- বইয়ের নামঃ সুর-সাকী
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আকুল হলি কেন বকুল বনের পাখি
বেহাগ-মিশ্র – দাদরা
আকুল হলি কেন বকুল বনের পাখি।
দেখেছিস তুইও নাকি প্রিয়ার ডাগর আঁখি॥
মধু ও বিষ মেশা
সেই সে আঁখির নেশা
তোরে করেছে পাগল, তাই কি এত ডাকাডাকি॥
চোখে পড়িলে বালি জ্বালাতে জ্বলিয়া মরি,
চোখে যাহার পড়েছে চোখ সে বাঁচে কেমন করি।
ফরাই আঁখি যেদিক পানে
তারই আঁখি মনে আনে,
বলিস পাখি দেখা হলে প্রাণ শুধু আছে বাকি॥
আজ ভারতের নব আগমনি
ভৈরবী – দাদরা
আজ ভারতের নব আগমনি
জাগিয়া উঠেছে মহাশ্মশান।
জাগরণী গায় প্রভাতের পাখি,
মরুতে বসেছে ফুল-বাথান॥
টলেছে অটল হিমালয় আজি,
সাগরে শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি,
হলাহল শেষে উঠিছে অমৃত
বাঁচাইতে মৃত মানব-প্রাণ॥
আঁধারে করেছে হানাহানি যারা
আলোকে চিনেছে আত্মীয় তারা,
এক হয়ে গেছে খ্রিস্টান শিখ
পারসি হিন্দু মুসলমান।
ধ্যানের ভারত নবরূপ ধরে
গড়িয়া উঠিছে গৌরব ভরে,
বিদূরিত হবে বিশ্বে এবার
হিংসা দ্বন্দ্ব অকল্যাণ।
এই তাপসীর চরণের তলে
পাইয়াছে জ্ঞান-আলোক সকলে,
প্রণাম করিয়া দেশ দলে দলে,
আসিবে করিতে তীর্থ স্নান॥
আজ শেফালির গায়ে হলুদ
পিলু – কারফা
আজ শেফালির গায়ে হলুদ
উলু দেয় পিক পাপিয়া।
প্রথম প্রণয়-ভীরু বালা
লাজে ওঠে কাঁপিয়া॥
বনভূমি বাসর সাজায়
ফুলে পাতায় লালে নীলে,
ঝরে শিশির আশিস-বারি
গগন-ঝারি ছাপিয়া॥
বৃষ্টি-ধোয়া সবুজ পাতার
শাড়ি করে ঝলমল,
ননদিনি ‘বউ কথা কও’
ডাকে আড়াল থাকিয়া॥
দেখতে এল দিগ্বালিকা
সাদা মেঘের রথে ওই,
শরৎ-শশীর মঙ্গল-দীপ
জ্বলে গগন ব্যাপিয়া॥
অতীত প্রণয়-স্মৃতি স্মরি
কেঁদে যায় আশিন হাওয়া,
উড়ে বেড়ায় বর সে ভ্রমর
কমল-পরাগ মাখিয়া॥
আজকে দোলের হিন্দোলায়
কাফি – হোরি
আজকে দোলের হিন্দোলায়
আয় তোরা কে দিবি দোল।
ডাক দিয়ে যায় দ্বারে ওই
হেনার কুঁড়ি আমের বৌল॥
আগুন-রাঙা ফুলে ফাগুন লালে-লাল,
আগুন-রাঙা ফুলে ফাগুন লালে-লাল,
লোল হয়ে পড়িল ওই রাতের জোছনা-আঁচল॥
হতাশ পথিক পথ-বিভোল,
ভোল আজি বেদনা ভোল,
টোল খেয়ে যাক নীল আকাশ
শুনে তোদের হাসির রোল,
দ্বার খুলে দেখ–ফুলেল রাত
ফুলে ফুলে ডামাডোল॥
আজি গানে গানে ঢাকব আমার গভীর অভিমান
পিলু-খাম্বাজ – কারফা
আজি গানে গানে ঢাকব আমার
গভীর অভিমান।
কাঁটার ঘায়ে কুসুম করে
ফোটাব মোর প্রাণ॥
ভুলতে তোমার অবহেলা
গান গেয়ে মোর কাটবে বেলা,
আঘাত যত হানবে বীণায়
উঠবে তত তান॥
ছিঁড়লে যে ফুল মনের ভুলে
গাঁথব মালা সেই সে ফুলে,
আসবে যখন বন্ধু তোমার
করব তারে দান॥
আমার সুরের ঝরনা-তীরে
রচব গানের উর্বশীরে
তুমি সেই সুরেরই ঝরনা-ধারায়
উঠবে করে স্নান॥
কথায় কথায় মিলায়ে মিল
কবি রে, তোর ভরল কি দিল,
তোর শূন্য হিয়া, শূন্য নিখিল,
মিল পেল না প্রাণ॥
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
ধনী – হোরি ঠেকা
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
আমের বউলে দোলন-চাঁপায়।
মৌমাছিরা পলাশ ফুলের গেলাস ভরে মউ পিয়ে যায়।
শ্যামল পাতার কোলে কোলে
আবির-রাঙা কুসুম দোলে,
দোয়েল শ্যামা লহর তোলে
কৃষ্ণচূড়ার ফুলেল শাখায়॥
বন-গোপিনী ফুল ছুঁড়ে ওই
খেলে হোরি দখিন-বায়ে,
হলদে পাখি দোদুল দুলে
সোনাল শাখায় আদুল গায়ে।
ভাঁট-ফুলের এ নাট-দেউলে
রঙিন প্রজাপতির দুলে,
মন ছুটে যায় দূর গোকুলে
বৃন্দাবনে প্রেম-যমুনায়॥
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
ধানী – হোরি
আজি দোল-ফাগুনের দোল লেগেছে
আমের বোলে দোলন-চাঁপায়।
মৌমাছিরা পলাশ ফুলের
গেলাস ভরে মউ পিয়ে যায়॥
শ্যামল তরুর কোলে কোলে
আবির-রাঙা কুসুম দোলে,
দোয়েল শ্যামা লহর তোলে
কৃষ্ণচূড়ার ফুলেল শাখায়॥
বন-গোপিনী ফুল ছুঁড়ে ওই খেলে হোরি দখিন বায়ে,
হলদে পাখি দোদুল দুলে সোনাল শাখায় আদুল গায়ে।
ভাঁট-ফুলের ওই নাট-দেউলে,
রঙিন প্রজাপতি দুলে,
মন ছুটে যায় দূর গোকুলে
বৃন্দাবনে প্রেম-যমুনায়॥
আজিকে তনু মনে লেগেছে রং লেগেছে রং
পাহাড়ি মিশ্র – দাদরা
আজিকে তনু মনে লেগেছে রং লেগেছে রং।
বধূর বেশে ধরা সেজেছে অভিনব ঢং॥
কাননে আলোছায়া,
নয়নে রঙের মায়া,
দুলে দোদুল কায়া, পরানে বাজিছে সারং॥
সে রঙের সাগর-কোলে
কত চাঁদ রবি দোলে,
বাজে গগন-তলে জলদ-তালে মেঘ-মৃদং॥
আনমনে জল নিতে ভাসিল গাগরি
বেহাগ – কাওয়ালি
আনমনে জল নিতে ভাসিল গাগরি।
সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি॥
জানি না, বলিব কী, শুধাবে যবে ননদি
কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি,
গাগরি না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি–
কী বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরি॥
একেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে
ডাকিল বউ-কথা-কও কেন হলুদ-চাঁপার শাখে,
বিদেশে শ্যাম আমার পড়ল মনে সেই সে ডাকে,
ঠাঁই দে যমুনে, বুকে, আমি ডুবিয়া মরি॥
আনো সাকি শিরাজি আনো আঁখি-পিয়ালায়
