাম মোনাদিরের খুব ভালো লাগে। শূন্য ভিটা, ছোটখাটো তরুলতার জঙ্গল, বনানীর নিচে কোথাও কোথাও সরু পথ–তার মন আকর্ষণ করে। লুকোচুরি খেলার এমন জায়গা তাদের গ্রামে ছিল না। এই পার্থক্যটুকু তার মনোহরণ করে।

আমজাদও আজকাল ঘর-পলাতক। দুইজনে বাউণ্ডেলের মতো গ্রাম তন্নতন্ন করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আমজাদও ধীরে ধীরে দুঃসাহসী হইয়া উঠিয়াছে। বাড়ির ফাঁই ফরমাশ পূর্বের মতো সম্পন্ন হয় না। দরিয়াবিবি মাঝে মাঝে খুব চটিয়া যায়। কিন্তু মোনাদির সম্বন্ধে সে খুব সচেতন। পাছে এতটুকু অনাদর-অবহেলার জন্য তাকে হারাইতে হয়। মোনাদিরের স্বভাব এমনিই বেপরোয়া, মাথার উপর তন্বি করিবার লোক নাই, এই সুযোগে সে আরো বেপরোয়া হইয়া উঠিল।

গোরস্থানের জঙ্গলের পশ্চিমদিকে খেজুরগাছের সংখ্যা অনেক। নীল থোকা-থোকা কাঁচা খেজুর পাক ধরিতে এখনও দুইমাস। অত ধৈর্য বালকদের নাই। আমজাদের সহিত যুক্তি করিয়া মোনাদির একদিন এক কাঁদি কাঁচা খেজুর কাটিয়া আনিল। তার জন্য অসীম দুঃসাহসের দরকার। বেতবনের ঘন ঝোপে বিষাক্ত সাপ থাকা বিচিত্র নয়। তা ছাড়া বুনোলতায় গা-হাত এমন কুটোয় যে অনেকেই খেজুর পাকিলেও এদিকে পা বাড়াইতে সাহস করে না।

মোনাদির পথপ্রদর্শক। লতাগুল্ম ফাঁক করিয়া সে অগ্রসর হইয়াছিল। বুনোলতার স্পর্শ সে প্রথমে সহ্য করিয়াছে। কিন্তু আমজাদের গা কুটাইতেছিল ভয়ানক। জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। মোনাদির অগ্রজের মতোই তাকে শান্ত করিল। কিন্তু ঘরে দরিয়াবিবি ক্ষোভে আশঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া গেল।

দুজনে আমার মাথা খেয়ে ছাড়বি কোনোদিন। পয়পয় করে মানা করেছি, কবরস্থানের দিকে যাসনে বাবা–বাবারা কান কুলো করে বসে থাকবে।

দুই ভাই কোনো জবাব দিল না। দরিয়াবিবি গরম পানিতে গামছা ভিজাইয়া পুত্রদের গা মুছাইয়া দিল।

মুনিভাই বললে, কাঁচা খেজুর খেতে খুব মজা।

আমজাদ মাকে বলিতেছিল।

মোনাদির প্রতিবাদ করিল : আমি বুঝি বলেছি মজা। খুব কষা।

আড়চোখে মোনাদিরের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিপাত করিয়া আমজাদের গা মুছাইতে লাগিল পুনরায় দরিয়াবিবি। মোনাদির তখন মৌন। দরিয়াবিবি ইহা লক্ষ্য করিয়া আবার মোনাদিরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল।

আয় মুনি, তোর গা-টা আবার মুছে দিই।

অভিমান-ক্ষুদ্ব কণ্ঠ মোনাদিরের : না থাক, আমার গা আর কুটোয় না।

দরিয়াবিবি কোনো প্রতিবাদ কানে তুলল না।

দ্যাখ দিকি বাবা, গায়ে কালো কালো দাগ পড়ে গেছে। অত ঘন জঙ্গলে আর যেয়ো না। বড় বড় সাপ আছে।

কী সাপ আছে, মা? আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল।

খুব বিষ সাপের, জাতসাপ আছে।

মোনাদির হাসিয়া উঠিল–হ্যাঁ, সাপ আছে হাতি। কই, আমরা একটা সাপের লেজও দেখিনি।

আমজাদ হাসিতে যোগ দিল।–মা, বড়ভাই সাপের লেজ দেখেনি। সাপ কাটলে লেজ খসে যায়। না,মা?

হ্যাঁ।

মোনাদির বিশ্বাস করে না এই প্রসঙ্গ।

হ্যাঁ, কাটলে লেজ খসে না ঘোড়ার ডিম। আমার চাচার একটা বেড়ে কুকুর ছিল, সে এত লোককে কেটেছে, তার লেজ একদম থাকত না তা হলে।

দরিয়াবিবি এতক্ষণ গম্ভীর হইয়াছিল, সেও উচ্চহাস্যে পুত্রদের আসরে যোগদান করিল।

আরে আমার বোবা ময়না, কুকুরের আবার লেজ খসে!

মোনাদির গা চুলকাইতে চুকাইতে বলিল, তবে যে আমু বলে।

তোর গা কুটোচ্ছে? জিজ্ঞাসা করিল দরিয়াবিবি।

না, মা।

তবু আমার কাছে লুকোবে?

মোনাদির সস্নেহে হঠাৎ মার কোমর জড়াইয়া আমজাদের দিকে আঙুল বাড়াইল।

ঐ তো আমাকে নিয়ে গেল।

কৃত্রিম কোপনদৃষ্টি প্রতিভাত হয় দরিয়াবিবির।

আমজাদ অভিমান করিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে আর যদি কোথাও যাই, মুনিভাই–

পরদিন আমজাদ তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিল। স্কুলের ছুটির পর দুইজনেই গ্রামপথে ঘুরিয়া বেড়াইল। অন্যান্য ছেলেরা স্কুলের গ্রাউন্ডে ফুটবল খেলে, মোনাদির সেখানে থাকতে চায় না। ভয়ানক ছোট হইয়া যায় সে অন্যান্য পড়য়াদের নিকট। তাহাদের বেশভূষা স্বতন্ত্র, পরিচ্ছেদে চিক্যতা থাকে। মোনাদির আমজাদের সঙ্গ-মাধুর্যে তাই পরিতৃপ্তির আস্বাদ পাইয়াছিল।

আজও স্কুলের ছুটির পর দুইজনে মাঠের দিকে চলিয়া গেল। চন্দ্র কোটাল বাড়ি নাই, ফসল লইয়া গঞ্জে গিয়াছে– সেখানে ভালো জমিল না। আমজাদ মজা খালের একটি ধারে কতকগুলি চিলের পালক কুড়াইয়া মোনাদিরকে উপহার দিল। ভালো কলমের কাজ চলিবে।

সন্ধ্যার পূর্বে লুকোচুরি খেলার সময় মোনাদির আমজাদের সঙ্গচ্যুত হইল। দুইজনে খেলার মাতামাতিতে পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিল। আমজাদের সঙ্গে দেখা না হইলেও মোনাদির বেশি বেগ পায় নাই। একটি বাঁক ফিরিতেই পরিচিত পথ দেখিয়া সে পুলকিত হইয়া উঠিল। ওই শীর্ণ রাস্তাটি শাদা ফিতের দাগৈর মতো আঁকাক সমন্বয়ে পাড়ার ওদিকে মিশিয়া গিয়াছে। দুইপাশে শুধু নানা রকমের গাছ। সন্ধ্যা আসন্ন। ভয়াতুর মসৃণ অন্ধকার জমিয়া। উঠিতেছে খানাখোন্দলে, পত্রপুঞ্জের অনাবৃত বুকে। শাদা ঘাস ধূসরিমায় শিহরিয়া উঠিতেছে। পথের কিনারায় কেঁচো-মাটির দাগ, পায়ের আঙুলে অস্তিত্বের প্রমাণ জানায়! কত ক্ষুদ্র টিলা! মোনাদিরের দৃষ্টি মিশিয়া যায় চারিদিকে। বোবার মতো বিস্ময়ে সে চাহিয়া থাকে।

একটু আগাইতেই পাতে মাদারের ঘন বেড়া চোখে পড়িল। নিচে কেবল লতার উলঙ্গ মূল, উপরে পাতার নীল আভরণ। পাশে একটি পানাছাওয়া ডোবা, জলের আলোড়ন-ধ্বনি শোনা গেল। কৌতূহলে মোনাদির উবু হইয়া দেখিতে লাগিল সূর্যের লালিমা ডোবার উপর। রঙিন ঘাটের পৈঠায় একটি পিতলের কলস, গ্রাম্য কোনো বধূ স্নান করিতেছে। তার গৌর মুখ দেখা যায়।

অন্ধকার হইয়া আসিতেছে, এই ভয়ে মোনাদির পদক্ষেপ দ্রুত করিল। পুরাতন বড় আমের গাছ পড়িয়াছিল, গুঁড়িসহ একটি মোটা ডাল পথের সহিত মিশিয়া রহিয়াছে। মালিকেরা সামান্য ডালপালা কাটিয়া লইয়া গিয়াছে, ধড়টি এখনও বর্তমান। ফাঁকড়া ডালের উপর বসিয়া মোনাদিরের দুলিতে ইচ্ছা করে। সময় নাই। আরো অন্ধকার হইয়া গেলে ঘরে ফেরা দায় হইবে। কয়েক পা আগে একটি শূন্য ভিটে, পথ এখানে সামান্য উত্রায়ের রূপ গ্রহণ করিয়াছে। ভিটার তিনদিকে আমগাছের পাহারা; ফাঁক দিয়া দূরে সন্ধ্যাকাশের স্নান অঙ্গনে হলুদ রঙের মতো মেঘ! মোনাদির দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। তার চোখে শূন্যতার এই আকার জ্ঞানরাজ্যের কোনো বাতা বহিয়া আনে না; তবু অসোয়াস্তি অনুভব করে সে। আবার ঢালু-পথ সমান্তরাল কয়েক বিঘা মাত্র। এইটুকু শেষ হইয়া গেলে সে পাড়ার অন্দরে ঢুকিয়া পড়িবে। এইখানে সে হাঁটিয়াছে আরো কয়েক দিন, কৌতূহলের নেশা আর এমন কোনদিন চাপিয়া বসে নাই। অন্ধকার প্রলেপ টানিতেছে ধরিত্রীর উপর মেঘের আলোয় সাদা পথের রেখা মুছিয়া যায় না। পানা-ভরা একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণীর পাড়ে বাঁশবনে নীড়-প্রত্যাগত বকের দল গুলতান করিতেছে। শাবকগুলির কক কক শব্দে উত্যু হয় মোনাদির। পুকুরের পাড়ের কোণে জীর্ণ কয়েকটি সুপারি গাছ, পাশে গোয়ালঘর। একটি বাছুর হাম্বার ছাড়িতেছে। সড়কের পাশে, ইহার পর তালপাতার বেড়ার রেখা। ওদিকে গেরস্থদের সায়ং-জীবন শুরু হইয়াছে। জমাট ধোঁয়া উঠিতেছে গাছপালার ভিতর দিয়া।

দ্রুত হাঁটিতেছিল মোনাদির। বেড়ার উপর শুষ্ক কলাপাতার দোদুল রেখামূর্তি, বাতাসে দুলিতেছে। হঠাৎ পথের পাশে খরখর শব্দ হইল। ভয় পাইয়াছিল প্রথমে,পরে সে কৌতূহলবশত থমকিয়া দাঁড়াইল। সাপ-খোপ নয় তো! এইখানে একটি শুষ্ক কাঁঠালগাছ বেড়ার খুঁটিরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। আবার শব্দ হইল। মোনাদির দৌড় মারিবার জন্য পা তুলিয়াছে!

এমন সময় বালিকার কণ্ঠের সাবধানবাণী শোনা গেল : এই খোকা–

মোনাদির ভাবিল কোনো বর্ষীয়সী বোধহয় তার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে। দৌড় বন্ধ করিয়া সে বেড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিল।

এই খোকা

কোনো না বর্ষিয়সী নয়, একটি কচিমুখ কলাপাতার আড়াল ফাঁক করিয়া মৃদু ঠোঁট সঞ্চালন করিতেছে।

বালিকার মুখের একাংশ মাত্র দেখা যায়। মরা কাঁঠালগাছের গুঁড়ির উপর বসিয়া সে আড়াল হইতে কেবল মুখটি বাহির করিয়া দিয়াছিল। আকাশের আলোয় মুখাবয়বের ডান দিক শুধু আলোকিত।

কোনো জবাব যোগাইতেছিল না মোনাদিরের মুখে। এমন অবস্থায় বালিকা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করিল।

কোন্ পাড়ার ছেলে?

আমতা আমতা করিয়া জবাব দিল মোনাদির : ঐ পাড়ার। অঙ্গুলি নির্দেশ করিতে সে বিস্মৃতি হইল না।

ঐ পাড়ার।

ফিকফিক করিয়া মেয়েটি হাসিয়া উঠিল। –ঐ পাড়ার নাম নেই?

তোমার নাম আছে?

বড় মুখরা তো মেয়েটা। মোনাদির রাগিয়া উঠিয়াছিল মনে মনে।

আমার নাম নেই, তোর নাম আছে? তোর শব্দটাতে বেশ জোর দিয়াছিল সে।

আমার নাম আছে, তোমার নামও আছে।

মোনাদির জিভ ভাসাইয়া শব্দ করিল : আমার ..না..ম আছেই– তারপর জিভ যদূর সম্ভব বাহিরে প্রসারিত করিয়া বলিল : তোর নাম আছে?

ভারি বজ্জাত ছেলে তো। কাদের ছেলে রে?

মোনাদির আবার ব্যঙ্গ করিল। বেড়ায় আড়াল ফাঁক করিয়া গুঁড়ির উপর সে সশরীরে বাহিরে আসিল। মোনাদির দেখিল ফালি পরা একটি সুডোল তনু, বছর নয় কী দশের বালিকা। চুলগুলি এলোমেলো পিঠের উপর দোল খাইতেছে। মুখটি গোলাকার, গৌর রঙের উজ্জ্বলতা-উচ্ছল। টানা চক্ষুতারকা চড়ুই পাখির মতো জ্বর নিচে চঞ্চলতায় অস্থির।

কাদের ছেলে রে? মেয়েটি ভেংচি দিতে বিলম্ব করিল না। মোনাদির এবার রীতিমতো রাগিয়াছিল। পথের উপর ঢেলা ইত্যাদি কিছু না পাইয়া আক্রোশে সে ফুলিতেছিল।

দেবো পা ধরে নিচে ফেলে চিৎপটাং।

মেয়েটি তাড়াতাড়ি পা গুটাইয়া ভেংচি কাটিয়া বলিল, আমার পায়ে সালাম করবি নাকি?

মোনাদির হাতের তালুর ভিতর অন্য হাতের মুঠি কচলাইতে লাগিল।

দেবো পা ধরে ফেলে।

দাঁড়া তো রে বজ্জাত, বলিয়া মেয়েটি গাছের গুঁড়ি হইতে বেড়ার আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। তার পদধ্বনি শোনা যায়। ভয় পাইল মোনাদির। সে ছুট দিল এইবার সড়কের সোজাসুজি।

পশ্চাতে বালিকাকণ্ঠের ডাক শ্রুত হয় : এই খোকা, শুনে যাও কিছু বলব না তোমাকে

মোনাদির আবেদনে কোনো সাড়া দিল না। ভীত-ত্রস্ত সে। কিছুদূর গিয়া গাছের কোলজোড়া অন্ধকারে থামিয়া একবার পশ্চাতে চাহিল। অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি আলুলায়িত কুন্তলা চকিত-দেখা কিশোরী দাঁড়াইয়া রহিল। হ্যাঁ, সে-ই তো। ভুল হয়নি কিছু।

কেমন যেন মনমরা হইয়া বাড়ি ফিরিল মোনাদির।

.

১৫.

পরদিন দুপুরে আহার সমাপ্তির পর মোনাদির কৌতূহলবশত পাড়ার পথে বাহির হইল। গত সন্ধ্যায় আবছা-দেখা সড়কের জগৎ। আজ দুপুরে চারিদিকে আমনা দৃষ্টি ছড়াইতে তার কাছে নূতন ঠেকিল সবকিছু। হারানো পথরেখা নূতন করিয়া সন্ধান করিতে লাগিল সে।

দুপাশে তালপাতার বেড়া। মাঝখানে শুষ্ক কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি। জায়গাটা চিনিতে বেশি বিলম্ব হইল না। অবাক হইয়া মোনাদির অবলোকন করিতে লাগিল চারিদিক। কীট পতঙ্গের ক্ষুদ্র জীবনলীলা। শুষ্ক কাঠের সেতু বাহিয়া একদল পিপীলিকা আহার মুখে অগ্রসর হইতেছে। ক্ষুদে লাল পিঁপড়ের সারি ছোঁড়া ঘুড়ির সূতার মতো যেন বাতাসে কাঁপিতেছে। আঁকাবাঁকা গতি একটি তালপাতার আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে।

মোনাদির একবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইল। জোড়া সুপারিগাছের ওধারে গেরস্থ বাড়ি। ডিডিগ শব্দে একটি খুদে পাখি তেঁতুলবনে পতঙ্গ সন্ধান করিতেছিল।

এই, কাদের বোকা ছেলে রে। বালিকা কণ্ঠের ডাক। হঠাৎ ভয় পাইয়া মোনাদির পেছনে ফিরিবে কী, আর একটি কোমল হস্তে সে বন্দী। গত সন্ধ্যায় দেখা সেই বালিকাই। তার হাত চাপিয়া ধরিয়াছে। মোনাদির প্রস্তুত ছিল না। মেয়েটি হাত ধরিয়া তাকে টানিতে টানিতে গেরস্থবাড়ির দিকে অগ্রসর হইতেছিল। মাকড়শার জালে যেন প্রতিবাদ করিবার অবসর নাই, দুমিনিটের ভিতর ভোজভাজির মতো কী যেন ঘটিয়া গেল। আর একটি গেরস্থর আঙিনায় সে এতক্ষণে অপরাধীর মতো দাঁড়াইয়া আছে।

ও মা, শিগ্‌গির বেরোও, দেখো কাদের ছেলে।

খিলখিল শব্দে হাসিতেছিল মেয়েটি।

কিরে আম্বিয়া।

আঙিনার সম্মুখে একটা খোড়ো চালের ঘর, তার দাওয়া হইতে একজন মেয়ে জবাব দিল। সে ঘরের দেওয়ালের মাটির ছোপ দিতেছিল।

আম্বিয়া আর একবার সমস্ত হাসি নিঃশেষ করিয়া দিল।

কী চুরি করবে বলে আজ বেলাবেলি বেরিয়েছে, মা।

মেয়েটি কর্মব্যস্ত। সে একবার এইদিকে চাহিয়া কাজ বন্ধ করিল।

আম্বিয়া, কাদের এমন সুন্দর ছেলে?

হাসির স্রোতে ভাটা নাই।

সুপুরিগাছের কাছে দাঁড়িয়েছিল, ধরে এনেছি।

লালমাটি মাখা ন্যাকড়া হাতে মেয়েটি দাওয়া হইতে নামিয়া আসিল। আম্বিয়ার মার নাম আমিরন।

খোকা, কোথায় থাকো?

এমন ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া যাইবে মোনাদিরের মতো চটপটে ছেলে, বিশ্বাস করা যায় না। আজ তার কণ্ঠে বাক্য হোঁচট খাইতেছিল।

আ-মি- খাঁ-পাড়ায় থাকি।

আমিরন বদনার পানি লইয়া হাত ধুইয়া ফেলিল। খা-পাড়ার কার ছেলে?

মোনাদির সঙ্কোচে মিশিয়া যাইতেছিল মাটির সঙ্গে। আর যা-ই হোক, আজহার খাঁ তার পিতা নয়।

আমার মা দরিয়াবিবি।

আমিরন দরিয়াবিবির চেয়ে বয়সে বড়। প্রৌঢ়ত্বের ছাপ মুখাবয়বে স্পষ্ট। রোগা শরীর। গাল দুটি সুষমায় উজ্জ্বল হইলেও, বয়সের দাগ পড়িয়াছে। একরকমের কৃত্রিম গাম্ভীর্যে তার মুখোনি ছাওয়া।

অভ্যর্থনার হাসি উচ্ছলিত হইয়া পড়ে।

দরিয়াবুবুর ছেলে, দরিয়াবুবুর ছেলে, বলিতে বলিতে আমিরন আগাইয়া আসিল।

আম্বিয়া তখনও হাসিতেছিল।

কৃত্রিম ক্রোধে তার দিকে ফিরিয়া আমিরন বলিল : হতচ্ছাড়ি, হিড়হিড় করে কাকে ধরে আনলি। মাফ চা।

আত্মীয়তার যোগসূত্র আছে এই কিশোরের সঙ্গে, আম্বিয়া তা কল্পনা করে নাই।

তুমি এসেছ শুনেছি, বাবা। গরিব মানুষ, কাজকর্মে সারাদিন যায়। খেটে খেটে আর পারি না। আজ কদিন যে খাঁ-পাড়ার দিকে যাইনি।

আম্বিয়া কৌতূহল-দৃষ্টি দিয়া মা ও আগন্তুক কিশোরের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল। হঠাৎ নখে মাটি খুঁটিতে লাগিল সে।

আমিরন হাঁক দিল : এই হতচ্ছাড়ি– একদম ভিজে বেড়ালছানা বনে গেলি যে, দাওয়ায় একটা বসবার জ্যাগা দে। চলো, বাবা।

আম্বিয়া মার আদেশ নীরবে পালন করিল। মোড়ার উপর যন্ত্রচালিতের মতো বসিয়া পড়িল মোনাদির। তার পাশে বসিয়া আমিরন সংসারের কাহিনী-জাল বুনিতে থাকে।

মোনাদির এতক্ষণ মুখ খোলে নাই। আমিরন বিবি বলিল, বাবা, একদম বোবার ব্যাটা। কথা বলো। আজকে আসি, চাচি।

না, একটু বসো। কিছু খাও।

আমি ভাত খেয়ে এসেছি।

কোনো প্রতিবাদ শুনিল না আমিরন। ডোলে করিয়া সামান্য মুড়ি তাহার সম্মুখে পরিবেশন করিল।

গরিব চাচি। কিছু কি ঘরে আছে, চাঁদ। তোমার চাচা আজ দুবছর হল ইন্তেকাল করেছে। ঐ হতভাগীকে নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরছি। কথা শুনবে না, খালি গাছতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে।

জননী-কন্যার দৃষ্টি বিনিময় হইল। ভারি গম্ভীর হইয়া গিয়াছে আম্বিয়া।

তুমি কদ্দিন এসেছো?

অনেকদিন হোয়ে গেল। মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে জবাব দিল মোনাদির।

ফুরসৎ নেই, বাবা। সকাল থেকে কত কাজ, গাই-গরু আছে একটা। মুরগি-হাঁস, ছাগল-পাগল আর ঐ (আম্বিয়ার দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ) পাগলী আমার সংসারে একফোঁটা দম ফেলার উপায় নেই। খাঁ-পাড়ার মুখ দেখিনি কমাস।

মোনাদির অনুভব করিল, তার নূতন চাচি অনর্গল বকিতে অপটু নন। মাথা দোলাইয়া আমিরন নিজের কথায় সায় দেয় : বেশ সুন্দোর ছেলে। আমার দরিয়াবুবু কেমন? তার ছেলে রাজপুতুরের মতো দেখতে হবে না?

লজ্জায় রাঙা হইতে থাকে মোনাদিরের কিশোর দুই কপোল।

কোনো রকমে বেঁচে আছি, খোকা। কপালে মেহনত ছাড়া আর কিছু লেখন দিয়ে আসি নি। তোমার চাচা ভালো লোক ছিলেন। তোমার এই বাপের মতো দশ চড়ে মুখ খুলত না। তার ফল আজ ভোগ করছি। দু-তিন বিঘে জমি ছিল, সব পরের গবে।

তারপর ফিসফিস শব্দে কথা বলতে বলতে আঙুল বাড়াইয়া আমিরন আঙিনার ওপারে কয়েকটি খড়ো চাল দেখাইল।

ওই যে আম্বিয়ার মেজ চাচা। একদম খান্নাস। বেওয়া মানুষ, তার দু-বিঘা মেরে নিল। ফসল দিত না, শেষে লুকিয়ে রেজেস্টারি করে নিজের জমির সাথে ঢুকিয়ে দিলে। নিক হতভাগারা, আল্লা তার ইসাফ করবে। কত কত জিনিস আনে বাবা। এতিম মেয়েটার হাতে যদি একটু ছোঁয়ায়। স্বত্যে আছে কী?

মোনাদির ম্রিয়মাণ শিশুর মতোই কাহিনী কান পাতিয়া শুনিতেছিল। আম্বিয়াও তার মত এতিম। মনের কোণায় কোণায় মৃদু নিঃশ্বাস রুদ্ধ আবেগের ঝটিকা ফুকার রচনা করে। তবুও বিদায়ের জন্য উশখুশ করিতেছিল মোনাদির।

গেল বছর বর্ষায় ঘরে একমুঠো চাল নেই। ধার করতে গেলাম। এক কুনকে চাল দিল না বেটি। একদিন উপোস করে মরি। আমার জমি নিলে, আমার পেটে দানা নেই।

আমিরনের চোখের কোণায় পানি জমিয়া উঠিতেছিল, আঁচলের খুট দিয়া মুছিতে লাগিল।

মোনাদির আসি চাচি বলিয়া উঠিয়া পড়িল। আর কেউ তোক করুণ কাহিনীর শ্রোতা। কিছুই ভালো লাগে না তার।

আনমনা সড়কের সম্মুখে আসিয়া সে পিছনে তাকাইল একবার। কখন অজানিতে পিছু পিছু আসিয়াছিল আম্বিয়া, সে লক্ষ্য করে নাই। একবার উৎকর্ণ হইল মোনাদির। হ্যাঁ, কান্নারই আওয়াজ। আমিরন চাচি মৃত স্বামীর উদ্দেশে অশ্রু বিসর্জন দিতেছিল।

১৬-২০. আমজাদ একদিন খবর আনিল

আমজাদ একদিন খবর আনিল, শৈরমীর পুত্র মারা গিয়াছে। তার পঙ্গু জীবনের অবসানে জননী অন্তত সোয়াস্তি পাইবে। দরিয়াবিবি পুত্রের সঙ্গে সেইসূত্রে নিজেদের বহু কাহিনী টানিয়া আনিল। বেচারা শৈরমী।

দরিয়াবিবি বলিয়াছিল, শৈরমীকে একবার ডেকে আনবি। মোনাদির ও আমজাদ বাগ্‌দীপাড়া হইতে পরদিন ফিরিয়া আসিল। শৈরমীও শরমী ও শয্যাশায়ী। প্রতিবেশীরা এতদিনে তার প্রতি কৃপাপরবশ। শৈরমীর দূরাত্মীয়া এক বিধবা ননদ তার সেবা শুশ্রূষার ভার লইয়াছে।

আরো দুইদিন কাটিয়া গেল। আমজাদ রোজই তার খবর লইয়া আসে।

আজ অপরাহ্নে আসিয়া সে বলিল : মা, শৈরমী পিসি আর বাঁচবে না।

বাঁচবে না! দরিয়াবিবি ম্রিয়মাণ মুখে পুত্রের দিকে চাহিয়া রহিল।

না গো, মা। একে পাতলা চেহারা, রোগে-শোকে বুড়িকে চেনা যায় না।

দরিয়াবিবি এই বাগদী রমণীর সখিত্বের বহু স্মৃতি স্মরণপথে টানিয়া আনিল। বন্ধক ঘড়াটি আর ছাড়ানো হয় নাই। মাসে সংসারের খরচ বাড়িতেছে। আয়ের সংস্থান কোথায়? চন্দ্র কোটাল নূতন কোনো ব্যবসা দিবার আয়োজন করিতেছে। মূলধনহীন কোনো ব্যবসা আরম্ভ করা যায় কিনা। কয়েক মাসে শুধু যুক্তি-পরামর্শই সার হইয়াছে। দরিয়াবিবি ভাবিল, সন্ধ্যায় একবার দেখা যাক, ঘড়া ছাড়ানোর টাকাটা যদি কোথাও থেকে যোগাড় করে আনতে পারি। প্রাচীন সামগ্রী ঘরছাড়া হইবে। কিন্তু শৈরমী কার কাছে বন্ধক রাখিয়া আসিয়াছে, সে জানে না।

দরিয়াবিবি আবার জিজ্ঞাসা করিল, বাঁচবে না?

আমজাদ মাথা দোলাইল : না গো, মা।

মোনাদির তার সঙ্গে গিয়াছিল, সেও মন্তব্য সমর্থন করিল।

ঘড়া চুলোয় যাক, একবার শৈরমীর সঙ্গে কি দেখাও হইবে না! এই চিন্তা দরিয়াবিবিকে বেশি পীড়িত করিতেছিল। বাগ্‌দীপাড়া দূর নয়। পনেরো মিনিটের পথ। গা ঢাকা অন্ধকারে আব্রু ও পর্দা বাঁচাইয়া সে সহজেই শৈরমীকে দেখিয়া আসিতে পারে। কিন্তু আজহার রাজি হইবে কি? এই একটি বিষয়ে দরিয়াবিবি আজহারকে ভয় করে। চাষীবাসীর সংসারে পর্দার অত ঝামেলা নাই। পাড়াপড়শীদের সঙ্গে দরিয়াবিবি স্বচ্ছন্দে দেখা করিতে যায়। কিন্তু ভিন পাড়ার, বিশেষ করিয়া বাগ্‌দীপাড়ার ব্যাপারটা প্রকাশ হইয়া পড়িলে মুসলমান পাড়ায় আর তাদের কোনো ইজ্জত থাকিবে না।

হৃদয়ের ঐশ্বর্য জাতিধর্মের বালাই লুকাইয়া রাখে। শৈরমীর সরল প্রাণের পরিচয়পত্র যতই দরিয়াবিবির নিকট গাঁথা স্মৃতির সড়ক বাহিয়া উড়িয়া আসিতে লাগিল, সে ততই অস্থির হইয়া উঠিল। আমজাদের ছোটবেলায় একবার খুব ম্যালেরিয়া হয়। জীবনের কোনো আশা ছিল না। শৈরমী প্রতিদিন তাকে দেখিতে আসিত। একদিন সে কয়েকটি বাতাসা আনিয়া দরিয়াবিবির হাতে দিয়াছিল।

কী হবে, শরীদি?

খোকাকে খাইয়ে দাও একটা।

কিসের বাতাসা?

শৈরমী মিথ্যা কথা বলে নাই। গ্রামের বারোয়ারতিলায় শিবালয়ে সে হরির লুট দিয়া আসিয়াছে আমজাদের নামে। তারই বাতাসা। ধর্মে বাধেই তো। দরিয়াবিবির মনেও খটকা লাগিয়াছিল। মরণাপন্ন পুত্রের শিয়রে দরিয়াবিবি কারো প্রাণে আঘাত দিতে রাজি ছিল না। যদি বাছার গায়ে বদদোয়া লাগে। শৈরমীর সম্মুখেই সে আমজাদকে বাতাসা খাইতে দিয়াছিল। আল্লা কি মানুষের মন দেখেন না, যিনি সব দেখেন? অখ্যাত পল্লীর জননী-হৃদয়েও সেদিন এই প্রশ্নই বারবার জাগিয়াছিল।

প্রত্যহ শৈরমীর জীবনের বহু অধ্যায় কল্পনায় পাঠ করিতে লাগিল দরিয়াবিবি। দুঃখের দিনে প্রতিবেশীদের কাছে যে লজ্জা বিরাট দীনতার প্রকাশ, দোসর পাইলে তার চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। শৈরমীর মতো দোসর দরিয়াবিবির দৈনন্দিতায় আকস্মিক আসিয়া জুটিয়াছিল।

তোর পিসি কথা বলতে পারে, আমজাদ?

বড় ক্ষীণ গলার আওয়াজ।

একবার তাকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করে।

আমজাদও মুরুব্বি চালে বলিল, তুমি বাগ্‌দীপাড়া যাবে?

যেতে দোষ কী? তারা মানুষ নয়?

মোনাদির বলিল : মা, তুমি অতদূর যেতে পারবে না, তোমার এই শরীর?

দরিয়াবিবি নিজের শরীরের দিকে চাহিয়া লজ্জিত হইল। তার স্ফীত জঠর পুত্রের চোখেও ধরা পড়িয়াছে। আর এক সমস্যা। পূর্ণ গর্ভবতী একটি মেয়ে নিশাচর সাজিয়া বাগ্‌দীপাড়া গিয়াছে শুনিলে আজহার তাকে খুন করিয়া ফেলিবে। এই ব্যাপারে স্বামী কেউটে সাপের চেয়েও বিপজ্জনক। অথচ কত নিরীহ আজহার। এই নিরীহ লোকটি ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি দেখিলে কেন এইরূপ রক্তোন্মত্ত হইয়া যায়, দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল।

পরামর্শ ঠিক হইয়া গেল তিনজনের মধ্যে। আজহার ঘুমাইয়া পড়িলে আমজাদ, মোনাদির ও দরিয়াবিবি শৈরমীকে দেখিতে যাইবে। শুধু-হাতে রুগ্ন সখীর নিকট যাওয়া অশোভন। অন্তত দুআনা পয়সা দরকার। যা হাতটান। সে ভার গ্রহণ করিল আমজাদ। আশেজ্জানের নিকট হইতে সে দুআনা পয়সা আদায় করিয়া আনিবে।

সুযোগ আসিল সহজে। সারাদিনের খাটুনির পর আজহার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সেদিন। তিনজনে গ্রামের অন্ধকার পথে পাড়ি দিল।

ফিসফিস কণ্ঠে পথ চলার সময় দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল : আমজাদ, পথ চিনিস?

খুব। রোজ এই রাস্তা চষে ফেললাম।

মোনাদির পথটির সহিত বিশেষভাবে পরিচিত নয়, সে চুপ করিয়া রহিল।

সরু সড়কের পাশে ঘন ঝোঁপজঙ্গল। বাতাস বহিতেছিল। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির আকাশ বিহারের মতো নেশা লাগে দরিয়াবিবির গায়ে। ঘরের আনাচ, কানাচ, বড়জোর প্রতিবেশীদের সীমানা ছাড়াইয়া পৃথিবীকে দেখিবার খুব বেশি সুযোগ ঘটে নাই তার।

প্রহর দুই রাত্রি অতীত। চাষীদের সদরে পিদিম জ্বলিতেছে এখনও। তাসের আড্ডা চলিয়াছে বোধহয়। পথে লোকজন নাই। দরিয়াবিবি নিঃসঙ্কোচেই হাঁটিতেছিল। অন্ধকারেও সরুপথের শুভ্র দাগ চকচক করিতেছে।

শৈরমীর ঘরে ঢুকিয়া দরিয়াবিবি শিহরিয়া উঠিল। ঝুপড়ি ঘর। পুরাতন হাঁড়িকুঁড়িপূর্ণ। ময়লা মাদুরের উপর আরো ময়লা একটি বালিশ মাথায় শৈরমী শুইয়াছিল। ঘরের চারিদিকে কোনো জানালা নাই। ঝড়ের উপদ্রব জীর্ণ কুটিরের পাঁজরে সহ্য হইবে না, তাই এই ব্যবস্থা সহজে মানিয়া লয় গরিব কৃষকেরা। দম আটকাইয়া যাইতেছিল দরিয়াবিবির। তবু মমতার বিজয়ী আহ্বান সব অসোয়াস্তির চিহ্ন মুছিয়া ফেলে। শৈরমী চোখ খুলিয়া বিস্ময়ে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল।

দরিয়াবিবি ডাক দিল, সই।

শৈরমী জবাব দিল না। হাত-ইশারায় উপবেশন করিতে অনুরোধ করিল। দরিয়াবিবি দ্বিরুক্তি করিল না। শৈরমীর আত্মীয়া শিয়রে বসিয়া পাখা দোলাইতেছিল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, এখন কেমন আছে?

কোথায় ভালো, মা।

আত্মীয়া মেয়েটি ম্রিয়মাণ কণ্ঠে জবাব দিল।

আবার ডাক দিল দরিয়াবিবি : সই। কেমন আছ?

গলায় কফ জমিয়াছিল শৈরমীর। ঘড়ঘড় শব্দ হয় শ্বাসনালীর ভিতর। সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করিল।

নারীকণ্ঠের ক্ষীণ শব্দ শোনা গেল : ভালো-ভালো।

আবার হাঁপাইতে লাগিল শৈরমী। বিধবা মেয়েটি আদিখ্যেতা শুরু করিল : কপাল দেখো, মা। গরিব আমরা, দেহটা যদি ভালো থাকে। শোকের ওপর আবার এই রোগ। ভগবানের কি ফুটো চোখও একটা আছে?

