দাওয়ার এককোণায় চন্দ্রমণি বসিয়া পড়িল। শাদা থানকাপড় পরনে। তার ফ্যাকাশে রক্তহীন শরীরের সঙ্গে রঙের ভালো সামঞ্জস্য হইয়াছে।
দুইটি উলঙ্গ কালো ছেলে চন্দ্রমণির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আজহার ইহাদের। আগে দেখে নাই।
পিতৃহীন অনাথদের পরিচয় তার অনুমানের কাছে অজানা নয়। তবু সে জিজ্ঞাসা করে : তোমার ছেলে না, মণি?
হ্যাঁ, দাদা। বড় গোপালের বয়স মোটে পাঁচ। যোগীন তিন বছরের। ওদের নিয়েই তো আমি জ্বলেপুড়ে মরলুম। একটা কানাকড়ি যদি বিধবা হওয়ার সময় রেখে যেত–
চন্দ্রমণির কোটরাগত নিষ্প্রভ চক্ষু হইতে টস্ট পানি পড়ে। গোপাল ও যোগীন মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া থাকে।
চন্দ্রমণি আচ্ছন্ন চোখেই আবার বলিল, দাদা ছিল বলে মাথা গোঁজার ঠাই আছে। কিন্তু দাদার অবস্থা তো দেখছ, ছেলেপুলে মরে গেল। তার ওপর আবার আমার বোঝা।
শুকনা গামছা পরিয়া কল্কেয় দম দিতে দিতে চন্দ্র বাহিরে আসিল। তার চোখ পড়ে মণির উপর।
এই আবার প্যানপ্যান শুরু করেছিস। এই মণি, অমন করবি তো যা নিজের জায়গায়। দেখ না আজহার ভাই, ওর হয়েছে কী। আমি তো মরে যাইনি।
চন্দ্র ধমক দিল আবার : যা উঠে, কিছু হয়নি। খেটে খেটে আমাদের জন্য শরীরটা কী হচ্ছে!
ভাগ-ভাগ– আর মুখ খুলিস নি। কী হয়েছে আমার শরীরের?
আজহারের হাতে কল্কে দিয়া চন্দ্র হাতের পেশি ফুলাইয়া বলে : দ্যাখ, মণি দ্যাখ। ঘুষি মেরে কোন্ বাপের ব্যাটা এটা নোয়াক দেখি।
মলো যা-যা রান্নাশালে।
গোঁফে তা দিয়া চন্দ্র ঠোঁট বাঁকাইল।
এলোকেশী চন্দ্রমণির হাত ধরিয়া টান দিল। সে বলিল : চলো না ঠাকুরঝি। ভাইবোনে আর সতীনের ঝগড়া দরকার নেই।
মৃদু হাসি এলোকেশীর ঠোঁটে।
যা-যা, নিয়ে যা শিগ্গির।
যোগীন মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে থাকে।
তুমি হাসছ! দেখি পাঞ্জা ধরো তো।
তিন বছরের শিশু। ভয় পায় না সে। কচি পাঞ্জা বাড়াইয়া দিল যোগীন।
গোপাল বড় নীরিহ। সে ছোটভাইয়ের খেলা দেখে। ভয়ে গোপাল মামার কাছে ঘেঁষে না।
এইরকম করে লড়তে শেখ বেটা। বড় হলে ডাকাতি করবি।
আজহার ঠোঁট হইতে কল্কে নামায়।
বেশ তালিম দিচ্ছ ভাগনেকে।
চন্দ্র লম্বা গোঁপে তা দিল একবার।
সত্যি, ডাকাত করব ছেলেগুলোকে। লুটেপুটে খাবে, খেটে তো খেতে পাবে না। নিজেও ডাকাতের দলে ঢুকব।
আজহার ভাবে, চন্দ্রের মাথায় ছিট আছে। তবু চুপ করিয়া যায় না সে।
তুমিও ডাকাতি করবে?
করব না? এত মেহনত করে লাভ কী? ধম্ম-উম্ম-ভগবান ওসব মানিনে। খেটে খেতে না-পাওয়ার চেয়ে চুরি করায় পাপ নেই।
আজহারের চোখ কপালে উঠিতেছে যেন।
কী সব বকছ, চন্দর!