ভৈরব – সেতারখানি
আনো সাকি শিরাজি আনো আঁখি-পিয়ালায়।
অধীর করো মোরে নয়ন-মদিরায়॥
পানসে জোছনাতে – ঝিম হয়ে আসে মন,
শারাব বিনে হেরো গুলবন উচাটন,
মদালস আঁখি কেন ঘোমটা ঢাকা এমন
বিষাদিত নিরালায়॥
তরুণ চোখে আনো অরুণ রাগ-ছোঁওয়া,
আঁখির করুণা তব যাচে ভোরের হাওয়া।
জীবন ভরা কাঁটার জ্বালা
ভুলিতে – চাহি শারাব-পিয়ালা
তোমার হাতে ঢালা॥
দুলাইয়া দাও মোরে আনন্দের হিন্দোলায়
ভুলাইয়া বেদনায়॥
আমার নয়নে নয়ন রাখি
মালবশ্রী মিশ্র – কারফা
আমার নয়নে নয়ন রাখি
পান করিতে চাও কোন অমিয়।
আছে এ আঁখিতে উষ্ণ আঁখিজল
মধুর সুধা নাই পরান-প্রিয়॥
ওগো ও শিল্পী, গলাইয়া মোরে
গড়িতে চাহ কোন মানস-প্রতিমারে,
ওগো ও পূজারি, কেন এ আরতি
জাগাতে পাষাণ-প্রণয়-দেবতারে।
এ দেহ-ভৃঙ্গারে থাকে যদি মদ
ওগো প্রেমাস্পদ, পিয়ো গো পিয়ো॥
আমারে করো গুণী, তোমার বীণা,
কাঁদিব সুরে সুরে কণ্ঠ-লীনা,
আমার মুখের মুকুরে কবি
হেরিতে চাহো কোন মানসীর ছবি।
চাহো যদি–মোরে করো গো চন্দন
তপ্ত তনু তব শীতল করিয়ো॥
আমার শ্যামলা বরন বাংলা মায়ের
খাম্বাজ মিশ্র – দাদরা
আমার শ্যামলা বরন বাংলা মায়ের
রূপ দেখে যা, আয় রে আয়।
গিরি-দরি-বনে মাঠে-প্রান্তরে রূপ ছাপিয়া যায়॥
ধানের খেতে বনের ফাঁকে
দেখে যা মোর কালো মাকে,
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিণী বীণ বাজায়॥
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিণী বীণ বাজায়॥
বিজন মাঠে গ্রাম সে বসায় নিয়ে কাদা খড় মাটি,
কাজল মেঘের ঝারি নিয়ে করুণা-বারি ছিটায়॥
কাজলা-দিঘির পদ্মফুলে যায় দেখা তার পদ্ম-মুখ,
খেলে বেড়ায় ডাকাত মেয়ে বনে লয়ে বাঘ ভালুক,
ঝড়ের সাথে নৃত্যে মাতে, বেদের সাথে সাপ নাচায়॥
নদীর স্রোতে পাথর নুড়ির কাঁকন চুড়ি বাজে তার,
দাঁড়ায় সাঁঝের অলিন্দে সে টিপ পরে সন্ধ্যা তারার,
উষার গাঙে ঘট ভরিতে যায় সে মেয়ে ভোর বেলায়॥
হরিৎ শস্যে লুটায় আঁচল ঝিল্লিতে নূপুর বাজে
ভাটিয়ালি গায় ভাটির স্রোতে, গায় বাউল মাঠের মাঝে,
গঙ্গা-তীরে শ্মশান-ঘাটে কেঁদে কভু বুক ভাসায়॥
আমার সোনার হিন্দুস্থান
পাহাড়ি মিশ্র – কারফা
আমার সোনার হিন্দুস্থান।
দেশ-দেশ-নন্দিতা তুমি বিশ্বের প্রাণ॥
ধরণির জ্যেষ্ঠা কন্যা তুমি আদি মাতা,
তব পুত্র গাহিল বেদ-বেদান্ত সাম-গাথা,
তব কোলে বারেবারে এল ভগবান॥
আদিম যুগের তুমি প্রথমা ধাত্রী,
তোমার আলোকে হল প্রভাত রাত্রি,
সবে বিলাইলে অমৃত সংগীত জ্ঞান॥
সোনার শস্যে তব ঝলমল বর্ণ
অন্তরে মাণিক্য-মণি-হিরা-স্বর্ণ,
তুমি বর্বরে করিয়াছ মানব মহান॥
হিংসা-দ্বেষ-ভোগ-ক্লান্ত এ বিশ্ব
আবার শিখিবে ত্যাগ, হবে তব শিষ্য,
তুমি বাঁচাবে সবারে করি অমৃত দান॥
আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি
কীর্তন
আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি
আমি ভোজনের লাগি করি ভজন।
আমি মালপোর লাগি তল্পি বাঁধিয়া
এ কল্প-লোকে এসেছি মন॥
‘রাধাবল্লভি’-লোভে পূজি রাধা-বল্লভে,
রস-গোল্লার লাগি আসি রাস-মোচ্ছবে!
আমার গোল্লায় গেছে মন রস-গোল্লায় গেছে মন!
ও তো রসগোল্লা কভু নয়
যেন ন্যাড়া-মাথা বাবাজি থালাতে হয়েন উদয়!
গজা দেখে প্রেম যে গজায় হৃদিতলে রে,
পানতোয়া দেখে প্রাণ নাচে হরি বলে রে!
ওই গোলগাল মোয়া মায়াময় এই সংসার দেয় ভুলিয়ে,
আর ক্ষীরের খোয়াতে খোয়াইতে কুল মন ওঠে চুলবুলিয়ে!
মন বলে হরি হরি হাত বলে হরো হে
অরসিকে তেড়ে আসে বলে ওহে ধরো হে!
সংসারেতে ভক্ত শুধু রাঁধুনি ও ময়রাই–
সেই দুই ভাই আজি এসেছে রে!
যারা ময়দা পেয়ে মালপো বিলোয়
সে দুই ভাই আজি এসেছে রে!
আমি চিনি মেখে গায়ে যোগী হব দাদা যাব ময়রার দেশে
রস- করার কড়াই-এ ডুবিয়া মরিব গলে সন্দেশ ঠেসে।
ভোজন-ভজহরির শোনো এই তথ্য
গো-ময় সংসারে ভোজনই সত্য॥
আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম
কীর্তন
আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম
কালারে কালো কালিন্দী-কূলে।
সে যে বাঁশরির তানে সকরুণ গানে
ডাকিল প্রেম-কদম্ব-মূলে।
তার সাগর-অতল ডাগর আঁখির কূলে
সে কী ঢেউ উঠিল দুলে॥
সখী সে কী সকরুণ আঁখি লো
ভয়- অনুরাগ-মাখামাখি লো,
তার অশ্রু-সজল আঁখি ছলছল
দূর মেঘপানে ডাকিল॥
কেন কলস ভরিতে গেনু যমুনা-তীরে,
মোর কলাসির সাথে গেল ভাসি লাজ-কুল-মান
আকুল নীরে।
কলসির জল মোর নয়নে ভরিয়া সই
আসিনু ফিরে॥
সখী লো, তোদের সে রাই নাই,
তোদের গোকুলের রাই গোকুলে নাই,
এ-কুলে নাই ও কুলে নাই।
গোকুলের রাই গোকুলে নাই।
সে যে হারাইয়া গেছে শ্যামের রূপে লো
নবীন নীরদে বিজলি-প্রায়।
সে রবি শশী সম ডুবিয়া গেছে লো
সুনীল রূপের গগন-গায়॥
হরি-চন্দন-পঙ্কে লো সখি
শীতল করে দে জ্বালা,
দুলায়ে দে গলে বল্লভ-রূপী
শ্যাম পল্লব-মালা!
নীল কমল আর অপরাজিতার
শেজ পেতে দে লো কোমল বিথার,
পেতে দে শয্যা পেতে দে,
নীল শয্যা পেতে দে পেতে দে!
মোর শ্যামের স্মৃতির নীল শিখী-পাখা,
চূড়া বেঁধে কেশে গেঁথে দে!