দরিয়াবিবির দিকে অদ্ভুত ক্লান্ত স্তিমিত দৃষ্টি মেলিয়া শৈরমী চাহিয়াছিল, চোখের পাতা আর পড়ে না। দরিয়াবিবিরও চক্ষু ফিরাইবার সামর্থ্য ছিল না যেন।

শৈরমী এবার গলা পরিষ্কার করিল কয়েকবার খকখক কাশিয়া।

সই, ভালো হই, যাব।

দরিয়াবিবি তার রেখাঙ্কিত ময়লা হাতটি স্পর্শ করিয়া দেখিল। জ্বর নাই বোধ হয়। শীতল, ঠাণ্ডা হাত।

হ্যাঁ, এসো আবার।

মাথা দোলাইল শৈরমী।

সই।

সই।

তোমার ঘড়াটা, জয়া দাও তো। কথা বলিতে রীতিমতো কষ্ট হইতেছিল শৈরমীর, ঘরের হাঁড়িকুঁড়ির জঙ্গলের দিকে সে হাত বাড়াইল।

আবার মৃদু ঠোঁট সঞ্চারিত হইল : আমি– আমি ছাড়িয়ে এনে রেখেছিলাম, টাকাটা আমার হাতে দিও।

শৈরমীর চোখের কোণ হইতে অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। জয়া একটি পিতলের ঘড়া দরিয়াবিবির সম্মুখে রাখিল। সে-ও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যজনরত হইল।

শৈরমীর চোখমুখ দেখিয়া মনে হয়, বহু-কথন প্রয়াসী সে। কিন্তু চুপ করিয়া রহিয়াছে। শ্বাসনালীর শব্দ আরো দ্রুত হইতেছে। বসিয়া রহিল দরিয়াবিবি নির্মম পাথরের মতো। দারিদ্রের হিংস্র রূপ তার কাছে অপরিচিত নয়। কিন্তু এত বিভীষিকাময় তার অট্টহাস্য, দরিয়াবিবি আর কোনোদিন শোনে নাই, শিহরিয়া উঠিতেছিল সে বারবার।

চৌকিদার প্রহর হাঁকিয়া গেল। ছেলে দুটি নির্বোধ দর্শকের মতো বসিয়াছিল। তাহাদের চোখের পাতায় ঘুম। দরিয়াবিবি আর বিলম্ব করিল না। জয়ার হাতে দুয়ানিটি খুঁজিয়া দিয়া বিদায় লইল। তবু একজন সমব্যথী পাইয়াছে শৈরমী। মেয়েটি ভিটার নিচে আগাইয়া আসিল।

কপাল মা। তবু ভিন পাড়া থেকে এসে দেখে গেলে। কেউ চোখও দেয় না। রাতটা কাটবে না। আর দেরি করব না। কফটা আবার এলো কিনা।

দ্রুত চলিয়া গেল জয়া।

ঘড়াটি মোনাদিরের বগলদাবা। আকাশে মেঘ জমিয়াছিল। চাঁদ আরো ঘনীভূত অন্ধকারে হারাইয়া গিয়াছে। জঠরের সন্তানের প্রতি মমতাবশতই বোধহয় দরিয়াবিবি সন্তর্পণে পা ফেলিতেছিল, নচেৎ চলৎশক্তি তার রহিত হইয়াছে।

ঘন বাঁশবনে বাতাসের আর্তনাদ মাথা কুটিতেছিল। হঠাৎ শৈরমীর ভিটা হইতে আকস্মিক রোদন নিনাদ শোনা গেল।

একবার থাম্‌, আমু।

দরিয়াবিবি ক্রমশ নিরস্ত হইয়া উৎকর্ণ হইল। জয়ার বুকফাটা চিৎকার।

হ্যাঁ, চিৎকার।

আমু বলিল, মরে গেল গো পিসি।

দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া রহিল জড়পদার্থের মতো। রক্তমাংসের নিচে মানুষে মানুষে সঙ্গীভূত হওয়ার যে পরিপ্লাবী উৎসধারা যুগ-যুগান্তের শিকড় উৎপাটন করিয়া নব নব সভ্যতার বীজ ছড়াইয়া যায় তারই সর্বস্বীকারহীন চঞ্চল আর্তনাদ তরঙ্গের মতো দরিয়াবিবির বুকে আছড়াইয়া পড়িতেছিল। তারই আহ্বান তো এত নিশীথ রাত্রে ঘরছাড়া করিয়া আনিয়াছে তার মতো গর্ভবতী জননীকে।

দরিয়াবিবি শৈরমীর ভিটার দিকে মুখ ফিরাইল।

আমজাদ বলিল : কোথা যাও, মা। হিন্দুদের মড়া, হিন্দুদের ঘর, সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে?

উচ্ছ্বসিত কান্নায় বুক চাপিয়া পথের উপর বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি।

সকালে শৈরমীর মৃত্যুসংবাদ ছড়াইয়া পড়িল। দরিয়াবিবির কেমন মায়া বসিয়াছিল বাগদী এই রমণীর উপর। সাংসারিকতার ভিতরেও সেদিন মন হাল্কা করিতে পারিল না আজহার-পত্নী।

.

মোনাদিরের জিদেই বিকালে আমিরনের বাড়ি গেল দরিয়াবিবি।

অবেলায় মুরগী হাঁস লইয়া ব্যস্ত ছিল আমিরন। বহুদিন পরে দরিয়াবিবির আগমনে সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। আম্বিয়া মোনাদিরকে দেখিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল।

দুই পল্লীরমণী সংসারের খেদোক্তি জুড়িয়া দিল। মোনাদির-আমজাদ চুপ করিয়া বসিয়া থাকার পাত্র নয়। আম্বিয়ার সঙ্গে প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া তাহারা সড়কের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল।

পল্লীর এই অংশে গাছপালা থাকিলেও ঘন জঙ্গল মনে হয় না। আমজাদের এইজন্য এলাকাটা খুব পছন্দ। মার্বেল খেলিবার এমন সুপ্রশস্ত চত্বর অন্যদিকে নাই।

দুই ভাই খেলা করিতে লাগিল। আম্বিয়া দর্শক মাত্র।

গাব্বুর ভেতর মার্বেল পিল করিতে করিতে মোনাদির বলিল : আম্বিয়া, তুই মতবে যাস?

মখতবে যাব না কেন? বুড়ো হতে বসেছি, লেখাপড়া শিখব না?

বড় পাকা কথা। কথার চেয়ে ঝাঁঝ আরো বেশি।–আরে আমার দাদিসাহেবা। কৈ চল, কী পড়িস দেখব।

মোনাদির মার্বেল খেলা ছাড়িয়া দিল।

চলো। আম্বিয়া হাত ধরিয়া সেদিনের মতোই তাহাকে টানিতে টানিতে অঙ্গনে প্রবেশ করিল। সে পড়ার বই বাহির না করিয়া একটি ছড়ার বই বাহির করিল মোনাদিরের সম্মুখে। শিশু-পাঠ্য, সুন্দর প্রচ্ছদপট, একটি পুস্তক। ছড়া ও ছবি-পূর্ণ। মোনাদির এমন পুস্তক পূর্বে দেখে নাই। বেশ মজা পাইতেছিল সে।

তুই, এই বই পড়তে পারিস?

ঠোঁট উল্টাইয়া আম্বিয়া জবাব দিল, পারব না কেন?

একটি ছড়া মিহিকণ্ঠে সে আবৃত্তি করিতে লাগিল।

বেশ তো। এই বই পেলি কোথায়?

মখতবে রহিম বকশ চৌধুরীর মেয়ে পড়ে। তারই কোনো আত্মীয় পুস্তকটা উপহার পাঠাইয়াছে।

মন্তব্যে মোনাদিরও পশ্চাৎপদ নয়।

তুই বেশ কাজের বুড়ি। পাকা বুড়ি।

মুখ ভেংচাইয়া উঠিল আম্বিয়া : বুড়ি বলবার কে তুমি? মোটে সাত বছর বয়েস।

আমজাদ সশব্দে হাসিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ চলিল ছড়া পাঠ। অবেলার বাতাসে শিশুকণ্ঠের গুঞ্জন।

তুমি এসো আর একদিন, অন্য বই আনব।

আমজাদ মোনাদিরের কাছে নিষ্প্রভ হইয়া যায়। আগন্তুক বালকের উপর তার হিংসা হয়, কিন্তু তা নিবৃত্তির একটা সহজ উপায়ও সে এই কয়েক মাসে আয়ত্ত করিয়াছে। মার উপর তার দরদ ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। দর্শকের মতো আমজাদ ছড়াপাঠের সভায় যোগ দিয়াছিল।

আমিরন চাচি হাঁক দিল : এই হতচ্ছাড়ি, এই বই নিয়ে হল্লা কেন এত? কদ্দিন বা তোকে মতবে পাঠাতে পারব।

দরিয়াবিবি ধমক দিল : খামাখা তুমি মেয়েকে ধমকাও। বেশ লক্ষ্মী মেয়ে। চালাক, পড়াশুনায় ঝোঁক আছে।

চালাক। পাঁচ বছর বাদ বুকে পাথর হয়ে বসবে ঐ মেয়ে। বেওয়া মায়ের আবার স্নেহ যত্ন শান্তি।

খোদার দিন খোদা চালায়। ভেবে ভেবে আমারও পাঁজরা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ভাবি, দূর ছাই আর চিন্তা করব না, তবু সব গোল পাকিয়ে আসে।

মোনাদির তখন একটি ছড়া আবৃত্তি করিতেছিল। শেষ হইলে আম্বিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিল, আর একটা পড়ো না মানু ভাই। তোমার মুখে বেশ মানায়।

প্রশংসায় মোনাদিরের বুক ভরিয়া উঠিতেছিল। তবু ধমক দিয়া বলিল : হ্যাঁ, আর ফাজলেমি করতে হবে না। বদমাইশ।

মোনাদির আর একটি ছড়া আবৃত্তি করিল। জননীদের মধ্যে তখন দুঃখ-দারিদ্র্যের কথোপকথন চলিতেছিল। আমিরন চাচির পাড়ার আত্মীয়রা মোটেই সদয় নয়। ভিটেমাটি ছাড়া হইলে, এই কয়েকটি গাছপালা ও পুকুর পুঙ্কুরিণীর উপর দৌরাত্ম করিতে পারিলে তারা সন্তুষ্ট হইবে।

দরিয়াবিবি অতীত আত্মীয়দের ব্যবহারের স্মৃতি বয়ান করিতে লাগিল।

বহুদিন এইদিকে দরিয়াবিবি আসে নাই। বড় পরিচ্ছন্ন আমিরনবিবি। দীনতার ভিতর এমন সৌন্দর্যের তৃষ্ণা বাঁচিয়া রহিয়াছে। উঠান, ঘাটের পথ, দাওয়া ঝকঝকে; গৃহলক্ষ্মীর স্বর্গ রহিয়াছে মাচাঙ, সবজি ও গাছপালার উপর।

সন্ধ্যা নামিতেছে। আর দেরি চলে না, ছড়ার আসরও ভাঙিতে হইল। মোনাদির। এখানে পরিচিত মনের সন্ধান পাইয়াছে। কয়েকদিন আগেকার অসোয়াস্তি ভুলিয়া গেল। আম্বিয়া ও আমিরন সড়ক পর্যন্ত আগাইয়া আসিল।

সড়কে আবার ভারী হইতে থাকে দরিয়াবিবির মন। এতক্ষণ বেশ ছিল সে। শৈরমী শাকের বোঝা মাথায় অবসন্ন সন্ধ্যায় সড়কে হাঁটিতেছে যেন, তারই সম্মুখে।

.

১৭.

শকরগঞ্জ আলুর চাষে অনেক লোকসান গিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল হাসিমুখেই বলিল : খ সাহেব, আমাদের কপালটা পাথর চাপা।

আজহার নিরুত্তর ছিল। সংসারে পোষ্য সংখ্যা বাড়িতেছে। আয়ের অঙ্ক যদি নড়চড় হয়, বাঁচার আর কোনো আস্বাদ থাকে না।

চিন্তায় আজহারের ঘুম হয় না ঠিকমতো। তার মস্তিষ্কের কলকজা এমনিই চালু নয়। মনের অন্ধকারে হামাগুড়ি দেওয়ার মধ্যেই সে শান্তি পায়।

চন্দ্র কোটাল অলস নয়। রোজগারের পন্থা সে সহজে আবিষ্কার করে। আজহার অবাক হইয়া গেল। চন্দ্র কোটাল বাস্তুর ঢিবির পাশেই আর এক চালাঘর তুলিয়াছে। তার ভিতর একটি ভাঙা হারমোনিয়াম, পুরাতন বেহালা, পরচুলা আর বাইজি সাজার পোশাক। চন্দ্র ভিতরে বসিয়া একজন যুবকের সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছিল।

এ কী, চন্দ্র? আজহার জিজ্ঞাসা করিল।

এসো, মাদুরের উপরে বসো। সব বলছি। একটা ভাঁড়-নাচের দল করলাম আবার।

আজহার মাদুরের উপর বসিয়া তামাক ফুঁকিতে লাগিল।

ছ্যা ছ্যা। শেষে আবার বুড়ো বয়সে এইসব কাজে হাত দিলে!

জঠরের উপর হাত বুলাইয়া চন্দ্র হাসিয়া উঠিল।

বুড়ো বয়স। কিন্তু এই জায়গাটা বুড়ো হতে জানে না।

আজহার বলিল, তোমাদের মহড়া চলছে?

চন্দ্র। খুব জোরেশোরে চলছে। এবার বস্ত্রহরণ পালা করব।

আজহার। ওটা তুমি ভালোই করতে। এত সাজগোজ। টাকা পেলে কোথা?

চন্দ্র পার্শ্বে উপবিষ্ট যুবকের পিঠে হাত থাপড়াইয়া জবাব দিল : এই যে আমার রাজেন্দ্র ভায়া আছে। ও বহুত দিন শহরে ছিল। শহরের ছাঁটকাট এনেছে কিন্তু পয়সা আনতে পারেনি।

রাজেন্দ্র এই গ্রামের কৃষকপল্লীর সন্তান। সত্যই তার ছাঁটকাট শহুরে। পরনে ধুতি, গায়ে হাফশার্ট। চুল দশ-আনা ছ-আনা।

রাজেন্দ্র লজ্জিত হইয়া বলিল, আর কেন ওসব চন্দ্রদা। এতেও যে পয়সা আসবে, মনে হয় না। তবে ফুর্তি করে দিনটা কাটানো যায়।

চন্দ্র। দাও না ভাই একটা গান শুনিয়ে।

তৌবা বলিয়া আজহার খুব কাঁচুমাচু করিল। রাজেন্দ্রের গান-গাওয়ার তেমন উৎসাহ ছিল না, গুনগুন করিতে লাগিল। চন্দ্র একটু অপ্রস্তুত হইল বৈকি।

চন্দ্র। দেখো খাঁ ভাই, এবার যখন রাজেন্দ্রকে পেয়েছি, দল ঠিক চলবে। ওর হাত গলা দুই সমান চলে। বেহালার ছড়ি ধরতে ওর জুড়ি নেই। যাত্রার দল সব ফেল মারবে দেখো।

আজহারের এই আবহাওয়া ভালো লাগে না। কয়েকটি পুরাতন শাড়ি ঝুলিতেছিল আলনায়। জিজ্ঞাসা করিল, ওগুলো কি নাচের সাজ?

জবাব দিল চন্দ্র : হ্যাঁ। রাজেন্দ্র এনেছে সঙ্গে করে।

আজহার সহজেই সবকিছু গ্রহণ করিতে পারিল না। রাজেন্দ্রের বদনাম অনেক। বাউরীপাড়ার একটি বিবাহিতা মেয়ে লইয়া সে উধাও হইয়াছিল দেশ হইতে সাতবছর পূর্বে। বাউরী মেয়েটির স্বামী ও দেবর গত বৎসর মারা গিয়েছে। নচেৎ রাজেন্দ্র দেশে ফিরিতে সাহস করিত না। তার প্রবাস জীবনের কত কাহিনী গুজবের আকারে পল্লীগ্রামে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। বাউরী মেয়েটি এখন নিষিদ্ধপল্লীতে আশ্রিতা। রাজেন্দ্র তার উপার্জনে আশ্রিত। থিয়েটারের এক বাইজি রাজেন্দ্রের প্রেমে পড়িয়াছিল। তার পশ্চাতে সে খোয়র হইয়া বর্তমানে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে। বহু টাকার মালিক রাজেন্দ্র দাস, অধর দাসের পুত্র। হাতেম বস খাঁর সন্তানেরা শহরে তার কল্যাণে ময়ূর উড়াইয়া বেড়াইতেছে কার্তিকের মতো। গুজবের শেষ নাই।

এইজন্য আজহার পরিচয় পাইয়া বড় বিগড়াইয়া গিয়াছিল মনে মনে। রাজেনকে চেনা দায়। রঙটি ফরসা। শহরের ছায়ায় আরো জৌলুশ খুলিয়াছে; সংলাপে কৃষকপল্লীর কোনো খুঁৎ পড়ে না। যেন কতদিন সে বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছে।

এমন লোকের সঙ্গে চন্দ্র জঘন্য ব্যবসা ফাঁদিতে গেল! কোটাল নেশা করে, সুতরাং অচিরেই সে গোল্লায় যাইবে। মুখ ফুটিয়া আজহার কোনো কথা বলিতে সাহস করিল না।

চন্দ্র কোটালের উৎসাহের অন্ত নাই। সুদীর্ঘ গোঁফে সে ঘন ঘন তা দিতে লাগিল।

দেখো আজহার ভাই, এবার ফসল যদি ভালো হয়, আমাদের বায়নার অভাব হবে না।

ফসল আল্লার মেহেরবানি। নিস্তেজ কণ্ঠে জবাব দিল আজহার।

রাজেন্দ্র হারমোনিয়াম টানিয়া রীড টিপিতে লাগিল। পড়ন্ত দুপুর। চন্দ্র কোটাল মাদুরের উপর তাল দিতে ব্যস্ত। আজহারের মুখে কোনো কথা নাই।

আজহার ভাই চন্দ্র মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিয়া উঠিল।

আজহার কিছু বুঝিতে পারে না। নূতন রোজগারের পন্থা জুটিয়াছে। মরীচিৎকার স্বপ্নে চন্দ্র কোটালের মুখে আনন্দের বন্যা আসিয়াছিল। নিষ্ক্রিয় আজহারকে সে ডাক দিল, কিন্তু তার মধ্যে বিদ্রুপের ভাব প্রচ্ছন্ন। আজহার ইহার বিন্দুবিসর্গ উপলব্ধি করিতে পারিল না।

তোমার সঙ্গে আমার আরো কথা আছে, চলো আজহার ভাই। রাজেন্দ্রের দিকে কোটাল দৃষ্টি বিনিময়ের সাহায্যে তাকে অপেক্ষা করিতে বলিল।

খাঁ সাহেব, তুমিও আমাদের দলে ঢুকে পড়ো।

আজহার চন্দ্রের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

কোটালের দাওয়ায় বসিয়া আজহার আরো বিস্মিত হইল। শ্ৰী লাগিতেছে তার। ঘরে। বাঁশের নড়বড়ে খুঁটি বদলাইয়া একটি কাঠের খুঁটি লাগাইয়াছে সে। আলুচাষে নিশ্চয় কোটাল তাকে ফাঁকি দিয়াছে। চন্দ্রমণির অসুখ সারিয়া গিয়াছে। শাদা পরিষ্কার থানকাপড় পরনে। খানিক আগে পান খাইয়াছিল। রাঙাঠোঁটে তাকে বেশ মানায়, দুই সন্তানের জননী বলিলে ভুল করা হইবে। আজহার কোটাল সম্বন্ধে কোনো নীচতা মনে প্রশ্রয় দিতে পারে না। ফাঁকি দেওয়ার লোক সে নয়। নূতন দলের জন্য রাজেন্দ্র বোধহয় খরচ করিতেছে। তার সম্বন্ধে এত গুজব, তবে ভিত্তিহীন নয়।

আজহারের অভ্যর্থনার ত্রুটি হয় না কোথাও। কোটাল বলিল : আজহার ভাই, সত্যি, বুড়ো বয়সে কোমর নাচান আর ভালো লাগে না। রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা ধরে বসল। দেখি কপাল ঠুকে যা আছে ভাগ্যে।

চন্দ্র কোটাল পূর্বে ভাড়-নাচের দলে কাজ করিত। দশ-বিশ মাইল দূরে গঞ্জে গঞ্জে তাহাদের ডাক পড়িত। এমন প্রবাস জীবনের সময় এলোকেশীকে সে এক মাহিষ্য বাড়িতে সঙ্গিনীরূপে পাইয়াছিল। এলোকেশী তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। রাজেন্দ্রের। কীর্তিকলাপের খোটা দিয়া চন্দ্রের নিকট আজহার কোনো অভিযোগ করিতে সাহস করিল না।

স্তিমিত স্বর আজহারের : চেষ্টা করে দেখ। আমার সঙ্গে আর একটা চাষবাস কর।

নিশ্চয় নিশ্চয়। জাত ব্যবসা আমি ছাড়ব না। ওটা তো বাড়তি কাজ। বায়না পাব, কি না পাব কে জানে।

সংসারে আর ভালো লাগে না।

আমারও ওই দশা।

চন্দ্রমণি বেশ ফুটফুটে প্রজাপতির মতো। স্বাস্থ্যের জৌলুশের সঙ্গে তাকে আরো সুন্দরী মনে হয়। ছেলে দুইটি উঠানে লাফালাফি করিতেছে। আজহার কল্পনায় এমনই সাংসারিক চিত্র আঁকিতে লাগিল। তার সংসারে কি স্বাচ্ছন্দ্যের এমন হাওয়া লাগিবে না?

তামাক নিঃশেষ করিয়া আজহার উঠিয়া পড়িল। বলিল : ভেবে দেখ, চন্দ্রর। যদি পুঁজি পাও।

আচ্ছা, আচ্ছা।

কোটালের কণ্ঠস্বরে আনন্দের উচ্ছ্বাস। হিংসা হয় আজহারের মুহূর্তের জন্য।

মাঠের নিঃসঙ্গ পথে ঔদাসীন্যের বোঝা আজহারের বুকে জগদ্দলের মতো চাপিয়া বসিতেছে যেন। হারমোনিয়ামের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছিল। জুড়ি গান ধরিয়াছে রাজেন্দ্র ও চন্দ্র কোটাল।

.

১৮.

আঁতুরঘরে আর কোনোদিন এত দীর্ঘকালব্যাপী দরিয়াবিবিকে পড়িয়া থাকিতে হয় নাই। সুঠাম স্বাস্থ্য তার। পাঁচদিন পার হইলেই সে আবার সংসার গুছাইয়া লইত। আসেকজান এই কয়দিন তাকে সাহায্য করিত। বর্তমানে তার দৃষ্টিশক্তি অন্তর্হিত। অকেজো বুড়ি সংসারের কোনো কাজে লাগিল না। আমিরন চাচির শরণাপন্ন হইল আজহার খাঁ। সেও বিধবা মানুষ। সংসারের আগল পাগল হইয়া ব্যস্ত। কিন্তু আমিরন-চাচি সহজে রাজি হইয়া গেল। তার সিদ্ধান্ত সত্ত্বর সংসার-শৃংখলার ছবি আঁকিয়া লইল। গরু দুটি এই কয়েকদিন আর মাঠে ছাড়া হইবে না। গোয়ালে শুইয়া শুইয়া খড় খাক। মুরগি হাঁস আম্বিয়ার তদারকে। নিশ্চিন্ত আমিরন চাচি।

দরিয়াবিবি কৃতজ্ঞতায় ডুবিয়া গেল।

আসেকজানের ঘরটি বর্তমানে আঁতুরঘর। অন্ধকার। দিনের আলো সেঁধোয় না। কোণে কোণে পুরাতন ঝুল জমিয়া রহিয়াছে। অস্বাস্থ্যকর গন্ধে দম বন্ধ হইয়া আসে। ইহার ভিতর দরিয়াবিবি শুইয়াছিল। পাশে সদ্যোজাত শিশু মেয়েটি। অর্ধ পরিষ্কৃত ন্যাকড়ায় প্রস্তুত কাথার উপর যেন পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে। মার আদল নবজাতকের চোখেমুখে।

দরিয়াবিবি শিশুর দিকে চাহিয়া বলিল : আমি বুবু তোমার দয়ায় এ যাত্রা হয়তো বেঁচে যাব।

ছি ছি, বুবু। তোমাকে শক্ত মেয়ে মনে করতাম। তুমি এত কাতর হয়ে পড়ছ?

আর কোনোদিন এমন হয়নি। শরীল খুব ভালো ঠেকছে না।

দাওয়ায় আস্তানা পাতিয়াছিল আসেকজান। তার কানে কথাটা সহজে প্রবেশ করে। সে খেদোক্তি আরম্ভ করিল : আমারও নসিব, বৌ। চোখের মাথা খেয়ে বসে আছি। আগে তবু ফাঁই-ফরমাশ এই অকালে শুনতে পারতাম।

দরিয়াবিবির জ্বর হইতেছিল অল্প অল্প। কবিরাজ আসিয়াছিল একদিন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ডিস্পেন্সারি হইতে বর্তমানে ঔষধ আনা হয়। কবিরাজের ঔষধে কিছুই ফল হইল না। কিন্তু ডিস্পেন্সারি প্রায় তিন মাইল দূরে। আমজাদ ও মোনাদিরের মুখ রৌদ্রের তাপে শুকাইয়া যায়। আজহার খাঁর জমির কাজ ও টাকা ঋণের উপায় লইয়া ব্যস্ত সংসার লণ্ডভণ্ড। সময়মতো সকলের খাওয়া হয় না। নঈমার দুই চোখে এমন পিচুটি জমে যে, দুপুরের আগে সে চোখ খুলিতে পারে না। দাওয়ায় বসিয়া আসেকজানের নিকট সে নাকি কান্না কাঁদিতে থাকে। শুইয়া শুইয়া দরিয়াবিবি তিরস্কার করে। তখন মুহূর্তের জন্য সে থামে। আবার শুরু হয় ক্রন্দন।

আমিরন চাচিকে কোনো দোষ দেওয়া চলে না। গৃহিণীপনায় সে কম নয়। পরের সংসার অনভ্যাসের ফলেই গুছাইতে এত বিলম্ব।

মোনাদির স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। মার পাশে গিয়া আর বসিয়া থাকিতে ভালোবাসে না। দরিয়াবিবির আহ্বানে সাড়া দিলেও, কোনো উৎসাহ পায় না সে। এই আবহাওয়া সে যেন বরদাস্ত করিতে পারিতেছে না। কিন্তু বোনটির দিকে চাহিয়া সে একরকমের লজ্জা অনুভব করে। কোনো সচেতন কারণ অবশ্য তার উপলব্ধির বাহির। সৌন্দর্যের পুত্তলি। মোনাদিরের দুই চক্ষু কোনো আনন্দের উপকরণ খুঁজিয়া পায় না। এইজন্য মোনাদির পাড়ার গাছগাছালির তলায় বেশিক্ষণ থাকিতে ভালোবাসে। সঙ্গে আম্বিয়া বা আমজাদ। অথচ মার ফাঁই-ফরমাশের জন্য এই সময় তাদের ঘরে থাকা উচিত।

খোলা টাঁটির ফাঁক দিয়া বাহিরের জগৎ যা দরিয়াবিবির চোখে পড়ে। কর্মনিষ্ঠ, চঞ্চল তার মনও স্থিতি পায় না এই অন্ধকারে। শুইয়া শুইয়া খবরদারি গ্রহণে তার কার্পণ্য নাই। মুনি খেয়েছে কিনা, আমু কোথা, নঈমার চোখ কিরকম। হাজার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন। জেলা বোর্ডের ডিস্পেন্সারির ডাক্তার বিছানায় শুইয়া থাকিতে আদেশ দিয়াছিল। প্রসূতি কতটুকু বা তা পালন করিতে পারে? উঠিতে হয় বৈকি দরিয়াবিবিকে। আমিরন চাচি এই জন্য বড় বিব্রত। প্রস্রাব পায়খানা ফেলিবার ভারটুকু সে অতি কষ্টে দরিয়াবিবির নিকট হইতে গ্রহণ করিল।

তুমি ভালো হয়ে নাও তারপর শোধ নিও।

শোধ! বলিয়া মুখ কুঞ্চিত করিল দরিয়াবিবি। নবজাতক হাতপা নাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিতে সে তাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল। পুরাতন সূত্রের আবার খেই চলে : শোধ এ জন্মে নয়। আমার মোনাদিরটা বড় হোক।

চুপ করিয়া গেল দরিয়াবিবি। মাথার যন্ত্রণা হইতেছে।

আমিরন বিবি জিজ্ঞাসা করিল, একটু মাথা টিপে দিই?

না। তুমি রান্না সেরে ফেল।

হ্যাঁ, সেরে ফেলি। এক দৌড়ে বাড়ি যেতে হবে। ডাবায় পানি দিতে বলেছিলাম গরু দুটোকেও কি চোট বালতি করে পানি তুলেছে কিনা কে জানে। সারাদিন শুকিয়ে মরবে।

তা যেয়ো। তুমি যা দিলে বোন, শোধ-শোধ আর ইহজন্মে কেউ করতে পারে না।

এত কাঙালীপনা কেন? অথচ দরিয়াবিবির প্রশান্ত মনের সম্মুখে ঝড়ঝঞ্ঝা কত তুচ্ছ। কাতুরে কিশোরীর মতো দরিয়াবিবি।

কিছু ভেবো না। সব দুঃখ আল্লাই তরাবেন।

আল্লা-আল্লা।

বিদ্রুপের ভ্রুকুটি খুলিয়া গেল দরিয়াবিবির মুখের উপর।

আল্লাই যদি সব করেন, তবে আমাদের এত দুঃখ দিয়ে কী পান তিনি? আমার ঈমান নেই, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বুবু।

ছি, ও কথা মুখে আনতে নেই।

থাক আল্লা। রোগ হলে ওষুধ খেলে ভালো হয়।

এই ভালো হওয়ার রাস্তাটা তো মানুষকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। ওটা তো আন্না মগজে ঢুকিয়ে দেননি। তবে আর আল্লার কথা কেন মুখে। দুনিয়ার দুঃখকষ্ট রোগভালাই সবকিছুর পিতিকার আমাদেরই করতে হবে। আল্লা থাকে থাক্‌, না থাকে থাক্। দু-তিন বছরে আমার ঈমান গেছে।

স্তম্ভিত আমিরন চাচি!

কী বলছ রোগের ঝেকে! ওসব আমি বুঝিনে।

দরিয়াবিবি ক্লিষ্ট বেদনায় চোখ বন্ধ করিল। তার জগতের উপর কালো ছায়া নামিয়াছে।

আবার উন্মীলিত পক্ষ দৃষ্টি আমিরনের সর্বাঙ্গ কৃতজ্ঞতায় লেহন করিতে থাকে।

রাগ কর না, বুবু। তুমি নামাজ পড়। আমি পড়া ছেড়ে দিয়েছি। মন বসে না। খামাখা যাতে মন নেই, তা করে কোনো লাভ নেই।

আমিরন চাচি দরিয়াবিবির মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, এখন চুপ কর। তোমার মাথা ঠিক নেই।

হুঁ!

পায়ের গাঁটে অসহ্য যন্ত্রণা, সটান পা লম্বা করিতে লাগিল দরিয়াবিবি।

ঘুমাও তুমি। আমি কাজ সেরে আসবো।

খোকাদের একটু ডেকে দাও।

আচ্ছা, বলিয়া আমিরন বিবি রান্নাঘরের দিকে নিষ্ক্রান্ত হইল।

খোকারা কেউ এই তল্লাটে ছিল না। হাসুবৌ মাঝে মাঝে খোঁজখবর লইয়া যায়। দরিয়াবিবির শারীরিক পরিচর্যা সে ফুরসৎ মতো সম্পন্ন করে। বেশিক্ষণ বাহিরে থাকার জো নাই তার। শ্বাশুড়ি এই নির্বোধ রুগ্ন বধূটিকে চোখে চোখে রাখিতে চায়। জিন ভূতের পাল্লায় সর্বনাশ হইতে চলিয়াছে তার। সংসারে বংশধর না আসিলে পুত্র আর ঘরমুখো হইবে না। বধূর ওপর খর মেজাজ ফলাইলেও সাকেরের মা আসলে করুণা পরবশ। ছেলেগুলিকে কয়েকদিন নিজের কাছে রাখিতে চাহিয়াছিল হাসুবৌ। দরিয়াবিবি রাজি হয় নাই। তাহাদের সংসারও খুব সচ্ছল নয়। আত্মীয়তার দৌরাত্মে মনের সাধারণ মিলটুকু পাছে হারাইতে হয়, দরিয়াবিবি সে আশঙ্কা করিয়াছিল। কিন্তু তার পুত্রবধূ গাছগাছালির উৎসঙ্গে আদর না পাইলে হাসুবৌর কাছেই ছুটিয়া যায়, সেখানে আহারাদি করে না। মোনাদির মার কড়া হুকুম পালন করিত। হাজার সাধাসাধির পরও সে হাসুবৌর বাড়িতে কোনো খাবার হাতে লইত না।

কাঁচা দুপুরে তারই অভিনয় চলিতেছিল। হাসুবৌর হাতে কয়েকটি সন্দেশ। তক্তপোশে আমজাদ, আম্বিয়া ও মোনাদির।

হাসুবৌ। লক্ষ্মী ছেলেদের মতো খেয়ে ফেলো। হা হা শব্দ করিল হাসুবৌ।

না, আমি খাব না। মা বকবে।

মা দেখতে আসছে নাকি?

এরা বলে দেবে।

ওরাও যে খাবে।

মোনাদিরের আর কোনো ভয় নাই। হাত পাতিয়া সে সন্দেশ গ্রহণ করিল। তারপর যৌথ হা-হামের পালা। হাসুবৌ হাসিয়া লুটোপুটি খাইতে লাগিল।

সাকেরের মা ঘরে ঢুকিয়া একচোট হাসিয়া লইল।

বৌমা রান্নাবানা দেখ। অভাগীর বেটি কপাল এনেছিস কী, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করবি।

হাসুবৌ পাথর হইয়া যায়। আমজাদ ইত্যাদিরা সন্দেশে কামড় দিয়া বসিয়া থাকে, আর মুখ নড়ে না।

আপন মনেই বকিতে লাগিল বুড়ি : যত-সব অভাগীর কপাল। একটা ছেলের হা পিত্যেশ মিটল না। সাকেরটা গেছে কোথা লাঠি নিয়ে কোনোদিন কী কপালে আছে আল্লা জানে।

বাহির হইয়া গেল বুড়ি। বুড়ি তো নয়, আপদ! ঘরে আবার হাসির হরা।

মোনাদির একটি গল্পের বই পড়া শুরু করিল। সকলে মন দিয়া শোনে। হাসুবৌ মোনাদিরের নিকটে। তার চালচলন, পঠনভঙ্গি বড় সুন্দর দেখায়।

অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। মোনাদির গল্প শেষ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিল। দুপুর ঢলিয়া পড়িতেছে। না, আর বসা যায় না। ক্ষুধা লাগিয়াছে তার।

আম্বিয়াকে সে বলিল : চল্ না, বাড়ি যাবি না?

চল না, মুনিভাই।

হাসুবৌ বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল : আম্বি, তুই যেতে চাস, যা। আবার ওকে কেন টানাটানি!

আমি ওর সঙ্গে যাব। কাঁচুমাচু খাইয়া আম্বিয়া জবাব দিল।

না, আমিও যাব।

মোনাদির তক্তপোশ হইতে নামিয়া দাঁড়াইল। হাসুবৌ আক্রোশ বিফল দেখিয়া অনুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল : মুনি, দরিয়াবুবুকে দেখে আসব।

তবে চল।

খুব উৎফুল নয় মোনাদির। স্বাভাবিক শালীনতা যেন সে এই বয়সে আয়ত্ত করিয়াছে। হাসুবৌ জবাব দিল : আমি তোমাকে হেঁটে যেতে দিচ্ছি নে, আমার কোলে চড় দেখি, সোনা।

বাধা দিল মোনাদির : আমি কি খোঁড়া, না আমার পায়ে মেহদি দিয়েছি?

কোনো বাধা হাসুবৌ স্বীকার করিল না। মোনাদিরকে সে কোলে তুলিয়া লইল।

আমজাদ ফুট কাটিল : ধেড়ে ছেলে কোলে উঠেছে।

শাসাইয়া জবাব দিল হাসুবৌ : তোর কী রে! দশ-এগারো বছর বয়সে যদি ধেড়ে, তুই কী?

মোনাদির কোলে চড়িয়াছিল, কিন্তু আরাম নাই তার বুকে। পাড়ার লোকে হাসিবে বৈকি!

গমন-উদ্দেশ্যে পা বাড়াইয়া হাসুবৌ মোনাদিরকে বলিল : লক্ষ্মী, আমার গলাটা জড়িয়ে ধর, না-হলে আছাড় খেয়ে পড়ে যাবে।

.

ঘরে আদৌ মন টেকে না মোনাদিরের। হাসুবৌ দরিয়াবিবির মাথা টিপিয়া দিতেছিল। মোনাদির কয়েক মিনিট মার সঙ্গে বাক্যালাপ করিয়া উঠিয়া গেল। আমিরন চাচি সকলের খাবার দিতেছিল। আজহারের ভাত রান্নাঘরে চাপা থাকে। মাঠের কাজ ছাড়া চন্দ্র কোটালের সঙ্গে সে কোথায় কী করিতেছে তার কেউ হদিশ জানে না।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর মোনাদির একটিবার মার ঘরে উঁকি দিয়া পাড়ায় উধাও হইয়া গেল। আম্বিয়া দুপুরবেলা ঘরে গিয়াছে, সেদিকেই খেলা ভালো জমিবে।

হাসুবৌ ডাক দিয়া কোনো সাড়া পাইল না। দরিয়াবিবি বিষমুখে বলিল, আমি বিছানায় পড়া-অব্দি ওর যে কী হয়েছে।

হাসুবৌ জবাব দিল, এই কদিন আমার কাছে নাহয় থাকত। তুমি আবার রাজি হও না।

না বৌ, সে হয় না। একে অনেক কষ্টে ও ফিরে এসেছে। আমার চোখে চোখে থাক।

খুব তো তোমার চোখে চোখে আছে!

হাসুবৌ খানিক পরে চলিয়া গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় কিন্তু এলোমেলো সাংসারিক জটাজাল কুণ্ডলী পাকাইয়া গেল।

ভর সন্ধ্যা। তবু একটি ছেলে ঘরে ফেরে নাই। আসেকজান আজকাল রাত্রি কাটাইবার সুযোগ অন্য কোথাও পাইলে এখানে থাকে না। কী বা সাহায্যে লাগে সে। নঈমা দাওয়ায় বসিয়া ঝিমাইতে জানে শুধু। সন্ধ্যার পর সে-ও ভালো দেখিতে পায় না। হাসপাতালের ডাক্তার চোখ দেখিয়া পথ্যের তালিকা প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন। অত পয়সা খাঁ-পরিবারে কারো নাই যে, আহার্য রোগের প্রতিষেধকরূপে ব্যবহৃত হইবে। আমিরন চাচি মুরগি-হাঁস তুলিতে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি গিয়াছে।

দরিয়াবিবি করুণ সুরে ডাকিতেছিল : একটি পানি দিয়ে যা– কণ্ঠস্বর তার রোগেশোকে ক্ষীণ। অনেকক্ষণ কারো জবাব না পাইয়া সে প্রাণপণে একবার চিৎকার করিয়া উঠিল, তোরা কি মরে গেছিস সব?

