না ভাবী। আপনি সংসারের লক্ষ্মী।
দরিয়াবিবি এই প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয়। সেও হাসিতে থাকে এবং বলে, নূতন কথা শোনালে ভাই।
ইয়াকুব এই নৈকট্যের প্রাসাদই তো চায়। সে খুশি হইয়া বলিল, বাচ্চাদের ডাকেন, আমাকে আর দুটো লুচি দিন।
সহজ গলায় দরিয়াবিবি জবাব দিল, বাচ্চারা পরে খাবে। তুমি এখন খাও।
ইয়াকুব খাওয়া শেষ করিয়া বলিল, ভাবী, আমি একটু বেড়িয়ে আসি। আপনাদের গা খানা বড় জংলাটে। টাকা পকেটে করে ঘোরা যায় না। আমার ব্যাগটা রাখেন।
আমার কাছে কেন?
ইয়াকুব টাকার ব্যাগ হাতে বলিল, চুরি হওয়ার ভয় আছে।
কত টাকা আছে?
পাঁচশ।
না ভাই। এত টাকা–হঠাৎ রাত্রে চোর এসে নিয়ে গেলে।
আপনার কাছে চোর টাকা চুরি করতে আসবে না। ইয়াকুব মৃদু হাসি ছিটাইয়া বলিল।
তবে কেন আসবে?
কথা ঘুরাইয়া ইয়াকুব জবাব দিল, চোরের ভয় নেই? আপনার যা সাহস। আমার গোশতের ঢিবিরা এমন জংলা জায়গায় থাকলে দশটা দারওয়ান রাখতে হত।
দরিয়াবিবি হাত পাতিয়া দিল। ইয়াকুব মানিব্যাগ দিতে বিলম্ব করিল না। বাহিরে তখন গোধূলি। ইয়াকুব বাহির হইয়া আসিল। দরিয়াবিবি আঁচলে ব্যাগ বাঁধিয়া আবার কাজে মনোযোগ দিল।
পরদিন দুপুরে ইয়াকুব গঞ্জের নৌকা ধরিবে। যাইবার সময় সে বলিল, ভাবী, আমার ব্যাগটা দিন।
দরিয়াবিবি আমানত ফিরাইয়া দেওয়ার সময় বলিল, ভাই, তোমার কাছে একটা আরজ আছে।
ভয়ানক অধীরতা প্রকাশ করিল ইয়াকুব। সে ভাবিয়াছিল, ব্যাগে আরো টাকা আছে, হয়ত দরিয়াবিবি ঋণের আবেদন জানাইবে।
আপনার আরজ কি? হুকুম বলুন। তাড়াতাড়ি বলুন।
একটা খোঁজ-খবর নিও।
তা আর নেব না। আমি মনে করেন আপনাদের পর, ভাবী? ইয়াকুব দরিয়াবিবির মুখের দিকে তাকায়। সে কিন্তু নতমুখী। দৃষ্টি মাটির উপর কি যেন খুঁজিতেছে।
খুব মৃদু কণ্ঠেই দরিয়াবিবি জবাব দিল, আমাদের খোঁজ নয়।
ইয়াকুব হতাশ। আবার প্রশ্ন করিল, তবে কার?