পরাইয়া দে লো সখী
অঙ্গে নীলাম্বরী,
জড়াইয়া কালো বরন
আমি যেন মরি॥
আমি দেখন-হাসি আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে
বেহাগ মিশ্র – দাদরা
আমি দেখন-হাসি
আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে
পেয়ে যাবে কাশি॥
আমি হাসির হাঁসলি ফিরি করি,
এলে আমার হাসির দেশে
বুড়োরা সব ছোঁড়া হয়, হেসে
ছোঁড়ারা যায় টেঁসে!
আমার হাঁস-খালিতে বাড়ি
আমি হাসনুহানার মাসি॥
এলে আমার হাসির হেঁসেলে,
তার হাঁসফাঁসানি লেগে
অন্তে শুধু দন্ত থাকে
শরীরটা যায় ভেগে!
আমি পাতিহাঁসির আন্ডা বেচি,
আর হাসির ময়দা থাঁসি॥
সেদিন পথে যাচ্ছিল সব রাজার হাতি উট
আমায় দেখে হাসতে হাসতে চোঁ চাঁ দিলে ছুট,
হেসে পালায় দড়ি ছিঁড়ে মটরু মিয়াঁর খাসি॥
আয় গোপিনী খেলবি হোরি
ধানী – হোরি
আয় গোপিনী খেলবি হোরি
ফাগের রাঙা পিচকারিতে।
আজ শ্যামে লো করব ঘায়েল
আবির হাসির টিটকারিতে।
রঙে রাঙা হয়ে শ্যাম আজ
হবে যেন রাই কিশোরী,
যমুনা-জল লাল হবে আজ
আবির ফাগের রঙে ভরি।
কপালের কলঙ্ক মোদের
ধুয়ে যাবে রং ঝারিতে॥
গুরুজনের গঞ্জনা আজ
সইব না লো মানব না লাজ,
কুল ভুলে আজ গোকুল পানে
ভেসে যাব রাঙা গীতে॥
উদার ভারত সকল মানবে দিয়াছ তোমার কোলে স্থান
কানাড়া মিশ্র – একতালা
উদার ভারত! সকল মানবে
দিয়াছ তোমার কোলে স্থান।
পারসি জৈন বৌদ্ধ হিন্দু
খ্রিস্টান শিখ মুসলমান॥
তুমি পারাবার, তোমাতে আসিয়া
মিলেছে সকল ধর্ম জাতি,
আপনি সহিয়া ত্যাগের বেদনা
সকল দেশেরে করেছ জ্ঞাতি;
নিজেরে নিঃস্ব করিয়া, হয়েছ
বিশ্ব-মানব-পীঠস্থান॥
নিজ সন্তানে রাখি নিরন্ন
অন্য সবারে অন্ন দাও,
তোমার স্বর্ণ রৌপ্য মানিকে
বিশ্বের ভাণ্ডার ভরাও;
আপনি মগ্ন ঘন তমসায়
ভুবনে করিয়া আলোক দান॥
বক্ষে ধরিয়া কত সে যুগের
কত বিজেতার গ্লানির স্মৃতি,
প্রভাত আশায় সর্বসহা মা
যাপিছ দুখের কৃষ্ণা তিথি,
এমনই নিশীথে এসেছিলে বুকে
আসিবে আবার সে ভগবান॥
এ কী সুরে তুমি গান শুনালে ভিনদেশি পাখি
ভৈরবী – কারফা
এ কী সুরে তুমি গান শুনালে ভিনদেশি পাখি।
এ যে সুর নহে, মদির সুরা, রে সুরের সাকি॥
বসি মোর জানালা পাশে
কেন বুক-ভাঙা নিরাশে,
যাও ঘুম ভাঙায়ে নিতি সকরুণ সুরে ডাকি।
তোর ও সুরে কাঁদছে উষা অস্ত চাঁদের গলা ধরে,
ভোর-গগনের কপোল বেয়ে শিশির-অশ্রু গড়িয়ে পড়ে॥
আমি রইতে নারি ঘরে,
আমার প্রাণ কেমন করে,
আমার মন লাগে না কাজে, জলে ভরে আঁখি॥
এ জনমে মোদের মিলন হবে না আর, জানি জানি
পিলু-মিশ্র – কারফা
এ জনমে মোদের মিলন
হবে না আর, জানি জানি।
মাঝে সাগর, এপার ওপার
করি মোরা কানাকানি॥
দুজনে দুকূলে থাকি
কাঁদি মোরা চখাচখি,
বিরহের রাত পোহায় না আর
বুকে শুকায় বুকের বাণী॥
মোদের পূজা আরতি হায়
চোখের জলে, গহন ব্যথায়,
মোদের বুকে বীণা বাজায়
বেদনারই বীণাপাণি॥
হেথায় মিলন-রাতের মালা ম্লান হয়ে যায় প্রভাত বেলা,
সকালে যার তরে কাঁদি, বিকালে তায় হেলাফেলা।
মোদের এ প্রেম-ফুল না শুকায়
নিঠুর হাতের কঠোর ছোঁয়ায়,
ব্যথার মাঝে চির-অমর মোদের মিলন-কুসুমদানি॥
একী হাড়-ভাঙা শীত এল মামা
পিলু – কারফা
একী হাড়-ভাঙা শীত এল মামা।
যেন সারা গায়ে ঘষে দিচ্ছে ঝামা॥
হইয়া হাড়-গোড় ভাঙা দ
ক্যাঙারুর বাচ্চা যেন গো,
সেঁদিয়ে লেপের পেটে
কাঁপিয়া মরি, ভয়ে থ!
গিন্নি ছুটে এসে চাপা দেয় যে ধামা॥
বাঘা শীত,কাঁপি থরথর,
যেন গো মালোয়ারির জ্বর,
বেড়ালে আঁচড়ায় যেন
শাণিয়ে দন্ত নখর,
মা গো দাঁড়াতে নারি, চলি দিয়ে হামা॥
হাঁড়িতে চড়িয়ে আমায়
উনুনে রাখো গো ত্বরায়,
পেটে মোর ভরিয়া তুলো
বালাপোষ করো গো আমায়!