নঈমা জবাব দিয়াছিল। অক্ষমের আর কোনো চারা নাই। এই সময় আজহার খাঁ ফিরিয়া আসিল। তখনও তার কাঁধে লাঙল। দরিয়াবিবির আর্তনাদ শুনিয়া আজহার আর গোয়ালঘরে লাঙল রাখিতেও যায় নাই।

কী হল, দরিয়াবৌ?

একটু পানি।

উঠানেই লাঙল রাখিয়া কলস হইতে পানি গড়াইল আজহার। দরিয়াবিবি নিশ্চিন্তে পান সমাধা করিয়া গ্লাস স্বামীর হাতে দিয়াছে, দেখা গেল উঠানের উপর আমজাদ একটি কঞ্চি হাতে অগ্রসর হইতেছে, পশ্চাতে মোনাদির।

গ্লাস মাটিতে নামাইয়া আজহার খাঁ তীরবেগে ছুটিয়া আসিল, কোথায় ছিলি হারামজাদা? দাঁড়া– বলিয়া সে আমজাদের কান ধরিয়া চপেটাঘাত ও পরে আছাড় দিয়া উঠানে ফেলিয়া দিল। ইহার পর শুরু হইল মোনাদিরের উপর ঐ প্রচণ্ড শাস্তি। হাতের কঞ্চি লইয়া আজহার খাঁ দুইজনকে একই সঙ্গে প্রহার শুরু করিল : যত সব পর-খেগো হারামীর বাচ্চা। খেয়ে টইটই ঘুরে বেড়াবে। শুয়োরের বাচ্চা, মরো নি তোমরা–।

নঈমা চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছিল। তার পরিবেশে কী ঘটিতেছে সে না দেখিলেও নির্মমভাবে উপলব্ধি করিয়াছিল। তারই ফলে ক্রন্দন ও চিৎকার।

আজহার খাঁ ছুটিয়া আসিয়া তাকেও দু-ঘা চাবকাইল।

উঠানে হাঁকাহাঁকি পড়িয়া গিয়াছে। নিরীহ আজহার খাঁ সে হঠাৎ এমন পাষণ্ড হইতে পারে, কল্পনার বাহিরে।

দরিয়াবিবিও বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিল। সেও চিৎকার আরম্ভ করিয়াছে : দাঁড়াও তোর মরদের গুষ্টিতুষ্টি করেছে। এত বড় বুকের পাটা, আমার ছেলেদের গায়ে হাত।

ছুটিয়া আসিল দরিয়াবিবি উঠানের উপর। দাওয়ার উপর হইতে পীড়িত শরীরে কিরূপে অবতরণ করিল, সেই মুহূর্তটুকু তার জবাব দিতে পারে।

আজহার রণে ভঙ্গ দিয়া লাঙল কাঁধে দহলিজের দিকে চলিয়া গেল।

উঠানের উপর ধূলি-লুণ্ঠিত অবস্থায় মোনাদির ও আমজাদ। কয়েক জায়গা ফাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে শরীর হইতে।

দরিয়াবিবি আগাইয়া আসিবার পূর্বে স-চিৎকার মূর্চিত হইয়া পড়িল মাটির উপর।

একটু পরে আসিল লণ্ঠন-হাতে সাকের, হাসুবৌ ও তার শাশুড়ি।

.

১৯.

আমিরন চাচির সেবার অপূর্ব দক্ষতায় এই যাত্রা সত্যই বাঁচিয়া গেল দরিয়াবিবি। গরিবের সংসারে বিনা চিকিৎসায়, বিনা পথ্যে শুধু মনের জোরেই নিজকে চাঙা করিয়া তুলিল খাঁ পত্নী। এই তিন সপ্তাহে সে আরো একটি দোসর পাইয়াছে জীবনে আমিরন ও আম্বিয়া। রোগশয্যায় শৈরমীর দীন-মৃত্যুচ্ছবি দরিয়াবিবির মানসপটে ফুটিয়া উঠিত। হয়তো তেমন মৃত্যু হইবে তার। আমিরন চাচি ধীরে ধীরে তার মানসিক স্বাস্থ্যও ফিরাইয়া আনিয়াছে। নূতন কচি মেয়েটির দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি ক্ষুব্ধ মনে মনে। এই রূপরাশি দরিদ্র্যের কুটিরে তামা হইয়া যাইবে। আমজাদ ও মোনাদিরকে লক্ষ্য করিয়া দরিয়াবিবি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে।

.

এই কয়েকদিনে পুরাতন স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিত দরিয়াবিবির। মোনাদির তাকে দাগা দিয়া গিয়াছে। তার কোনো খোঁজ নাই। মার খাইয়া সে বিছানায় মুখ খুঁজিয়া পড়িয়াছিল। পরদিন ভোরবেলা হইতে সে নিরুদ্দেশ। সাকের দরিয়াবিবির আগেকার বাড়িতে সন্ধান লইয়াছিল। মোনাদির সেখানে যায় নাই।

কান্নাকাটির কসুর করিল না দরিয়াবিবি। আজহারের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। দৈনন্দিনতার চাকায় মিশিয়া গিয়াছিল দরিয়াবিবি। স্ত্রীর সমস্ত কর্তব্য সে সম্পন্ন করে। কিন্তু নির্বাক। তার নির্মম মুখের দিকে চাহিয়া আজহার কথা বলিতে সাহস করে না। সংসারে দুইজন জীব একসঙ্গে বসবাস করিতেছে মাত্র। পশুর মতো একে অপরের ভাষা বোঝে না, সেইজন্য বাক্যালাপেরও কোনো প্রয়োজন নাই।

চন্দ্র কোটাল ভাড়-নাচ লইয়া খুব মজিয়াছিল। কয়েকটি মঞ্চে ইতিমধ্যে সে আসর জমাইয়া আসিয়াছে। দরিয়াবিবির অসুখের সময় এলোকেশী চন্দ্রমণি কয়েকদিন আসিয়া দেখিয়া গিয়াছিল। মোনাদির আজহারের তিরস্কারে এই ঘর পরিত্যাগ করিয়াছে, তাও জানিত চন্দ্র কোটাল। কিন্তু তা লইয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিঃশব্দের পাহাড় মাথা তুলিয়াছে, এই সংবাদ তার জানা ছিল না।

আজহার একদিন সমস্ত বৃত্তান্ত কোটালকে বলিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিল।

তোমারও রাগ আছে তা হলে?

হাসিতে লাগিল চন্দ্র। মেনি বিড়ালেরা মাঝে মাঝে রুইমাছের মুড়া গিলিয়া ফেলে। আজহার রাগিতে পারে, আশ্চর্যের বিষয় নয়।

হঠাৎ, অমন মারা উচিত হয়নি।

ভাবীর পায়ে ধরেছ?

গোঁপে তা দিতে লাগিল চন্দ্র।

তৌবা। তুমি একবার গিয়ে বলল, এমন করে সংসার চলে?

চলুক। বেশ তো, দশবছর কথা বলেছ, এখন কথা না বললে চলবে না?

দূর পাগল।

এইবার ভালো ফসল হইয়াছিল। আজহার খুব সংসার-বিব্রত নয়। কল্পনায় ছবি আঁকিতে সে-ও ভালোবাসে।

চন্দ্র কোটাল সেইদিন দরিয়াবিবিকে হাস্য-কৌতুকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল।

ভাবী, আমার ভাঁড়-নাচ তোমাকে দেখাতে পারলাম না। যা ধর্মের কড়াকড়ি তোমাদের।

একদিন দেখে আসব তোমার বাড়ি গিয়ে।

টাঁটির আড়াল হইতে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

আমার সঙ্গে কথা বলছ। আর খাঁয়ের সঙ্গে কেন কথা নাই?

চুপ করিয়া গেল দরিয়াবিবি। একটু পরে আসিল উত্তর, আমার ছেলেকে যদি কেউ তাড়িয়ে দেয়

সেটা নিশ্চয় অপরাধ। আমি যদি মুনি খুড়োকে এনে দিই।

আগে এনে দাও।

নিশ্চয় এনে দেব। নিশ্চয়।

আমজাদকে মারল, আমি রাগ করিনি। কিন্তু একটা হতভাগ্য এখানে ঠাই নিয়েছিল, তার উপর হাত চালালে। আমার দিকে একবার দেখলে না।

সেটা ভারি অন্যায় করেছে।

চন্দ্র কোটালের বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগে দরিয়াবিবি বলিতে লাগিল, বড় দুঃখী আমার মুনি, তার গায়ে হাত দিলে হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিল দরিয়াবিবি। চন্দ্র কোটাল তা উপলব্ধি করিতে পারে। সাহ্যপ্রিয় তার মতো মানুষটি আর কথা বলিতে সাহস করিল না।

দহলিজে ফিরিয়া আজহার খাঁকে সে খুব ধমক দিল।

সত্যি খাঁ ভাই, ভারি অন্যায় করেছ। বোঝ না ছেলের মায়া?

আজহার গুড়ুক ফুঁকিতেছিল। বলদের মতো নিস্তেজ দুই চক্ষু বুজিয়া সে জবাব দিল, হু।

চন্দ্র কোটাল আজ হারিয়া গিয়াছে। সে চুপ করিয়া রহিল।

খোঁজ করে দেখ না, চন্দর।

আমি লোক লাগাচ্ছি। আমার বায়না আছে শ্যামগজ্ঞে। দেখা যাক।

চন্দ্র কোটাল আজ বিশেষ ভণিতা না করিয়া উঠিয়া পড়িল।

আজহার গুড়ুক ফুঁকিয়া যায়। নিস্পৃহ হইয়া উঠিতেছে সে সব বিষয়ে।

বিঘে দুই জমির ভালো ফসল পাইয়াছিল। এই বছর সংসারে মাস তিন টানাটানি চলিতে পারে টাকা পয়সা। আজহার দরিয়াবিবির জন্য একটি তাঁতের শাদা শাড়ি কিনিয়া আনিল। কথাবার্তা নাই দম্পতির ভেতর। তক্তপোশে শাড়ি রাখিয়া দরিয়াবিবির উদ্দেশে সে কয়েকটি কথা বলিয়াছিল মাত্র।

কয়েকদিন পরে আরো ফসল আসিল ঘরে। আজহার দেখিল তার দেওয়া কাপড় পরিয়া রহিয়াছে আসেকজান। চাহিয়া রহিল সেইদিকে কিয়ৎক্ষণ। নিরীহ মানুষটির বুকেও শত প্রশ্নের কল্লোল উঠিয়াছে।

সেইদিন বৈকালে আজহার খাঁ সুতা-কনিক-সুর্মি হাতে ভিনগাঁয়ের পথ ধরিল।

পরদিন আমজাদ একবার পিতার প্রসঙ্গ তুলিয়াছিল। তাহাকে ধমকে স্তব্ধ করিয়া দিল দরিয়াবিবি।

.

২০.

আলু-পেঁয়াজের গস্ত করিতে ইয়াকুব গঞ্জে আসিয়াছিল। সেদিন ভালো বেপারী জোটে নাই। বেশি মাল কেনা হইল না। পাঁচ ক্রোশ বাড়ি ফিরিয়া আবার গঞ্জে আসা মহা হাঙ্গামা। আজহারের বাড়ি নিকটে, পুরাতন আত্মীয়তা ঝালাই করা হবে তবু। তাই ভাবিয়া সে বহু বছর পরে গরিব মামাতো ভাইয়ের অঙ্গনে পা বাড়াইয়াছিল।

দরিয়াবিবি ইয়াকুবকে সহজে চিনিতে পারে নাই। কয়েক বছরে তাহার চেহারা বেশ বদলাইয়া গিয়াছে।

আমাকে চিনতে পারলে না? আমি তোমার সেই দেবর– যে বড্ড বেশি বিরক্ত করত।

এসো, এসো।

দরিয়াবিবির সম্ভাষণে স্মৃতিশক্তি পুনরুজ্জীবন লাভ করে।

ভাবী, গঞ্জে এসে মুশকিলে পড়েছিলাম। মাল কেনা হয়নি।

তাই বুঝি গরিবের কুঁড়েঘরে হাতি

ইয়াকুব কথা লুফিয়া লইল : হাতি নয়, বরং চামচিকে বলুন, তা-ও সহ্য হবে।

বহুদিন আগে ইয়াকুব এই বাড়ি আসিয়াছিল। তবে বেশভূষার পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সে লম্বা-কোঁচা ধুতি পরিয়াছিল। নাকের সোজাসুজি টেরি, চুলগুলি ঢেউ খেলানো, পায়ে কারো পাম-শ্য, গায়ে ঝুলা-পাঞ্জাবি। পানের দাগ দাঁতের গোড়ায়। হাসির ভিতর বাঁকা মনের পরিচয় ফুটিয়া উঠে।

ইয়াকুব সম্পর্কে আজহারের ফুপাতো ভাই। জোত-জমি আছে শ-বিঘা। তার ধান, তাছাড়া মওসুমে আলু, পটল, পেঁয়াজ, পাট ইত্যাদি লইয়া সে ব্যবসা করে। গত কয়েক বছরে সে বেশ পয়সা রোজগার করিয়াছে, এ সংবাদ দরিয়াবিবি জানিত। তার আরো প্রমাণ, বর্তমানে তার সংসারে দুই স্ত্রী বর্তমানে। কয়েক মাস আগে আর একটি বিবাহের যোগাড় করিয়াছিল। প্রতিবেশী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মীয়দের জুলুমে। ইয়াকুব সে সদিচ্ছা পরিত্যাগে বাধ্য হইয়াছিল।

আজহার ভাই কোথা? একটি মাদুরের উপর বসিয়া ইয়াকুব জিজ্ঞাসা করিল।

দরিয়াবিবি আগে এক গ্লাস পানি দিয়াছিল। এখন ইয়াকুবের জন্য পান সাজিতেছিল। সে পান-ই সাজিতে লাগিল, কোনো জবাব দিল না।

ইয়াকুব আবার প্রশ্ন করিল, ভাই কোথা?

আমি কী জানি? আজ পনেরো দিন বেরিয়েছে। একটা খবর পর্যন্ত দেয়নি।

আচ্ছা মজার লোক। খালি দোকান-দোকান আর ব্যবসার ঝোঁক। ওসব ভালোমানুষ দিয়ে ব্যবসা হয় না।

ইয়াকুবের হাতে পানের খিলি দিয়া দরিয়াবিবি জবাব দিল, কে বোঝাবে বল। মাঝে মাঝে খেয়াল চাপে।

আজহার ভাই ওই রকম। কত জায়গায় কত রকমের ব্যবসা ফেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। সেটা ওর মহাদোষ।

অবেলা। দিনের আলো ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছিল। ইয়াকুব হাসির ঢেউ তুলিয়া পকেট হইতে একটি দশ টাকার নোট বাহির করিল।

ভাবী, কিছু মনে করবেন না। আমি রাত্রে খিচুড়ি খাব। ঘি আর ভালো চাল কিনে আনাও। মুরগি পাড়ায় পাওয়া যায়?

পাড়ায় পাওয়া যায় না, তবে আমার ঘরে আছে।

বহুত আচ্ছা।

দরিয়াবিবি নোট গ্রহণ করিতে রাজি হইল না। এমন মেহমান না আসাই ভালো। অপমানিত হওয়ার ক্লিষ্টতা তার বুকে গিয়া বিধিল। ইয়াকুব নাছোড়বান্দা। আমজাদ ও নঈমা পাশে দাঁড়াইয়া পিতার ফুপাতো ভাইয়ের কাণ্ড দেখিতেছিল।

ইয়াকুব দুইজনের হাতে দুটি পাঁচটাকার নোট খুঁজিয়া দিল।

খোকা-খুকি, তোমরা মিষ্টি কিনে খেয়ো।

দরিয়াবিবি আরো প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু ইয়াকুব কর্ণপাত করিল না।

এমন ব্যাপার করলে আমার বাড়ি এসো না, ভাই। আমরা গরিব।

অভিমান-ক্ষুণ্ণ ইয়াকুব কহিল : আমার ভাইপো ভাইঝিরা আমার পর? বেশ, তুমি যা খুশি বল। আজহার ভাই আসুক না।

আবার প্রাণ খুলিয়া হাসিতে লাগিল ইয়াকুব, সে যেন কত রসিকতা করিয়া ফেলিয়াছে।

দরিয়াবিবিকে অগত্যা উঠিতে হইল। খাতিরদারির সরঞ্জাম অল্প নয়।

আমজাদ নিজের নোটটি সযত্নে ভাঁজ করিয়া মার হাতে দিল। তার ফুরসৎ নাই। ঘিয়ের জন্য কৈবর্তপাড়ায় যাইতে হইবে। এমন মজুরি পাইলে সে কাজে অবহেলা করিতে রাজি নয়। একটি বোতল হাতে সে চলিয়া গেল। মুরগি জবাই করা হইল তখনই। দরিয়াবিবির একটি বড় মোরগ ছিল, সেটি এখনও বাড়ি ফেরে নাই। কত দেরি হইবে কে জানে। বাড়ির মুরগি নষ্ট করিলে আয়ের পথ বন্ধ হইয়া যায়। ডিম আর বাচ্চা রোগীর জন্য অনেকে ক্রয় করে।

রান্নাঘরে দরিয়াবিবি খুব ব্যস্ত। ছোট খুকিটা ভয়ানক কান্না জুড়িয়াছিল।

ইয়াকুব অভয় দিল, ভাবী, রান্না কর। আমি খুকিকে কোলে নিই।

খুকির কান্না থামিয়া গেল। তাকে কোলে লইয়াই ইয়াকুব রান্নাঘরে প্রবেশ করিল। দরিয়াবিবি বসন সংযত করিতে সময় পায় না।

অপ্রস্তুত হইয়া ইয়াকুব বাহিরে ফিরিয়া বলিল : ভাবী, তোমার খুকিটা বেশ।

হ্যাঁ, ভাই। বেশ সুন্দর হয়েছে মেয়ে।

ইয়াকুব আবার খুকিকে দোলাইতে দোলাইতে রান্নাঘরে প্রবেশ করিল।

হাসিয়া সে বলিল, তা হবে না, মা কেমন?

লজ্জায় রাঙা হইয়া ওঠে দরিয়াবিবির মুখ। গোস্তের হাঁড়িতে মশলা দিতেছিল সে। ধনে-ভাজা নাই। একটি তাওয়া চড়াইয়া দিল দরিয়াবিবি। ইয়াকুবের উপস্থিতি একটু অসোয়াস্তিকর।

দরিয়াবিবি ডাকিল, ইয়াকুব ভাই।

জি।

বাইরে যাও না। তুমি কী রান্না শিখবে?

কে শেখায়, ভাবি।

থাক, আর শিখে কাজ নেই। দুই বাঁদির ঘর– তার রান্না শিখতে হয় না।

হয় বৈকি।

তুমি খুকিকে বাতাসে নিয়ে যাও। যা ধোঁয়া এখানে।

দরিয়াবিবি নিজমনে রান্না করিতে লাগিল।

ইয়াকুবের কথা শেষ হয় না। সে আবার আসিল খুকিকে কোলে করিয়া।

ভাবী, আজহার ভাই পনেরো দিন গেছে, খবর দেয়নি?

না।

তুমি বলে তার সংসার কর। এমন লোক খবর দেবে না তা বলে।

আমরা তো তার কেউ নই।

দরিয়াবিবি চুলায় ফুঁক দিতেছিল বাঁশের চোঙ্গার সাহায্যে। ধোঁয়ায় ভরিয়া উঠিতেছিল সারা রান্নাশালা।

আহা। এমন সুন্দর খুকি, তার মায়া তাকে বেঁধে রাখতে পারে না।

বড় বিরক্তি বোধ করিতেছিল দরিয়াবিবি।

টাকার মায়া সবচেয়ে বড়। আবার কোথাও কিছু ফেঁদে বসেছে, লাখ টাকা কামাবে। সেবার চন্দ্র কোটাল ওর খোঁজ পেয়ে তবে ফিরিয়ে আনে।

দেখা যাক, আমিও চেষ্টা করব।

অত দয়ার কাজ নেই। নেই আসুক সে।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির চোখের দিকে চাহিল, জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। হয়তো ধোঁয়ায়, হয়তো সাংসারিক তাড়নার আঘাতে। ইয়াকুব তা উপলব্ধির চেষ্টা করিল।

দরিয়াবিবি কোনো সহানুভূতি চায় না। ইয়াকুব উঠিয়া গেলে সে সন্তুষ্ট হয়। আড়চোখে তার দিকে দরিয়াবিবি ধূমায়িত চুলায় আরো ধোঁয়া করিতে লাগিল, তারপর বলিল : ওঠে যাও না, ভাই। খুকিদের বড় চোখের দোষ হয় ধোঁয়া লেগে।

ইয়াকুব অনিচ্ছাসত্ত্বে ওঠিয়া গেল।

গেরস্থালির কাজ, মেহমানের জন্য বিশেষ রান্না। বহু দেরি হইয়া গেল। দুটি মাত্র ঘর। ইয়াকুবের শোয়ার জায়গা আর এক সমস্যা। আজ আমজাদকে দাওয়ায় শুইতে হইল।

গঞ্জের কাজ সারিয়া আরো তিনদিন ইয়াকুব এইখানে রহিয়া গেল। আজহারের তল্লাশি করিতেছে সে। কৃতজ্ঞতায় গলিয়া দরিয়াবিবি, খাতিরদারির ত্রুটি না হয়, সেদিক বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিল। দুহাতে খরচ করিতেছিল ইয়াকুব। সন্দেশের স্বাদ এই বাড়ির ছেলেরা মৌলুদ শরিফ বা পাড়ার কোনো বিশেষ উপলক্ষে চাখিতে পায়। ইয়াকুব নানা রকমের মিষ্টি কিনিয়া আনিয়াছিল। ময়দা, ঘি, পরটা, আরো চৰ্য– চুষ্যের ব্যবস্থা সে রীতিমতো করিতেছিল।

বাড়িতে ধুম লাগিয়াছে উৎসবের। আসেকজানকে পর্যন্ত ইয়াকুব বাহির হইতে দেয় নাই। সেও অতিথি এই বাড়ির।

দরিয়াবিবি চক্ষুলজ্জার জন্য কোনো কথা ইয়াকুবকে বলে নাই। নচেৎ সে-ও এই মহসিনীপনা খুব ভালো চোখে দেখিতেছিল না।

আরো দুইদিন থাকিয়া বিদায় লইল ইয়াকুব। আমজাদ অনেকদূর তার সঙ্গে আসিল।

২১-২৫. হাসুবৌ

হাসুবৌ আমজাদকে দুপুরবেলা ডাকিয়া গেল। বাড়ি যায় নাই সে। পাড়ার এক টেরে গাছের ছায়ায় একটি গুঁড়ির উপর দুই জনে বসিল।

কেন ডেকে আনলে, আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল।

লক্ষ্মী ছেলে, বস না– সন্দেশ কিনে দেব।

না, জলদি বল।

হাসুবৌ ইতস্তত করিতেছিল।

মুনি, আর আসবে না?

আমি কি জানি। মা কত কাঁদে। আব্বার সঙ্গে কথা বলে না।

হাসুবৌ বলিল, তোর আব্বা চলে গেল। মুনি ছেলেটা ভারি বদ। আমজাদ সায় দিল না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মুখচোরা ভাব কাটিয়া যাইতেছে।

বদ! তুমি ভারি ভালো?

হাসুবৌ আমজাদকে আদর করিতে লাগিল। না, সে বেশ ভালো। আমজাদ একটু দূরে সরিয়া গিয়া ব্যঙ্গ করিল, আমাকে আদর করতে হবে না। মুনিভাই নেই, তাই।

হাসুবৌ অবাক হইয়া যায়। এইটুকে ছেলে, তারও মনে ঈর্ষার ছোঁয়াচ লাগিয়াছে।

হাসুবৌ তার নিকটে সরিয়া আসিল। আবার তার চুলের উপর হাত বুলাইয়া আদর করিতে লাগিল। না, তুমি বেশ ভালো ছেলে।

আমজাদ জবাব দিল, না।

হাসুবৌ পুনরায় বলিল, যদি তুমি একটা কাজ কর, তোমাকে বেশি আদর করব।

কি, শুনি।

একবার মুনিরকে খবর দিতে পার?

আমি কি করে দেব?

হাসুবৌ আনমনা, গাছপালার ফাঁক অতিক্রান্ত দূরের আকাশের দিকে চাহিয়াছিল।

খোঁয়াব কাটাইয়া সে আবার বলিল, তুমি তাদের গাঁয়ে যাও না।

আমজাদ অক্ষমতা জানাইল।

খুব বেশি দূর নয়। আমি গরুর গাড়ির পয়সা দেব।

মা যে বকবে।

না, স্কুলে যাওয়ার নাম করে চলে যাবে।

হাসুবৌ আঁচলের গিট খুলিয়া একটি আধুলি বাহির করিল।

এই নাও, তোমার কাছে রেখে দাও, কতক্ষণ আর লাগবে।

মা যদি শোনে! শঙ্কিত দৃষ্টি আমজাদের চোখে।

না, কেউ বলবে না।

মহেশডাঙায় গাছপালা এত ঘন। এই জায়গাটি আরো নীরব। বাতাসের মৃদু নিনাদ ঝোপেঝাড়ে একদল বুনো পাখি কোথায় অদৃশ্য থাকিয়া হঠাৎ ডাকিয়া উঠিল।

তুমি যাবে?

হ্যাঁ। মাথা দোলাইল আমজাদ।

বেশ, লক্ষ্মী ছেলে।

হাসুবৌ সুকুমার মতি বালকের চোখের দিকে চাহিয়া আনমনা আলিঙ্গনে জড়াইল আমজাদকে। বেশ লক্ষ্মী ছেলে তুমি। মৃদুভাবে বন-ক্রোড়ের নীরবতা হঠাৎ চমক খাইতে থাকে।

বেশ লক্ষ্মী ছেলে তুমি।

আমাকে ছেড়ে দাও।

না।

মুনিভাইয়ের মতো আমার গালে কামড়ে দিও না যে, হাসুচাচি।

হাসুবৌ স্তব্ধ হইয়া আলিঙ্গন শ্লথ করিয়া দিল, দূরে সরিয়া গেল সে।

আমজাদ হাসিতে থাকে। হাসু চাচি, মুনিভাই একটা খ্যাপা। প্রজাপতি ধরে বলে, ওর রঙ তুলে গায়ের জামা রাঙাব।

নিরুত্তর হাসুবৌ।

আচ্ছা, চাচি, প্রজাপতির রঙে জামা রঙ করা যায়?

হ্যাঁ। আমি তোমার জামা রঙ করে দেব। তুমি একবার মুনির খবর এনে দাও। দেখ না, তোমার মা কত কাঁদে।

মার নামে আমজাদের করুণা হয়। দৃঢ়কণ্ঠে সে জবাব দিল, নিশ্চয় যাব। চার আনা গরুর গাড়ির ভাড়া। আমি চার আনার মুড়ি কিনব।

বেশ।

হাসুবৌ হাত বাড়াইল আমজাদের দিকে। সে তখন এক দৌড়ে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে।

.

২২.

দরিয়াবিবি ছোট মেয়েটির নাম রাখিয়াছিল শরীফন। ডাকনাম শরী। শৈরমীর স্মৃতি একবার তার মনে জাগিয়াছিল বৈকি। সেই দীন-জীবনের করুণ অবসান-মুহূর্ত! ডাক নামে শৈরমীর স্মৃতি বাঁচিয়া থাক। দেশের বিশাল মানচিত্রের এক কোণে নামহীন গ্রাম্য জননীর দীন প্রচেষ্টা-জাতি-ধর্ম যেখানে মানবতার উপর নৈরাজ্যের কোনো ফণা মেলিতে পারে না।

কিন্তু গ্রামে হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধিবার উপক্রম হইয়াছিল।

রোহিণী চৌধুরী ও হাতেম খাঁর মধ্যে গত কয়েক বছর একটি বিঘা-পঞ্চাশের জলাশয় লইয়া মন-কষাকষি চলিতেছিল। এতদিন জলাশয় চৌধুরীদের দখলে ছিল। দলিলে হাতেম খাঁর প্রাপ্য হইলেও সে ইহার কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। জলাশয় জমা। লইয়াছিল কয়েকজন মুসলমান জেলে। ইহাদের ভদ্রবংশীয় মুসলমানেরা আতরাফ বলে। বিলের আয় মন্দ নয়। হাতেম খাঁ কয়েকজন আফকে হাত করিয়া খাজনা বন্ধ করিয়া দেওয়ার প্ররোচনা দিল। তাহারা সেইমত খাজনা বন্ধ করিয়াছে। রোহিণী চৌধুরী। এই শলাপরামর্শ ভালোরূপে আঁচ করিয়াছিল। তিলি-বাগদী-ডোম শ্রেণীর কৃষক হিন্দু হাত করিয়া গ্রামে তিনি দাঙ্গার প্ররোচনা দিতে লাগিলেন।

হাতেম বকশ ইদানীং ঘোরতর মুসলমান সাজিয়াছেন। তাঁর পুত্রেরা অন্দরমহলেই শরাব পান করেন। তিনি কোনো কথা বলেন না। নিজেও নামাজ-রোজার ধার ধারেন না। বর্তমানে জুম্মার নামাজের সময় হাতেম বখ্শকে মসজিদে দেখা যায়। তার কালোশাদা দাড়ি শ্বেত-খোজাফে আরো শুভ্র রঙ ধারণ করিয়াছে। শাদা পিরহান হাঁটু পর্যন্ত ঝুলাইয়া একটি আসা (ছড়ি) হাতে গ্রামের অন্ধকারে দারোয়ান সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ান। বৈঠক, শলা-পরামর্শ আর যুক্তির বহর। নামাজের সময় না হইলেও তিনি এত্তেলা দেন। নামাজ কাজা করা শক্ত গোনাহ। হাদিস-কোরানের সম্প্রতি এজেন্সী লইয়াছেন তিনি। গ্রামের মখতবগুলির জীর্ণ-দশা। এক পয়সা তিনি খরচ করেন নাই। বর্তমানে তিনি একটি তামদারী করিয়া গ্রামের মুসলমানদের পোলাও-কোর্মা খাওয়াইলেন। কাফের হিন্দু জমিদার মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করিয়া ছাড়িবে, এই কথা পাকে প্রকারে প্রচারণার খোলসে বিতরণ করিতে লাগিলেন।

নিস্তেজ মহেশডাঙার জীবনে তবু চাঞ্চল্য ফিরিয়া আসিয়াছে। হিন্দুপাড়ায় রোহিণী চৌধুরীর কার্পণ্য নাই। প্রচারণা শক্তি তাঁরও কম নয়।

সাকেরকে হাতেম বখশ এতদিন আমল দিত না। তার লাঠির জোর দশ গা জানে। হাতেম বখশ দাওয়াত খাওয়াইয়া, টাকা-পয়সার ঘুষে তাহাকে ক্রয় করিয়া ফেলিল। সেও হালফিল ভয়ানক মুসলমান হইয়া উঠিয়াছে। ইমামের পেছনে ইমামের যা নিয়ত আমারও তাই বলিয়া ঈদ ও বকর ঈদে সে বছরে দুইবার মাত্র নামাজ পড়িত, সেও নামাজ শিখিতেছে। বাংলা নামাজ শিক্ষা গঞ্জ হইতে কিনিয়া আনিয়াছে ঠিকমতো আরবি উচ্চারণ হয় না, তা লইয়া হাসাহাসি করিতে গিয়া হাসুবৌ ভয়ানক তাড়া খাইল। নূতন কাক নাকি বিষ্ঠা খাওয়ার যম, এমন মন্তব্য করিয়াছিল নিরীহ বৌটি। সুপারী খাওয়া ছাড়ো, তোমার জিভ সরল হোক।

চন্দ্র কোটাল পালের গোদা সাজিয়াছে। শেখপাড়ার একজন মুসলমানের সঙ্গে জমির আল লইয়া গত বৎসর তার বচসা হইয়াছিল। রোহিণী চৌধুরীর মোসাহেবরা সেই উপলক্ষ যথারীতি কাজে লাগাইল। পাড়ায় পাড়ায় চন্দ্র কোটাল বলিয়া বেড়াইতেছে, মুসলমানেরা যদি টু-শব্দ করে, উড়িয়ে দাও তুড়ি দিয়ে।

জলাশয়ের পাশে একদিন দুই প্রজাদলে ছোটখাটো সংঘর্ষ বাধিয়া গেল। কয়েকজন জখম হইয়াছিল। আদালতে মামলা দায়ের হইল। আহতদের পয়সা নাই। চৌধুরী ও হাতেম বখশের যখন পয়সা আছে, তখন কিছুর অভাব হইবে না।

গ্রাম থমথম করিতেছে।

এমনই আসন্ন অপরাহ্নে আজহার খাঁ ফিরিয়া আসিল। কাঁধে ঝোলানো থলে, তার ভিতর মনিহারী দ্রব্য। লাটিম, আলতার ডিবা, ছোট মেয়েদের হাতের চুড়ি ইত্যাদি।

নঈমা ও আমজাদ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। প্রত্যেকে উপহার পাইয়াছে। আমজাদের জন্য খাতা-পেন্সিল, লাল রবার। লাটু-লেত্তি জোর করিয়া সে আদায় করিল। নঈমার সওগাত কানফুল, কয়েকটি রেশমী চুড়ি।

দরিয়াবিবির স্তব্ধতা ভাঙিয়াছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানের সেতু তেমনই যোগ-ছিন্ন। তিরিশটা টাকা আনিয়াছিল আজহার খাঁ। চার মাস সে বেকার বসিয়া থাকে নাই। তবে দোকান সে করিয়াছিল গত একমাস। দোকানদারী পোষাইল না।

দরিয়াবিবির হাতেও টাকা ছিল। ইয়াকুব দেদার খরচ করিয়া যায় এইখানে। গঞ্জের দিনে সে প্রায়ই আসে। আজহার ফিরিয়া না আসিলে, তার কোনো হাত-টান হইত না। আমজাদের স্কুলের বেতন পর্যন্ত ইয়াকুব মাস-মাস দিবে বলিয়া শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেয় নাই, তিন মাসের টাকা অগ্রিম দিয়া গিয়াছে।

গ্রামের কথা শুনিয়া আজহার থ হইয়া গেল। আমজাদ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করিতে লাগিল পিতার নিকট। সাকের চাচা নাকি বলিয়াছে, রোজগারের মরশুম এসেছে। সে দুই জমিদারের নিকট টাকা লুটিতেছে। রোহিণী চৌধুরীকে সে আশ্বাস দিয়াছে, দাঙ্গার দিন লাঠি ধরব না, কসম করছি– ব্যাস দেখব হাতেম বখশ কত লেঠেল আনে। হাতেম বখশকে সাকের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, পাঠানের বাচ্চা শেষ লাঠিখেলা দেখিয়ে যাব।

আজহার খাঁ বিলম্ব করিল না। খাওয়া দাওয়া শেষ করিয়া একদম মাঠের দিকে গেল। বাজে ঝঞ্ঝাটের চেয়ে মাঠের অবস্থা তার প্রথমে জানা দরকার। মাঠ, ফসল, তার কামধেনু। ওই বছর ফসল পাইয়াছিল বলিয়া সংসারেও শ্ৰী বজায় আছে। সকলে রবিফসলের চাষ দিতেছে। গরু-বাছুরের জুলুমের জন্যে কয়েকজন চাষি বাখারীর বেড়া প্রস্তুত করিতেছে। পটল দিবে সকলে এবার। তরমুজ গত বছর ভালো ফলে নাই। কুমড়া আর মূলোর চাষ চলিতেছে।

দেরি হইয়া গিয়াছে তার। তাহোক। নাবি ফসল হইবে। সেজন্য আজহার বেশি অনুতাপ করিল না।

চন্দ্র কোটালের সঙ্গে দেখা করা দরকার, চন্দর! মনে মনে হাসিয়া উঠিল আজহার। সন্ধ্যার পদক্ষেপে শূন্য মাঠের আইল বিচিত্র বর্ণে অদৃশ্য হইতেছে।

চন্দ্র দাওয়ায় বসিয়াছিল, আজহারকে দে অভিভাষণ জানাইল না, বসিতে পর্যন্ত বলিল না।

চন্দ্র।

সে নিরুত্তর।

এলোকেশী একটি পিড়া বাহির করিয়া আজহারকে বসিতে দিল। চন্দ্রমণি আসিল পিছু পিছু। আজহার ডাকিল, চন্দ্র!

কোনো জবাব দিতেছে না সে। এলোকেশীর দিকে ফিরিয়া আজহার বলিল, কি, আজ চন্দ্র নেশা করে বসে আছে?

এলোকেশী ভয়ানক রাগিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল : ও কী, বসে আছে যেন সং। লোক এল, কথা বল। গায়ে হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া তো ভাইয়ের সঙ্গে কী। যতসব অপসিষ্টি, হতচ্ছাড়া তোক।

এলোকেশী বলিতে লাগিল, জমিদারে জমিদারে ঝগড়া। বড়লোকে বড়লোকে দলাদলি তোদের কী? তোদের জমিদারি দিয়ে যাবে– ওই যে বসে আছে, রোহিণী বাবু জলাশয়টা ওকে দিয়ে যাবে। তাই নিয়ে দিন-রাত টইটই হিন্দুপাড়ায় ঘুরছে।

যার উদ্দেশে বাক্যবাণ বর্ষিত হইতেছিল, সে নির্জীব মূর্তির মতো বসিয়া রহিল। বোকা-চোখ মিটমিট করিয়া সে আজহারের দিকে চাহিয়া আবার চোখ ফিরাইয়া লইল।

কল্কে সাজিয়া আনিল চন্দ্রমণি। আজহার নীরবে টানিতে লাগিল। ধোঁয়া ছাড়ার অবকাশে সে আবার ডাকিল, চন্দ্রর।

আজহার স্তিমিত হইয়া আসিতেছে। বড় ক্ষুণকণ্ঠ তার : চন্দ্রর! আমি এতদিন দেশছাড়া। জানি চন্দর আছে। বড়লোকে বড়লোকে দলাদলি, আমরা গরিবেরা কেন ওর মধ্যে?