তোমার ভাইয়ের খবরটা।
ওহ্ আজহার ভাইয়ের! তিনি তো খেয়ালী লোক, আসবেন একদিন। ইয়াকুব জবাব দিল অত্যন্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে।
তার জন্য আপনি এত উতোলা কেন? বিস্ময় প্রকাশ করিল ইয়াকুব।
স্বামীর জন্য এত মাথাব্যথা কেন, তুমি তা-ই জিজ্ঞেস করছ? দরিয়াবিবি সোজাসুজি ইয়াকুবের দিকে তাকাইল।
না-না, তা নয়। আমি ভাবছি, একটু বিরাগী ধরনের মানুষ তার জন্যে ভেবে লাভ কী। ইয়াকুব তখনই দৃষ্টি নামাইয়া অপরাধী সুলভ কণ্ঠে জানাইল।
তবু ভাবতে হয়। শহরে মালপত্র কিনতে তোমার লোক যায়, তাই খবর নিতে বলছি।
নিশ্চয়, খবর নেব বৈকি। আমি তার কোনো ত্রুটি রাখব না।
নিও ভাই। আল্লা তোমার ভালো করবে। দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বরে কোনো খাদ ছিল না।
গঞ্জের বেলা হয়ে গেল। আপনাকে খবর দেব, আপনি নিশ্চিত থাকেন।
ইয়াকুব আর দেরি করিল না। দরিয়াবিবি ঘরে ফিরিয়া আসিল।
৩১-৩৫. দরিয়াবিবি আগে
দরিয়াবিবি আগে আশপাশের দুএকটি ভিটা ছাড়া আর কারো বাড়ি যাইত না। তার নিজেরও লজ্জা করিত। তা ছাড়া ছিল আজহারের ভয়। এমনি শান্ত মানুষ, কিন্তু বেশরিয়তী দেখিলে আর রক্ষা ছিল না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাংসারিক প্রয়োজনে দরিয়াবিবিকে। অন্য পাড়ায় যাইতে হয়।
আমিরন চাচির বাড়ি পাড়ার এক টেরে। পথে এত ঝোঁপ-জঙ্গল। আর এই সড়ক প্রায় নির্জন থাকে। কারণ লোক-চলাচল কম। দরিয়াবিবির পর্যন্ত ভয় হয়। তাই সঙ্গে আমজাদকে লইত। নঈমা মা ছাড়া ঘরে থাকে না। সেও প্রায়ই সঙ্গে যায়। আমজাদের এই পথে হাঁটিতে খুব আরাম লাগে। সে এইজন্যে মাঝে মাঝে আমিরন চাচির বাড়ি চল বলিয়া দরিয়াবিবির কাছে বায়না ধরে।
চাচির বাড়ির আরো আকর্ষণ ছিল। আমিরন চাচি ঘরে ছেলেদের জন্য মোয়া, নাড় ১৭৬
কিছু-না কিছু সব সময় মজুদ রাখে। আর আম্বিয়া মেয়েটি বড় প্রাণবন্ত। সেখানে গেলে মেয়েদের গল্পের অবসরে বেশ কিছুক্ষণ খেলা করা যায়।
আমজাদ সেদিন জিদ ধরিয়া দরিয়াবিবিকে চাচির বাড়ি লইয়া গেল। হাতে বিশেষ কাজ নাই। দরিয়াবিবির কোনো আপত্তি ছিল না। সেখানে গেলে মন কিছু হালকা হয়।
আমিরন চাচি গরুকে এই মাত্র জাব দিয়া হাত ধুইতেছিল। হঠাৎ দরিয়াবিবি ও ছেলেদের দেখিয়া স্মিতহাস্যে সাদর অভ্যর্থনা জানাইল, এসো বুবু এসো। আরে, আজ আমজাদ চাচা, নঈমা খালা সুদ্ধ এসেছ। ও আম্বিয়া, বেরিয়ে আয়।
ডাক দেওয়ার আগেই মেয়ে হাজির।
আম্বিয়া আর একটু ডাগর হইয়াছে। চাঞ্চল্য আদৌ কমে নাই। সে আমজাদের দুই। হাত ধরিয়া বলিল, আমু ভাই, চল ঘুঘুর বাসা দেখে আসি। তালগাছের পাশে একটা করঞ্জা গাছের কোটরে বাসা বানিয়াছে।
চল।
আর কার তোয়াক্কা। আম্বিয়ার পিছু পিছু আমজাদও দৌড়াইতে লাগিল। পিছন হইতে আমিরন চাচি চিৎকার দিয়া ডাকিল, তোরা বেশি ঝোঁপের ভিতর যাসনি, বড় সাপের জুলুম বেড়েছে। কিন্তু তার কথা কে শোনে?
আমিরন চাচি পান সাজিয়া দিল। দরিয়াবিবির সাধারণত পান খাওয়ার অভ্যাস নাই। তবে চাচির দান প্রত্যাখ্যান করে না।
আমিরন চাচি জিজ্ঞাসা করিল, আজ কি রান্না হল?
রান্না সেরে এসেছি।
আমিরন চাচি যেন প্রশ্নের জবাব পাইয়াছে। তাই অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল।
আমার দেওরটা আসলে লোক খারাপ ছিল না।
আমিরন চাচির কথার মধ্যে দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আবার জুলুম ধরেছে নাকি?