হল শরীর আমার ফেটে মহিষ-চামা।
ওরে হরে! নিয়ে আয় মোজা পায়জামা॥
একেলা গোরী জলকে চলে গঙ্গাতীর
জৌনপুরি – দাদরা
একেলা গোরী জলকে চলে গঙ্গাতীর।
অঙ্কে ঢুলিয়া পড়ে লালসে অলস সমীর॥
কাঁকনে কলসে বাজে
কত কথা পথ মাঝে,
আঁচল চুমিছে শিশির॥
তটিনীতে চলে কি গো
সোনার বরন মায়া-মৃগ,
নয়নে আবেশ মদির।
রাঙা উষার রাঙা সতিন,
পথ-ভোলা ছন্দ কবির॥
এল ফুলের মরশুম শারাব ঢালো সাকি
পাহাড়ি – দাদরা
এল ফুলের মরশুম
শারাব ঢালো সাকি।
বকুল-শাখে কোকিল ওঠে ডাকি॥
গেয়ে ওঠে বুলবুল আঙ্গুর-বাগে,
নীল আঁখি লাল হল রাঙা অনুরাগে,
আজি ফুল-বাসরে শিরাজির জলসা
বরবাদ হবে না কি॥
চাঁপার গেলাস ভরি ভোমরা মধু পিয়ে,
মহুয়া ফুলের বাসে আঁখি আসে ঝিমিয়ে।
পাপিয়া পিয়া পিয়া ডাকে বন-মাঝে,
গোলাপ-কপোল রাঙে গোলাপি লাজে,
হৃদয়-ব্যথার দারু আছে তব কাছে–
রেখো না তাহা ঢাকি॥
এসো মা ভারত-জননি আবার
জৌনপুরি মিশ্র – দাদরা
এসো মা ভারত-জননি আবার
জগৎ-তারিণী সাজে।
রাজরানি মা-র ভিখারিনি বেশ
দেখে প্রাণে বড়ো বাজে॥
শিশু-জগতেরে মায়ের মতন
তুমি মা প্রথম করিলে পালন,
আজ মা তোরই সন্তানগণ
কাঁদিছে দৈন্য লাজে॥
আঁধার বিশ্বে তুমি কল্যাণী
জ্বালিলে প্রথম জ্ঞান-দীপ আনি,
হইলে বিশ্ব-নন্দিতা রানি
নিখিল নর-সমাজে॥
দেখা মা সে অতীত মহিমা,
মুছে দে ভীরুতা গ্লানির কালিমা,
রাঙায়ে আবার দশদিক-সীমা
দাঁড়া মা বিশ্ব-মাঝে॥
ও কূল-ভাঙা নদী রে
ভাটিয়ালি–কারফা
ও কূল-ভাঙা নদী রে
আমার চোখের জল এনেছি মিশাতে তোর নীরে॥
যে লোনাজলের সিন্ধুতে নদী নিতি তব আনাগোনা,
মোর চোখের জল লাগবে না ভাই তার চেয়ে বেশি লোনা,
আমায় কাঁদতে দেখে আসবিনে তুই উজান বেয়ে ফিরে॥
আমার মন বোঝে না নদী,
তাই বারেবারে আসি ফিরে তোর কাছে নিরবধি।
তোর অতল তলে ডুবিতে চাই, তুই ঠেলে দিস তীরে॥
তোর জোয়ারে সাগরে ঠেলে ফেলে দেয়, তবু ভাটির স্রোতে
তুই ফিরে ফিরে যাস রে নদী সেই সাগরের পথে,
নদী তেমনি অবুঝ আমারও মন তোরই পিছে ফিরে॥
ওই ঘর-ভুলানো সুরে
পিলু-ভৈরবী–কারফা
ওই ঘর-ভুলানো সুরে
কে গান গেয়ে যায় দূরে।
তার সুরের সাথে সাথে
মোর মন যেতে চায় উড়ে॥
তার সহজ গলার তানে
সে ফুল ফুটাতে জানে,
তার সুরে ভাটির টানে
নব জোয়ার আসে ঘুরে॥
তার সুরের অনুরাগে
বুকে প্রণয়-বেদন জাগে,
বনে ফুলের আগুন লাগে,
ফুল সুধায় ওঠে পুরে॥
বুঝি সুর-সোহাগে ওরই
পায় যৌবন কিশোরী
হিয়া বুঁদ হয়ে গো নেশায়
তার পায়ে পায়ে ঘুরে॥
কত আর এ মন্দিরে-দ্বার হে প্রিয় রাখিব খুলি
ভীমপলশ্রী – কাওয়ালি
কত আর এ মন্দিরে-দ্বার,
হে প্রিয় রাখিব খুলি।
বয়ে যায় যে লগ্নের ক্ষণ
জীবনে ঘনায় গোধূলি॥
নিয়ে যাও বিদায়-আরতি,
হল ম্লান আঁখির জ্যোতি,
ঝরে যায় যে শুষ্ক স্মৃতির
মালিকার কুসুমগুলি॥
কত চন্দন ক্ষয় হল হায়
কত ধূপ পুড়িল বৃথায়,
নিরাশায় সে পুষ্প কত
ও পায়ে হইল ধূলি॥
ও বেদির তলে কত প্রাণ
হে পাষাণ, নিলে বলিদান!
তবু হায় দিলে না দেখা,
দেবতা, রহিলে ভুলি॥
কত সে জনম কত সে লোক
দুর্গা-মান্দ – দাদরা
কত সে জনম কত সে লোক
পার হয়ে এলে হে প্রিয় মোর।
নিভে গেছে কত তপন চাঁদ
তোমারে খুঁজিয়া হে মনোচোর॥
কত গ্রহে, প্রিয়, কত তারায়
তোমারে খুঁজিয়া ফিরেছি, হায়!
চাহো এ নয়নে, হেরিবে তায়
সে দূর স্মৃতির স্বপন-ঘোর॥
হারাই হারাই ভয় সদাই
বুকে পেয়ে বুক কাঁপে গো তাই,
বারে বারে মালা গাঁথিতে চাই
বারে বারে ছিঁড়ে মিলন-ডোর॥
মিলনের ক্ষণ স্বপন প্রায়
হে প্রিয়, চকিতে মিলায়ে যায়,
শুকাল না মোর আঁখি-পাতায়
চির-অভিশাপ নয়ন-লোর॥
আজও অপূর্ণ কত সে সাধ,
অভিমানী, তাহে সেধো না বাদ!
না মিটিতে সাধ, স্বপন-চাঁদ,
মিলনের নিশি কোরো না ভোর॥
কহ প্রিয়ে, কেমন এ রাতি কাটাই
পিলু – দাদরা
কহ প্রিয়ে, কেমন এ রাতি কাটাই।
কহিতে শরমে বাধে, তামুক যে নাই॥
প্রাণ করে আঁকুপাঁকু,
কোথায় গেলে পাই তামাকু,
পেটে যেন চলে মাকু
বুক করে আইঢাই।
তামাকু যে নাই॥
বসে আছি নইচে ধরে
শূন্য কলকে শূন্যে তুলে,
ধোঁয়া বিনে চোঁয়া ঢেকুর
ঠেলে ওঠে কণ্ঠ-মূলে।
প্রাণের দায়ে খেতে হবে
চেঁছে হুঁকোর কাই।
তামাকু যে নাই॥
হুঁকোর জলের গন্ধ শুঁকে
কোনোরূপে কাটত এ-রাত
ছুঁচো তাড়াইতে তাহাও
শেষ করেছ, হায় রে বরাত!
গুল থাকলেও হত উপায়,
দাঁত মেজেছ তাই দিয়ে, হায়!
রংপুরে তোমার বাড়ি ভেবেও শান্তি পাই॥
কাহার তরে হায় নিশিদিন কাঁদে মন প্রাণ
ভৈরবী মিশ্র – কারফা
কাহার তরে হায় নিশিদিন কাঁদে মন প্রাণ
জানে শুধু সেই, জানে আর হৃদি ব্যথা-ম্লান॥
কমল-পাতে যেন জল প্রণয় তার সই
বুলবুলি চপল ছলে যায় লতিকা-বিতান॥
জানে শুধু সে নিতে মন, দিতে জানে না,
দলিয়া চলে সে মুকুল, বারণ মানে না।
জীবন লয়ে খেলে সে মরণ-খেলা,
সকালে যারে চাহে তায় বিকালে হেলা।
কুসুম-সমাধি রচে সে নিঠুর পাষাণ॥
চাহি শুধু এই–যেন সে বাসিয়া ভালো
এমনই ব্যথা পায় সে ওগো ভগবান॥
কুঁচ-বরন কন্যা রে তার মেঘ-বরন কেশ
ভাটিয়ালি – কারফা
কুঁচ-বরন কন্যা রে তার মেঘ-বরন কেশ।
আমায় লয়ে যাও রে নদী সেই সে কন্যার দেশ॥
পরনে তার মেঘ-ডম্বুর উদয়-তারার শাড়ি,
রূপ নিয়ে তার চাঁদ-সুরুযে করে কাড়াকাড়ি,
আমি তারই লাগি বিবাগি ভাই,
আমার চির-পথিক বেশ॥
পিছলে পড়ে চাঁদের কিরণ নিটোল তারই গায়ে,
সন্ধ্যা সকাল আসে তারই আলতা হতে পায়ে।
সে রয় না ঘরে, ঘুরে বেড়ায় ময়নামতীর চরে,
তারে দেখলে মরা বেঁচে ওঠে, জ্যান্ত মানুষ মরে,
তোর জল-তরঙ্গে বাজে রে তার সোনার চুড়ির রেশ॥
কে দুয়ারে এলে মোর তরুণ ভিখারি
পিলু – আদ্ধা কাওয়ালি