এলোকেশী আবার এক পশলা বর্ষণ করিয়া গেল। দাওয়ায় একটা মাদুরে আড় হইয়া চন্দ্র হুঁকা পান করিতে লাগিল। ভীষ্মের শরশয্যা আরম্ভ হইল। এলোকেশীর বাণ তা হইলে ব্যর্থ হয় নাই, কিন্তু ভীষ্মদেব শরে কাতর নন, কণ্ঠস্বরে কাতর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। একবার সে হাই তুলিল।

সন্ধ্যায় গ্রাম ছাইয়া গিয়াছে।

উঠানে নীরবতা। দূরে মাঠে বাছুর ডাকিতেছিল।

আজহার উঠিবার পূর্বে বলিল, যোগীনের মা, আবার কাল আসব, আজ ওর মেজাজ ঠিক নেই।

ভিটার উপর হইতে নামিয়া পড়িল আজহার অন্ধকার প্রলেপিত মাঠে; তার মনের মতোই শূন্য। সে বাতাসের পদ-সঞ্চালন-ধ্বনি শুনিতে লাগিল।

একবার উৎকর্ণ হইল আজহার। চন্দ্র কোটাল গাল পাড়িতেছে : না, আমার দুচোখ নেই আর মুসলমানদের দেখি– চোখ নেই।

এলোকেশী কণ্ঠস্বর তার সঙ্গে : তা থাকবে কেন? তাড়ি গিলে গিলে চোখের। মাথাও যে গিলেছে।

আবার ভর্ৎসনার শরজাল : চুপ, শালী।

এলোকেশীর জবাব : আমার বোনের সঙ্গে অত কেন। নিজের বোনকে দিয়ে এসো রোহিণীবাবুকে। এখনো তো বয়স রয়েছে- পীরিতি করবে।

আজহার হাঁটিতে লাগিল। এই একটিমাত্র আত্মভোলা মানুষকে চিনিয়াছিল, সে তার কত নিকট। এতটুকু দরদের জায়গা আর নাই তার পৃথিবীতে।

পেছনে ফিরিয়া আজহার অব্যক্ত বেদনায় কোটালের ভিটের দিকে আবার চাহিল। দুই চোখ তার জলে ভরিয়া উঠিল। দরিয়াবিবি কি মরিয়া গিয়াছে?

পরদিন বিকালে আজহার রবি-ফসলের জন্য জমি তৈয়ারি করিতেছিল। বহুদিন মূলা চাষ করে নাই সে। এইবার মূলা ও তরমুজ দেওয়া হইবে এইখানে। জমির কিনারায় শকরগঞ্জ আলু। আমজাদও সঙ্গে আসিয়াছিল। আজকাল আজহারকে সে খুব এড়াইয়া চলে। কিন্তু পিতার নিস্তব্ধ গাম্ভীর্যের সম্মুখে সে ভয়ানক ভীরু। মাঠে কাজ করা তার ভালো লাগে না। স্কুলের পড়য়া, সে কেন সাধারণ চাষির মতো এই বয়সে জমির খবরদারী করিবে?

পিতার আদেশ নীরবে পালন করে। কয়েকটি বাঁশ কাটিয়া আনিয়াছিল আজহার। আমজাদ তার বাখারী তুলিতেছিল। গরু-বাছুরের যা জুলুম, বেড়া না দিলে ফসল আদায় হইবে না।

আরেক কৃষক দূরে কর্মব্যস্ত। এক মাসে এইখানে সমীর চঞ্চল ধান-বন রঙ রেখায় মাঠগুলি সাজাইয়া রাখিয়াছিল। এখন শূন্য ক্ষেত! খামারে গাদা উঠিয়াছে। অবেলার শূন্যতার মধ্যেও তেমনি কুটির ছোঁয়া নাই। গ্রীষ্মকালে সমস্ত প্রান্তর যেন গ্রাস করিতে আসে।

আজহার সমগ্র মাঠের দিকে তাকায় না। আমজাদ নীরবে কাজ করিতেছিল।

শিস-ধ্বনি শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিল। নিশ্চয় চন্দ্র কাকা আসছে, কয়েক বিঘা দূরেই তার জমি। খালের ঢালু পাড় হইতে চন্দ্র কোটালের অবয়ব ক্রমশ দৃশ্যমান হইতে লাগিল।

আমজাদের কাজে মন নাই। এখনি চন্দ্র কাকা আসিয়া পড়িবে। তখন হয়ত তাকে কোনো কাজই করিতে হইবে না। তার মৃদু হাস্যে কপোল রাঙিয়া উঠিতেছিল।

চন্দ্র কোটাল সোজা এই জমির দিকে আসিল না। একটি কলাগাছের আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া আত্মপ্রকাশ করিল। কিন্তু স্বতঃস্ফুর্ত শিস বহু আগে নিভিয়া গিয়াছে।

আমজাদই প্রথম সম্ভাষণ জানাইল, ও চন্দর কাকা। চোখাচোখি দুইজন। হাস্য। সংবরণ করিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল কোটাল।

ও কাকা।

কাকা কোনো জবাব দিল না।

আজহার কোদাল চালাইয়া জমি পরিপাটি করিতেছিল। সে মুখ তুলিয়া আবার চক্ষু অবনত করিল।

আমজাদ হাসিমুখে অগ্রসর হইতে গেল। আজহার ধমক দিল, কাজ কর, আমু।

চন্দ্র কোটাল দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আজহার নীরব, নত মুখে কাজ করিতে লাগিল। দুজনে যেন কোনো পরিচয় নাই। আমজাদ মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতেছিল। গায়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধিবার উপক্রম হইয়াছে। তারই কী ফল এই।

চন্দ্র কোটাল জমির পাশ দিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল, ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া গেল গাছপালার আড়ালে, সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই।

আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল, চন্দর কাকা কথা বলল না যে?

না।

পিতার জবাবের ধাচ দেখিয়া আমজাদ আর অন্য প্রশ্ন করিল না।

শিসের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছিল। নিশ্চয় চন্দ্র কাকা। আমজাদ স্বয়ং বিষণ্ণ, মাঠের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল।

.

২৩.

চন্দ্রমণির সঙ্গে আজহারের পথে হঠাৎ দেখা হইয়াছিল। মাঝে মাঝে চন্দ্রমণি গ্রামের ভিতরে আসে। চন্দ্রই কেবল গ্রাম-ছাড়া, তার অন্যান্য আত্মীয়েরা এখনো পূর্ব পুরুষের ভিটায় বাস করিতেছে।

আজহার অন্যমনস্ক পথ হাঁটিতেছিল। ও দাদা শব্দে সে চমকিত হইয়া প্রশ্নকর্তীর মুখের দিকে তাকাইল। না, চন্দ্রমণিকে সহজে চেনা যায় না। তার খোলস-পরিবর্তন ঘটিয়াছে। বেশ পরিষ্কার কাপড় পরনে, পানের কষে ঠোঁট দুটি রাঙা। বিধবা বলিয়া চন্দ্রমণির যেন কোনো পরিচয় নাই। আজহার চন্দ্রমণিকে কোনো যুবতী পরস্ত্রী মনে। করিয়া হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করিতেছিল।

ও দাদা, আমি চন্দ্রমণি।

আজহার সেদিন বৈকালে চন্দ্রমণির এই রূপ দেখে নাই। অবাক হইয়া গেল সে। চন্দ্র কোটালের আয়-উপার্জন নিশ্চয় বাড়িয়াছে। রাজেন্দ্রের সঙ্গে ভাঁজ-নাচের দল গড়িয়া সে ভালোই করিয়াছে।

ও মণি, তুই! আমি তো ভাবছিলাম আর কেউ।

চন্দ্রমণি কিশোরীর মতো হাসিতে লাগিল। বছর আগে ম্যালেরিয়া জ্বরে কি ছিরি না হইয়াছিল তার।

তুমি আর যাও না যে দাদা!

আজহার লজ্জায় মুখ নিচু করিল।

কি রে যাই! চন্দর একদম কথা পর্যন্ত বলে না।

ও নিয়ে বৌদির সঙ্গে রোজ ঝগড়া বাধে।

চন্দ্রমণি এলোকেশীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল।

চন্দ্রকে সেদিন দেখলাম। ওর শরীরটা খারাপ।

রাখালেরা একপাল গরু তাড়াইয়া আসিতেছিল। চন্দ্রমণি ও আজহার পথের এক পাশ হইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিল।

শরীর খারাপ হবে না। কত তাড়ি গেলে। আর আজকাল দাদা কি যেন হয়ে গেছে।

কি হয়েছে?

সে মন-মেজাজ আর নেই। আমাকে দেখতে পারে না। কথায় কথায় গালিগালাজ।

খামাখা?

হ্যাঁ, দাদা।

আজহার চন্দ্র কোটালের এই অধঃপতনে কোনো দুঃখ প্রকাশ করিল না। গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আরো একপাল গরু আসিতেছে। আজহার সেইদিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল, চন্দ্র আসলে ভালোমানুষ। ও কেন এমন হয়ে গেল।

কি জানি।

রাজেন্দ্রের পাল্লায় পড়েছে?

চন্দ্রমণি হঠাৎ কোনো জবাব দিল না, চুপ করিয়া গেল।

আজহার প্রসঙ্গ-স্রোত বন্ধ করিল না : রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা তেমন ভালো নয়। ওর সঙ্গে বশি তাড়ি গেলে বোধহয়।

না দাদা!

চন্দ্রমণি অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল, কণ্ঠস্বরে তার প্রমাণ।

গাঁয়ের বড় লোকদের ঝগড়া থেকে দাদার মেজাজ আরো বিগড়ে গেছে।

সত্যি, মণি। আমিও রাগে সেদিন চন্দ্রের সঙ্গে কথা বললাম না। ও মাঠে এসেছিল। আমারও মেজাজের ঠিক নেই।

চন্দ্রমণি আবার হাসিতে লাগিল। আমার দুই দাদাই পাগল।

আজহারকে রসিকতা স্পর্শও করিল না।

পুরাতন খেই টানিতে ব্যস্ত সে : আজকার রোজগার কেমন করছে।

তা, মা লক্ষ্মীর কৃপায় বেশ। নাচের দলে দুপয়সা হয়।

আজহার হঠাৎ হিংসুকের মতো বেদনা অনুভব করে। বেশ আছে চন্দ্র কোটাল।

আমি যাই দাদা, আর একদিন আসবেন।

চন্দ্রমণি আর সেখানে দাঁড়াইল না।

.

২৪.

দুই জমিদারে মামলা বাধিয়াছে। গ্রামে আর কোনো গোলমাল নাই। সাময়িক উত্তেজনা নিভিয়া গিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল আজহারকে এড়াইয়া চলে। দুই পরিবারে পূর্বের মতো সদ্ভাব নাই। এলোকেশী কোনোদিন ঝগড়া-কলহ পছন্দ করে না। কোটালের সঙ্গে তার মতবিরোধ প্রায় দেখা যায়। আজহার বহুদিন চন্দ্রের বাড়ির ভিটার পাশে গিয়াও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সাহসে কুলাইয়া উঠিতে পারে নাই। সাকের আবার রোহিণী চৌধুরীর সঙ্গে খাতির পাতাইয়াছে। কিষাণেরা রবি-ফসল লইয়া ব্যস্ত। জমিদারের কোন্দলে কারো কোনো উৎসাহ নাই।

এলোকেশী একদিন স্বেচ্ছায় দরিয়াবিবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। আজহার বাড়ি ছিল না, আলু-বীজ ক্রয় করিতে ভিন-গাঁয়ে গিয়াছিল।

দরিয়াবিবি রৌদ্রে বসিয়া পান্তা খাইতেছিল তখন।

এলোকেশী হাসিয়া বলিল, ঠিক সময় এসেছি।

এসো দিদি।

শশব্যস্ত দরিয়াবিবি একটা পিঁড়া আগাইয়া দিল।

কিন্তু এলোকেশী আরো ব্যস্ততা দেখাইতেছিল।

তুমি খেয়ে নাও, আমি এখখনি উঠব।

এত তাড়া কেন? ও, আমার সঙ্গে ঝগড়া আছে নাকি?

এলোকেশী হাসিতে লাগিল।

কেন, বলো দিদি। সব জায়গায় খালি কোন্দল। গাঁয়ে, আমার ঘরে।

কোটালের সঙ্গে?

হ্যাঁ।

দরিয়াবিবি যথা দ্রুত আহার সম্পন্ন করিল। এলোকেশী তারপর দশটা টাকা বাহির করিয়া বলিল, দিদি, এই টাকা কটা রেখে দিও। জমা রাখলাম।

আমার কাছে কেন?

রেখে দাও।

পরে কানে কানে ফিসফিস করিয়া সে বলিল, রেখে গেলাম। ঘরে কী রাখার জো আছে?

আজকাল নাচে বেশ পয়সা আসছে।

তা আসছে। রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা বেশ কাজের। এখন বলে যাত্রার দল করব।

আরো সাংসারিক কথা হইতেছিল। উঠানে হঠাৎ আগন্তুকের ছায়া পড়িল। এলোকেশী লোকটিকে কখনো এখানে দেখে নাই। সে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিল।

দরিয়াবিবি উঠানের দিকে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল।

এসো ভাই। দরিয়াবিবির ঠোঁটে কৌতুক-মাখা হাসি। আগন্তুক ইয়াকুব। দরিয়াবিবি এলোকেশীর কানে কানে বলিল, আমার দেওর।

ইয়াকুব দাওয়ায় একটি মাদুরের উপর বসিয়া পড়িল। হাতে একটি পুঁটলি ছিল। সে খবরদারীর ভার দরিয়াবিবির উপর।

সব ভালো? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল। এলোকেশী লজ্জায় কলাবৌ সাজিয়া বসিয়া ছিল। ধমকের সুরে দরিয়াবিবি বলিল, ঘোমটা খোল না বৌ। ও আমাদের দেওর।

এলোকেশী ঘোমটা খুলিয়া ইয়াকুবকে ভালোরূপে দেখিয়া লইল।

শরীর ভালো নয়, ভাবী! আজ চার দিন জ্বর। তোমার এখানে এসে পড়লাম।

বাড়ি থেকে দুদিন-তাহলে জ্বর গায়েই বেরিয়েছ?

হ্যাঁ।

এলোকেশী বিদায় হইল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসাবাদে কসুর করে না। জ্বর গায়ে বেরিয়েছে?

হ্যাঁ।

এ কি? আর কেউ ছিল না ব্যবসার জন্য। এতক্ষণ ইয়াকুব কোনো অস্থিরতা দেখায় নাই। হঠাৎ সে চাপিয়া বলিল, ভাবী, একটু ঘুমোবার জায়গা করে দাও।

দিচ্ছি। কিন্তু আমার বোনেরা কেমন-ধারা মেয়ে! তোমার জ্বর, অথচ গঞ্জে আসতে দিল।

চুপ করিয়া রহিল ইয়াকুব। রৌদ্রের উত্তাপ তার শরীরে মনোরম লাগিতেছিল। সে বাহিরে মাথা বাড়াইয়া দিল। ছেলেদের পড়ার ঘরে দরিয়াবিবি শয্যা রচনা করিয়া ফিরিয়া আসিল। তার মুখের কামাই নাই : ভারি খারাপ কথা। তোমার জ্বর। অথচ ছেড়ে দিল। কেউ খোঁজ নেয়নি বোধহয়।

নিস্তব্ধতা যেন ইয়াকুবের জবাব। তবু সে মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, না। খোঁজ নিয়েছিল বৈকি। আমার মাথাটায় হাত দিয়ে দ্যাখো।

দরিয়াবিবি কপালের উষ্ণতা পরীক্ষা করিল। ভারি গরম। তোমার মুখ দেখে অসুখ হয়েছে বলে মনে হয় না। উঠে গিয়ে শুয়ে পড়।

দরিয়াবিবি আবার বলিল, বাড়ির লোকগুলো কী! এত জ্বর, ছেড়ে দিল?

ইয়াকুব জবাব দিল, আমি গঞ্জ থেকে আসছি।

আসলে ইয়াকুবের মতো মিথ্যাবাদী সংসারে অল্প। দাম্পত্য-জীবনে তার সুখ নাই। প্রায়ই দুই স্ত্রী কোন্দল বাধাইয়া থাকে। তা ছাড়া তার মতো পেশাদার লম্পটের কীর্তিকাহিনী স্ত্রীদের কানেও প্রবেশ করে বৈকি।

স্ত্রীর সহিত ঝগড়া করিয়া সে ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছিল। দরিয়াবিবি ইহার বিন্দু বিসর্গ জানে না। গ্রামের সঙ্গতিপন্ন মানুষদের মধ্যে ইয়াকুবের প্রতিপত্তি খুব বেশি। কারণ সে তাদের সমগোত্র। ধান-আলু-পেঁয়াজের কারবারে ইয়াকুব কত উপার্জন করে, তা দরিয়াবিবির অবগতির বাহিরে।

গত কয়েক মাস ইয়াকুব যাতায়াত করিতেছে। তার ভোলা মন স্বতঃই সমীহ আকর্ষণ করে। কোনো ত্রুটি রহিল না দরিয়াবিবির সেবায়। মাথায় উত্তাপ উঠিয়াছিল। ঠাণ্ডা পানি দিয়া তাহা সে ধুইয়া দিল। মোটা কাঁথা বিছাইয়া দিল তক্তপোশে। অবশ্য তা ইয়াকুবের টাকায় কেনা। গায়ে একটি তাঁতের চাদর দিল দরিয়াবিবি।

আসেকজান নিজে ঘর হইতে বাহির হয় না। সে আমজাদের নিকট খবর সংগ্রহ করিত। একটি পুরাতন শাল ছিল তার সিন্দুকে। কোনো মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি, আত্মীয়রা দান করিয়াছিল। দরিয়াবিবি চাঁদরের জায়গায় শালের আবরণ চড়াইল। বড় নির্ঝঞ্ঝাট গৃহসুখ অনুভব করিতেছিল ইয়াকুব, আমজাদ নিজে মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল। নঈমা পিঁচুটি ভরা চোখ লইয়া কৌতূহলে সবকিছু দেখিতেছিল।

আজও ইয়াকুব কুটুম্বপনার কোনো খুঁত রাখে নাই। ছেলেদের জন্য মিষ্টান্ন ও অন্যান্য খাবার আনিয়াছিল। পুঁটলি নয়, ছেলেদের রত্ন-ভাণ্ডার। ছোট খুকির কথা পর্যন্ত ইয়াকুব ভোলে নাই। তার জন্য পাতলা জামা আনিয়াছিল।

দরিয়াবিবি পথ্য তৈয়ার করিয়া আনিল। ইয়াকুব নিস্তেজ চোখে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। বড় আরাম তার।

দরিয়াবিবি বলিল, ডাক্তার ডাকাই, ভাই।

ঘোর আপত্তি জানাইল ইয়াকুব। না, এমনি সেরে যাবে। ওষুধ গেলা আমার ভালো লাগে না।

একটি নোট বাহির করিল সে, কথা ও সাগু শেষ করিয়া।

দরিয়াবিবি কোনো আপত্তি জানাইল না। কারণ এই ক্ষেত্রে অনিচ্ছা বৃথা। ইয়াকুবের হাত হইতে নিস্তার নাই। হাজার কথা বলিতে শুরু করিবে।

দুপুরে ইয়াকুব জ্বরের ঘরে উ-উ শব্দ করিতেছিল। ঘরে আর কেউ ছিল না। হঠাৎ খুট শব্দে সে জাগিয়া উঠিল। দরিয়াবিবি তার সম্মুখে।

খাঁ-পত্নী জিজ্ঞাসা করিল, শরীর ভালো?

না, ভাবী।

তারপর ইয়াকুব কাতরোক্তি আরো বাড়াইয়া কহিল, মাথা ভেঙে পড়েছে। একটু টিপে দিলে ভালো লাগে।

দরিয়াবিবি কয়েকবার আমজাদকে ডাকিল, কোনো জবাব নাই। ইয়াকুব ইঙ্গিত করিল বিছানার উপর বসিতে।

আচ্ছা, আমি টিপে দিচ্ছি। ছেলেগুলো বজ্জাত। বলিয়া দরিয়াবিবি ইয়াকুবের মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল।

ইয়াকুব নিরুত্তর। সে নীরবে একবার চক্ষুর পাতা খুলিতেছিল, পর মুহূর্তে বন্ধ করিতেছিল।

ভাবী, তোমার কাছে বেশি ঋণ কচ্ছি।

ধার। আমি বরং–

ইয়াকুব হঠাৎ হাত তুলিয়া তার মুখে চাপা দিতে গেল। দরিয়াবিবি মুখ তার নাগালের বাহিরে রাখিয়া বলিল, ঋণ আমরাই করছি।

ইয়াকুব আবার একটি নোট বাহির করিল। তবে আর একটু ঋণ বাড়াও ভাবী। না হলে আমি মরে যাব। আমার শেষ জ্বর।

এমন মানুষ। জ্বরের বিকার নয় তো? দরিয়াবিবি নোটটা নাড়াচাড়া করিয়া ইয়াকুবের ব্যাগেই রাখিয়া দিল। নিঃশব্দে লক্ষ্য করিল ইয়াকুব, আর কোনো কথা বলিল না।

ডাক্তার ডাকি। কি বলো ভাই?

না। যদি ডাক্তার ডাকো, আমি জ্বর গায়েই বাড়ি ফিরব।

দরিয়াবিবি নিরুপায়। বড় একরোখা ইয়াকুব, সামান্য কয়েক মাসের পরিচয়ে সে উপলব্ধি করিয়াছিল। চুপ করিয়া গেল সে।

ঘুমাইয়া পড়িল ইয়াকুব কয়েক মিনিটে। দরিয়াবিবি মাথা টেপা বন্ধ করিল। আমজাদের গলার আওয়াজ পাইয়া সে বিছানার পাশ ছাড়িয়া বাহিরে আসিল। বেশি বেলা নাই। সংসারের হাজার কাজ অপেক্ষা করিতেছে।

সন্ধ্যার একটু পূর্বে বস্তা মাথায় ফিরিয়া আসিল আজহার। পটল বীজ পায় নাই। পটল আলের দাম বেশি। তাও প্রায় শুষ্ক।

ইয়াকুব এখানে জ্বরে ভুগিতেছে। সে-সংবাদ তার কানে গেল। তার সঙ্গে সাক্ষাতের তেমন কোনো উৎসাহ দেখাইল না আজহার।

হাত-মুখ ধুইয়া, কিছু আহারের পর সে দাওয়ায় তামাক নিঃশেষ করিতে লাগিল।

দরিয়াবিবি বলিল, একবার দেখে এসো। তোমার কী একটু মেনসত্বে (মনুষ্যত্ব) নেই। কি মনে করবে।

আজহার এই ধমকে সন্তুষ্ট হয়। সংসারের কাজে দরিয়াবিবি আবার পরামর্শ করিতেছে তার সহিত। সহযোগিতার দরদই তো সে প্রত্যাশা করে। ইয়াকুবের সহিত অনেক কথা হইল। সংসার, চাষ-বাস, ছেলেদের লেখাপড়া, নঈমার চোখের অসুখ ইত্যাদি। পটল-আলের কথাও বলিল আজহার।

ইয়াকুব পকেট হইতে কুড়িটি টাকা আজহারের হাতে দিয়া বলিল, বড় ভাই, আপনি কত জায়গায় ঘুরছেন। আমার সঙ্গে ব্যবসা করুন। কোনো কিছু আটকাবে না।

আজহার নোট লইয়া বসিয়া রহিল। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সে গ্রহণ করিল এই দান।

জবাব দিন।

হ্যাঁ। কত কষ্ট করছি। তোমার সঙ্গে ব্যবসা করব, সে তো ভালো কথা।

আজহার আরো গল্প ছাড়িল।

কয়েক প্রহর রাত্রি অতিবাহিত। দরিয়াবিবির ধমকে আজহার গল্প সমাপ্ত করিল।

ভাত পরিবেশনের সময় দরিয়াবিবি হাসিয়া বলিল, ওর সঙ্গে দেখা করছিলেন না, এখন যে আঠার মতো জড়িয়ে গিয়েছ?

.

২৫.

বৈশাখের এক ঝঞ্ঝা-উতোল রাত্রে আসেকজান মরিয়া গেল। কেহ খোঁজও রাখে নাই। আমজাদ অন্য ঘরে ঘুমাইত আজকাল। পরদিন অনেক বেলা হইয়া গেলে, আসেকজান উঠিল না। খোঁজ লইতে গেল দরিয়াবিবি। বৃদ্ধার ঠাণ্ডা মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে।

অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করিল দরিয়াবিবি। আমজাদ, নঈমা, আজহার বোকার মতো চাহিয়া রহিল অনেকক্ষণ। বুড়ির আত্মীয়-স্বজন কেহই ছিল না। প্রতিবেশীদের সহায়তায় দাফন-কাফন শেষ করিল আজহার।

আসেকজানের একটি পেঁটরা খোলা হইল। দশ-বারোটি খুচরো টাকা ও কয়েকখানি কাপড় পাওয়া গেল। বিশেষ লাভ হয় নাই দরিয়াবিবির। কাফনেই দশ টাকা গিয়াছে।

এই অসহায় বৃদ্ধার কথা বারবার মনে পড়ে দরিয়াবিবির। তার জীবনের পরিসমাপ্তি কিরূপে ঘটিবে, সে কি জানে? হয়তো এমন অপমৃত্যু তারও কপালে লেখা আছে। কতদিন হইল শৈরমী মরিয়া গিয়াছে। কত দিন!

এক সপ্তাহে আসেকজানের নাম মিটিয়া গেল এই বাড়ি হইতে। চতুর্থ দিনে পাড়ার দুইজন ভিক্ষুককে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া দরিয়াবিবি চালাম সমাপ্ত করিল।

আমজাদ কিন্তু ভয়ে একা ঘুমাইতে পারিল না কয়েকদিন। মোনাদির নাই কাছে। নিজের ছোট কুঠরীতে শুইতে তার বড় ভয় লাগে।

দরিয়াবিবি ধমক দিয়া বলিল, ভয় কি, ব্যাটা। তোমার দাদি আম্মা তার ভেস্ত নসিব করেছে। ভয় কী?

আমজাদের তবু ভয় কাটিল না।

কয়েকদিন দরিয়াবিবি শরীফনকে লইয়া আমজাদের ঘরে আস্তানা পাতিল।

স্কুলে পণ্ডিতের মুখে আমজাদ ভূতের কাহিনী শুনিয়াছিল। মন হইতে তা সহজে মুছিয়া যায় না।

মাকে সে জিজ্ঞাসা করিল, মা, মরে গেলে ভূত হয় মানুষ?

যারা খারাপ লোক, তারা ভূত হয়।

আসেক দাদি কি হয়েছে?

ছিঃ ভয় কি, আমু। সে ভালো মানুষ। আল্লা তার ভেস্ত নসিব করেছে।

ভালো মানুষ আবার পরের বাড়ি খায়!

গরিব ছিল যে। গরিব।

দরিয়াবিবি ঈষৎ বিচলিত হয় মনে মনে। জবাব যেন ছেলের মন মতো হয় নাই।

আমার ভয় করে। দাদি রাত্রে পাশে ঘুমায়।

থুথু-কুঁড়ি ছড়াইল দরিয়াবিবি পুত্রের গায়ে।

তার পাশে শুয়ে এত বড় হলে কিনা, তাই মনে হয়।

আমার ভয় করে কেন, মা?

বেটাছেলে। তোর বুকের পাটা নেই।

ইস।

আমজাদ তবু রাত্রে দরিয়াবিবির কোল ঘেঁষিয়া ঘুমাইত। বাহিরে কাঁঠাল গাছের বনে বনে দমকা বাতাস লাগিলে সে মাকে জড়াইয়া ধরিত। গোরস্তান হইতে আসেকজান দাদি লাঠি হাতে কারো চল্লিশা খাইতে যাইতেছে।

ব্যাপারটা আজহারের কানে গেলে সে একদিন আমজাদকে মখতবের মৌলবী সাহেবের কাছে লইয়া গেল। তিনি ফুক দিয়া দিলেন। সঙ্গে এক গ্লাস পানি-পড়া। গোটা একটি টাকা বাহির হইয়া গেল দুই ফুকের ঠেলায়।

মৌলবী সাহেব জুম্মাবারে আর একবার আমজাদকে আসিতে বলিল, আজহার তা শুনিল মাত্র। আবার এক টাকার বন্দোবস্ত আর কি। আজহার মনে মনে যোগ করিল।

আমজাদের ভয় সহজে কাটিল না। আজকাল সন্ধ্যায় একা একা সে দাওয়ায় বসিয়া থাকিতে পারে না। কিন্তু মার কাছে সে সব চাপিয়া গেল। বাগাড়ম্বরে তার বুকের পাটা কয়েক মাইল চওড়া।

আমজাদের ভয় গেল অন্য এক ঘটনার ধাক্কায়।

আজহারের হাতে ইয়াকুবের দেওয়া টাকা ছাড়া আরো কিছু টাকা জমিয়াছে। আসেকজানের একটি ছোট বাক্স তার কাছে গচ্ছিত ছিল। দরিয়াবিবি তাহা জানিত। ভিতরে আরো গোটা কুড়ি টাকা ছিল। এই ব্যাপার ঘুণাক্ষরে দরিয়াবিবি কানে ইমামের কথা ঠিক নয়।

লা-মজহাবীরা খুব সন্তুষ্ট। সভায় তাদের দলে আনন্দের গুঞ্জন শুরু হয়। কিন্তু হানাফিরা মৌলানার উপর চটিয়া উঠিতেছিল।

প্রথম মৌলানা আবার বলিলেন, চুপ করুন। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি চুপ করার বান্দা নন।

কোন দলিলে এমন আজগুবি কথা পেয়েছো? তিরমিজী শরীফে আছে, হযরত আলীর দাড়ি নাভি পর্যন্ত নয়।

ঝুট তোমার তিরমিজী।

হানাফিরা তাহাদের মৌলানার সমর্থক। তাহারা আর চুপ থাকে না। সভায় ফিসফাস শব্দ শুরু হয়।

চুপ করুন।

না, আমি চুপ করব না।

বেয়াদব।

কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি চলিল। তুমুল বাক-যুদ্ধ।

প্রথম মৌলানার ধৈর্য আর টেকে না। তিনি চিৎকার করিয়া বলিলেন, তুমি বেয়াদবের বাচ্চা।

তবে রে হারামজাদা।

দ্বিতীয় মৌলানা অতর্কিত উঠিয়া প্রথম মৌলানা শাহ ফখরুদ্দিনের গালে এক চড় মারিলেন।

দ্বিতীয় মৌলানা হেফজুল্লা সাহেব প্রাথমিক তাল সামলাইয়া ধরিলেন ফখরুদ্দিনের দাড়ি। তারপর ঠাস এক চড়।

শেষে দুইজনে পরস্পরের দাড়ি ধরিয়া চুলাচুলি শুরু করিল। সভায় হট্টগোল। দুই দল সমর্থক ছুটিয়া আসিল। মৌলানাদের দ্বন্দ্ব মুরীদানদের মধ্যেও হাতাহাতির সুযোগ খুলিয়া দিল।

মারো শালা- লা-মজহাবীদের-মারো শালা- হানাফিদের– ওয়াজের মজলিশে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভ্রাতারা হঠাৎ খিস্তী বয়ান শুরু করিলেন।

হাতেম বখশ এতক্ষণে সক্রিয়। প্রথম মৌলানার সমর্থনে তিনি চিৎকার করিতে লাগিলেন। হাতাহাতি থামিল না দেখিয়া তিনি অন্ধকারে গা আড়াল দিলেন। ইজ্জত বাঁচাইলেন চতুরজনের মতো।

আজহার খাঁও এই ওয়াজের মজলিশে আসিয়াছিল। সে নিরীহ ব্যক্তি কিন্তু এই ব্যাপারে সে পাক্কা মুসলমান। এমন বর্বর হইয়া উঠিতে পারে সে হাত আজহার কম চালায় নাই। মজলিশের বাতি নিভিয়া গিয়াছিল। মনের সুখে সে হাতের সাধ মিটাইল। গলা-ফাটা চিৎকার করে সে : শালা হানাফিদের খতম করে দাও। কে বলিবে, আজহার নিতান্ত বেচারা মানুষ। পাকা মুসলমান। ধর্মের অপমান সে সহ্য করিতে পারে না।

দাড়ি লইয়া বিরোধ বাধিয়াছিল। সভা শেষে অনেকে আস্ত দাড়ি লইয়া ঘরে ফিরিতে পারিল না, কয়েকজন জখম হইল। শুধু তাই নয়, দুই গ্রাম দুই শিবিরে পরিণত হইল।

পরদিন লা-মজহাবী পাড়ার লোক হানাফিদের সুযোগ পাইয়া মার দিল। হানাফিরা তার পাল্টা প্রতিশোধ লইল। মৌলানাগণ সেনাপতিরূপে এই গ্রাম-যুদ্ধ পরিচালনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ফিল্ড-মার্শালদের ফিল্ডে দেখা গেল না। তাহারা সদর অন্দরে অবস্থান করিয়া কচি মুরগির আস্বাদ লইতেছিলেন, সঙ্গে পোলাও পরোটা বাদ পড়ে নাই।

এক সপ্তাহ গ্রামে এই অবস্থা। আরো কতদিন কাটিত, কে জানে। সাকের এই সময় সকলের একটি উপকার করিল। প্রথম দিন সেও হুজুগে মাতিয়াছিল। পরে মৌলানাদের কীর্তি সে বুঝিতে পারে। ইহারাই এত গোলমালের খুঁটি। ভয়ানক চটিয়া গেল সে।

লাঠি হাতে সে প্রথমে হানাফি পাড়ায় উপস্থিত হইল। সে পাড়ায় প্রবেশের আগেই চিৎকার করিতে লাগিল : আমি মারামারি করতে আসিনি, যদিও আমার হাতে লাঠি আছে।

অন্যান্য প্রতিবেশী মজা দেখিতে দাঁড়াইল। এই গোয়র লোকের সঙ্গে লাঠিবাজি করিতে কেহ সক্ষম হইবে না।

দহলিজ হইতে সে এক মৌলানাকে কান ধরিয়া টানিয়া আনিল। তারপর দুই চড় ও এক লাঠির ঘা দিয়া বলিল : নিকালো হিয়াসে কাইজ্যা বাধাতে এসেছো, শালারা। চশমখোর শালারা নিজের রাগ সামলাতে পারে না। কুকুর-কুকুর। আবার মুরীদ করতে এসেছে।

মৌলানার মুরীদগণ স্তব্ধ। হুজুরের দুর্দশার মুখে কেহ ছুটিয়া আসিল না।

সাকের নিজে ওহাবী। নিজের পাড়ায় এক মৌলানাকে ভয়ানক চাবুক বাজির পর হাঁকাইয়া দিল।

গ্রাম হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। প্রথমে কয়েকজন সাকেরের উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিল, পরে দুই হাত তুলিয়া শোকর। মেয়েমহলের অনেকে সাকেরের জন্য আল্লাহর দরগায় দোয়া প্রার্থনা করিল। ছেলেপুলে লইয়া এতদিন শান্তি ছিল না। কখন কে জখম হয়। অনেক মেয়ের বুকের ধুকধুকানি ভাব এতদিনে গেল।

গ্রাম দুই দিনে স্বাভাবিক।

আজহার প্রকৃতিস্থ হইয়াছে পুনরায়। এই কয়দিন দরিয়াবিবি পর্যন্ত তার চেহারা দেখিয়া মনে মনে ভয় পাইত। ধর্মের নামে সে যেন জানোয়ার বনিয়া যায়, অথচ আর কখনো তার এই তেজ চোখে পড়ে না।

সুযোগ বুঝিয়া দরিয়াবিবি একদিন ব্যক্ত করিয়া বলিল, যখন কেউ বিনা দোষে তোমার উপর জুলুম করে, তখন তো ভিজে বিড়াল সেজে বসে রইলে।

হুঁ।

দরিয়াবিবি ব্যঙ্গ-শব্দ করিল, হুঁ।

তারপর সে সাকেরের পৌরুষের প্রশংসা আরম্ভ মাত্র আজহার নিঃশব্দে মাঠের দিকে চলিয়া গেল।

আমজাদ বহু পূর্বে মাঠে গিয়াছে। স্কুলের ছুটি। তার লজ্জা লাগে মাঠের কাজে। কিন্তু বাড়ির দুর্দশা দেখিয়া পিতাকে সাহায্য করিতে বেশ আনন্দ পায়। যদিও পিতার উপর তার শ্রদ্ধা দিনদিন কমিয়া যাইতেছে। তার আব্বা যেন কি রকম!

জমির এক কোণে লঙ্কাচারা রোপণের জন্য মাটি তৈয়ারি হইতেছিল। লাঙল হইয়া গিয়াছে। এখন শুধু পরিপাটি বাকি।

বেড়া দিতে হইবে মজবুত করিয়া। গরু ছাগলের উৎপাত লঙ্কা গাছের উপর বেশি। সারি বন্দী চারা পুঁতিবার জন্য আইল সোজা করিতে হইবে।

আমজাদ এইসব কাজ খুব ভালোবাসে। ছোট কোদাল লইয়া সে সোজা রেখাকার মাটি সাজাইতেছিল। এই সময় পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল, পানি-বওয়ার মেহনত দরকার হইল না।

হঠাৎ আজহারকে দেখিয়া সে উফুল্ল হয় না।

অমনি বলে, আব্বা।

আব্বা, তুমি অনেক কাজ এগিয়ে রেখেছে, দেখছি।

হ্যাঁ আব্বা।

বেশ।

এবার লঙ্কা হলে হাটে নিয়ে যাব না। আমাদের সারাবছর কিনতে হয়।

কিন্তু তখন হাত টান থাকলে তুমি কি তা মনে রাখবে?