সত্যি বলছি, মনমেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। তুমি বিশ্বাস করো ভগবান আছে, আল্লা আছে?
তৌবা, তৌবা, তৌবাস্তাগফের।
আজহার মনে মনে দরুদ শরিফ পড়িতে লাগিল।
যোগীন মাতুলের সঙ্গে তখনও পাঞ্জা লড়িতেছে।
চন্দ্র কোটালের মুখ বন্ধ থাকে না : আমরা খেটে খেতে পাই না। ওরা বসে-বসে তামাক ফোঁকে, গদিতে শুয়ে খেতে পায়। বলে, ভগবানের ইচ্ছে, কপাল! তেমন অবিচারী ভগবানে আমার দরকার? লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা।
গঞ্জে মেড়ো ব্যবসায়ীদের নিকট চন্দ্র হিন্দি জবান শোনে। আজ তার সুযোগ গ্রহণ করিল।
চন্দ্র যোগীনকে তাল দিতে শেখায়। গান করে সঙ্গে সঙ্গে : লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা। লুট করেঙ্গা
আজহার খাঁর মুখাবয়বের উপর চন্দ্রের দৃষ্টি পড়ামাত্র গান থামিয়া গেল।
গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিয়াছে আজহার খাঁ।
হাত বাড়াইয়া দিল চন্দ্র তার দিকে। বলিল, রাগ করছ? আচ্ছা, এখন আসল কথা পাড়া যাক।
জিজ্ঞাসা করে আজহার, কী কথা?
কী বলেছিলাম?
সে-প্রশ্ন এতক্ষণ আজহার খাঁর মনে কোনো চিহ্ন বজায় রাখে নাই। নিতান্ত নির্বোধের মতোই সে উত্তর দিল।
কী বলেছিলে?
একচোট হাসিয়া লইল চন্দ্র।
তা আর মনে থাকবে কেন। মাছ-ব্যবসা তোমার সঙ্গে?
আরো অপ্রতিভ হয় আজহার খাঁ।
লজ্জায় সে অস্পষ্ট কণ্ঠেই জবাব দিল, জানো তো আমার অবস্থা। টাকাও ধার পাওয়া গেল না।
খামাখা এতক্ষণ আমার সঙ্গে তর্ক জুড়েছিলে। চোখে চেয়ে দ্যাখো না। পেট চলে, ব্যবসা করব। তা একটা কানাকড়ি পুঁজি নেই।
তারপর চন্দ্র চুপ করিয়া গেল। চন্দ্রমণি নিঃশব্দে আসিয়া তাহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। সে-ই নীরবতা ভাঙিল।
–দাদা, মাছের ব্যবসার জন্য যোগীনের বাবারও খুব ঝোঁক ছিল।
চন্দ্র হুঁ শব্দে সায় দিল মাত্র।
যোগীনের মামার সঙ্গে খেলা বন্ধ। সে অভিমানীর মতো বসিয়া আছে। চন্দ্র তার দিকে দৃষ্টি ফেলিয়া জোরে হাসিয়া উঠিল।
এই ছোটমামা, আমাদের যুক্তি আঁটাই রইল। না, আর ব্যবসা করব না। চাষবাষ করব না।
আজহার মনে করে চন্দ্র তার উপর বিরক্ত। খটকা মুছিয়া ফেলিবার জন্য সে সরস কণ্ঠেই বলিল, আমার উপর রাগ করো না, চন্দর। গেল দুবছর কী করে যে সংসার চালিয়ে নিয়ে আসছি, আমিই জানি।
চন্দ্র যোগীনের মাকে আর এক কল্কে তামাক আনিবার জন্য আদেশ করিল।
তোমার উপর রাগের কী আছে। রাগ সব ওই-যে তুমি কী বলো–কপাল, কপালের উপর।
আজহার ভিজা কাপড়ে বসিয়াছিল। সে যেন কত অপরাধ করিয়াছে। সহজে চন্দ্রের দাওয়া হইতে উঠিতে পারিতেছিল না।
চন্দ্রমণি গগনে এক কল্কে আগুন লইয়া হাজির হইল। আজহার নির্জীবের মতো দুএক টান দিয়া কল্কে আবার প্রত্যর্পণ করিল।