কে দুয়ারে এলে মোর তরুণ ভিখারি
কী যাচে ও আঁখি বুঝিতে যে নারি॥
হৃদি প্রাণ মন
বিভব রতন
ডারিনু চরণে, লহো পথচারী॥
দুয়ারে মোর নিতি গেয়ে যাও যে গীতি
নিশিদিন বুকে বেঁধে তারইস্মৃতি,
কী দিয়ে ব্যথা নিবারিতে পারি॥
মিলন বিরহ
যা চাও প্রিয় লহো,
দাও ভিখারিনি-বেশ
দাও ব্যথা অসহ,
মোর নয়নে দাও তব নয়ন-বারি॥
কে পাঠালে লিপির দূতী
ঝিঁঝিট-খাম্বাজ – দাদরা
কে পাঠালে লিপির দূতী
গোপন লোকের বন্ধু গোপন।
চিনতে নারি হাতের লেখা
মনের লেখা চেনে গো মন॥
গান গেয়ে যাই আপন মনে
সুরের পাখি গহন বনে,
সে সুর বেঁধে কার নয়নে
জানে শুধু তারই নয়ন॥
কে গো তুমি গন্ধ-কুসুম,
গান গেয়ে কি ভেঙেছি ঘুম,
তোমার ব্যথার নিশীথ নিঝুম
হেরে কি মোর গানের স্বপন॥
নাই ঠিকানা নাই পরিচয়
কে জানে ও মনে কী ভয়,
গানের কমল ও চরণ ছোঁয়
তাইতে মানি ধন্য জীবন॥
সুরের গোপন বাসর-ঘরে
গানের মালা বদল করে
সকল আঁখির অগোচরে
না দেখাতে মোদের মিলন॥
কেরানি আর গোরুর কাঁধ
জংলা – কারফা
কেরানি আর গোরুর কাঁধ
এই দুই-ই সমান দাদা।
এক নাগাড়ে জোয়াল বাঁধা
টানছে খেয়ে নুন আদা॥
দুইজনে যা জাবনা পায়
দশগুণ তার নাদনা খায়,
হটর হটর টানছে গাড়ি
মানে নাকো জল কাদা॥
দুইজনাতে কথায় কথায়
পাঁচন-গুঁতো ন্যাজমলা খায়,
ছ্যাকড়াটানে বোঝাও বহে
কভু ঘোড়া কভু গাধা॥
বড়ো সায়েব আর গাড়োয়ান
দুই স্যাঙাতই এক সমান,
হতে নাহি পারে হবেও নাকো
এমন সম্বন্ধ পাতান,
গরিবের বউ বউদি সবার
বলে নে বাপ, নেই বাধা॥
খ্যাপা হাওয়াতে মোর আঁচল উড়ে যায়
খাম্বাজ-পিলু – দাদরা
খ্যাপা হাওয়াতে মোর আঁচল উড়ে যায়।
চলিতে নারি পথে দাঁড়ায়ে নিরুপায়॥
খুলে পড়ে গো বাজুবন্দ ধরিতে আঁচল,
কোন ঘূর্ণি বাতাস এল ছন্দ-পাগল,
লাগে নাচের ছোঁয়া দেহের কাচ-মহলায়।
হয়ে পায়েলা উতলা সাধে ধরিয়া পায়॥
খুলিয়া পড়ে খোঁপা, কবরী ফুলহার,
হাওয়ার রূপে গো এল কি বঁধু আমার,
এমনই দুরন্ত আদর সোহাগ তার,
এ কী পুলক-শিহরণে পরান মুরছায়॥
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায় প্রিয়তম।।
বাণ বেধা মোর গানের পাখিরে
তু’লে নিও প্রিয় তব বুকে ধীরে,
লভিবে মরণ চরণে তোমার
সুন্দর অনুপম।।
তারা সুখের পাখায় উড়িতেছিল গো নভে,
তব নয়ন শায়কে বিঁধিলে তাহাদের কবে।
মৃত্যু আহত কন্ঠে তাহার
একি এ গানের জাগিল জোয়ান,
মরণ বিষাদে অমৃতের স্বাদ
আনিলে বিষাদ মম।।
(ভৈরবী–একতালা)
গেরুয়া-রং মেঠো পথে বাঁশরি বাজিয়ে কে যায়
বাউল – নবতাল
গেরুয়া-রং মেঠো পথে বাঁশরি বাজিয়ে কে যায়।
সুরের নেশায় নুয়ে পড়ে ভুঁই-কদম তার পায়ে জড়ায়॥
সুর শুনে তার সাঁঝের ঠোঁটে,
বাঁকা শশীর হাসি ফোটে
গো-পথ বেয়ে ধেনু ছোটে
রাঙা মাটির আবির ছড়ায়॥
গগন-গোঠে গ্রহ তারা
সে সুর শুনে দিশাহারা,
হাটের পথিক ভেবে সারা
ঘরে ফেরার পথ ভুলে যায়॥
জল নিতে নদীকূলে
কুলবালা কুল ভুলে,
সন্ধ্যাতারা প্রদীপ তুলে
বাঁশুরিয়ার নয়নে চায়॥
গোলাব ফুলের কাঁটা আছে সে গোলাব শাখায়
পিলু মিশ্র – কারফা
শেয়র :- গোলাব ফুলের কাঁটা আছে সে গোলাব শাখায়
এনেছি তুলে রাঙা গুল পরাতে তোমার খোঁপায়।
কী হবে শুনে সে খবর গোলাব কাঁদিল কি না;
হৃদয় ছিঁড়েছি যাহার, বুঝিবে না গো সে বিনা।
ভুল ভাঙায়ো না আর সাকি, ঢালো শারাব-পিয়ালা।
মতলব কহিব পিছে, নেশা ধরুক চোখে বালা॥
জানি আমি জানে বুলবুল
কেন দলিয়া চলি ফুল,
ভালোবাসি আমি যারে, তারে ততই হানি জ্বালা॥
হাসির যে ফুর্তি ওড়ায় তার চোখের জলের দেনা
হিসাব করিয়া কে দেখে, হায় তুমি বুঝিবে না।
বুকের ক্ষত তাই লুকাই পরি রাঙা ফুলের মালা॥
তিক্ত নহে এ শারাব বিফল মোর জীবনের চেয়ে,
শোনায়ো না নীতি-কথা, শোনাও খুশির গজল গেয়ে,
প্রভাতে টুটিবে নেশা, আসে বিদায়ের পালা॥
চাঁদিনি রাতে কানন-সভাতে
সিন্ধু-ভৈরবী – কারফা
চাঁদিনি রাতে কানন-সভাতে
আপন হাতে গাঁথিলে মালা।
সয়েছি বুকে নিবিড় সুখে
তোমার হাতের সূচির জ্বালা॥
আজিও জাগে লোহিত রাগে
রঙন গোলাবে তাহারই ব্যথা,
তব ও-গলে,দুলিব বলে
দিয়াছি কুলে কলঙ্ক কালা॥
যদি ও-গলে নেবে না তুলে
কেন বধিলে ফুলের পরান,
অভিমানে হায় মালা যে শুকায়
ঝরে ঝরে যায় লাজে নিরালা॥
চাঁপা রঙের শাড়ি আমার
সারঙ-মিশ্র – কারফা
চাঁপা রঙের শাড়ি আমার
যমুনা-নীর ভরণে গেল ভিজে।
ভয়ে মরি আমি, ঘরে ননদি,
কহিব শুধাইলে কী যে॥
ছি ছি হরি একী খেল লুকোচুরি,
একলা পথে পেয়ে কর খুনসুড়ি,
রোধিতে তব কর ভাঙিল চুড়ি,
ছলকি গেল কলসি যে॥
ডাঁশা কদম্ব দিবে বলি হরি,
ডাকিল তরু-তলে কেন ছল করি,
কাঁচা বয়সি পাইয়া কিশোরী
মজাইলে, মজিলে নিজে॥
ছলছল নয়নে মোর পানে চেয়ো না
বাগেশ্রী মিশ্র – কারফা
ছলছল নয়নে মোর পানে চেয়ো না।
যাবে যাও, নয়নে জল নিয়ে যেয়ো না॥
থাকে ব্যথা থাক বুকে,
যাও তুমি হাসি মুখে,
আমার চাঁদিনি রাতি ঘন মেঘে ছেয়ো না॥
রঙিন পিয়ালাতে মম লোনা অশ্রু-জল ঢালি
পানসে কোরো না নেশা, জীবন-ভরা ব্যথা খালি।
ভুলিতে চাহি যে ব্যথা
মনে এনো না সে কথা,
করুণ সুরে আর বিদায়-গীতি গেয়ো না॥
ছিটাইয়া ঝাল নুন এল ফাল্গুন মাস
সোহিনী বসন্ত – কারফা
ছিটাইয়া ঝাল নুন এল ফাল্গুন মাস।
কাঁচা বুকে ধরে ঘুণ, শ্বাস ওঠে ফোঁস ফাঁস॥
শিমুল ফলের মতো ফটাফট ফাটে হিয়া,
প্রেম-তুলো বের হয়ে পড়ে গো ছড়াইয়া,
সবে বালিশ ধরিয়া করে ছটপট হাঁসফাঁস॥
চিবুতে সজনে খাড়া সজনিরা ভুলে যায়,
আনাগোনা করে প্রেম পরানের দরজায়,
হৃদয়ের ইঞ্জিনে গ্যাস ওঠে ভোঁস ভাঁস॥
কচি আম-ঝোল-টক খাইয়া গিন্নি মায়
বউঝির সাথে করে টক্ষাই টক্ষাই!