লজ্জিত হয় আজহার মন্তব্যে। সত্যি তার খেয়াল থাকে না তখন। অথচ ক্ষেতের ফসল বেচিয়া দিয়া সারা বছর মুদির দোকানের দিকে চাহিয়া থাকিতে হয়।

না, এবার আর বেচব না আল্লা চায়-তো।

থামিয়া গেল আজহার। হাতে টাকা আছে, তবু খটকা তার মনে। আল্লার করুণা মুছিয়া যাইতে কতক্ষণ।

দিনের আলো নিভিয়া আসিতেছে। মাঠের রূপ বদলাইয়া যায়। পিতা-পুত্রে রবি ফসলের টুকিটাকি কাজ করে।

হঠাৎ গানের আওয়াজ শোনা গেল।

পিতা-পুত্র উৎকর্ণ। গানের কলি দোহরাইয়া গায়ক গাহিতেছে :

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা,
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।
যে চেয়েছে তোমার দিকে
তারই চোখে লঙ্কা-বাটা।
ও ছড়িয়ে দিলে, ছড়িয়ে দিলে
মারলে তারে তিলে তিলে
ও আমার বৃথা ফসল কাটা
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।

কণ্ঠস্বর পরিচিত।

আজহার আবার নিজ মনে কাজ করিতে লাগিল।

চন্দ্ৰকাকা, না আব্বা?

আজহার কোনো জবাব দিল না। আমজাদ মাঠের দিকে চাহিয়াছিল। গায়কের অবয়ব তখনো দৃষ্টির বাহিরে।

আনমনা আমজাদ। আজহার লক্ষ করে। কাজের গাফিলতি সে পছন্দ করে না।

কাজ কর, আমু।

চন্দ্ৰকাকা, না?

হুঁ, তা কি করতে চাও?

পিতার কণ্ঠস্বর উষ্ণ। আমজাদ মাথা হেঁট করিয়া ক্ষেতের লঙ্কাচারা বসায়। আড়চোখে মাঠের দিকে চাহিয়া থাকে।

যে চেয়েছে তোমার দিকে
তারই চোখে লঙ্কা বাটা।

গান পুনরায় শুরু হইয়াছে।

আমজাদ হাসিয়া বলে, আব্বা, চন্দ্র কাকা পাগল। ভগবান মানে আল্লা না, আব্বা?

কাজ কর।

ধমক দিয়া উঠিল আজহার।

কলাবনের আড়াল হইতে মেঠোপথে চন্দ্র বাহির হইল। কণ্ঠস্বর নিকটবর্তী হইতেছে। আমজাদ মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু আনন্দ আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। চন্দ্ৰকাকা আর এদিকে আসিবে না। হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া। নিকুচি করি ঝগড়ার, কি-সব বাজে কথা। আমজাদ ভিতরে তাতিয়া উঠে।

আজহার আবার আনমনা আমজাদকে কাজে মনোযোগ দিতে বলিল।

গায়ক এইদিকে আসিতেছে। আড়চোখে আমজাদ দেখিল, আজ চন্দ্র কোটাল জমির বেড়ার ওপারে থমকিয়া দাঁড়ায় নাই। সে তাহাদের দিকেই ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। আরো নিকটে, ঠিক তাহাদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল চন্দ্র কোটাল।

আজহার চুপচাপ কাজ করিয়া যাইতেছে। কোটালের উপস্থিতি যেন সে অবহেলা করিতে চায়। পিতার ভয়ে আমজাদ তাহার দিকে তাকায় না।

তিনজনে নিস্তব্ধ। এমন অসোয়াস্তিকর মুহূর্ত কারো জীবনে যেন আসে নাই। কোটাল হঠাৎ বোকার মতো হাসিয়া উঠিল। আমজাদ তার দিকে একবার আড়চোখে চাহিয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিল। হাসি পায় তার। শুধু পিতার ভয়ে চুপ করিয়া আছে।

–আজহার ভাই, ও খাঁ সাহেব। বলিয়া চন্দ্র থামিয়া গেল। অপরপক্ষ তখনো নীরব।

এই চাচা, তোমার বাবা এবার বোবা হয়ে গেছে নাকি?

বোবা বাবা। ও-কার আর আ-কার।

চন্দ্র আমজাদকে লক্ষ্য করিয়া বলিল।

আজহার বিন্দুমাত্র নড়িল না। তার হাতের কাজ অবশ্য স্তব্ধ। তারপর খিলখিল হাসিয়া চন্দ্র হঠাৎ দণ্ডায়মান আজহারের ঠিক পায়ের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া তার চোখের দিকে তাকাইল। চোখে চোখ পড়ে। কোটালের হাসি সংক্রামক। আজহার না। হাসিয়া পারে না।

চন্দ্র তখন তুড়ি দিয়া এক লাফে উঠিয়া আমজাদকে কাঁধে তুলিয়া লইল। আমজাদ আজকাল বড় হইয়াছে। কাঁধে উঠিতে তার লজ্জা লাগে। কিন্তু বারণের অবসর কোথায়। এতক্ষণে সে শূন্যে।

চন্দ্র নাচিতে নাচিতে বলে, ধৰ্ম্ম-উম্ম আমি মানি নে। যতসব বেজন্মাদের কীর্তি। গান ধরিল সে,

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা,
ও তোমার মাথায় ঝাটা।

তারপরই সে বলে, আজহার ভাই, আমি ভাবতাম আমাদের সাত রকম জাত আছে। তোমাদেরও তাই। ঠিক করেছে সাকের। আমাদের শালা পুরুত ঠাউর (ঠাকুর) আর তোমাদের ওই–।

কথা শেষ করিতে পারে না সে। খিলখিল হাসির শব্দে বেলাশেষের মাঠ ভরিয়া ওঠে।

সুইৎ শব্দে আমজাদকে কাঁধ হইতে নামাইয়া সে বলিল, তামাক দাও।

অন্য কারো কথা বলার অবসর নাই।

চন্দ্র আবার কহিল, আমাদের পুরুত এলে আমিও দাড়ি ছিঁড়ে লেঙ্গা। ধর্মের নিকুচি। যতসব চালবাজি শালাদের ঝগড়া লাগানোর।

আজহার এতক্ষণে মুখ খুলিল, এই পাগল চন্দর।

ঝাঁকড়া-চুল মাথা নাড়িয়া চন্দ্র পদবী গ্রহণ করিল। তারপর আমজাদের দিকে চাহিয়া সে বলিল, চাচা, তোমার বাবার দাড়ি ছিঁড়ে লেঙ্গা।

তিনজনে দম ভরিয়া হাসিতে থাকে এইবার।

আজহার জিজ্ঞাসা করিল, চন্দ্র, তোমার হয়েছিল কি এতদিন?

ভূতে ধরেছিল।

একদম মামদো ভূত।

হ্যাঁ, খাঁ ভাই। আমার চোখ খুলে গেছে কাল।

কাল!

হ্যাঁ।

হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায় চন্দ্র। তার মুখাবয়বে থরথর কম্পন দেখা যায়। অশ্রুসজল চোখ।

আজহার ভাবে, কি হইল চন্দরের। এ আবার কোন রকম পাগলামি! এতক্ষণ তো সে হাসিতেছিল।

চন্দ্র পাথর। তার চোখ দিয়া অশ্রুর ফোঁটা ঝরিতেছে।

কি হলো, চন্দর?

আজহার নিকটে আসিয়া সমব্যথা মাখা দুই হাত বাড়াইল।

কি হয়েছে?

শালতরু যেন শিলীভূত।

কি হয়েছে?

শিবু, ইসমাইল সদরের হাসপাতালে মারা গেছে।

মারা গেছে।

আজহারের মুখে আর কোনো কথা নাই। সেও বজ্রাহত, স্তব্ধ হইয়া গেল।

জলকর লইয়া দাঙ্গার সময় শিবু ও ইসমাইল বেশ জখম হইয়াছিল। সদর হাসপাতালে ছিল তারা এতদিন। দুইজনে খুব পরিচিত বন্ধু।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসিয়া থাকে তিনজন। সন্ধ্যার কালিমালেপন শুরু হইয়াছে দিকদিগন্তরে।

ফোঁপাইয়া উঠিল চন্দ্র, ওদের বাড়িতে কি কান্না। শিবুর বৌ ছেলেপুলে নিয়ে হয়ত খেয়ে মরবে। রোহিণী আর হাতেম শালার কি আসে যায়। আমার চোখ খুলে গেছে কাল সদরের হাসপাতালে।

ফোঁপাইতে থাকে চন্দ্র, কথা শেষ হয় না।

আজহার নির্বাক। চন্দ্র আর কোনো কথা বলিল না, নির্জীবের মতো বসিয়া রহিল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে আর কাহারো মুখ দেখা যায় না। নিস্তব্ধতা প্রথম ভাঙিয়া আজহার বলিল, চল চন্দর, বাড়ি চল।

চন্দ্র কোনো জবাব না দিয়া উঠিয়া পড়িল। আর কোনো বাক্যালাপ করিল না মাত্র। সে মাঠের পথ ধরিয়াছে।

পিতা-পুত্র হতবাক। তাহারা গ্রামের পথে অগ্রসর হইল। আমজাদের অসোয়াস্তি, বহুদিন পরে চন্দ্র কাকার সঙ্গে দেখা। কিন্তু সন্ধ্যাটি আজ মাঠেই মারা গেল।

কাঠা দশেক জমি পার হইয়া আমজাদ শুনিতে পায় চন্দ্র কোটাল যেন গান ধরিয়াছে।

আজহার বলে, সত্যি পাগল চন্দর। তাড়ি গিলেছে বোধহয়।

না, আব্বা। মুখে গন্ধ নেই একদম।

সায়ং-আচ্ছন্ন মাঠের প্রান্তরে মেঠো সুর বাতাসের আলিঙ্গনে ভাসিয়া যায়। আমজাদের শ্রুতিভ্রম মাত্র।

ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা
যে চেয়েছে তোমার দিকে
তারই চোখে লঙ্কা বাটা।
ও তোমার মাথায় ঝাঁটা।

আমজাদের কান সুরের অন্বেষণে চলে।

হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করিল, আব্বা, ভগবান মানে আল্লা, না?

আজহার ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিল, হ্যাঁ।

২৬-৩০. দরিয়াবিবির খোঁজ

হাসুবৌ আজকাল প্রায়ই দরিয়াবিবির খোঁজ লইতে আসে। শাশুড়ীর কড়া তাগিদের তাড়া না আসিলে এই বাড়ি হইতে যাওয়ার নাম করে না সে।

আমজাদ মোনাদিরের খবর লইয়াছিল। সে তার আগেকার বাড়িতে যায় নাই। দরিয়াবিবি এ খবর জানে না। হাসুবৌ আমজাদকে তাহা বলিতে বারণ করিয়াছিল। পাছে তার মা আরো ব্যাকুল হইয়া পড়ে। আমজাদ তাই মিথ্যা কথা বলিয়াছিল। সে ওই গাঁয়ে আছে, মা।

হাসুবৌ গোপনে আমজাদের উপর ভর দিয়াছে, মুনির খবর আনা চাই-ই কিন্তু। হাসু চাচি, আমি আরো কয়েকজনকে তাগাদা দিয়েছি। এই ষড়যন্ত্রের কোনো খোঁজ দরিয়াবিবি রাখে না। সে চলিয়া গিয়াছে, তা যাক। কোনো উপায় তো আর নাই। তবু আত্মীয়দের সঙ্গে আছে, দরিয়াবিবির বুকে যেন বাঁধা থাকে সে।

হাসুবৌ জিজ্ঞাসা করিল, আমুর মা বুবু, তোমার নূতন মেয়েটি কিন্তু বেশ। আমাকে দিয়ে দাও, আমার তো ছেলেমেয়ে নেই।

তা কি দেওয়া যায়, পাগলী।

আমার কত সাধ একটা ছেলে–কানা খোঁড়াও যদি একটা ছেলে কি মেয়ে পেতাম।

দরিয়াবিবি এই বন্ধ্যা-নারীর ব্যথা অনুভব করে।

আল্লা দিলে হবে। তোর বয়স তো চলে যায়নি।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল হাসুবৌ নীরবে।

এমন সময় আসিল আমিরন চাচি। সঙ্গে আম্বিয়া।

দরিয়াবিবি খুব খুশি হয়, এসো বুবু।

কৈফিয়ত দিতে থাকে আমিরন চাচি, এতদিন পরে আজ একটু ফুরসত পেয়েছি জান-জালাপালা কাজে কাজে।

আসলে আমাদের মনে নেই।

দরিয়াবিবি কৃত্রিম ও কুটিল হাসির ছায়ায় চাহিয়া থাকে।

তুমি তো বলবেই দরিয়াবুবু! সত্যি নানা ঝঞ্ঝাট।

পেটে আর ভাত সেঁধোয় না।

কেন?

তারপর আমিরন চাচি তার দেবরের কাহিনী বলে। জমিগুলি হস্তগত করিতে সে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। তিন-চার বছর পরে আম্বিয়াকে বিদায় করিতে এই জমিগুলি কাজে লাগিত। হয়ত জমি দেখাইয়া কোনো ঘর-জামাই পাওয়া যাইত। ওই তো এক রত্তি মেয়ে। তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া ভিটায় বাস অসম্ভব।

দরিয়াবিবির সহানুভূতি আজও হ্রাস হয় না।

আম্বিয়ার জন্য অত মাথা ঘামিয়ো না। আল্লার মাল আল্লার হাতে সঁপে দেবে। কিন্তু তোমার দেবরটা এত ছোটলোক!

আর ঘরে বসে খাবে কী? পরের দিকে চেয়ে আছে শকুনের মতো।

আম্বিয়া মার পাশে ছিল না। আমজাদের সহিত সে দাওয়ার বাহিরে কাঁঠাল তলায় নানা কথায় ব্যস্ত।

মুনি আর এল না।

আমজাদ বিমর্ষ কণ্ঠে জবাব দিল, সে চলে গেছে কি-না। মা এখনো তার জন্য কত কাঁদে।

কবে যে আবার আসবে। তোর মুনিভাই কিন্তু বেশ।

বেশ, না?

হ্যাঁ।

মুনিভাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করে না।

খোঁজ করে নিয়ে আয় না তাকে।

খোঁজ নিয়েছি।

আসল কথা প্রায় প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল। হাসুবৌর উপদেশ স্মরণ হয় অকস্মাৎ।

কথা ঘুরাইয়া আমজাদ বলে, খোঁজ নিয়েছি। আসবে ইচ্ছামতো।

আম্বিয়া জবাবে সন্তুষ্ট হয় না।

তুমি বড় মিছে কথা বল। খোঁজ নিলে আর আসে না?

সে আসতে চায় না।

তার মুখে পড়া বেশ মানায়।

মোনাদির সকল প্রশ্ন ও জবাবের কেন্দ্র। আর যেন কোনো কথা নাই পৃথিবীতে।

আমিরন চাচি, হাসুবৌ, দরিয়াবিবি গৃহস্থালির নানা গল্প করে। দুঃখ-লাঘবিনী শক্তি আছে কথার। একের বেদনা-কাহিনী অপরের দুঃখাগ্নির মুখে ছাই চাপা দিতে পারে। সহানুভূতির হেতু আরো অটুট হয় তার জোরে।

হাসুবৌকে আমিরন চাচি বলে, হতভাগী, ছেলেমেয়ে চাস, এই দ্যাখ, আমরা পুড়ে মরছি।

এমন পুড়ে মরতেই বা জায়গা পাই কোথায়?

দরিয়াবিবির মন কয়েকদিন ভালো ছিল। নিত্যনূতন অভাব-বিজড়িত সংসারে যেন সামান্য সচ্ছলতার হাওয়া ঢুকিয়াছে। গল্পে গল্পে সময় কাটিয়া যায়। আম্বিয়া এই বাড়ি আসিলে আর যাইতে চায় না।

প্রায় সন্ধ্যা। এবার বাড়ি ফিরিতে হয়। মার ডাক আম্বিয়ার কানে যায় না।

তুমি যাও না, মা। তু

ই এই বাড়িতে থাক তবে, বুবুর বৌ হয়ে।

দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ আগে তার গোপন-মনে এমনই কল্পনার দুর্গ রচনা করিয়াছিল। মোনাদির আর চার বছরে মোলোয় পড়িবে। তখন

আমিরন চাচির কথা শুনিয়া দরিয়াবিবি হাসিয়া উঠিল।

বেশ, রেখে যাও।

আমার গাডেয় হাওয়া লাগে। খাইয়ে-পরিয়ে এখন মানুষ তো করো।

হাসুবৌ কথা গায়ে মাখিয়া লইল।

আমাকে দাও, আমি খাওয়াব-পরাব।

বেশ, নিয়ে যা।

আয়, আম্বিয়া আয় না, মা।

সাকেরের মার চড়া আওয়াজ দূর হইতে শোনা যায়। হাসুবৌ চলিয়া গেল।

আমজাদ চাচিদের আগাইয়া দিতে আসিল। মার বারণ সে শোনে না। তার আর ভূতের ভয় করে না। চন্দ্র কাকার গানের ঢেউয়ে সব কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে। হোক না সন্ধ্যা।

অস্পষ্ট বনের সড়কে মা-মেয়ে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়। আমজাদ কিছুদূর গিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।

সন্ধ্যার আঁধার-বন্দী বাতাস বেতগাছে শিরশির বহিয়া যায়। সেদিনও সন্ধ্যা ছিল। সেদিন মুনিভাই সঙ্গে ছিল। হঠাৎ তার দুই চোখ ছাপাইয়া পানি আসে। মুনিভাইকে সে সত্যি ভালোবাসিয়াছিল।

.

২৭.

চন্দ্র কোটালের অবসর নাই।

এই বছর ভালো ফসল হইয়াছিল। গ্রামে গ্রামে ভাড়-নাচের আসর বসে। অনেক বায়না কোটালের। রাজেন্দ্র সাজ-পোশাক আনিয়াছিল। বেশ জাঁক-জমকের সঙ্গে তার দল জমিয়া উঠিয়াছে। এই জন্য বিভিন্ন গ্রাম হইতে ডাক আসে।

আজহার নূতন ব্যবসা-পত্তনের সঙ্গী পায় না। কোটালও তাকে কিছুদিন সবুর করিতে বলিল। মনঃক্ষুণ্ণ হয় আজহার। হয়ত পরে তার হাতে টাকা থাকিবে না। সে নিজেই কোনো সুরাহা করিবে।

গঞ্জের দিনে ইয়াকুব আসিয়াছিল। সেও প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল। আজহার তার কথায় সায় দেয় না। ইয়াকুব একা আসে না তো। সঙ্গে হাট-বাজার। মুরগি, ঘি, এমনকি সরু চাল পর্যন্ত সে লইয়া আসে। আজহার এসব পছন্দ করে না। তার আত্মসম্মানে ঘা লাগে। এইজন্য ইয়াকুবের সঙ্গে কোনো অংশীদারী কাজ তার ভালো লাগে না।

দরিয়াবিবি আজকাল ইয়াকুবের চাল-চলন সহজে গ্রহণ করে। তার আত্মসম্মান সহজে তীক্ষ্ণ হইয়া ওঠে না। আপনজন আত্মীয়, সে কিছু সঙ্গে আনিলে, অত সংবেদনশীল হইলে চলিবে কেন?

আজহার চুপচাপ থাকে। মেহমানদারীর কাজে দরিয়াবিবির বেশ উৎসাহ দেখা যায়। বহুদিন পরে এই বাড়িতে পলান্নের সৌরভ পাওয়া গেল। আরো দুতিন রকমের তরকারী হইল। ইয়াকুব লুচি তৈয়ারি করিতে বলিয়াছিল। দরিয়াবিবির সম্মতি ছিল না। কাল সকালে নাস্তার সময় তৈয়ারি হইবে। বাড়ির ছেলেরা ইয়াকুবের নামে উৎফুল্ল হইয়া ওঠে। ইয়াকুব চাচা নামে মধু ঝরে না শুধু, নঈমার জিহ্বায় রীতিমতো লালা ঝরে।

আমজাদের স্কুলের বেতন সে নিয়মিত দিয়া আসিতেছে।

কয়েক বছর পূর্বে দরিয়াবিবি সামান্য দান-গ্রহণে আসেকজানের সহিত বিবাদ করিত। সেই তেজ অন্তর্হিত হইয়াছে। স্বামীর মানসিকতা সে চেনে। আজহারের উপর তার ক্ষোভ হ্রাস পায় না। আত্মীয়স্বজনের সহিত অত বাঁধাবাঁধি নিয়ম চলে না।

রাত্রে আহারের সময় আজহার ডাল ও দৈনন্দিন বরাদ্দ একটি আলুর তরকারি দিয়া ভোজ সমাধা করিল। মাগুর মাছ আনিয়াছিল ইয়াকুব। সে তা স্পর্শ করিল না।

দরিয়াবিবি শুধায়, গোশত খাবে না?

না, আমার পেটের গোলমাল আছে।

আসলে আজহার মনের কথা চাপিয়া গেল। ইয়াকুবের কয়েকটি টাকা সে লইয়াছে তাহা যেন তার গায়ে হুল ফুটাইতেছে। টাকা ফেরত দেওয়ার উপায় নাই। তার স্বপ্নরাজ্য যে ধূলিসাৎ হইয়া যায় টাকাগুলির অভাবে। এই বাধ্য-বাধকতার ছায়ায় আজহার নিরুপায়। নচেৎ সে ইয়াকুবের মুখোমুখি এই দাঁতব্যগিরি বন্ধ করিবার হুকুম দিত।

দরিয়াবিবি কোথায় ঘা দিতে হয়, ভালোরূপেই জানে।

রাত্রে স্বামীকে বলিল, আমুর ইস্কুলের মাইনে মাসে মাসে দিতে হয়রান। সামনের বছর ফসল যদি না হয়, কিভাবে যে দিন কাটবে।

আজহার কিছুক্ষণ নিরুত্তর রহিল।

জবাব দাও, এসব কথা মনে আছে! খালি ব্যবসা-ব্যবসা। কতবারই কত টাকা উড়িয়ে দিলে।

আল্লার মরজি হলে কতক্ষণ।

বিরক্ত হয় দরিয়াবিবি, আল্লার মরজি মরজি করে তো দশ বছর কেটে গেল। এখন তোমার মরজি হলে বাঁচা যায়।

আজহার জবাব দিতে গিয়া থামিয়া গেল।

ইয়াকুব ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা কর না। দেখ না, আল্লার মরজি কোন দিকে যায়।

ওর সঙ্গে ব্যবসা পোষাবে না।

তা পোষাবে কেন?

দরিয়াবিবি উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। আজহারের নির্বুদ্ধিতার শত রকম ব্যাখ্যা করিল।

কিন্তু অপর পক্ষ নীরব। আনমনা কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, সে জানে না।

পরদিন সকালে আবার নাস্তার বহর। ইয়াকুব দরিয়াবিবিকে তার বাৎসরিক মুনাফার বয়ান দিল। তিন হাজার টাকা পাইয়াছে পাটে, গোলদারীর দোকানে দুহাজার ইত্যাদি ইত্যাদি।

নাস্তা খাওয়ার সময় আজহারকে পাওয়া গেল না। সে মাঠে চলিয়া গিয়াছে। গোয়ালঘরে গরু-ছাগল কিছু নাই। দরিয়াবিবির অনুমান মিথ্যা নয়।

ইয়াকুব বলিল, ভাবী সাহেব, কেমন যেন আমাদের ভাই সাহেব। আমার সঙ্গে কাজকর্ম করত, আল্লা মুখ তুলে চাইতেন।

মাথায় ছিট আছে। কে পারবে বল ওর সঙ্গে।

আপনার মতো আক্কেল থাকলে আমি এতদিনে লাখপতি হয়ে যেতাম।

প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয় দরিয়াবিবি। দেবরকে সে পান সাজিয়া দিতেছিল। বাটায় সুপারি নাই। একবার উঠিয়া দরিয়াবিবিসিকায় সুপারি আছে। ঘরে প্রবেশের সময় সে একবার পিছন ফেরে। ইয়াকুব তার গমনপথ অথবা নিতম্বের দিকে চাহিয়া আছে, বোঝা যায় না। কিন্তু তার দৃষ্টি খুব শোভন মনে হয় না।

পানের বাটার নিকট ফিরিয়া আসিল দরিয়াবিবি সংকুচিত।

চোখাচোখি ইয়াকুবের দিকে সে তাকায়। না, তার দৃষ্টিভ্রম। আসলে ইয়াকুবের দৃষ্টি যেন এইরূপ।

অবসর সময়ে তার মনে আন্দোলন জাগে। আসলে লোকটা খারাপ নয়। তবে অমার্জিত রুচি। এই জাতীয় দ্বন্দ্বের ভিতর দরিয়াবিবি সমস্যার সমাধান খোঁজে। ব্যবসাদার লম্পট সম্বন্ধে দরিয়াবিবির কোনো জ্ঞান ছিল না। আজহার তার গুণগ্রামের হদিস জানিত বলিয়া দূরে দূরে থাকিত।

সেদিন সকালেই ইয়াকুব চলিয়া গেল। দুপুরবেলা বিছানা পরিষ্কার করিতে গিয়া বালিশের নিচে একটা দশ টাকার নোট পাইল, দাঁড়াইয়া রহিল দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ স্তব্ধ। মুঠির মধ্যে নোট অজানিতেই সে দুমড়াইতে থাকে। সচেতন হইলে সে সংকুচিত নোটটি আঁচলে বাঁধিয়া রাখিল।

মাঠের সামান্য কাজ করিয়া আজহার চন্দ্র কোটালের বাড়ি গিয়াছিল। সে বিকালে গানের বায়নায় যাইবে। সাজগোজ হইতেছে সকালে।

চন্দ্র আজহারকে বসিতে দিয়া তামাক সাজিতে লাগিল। শিবুর বৌ আগে আসিয়াছিল। একটি বছর চার বয়সের ছেলে মার অঙ্গসংলগ্ন হইয়া আঙুল চুষিতেছে। কাঁখে আর একটি মেয়ে।

আজহারের চোখে পড়িতে শিবুর বৌ ঘোমটা বাড়াইয়া দিল।

কেমন আছ, বৌ।

বৌ অশ্রুসজল কণ্ঠেই জবাব দিল, ভগবান মেরেছেন। আমাদের আর থাকাথাকি, চাচা।

শিবু আজহারকে চাচা বলিয়া ডাকিত। সেই সূত্রে এই আত্মীয়তা।

আজহার সমবেদনার কোনো কথা যেন খুঁজিয়া পায় না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। শিবুর বৌর কানে তা পৌঁছায়।

চন্দ্র এমন সময় কলিকা হাতে আজহারের পাশে আসিয়া বসিল।

দেখেছ তো খাঁ সাহেব। এই তোমার-আমার ধর্ম।

তা দেখছি।

দেখছ। ঘোড়ার ডিম দেখছ। ধর্ম না কচু। হাতেম বখশ যদি মুসলমান হয়, কি রোহিণী হিন্দু হয় তবে চণ্ডাল কে?

দেখছি সব।

তুসি কিছু দেখতে পাও না, খাঁ। টাকার নামে শালারা ধার্মিক। খামাখা দুটো গরিবের প্রাণ গেল।

শিবুর বৌকে সম্বোধন করিয়া বলিল, তুমি গিয়েছিলে মা, রোহিণী চৌধুরীর কাছে?

গিয়েছিলাম, পাঁচটা টাকা দিয়েছিল।

বড় ম্রিয়মাণ কণ্ঠ শিবুর বৌর।

শোনো, খাঁ। পাঁচ টাকা। অমন টাকায় মুতে দাও। একটা লোকের দাম পাঁচ টাকা। আজহার ভাই, গরিবে গরিবে যদ্দিন বেঁচে আছি, আর ধর্মের কথা কানে আনছি না। আমিও রোহিণীর ফাঁদে পড়েছিলাম। শালা রোহিণী।

গালাগাল দিয়ো না খামাখা।

গালাগাল দেব না। তুমি শিবুর বৌকে খাওয়াতে পারবে? ধরো, খাওয়াতে পারলে, কিন্তু ওর স্বামীকে জ্যান্ত করে দিতে পারবে? গালাগাল দেব না?

রক্তচক্ষু কোটাল হুঁকা টানিতে লাগিল।

শিবুর ছেলেটা দুইজনের দিকে অবোধ নয়নে চাহিয়া থাকে।

গালাগাল দেব না। ইসমাইলের বৌ ছেলেপুলে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেল। তারাও গরিব। তুমি তো চেন দশহাটার মল্লিকদের।

হুঁ চিনি।

শিবুর বৌর কেউ নেই। তার চালে খড় নেই দুআঁটি। বলছি, বৌ এখানে এসে থাক। আমি আর একটা কুঁড়ে তুলব। গাঁয়ের বাসেদ, পাড়, গণেশ সবাই গায়ে-গতরে খেটে দেবে বলেছে।

আজহার বলিল, যখন যা দরকার আমাকে ডেকো।

তা আলবৎ ডাকব। হাতেম বখশের গুষ্টিশুদ্ধ শহরে মদ টানে, সে মুসলমান, তুমিও তার কথায় উঠো বসো, না?

তুমিও তো রোহিণীর কথায় নেচেছিলে?

লজ্জিত কোটাল জবাব দিল, তা ঠিক। কিন্তু আর নয়। শালাদের ধর্মের নিকুচি। আর আজহার ভাই, তোমার মিনমিনে স্বভাব আমার ভালো লাগে না। জোর গলায় বুক ঠুকে ওদের কাছে কথা বলতে হবে।

ওরা বড়লোক। পুলিশ-দারোগা।

কথা তার মুখ হইতে চন্দ্র যেন লুফিয়া লইল, আইন নেই? আমরা তো দুচারজন নই। গাঁয়ের হাজার হাজার গরিব। পুলিশ যদি আইনমতো না চলে, ওদের কথায় ওঠে বসে; আমাদের লাঠি নেই, বল নেই?

ভাঁটার মতো চক্ষু ঘোরে কোটালের।

হঠাৎ থামিয়া সে বলে, কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল, অনেক গোছগাছ বাকি। পরে এসো তুমি। শিবু বৌমা, এখানে খেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি যেয়ো–

দুইজনে আসর ভাঙিয়া দিল।

আজহার গ্রামের পথে শিবুর বৌর কথা ভাবে। ভবিষ্যতের সংস্থান তারও নাই। একমাত্র আশ্রয় পথ। না, সে আবার ভাগ্য অন্বেষণে বাহির হইবে। টাকার জন্য এত হীনতা যখন স্বীকার করিয়াছে, ঘরে পড়িয়া থাকা ভালো নয়। কপাল ফিরিবে না তার?

খোদার মরজি হইলে কতক্ষণ?

.

২৮.

সকাল-সকাল দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজ সারিয়া বসিয়াছিল। কোলে ছোট খুকি শরী।

ঈষৎ সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া উঠিতেছিল। আমজাদ নিজের ঘরে জোরে জোরে পাঠাভ্যাস করিতেছে। আজহার দাওয়ায় বসিয়া হুঁকা লইয়া মশগুল। গুড়গুড় শব্দ উঠিতেছে।

মুনির মা!

আজহার ডাক দিল। মোনাদির আসিবার পর দরিয়াবিবির নাম বদলাইয়া ফেলিয়াছিল সে। কালেভদ্রে আমুর মা বলিয়া ডাক দিত।

কেন?

আজ ওদিকের গাঁয়ে গিয়েছিলাম।

কেন?

বীজ ধান কেনা দরকার।

উত্তপ্ত কণ্ঠ দরিয়াবিবির, তা আমাকে শোনানোর কোনো দরকার আছে?

না। এমনি।

আজহার চুপ করিয়া গেল। কিন্তু তার কথার খেই শেষ হয় নাই, কণ্ঠে তার পরিচয়।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ সে বলে, ও গাঁয়ে গিয়েছিলাম, শুনলাম মুনি নাকি

দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হয় এইবার।

আজহার বলিতে থাকে : মুনি, ওগাঁয়ে নেই।

নেই!

শ্রুতি-ভ্রমের উপর এখনো বিশ্বাস আছে দরিয়াবিবির।

পুনরুক্তি করিল, কে নেই?

মুনি।

মুনি ও-গাঁয়ে নেই?

না।

কতদিন নেই!

এখান থেকে যাওয়ার পর আর নাকি ওখানে যায়নি।

আমজাদের ডাক পড়িল। সে পড়া ছাড়িয়া উঠিয়া আসিল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে, আমু, তোর মুনিভাই তবে যে তার চাচার বাড়িতে আছে, আগে বলেছিলি?

আমি তো তাদের বাড়ি যাইনি। শুনে এসেছিলাম।

দরিয়াবিবি ক্ষোভে আগুন হইয়া উঠে, শুনে এসেছিলি

তারপর পুত্রের দিকে কটমট চোখে তাকায়।

আমজাদ প্রায় কাঁদিয়া ফেলার উপক্রম। নিজের সাফাই সে দক্ষ আসামীর মতো গাহিয়া গেল। আজহারের আফশোস বড় কম নয়। নিজের উপর বারবার ধিক্কার দিতে লাগিল।

আমার চণ্ডাল মেজাজে সেদিন আগুন ধরেছিল। এই হাতে আজার হোক।

দরিয়াবিবি আর কোনো কথা বলিল না। কারো বাক্যালাপ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতেছিল কি-না সন্দেহের ব্যাপার।

সমগ্র দাওয়া স্তব্ধ এক নিমেষে।

আমজাদ পা টিপিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। তার পাঠ্যাভ্যাস নিভিয়া গিয়াছে। কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আজহার হাঁটুর ভিতর মুখ খুঁজিয়া বসিয়া রহিল। দরিয়াবিবি কখন শরীকে লইয়া উঠিয়া গিয়াছে, তার খোঁজও সে রাখিল না। সেই অবস্থায় সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুম ভাঙার পর তার অচেনা ঠেকে সব জায়গা। দাওয়ায় পিদিম নাই। উঠানে অন্ধকার আর অন্ধকার। একরাশ ঝিঁঝি ঊধ্বশ্বাসে ডাকিতেছে। আজহারের মস্তিষ্কে তার অনুকরণ চলে। সন্তর্পণে সে ঘরের দুয়ারে করাঘাত করিল। না, সব বন্ধ। আমজাদের ঘরও ভোলা নাই। অভুক্ত সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সেও ঘুমাইয়া পড়িল দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া।

পরদিন খুব ভোরে আজহার মাঠে চলিয়া গেল।

দরিয়াবিবির ডাকে আমিরন চাচি হাজির হইল পরদিন। মুনির খোঁজ গ্রহণের সে প্রতিশ্রুতি দিল।

বিকালে আমিরন চাচি হতাশ। সংবাদ দিয়া গেল মুনি চাচার বাড়ি যায় নাই। ভয়ানক কান্না জুড়িল দরিয়াবিবি। কারো স্তোক বাক্যে থামে না। হাসুবৌ আসিয়াছিল। তারও চোখের পানি সহজে থামে না।

ও যদি একদম আর এ বাড়ি না আসত আমার দুঃখ ছিল না। কিন্তু এলো, আমি তাড়িয়ে দিলাম।

দরিয়াবিবি ফোঁপাইতে থাকে।

বেটাছেলে, কোথাও গেছে। আমি আরো খোঁজ নিচ্ছি। আশ্বাস দিল আমিরন চাচি।

আর সে ফিরে আসবে! কোথা গেল, অতটুকু কচি ছেলে।

আমি গণৎকারের কাছে গুনিয়ে আসব। কোনদিকে গেছে, কবে ফিরে আসবে ঠিক বলে দেবে, সেবার আমার বোনের দেবর এমনি।

আমিরন চাচি নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রত্যাবর্তনের কাহিনী বলিল।

দরিয়াবিবি আশ্বস্ত হয় না, তবু অনুরোধ করিল, আমি পাঁচ পয়সা দেব, বোন।

পাঁচ পয়সা আর একটা সুপারি লাগে।

আমিরন চাচি জবাব দিল।

তুমি এখনই নিয়ে যাও।

আম্বিয়া বাড়িতে আছে, আমিরন চাচি আর দেরি করিতে পারে না। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল। বেশ অন্ধকার চারদিক। বন-বাদাড় ভাঙিয়া যাইতে হইবে।

পয়সা, সুপারি আমি দেব। মুনি আমার ছেলে নয় নাকি? চাচির সহানুভূতি অকৃত্রিম।

হাসুবৌ ও আমিরন চাচি বিদায় লইল।

আজহার মাঠ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। আমজাদ শুধু সে সংবাদ জানে। থমথমে আবহাওয়ার জন্য পিতাকে একবার দেখিয়া সে নিজের ঘরে ডিপার আলোয় চুপিচুপি পড়িতেছিল। কিন্তু পড়ায় তার কোনো মন ছিল না।

দরিয়াবিবি সকলে চলিয়া গেলে আমজাদের ঘরে আসিল।

আমু।

মা।

কাল ও গায়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবি। আর একবার গঞ্জের দিকে যাস।

আচ্ছা, মা। মুনিভাইয়ের জন্য আমারও মন কেমন করে।

সত্যি সজল হইয়া উঠে আমজাদের চক্ষু।

তোর আব্বা মাঠ থেকে আসেনি?

এসেছিল তো। খানিক আগে দেখেছি।

ডিপা হাতে দরিয়াবিবি ঘরে প্রবেশ করিল। বাঁশের আলনায় আজহারের লুঙি পিরহান কিছু নাই। কাটা দেওয়ালের গায়ে একটি কুলুঙ্গী ছিল। আজহারের সূতা কন্নিক-পাটা উষো ও যাবতীয় রাজমিস্ত্রীর সরঞ্জাম থাকিত। সব শূন্য।

দরিয়াবিবি চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাইল এবং সবকিছু নিমেষে উপলব্ধি করিল।

.

২৯.

তোমার বাবা আবার রুই-পোনা ধরতে গেছে। চুনো চানা খেয়ে কি খাঁ সাহেবের দিন কাটে? জানো, চাচা?

