.
৩৪.
আমিরন চাচি যুক্তি দিয়াছিল, আরো হাঁস-মুরগি, বকরী-খাসি পোষো। বুবু। কোনো রকমে দিন চলবেই। তোমার ভাই মারা যেতে আমিও চোখে আন্ধার দেখেছিলাম। এখন বুক বাঁধতে হবে, ভাবনা করলে তো দিন যাবে না।
দরিয়াবিবি কথায় সায় দিয়াছিল। কিন্তু তার পক্ষে বাধা অনেক। সে পর্দানশীনা। কাছে মাঠ নাই। আমজাদ লেখাপড়া আগেই ছাড়িয়া দিয়াছিল। গরু-বাছুর মাঠে লইয়া যাইতে নিমরাজি। ইলেমের এমনই প্রভাব। আজহারকে সে খুব ভয় করিত, তাই মুখের উপর কোনো জবাব দেওয়ার সাহস পাইত না। এখন সে বেপরোয়া। চাষাবাদ তার ভালো লাগে না। চন্দ্র কাকার সঙ্গে প্রথম বছর চাষাবাদে গায়ে-গতরে খাঁটিয়াছিল। কিন্তু ধান বেশি হইল না। মাটির জন্য দরদ ছিল না। নিড়েন ঠিকমতো দেওয়া হয় নাই। পর বৎসর চন্দ্র কোটাল তাই তিন বিঘা জমি বিক্রয় করিয়া দিতে বলিল। গ্রহীতা ইয়াকুব। দেড় বিঘা জমি ছিল, আমজাদের জন্য তাহাও বিক্রয় হইয়া গেল। চন্দ্র কাকার সংস্পর্শে তার ভালো লাগে না। এত মেহনত আমজাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দরিয়াবিবি রাগ করিলেও পুত্রের উপর ক্ষোভ ছিল না। তের বছর বয়সের পক্ষে চাষাবাদ যেন ঠাট্টার ব্যাপার।
আমিরন চাচির সংসার ছোট। কিন্তু দরিয়াবিবির সংসারে এতগুলি পেট চালানো সহজ নয়। প্রথম দিকে সহানুভূতি কারো কম ছিল না। কিন্তু তারও সীমা আছে। বেচারা চন্দ্র নিজেই অস্থির। সে চাষ করে, মাছ ধরে, গান করে। কিন্তু সব সময় রোজগার হয় না। তবু তার আন্তরিকতা অকৃত্রিম। নিজে না আসিলেও বোনকে পাঠাইয়া খোঁজ-খবর লয়। এলোকেশী খালি হাতে আসে না। কোনোদিন মাছ, মাঠের ফসল, অন্তত একফালি কুমড়া হাতে সে লৌকিকতা রক্ষা করে।
চারিদিকে ভাঙন। নঈমার চোখে আজকাল খুব পিচুটি জমে। চোখে ভালো দেখে হয়ত অন্ধ হইয়া যাইবে।
ইয়াকুব মাঝে মাঝে চিরাচরিত আড়ম্বরে আসে। মাঝে মাঝে টাকাও সাহায্য করে। দরিয়াবিবি কর্জ চাহিতে লজ্জা পায় না। কিন্তু এইভাবে দিন কতদূর গড়াইতে পারে। আগে ঘরে দুধ ছিল। এখন গাইটা অল্প দুধ দেয়, তা-ও বিক্রয় করিতে হয়। শমী-র মুখে দুধ ওঠে না। তিন বছরের মেয়ে ভাত ধরিয়াছে বড়দের মতো। তার মাঝে মাঝে পেটের অসুখ করে, সহজে সারে না। শুধু শরীরের কাঠামোর জোরে টিকিয়া আছে।
দুঃখের পেয়ালা পূর্ণ করিবার জন্য এমনই দুর্দিনে মোনাদিরের পত্র আসিল। সে লিখিয়াছে :
মা, আমার সালাম জানিবেন। বহুদিন বহু জায়গায় ঘুরিয়া আমি এখন স্কুলে পড়িতেছি। পাঁচটা টাকা যদি মাস-মাস আমার জন্য পাঠান, কোনো রকমে আমার দিন চলিতে পারে। আপনাদের অসুবিধা হইলে পাঠাইবেন না। আমার দিন এক রকমে চলিয়া যাইবে। আমু, নঈমাদের জন্য আমার স্নেহ।
ইতি
আপনার স্নেহের
মুনি
একটি ইনভেলাপে পত্ৰ আসিয়াছিল। আমজাদ পড়িয়া শোনাইল। দরিয়াবিবি যুগপত আনন্দ ও নিরাশায় খামখানি হাতের মুঠায় ধরিয়া ভাবিতে লাগিল। তিন-চার বৎসর। অতিবাহিত। কত বড় হইয়াছে মুনি! একটি দীর্ঘশ্বাসে দরিয়াবিবি এই চিন্তা সমাহিত করিল। পাঁচটি টাকা সাত রাজার ধন নয়। তবু সে-কথাই আগে ভাবিতে হয়।
আমজাদ পাশে বসিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, মা, মুনি ভাইকে টাকা পাঠাবে না?