আইবুড়ো আইবুড়ি জল গেলে ছ-গেলাস॥
বিরহিণীদের আঁখি-কলসি হয়েছে ফুটো,
গাধাও আজ গাহে গান ফেলিয়া ঘাসের মুঠো,
নোনা-পাকা মন বলে, কবে আসে তালশাঁস॥
জাগো শ্যামা জাগো শ্যামা
সিন্ধু কাফি – যৎ
জাগো শ্যামা জাগো শ্যামা
আবার রণ-চণ্ডী সাজে
তুই যদি না জাগিস মা গো
ছেলেরা তোর জাগবে না যে॥
অন্নদা তোর ছেলে মেয়ে
অন্নহারা ফেরে ধেয়ে,
বাঁচার অধিক আছি মরে, দেখে কি প্রাণে না বাজে॥
শ্মশান ভালোবাসিস যে তুই,
ভূ-ভারত আজ হল শ্মশান,
এই শ্মশানে আয় মা নেচে,
কঙ্কালে তুই জাগা মা প্রাণ।
চাই মা আলো মুক্ত বায়ু
প্রাণ চাই, চাই পরমায়ু,
মোহ-নিদ্রা ত্যাগ কর মা
শিব জাগা তুই শবের মাঝে॥
ডেকে ডেকে কেন সখী ভাঙালি ঘুমের ঘোর
ভৈরবী – কারফা
ডেকে ডেকে কেন সখী ভাঙালি ঘুমের ঘোর।
স্বপনে মোর এসেছিল স্বপন-কুমার মনোচোর॥
সে যেন লো পাশে বসে কহিল হেসে হেসে
যাব না আর পরদেশে মোছো মোছো আঁখি-লোর॥
দেখাল তার হৃদয় খুলি, কহিল, হেরো প্রিয়ে
তোমার অধিক ব্যথা হেথায় তোমারে ব্যথা দিয়ে।
হেরিনু – মোর হিয়ার চেয়ে অধিক ক্ষত তার হৃদয়,
সে হৃদয়ে আমার ছবি, সকল হিয়া আমি-ময়।
তাহার জীবন-মালার মাঝে আমি যেন সোনার ডোর॥
কহিনু – বুঝেছি সখা তোমার দুখ দেওয়ার ছল,
ভালোবাসার ফুল না শুকায়, তাই চাহ মোর চোখের জল।
কাছে পেয়ে ভুলি যদি, করি যদি অনাদর,
তাই গেছিলে পরবাসে, চির-আপন হয় কি পর ।
জেগে দেখি কেঁদে কেঁদে ভিজেছে বুকের আঁচোর॥
ঢলঢল তব নয়ন-কমল
মাঢ় – কারফা
ঢলঢল তব নয়ন-কমল
কাজল তোমারেই সাজে।
শোভে তোমারেই চাঁদের হাসি
হিঙুল অধর-মাঝে॥
ফিরোজা-রং শাড়ি চাঁপা রঙে তব
সেজেছে প্রিয়া কী অভিনব,
সুনীল গগনে গোধূলি রং যেন
মিশেছে আসিয়া উষা ও সাঁঝে॥
কোমলে কড়িতে বাজে কাঁকন চুড়ি,
শিথিল আঁচল লয়ে খেলে হাওয়া লুকোচুরি,
উষ্ণ কপোল ছুঁয়ে থল-কমলি
আঁউরে গেল যে লাজে॥
ঢের কেঁদেছি ঢের সেধেছি
আশা – কারফা
ঢের কেঁদেছি ঢের সেধেছি,
আর পারিনে, যেতে দে তায়।
গলল না যে চোখের জলে
গলবে কি সে মুখের কথায়॥
যে চলে যায় হৃদয় দলে
নাই কিছু তার হৃদয় বলে,
তারে মিছে অভিমানের ছলে
ডাকতে আরও বাজে ব্যথায়॥
বঁধুর চলে যাওয়ার পরে
কাঁদব লো তার পথে পড়ে,
তার চরণ-রেখা বুকে ধরে
শেষ করিব জীবন সেথায়॥
তুমি কোন পথে এলে হে মায়াবী কবি
কীর্তন
তুমি কোন পথে এলে হে মায়াবী কবি
বাজায়ে বাঁশের বাঁশরি
এল রাজ-সভা ছাড়ি ছুটি গুণিজন
তোমার সে সুরে পাশরি॥
তোমার চলার শ্যাম বনপথ
কদম-কেশর-কীর্ণ,
তুমি কেয়ার বনের খেয়া-ঘাটে হলে
গোপনে কি অবতীর্ণ?
তুমি অপরাজিতার সুনীল মাধুরী
দুচোখে আনিলে করিয়া কি চুরি?
তোমায় নাগ-কেশরের ফণী-ঘেরা মউ
পান করাল কে কিশোরী?
জনপুরী যবে খল-কোলাহলে
মগ্নোৎসব রাজসভাতলে,
তুমি একাকী বসিয়া দূর নদী-তটে
ছায়া-বটে বাঁশি বাজালে,
তুমি বসি নিরজনে ভাঁট ফুল দিয়া
বালিকা বাণীরে সাজালে॥
যবে রুদ্র আসিল ডম্বরু-করে
ত্রিশূল বিঁধিয়া নীল অম্বরে
তুমি ফেলিয়া বাঁশরি আপনা পাশরি
এলে সে প্রলয়-নাটে গো,
তুমি প্রাণের রক্তে রাঙালে তোমার
জীবন-গোধূলি পাটে গো॥
হে চির-কিশোর, হে চির-তরুণ,
চির-শিশু চির-কোমল করুণ!
দাও অমিয়া আরও অমিয়া,
দাও উদয়-উষারে লজ্জা গো তুমি
গোধূলির রঙে রঙিয়া!
প্রখর রবি-প্রদীপ্ত গগনে
তুমি রাঙা মেঘ খেল আনমনে,
উৎসব-শেষে দেউলাঙ্গনে
নিরালা বাজাও বাঁশরি,
আমি স্বপন-জড়িত ঘুমে সেই সুর
শুনিব সকল পাশরি॥
তোমার আঁখির কসম সাকি
পিলু মিশ্র – কারফা
শেয়র :– তোমার আঁখির কসম সাকি
চাহি না মদ আঙুর পেষা।
তোমার ও-নয়নে চাহি
ধরে গো শারাবের নেশা॥
তব মদালস ওই আঁখি
সাকি দিল দোলা প্রাণে।
বাদল-হাওয়া এ গুলবাগে
বুলবুল কাঁদে গজল গানে॥
গোলাব ফুলের নেশা
ছিল মোর ফুলেল ফাগুনে,
শুকায়ে গেছে ফুলবন
নাহি গোলাব গুলিস্তানে॥
শুনি সাকি তোমার কাছে
ব্যথা ভোলার দারু আছে,
হিয়া কোন অমিয়া যাচে
জান তুমি, খোদা জানে॥
দুখের পসরা লয়ে
কী হবে কাঁদিয়া বৃথা,
নসিব গিয়াছে যখন,
যাক ইমান শারাব পানে॥
তোমায় আমায় ও প্রেয়সী
খাম্বাজ – লোফা
তোমায় আমায় ও প্রেয়সী
মিল খেয়েছে, রাজ-যোটক।
আমি যেন গোদা চরণ
তুমি তাহে বিস্ফোটক॥
আমি কুমড়ো তুমি দা
আমি কাঁচকলা তুমি আদা,
তুমি তেজি আমি ম্যাদা,
আমি সাপ, তুমি বেজি যেন, বাপ!