চন্দ্র ও আমজাদের মধ্যে বাক্যালাপ হইতেছিল। হাসিয়া হাসিয়া কোটাল কথাগুলি উচ্চারণ করিল। দরিয়াবিবি দহলিজের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছে, চন্দ্রের তা খেয়াল ছিল না। তার মুখের হাসি তখনই নিভিয়া গেল।

দরিয়াবিবি চন্দ্রকে ডাকাইয়া আনিয়াছিল। আমজাদ জানে, বিপদে আপদে মা প্রথমে চন্দ্র কাকার কথাই মনে করে। পুত্রের মারফৎ এতক্ষণ অনেক কথাই দরিয়াবিবি তাহাকে শোনাইয়াছে।

তাই।

হাসি চাপা দিতে চন্দ্র কোটাল আবার উচ্চারণ করিল, তাই তো ভাবী সাহেব। এমন মানুষ আমি আর একটা দেখিনি। মাঝে মাঝে কি যেন ঝোঁক চাপে! দুহপ্তা গেল। মানুষ একটা খবর তো দেয়। তা-ও না।

দরিয়াবিবির দীর্ঘশ্বাস কোটালের কানে যায়। চন্দ্র সহসা কোনো জবাব দিতে পারে। আবহাওয়া হালকা করিতে সে ওস্তাদ। কিন্তু সেও কেমন যেন ম্লান হইয়া গিয়াছিল।

আমজাদ বলিল, জানো কাকা, আব্বা আমাদের দেখতে পারে না। তাই বাড়ি ছেড়ে পালায়।

চন্দ্র প্রতিবাদ জানাইল, তা না, চাচা। খেয়ালী মানুষ। সংসার নিয়ে কষ্ট পায়। তাই মাঝে মাঝে ঐ সব করে। ভাবে দুঃখ যাবে। কিন্তু দুঃখ কি সহজে যায়? ব্রিটিশ রাজত্ব। আগে ব্রিটিশ যাক, রোহিণী-হাতেম বখশ ঐ শালারা যাক, তবে না দুঃখ যাবে।

আমজাদ এত কথা বোঝে না।

সে সায় দিতে রাজি নয়। পিতার প্রতি তার আক্রোশ আছে।

কিন্তু ব্যাপার কি জানো, তোমার বাবা। চন্দ্র কোটালের বাক্য আড়াল হইতে পূর্ণ করিল দরিয়াবিবি, চুপ শয়তান।

চন্দ্র এবার হাসিল। সে যেন আত্মস্থ হইয়াছে। ঠিক বলেছেন ভাবী। আমার মনে যা হয়, মুখে তা বলে ফেলি। কিন্তু খাঁ ভাই? উহ্ জান গেলেও বেশি কথা বলে না। যদি কারও হাজার টাকায় চুপ শয়তান দরকার হতো, আমি তোমার বাবাকে বেচে দিতাম বাবা। চন্দ্র হা হা শব্দে হাসিতে লাগিল। আমজাদ সঙ্গে যোগ দিল।

এমন সময় ভিতর হইতে ধমকের সুরে দরিয়াবিবি ডাকিল, আমু, তোর কাকাকে জমির কথা জিজ্ঞেস কর।

দুই জনের হাসি হঠাৎ বন্ধ হইল। আমজাদ নয়, জবাব দিল কোটাল।

ভাবী সাহেব, তার জন্য আপনি ঘাবড়াবেন না। ধান আমি নিজে কেটে দেব। এবার খড়ের দাম খুব বেশি। মানুষ ঘরদোর ছাওয়াচ্ছে। পনেরো-ষোলো টাকা কাহন। আমি ভাবছি, খড় কিছু রেখে বাকি বেচে দেব।

কাহন খানেক রেখে দেবেন। মৃদুকণ্ঠে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

চন্দ্র আবার বলিল, শুধু ধান কাটা নয়, তরমুজ আর কুমড়া বিঘে খানেক জমিতে দেব ভাবছি। কিন্তু আমার আসর গানের বায়না আছে। আমজাদ চাচা আছে, দেখি কি বন্দোবস্ত করা যায়।

দরিয়াবিবি এবার আমজাদকে ডাকিয়া বলে, আমু, তোর চাচাকে পান তামাক এনে দে।

ঘোর আপত্তি জানাইল চন্দ্র। না, এখন কিছু দরকার নেই। আমি আজ উঠি, ভাবী সাহেব। আমার ক্ষেতে অনেক কাজ পড়ে আছে। সত্যই চন্দ্র কোটাল উঠিয়া পড়িল। আমজাদ তার অনুসরণে গেল। মহেশডাঙার জলাজঙ্গল ভরা পথে পথে চন্দ্র কাকার সহিত বেড়াইতে পাইলে সে আর কিছু চায় না। কত হাসির গান, মশকরা আর প্রাণ ঢালা আদর না পাওয়া যায় চন্দ্র কাকার কাছ হইতে!

ভাবী সাহেব, ঘাবড়াবেন না– চন্দ্রের স্তোকবাক্যে দরিয়াবিবি জোর পায়, কিন্তু অসোয়াস্তি যায় না। গত বিশ বছর এমন কতবার ঘটিয়াছে। বার-ফাট্টা আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু যদি আর না আসে। দৈহিক শক্তি এতদিন দরিয়াবিবির সহায় ছিল। আজও স্বাস্থ্য তার অটুট। কিন্তু মন বড় নিস্তেজ ও নিঃসঙ্গ।

আত্ম-চিন্তায় মশগুল দরিয়াবিবি। উঠানে একটি ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াইতেছিল। শরী দাওয়ায় চুপচাপ একা ঘুমাইয়া। সে বড় লক্ষ্মী মেয়ে, কেবল ক্ষুধার সময় কাঁদে। পেটভরা থাকিলে শুধু ঘুমায়। দরিয়াবিবি তাই বড় নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্নে সাংসারিক কাজ সম্পন্ন করিতে পারে। ছাগলগুলি দরিয়াবিবির বড় প্রিয়। প্রতি বছর বছর বাচ্চা হয়। ঈদ ইত্যাদি পর্ব উপলক্ষে লোকে ছাগল কেনে। তখন ছাগল বেচায় একটা আনন্দ আছে। দাম বেশি পাওয়া যায়, তা ছাড়া টানাটানির দিন একটু সহজ হয়।

এই প্রাণীদের লইয়া দরিয়াবিবি ব্যস্ত। আমিরন চাচি কখন ধীরে ধীরে উঠানে ঢুকিয়াছে তা সে লক্ষ করে নাই। পাতা খাওয়ানো তো একটা দৈনন্দিন কাজ। দরিয়াবিবি ছাগলগুলির দিকে ভালোরূপে তাকায় নাই। কাঁঠালের ডালপালা শুধু আগাইয়া দিতেছিল। মনে নানা হিসাব নিকাশের ঝড়।

আমিরন চাচি দরিয়াবিবির থমথমে মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে হঠাৎ মৃদুকণ্ঠে ডাক দিল, বুবু।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে অভ্যর্থনামুখর হাসি।

কখন এলে?

তারও খোঁজ নেই? কর্তাবিরাগী, গিন্নীর মন এমন উদাস না হলে চলে– বলিয়া আমিরন চাচি হাসিয়া উঠিলেন।

দরিয়াবিবির মুখ আবার থমথমে। আমিরন চাচি অপ্রস্তুত হইয়া যায়। দরিয়াবিবি সেদিকে চোখপড়া মাত্র সে ছাগলগুলিকে হাঁকাইয়া দিয়া চাচির কোমর জড়াইয়া বলিল, ঘরের ভিতর চল বুবু। কি আমার কর্তা রে– তার জন্য আবার চিন্তা!

আমিরন চাচি সহানুভূতির সুরে জবাব দিল, এমন লোক।

কিন্তু যেন ঝাপটা দিয়া দরিয়াবিবি তার মুখের কথা নিভাইয়া দিল। চল, পান খাই, দুটো কথা বলি।

নদীর ধারে বাস
দুক্ষু বারো মাস

রাখো বাজে কথা।

আমিরন চাচি দরিয়াবিবির সুখের কৃত্রিমতা কিছুই ধরিতে পারে না।

দুইজনে সত্যই কিছুক্ষণ আজেবাজে আলাপ করিল। গ্রামের কথা, পাড়া-পড়শীদের। কথা। সাকের কোথায় দাঙ্গা করিতে গিয়াছে, হাসুবৌ শাশুড়ির গঞ্জনা আজকাল অনেক বেশি শোনে ইত্যাদি।

আমিরন চাচি কাজের লোক। গরু-বাছুর-হাঁস-মুরগি লইয়া সে এক রাজ্যের অধিশ্বরী। বেশিক্ষণ কথা-ফোড়নের সময় কোথায়? একটি খবর দিতে আসিয়া সে এতক্ষণ সুযোগ খুঁজিতেছিল। হঠাৎ চাচি বলিয়া ফেলিল, দরিয়াবুবু, একটা খবর আছে।

কত সংবাদের জন্যই দরিয়াবিবি হা-প্রত্যাশায় নিমজ্জিত, তখনই উৎকর্ণ উন্মুখ ব্যগ্রতায় চাচির দিকে তাকাইল।

আমাদের মুনি চাচার খবর পেয়েছি।

দরিয়াবিবি অন্য কোনো সংবাদ পাইলে যেন সন্তুষ্ট হইত। বেশি উৎসাহ না দেখাইয়া সহজ গলায় বলিল, কি খবর?

মুনি চাচাও বাড়ি থেকে চলে গেছে। আরো পাঁচ ক্রোশ দূরে কি স্কুল আছে, সেখানেই পড়ে। চাচাঁদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ আর নেই। আমিরন চাচি খুব তরল গলায় পরিবেশন করিল।

যেখানেই থাক, ভালো থাক। আমার ছেলে তো নয়, আমার কি জোর আছে! ভয়ানক নির্লিপ্ত শোনায় দরিয়াবিবির কণ্ঠ।

প্রতিবাদ জানাইল আমিরন চাচি, তোমার ছেলে নয় কে বললে? দেখ রক্তের টান, চাচা আবার তোমার কোলেই ফিরে আসবে।

আসুক বা না আসুক, যেখানে থাক বেঁচে থাক। তুমি কোথা থেকে খবর পেলে?

আমি খবর পেয়েছি। আমার এক মামাতো ভাই আছে মুনিদের গাঁয়ের পাশে। তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। …তোমার মেহেরবানি বুবু।

তারপর আমিরন চাচি কর্তব্যের ডাকেই উঠিয়া পড়িল। আম্বিয়া একা বাড়িতে আছে। দেবর বিধবার সম্পত্তি হরণের নানা পাঁয়তারা কষিতেছে। আর বেশিক্ষণ এখানে কাটানো। চলে না। আমিরন চাচি কিন্তু অবাক হয়। আজ তার বুবু পুত্র প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করিল না। অথচ অন্য সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই এক কথাই বড় হইয়া দেখা দেয়।

দরিয়াবিবি আমিরন চাচিকে দহলিজ পর্যন্ত আগাইয়া দিল ও আবার আসার জন্য অনুরোধ করিল। কিন্তু উঠানের দিকে অগ্রসর হইতে তার পা যেন আর চলে না। ধীরে ধীরে ছোট্ট শরীর বিছানার পাশে আসিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল ও তার ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। তখন দরিয়াবিবি কী ভাবিতেছিল, শুধু সেই তার খবর রাখে।

.

৩০.

গঞ্জের পথে ইয়াকুব আসিয়াছিল খোঁজ-খবর লইতে। সে খালি হাতে আসে না। ছেলেদের জন্য মিষ্টি, তা ছাড়া এত জিনিসপত্র আনে যার প্রাচুর্যই যে কোনো সংসারের পক্ষে তিন-চার দিনের জন্য লোভনীয়। দরিয়াবিবি প্রথম প্রথম মৃদু আপত্তি জানাইত। এখন নিজেই ইয়াকুব আনীত মায়া পেটিকা নিজের হাতে খোলে। অবশ্য উৎসাহ দেখায় না বিশেষ।

এবার ইয়াকুব বড় বড় কই ও বড় বড় চিংড়ি মাছ পর্যন্ত আনিয়াছিল। আজহার ঘরে থাকিলে মাঝে মাঝে মাছ ধরিতে যায়। তখন এমন মাছ এই বাড়ির হাঁড়িতে উঠে। নচেৎ এত দামে এমন আমিষ আহারের সামর্থ্য কোথায়?

ইয়াকুব ফোড়ন দিয়া বলিল, ভাবী, এবার মটরশুটি পাওয়া গেল না। বড় চিংড়ি আর মটরশুটি আমার খুব পছন্দ।

তোমার ক্ষেতে হয় না? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল।

না। অসময়ে সব সময় কি আর এই ফসল তোলা যায়?

ছেলেরা ইয়াকুব চাচাকে ঘিরিয়া থাকে। নঈমা কাছ ছাড়া হয় না; বরং অন্য সময় মাকে জিজ্ঞাসা করে, চাচা কবে আসবে মা? কারণ চাচা একা আসে না। আমজাদ কাছ ঘেঁষিয়া বসে। সে লাজুক, তাই সে কম কথা বলে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইয়াকুবের সঙ্গ ত্যাগ করে না।

লৌকিকতার রেশ আর নাই। মেহমান হইলেও ইয়াকুব আহারের ফিরিস্তি নিজেই দিয়া থাকে। কারণ যোগাড় সে বহন করিয়া আনে।

দরিয়াবিবি বিকালে লুচি ভাজিতেছিল। পাশে কোনো ছেলেপুলে নাই। নঈমা একবার আসিয়াছিল শিশুসুলভ প্রত্যাশায়। কিন্তু মা বসিতে দেয় নাই, ধমক দিয়া তাহাদের ভাগাইয়াছে। আরো বকুনি খাইয়াছে আমজাদ। এত বড় ছেলে স্কুলে পড়িস। এমন হাঁ খেয়ে কেন? কোনোদিন লুচি দেখিসনি চোখে? ইহার চোটে দুরন্ত পেটুকও ছুটিয়া পলাইত।

আজহারের কথা এই বাড়িতে ছেলেরা কেহ মুখে আনে না। ইয়াকুব তার কথা জিজ্ঞাসা করে সারাদিন। কুশল জিজ্ঞাসার রীতিটুকু পর্যন্ত সে পালন করে নাই। অথচ আত্মীয়।

কড়ায় গরম তেলে ফেলা লুচির হ্যাঁক শব্দ হইতেছিল। দরিয়াবিবি আনমনা কাজ। করিয়া যায়। সে নিজের চিন্তায় কুঁদ, তা-ও মুখাবয়বে প্রমাণ। দরিয়াবিবি সুডৌল গৌর মুখ চুলার আঁচে ঘামিতেছিল।

ভাবী, ভাবী–আপনার রান্না কত দূর। ডাক দিতে দিতে ইয়াকুব চুলাশালে প্রবেশ করিল।

বেগুন ভাজা হয়ে গেছে, এখন লুচি ভাজছি। ইয়াকুবের দিকে না তাকাইয়া চুলার ভিতর এক খণ্ড লাকড়ি ঠেলিতে ঠেলিতে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

এখানেই দিন, গরম গরম লুচি খাওয়া যাক।

বেশ। কিন্তু বসার জায়গা কোথায়?

বসার জায়গা কি হবে? এই আমি বসে দেখিয়ে দিচ্ছি–বলিয়া ইয়াকুব উবু বসিয়া পড়িল।

তোমার কাপড়চোপড় ময়লা হবে। ইয়াকুবের পরনে সিল্কের লুঙি, গায়ে শাদা শার্ট। দরিয়াবিবি মিথ্যা বলে নাই।

না, আমি তো আর ছেলেমানুষ নই। যেন কত রসিকতা করা হইল। ইয়াকুব বেদম হাসিয়া উঠিল।

বেশ, বসো। আমি থালা বাটি নামিয়ে আনি।

দরিয়াবিবি মাচাং হইতে লোয়াজিমা কয়েকটি নামাইয়া আনিল এবং বেগুনভাজা ও লুচি পরিবেশন করিতে লাগিল।

থালায় হাত নামাইয়া ইয়াকুব বলিল, ভাবী, ছেলেদের ডাকেন।

ওরা খেয়েছে। সংক্ষিপ্ত জবাব। ইয়াকুব চাহিয়া দেখিল দরিয়াবিবি তখন লুচি বেলায় মগ্ন। উত্তপ্ত কড়ার দিকে তার আড়চোখের দৃষ্টি। সেখানে টগবগ শব্দে তেল ফুটিতেছে।

সত্যি ওরা খেয়েছে?

হ্যাঁ। দরিয়াবিবির কণ্ঠ ঈষৎ তীক্ষ্ণ শোনায়।

দরিয়াবিবি গরম লুচি ছাঁকিয়া পাতে দিতে লাগিল। ইয়াকুব ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করে।

ভাবী, একটু পানি।

দরিয়াবিবি ঝটপট হুকুম তামিল করিল। আর কোনো বাক্যালাপ যেন এগোয় না। ইয়াকুব দরিয়াবিবিকে রীতিমতো ভয় করে। তার চোখের দিকে সহজে তাকাইতে পারে না। থমথমে মুখ যেন শাসনভঙ্গির আদল। ইয়াকুব অসোয়াস্তি বোধ করে। তবে সে দুই স্ত্রীর পতিদেব। মনের গোপনে একটা আত্মবিশ্বাস আছে তার। কিন্তু এখানে যেন সব ঠাণ্ডা হইয়া যায়। দরিয়াবিবি কত শান্ত। অথচ ইয়াকুব অসোয়াস্তি অনুভব করে।

নিজের মনেই সে বলিয়া যায়, আপনার বাড়ি এলে যা শান্তি পাওয়া যায়, আর কোথাও তা মেলে না।

আবার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন কেন?

কেন? যত্নআত্যি কে করে?

যত্নআত্যি! দরিয়াবিবি হাসিয়া উঠিল। ইয়াকুব কান খাড়া করিল। কথাটা বিদ্রুপের মতো শুনাইতেছে না তো? কিন্তু কিছু উপলব্ধি করিতে পারে না। দরিয়াবিবি কোনো সুযোগ না দিয়া বলিল, তুমি যত্নআত্যি কোথায় দেখলে?

কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা দোকানদারী ভাব।

ইয়াকুব মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়। তবু আবহাওয়া আরো সন্নিকট করিতে বলিল, না, ভাবী, এসব কপালের কথা। এমন শান্তি আমি ঘরেও পাই না।

তোমার তো খোদার মরজি দুবিবি আছে?

বিবি! বিবি কোথায় দেখলেন ভাবী?

ঘরের সে দুটো তবে কি?

গোশতের ঢিবি।

দরিয়াবিবি এবার হাসিয়া ইয়াকুবের দিকে তাকাইল। তখনই চোখ নামাইয়া বলিল, আমি বিবিসাবদের দেখিনি। মোটা হলে যদি গোশতের ঢিবি হয়, আমি তো গোশতের পাহাড়।

না ভাবী। আপনি সংসারের লক্ষ্মী।

দরিয়াবিবি এই প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয়। সেও হাসিতে থাকে এবং বলে, নূতন কথা শোনালে ভাই।

ইয়াকুব এই নৈকট্যের প্রাসাদই তো চায়। সে খুশি হইয়া বলিল, বাচ্চাদের ডাকেন, আমাকে আর দুটো লুচি দিন।

সহজ গলায় দরিয়াবিবি জবাব দিল, বাচ্চারা পরে খাবে। তুমি এখন খাও।

ইয়াকুব খাওয়া শেষ করিয়া বলিল, ভাবী, আমি একটু বেড়িয়ে আসি। আপনাদের গা খানা বড় জংলাটে। টাকা পকেটে করে ঘোরা যায় না। আমার ব্যাগটা রাখেন।

আমার কাছে কেন?

ইয়াকুব টাকার ব্যাগ হাতে বলিল, চুরি হওয়ার ভয় আছে।

কত টাকা আছে?

পাঁচশ।

না ভাই। এত টাকা–হঠাৎ রাত্রে চোর এসে নিয়ে গেলে।

আপনার কাছে চোর টাকা চুরি করতে আসবে না। ইয়াকুব মৃদু হাসি ছিটাইয়া বলিল।

তবে কেন আসবে?

কথা ঘুরাইয়া ইয়াকুব জবাব দিল, চোরের ভয় নেই? আপনার যা সাহস। আমার গোশতের ঢিবিরা এমন জংলা জায়গায় থাকলে দশটা দারওয়ান রাখতে হত।

দরিয়াবিবি হাত পাতিয়া দিল। ইয়াকুব মানিব্যাগ দিতে বিলম্ব করিল না। বাহিরে তখন গোধূলি। ইয়াকুব বাহির হইয়া আসিল। দরিয়াবিবি আঁচলে ব্যাগ বাঁধিয়া আবার কাজে মনোযোগ দিল।

পরদিন দুপুরে ইয়াকুব গঞ্জের নৌকা ধরিবে। যাইবার সময় সে বলিল, ভাবী, আমার ব্যাগটা দিন।

দরিয়াবিবি আমানত ফিরাইয়া দেওয়ার সময় বলিল, ভাই, তোমার কাছে একটা আরজ আছে।

ভয়ানক অধীরতা প্রকাশ করিল ইয়াকুব। সে ভাবিয়াছিল, ব্যাগে আরো টাকা আছে, হয়ত দরিয়াবিবি ঋণের আবেদন জানাইবে।

আপনার আরজ কি? হুকুম বলুন। তাড়াতাড়ি বলুন।

একটা খোঁজ-খবর নিও।

তা আর নেব না। আমি মনে করেন আপনাদের পর, ভাবী? ইয়াকুব দরিয়াবিবির মুখের দিকে তাকায়। সে কিন্তু নতমুখী। দৃষ্টি মাটির উপর কি যেন খুঁজিতেছে।

খুব মৃদু কণ্ঠেই দরিয়াবিবি জবাব দিল, আমাদের খোঁজ নয়।

ইয়াকুব হতাশ। আবার প্রশ্ন করিল, তবে কার?

তোমার ভাইয়ের খবরটা।

ওহ্ আজহার ভাইয়ের! তিনি তো খেয়ালী লোক, আসবেন একদিন। ইয়াকুব জবাব দিল অত্যন্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে।

তার জন্য আপনি এত উতোলা কেন? বিস্ময় প্রকাশ করিল ইয়াকুব।

স্বামীর জন্য এত মাথাব্যথা কেন, তুমি তা-ই জিজ্ঞেস করছ? দরিয়াবিবি সোজাসুজি ইয়াকুবের দিকে তাকাইল।

না-না, তা নয়। আমি ভাবছি, একটু বিরাগী ধরনের মানুষ তার জন্যে ভেবে লাভ কী। ইয়াকুব তখনই দৃষ্টি নামাইয়া অপরাধী সুলভ কণ্ঠে জানাইল।

তবু ভাবতে হয়। শহরে মালপত্র কিনতে তোমার লোক যায়, তাই খবর নিতে বলছি।

নিশ্চয়, খবর নেব বৈকি। আমি তার কোনো ত্রুটি রাখব না।

নিও ভাই। আল্লা তোমার ভালো করবে। দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বরে কোনো খাদ ছিল না।

গঞ্জের বেলা হয়ে গেল। আপনাকে খবর দেব, আপনি নিশ্চিত থাকেন।

ইয়াকুব আর দেরি করিল না। দরিয়াবিবি ঘরে ফিরিয়া আসিল।

৩১-৩৫. দরিয়াবিবি আগে

দরিয়াবিবি আগে আশপাশের দুএকটি ভিটা ছাড়া আর কারো বাড়ি যাইত না। তার নিজেরও লজ্জা করিত। তা ছাড়া ছিল আজহারের ভয়। এমনি শান্ত মানুষ, কিন্তু বেশরিয়তী দেখিলে আর রক্ষা ছিল না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাংসারিক প্রয়োজনে দরিয়াবিবিকে। অন্য পাড়ায় যাইতে হয়।

আমিরন চাচির বাড়ি পাড়ার এক টেরে। পথে এত ঝোঁপ-জঙ্গল। আর এই সড়ক প্রায় নির্জন থাকে। কারণ লোক-চলাচল কম। দরিয়াবিবির পর্যন্ত ভয় হয়। তাই সঙ্গে আমজাদকে লইত। নঈমা মা ছাড়া ঘরে থাকে না। সেও প্রায়ই সঙ্গে যায়। আমজাদের এই পথে হাঁটিতে খুব আরাম লাগে। সে এইজন্যে মাঝে মাঝে আমিরন চাচির বাড়ি চল বলিয়া দরিয়াবিবির কাছে বায়না ধরে।

চাচির বাড়ির আরো আকর্ষণ ছিল। আমিরন চাচি ঘরে ছেলেদের জন্য মোয়া, নাড় ১৭৬

কিছু-না কিছু সব সময় মজুদ রাখে। আর আম্বিয়া মেয়েটি বড় প্রাণবন্ত। সেখানে গেলে মেয়েদের গল্পের অবসরে বেশ কিছুক্ষণ খেলা করা যায়।

আমজাদ সেদিন জিদ ধরিয়া দরিয়াবিবিকে চাচির বাড়ি লইয়া গেল। হাতে বিশেষ কাজ নাই। দরিয়াবিবির কোনো আপত্তি ছিল না। সেখানে গেলে মন কিছু হালকা হয়।

আমিরন চাচি গরুকে এই মাত্র জাব দিয়া হাত ধুইতেছিল। হঠাৎ দরিয়াবিবি ও ছেলেদের দেখিয়া স্মিতহাস্যে সাদর অভ্যর্থনা জানাইল, এসো বুবু এসো। আরে, আজ আমজাদ চাচা, নঈমা খালা সুদ্ধ এসেছ। ও আম্বিয়া, বেরিয়ে আয়।

ডাক দেওয়ার আগেই মেয়ে হাজির।

আম্বিয়া আর একটু ডাগর হইয়াছে। চাঞ্চল্য আদৌ কমে নাই। সে আমজাদের দুই। হাত ধরিয়া বলিল, আমু ভাই, চল ঘুঘুর বাসা দেখে আসি। তালগাছের পাশে একটা করঞ্জা গাছের কোটরে বাসা বানিয়াছে।

চল।

আর কার তোয়াক্কা। আম্বিয়ার পিছু পিছু আমজাদও দৌড়াইতে লাগিল। পিছন হইতে আমিরন চাচি চিৎকার দিয়া ডাকিল, তোরা বেশি ঝোঁপের ভিতর যাসনি, বড় সাপের জুলুম বেড়েছে। কিন্তু তার কথা কে শোনে?

আমিরন চাচি পান সাজিয়া দিল। দরিয়াবিবির সাধারণত পান খাওয়ার অভ্যাস নাই। তবে চাচির দান প্রত্যাখ্যান করে না।

আমিরন চাচি জিজ্ঞাসা করিল, আজ কি রান্না হল?

রান্না সেরে এসেছি।

আমিরন চাচি যেন প্রশ্নের জবাব পাইয়াছে। তাই অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল।

আমার দেওরটা আসলে লোক খারাপ ছিল না।

আমিরন চাচির কথার মধ্যে দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আবার জুলুম ধরেছে নাকি?

অভ্যেস আর সহজে যায়! সেদিন খামাখা আমার ঝাড়ের দুখানা বাঁশ কেটে নিল। নিক, ওর ছেলের কবরে লাগবে। আমিরন চাচির গলা হইতে যেন এক ঝলক আগুন বাহির হইল।

দরিয়াবিবিও ঘৃণা প্রকাশ করিল, বেওয়া মানুষ, তাকে দুগাছি এনে দেওয়া দূরে থাক, তারই চুরি, এসব সইবে না।

ওদের সয়। পরের মেরে মেরে বড় হচ্ছে। এদিকে লেফাফা ঠিক আছে। আজকাল আবার মসজিদের মুয়াজ্জিনগিরি করে।

নঈমার চোখ দিয়া পানি পড়ে। সে দৌড়াদৌড়ি আর ভালোবাসে না। চাচি দুটি মোয়া দিয়াছিল। সে তা চিবাইতে ব্যস্ত। বোধহয় গলায় বাঁধিয়াছিল, তাই চাচির নিকট পানি চাহিল।

কথায় ছেদ পড়িল। দরিয়াবিবি তখন চাচির উঠানের চারিদিকে চাহিয়া থাকে। এখানে আসিলে সত্যি, বুকে জোর পাওয়া যায়। বিধবা মানুষ। অথচ সংসার বেশ চালাইয়া যাইতেছে। উঠানটি নিখুঁত পরিষ্কার থাকে। আশপাশে সজি আনাজের গাছ। গত বছর চাচি একটি লেবু গাছ লাগাইয়াছিল। তা-ও পত্র-সম্ভারে বাড়িয়া উঠিয়াছিল। সংসার বড় নয়, এইজন্যই আমিরন সামাল দিতে পারে। দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল।

আমিরন চাচি পানির গ্লাস নঈমার হাতে দিল।

ওর জন্য আবার গ্লাস দিয়েছ, এখনই ভাঙবে। দরিয়াবিবি সাবধান করিল।

আমিরন চাচি আপত্তি জানাইল, আমি ধরে আছি। ঘরে কিইবা আছে বুবু। এই গ্লাসটা, তোমার ভাই তখন বেচে হরিশপুরের মেলা থেকে এনেছিল।

আমার ঘরেও সব ভেঙেছে। পুরাতন কাঁচের দুচারটে জিনিস আছে, তুলে রেখেছি। কেউ মানুষ জন এলে বের করতে হয়। দরিয়াবিবি সায় দিল।

আমিরন চাচির সময় কম। বিকালে গরু বাছুরের খবরদারীতে বহু সময় যায়। শাজসজির গাছ আছে আশপাশে; পানি না দিলে চলে না। চাচি তাই দ্রুত কথা বলিতেছিল। আজ মোনাদির কি আজহারের প্রসঙ্গ আমিরন চাচি মুখ দিয়া বাহির করিল না, পাছে দরিয়াবিবি কষ্ট পায় বা হঠাৎ কেঁচো খুঁড়িতে সাপ বাহির হয়।

কিন্তু কথা প্রসঙ্গে এই সাপই ছোবল তুলিল।

আমিরন চাচি বলিতেছিল, বুবু, একা মানুষ হলে আমি কি ভয় পেতাম। তেমন ডরানেওয়ালী মায়ে পয়দা করেনি। কিন্তু ঐ যে-এক গলার কাঁটা রয়েছে।

দরিয়াবিবি কথাটা ঠাহর করিতে পারিল না সহজে। গলার কাঁটা। বিস্ময় প্রকাশ করিয়া সে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।

আমিরন চাচি হাসিয়া উঠিল। তুমি আমার গলার কাঁটা দেখনি? বলিয়া আবার হাসিতে লাগিল। দরিয়াবিবি খামাখা হাসে, আর সত্যিই চাচির কণ্ঠনালীর দিকে তাকায়।

আমিরন চাচি হাসে আর বলে, তুমি ডাক্তার হেকিম হলে আমার কাঁটা দেখতে পেতে।

আমাকে আগে বল নি, বুবু! দরিয়াবিবির বিস্ময়ের অবধি নাই। আমিরন চাচি আরো হাসিতে থাকে। আর বিশেষ বেলা নাই। তাই বলিল, দাঁড়াও বুবু, গলার কাঁটা দেখাচ্ছি। অ আম্বিয়া, অ আম্বিয়া। শেষের দিকে চাচি চিৎকার জুড়িল।

নিকটেই ছিল, আমজাদ ও আম্বিয়া আসিয়া উপস্থিত। ঐ আমার গলার কাঁটা, চাচি আম্বিয়ার দিকে আঙুল বাড়াইল।

কি মা? আম্বিয়া খেলা ছাড়িয়া আসিয়াছে। এখানে দাঁড়াইতে রাজি নয়।

যা, খেল গে।

ছেলেমেয়ে দুটি আবার দৌড়াইয়া পালাইল। তখন দরিয়াবিবি হাসিতে হাসিতে বলে, তুমি লোককে এমন বোকা বানাতে পারো।

গলার কাঁটা নয়? একা হলে ঝাড়া হাত পা যা খুশি করতাম। যেমন ইচ্ছে থাকতাম। বুবু, এখন কত কথা ভাবতে হয়। মাঝে মাঝে রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবনায় নিদ ধরে না। চাচির মুখের উপর দিয়া ছায়া খেলিয়া গেল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া দরিয়াবিবি বলিল, বুবু, আমার কতগুলো দ্যাখো। সব তো বেঁচে নেই। এইগুলো তো আমার পায়ের বেড়ি। কবছরে কি যেন হয়ে গেলাম।

তবু ওদের ছাড়া ঘর মানায় না। হাসুবৌটার দশা দ্যাখো। সোয়ামির চোখের বালি, শাউড়ীর কাঁটা। একটা ছেলেপুলে নেই।

ও বেশ আছে। যার নেই, তার এক ধান্দা। যার আছে তার শতেক ধান্দা।

হক কথা বুবু।

আমার মুনিটা এখানে থাকলে, আমি কোনো কিছুতেই ভয় পেতাম না।

আমিরন চাচি এই প্রসঙ্গ এড়াইতে চায়। কিন্তু দরিয়াবিবি রেহাই দিল না।

মুনি থাকলে, আমি আম্বিয়াকে ঘরে নিয়ে যেতাম। কি তোমার কাছেই থাকত। তোমার আর কেউ নেই–একটা ছেলে সংসারে বাড়ত।

আমিরন চাচি যেন চাঁদের স্বপ্নে বিভোর। বলিল, বুবু, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ক। আহ্ আমার কি সে কপাল হবে। তুমি রাজি হলেও, খাঁ ভাই? তোমার উঁচু খাঁ বংশ।

তালপুকুর ঘটি ডোবে না। বেশ ব্যঙ্গসুরে দরিয়াবিবি বলিল, আমার ছেলের বিয়ে দিলে কে কী বলবে? সে তো আর মোনাদিরের বাপ নয়।

আমিরন চাচি বড় খুশি হয়। কিন্তু মিথ্যা কল্পনা, তা উপলব্ধি করেও।

কিন্তু ছেলেটা চলে গেল–

দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ হইয়া পড়িল। আমিরন চাচি তাড়াতাড়ি ছেলেদের ডাকিয়া নাড় খাওয়াইল। সেই হট্টগোলে সহজ আবহাওয়া ফিরিয়া আসে। সন্ধ্যা হইতে আর দেরি নাই। দরিয়াবিবি কাজের মর্যাদা জানে। চাচিকে সে ছুটি দিল।

পৃথিবী কত বড়। পাল্কি-জানালার ফাঁক দিয়া কতটুকু আর দেখা যায়। ঝোপে ঝোপে এই সড়ক পথে হাঁটিবার সময় আমজাদের মতো দরিয়াবিবিও অদ্ভুত আস্বাদ পায়।

গা-ঢাকা সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। জঙ্গলে জঙ্গলে তখন জোনাকিরা প্রদীপ কাড়াকাড়ি শুরু করিয়াছিল।

.

৩২.

চন্দ্র একরাশ তাড়ি গিলিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। ভিটার কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল, তার ঘাড়ে একটি আধপোড়া চেলা কাঠ। শ্মশান হইতে চন্দ্র তুলিয়া লইয়াছিল, তা আর বুঝিতে দেরি হয় না।

দুপুর বেলা মাঠে কেউ থাকে না। এতক্ষণ আপনমনে চন্দ্র গান করিতেছিল। কিন্তু বাড়ির কাছে হঠাৎ গান বন্ধ হইয়া গেল। গায়ক পর মুহূর্তে যোদ্ধা সাজিয়াছে। কোটাল পোড়া চেলা কাঠখানি বাই-বাই শব্দে ঘুরাইতেছে আর মুখে হট-যাও, হট যাও রব।

চন্দ্রমণি, তার ছেলেরা আর কোটালের স্ত্রী হঠাৎ হিন্দি চিৎকার শুনিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। প্রথমে বিস্ময়, তারপর সকলে তামাশা দেখিতে লাগিল। চন্দ্রমণির দুই ছেলে মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিয়া খুন। কোটালের স্ত্রী কিন্তু খুব চটিয়াছিল। তাড়ি তো চন্দ্র কোটালের কাছে জল। আপত্তি সেখানে নয়। এই অবেলায় মড়াকাঠ কাঁধের উপর! এমন অলুক্ষণে কাণ্ড কোটাল-স্ত্রীর সহ্যের বাহিরে।

সেও চিৎকার করিয়া বলিল, তুমি এসো ঘরে, তোমার হট-যাও আমি বের করব। চন্দ্রমণির চোখ ভ্রাতৃজায়ার দিকে। ছি ছি, দাদার যত বয়স বাড়ছে, তত ঢিটেমি বাড়ছে।

তুমি ঐ কাঠ নিয়ে ভিটের উপর একবার ওঠো দেখি। কোটাল-গিন্নী শাসাইতে লাগিল।

চন্দ্র হঠাৎ চেলাকাঠ ঘুরানো থামাইল, তারপর চিৎকার করিয়া শুধাইল, কিয়া হুয়া।

কিয়া হুয়া? তোমার হুক্কাহুয়া বের করব, একবার ওঠো দেখি। কোটাল আবার যোদ্ধার হুঙ্কারে চেলাকাঠ ঘুরাইতে লাগিল। কিন্তু ভিটার নিকটে কয়েকটা চারা করঞ্জা গাছের কাছে আসিয়া থামিল। যোগীন তখন মামার উদ্দেশে ডাক দিল, মামা, উপুরে এসো না, মামী মারবে।

চুপ বেটা। আমি জমিদার হ্যাঁয়, হ্যামকো কোন রোকেগা। কাঁধে গদা লইয়া ভীমের মতো চন্দ্র সটান খাড়া হইল। বাবরী চুল বাতাসে এলোমেলো। চক্ষু দুটো নেশার ছলকে গোল ভাটার মতো। যোগীর ছোট ভাই তো রীতিমতো ভয় পাইয়া মার আঁচলে আশ্রয় লইল।

ভিটার উপরে কোটাল-পত্নী কোমরে কাপড় জড়াইয়া হুংকার ছাড়িল, মড়াকাঠ ফেলে ভালো মানুষের মতো আবার নদীতে স্নান করে এসো। না হলে স্ত্রীর বদ্ধমুষ্টি, চন্দ্র ভালোরূপে ঠাহর করিল।

হট-যাও, হাম জমিদার হ্যাঁয়। তারপর কোটাল সমস্ত মাঠের দিকে আঙুল অর্ধবৃত্তাকারে বাড়াইয়া বলিল, হট যাও, সমস্ত জমি আমার হ্যাঁয়। ইয়ার্কি পায়া হায়– রোকদেগা।

একবার ভিটের উপর উঠে দ্যাখো। কোটাল পত্নী ভ্যাংচাইয়া বলিল।

কোটাল জবাব না দিয়া চেলাকাঠখানির সাহায্যে ধাই ধাই চারা গাছগুলি পিটাইতে লাগিল আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার–এইসব আমার প্রজা আছে-বাত নেই শোন্তা? কিছুক্ষণ এই তরুপ্রজা ঠ্যাঙ্গানো চলিল। ভিটার উপরে সকলে তখন বেদম হাসিতে শুরু করিয়াছে।কোটালের বীরোচিত শৌর্যের উৎসাহ আরো বাড়িয়া যায়।

গিন্নী চিৎকার দিল, এই পাগল পাগল।

পাগল! যোদ্ধা মুগুর উঁচাইয়া থামিল। প্রথমে ব্যঙ্গের হাসি, পরে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছাড়িল, পাগল! জমিদার শালা পাগল?

