নূরী, বনহুর সব পারে। ছলনা বা কৌশলে বনহুৱকে বন্দী করা এত সহজ নয়, সেটাই জানিয়ে দিলাম। আর অযথা বৃদ্ধ, নায়েব মহাশয়কে বিপদগ্রস্ত করতে চাইনে। শ্যামাচরণ মহাশয় কিছুতেই এই তিন লাখ টাকা ছাড়বে না, বৃদ্ধ নায়েব বাবুকেই পরিশোধ করতে হবে, নয়তো হাজত বাস।
তাতে তোমার কি, যা হয় হউকগে।
তা হয় না নূরী, অযথা কাউকে কষ্ট দেয়া আমার ইচ্ছে নয়, আচ্ছা চলি, ভোরে ফিরে আসবো।
নিস্তব্ধ প্রান্তরে জেগে ওঠে বনহুরের অশ্ব-পদশব্দ। নূৰী দু’হাতে বুক চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়, বুকের মধ্যে ধক ধক্ করে ওঠে, না জানি সে কেমনভাবে ফিরে আসবে।
রায়বাহাদুর শ্যামাচরণের বাড়ির পেছনে গিয়ে বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো, তারপর প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো অন্তঃপুরে। একে গভীর অন্ধকার, তার উপরে বনহুরের শরীরে কালো ড্রেস থাকায় অন্ধকারে মিশে গেল সে।
অতি সহজেই রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের কক্ষের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো।
কক্ষে ডিমলাইট জ্বলছে। বনহুর পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে অল্পক্ষণের মধ্যেই জানালার কাঁচ খুলে ফেললো, তারপর প্রবেশ করলো কক্ষে।
খাটের ওপর রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ শায়িত। গোটা রাত অনিদ্রায় কাটিয়ে এতক্ষণে একটু ঘুমিয়েছেন। তিন লাখ টাকার শোক কম নয়, টাকার শোকে তিনি অস্থির হয়ে পড়েছেন। যত দোষ ঐ নায়েব বাবুর। তিনি না জেনেশুনে অপরিচিত একটা লোককে বিশ্বাস করলেন, এত টাকা ছেড়ে দিল তার হাতে। না, এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করতে হবে। বৃদ্ধ পুরানো নায়েব বলে খাতির করলে চলবে না, জেল খাটাবেন। কিছুতেই রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ তাঁকে রেহাই দেব না…. এতসব ভাবতে ভাবতে কেবলমাত্র ঘুমিয়েছেন।
বনহুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের খাটের পাশে গিয়ে উঁড়ালো। তারপর গায়ে মৃদু আঘাত করে ডাকলো—উঠুন।
রায়বাহাদুর ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে তাকালেন সামনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করতে যাব, অমনি বনহুর রিভলবার চেপে ধরলো তার বুকে-খবরদার, চিৎকার করবেন না।
বনহুরের কালো অদ্ভুত ড্রেস, মুখে, গাল পাট্টা রায়বাহাদুরকে আতঙ্কিত করে তুললো। তিনি একটা ঢোক গিলে বলেন—তুমি কে?
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল-দস্যু বনহুর!
রায়বাহাদুর রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছিল, চিৎকার করে বলেন–তুমিই দস্যু বনহুর!
হেসে বলেন বনহুর-হ্যাঁ।
আবার কি জন্য এসেছো? আমার তিন লাখ টাকা নিয়েও তোমার লোভ যায়নি?
ভুল বুঝেছেন রায়বাহাদুর মহাশয়, আপনার টাকা নেইনি, আপনার নিকটে পৌঁছে দেবার জন্যই আপনার নায়েব বাবুর কাছ হতে নিয়ে এসেছি। কারণ আপনি যেভাবে টাকা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেভাবে আনাটা নিরাপদ নয়, তাই আমি–
ওঃ তাহলে তুমি টাকাটা অন্য কেউ লুটে নেবার পূর্বেই লুটে নিয়েছে, শয়তান কোথাকার!
দেখুন আমি শয়তান নই, শয়তানের বাবা। যাক বেশি বিরক্ত করতে চাইনে আপনাকে এ দুপুর রাতে। বুঝতেই পারছি আপনি এ তিন লাখ টাকার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। সে কারণেই আমি তাড়াতাড়ি এলাম, এ নিন আপনার টাকা। প্যান্টের পকেট থেকে তিন লাখ টাকার তোড়া বের করে রায় বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের হাতে দিয়ে বলে—গুণে নিন।
রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে। একবার হস্তস্থিত টাকা আর একবার বনহুরের কালো গালপাট্টা বাধা মুখের দিকে তাকান তিনি। একি অবিশ্বাসের কথা, বনহুর তবে কি তাকে হত্যা করতে এসেছে? ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল।
বনহুর পুনরায় বলে ওঠে—নিন টাকা গুণে নিন। এক পা পাশের চেয়ারে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে।
রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ কম্পিত হাতে টাকার তোড়াগুলো গুণে নিলেন।
বনহুর বলেন—ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
বনহুর এক টুকরা কাগজ আর কলম বাড়িয়ে ধরলো রায়বাহাদুর মহাশয়ের সামনে—একটা রসিদ লিখে দিন, আমি তিন লাখ টাকা বুঝে পেলাম।
শ্যামাচরণ কাগজ আর কলমটা হাতে নিয়ে লিখলেন।
বনহুর হেসে বলেন—নিচে নাম সই করুন।
শ্যামাচরণ মহাশয় নাম সই করে কাগজখানা বনহুরের হাতে দিল।
বনহুর কাগজখানা হাতে নিয়ে আর একবার পড়ে দেখলো, তারপর পকেটে রাখলো। রিভলবার উঁচিয়ে ধরে পিছু হটতে লাগলো সে, পরমুহূর্তে যে পথে এসেছিল সে পথে অদৃশ্য হলো।
এবার বনহুরের অশ্ব রায় মহাশয়ের দেশের বাড়ির সদর গেটে গিয়ে থামলো, অতি সতর্কতার সঙ্গে প্রাচীর টপকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলো সে। নায়েব বাবুর কক্ষ সেদিন চিনে নিয়েছিল বনহুর, আজ সে কক্ষের দরজায় আঘাত করলো।
নায়েব বাবুর চোখে ঘুম নেই, তিন লাখ টাকা যেমন করে হউক তাকে পরিশোধ করতেই হবে, না হলে নিস্তার নেই। কিন্তু কোথায় পাবেন তিনি অত টাকা। মাথার চুল ছিড়ছেন তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঠিক সে মূহুর্তে কক্ষের দরজায় মৃদু শব্দে নায়েব বাবু বিছানায় উঠে বসে বলেন—কে?
বনহুর পুনরায় শব্দ করে ঠুক ঠুক ঠুক…….
এবার নায়েব বাবু শয্যা ত্যাগ করেন। দরজা খুলে দিয়ে সম্মুখে বনহুরকে দেখেই চিৎকার করতে যান, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর চেপে ধরে তার মুখভয় নেই, আজ টাকা নিতে আসিনি। রায় বাহাদুর মহাশয়ের নিকটে টাকা পৌঁছে দিয়েছি, এই নিন রসিদ।
বৃদ্ধ নায়েব কম্পিত হাতে রসিদখানা হাতে নিয়ে হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না এ কথা।