তুমি হস্তিনী আমি ঘোটক॥
তুমি বঁটি আমি চিচিঙ্গে,
আমি চিল, পিছে তুমি ফিঙে,
আমি টিংটিঙে তুমি ডিংডিঙে!
আমি ভেতো বাঙালিটি, তুমি যেন বর্গি ঠগ॥
আমি দড়ি তুমি ক্ষুর,
তুমি সাপ আমি ন্যাজুড়,
তুমি মাফ, আমি কসুর
আমি ভাঙা ডোঙা কলার ভেলা,
তুমি খিদিরপুরি ডক॥
তুমি বড়শি আমি মাছ,
আমি মোম তুমি আগুন-আঁচ,
তুমি হিরে আমি কাচ,
তুমি আর জন্মে স্বামী হোয়ো,
আমায় দিয়ো পাদোদক॥
তোরা যা লো সখী মথুরাতে
কীর্তন
তোরা যা লো সখী মথুরাতে
দেখে আয় কেমন আছে শ্যাম।
তোরা কুবুজা-সখার কাছে
নিস নে লো
নিস নে রাধা নাম॥
তাদের রাধার কথা
স্মরণ করায়ে দিয়ে দিস নে লাজ দিস নে ব্যথা।
বড়ো বাজবে ব্যথা,
মোর শ্যাম যদি লো পায় ব্যথা তার দ্বিগুন ব্যথা বাজবে বুকে
সে অভাগিনি রাধায় ভুলে যে দেশে হোক আছে সুখে॥
সখী গো–
দেখে তোরে বিন্দে লো, বৃন্দাবনের কথা
গোবিন্দ শুধায় সে যদি
(সখী লো),
বলিস – হে মাধব, মাধবী-কুঞ্জ তব ভেঙে গেছে
শুকায়েছে যমুনা নদী
(সখা হে)।
যমুনা শুকাইয়া শ্যাম তব শোকে হে,
লভিয়াছে আশ্রয় শ্রীরাধার চোখে হে।
ব্রজে বাজে নাকো বেণু, চরে নাকো ধেনু,
ফুল-দোল-রাস বন্ধ,
আর ময়ূর নাচে না তমাল-চূড়ায়,
কেঁদে লুটায় যশোদা-নন্দ।
বলিস– তুমি আসার সাথে শ্যাম
পুড়ে গেছে ব্রজধাম।
গেছে জ্বলিয়া পুড়িয়া
গেছে গোকুলের খেলাঘর অকূলে ভাসিয়া!
বলিস – কী হবে শুনে সে কথা
তুমি রাখাল নও তো আর,
এখন তুমি রাজাধিরাজ, এখন তুমি কুবুজার॥
ত্রিংশ কোটি তব সন্তান ডাকে তোরে
মালগুঞ্জ – জলদ তেতালা
ত্রিংশ কোটি তব সন্তান ডাকে তোরে।
ভুলে আছিস দেশ-জননি কেমন করে॥
ব্যথিত বুকে মা গো তোমার মন্দির গাড়ি
করি পূজা আরতি কত যুগ যুগ ধরি,
ধূপ পুড়েছে মা গো, চন্দন শুকায়ে যায়,
আয় মা আয় পুন রানির মুকুট পরে॥
দুখের পসরা মা আর যে বহিতে নারি,
কাঁদিয়া কাঁদিয়া শুকায়েছে আঁখি-বারি,
এ গ্লানি লজ্জা মা সহিতে নাহি পারি,
বিশ্ব-বন্দিতা এসো দুখ-নিশি ভোরে॥
অতীত মহিমা লয়ে এসো মহিমময়ী
হীনবল সন্তানে কর মা ভুবন-বিজয়ী,
দুখ-তপস্যা মা কবে তব হবে শেষ,
আয় মা নব-আশা রবির প্রদীপ ধরে॥
থাক সুন্দর ভুল আমার ছলনা-মধুর তব মন
ভৈরবী – কারফা
থাক সুন্দর ভুল আমার
ছলনা-মধুর তব মন।
ভুল করে তুমি ‘ভালোবাসি’বলে
দিয়ো গো ভুলের হরষন॥
মরীচিকা থাক, না থাকুক জল
ভোলাবে তৃষ্ণা সেই মায়া-ছল,
তাহারই আশায় আজও বাঁচি হায়,
মরুভুমে ধাই অনুখন॥
রাঙা রামধনু বৃষ্টির শেষে
জানি জানি প্রিয়, সত্য নহে সে,
নিমেষে উঠিয়া সে মেশে
তবু রেঙে ওঠে এ গগন॥
প্রভাত ভাবিয়া কাক-জ্যোৎস্নায়
জাগিয়া যেমন পাখি গান গায়
তেমনই পরান গেয়ে যাক গান
হোক সে অকাল জাগরণ॥
দিল দোলা দিল দোলা
জংলা – কারফা
দিল দোলা দিল দোলা
কোন দখিন হাওয়া গজল-গাওয়া
কুসুম-ছাওয়া বনে।
ওঠে চমকি চমকি পরান ক্ষণে ক্ষণে॥
ফুল-বধূদের মধু যেচে
বেড়ায় হিয়া নেচে নেচে,
দেখেছিলাম স্বপনে যায়
পেয়েছি তায় আজকে জাগরণে॥
কূল ছাপিয়া মন-তটিনী নটিনীর বেশে
দুলে দুলে যায় ভেসে।
দুলে দুলে যায় ভেসে।
বসন ভূষণ আজি শাসন নাহি মানে
খুশির তুফানে
আপনাকে কার পায়ে
দিতে চাহি বিলায়ে,
চাই কুঞ্জপথে ঝরে যেতে
ঝরা ফুলের সনে॥
দুঃখ-সাগর মন্থন শেষ
গৌড়সারং – একতালা
দুঃখ-সাগর মন্থন শেষ
ভারত-লক্ষ্মী আয় মা আয়।
কবে সে ডুবিলি অতল পাথারে
উঠিলি না আর হায় মা হায়॥
মন্থনে শুধু উঠে হলাহল,
শিব নাই, পান করে কে গরল,
অমৃত-ভাণ্ড লয়ে আয় মা গো
জ্বলিয়া মরি বিষের জ্বালায়॥
হরিত-ক্ষেত্রে সোনার শস্যে
দুলে নাকো আর তোর আঁচল,
শুকায়েছে মা গো মায়ের স্তন্য
গাভির দুগ্ধ নদীর জল॥
চাহি না মোক্ষ, চাই মা বাঁচিতে
অক্ষয় আয়ু লয়ে ধরণিতে,
চাই প্রাণ, চাই ক্ষুধায় অন্ন
মুক্ত আলোকে মুক্ত বায়॥
নদী এই মিনতি তোমার কাছে
ভাটিয়ালি – কারফা
নদী এই মিনতি তোমার কাছে।
ভাসিয়া নিয়ে যাও আমারে যে দেশে মোর বন্ধু আছে॥
নদী তোমার জলের পথ ধরে সে চলে গেল একা,
আমি সেই হতে তার পথ চেয়ে রই, পেলাম না আর দেখা,
ধুলার এ পথ নয় যে বন্ধু থাকবে চরণ-রেখা।
আমি মীন হয়ে রহিব জলে, ছুটব ঢেউ-এর পাছে।
আমি ডুবে যদি মরি, তোমার নয় সে অপরাধ,
কূলে থেকে পাইনে খুঁজে, তাই জেগেছে সাধ
আমি দেখব ডুবে তোমার জলে আছে কি মোর চাঁদ,
বড়ো জ্বালা বুকে রে নদী টেনে লহো কাছে।
নদী, অভাগা এই যাচে॥
না মিটিতে মনোসাধ যেয়ো না হে শ্যামচাঁদ
কীর্তন
না মিটিতে মনোসাধ
যেয়ো না হে শ্যামচাঁদ
আঁধার করিয়া ব্রজধাম।
সোনার বরনি রাই
অঙ্গে মাখিয়া ছাই
দিশা নাই, কাঁদে অবিরাম॥
রাই অবিরাম কাঁদে হে
তারে কাঁদায় যে তারই তরে
অবিরাম কাঁদে হে॥
তারে বুঝালে বুঝেনা
ধৈরজ নাহি বাঁধে হে।
তারে ত্যজিয়া যাইবে শ্যাম
কোন অপরাধে হে॥
সে যে নয়ন মেলিতে হেরে তুমিময় সবই হে,
হেরে নয়ন মুদিলে শ্যাম তোমারই সে ছবি হে
রহি সুনীল গগনতলে
ভুলিবে সে কোন ছলে
ও সুনীল রূপ অভিরাম।
রহি শ্যামল ধরার কোলে
ভুলিবে সে কোন ছলে
ও শ্যামল রূপ অভিরাম॥
সখা হে–
এখনও মাধবীলতা
কহেনি কুসুম-কথা
জড়াইয়া তরুর গলে,
এখনও ফোটেনি ভাষা,
আধ-ফোটা ভালোবাসা
ঢাকা লাজ-পল্লবতলে।
বলা হল না হল না,
বুকের ভাষা মুখে বলা যে হল না।
না শুনে তা রসময়
যেয়ো না হে অসহায়
অভিমান থাকে যদি মনে,
রাই যে কথা মুখে না বলে
হেরো তা চোখের জলে
বিদায়ে হেরো গো, যাহা
পেলে না মিলনে॥
সখা আমরা নারী, বলতে নারি!