পাগল, পাগল।

ছেলেরা চিৎকার দিয়া হাসিল, পাগল, পাগল!

সব মার ডালেগা–বলিয়া মুগুর-বিশারদ আবার কল্পিত প্রজাদের শায়েস্তা করিতে লাগিল। নেশা বেজায় চড়িয়াছিল।

প্রতিপক্ষ তখন হাসিয়া লুটাইবার উপক্রম। সুযোগ বুঝিয়া চন্দ্র ভিটার দিকে এক পা অগ্রসর হইল। তখন গিন্নী একটা চেলাকাঠ লইয়া দাঁড়াইল।

চন্দ্র চিৎকার দিয়া বলিল, পাগল না হলে মানুষ ঠ্যাঙায়? সব মার ডালো।

আবার মুগুরবাজি চলিল।

খিলখিল নারী হাস্যে তখন অবেলার রঙ আরো ঘন হয়।

কতক্ষণ এমন চলিত কে জানে? এই সময় আমজাদ ভিটার পথে উপস্থিত হইল। দরিয়াবিবির জরুরি আদেশেই সে এই দিকে আসিয়াছিল। ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। কাকার নূতন কীর্তি। কিন্তু সে রণদেহি মূর্তি দেখিয়া বেশ ভয় পাইয়াছিল। মার আদেশ হাতে করিয়াই ফিরিয়া যাইবে কিনা ভাবিতেছিল। হঠাৎ যোদ্ধার নজর সেদিকে গেল।

প্রজারা নিস্তার পাইল। মুগুর উঁচাইয়া মহাবীর আমজাদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমজাদের ভয়ে মুখ শুকাইয়া যায়। সে সাহসের উপর ভর দিয়া বলিয়া ফেলিল, কাকা আপনাকে মা ডাকছে। খুব দরকার।

যোদ্ধার কানে যেন কথাটা গেল না। গজেন্দ্র-গমন ও স্কন্ধ-শোভিত গদা অবিচল থাকে।

কিন্তু চন্দ্র ভয়ের ফুরসৎ দিল না। হঠাৎ গদা ফেলিয়া সে আমজাদকে কাঁধে তুলিয়া লইল। ছেলেবেলা বেশ মজা লাগিত! এখন আমজাদ কিশোর, তার বড় লজ্জা করে। কাকা, আমাকে নামিয়ে দাও। সে মিনতি জানাইল। কিন্তু নেশাখোর নিজের খেয়ালে বিভোর। কবিগানের সর্দার তখন গান ও নৃত্য জুড়িয়া দিয়াছে।

চাচা এল অবেলায়।
এখন কোথায় কি পাই?
খেতে দেওয়া দায়।
হাঁস রয়েছে পুকুর পাড়ে
মুরগি আর ডিম না পাড়ে
ঝোপে-ঝাড়ে বন-বাদাড়ে
শেয়ালছানাও নাই।

চন্দ্র হঠাৎ মাথা ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া উঠিল, তওবা, মুসলমানের ছেলে। তারপর ওয়াকশব্দে থুথু ফেলিল। গানের নূতন কলি শুরু হয়।

ভাইপো তুমি কর না ভাবনা
আমি ওসব কিছুই খাব না।
ঘরে আছে মুটকী চাচী
তারে কর না জবাই ॥
আহা চাচা, আক্কেল বটে
বলিহারি, বলিহারি যাই ॥

চন্দ্র খাঁ-পাড়ার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ভিটার উপর হাসির মওজ ছুটিল। পড়ন্ত বেলা। দিকে দিকে রঙ লাগিয়াছে। ঝাঁকুনি খাওয়া গান মাঠে মাঠে রেশ রাখিয়া যায়।

ঘরে আছে মুটুকী চাচী
তারে কর না জবাই।

সলজ্জ, তবু আমজাদ কাঁধের উপর হাসিতে লাগিল।

.

৩৩.

বছর ঘুরিয়া গেল।

সূর্য-প্রদক্ষিণ শুধু স্থাবর-জঙ্গমের সহগামী নয়। সংসারের বিচিত্র প্রক্ষেপও সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়। সচ্ছলতা-অনটন, হাসি-কান্না বিচিত্র ছন্দ তার দাগ রাখিয়া যায়।

এই আবর্ত দরিয়াবিবিকে টানিয়া লইয়া গেল ক্রমশ দিশাহারা পথে। এক ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হইয়াছিল স্বামী আর নিরুদ্দিষ্ট প্রবাসী নয়। আজহার ফিরিয়া আসিয়াছিল মাত্র তিন সপ্তাহের মেয়াদ লইয়া। এক বছরে কত কি-না করিয়াছে। রাজমিস্ত্রী তার আদিম পেশা, ইটের পাঁজার সর্দারী, মসজিদের সহকারী আর মনোহারীর দোকান–তার আর এক মরীচিকা-মাখা শখ। নূতন মোড় ফেরার স্বপ্নে সে ফিরিয়া আসিয়াছিল। বাড়ি ফেরার আগে সে একটি দোকান পাতিয়াছিল। তার নিরীহ শান্ত মনেও তখন অস্থিরতার ছোঁয়াচ। নিজের দিকে সে নিজে চাহিতে শিখিয়াছিল। নামাজে মন থাকে না। জায়নামাজের পাটির উপর কখনো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে সেজদা দিতে গিয়া। কেন এমন হয়? কোটাল চন্দ্র তো বিধর্মী। তার চেয়েও দুঃখী। কিন্তু সে আনন্দের অধিকারী। জীবনের ঝাপ্টা তার পাখনাকে পঙ্গু করিতে পারে নাই। অথচ-সে! বুকের ভিতর বাঁচা ও সংসার গোছানোর হাজার তৃষ্ণা লইয়া কলে-পড়া মূষিকের মতো পরিত্রাণের আশায় দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করিতেছে। সকলের রুজি-দেনেওয়ালা আল্লার উপর তার বিশ্বাস কতটুকু? আজহার ক্লান্ত অবসর সময়ে নিজের কাছে এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজিত। শেষদিনে হঠাৎ দাম লইয়া এক খরিদ্দারের সঙ্গে ঝগড়াই করিয়া বসিল। পরদিন দোকান বিক্রয় হইয়া গেল। আবার গ্রামেই সে ফিরিয়া যাইবে। চন্দ্রের কাছে জিজ্ঞাসা করিবে, বাঁচার আনন্দ সে কোথা হইতে পায়? রহিম বখশ, হাতেম খাদের চন্দ্র ঘৃণা করে। এই ঘৃণার মধ্যে কী আনন্দ আছে? ঘৃণা তো হিংসা। এমন পাঁকের মধ্যে পদ্মফুল ফোটে? আর যা-ই করুক, চন্দ্রের সঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ সে মিলাইয়া দিবে। সে তাড়ি খাক, নাচুক বা গান করুক, তা দেখার আবশ্যক নাই আজহারের। আজহার বুকে নূতন জোর পাইয়াছিল। মাঠের মাটির সঙ্গে সে কেন প্রবঞ্চনা করিবে না আর। জীবনের বোঝাঁপড়া হোক আবার। চন্দ্রের সঙ্গ আজহারকে উতোল করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু গ্রামে সে তো একা আসিল না। জেলা-জেলার ঘোরার ফলে বাঁকুড়ার দুরন্ত ম্যালেরিয়া আগেই দেহে বাসা বাঁধিয়াছিল। মাঝে মাঝে ভুগিতে হইত। পথেই নূতন প্রতিক্রিয়া শুরু। শেষ অঙ্ক মহেশডাঙায় অভিনীত হইল মাত্র।

নিরীহ ঈমানদার মানুষ– এইজন্য সমশ্রেণীর বন্ধুদের নিকট হইতে এই কয়েকদিন আজহার সহানুভূতি কম পায় নাই। চন্দ্র কোটাল প্রায়ই বসিয়া থাকিত বণ্টার পর ঘণ্টা। বাক্যালাপ হইত নামমাত্র। তবু তার উপস্থিতির কামাই ছিল না। রোগ ক্রমশ বাড়িতে থাকিলে এক মন্দিরের ঠাকুরের কাছ হইতে চন্দ্র গাছের শিকড় আনিয়া আজহারের হাতে বাঁধিয়া দিল। অন্য সময় কত আপত্তি করিত, হয়ত দুইজনের মধ্যে চটাচটি হইয়া যাইত। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী আজহার আর এক মানুষ। চন্দ্রের নিকট নিজেকে সঁপিয়া দিতেই তো সে গ্রামে আসিয়াছিল। এই বাড়িতে আসিলে চন্দ্রের ছোঁয়াচ হাসি কাহাকে না স্পর্শ করিত। কিন্তু চন্দ্রও আজকাল ভয়ানক গম্ভীর। একদিন দম-ভর তাড়ি খাইয়া আসিয়াও সে চুপচাপ বসিয়াছিল। কারো প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় নাই। তারপর আপন মনেই বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছিল। এই সংসারের ভবিষ্যৎ যেন এখনই তার সম্মুখে জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতো খাড়া। সহানুভূতি, এমনকি ইয়াকুবের কাছেও, সীমাতীত ভাবে পাওয়া গেল। সে পাঁচ মাইল দূর হইতে পাল্কি করিয়া পাস করা ডাক্তার আনিল। তখন শেষ অবস্থা। ডাক্তার কোনো আশা দিতে পারিল না।

দরিয়াবিবির একদা-তেজ যেন উবিয়া গিয়াছিল। অবশ্য গৃহস্থালীর কাজ ও সেবার কোনো ত্রুটি ছিল না। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রোগীর বিছানার পাশে আসিয়া বসিয়া থাকিত। কিন্তু আজহার নির্বিকার। নিজের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার কোনো সচেতনতা ছিল না। দরিয়াবিবির দিকে একবার চোখ তুলিয়া চাহিয়াও দেখিত না সে। পাষাণের মতো নিঃসাড় খোলা দুই চোখ আর দেখার কাজে লাগে না যেন এখন তা চিরন্তন হাতিয়ার। দরিয়াবিবি কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করিলে হাঁ-না-রবে তার পরিসমাপ্তি হইত মাত্র। এই নীরবতা দরিয়াবিবিকে ভয়ানক চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। স্বামীর কাছে নঈমা বা আমজাদকে ঘন ঘন পাঠাইত। কথা হইত শুধু নঈমার সঙ্গে। সে-ই যেন শুধু তার সব কথা বুঝিতে পারে। দরিয়াবিবি পিতা ও কন্যার কথোপকথনকালে উপস্থিত হইত। আজহার তখন নীরব। দরিয়াবিবি পাশে বসিয়া উঠিয়া আসিত ও অলক্ষ্যে চোখের পানি মুছিত। কত দায়িত্ব পিছনে পড়িয়া থাকিল, এই চিন্তা কি একবারও তোমার মনে জাগে না? দরিয়াবিবি ভাবিত, সে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবে। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিত না।

আজহারের গলায় কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হইতেছিল। আজকাল সারারাত্রি পিদিম জ্বলে। দরিয়াবিবি উঠিয়া তখন জিজ্ঞাসা করিল, কষ্ট হচ্ছে?

না। তারপর আজহার দরিয়াবিবির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমুর মা, আমি। কথা থামিয়া গেল।

দরিয়াবিবি তখন জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে কিছু বলবে?

মাথা নাড়িয়া আজহার সম্মতি জানাইল ও পলকহীন চোখে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইল।

অধীর দরিয়াবিবি সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে শুধাইল, কিছু বলবে?

আজহার কোনো কথা বলিল না। শীর্ণ হাতখানি দরিয়াবিবির হাতের দিকে বাড়ানোর পথে আবার মুষ্ঠিবদ্ধ করিয়া লইল। চোখ তেমনই পলকহীন। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো প্রতিধ্বনি ছিল না এই নীরবতার মুখোমুখি। এখনি এই ঠোঁট হইতে কথা ঝরিবে। দরিয়াবিবি আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল। কিন্তু আর কোনো কথা বলা হইল না। জীবন-যোদ্ধা পৃথিবীর কাছ হইতে ইত্যবসরে ছাড়পত্র পাইয়াছিল। শুধু চোখ দুটি তখনো সজীব। দরিয়াবিবি তাহা বুঝিতে পারে নাই। মৃত স্বামীর চোখের দিকে দৃষ্টি পাতিয়া সে চাহিয়া রহিল, চাহিয়া রহিল।

.

৩৪.

আমিরন চাচি যুক্তি দিয়াছিল, আরো হাঁস-মুরগি, বকরী-খাসি পোষো। বুবু। কোনো রকমে দিন চলবেই। তোমার ভাই মারা যেতে আমিও চোখে আন্ধার দেখেছিলাম। এখন বুক বাঁধতে হবে, ভাবনা করলে তো দিন যাবে না।

দরিয়াবিবি কথায় সায় দিয়াছিল। কিন্তু তার পক্ষে বাধা অনেক। সে পর্দানশীনা। কাছে মাঠ নাই। আমজাদ লেখাপড়া আগেই ছাড়িয়া দিয়াছিল। গরু-বাছুর মাঠে লইয়া যাইতে নিমরাজি। ইলেমের এমনই প্রভাব। আজহারকে সে খুব ভয় করিত, তাই মুখের উপর কোনো জবাব দেওয়ার সাহস পাইত না। এখন সে বেপরোয়া। চাষাবাদ তার ভালো লাগে না। চন্দ্র কাকার সঙ্গে প্রথম বছর চাষাবাদে গায়ে-গতরে খাঁটিয়াছিল। কিন্তু ধান বেশি হইল না। মাটির জন্য দরদ ছিল না। নিড়েন ঠিকমতো দেওয়া হয় নাই। পর বৎসর চন্দ্র কোটাল তাই তিন বিঘা জমি বিক্রয় করিয়া দিতে বলিল। গ্রহীতা ইয়াকুব। দেড় বিঘা জমি ছিল, আমজাদের জন্য তাহাও বিক্রয় হইয়া গেল। চন্দ্র কাকার সংস্পর্শে তার ভালো লাগে না। এত মেহনত আমজাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দরিয়াবিবি রাগ করিলেও পুত্রের উপর ক্ষোভ ছিল না। তের বছর বয়সের পক্ষে চাষাবাদ যেন ঠাট্টার ব্যাপার।

আমিরন চাচির সংসার ছোট। কিন্তু দরিয়াবিবির সংসারে এতগুলি পেট চালানো সহজ নয়। প্রথম দিকে সহানুভূতি কারো কম ছিল না। কিন্তু তারও সীমা আছে। বেচারা চন্দ্র নিজেই অস্থির। সে চাষ করে, মাছ ধরে, গান করে। কিন্তু সব সময় রোজগার হয় না। তবু তার আন্তরিকতা অকৃত্রিম। নিজে না আসিলেও বোনকে পাঠাইয়া খোঁজ-খবর লয়। এলোকেশী খালি হাতে আসে না। কোনোদিন মাছ, মাঠের ফসল, অন্তত একফালি কুমড়া হাতে সে লৌকিকতা রক্ষা করে।

চারিদিকে ভাঙন। নঈমার চোখে আজকাল খুব পিচুটি জমে। চোখে ভালো দেখে হয়ত অন্ধ হইয়া যাইবে।

ইয়াকুব মাঝে মাঝে চিরাচরিত আড়ম্বরে আসে। মাঝে মাঝে টাকাও সাহায্য করে। দরিয়াবিবি কর্জ চাহিতে লজ্জা পায় না। কিন্তু এইভাবে দিন কতদূর গড়াইতে পারে। আগে ঘরে দুধ ছিল। এখন গাইটা অল্প দুধ দেয়, তা-ও বিক্রয় করিতে হয়। শমী-র মুখে দুধ ওঠে না। তিন বছরের মেয়ে ভাত ধরিয়াছে বড়দের মতো। তার মাঝে মাঝে পেটের অসুখ করে, সহজে সারে না। শুধু শরীরের কাঠামোর জোরে টিকিয়া আছে।

দুঃখের পেয়ালা পূর্ণ করিবার জন্য এমনই দুর্দিনে মোনাদিরের পত্র আসিল। সে লিখিয়াছে :

মা, আমার সালাম জানিবেন। বহুদিন বহু জায়গায় ঘুরিয়া আমি এখন স্কুলে পড়িতেছি। পাঁচটা টাকা যদি মাস-মাস আমার জন্য পাঠান, কোনো রকমে আমার দিন চলিতে পারে। আপনাদের অসুবিধা হইলে পাঠাইবেন না। আমার দিন এক রকমে চলিয়া যাইবে। আমু, নঈমাদের জন্য আমার স্নেহ।
ইতি
আপনার স্নেহের
মুনি

একটি ইনভেলাপে পত্ৰ আসিয়াছিল। আমজাদ পড়িয়া শোনাইল। দরিয়াবিবি যুগপত আনন্দ ও নিরাশায় খামখানি হাতের মুঠায় ধরিয়া ভাবিতে লাগিল। তিন-চার বৎসর। অতিবাহিত। কত বড় হইয়াছে মুনি! একটি দীর্ঘশ্বাসে দরিয়াবিবি এই চিন্তা সমাহিত করিল। পাঁচটি টাকা সাত রাজার ধন নয়। তবু সে-কথাই আগে ভাবিতে হয়।

আমজাদ পাশে বসিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, মা, মুনি ভাইকে টাকা পাঠাবে না?

পাঠাব। পাঠাতে পারবি?

তা আর পারব না! তুমি টাকা দিও, মনি অর্ডার করে আসব। পোস্টাপিস আছে পাশের গায়ে।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি দেখা দিল। আমজাদ এখনো কত অবোধ।

কিছুক্ষণ আগে আমজাদ সংবাদ আনিয়াছিল, এবার জমির ধান ইয়াকুব নৌকায় বোঝাই দিয়া লইয়া গিয়াছে। এতদিন জমি বিক্রয় হইয়াছিল। কিন্তু ধান, বর্গা পরিশোধের পর অর্ধেক পাওয়া যাইত। ইয়াকুবের করুণা! এবার তাও বন্ধ। জমি কিনিয়াছে, ফসল লইয়া যাইবে– বৈচিত্র্য কিছু নাই। তবু দরিয়াবিবি ক্ষোভে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। পুত্রের কাছে সংবাদ পাইয়া আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন সে মনে করে নাই।

মুনির পত্র হাতে ইয়াকুবের কথাই প্রথমে স্মরণ হইল ও হঠাৎ অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, পাঁচটা টাকা। আমজাদ তাহা শুনিতে পাইল না।

দুদিন পর ইয়াকুব এখানে পৌঁছিলে, দরিয়াবিবি তার শরণাপন্ন হইল।

ভাই, আমার একটা আরজ আজ তোমাকে রাখতে হবে।

আপনার আরজ। বলুন-বলুন। ইয়াকুব ভয়ানক আগ্রহ দেখাইয়া বলিল, আপনি এত চুপচাপ থাকেন।

ভাই, চুপচাপ কি সাধে থাকি। দেখছ না, কত সুখে আছি।

আপনার দুঃখ কি। আপনার মুখের হাসির দাম লাখ টাকা।

অন্য সময় এমন গায়ে-পড়া প্রশংসা দরিয়াবিবি বেয়াদবীর শামিল মনে করিত। আজ তা গায়ে মাখিয়া লইল। ইয়াকুব কিন্তু কথাটা বলিয়াই দরিয়াবিবির দিকে আড়চোখে তাকাইল।

লাখ টাকা নয়, পাঁচ টাকার আরজ।

মোটে। ইয়াকুব ঠোঁট কুঁচকাইল।

হ্যাঁ।

মোটে?

হ্যাঁ, কিন্তু মাস-মাস দিতে হবে।

কাউকে দেবেন?

হ্যাঁ।

কাকে?

তা কোনোদিন জানতে চেয়ো না।

আপনার যা হুকুম। ইয়াকুব হাসিয়া ঘাড় নোয়াইল ও কহিল, আপনি বলেন, আর কি দরকার। আপনি একদম পাথরের মতো কি-না, মুখে কিছু বলেন না। আজ ধান নিয়ে গেলাম। কই, কিছু তো বললেন না?

তোমার জমির ধান তুমি নিয়ে গেছ। কি আবার বলতে হবে? দরিয়াবিবির কণ্ঠে মোলায়েম ব্যঙ্গের সুর।

কেন বলবেন না? আপনারা আমার আপনজন। জমি কিনেছি বলে ধানও নিয়ে যাব?

নিশ্চয় নিয়ে যাবে।

আপনজনেরা এমন নিষ্ঠুর হয় না।

নিষ্ঠুর আবার কি?

নিশ্চয়। জিজ্ঞেস করতে তো পারতেন, কেন ধান নিয়ে গেলাম। থাক সে কথা। এখন আমাকে বলতে হয়। ঘরে আমার দুটি গোস্তের ঢিবি আছে। ইয়াকুব একগাল হাসি মুখ হইতে খালাস করিয়া বলিল, তাদের চোখ টাটায়। জমি কিনেছি অথচ ঘরে ধান যায় না। এবার তাই নিয়ে গেলাম। এই নিন ধানের টাকা।

ইয়াকুব পকেট হইতে পঁচিশ টাকা বাহির করিল।

এখন বাজার-দর আড়াই টাকা! দশ মণ ধান হয়েছিল। দরিয়াবিবি ইয়াকুবের দিকে তাকাইল। কৃতজ্ঞতার এমন দৃষ্টি কেহ কোনোদিন দরিয়াবিবির চোখে দেখে নাই।

ইয়াকুব মানিব্যাগ হইতে আবার পাঁচ টাকার একটি নোট বাহির করিল।

এই নিন। আমি মাসে মাসে এই টাকাটাও দেব।

দরিয়াবিবি হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।

ভাবী, আমাকে আপনজন মনে করবেন।

দরিয়াবিবি তার কোনো জবাব দিল না। ইয়াকুবের দিকে সোজাসুজি তাকাইল মাত্র। সে ভয়ে চোখ নামাইয়া লইল।

ইয়াকুবের হালচাল রাত্রে শুইয়া দরিয়াবিবি তোলপাড় করিতে লাগিল। বালিশের নিচে নোটখানি এখনো চাপা। অন্ধকারে হাতড়াইয়া দরিয়াবিবি নোটখানি নিজের চোখের উপর চাপিয়া ধরিল। ভয়ানক কান্না পাইয়াছিল তার।

চোখের পানি শুষিয়া লইতে এমন কাগজেরই যেন দরিয়াবিবির প্রয়োজন বেশি।

.

৩৫.

পোস্টাপিস হইতে আমজাদ একটি খাম কিনিয়া আনিয়াছিল।

দরিয়াবিবি বলিল, একটা চিঠি লিখে দে, আমু। তোর মুনি ভাই যেন তাড়াতাড়ি আসে। আমজাদ পত্র লিখিতে বসিল। এমন সময় হাসুবৌ হাজির হইল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে, হাসুবৌ, আর যে এদিকে এলে না? দশ-বারো দিন হল।

সন্তর্পিত হাসুবৌ চারদিকে চাহিয়া লইল, যেন তার আওয়াজ বেশিদূর না পৌঁছায়; অথবা কেউ আছে কি-না। পরে ফিসফিস শব্দে বলিল, শাউড়ীর মেজাজ জানো না, বুবু? এদিকে এলেই চটে। আর ছেলে হয়নি। আর খোটা ধরে শুরু করবে হাজার কাল্লাম।

কখন আসি, বুবু।

সাকের ভাই কোথায়?

তার ভাবনাতেও অস্থির ছিলাম। আবার কোন জমিদারের জমি দখলে গিয়েছিল।

মানা করতে পারো না?

মানা শোনে কৈ? এবার পায়ে চোট লেগেছে। চুন-হলুদ করে দিলাম কাল। আজ ভালো আছে। সাত আট দিন গিয়েছিল। এই জন্যেও ভেবে ভেবে অস্থির। ছাই, মন ভালো না থাকলে কি কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করে?

হাসুবৌ দরিয়াবিবির দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাইল।

সহানুভূতি জানাইল দরিয়াবিবি, তা ঠিক। মন ভালো না থাকলে খাট-পালঙ্কে শুয়েও সুখ নেই। অতঃপর আমজাদের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, আমু, আর অন্য কোনো কথা লিখিস নে। শুধু আমার কথা লেখ। আর আমরা ভালো আছি।

আমজাদ পেন্সিল চালাইতে চালাইতে জবাব দিল, আচ্ছা মা।

হাসুবৌ জিজ্ঞাসা করিল, কাকে চিঠি দিচ্ছ বুবু?

আমার মুনিকে।

মুনির খবর পেয়েছ?

হ্যাঁ।

সোবহান আল্লা। আমু চাচা, আমার দোয়া লিখে দিও। হাসুবৌ বড় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। পরে বলিল, কি সুন্দর ছেলে। অমন না হলে মায়ের কোল জুড়ায়!

আমার বুক জ্বলতেই রইল, হাসুবৌ। দরিয়াবিবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল।

বুবু, তোমার ধন তোমার বুকেই ফিরে আসবে। দেখ, আমার কথা নিশ্চয় সত্যি হবে। আমার মন বলছে।

সোনা-কপালী, তোমার মুখে কাটা যাই। তা যদি হয়, আমি এই অকূলেও কূল পাই।

ঠিক তোমার হক্কের ধন ফিরে আসবে।

পনেরো বছর বয়স। এখন কত বড় হয়েছে। আজ কবছর চোখের দেখা দেখতে পাইনি।

দরিয়াবিবির কাতরদৃষ্টি হাসুবৌকে স্পর্শ করিল। দুইজনে একে অপরের দিকে তাকায়।

আমজাদের লেখা শেষ হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

তবে আবার কি লিখবি?

লিখে দেব– আব্বা ইন্তেকাল করেছে।

ধমক দিয়া উঠিল দরিয়াবিবি, না, ওসব লিখতে হবে না।

আচ্ছা।

শান্ত আমজাদ যেন ঠাণ্ডা হইয়া গেছে, এমন উচ্চারণের ভঙ্গি।

হাসুবৌ উঠিয়া বলিল, এখন যাই বুবু। আমু চাচা, আমাকে একটু এগিয়ে দাও।

আমজাদ খুব রাজি। সে হাসুবৌর অনুসরণ করিল।

ভিটার নিচে সড়কের উপর দুই জনে দাঁড়াইল। গোধূলির ছায়ায় চারদিক বিষণ্ণ। হাসুবৌর গা এমন ঝোপে-ঝাড়ে সত্যি ছমছম করে। মহেশডাঙা জঙ্গল বলিলেই চলে। নিচের পথের সাদা-সাদা রেখা আবছা। দুপাশে ঝি ঝি ডাকা অনেকক্ষণ শুরু হইয়াছে। আমজাদের পিছনে হাসুবৌ।

কিয়দূর অগ্রসর হইলে বৌ আমজাদের হাত ধরিয়া বলিল, চাচা, আমার দোয়া লিখে দিয়েছো?

দিয়েছি, হাসু চাচি।

সত্য? কিরা দিচ্ছি আমার গা-ছুঁয়ে বল।

আমজাদ হাসুবৌর কাঁধ ছুঁইয়া বলিল, দিয়েছি, দিয়েছি, দিয়েছি, তিন সত্যি।

হাসুবৌ খুব খুশি হইয়া বলিল, কাল এসো চাচা, তোমার জন্য ক্ষীর বানিয়ে রাখব।

আচ্ছা, আসব।

আর মুনির চিঠি এলে খবর দিও, দেরি করো না চাচা।

হাসুবৌর অনুরোধ ভঙ্গি বড় অদ্ভুত দেখায়।

এবার তুমি যাও। এখন আমি বাড়ি যেতে পারব। পথে সাপ দেখে যাস, বাপ।

আমজাদের নিজেরই ভয় লাগিতেছে এবার। জবাব দেওয়ার জন্য সে আর বিলম্ব করিল না। তার সবচেয়ে বেশি ভয় সাপের।

৩৬-৪০. মোনাদিরের আর একটি পত্র

তিন-চার মাস পরে মোনাদিরের আর একটি পত্র আসিল। সে ঠিকানা বদল করিয়াছে। এক বাড়িতে জায়গীর ছিল। কোন কারণে তাহারা আর ছাত্র রাখিতে পারে না। তাই অন্যত্র গিয়াছে মোনাদির। সেখানে মাসিক পনেরো টাকার কম খরচ পড়ে না। এখন সে কি করিবে, তাহাই ভাবনার ব্যাপার।

দরিয়াবিবির মনে আন্দোলন করিতে লাগিল। পনেরো টাকায় তাহাদের সমস্ত মাস নির্বিঘ্নে চলিতে পারে। ধান যে কয় মণ পাওয়া যায়, তাহা দিয়া চার মাসের মাত্র খোরাক হয়। বাকি দিন আল্লাই চালান। কখনো আমজাদ চন্দ্রের সঙ্গে মুনিশ খাঁটিতে যায়। এত ছোট ছেলে লোকে লইতে চায় না। শুধু চন্দ্রের খাতিরে তিন আনা চার আনা দেয় মাত্র। গরু, বাছুর, মুরগি-হাস ডিম বিক্রি ইত্যাদির উপর দিয়া কোনো রকমে দিন গুজরান। ইহার উপর মুনির এই অনুরোধ। দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল। উপায় একটা স্থির করিতে হইবে। আবার ইয়াকুবের ধর্ণা! না তা সম্ভব নয়। তবু একই কেন্দ্রে সমস্ত চিন্তা স্রোতায়িত হইতে লাগিল। শেষে দরিয়াবিবি স্থির করিল, ইয়াকুবকে বলিয়া দেখিতে হইবে।

ইয়াকুব প্রস্তাব শুনিয়া হাসিয়া বলিল, ভাবী, আপনার যা দরকার, আমাকে বলেন না কেন?

ভাই, তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। আমার বলতেও লজ্জা লাগে।

কোনো লজ্জা করবেন না। আপনার মুখের হাসি আমি দেখতে চাই।

হাসি কি সহজে আসে!

মন নরম থাকলে আসে বৈকি।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া আবার মৃদু হাসিল। বৈধব্যের পর দরিয়াবিবির শরীরের তেমন পরিবর্তন ঘটে নাই। চেহারায় আর একটু রুক্ষতার ছাপ লাগিয়াছে। মাত্র। তার ফলে আরো আপ্তরমণীর মতো দেখায় দরিয়াবিবিকে। হঠাৎ কারো চোখে পড়িলে মনে হইবে, যেন কত দেমাকী। কিন্তু দরিয়াবিবি নিজের দিকে চাহিয়া আর কিছু দিশা করিতে পারে না। সে যেন আসেকজানের মতো হইয়া যাইতেছে। ভয়ে বিবর্ণ হইয়া যায় তখন দরিয়াবিবি।

না ভাই। বাইরে থেকে আমি দেখতে অমন। খুব মোলায়েম সুরে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

আপনি কষ্ট পান খামাখা। আমাকে বললেই হয়। পনেরো টাকা আমি মাস-মাস দেব। আপনি যাওয়ার সময় তিন মাসের আগাম চেয়ে নেবেন।

আল্লা তোমার মঙ্গল করুক, ভাই। ধনে-দৌলতে তিনি তোমাকে আরো বাড়ান। প্রায় গদগদভাবে দরিয়াবিবি উচ্চারণ করিল।

আপনার দোয়া। তারপর ইয়াকুব আবার নির্লজ্জের মতো তাকাইয়া বলিল, আপনার হাসির দাম লাখ টাকা।

খামাখা লজ্জা দাও, ভাই। আমরা গরিব-দুঃখী, আমাদের আবার হাসি– তার আবার দাম! ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া দরিয়াবিবি বাক্য সমাপ্ত করিল।

ইয়াকুব হাসি ছাড়িয়া বোধহয় আর কিছু মূল্য যাচাইয়ের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। দরিয়াবিবি তার সুযোগ দিল না। ওদিকে হাঁড়ি চড়িয়ে এসেছি, এঁচে গেল, গন্ধ উঠেছে– বলিয়া দরিয়াবিবি রান্নাঘরের দিকে ছুটিল।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির ছন্দময় দেহাবয়বের দিকে পশ্চাৎ হইতে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল ও মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।

উপবাস এই সংসারে দরিয়াবিবির জন্য অচেনা কিছু নয়। মাঝে মাঝে কোনোদিন ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েরা হাঁড়িতে ভাত থাকা পর্যন্ত আর ক্ষান্ত হয় না। দরিয়াবিবি তখন পরিবেশন করিয়াই খুশি। এই চালাকি মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। তখন আমজাদ লজ্জিত হয়। নঈমা, শরীফা কি-বা বোঝে। আমিরন চাচির কাছে ধরা পড়িলে দরিয়াবিবি খুব বকুনি খায়। একদিন তো চাচি অভিমান করিয়া চলিয়া গেল। বলিয়া গেল, আমরা তো আত্মীয়-স্বজন নই, আমাদের কাছে কেন কিছু বলবেন, বুবু। দুমুঠো চাল কি তরকারী আমজাদকে দিয়ে আনালে কি আমি অসুবিধায় পড়তাম?

কিন্তু দরিয়াবিবি আরো অভিমানী। কোনো কিছু যাঞ্জার বেলা সে যেন মর্মে মর্মে মরিয়া থাকে। নিজের অতীতের দিকে চাহিয়া সে নিজেকেই আর বিশ্বাস করে না। আত্মবিশ্বাস ক্রমশ অন্তর্হিত হইয়াছে। পর্বে অন্নহীন দিন এমন বিষণা বোঝা মনে হইত না।

সেইদিন রাত্রে আমজাদ ও নঈমার জন্য দরিয়াবিবির ঠোঁটে আর ভাত উঠে নাই। সকালে শরীর বড় ঝিমঝিম করিতেছিল। ইয়াকুব আসিল সেই সময়। রাজগীর কমতি নাই তার। ভালো চাল, মাছ শাক সজি, ঘি কিছু বাদ পড়ে নাই তার আড়ম্বর-লীলায়।

দরিয়াবিবি অগত্যা রান্নায় বসিল। তারপর সকলের শেষ খাওয়া। দরিয়াবিবি অভুক্ত শরীরে সেদিন আহার করিল। রীতিমতো আহার। পর্বে অপরের দেওয়া অন্ন সম্মুখে, সে আসেকজানের চল্লিশার খাওয়ার কথা স্মরণ করিত। আজ অতৃপ্তির কোনো বালাই ছিল না। ক্ষুধার্ত জঠর বাকিটুকু পরিবেশন করিল।

দুপুরের পর আমজাদ চন্দ্ৰকাকার কাছে কাজের তল্লাশে গেল। নঈমা শরীকে কোলে করিয়া হাসুবৌর বাড়ি পৌঁছিল। আগের দিন বৌ তাহাদের দাওয়াত করিয়া গিয়াছিল। নূতন ছাঁচিলাউ কাটা হইয়াছে, ক্ষীর রান্না হইবে আজ।

হাতে বহু কাজ। হাঁড়িপাতিল মাজা হয় নাই, গৃহপালিত আগল-পাগলদের খবরদারী বাকি আছে। তবু ভরা খাটে খোয়ারী ধরিয়াছিল। একটু গড়াইয়া উঠিয়া পড়িবে, এই আশায় শোয়ামাত্র কিন্তু দরিয়াবিবির বেশ ঘুম পাইল। অভুক্ত শরীর মাঝে মাঝে যদি ছুটি চায়, তা বিচিত্র কিছু নয়।

বাইরে বৈশাখের উত্তপ্ত দিন। এখানে ঝোঁপ-জঙ্গল ভেদ করিয়া গরম ঝামাল আসে না। তাই ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা মনে হয়। জানালার পাশে কাঁঠাল গাছে ঘুঘু ডাকিতেছিল। একটানা স্বরে। আজ কোনো উদ্বেগ দরিয়াবিবির-ক্লান্ত ভার শরীরে হানা দিতে পারে না। বেশ ঘুম ধরিয়া গেল।

কিন্তু ঘুম তাহার আবার আচমকাই ভাঙিল। দরিয়াবিবি হঠাৎ অনুভব করে, কার যেন গভীর আলিঙ্গনে সে একদম নিষ্পিষ্ট। চোখ খুলিয়া দেখিল, ইয়াকুব। দরিয়াবিবি প্রথমে ঘরের খোলা টাটির দিকে চাহিল। বাঁশের দরজা খোলা ছিল, এখন বন্ধ। দরিয়াবিবির মনে হয় হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছে তার সমস্ত শরীর। আর একজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস শুধু নাকে লাগিতেছে। একবার উঠিতে গেল সে। কিন্তু দুর্দান্ত দৃঢ়তায় আর একজন তাহাকে সাপটিয়া বাঁধিতেছিল। নিস্তেজ নিথরতায় দরিয়াবিবি চুপ করিয়া রহিল। আর চোখ খুলিল। সে যেন অন্ধ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত পৃথিবী তাহার নিকট নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে আবৃত।

বাহিরে পুত্র-হারা ঘুঘু জননী এক মনে শুধু ডাকিয়া খুন হইতে লাগিল।

.

৩৭.