পাঠাব। পাঠাতে পারবি?
তা আর পারব না! তুমি টাকা দিও, মনি অর্ডার করে আসব। পোস্টাপিস আছে পাশের গায়ে।
দরিয়াবিবির ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি দেখা দিল। আমজাদ এখনো কত অবোধ।
কিছুক্ষণ আগে আমজাদ সংবাদ আনিয়াছিল, এবার জমির ধান ইয়াকুব নৌকায় বোঝাই দিয়া লইয়া গিয়াছে। এতদিন জমি বিক্রয় হইয়াছিল। কিন্তু ধান, বর্গা পরিশোধের পর অর্ধেক পাওয়া যাইত। ইয়াকুবের করুণা! এবার তাও বন্ধ। জমি কিনিয়াছে, ফসল লইয়া যাইবে– বৈচিত্র্য কিছু নাই। তবু দরিয়াবিবি ক্ষোভে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। পুত্রের কাছে সংবাদ পাইয়া আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন সে মনে করে নাই।
মুনির পত্র হাতে ইয়াকুবের কথাই প্রথমে স্মরণ হইল ও হঠাৎ অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, পাঁচটা টাকা। আমজাদ তাহা শুনিতে পাইল না।
দুদিন পর ইয়াকুব এখানে পৌঁছিলে, দরিয়াবিবি তার শরণাপন্ন হইল।
ভাই, আমার একটা আরজ আজ তোমাকে রাখতে হবে।
আপনার আরজ। বলুন-বলুন। ইয়াকুব ভয়ানক আগ্রহ দেখাইয়া বলিল, আপনি এত চুপচাপ থাকেন।
ভাই, চুপচাপ কি সাধে থাকি। দেখছ না, কত সুখে আছি।
আপনার দুঃখ কি। আপনার মুখের হাসির দাম লাখ টাকা।
অন্য সময় এমন গায়ে-পড়া প্রশংসা দরিয়াবিবি বেয়াদবীর শামিল মনে করিত। আজ তা গায়ে মাখিয়া লইল। ইয়াকুব কিন্তু কথাটা বলিয়াই দরিয়াবিবির দিকে আড়চোখে তাকাইল।
লাখ টাকা নয়, পাঁচ টাকার আরজ।
মোটে। ইয়াকুব ঠোঁট কুঁচকাইল।
হ্যাঁ।
মোটে?
হ্যাঁ, কিন্তু মাস-মাস দিতে হবে।
কাউকে দেবেন?
হ্যাঁ।
কাকে?
তা কোনোদিন জানতে চেয়ো না।
আপনার যা হুকুম। ইয়াকুব হাসিয়া ঘাড় নোয়াইল ও কহিল, আপনি বলেন, আর কি দরকার। আপনি একদম পাথরের মতো কি-না, মুখে কিছু বলেন না। আজ ধান নিয়ে গেলাম। কই, কিছু তো বললেন না?
তোমার জমির ধান তুমি নিয়ে গেছ। কি আবার বলতে হবে? দরিয়াবিবির কণ্ঠে মোলায়েম ব্যঙ্গের সুর।
কেন বলবেন না? আপনারা আমার আপনজন। জমি কিনেছি বলে ধানও নিয়ে যাব?