সন্ধ্যায় আহারের সময় আমজাদ বলিল, মা, ইয়াকুব চাচা হঠাৎ চলে গেল। কাল তো যাবার কথা।

দরিয়াবিবি প্রথমে জবাব দিল না। পরে হঠাৎ আগুন হইয়া বলিল, খাচ্ছিস, খা। তোর আবার এত কথা কেন? আমজাদ মার দিকে একবার চাহিয়া আবার আহারে মনোনিবেশ করিল।

সকালে সে আবার বকুনি খাইল। বাড়ির পাঁদারে সকালে উঠিয়া আমজাদ দেখে, রান্না তরকারী নয়, শুধু-কাঁচা শাক-সজি পর্যন্ত পড়িয়া রহিয়াছে। কাল ইয়াকুব চাচা এইসব আনিয়াছিল, সে জানে। তাই তাড়াতাড়ি মার কাছে উধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া আসিল।

মা, আস্তাকুঁড়ে কত তরকারী কে ফেলে দিয়েছে তুমি দেখবে এসো।

দরিয়াবিবি হাঁস-মুরগিদের একমনে খুদ-কুড়া খাওয়াইতেছিল, সে যেন পুত্রের কথা শুনিয়াও শুনিল না।

পুত্র আবার এত্তেলা দিল।

দরিয়াবিবি তখন ধমক দিয়া বলিল, হাতে কাজ আছে দেখছিস নে? চোখ কি ফুটো হয়ে গেছে তোর?

আমজাদ মার থমথমে চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছিল, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয়।

তিন চার দিন আমজাদ নিরীহ ছেলের মতো ঘরে রহিল। মার এমন মূর্তি সে আর পূর্বে দেখে নাই। এমনভাবে কত দিন কাটিত কে জানে, আবার ইয়াকুব চাচার আগমনে সব শান্ত হইল। এবার সে একা আসে নাই। সঙ্গে পুত্র ও রসদসম্ভার আনিয়াছিল। তার ছেলের বয়স নয় কি দশ। আমজাদের প্রায় সমবয়সী। হঠাৎ পুত্র সঙ্গে কেন? দরিয়াবিবি অচেনা ছেলের সম্মুখে স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হইল, ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসাবাদ করিল। দেবরের চাল বোঝার সাধ্যি দরিয়াবিবির নাই।

মোনাদির আবার পত্র লিখিয়াছিল। তাই পুত্রসহ বাড়ি ফেরার আগে দরিয়াবিবি ইয়াকুবের নিকট হইতে পনেরোটি টাকা চাহিয়া লইল।

আমজাদ বুঝিতে পারে, মার মেজাজ ঠিক হয় নাই। আজকাল সে বকুনি খায়, নঈমা–এমনকি শরী পর্যন্ত কান্নাকাটি করিলে প্রহার ভোগ করে। মা এমন ছিলেন না। একদিন সে আমিরন চাচির কাছে বেড়াইতে গিয়া অভিযোগ করিয়া আসিল।

কাজের চাপে কদিন আমিরন চাচি এই বাড়িতে আসিতে পারে নাই।

একদিন আসিয়া জেরা শুরু করিল, বুবু, তুমি নাকি ছেলেদের বড় মারধোর কর?

পোড়াজানে যদি মারধোর করি, কী অন্যায়টা করি? এগুলো মরলে আমার হাড় জুড়োয়।

আমিরন চাচি বাধা দিল, ছি ছি বুবু, এমন অপয়া কথা মুখে আনে! আমার একটা। সেও কম জ্বালায় না।

একটা আর দুটো। এরা জ্বালাতেই আসে। একজন তো মুখই আর দেখায় না। তার জন্য জ্বলছি। আর সঙ্গে যে কটা আছে, তারাও কম জ্বালাচ্ছে না। আল্লা এগুলো তুলে নিতে পারে না?

দরিয়াবিবি খুব অপ্রকৃতিস্থ। আমিরন চাচি কাজের বাহানায় সেদিন আর বেশিক্ষণ বাক্যালাপ করিল না। চলিয়া গেল।

দুপুরে কুঁড়া পায় নাই, উঠানে তাই কতগুলি মুরগি কটকট শব্দে কান ঝালাপালা করিতেছিল। দরিয়াবিবি ক্রোধে হাতের নাগালে পাওয়া একটি মুরগি ধরিয়া এক আছাড় দিল। আহত প্রাণী ঝটপট করিতে লাগিল।

নঈমা চোখে ভালো দেখে না, দাওয়ায় বসিয়াছিল। সে সেখানে হইতে বলিল, মা, মুরগি জবাই করছ? দরিয়াবিবি চিৎকার করিয়া উঠিল, দাঁড়া হারামজাদি, তোকে। জবাই করব।

আমজাদ এই সময়ে খেলা সারিয়া ফিরিতেছিল। সে মার হুঙ্কার শুনিয়া ধীরে ধীরে দহলিজের দিকে চলিয়া গেল। হাওয়া ফিরিলে, সেও ফিরিয়া আসিবে। আসিয়া বসিল আর নড়িতে চাহিল না। হাসুবৌর কাছে তো মোনাদির আর মুখ খুলিতে পারে না। হাঁ-না দিয়া জবাব দায়সারা করে। হাসুবৌ মোনাদিরের উদ্ধারে আসিল, চাচা, কথা বল, তুমি কেমন হয়ে গেছ।

মোনাদির মাথা হেঁট করিল। মার আদেশে সে আসিয়া চাচিকে সালাম করিয়াছিল। আর মুখ খুলিতে পারে নাই।

এমন লাজুক কেন, চাচা। আমিরন চাচি মোনাদিরের দিকে চাহিল।

পুত্রের বদলে জবাব দিল মা, বড় হয়েছে এখন সব বোঝে তো। মুরুব্বিদের সামনে কি বেশি কথা বলে? বেয়াদবী হয় যে!

তোমরা খেলা কর গে। যা, যা আম্বিয়া, যা। আমিরন চাচি মেয়েকে এক ঠেলা দিল।

আমজাদ মুনিভাইয়ের সঙ্গ পাইলে আর কিছু চায় না। সে বলিল, চল দাদা।

এতক্ষণে মনমতো প্রস্তাব আসিয়াছে। মোনাদির সাড়া দিতে বিলম্ব করিল না। আম্বিয়া তখন সলজ্জ ধীরপদে অগ্রসর হইতে লাগিল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে এক দৌড়ে আমজাদ ও মোনাদিরের পথে অদৃশ্য হইয়া গেল।  মেয়েরা হাসিয়া উঠিল। হাসুবৌ কহিল, চাচির মেয়ে একখানা। বড়া তাজা। দেখলে, কীভাবে দৌড় মারল।

যাক যাক। ও একটা জ্বালানি।

মেয়ের প্রশংসা মা সহ্য করিতে পারিল না।

বুবু, ছেলে এবার তোমার হল না? আমিও তো বলেছি, না এসে পারে?

আমার কোনো ভরসা নেই।

এমন অলক্ষুণে কথা মুখে এনো না।

দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না, শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। চাচি আবার জিজ্ঞাসা করিল, কদিন থাকবে?

স্কুলের ছুটি আছে চারদিন। পরশু আবার চলে যাবে।

ও, বলিয়া আমিরন চাচি একটু চিন্তান্বিত হইল।

তোমরা খুব বুঝিয়ে বল, বোন। আবার যদি চলে যায়, আমি আর বাঁচব না।

হাসুবৌ ও আমিরন চাচি এক জোটে সায় দিল, নিশ্চয় বলব।

আম্বিয়া হি হি করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসিল। তার দিকে সকলের লক্ষ্য।

এই পোড়ামুখি, হাসছিস কেন?

আম্বিয়া মার মধুর সম্বোধনে হাসি ক্ষ্যান্ত দিল। পরে বলিল, মুনিভাই গাছে চড়ে গান ধরেছিল। হঠাৎ একটা বাঁদর দেখে নামতে নামতে কাঠপিঁপড়ে কামড়েছে। তাই হাসি।

আবার কোথা থেকে মড়ার বাঁদর এসেছে। গাছপালা রাখা দায়। সেদিন আমার শিমগাছ খেয়ে গেছে। আমিরন চাচি উঠানের গাছপালার দিকে তাকাইল।

কথায় কথায় বেলা শেষ। মোনাদির ফিরিয়া আসিলে আজ চাচি নানা উপদেশ দিলেন। আম্বিয়ার জড়তা কাটিয়াছে। সে সকলের সঙ্গে খুব চাকুম চাকুম শব্দে মুড়ি ও নাড় খাইল।

দরিয়াবিবি বলিল, অবেলাটা বড় সুখে কাটল আমিরন বোন।

আবার এসো মুনি চাচা। তুমি পরশু দিন সকালে যাবে, তখন আমি থাকব এই হতভাগীকে সঙ্গে নিয়ে। চাচি সহাস্যে মেয়ের দিকে আঙুল বাড়াইল।

হাসুবৌ শুধু বড় ম্রিয়মাণ। তার আবার শাশুড়ির ভয় জাগিয়াছে।

আজ আমিরন চাচি সকলের সঙ্গে সড়কের অনেক দূর পর্যন্ত আগাইয়া আসিল কথা বলিতে বলিতে। কথা আর ফুরায় না।

.

৪০.

চন্দ্র কোটালের প্রস্তাব মোনাদিরের খুব ভালো লাগিয়াছিল। মুনি চাচা লেখাপড়া জানে, আমাদের গানের দলের অধিকারী হবে, আর সমস্ত গান লিখে রাখবে। আজকাল গেঁয়ো, সোজা গান বাবুরা পছন্দ করে না। চাচা ভাষা ঠিক করে দেবে?

কিন্তু যথাসময়ে মোনাদির চলিয়া গেল। এই বাড়িতে কেন যেন মন টেকে না। মাঝে মাঝে মায়ের হৃদয়ের উত্তাপহীনতা সে উপলব্ধি করিতে শিখিয়াছিল। এই তিনদিনেই সে বুঝিয়াছিল, মা আগের মতো তার জন্য আকুলি-বিকুলি করে না। দরিয়াবিবির আকস্মিক ব্যবহারে আমজাদ দুঃখ পাইত, মোনাদির বিস্মিত হইয়াছিল। কিন্তু কিশোরের মনে তার কোনো বিশেষ দাগ পড়িল না। যাওয়ার দিন দরিয়াবিবি বারবার অনুরোধ করিল, সে যেন ছুটি পাইলেই চলিয়া আসে।

হাসুবৌ ইদানীং এই বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করে। কাছে সহানুভূতিশীল আর কোনো প্রতিবেশী নাই। বন্ধ্যা জীবনে জুলুম সহ্য করিতে হয়। এইখানে তবু মনের ভার হালকা করা যায়। দরিয়াবিবি এই নিরীহ সরল বধূটির প্রতি বড় স্নেহশীল। সাকেরের মা তাই লইয়া মনে মনে গজ গজ করিত, অবশ্য মুখে কিছু বলিত না। কারণ সাকের দরিয়াবিবির কথা সহজে অবেহলা করে না। দরিয়াবিবির খাতিরে সে তার মার সঙ্গে বিবাদ জুড়িতেও প্রস্তুত।

মোনাদির চলিয়া যাওয়ার দিন খুব সকাল সকাল হাসুবৌ এখানে আসিয়াছিল। অনেক বেলা হইয়া গেল, তবু বাড়ি যাওয়ার নাম নাই। দরিয়াবিবির সহিত এ কথা সে কথা ও গৃহস্থালীর ছোটখাটো কাজ করিয়া দিল।

বুবু, মন খারাপ কর না, এমন সোনার চাঁদ ছেলে। ও তোমার ছাড়া কার? এমন বহু সান্তুনা-বাক্য হাসুবৌর মুখে আজ যেন লাগিয়াই ছিল।

দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ। কাজকর্ম করিতেছিল, কিন্তু সহজ কথোপকথনে তার মন। ছিল না।

বাঁশের একটি চুপড়ি ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। হাসুবৌর সহযোগিতায় দরিয়াবিবি তা মেরামত করিতে বসিল।

বুবু, আল্লার মরজি, তোমার শরীর বেশ আছে। তুমি বেশ মোটা হচ্ছ।

দরিয়াবিবি কোথায় কাপড় অসম্বৃত এই আশঙ্কায় নিজের দিকে চাহিয়া লইয়া জবাব দিল, লোকে বলে, আছে ভালো, কিন্তু ওদিকে শালুক খেয়ে যে দাঁত কালো তার খবর কেউ রাখে না।

হাসুবৌ চুপ করিয়া গেল। দরিয়াবিবির কণ্ঠে সৌহার্দ্যের লেশ ছিল না। যেন ঝগড়ার মুখে আর একজনের সঙ্গে সে কথা কাটাকাটি করিতেছে।

শাশুড়ির চিৎকার শোনা গেল। হাসুবৌ হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। দরিয়াবিবির যেন তার উপর কত খাপ্পা। হাসুবৌ তাই ভয় পাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, এখন যাই, বুবু।

দরিয়াবিবি নিজের মনে একটি কঞ্চি ফাড়িতে লাগিল। কোনো জবাব দিল না হয়ত শুনিতে পায় নাই। সে নিজের কাজে মগ্ন। হাসুবৌ অপরাধীর মতো বিদায় লইল।

সেদিন বিকালে ইয়াকুব আসিল। সঙ্গে পুত্র। তাহাকে দরিয়াবিবির কাছে রাখিয়া চলিয়া গেল। আবার দুদিন পরে আসিবে সে।

সমগ্র পরিবারের রসদ দিয়া গিয়াছে, দরিয়াবিবির কোনো অসুবিধা ছিল না। নিজের ছেলে আজই প্রবাসী, আবার পরের সন্তান ঘাড়ে। কিন্তু দরিয়াবিবি কোনো অবহেলা দেখাইল না। ছেলেটার নাম ওয়ায়েস। বেশ ফুটফুটে কথা বলে। আর বড় সুন্দর জবাব দিতে পারে। দরিয়াবিবি মানসিক ভার কাটাইবার উদ্দেশ্যে ছেলেটিকে ইয়াকুবের অন্দর মহলের অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল।

তোমার দুই মা, না?

হ্যাঁ, চাচি। ছোটমা আর বড়মা। আমি বড় মায়ের ছেলে। আমরা দুভাই।

তোমার ছোটমা কেমন?

খুব ঝগড়া করে মায়ের সঙ্গে বাপের সঙ্গে।

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে?

হ্যাঁ। আজ ঝগড়া হয়েছে। তাই আমাকে বাপ নিয়ে এল।

ঝগড়া হল?

রোজ ঝগড়া হয়। আজকাল বাপ ঘরে থাকে না।

কোথায় থাকে?

দহলিজে ঘুমায়। আর বাপের অসুখ আছে। শরীর খারাপ।

দরিয়াবিবি চুপ করিয়া যায়। ছেলেটিকে নিজের পাশে শোয়াইয়া আরো তথ্য সংগ্রহ করিল। ইয়াকুবের অন্দর মহল একটি দোজখ। মোটামুটি গ্রাম্য জীবনের সচ্ছলতা আছে, তাই বাড়ির মেয়েরা রান্না-খাওয়া ছাড়া বেকার। টাকার গরম, শাড়ির গরম দেখাইতে পরস্পরে হিংসা, ঝগড়া। এইটুকু ছেলেও কেমন কূটচক্রের ইতিহাস জানে।

দুদিন পর ইয়াকুব ছেলেটিকে লইয়া যাইবার সময় বলিল, দরিয়াভাবী (আর ভাবী সাহেব বলে না) ছেলেটাকে এনে রেখে দেব। ওখানে থাকলে আর মানুষ হবে না।

কথার জবাব দিতে হয়, আমজাদ সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। দরিয়াবিবি বলিল, তোমার পাকা বাড়ি, এখানে বাঁশের ঘরে কেন?

সেখানে ছেলেগুলা মার জন্য খারাপ হবে। খালি কিচামিচি ঝগড়া-ঝাটি।

দরিয়াবিবি আর কোনো জবাব দিল না।

ইয়াকুব পুত্রকে লইয়া পথাভিমুখী হইল। আমজাদের সঙ্গে ওয়ায়েসের খুব খাতির জমিয়াছে। সেও পিছন পিছন গেল।

একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মা, তোমাকে পনেরো টাকা দিয়েছে। ভুলে গিয়েছিল। ওয়ায়েসের বাপ বললে।

মুনি মাত্র দুটাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে। কালই টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়। মনে মন দরিয়াবিবি সাত-পাঁচ ভাবিতে লাগিল।

৪১-৪৫. অচল দিন

অচল দিনকে প্রাণপণে ঠেলিতে হয়। সমস্ত উদগ্র শিরা-উপশিরা বিদ্রোহী, তবু বিশ্রাম কি শৈথিল্য দেওয়া চলে না। উত্রাইয়ের বাঁকে বোঝাও অনড় হইয়া সংগ্রামশীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে ব্যঙ্গ করে। উপত্যকায় তখন আবার ঝড় দেখা দিলে, অসহায়তা নৈরাশ্য মেঘ গর্জনের সঙ্গে বিকট প্রতিধ্বনি ধাক্কার বেগে ছুটিয়া আসে।

দরিয়াবিবি উত্রাইয়ের মুখে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। চারদিকে শ্বাপদসংকুল খাদ ভরা অরণ্যানী। পানি আর তৃষ্ণা মেটায় না, বাতাস আর শ্রান্তি হরণ করে না।

মা।

দরিয়াবিবি চাউলের কাঁকর বাছিতেছিল। উঠানের দিকে পিঠ। সুতরাং আগন্তুকের সংবাদ সে জানিতে পারে নাই। চকিতে চোখ ফিরাইয়া দরিয়াবিবি অবাক হইয়া গেল। মোনাদির আসিয়াছে। পিঠের উপর একটি বোঝা-সমস্ত শরীর ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। পথ-চলার ক্লান্তি পথিকের নিঃশ্বাসের দ্রুততায় ধরা পড়ে।

হঠাৎ এলি নাকি, বাবা?

গরমের ছুটি হতে এখনো তিন মাস বাকি। স্কুলে পরীক্ষা হচ্ছে, এক হপ্তা ছুটি। তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ।

দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি নিজের হাতে মোনাদিরের জামা খুলিয়া ঘাম মুছিয়া দিল। হাঁকডাকে আমজাদ আসিয়া হাজির। সে একটা মোড়া আগাইয়া দিল।

দরিয়াবিবি বড় খুশি। তাড়াতাড়ি ভাত চাপাইয়া দিল। দুপুরের হাঁড়ি শূন্য। কিছুক্ষণ আগে তাহারা আহার সমাধান করিয়াছে। আমজাদ মাঝে মাঝে হাত-খরচের লোভে মুরগি-হাঁসের ডিম লুকাইয়া রাখে। সে একটি ডিম আনিয়া দিল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আণ্ডা কোথা পেলি?

আমাদের লাল মুরগিটা যেখানে-সেখানে ডিম পাড়ে। কাল গোয়ালঘরের মাচাঙে। ছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।

পুত্রের আবিষ্কার-দক্ষতায় দরিয়াবিবি খুব উৎফুল্ল হয়। সে আলুভাজা আর ডাল করিতে চাহিয়াছিল। এখন ডিম পাওয়া গেল। আহারের মোলোকলা পূর্ণ।

মোনাদির পুকুরে গোসল করিয়া আসিল। অজানা পরিতৃপ্তি তার মনে। তাই ভাই বোনদের সঙ্গে নানা গল্প ছাড়িল। ঝোলা হইতে কয়েকটি মাটির পুতুল সে নঈমা ও শরীকে দিল। তাহাদের খুশির অন্ত নাই। একজোড়া ভালো লাটিম বাহির করিল মোনাদির আমজাদের জন্য। দুই ভাইয়ে কাল নদীর ধারে গাছতলায় খেলব, এই প্রস্তাবে আমজাদ লাফাইয়া উঠিল।

দরিয়াবিবির কাছে সমস্ত বৈকাল যেন সুরের মতো বাজিতে থাকে। ছেলেপুলেদের লইয়া সে বহুদিন এমন আনন্দ পায় নাই। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সে রাত্রির রান্নায় বসিল। আমিরন চাচির গাছ হইতে একটি লাউ চাহিতে গিয়াছিল আমজাদ। সে লাউয়ের সঙ্গে একটা মুরগিছানা দিয়াছে। কদু-গোস্তের তরকারী বাধিতে দরিয়াবিবি সমস্ত নৈপুণ্য ঢালিয়া দিল।

আহার শেষে দাওয়ায় অনেকক্ষণ গল্প-গুজব শুরু হইল। মোনাদিরের কাছে পরিবেশ আর অচেনা নয়। সে বেশ সহজ। দরিয়াবিবিও প্রাণ খুলিয়া ছেলেদের হল্লায় যোগ দিল।

পরদিন আমজাদ ও মোনাদির টো টো করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইল। চন্দ্র কোটালের ভিটায়, নদীর ধারে, মাঠে মাঠে, সড়কের আশপাশে ঝোপে-জঙ্গলে দুইজনের গতিবিধি। আমজাদ তো এমন স্বাধীনতাই প্রতিদিন কামনা করে। একা একা সে আবার বড় ভীরু ও লাজুক। শুধু মুনি ভাই সঙ্গে থাকিলেই সে সব কাটাইয়া উঠিতে পারে।

মার মেজাজ বড় হালকা আজকাল। আমজাদ তাই আরো খুশি।

মোনাদিরই প্রথম অনুজকে জিজ্ঞাসা করিল, আমু, মা বড় মোটা হয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। মুনি ভাই, আমার মনে হয় অসুখ!

না। মার শরীর আমার মতো কিনা।

তা ঠিক মুনি ভাই। বড় হলে তুমি চন্দ্র কাকার মতো জওয়ান হবে।

তাই তো বেঁচে আছি। স্কুলের বোর্ডিংয়ে যা খাওয়ায়, এতদিন আমারও অসুখ করত।

ভ্রাতৃবিক্রমে আমজাদ গৌরবান্বিত। সে প্রস্তাব করিল, তুমি সাকের চাচার কাছে লাঠি খেলা শিখবে?

গ্রামে এসে থাকলে নিশ্চয় শিখব। আমি খুব ভালো লাঠিখেলা শিখতে পারব। মোনাদির হাতের পেশী দেখাইল।

নদীর ধারে এক জায়গায় দাঁড়াইয়া দুইজনের কথাবার্তা চলিতেছিল। চৈত্র মাস। তাই নদী শুষ্ক। দুই পাশে চলে খাগড়া বন। মাছরাঙার বাসা খুঁজিয়া অনেকক্ষণ দুইজনে কাটাইয়াছে। কোনো লাভ হয় নাই। একটি বড় চালতা গাছের গুঁড়ির উপর দুইজনে ঠেস দিয়া দূরে দূরে চাহিতেছিল। আকাশ একদম মেঘহীন। রৌদ্রের তরল ঝরণায় সমস্ত মাঠ ঝমঝম বাজিতেছে। নিঃসঙ্গ তালগাছ বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে প্রত্যঙ্গের থরথরানি মিশাইয়া দিয়াছে। গ্রাম্য দুই বালক কথার ফাঁকে ফাঁকে পৃথিবীর বিশালতা অনুভব করে।

শুধু ক্ষুধার তাড়না এই অবসর উপভোগে ছেদ টানিল। মোনাদির বাড়ি ফিরিয়া দেখিল ইয়াকুব আসিয়াছে। মা বলে নাই, তবে আমজাদ বলিয়াছে, এই লোকটি গত তিন-চার বৎসর তাহাদের বহু উপকার করিয়াছে। মোনাদির অচেনা লোকের সম্মুখে বড় লাজুক। শুধু সে আর নিজে কোনো আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারে না।

রাত্রে ছেলেরা আহারে বসিল। দরিয়াবিবি মিয়মাণ দাসীর মতো কর্তব্য সম্পাদন করিতে লাগিল। আমজাদ আসর জমাইতে চায়। কি একটা মুনি-সম্পর্কিত রসিকতা করিতে গিয়া সে ধমক খাইল। তখন আহারই একমাত্র তপস্যা হইয়া দাঁড়াইল সকলের পক্ষে।

দুইটি মাত্র কক্ষ। আমজাদ ও ইয়াকুব এক কামরায়, অন্য কামরায় মার কাছে নঈমা ও শরীর সহিত মোনাদিরের শয়ন ব্যবস্থা হইল।

আজ মার সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা হইল না। সারাদিন কত খাটে, এই ভাবিয়া মোনাদির ঘুমাইয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি বিনিদ্র বহুক্ষণ পড়িয়া রহিল। গরমের দিন। তবু একটি কথায় তার হাঁটু পর্যন্ত চাপা। গরম, তার উপর দৈনন্দিন চিন্তার টানাপোড়েন। বাহিরে জানালা দিয়া দেখা যায় আকাশ ভরিয়া কত জ্যোৎস্না উঠিয়াছে।

ঘুম আসিতেছিল না। দরিয়াবিবি সকলকে ঘুমন্ত দেখিয়া ধীরে ধীরে উঁটি খুলিয়া উঠানে দাঁড়াইল। জানালার কাছে কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে জোছনা পড়িয়াছে মাটির উপর। দরিয়াবিবি আনমনা গিয়া দাঁড়াইল। আকাশে নিষ্প্রভ কয়েকটি তারা জ্বলিতেছে মাত্র। সমস্ত আকাশ তো গাছের তলা হইতে দেখা যায় না। দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া রহিল বেশ কিছুক্ষণ। সুপ্ত গ্রামের নীরবতা কৃচিৎ পাখির ডাকে, দূরাগত কুকুরের চিৎকারে চিড় খায় মাত্র।

হয়ত অনন্তকাল এমনভাবে দাঁড়াইয়া থাকিলে দরিয়াবিবি আনন্দিত হইত, কিন্তু হঠাৎ মানুষের ছায়া পড়িল জোছনায়। শিহরিয়া, তাড়াতাড়ি উঠানের দিকে যাইবে, সে দেখিল ইয়াকুব তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। সম্মোহিতের মতো দরিয়াবিবি নিজের জায়গায় স্থাণু।

কয়েক মুহূর্ত পরে সম্বিৎ ফিরিয়া আসিলে দরিয়াবিবি ফিসফিস কণ্ঠে বলিল, এখানে কেন?

কেন, তুমি জানো না, দরিয়া? ইয়াকুব তার হাত ধরিয়াছে ততক্ষণে।

হয়ত হাত টানাটানি শুরু হইত, জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া মোনাদির ডাকিল, মা, এত রাতে তুমি একা বাহিরে গেছ, আমাকে ডাকলে না কেন?

আসছি বাপ। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই আর জাগাইনি।

ইয়াকুব চোরের মতো আড়াল অন্ধকারে লীন হইতে গেল, কিন্তু তার লম্বা ছায়া জোছনার হাত এড়াইতে পারিল না।

দরিয়াবিবি কম্পিত বুকে তাড়াতাড়ি আসিয়া দরজা বন্ধ করিল। মোনাদির তখনো জানালায় দাঁড়াইয়া। মাকে, বলিল, মা চোরটোর হবে। একটা লোকের ছায়া পড়ল কাঁঠাল গাছের পাশে।

না। অন্ধকারে দরিয়াবিবি আবার বলিল, তুমি এসো, শুয়ে পড়।

যাই। মা, তুমি একলা এমন রাত্রে বেরিয়ো না।

কি আছে আমাদের, চোর আসবে?

মোনাদির কয়েক মিনিট জ্যোৎস্নার দিকে চাহিয়া নিজের বিছানায় ফিরিয়া আসিল।

সারাদিনের ক্লান্তি, উদ্বেগজনিত নিদ্রাহীনতা–ভোরের দিকে দরিয়াবিবির চোখে ভয়ানক ঘুম নামিয়াছিল। কাক ডাকা সকাল তার জীবনে প্রথম দেখে নাই।

আরো কতক্ষন ঘুমাইত কে জানে, হঠাৎ আমজাদ আসিয়া ডাক দিল, মা, মা।

খোঁয়ারি চোখে দরিয়াবিবি ধমক দিল, কি, এত ডাকছিস কেন?

মুনি ভাইয়ের কাপড়চোপড় কোথা?

বাঁশের আলনায় আছে।

কই নেই তো?

দরিয়াবিবি চোখ খুলিয়া চাহিল।

তোর ঘরে নেই?

না। ইয়াকুব চাচা সকালেই চলে গেছে।

দরিয়াবিবি কাঁথা জড়াইয়া উঠিয়া পড়িল। বারবার চোখ কচলাইল। মোনাদিরের ঝোলা, কাপড়চোপড় আলনায় নাই।

বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল দরিয়াবিবি। তার শরীর থরথর কাঁপিতেছে।

দিঘীর পাড়ে গিয়ে দেখ তুই, সেদিকে গেছে বোধহয়।

আমজাদ চলিয়া গেলে দরিয়াবিবি পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, মোনাদিরের বইপত্র নাই।

দরিয়াবিবি হয়ত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইত। কিন্তু মনে মনে বুকে জোর সঞ্চয় করে সে। না, মূৰ্ছা যাওয়া তার সাজে না।

তাল সামাল দেওয়ার জন্য ঝিম ধরা মাথা দুই হাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া দাওয়ার উপর দরিয়াবিবি বসিয়া পড়িল। একটু হাঁফ ফেলা দরকার শুধু।

.

৪২.

চন্দ্রমণি এক রাত্রে রাজেন্দ্রের সঙ্গে গ্রাম ত্যাগ করিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল প্রায় একমাস আর গ্রামের ভিতর আসে নাই। আমজাদ নিজেই যাইত খোঁজ-খবর লইতে। চন্দ্র যেন আর এক রকম হইয়া গিয়াছে। তাড়ি সে খায়। কিন্তু নিঃশব্দে খায়। আর হল্লা করে না, গান করে না। চন্দ্রমণির ছেলে দুটি মামার কাছেই আছে।

দরিয়াবিবি এই সংবাদ শুনিয়াছিল হাসুবৌর মুখে, আমিরন চাচির মুখে। কিন্তু কোনো মন্তব্য করে নাই। বিপদে-আপদে কোটালের কাছে আমজাদকে পাঠানো বৃথা। যে যার মাথার ঘায়েই পাগল। এইজন্য দরিয়াবিবি কোটালের জন্য বড় দুঃখিত। আহা, এমন মানুষের কপাল বটে! কিন্তু উপায় কোথায়? দাদার গলগ্রহ জীবনের চেয়ে চন্দ্রমণি তার কারো আশ্রয়ে গিয়াছে। সংসারের কতটুকু ক্ষতি তাতে? হয়ত দরিয়াবিবির মনে এইসব কথা উঁকি দিয়াছিল।

দরিয়াবিবির একদিন সন্ধ্যায় কোটালের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমজাদ খুব রাজি না। কিন্তু আর যেন সেদিকে পা বাড়ানোর উৎসাহ নাই। খ্যাপা কোটালের সংসার দেখার ইচ্ছা কার না হয়? আজহারের মতো ধর্মান্ধ ধর্মভীরু লোকটি চন্দ্রকে চিনিয়াছিল। কিন্তু সে জীবিত থাকিতে দরিয়াবিবি এমন প্রস্তাব উত্থাপন করে নাই। আর যাওয়া হোলো না, দরিয়াবিবি সেদিন মনে মনেই উচ্চারণ করিল। গ্রাম্য জীবনে একজনের অপবাদ সমস্ত বাড়ির উপর ভর করিয়া থাকে।

এক মাস পরে আমজাদ মার কাছে আসিয়া জানাইল, মা, আজ মুনি ভাইয়ের টাকা ফেরত এল। এই নাও টাকা। আমজাদ পনেরোটি টাকা গণিয়া দিল।

টাকা ফেরত এল কেন?

পিয়ন বললে মুনিভাই সেখান থেকে চলে গেছে।

অস্ফুট কণ্ঠে দরিয়াবিবি একবার উচ্চারণ করিল, চলে গেছে! তারপর পুত্রের সহিত আর কোনো বাক্যালাপ করিল না। অবিচল মূর্তির মতো টাকা কয়টি হাতে দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল। দুশ্চারিণী জননীর দান সৎ সন্তান কেন গ্রহণ করিবে? মুনি–

আমজাদ হাসুবৌকে তখনই খবর দিয়া আসিয়াছিল। পিয়ন তাহাদের বাড়ির পাশেই দাঁড়ায়। হাসুবৌ আসিল। দরিয়াবিবির অশ্রুসজল মুখের দিকে চাহিয়া সে আর কোনো কথা বলিল না, নিঃশব্দে পাশে বসিয়া পড়িল।

দরিয়াবিবির মুখাবয়ব ক্রমশ থমথমে, গৌরসুডোল গণ্ডদেশ বহিয়া অশ্রু গড়াইতে লাগিল। হাসুবৌ আমজাদকে বলিল, বাবা, একটু পানি এনে দে।

আমজাদ বিলম্ব করিল না আদেশ-পালনে।

হাসুবৌ দরিয়াবিবির চোখের পানি মুছাইতে মুছাইতে বলিল, বুবু একটু বারফাট্টা ছেলে। আবার আসবে। বেটাছেলের জন্য এত চিন্তা কেন?

দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না। হাসুবৌ আবহাওয়া সহজ করিতে ছুঁতানাতা খোঁজে। বলিল, বুবু, সন্ধ্যা হয়, এখন কত কাজ তোমার, উঠে পড়।

উঠানে একপাল মুরগি-হাঁস কোলাহল তুলিয়াছিল। ইহাদের সান্ধ্য-ভোজন বাকি। হাসুবৌ আরো জিদ ধরিল, বুবু, তুমি না উঠলে আমি বাড়ি যেতে পারব না। তোমার ছেলে তোমারই আছে।

দরিয়াবিবির চোখে আর পানি নাই। কিন্তু বড় চিন্তান্বিত সে। হাঁটুর উপর থুত্রী রাখিয়া অবিচলতার নারী-প্রতীক রূপে বসিয়া রহিল।

ওঠো বুবু। হাসুবৌ হাত ধরিয়া বলিল, ওঠো। তোমার নিজের শরীরও ভালো নয়। কেমন ফোলা-দেখাচ্ছে। এমন করলে শরীর টেকে?

তুমি যাও। আমি উঠছি। দরিয়াবিবি মৃদু কণ্ঠে বলিল।

তুমি ওঠো।

উঠছি। তুমি যাও।

বেশ, আমি উঠানের পৈঠা পর্যন্ত গিয়ে দেখব, না উঠলে আবার আসছি।

হাসুবৌর যা কথা তাই কাজ। কিন্তু দরিয়াবিবি সত্যই তাড়াতাড়ি উঠিয়া হাঁস মুরগির খবরদারীতে মনোযোগ দিল।

.

৪৩.

সাকের নঈমাকে সদরের হাসপাতালে লইয়া গিয়াছিল। চোখের দৃষ্টি তার ক্রমশ নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছে। এত বেশি পিচুটি পড়ে, সকালে সে চোখই খুলিতে পারে না। তাই দরিয়াবিবি সাকেরের শরণাপন্ন হয়। চন্দ্র কোটাল বহুদিন এদিকে মাড়ায় নাই। হাসপাতালের ডাক্তার ঔষধ দিয়াছে। কিন্তু রোগের প্রতিকার অনিশ্চিত। ডাক্তারের অভিমত দরিয়াবিবি শুনিয়াছিল। কিন্তু সে ব্যাপারটা আর গুরুতর মনে করে না। অন্ধের কি দিন বন্ধ থাকে?

গত দুই মাসে দরিয়াবিবি বড় স্থির ও শান্ত হইয়া আসিল। কাজের গাফিলতি হয় না কিন্তু সব কাজ ধীরে ধীরে। মন যেন আর কোথাও উধাও, তারই পটভূমিকায় দৈনন্দিনতার কর্তব্য-সাধন মাত্র। ছেলেদের উপর রাগও নাই। শরী কত বিরক্ত করে, দরিয়াবিবি মোটেই তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। আমজাদ একদিন মার কোপন-স্বভাবের জন্য যেমন ভীত হইয়াছিল, আজ আবার বর্তমান অবস্থার জন্য তেমনই ভয় পাইল। তার ছেঁড়া লুঙি ও শার্ট সেদিন পাওয়া গেল না। নালিশ জানাইলে মা জবাব দিল, গেছে যাক। আর কোনো ধমক নয়। দরিয়াবিবি যেন ধমক দিতে ভুলিয়া গিয়াছে। আমজাদ তাই অস্বাভাবিকতার আবহাওয়া স্বতঃই টের পায়। আমিরন চাচি আসিলে দরিয়াবিবির চাঞ্চল্য সামান্য বাড়ে। হাসুবৌ কোনো পাত্তা পায় না। তাহার সহিত দু-একটি কথা হয় মাত্র। চুপচাপ বসিয়া বসিয়া সে চলিয়া যায়। দরিয়াবিবি কোনোদিন মুখরা ছিল না। কিন্তু এখন তার সমস্ত কথা যেন শেষ হইয়া গিয়াছে।

একদিন সকালেই রাজকীয় উপহারে সজ্জিত ইয়াকুব আসিল। ছেলেদের সম্মুখে দরিয়াবিবি কোনো নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘৃণা করে। সহজেই সে জিনিসপত্র গুছাইয়া রাখিল!

ইয়াকুব তাড়াতাড়ি আমজাদের বিছানায় শুইয়া পড়িল। তার চোখমুখ কোটরাগত ও শীর্ণ। দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসাবাদ কিছুই করে না। কখন এলে? বা এই জাতীয় মামুলী প্রশ্ন মাত্র।

একটু পরে আমজাদের কক্ষে দরিয়াবিবি প্রবেশ করিল।

ঘুমুচ্ছো? ইয়াকুবের নিকট তার প্রথম প্রশ্ন। ইয়াকুব মুখে চাদর ঢাকা দিয়া শুইয়াছিল। দিনের আলোয় মুখ দেখাইতে সে যেন ভয় পায়।

ইয়াকুব মুখের আবরণ খুলিয়া অন্যদিকে দৃষ্টি দরিয়াবিবির তরফে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কিছু বলছ?

দরিয়াবিবি প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। ইয়াকুবের মুখের উপর পনেরোটি রূপার টাকা ঝনঝন শব্দে রাখিয়া বলিল, মাস-মাস তোমাকে এই টাকা আর দিতে হবে না।

কেন? ইয়াকুবের মুখ বিবর্ণ। জ্বরে তার হাড় সিদ্ধ হইতেছিল, এমনই দেহে কোনো জৌলুশ ছিল না।

দরিয়াবিবি কক্ষ-ত্যাগের জন্য পা বাড়াইলে প্রায় আসন্ন-মৃত্যু রোগীর চেরা-কণ্ঠে ইয়াকুব ডাকিল, শোনো।

দরিয়াবিবি গমন-পথের দিকে চাহিয়া পেছন ফিরি