আমরা মনের কথা বলতে নারি
চির-নয়নজলে গলতে পারি
তবু খুলে বলতে নারি।
মোরা নিজেরে নিজেই ছলতে পারি
মুখে তবু বলতে নারি।
মোরা মরণ-কোলে ঢলতে পারি
মুখ ফুটে তবু বলতে নারি॥
নবীন নীরদ-বরন শ্যাম
জানিতাম মোরা তখনই,
ওই করুণ সজল কাজল মেঘে
থাকে গো ভীষণ অশনি।
তুমি আগুন জ্বালিলে,
ওহে নিরদয়! বুকে কেন
আগুন জ্বালিলে।
বুকে আগুন জ্বালায়ে – চোখে
সলিল ঢালিলে!
তাহে চোখের জলে বুকের আগুন নেভে কি॥
কাঁদিসনে যমুনা নদী শুকাইয়া শোকে,
বাঁচিয়া রহিবি লো তুই শ্রীরাধার চোখে।
সেথা বইবি উজান,
তুই রাধার চোখে বইবি উজান,
তার দুই নয়নের দু-কূল ছেপে
বক্ষ ব্যেপে বইবি উজান!
শুনিবি দু-কূলে রোদন
শ্যাম শ্যাম নাম॥
নাইয়া ধীরে চালাও তরণি
ভৈরবী – কাশ্মীরি খেমটা
নাইয়া! ধীরে চালাও তরণি।
একে ভরা ভাদর তায় বালা মাতোয়ালা
মেঘলা রজনি॥
হায় পারে নেওয়ার ছলে নিলে মাঝ নদীতে,
যৌবন-নদী টলমল নারি রোধিতে,
ওই ব্যাকুল বাতাস হরি নিল লাজ বাস,
তায় চঞ্চল-চিত যে তুমি চাহ বধিতে,
পায়ে ধরি ছাড়ো বঁধু
আমি পরের ঘরের ঘরনি॥
তরঙ্গ ঘোর রঙ্গ করে, অঙ্গে লাগে দোল,
একী এ নেশার ঘোরে তনু মন আঁখি লোল।
দুলিছে নদী দুলে বায়ু দুলিছে তরি,
কেমনে থির রাখি মোর চিত উতরোল।
ওঠে ডিঙি পানসি ভরি বারি কী করি
কিশোরী রমণী॥
নাচন লাগে ওই তরুলতায় পাতায় ফুলে
বেহাগ খাম্বাজ –কারফা
নাচন লাগে ওই তরুলতায় পাতায় ফুলে।
ফুল-শৌখিন দখিন হাওয়া
নাচে সাথে দুলে দুলে॥
রঙিন-পাখা প্রজাপতি,
বন দুলায়ে মন ভুলায়ে।
ঝিল্লি-নূপুর বাজায়ে
নাচে বনে নিশীথিনী এলোচুলে॥
মৃণাল-তনু কমল নাচে এলোখোঁপায় নীল জলে,
ঝুমুর ঝুমুর ঘুমুর বাজায় নির্ঝর পাষাণ-তলে।
বাদলা হাওয়ায় তালবনা ওই বাজায় চটুল দাদরা তাল,
নদীর ঢেউ-এ মৃদং বাজে, পানসি নাচে টালমাটাল।
নেচে নেচে গ্রহতারা দিশাহারা নটরাজের নাট-দেউলে॥
নিরালা কানন-পথে কে তুমি চল একেলা
পিলু মিশ্র – লাউনী
নিরালা কানন-পথে কে তুমি চল একেলা।
দুধারে চরণ-পাতে ফুটায়ে ফুলের মেলা॥
তোমার ওই কেশের সুবাস ফুলবন করিছে উদাস,
কুসুম ভুলিয়া মলয় ও-কেশে করিছে খেলা॥
লুটায়ে পড়ে ফুলদল পরিবে বলিয়া খোঁপায়,
চলিবে বলি পথতল ফুলেরা পরাগে রাঙায়,
ও-পায়ে আলতা হতে চায় রঙিন গোধূলি-বেলা॥
চলিবে যেয়ো না–বলি লতারা চরণে জড়ায়,
টানিছে কণ্টক-তরু, আঁচল ছাড়িতে না চায়,
আকাশে ইশারায় ডাকে দ্বিতীয়া চাঁদের ভেলা॥
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা সজনি ধীরে চলো
পাহাড়ি মিশ্র – দাদরা
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা সজনি ধীরে চলো।
ধীরে ধীরে ধীরে চলো।
চলিতে ছলকি যায় ঘটে জল ছল ছল॥
একে পথ আঁকা বাঁকা,
তাহে কণ্টক-শাখা
আঁচল ধরে টানে, টলে তনু টলমল॥
ভরা যৌবন-তরি,
তাহে ভরা গাগরি,
বুঝি হয় ভরা-ডুবি, ছি ছি আমার এ কী হল॥
পথের পাশে ও কে
হাসে ডাগর চোখে,
হাসিবে পথের লোকে সখি সরে যেতে বলো॥
প্রিয় তব গলে দোলে যে হার কুড়িয়ে পাওয়া
ভীমপলশ্রী – কারফা
প্রিয় তব গলে দোলে যে হার কুড়িয়ে পাওয়া,
ও যে হার নহে, হৃদয় মোর হারিয়ে যাওয়া॥
তোমারই মতন যেন কাহারা সনে
সেদিন পথে চোখোচোখি হল গোপনে,
মন চকিতে হরিল যে সেই চকিত চাওয়া॥
ছিল চৈতালি সাঁঝ, তাহে পথ নিরালা,
ছিনু একেলা আমি, চলে একেলা বালা,
বহে ঝিরি ঝিরি ধীরি ধীরি চৈতি-হাওয়া॥
চাহিল সে মুখে মোর ঘোমটা তুলে,
তার নয়নে ও ঘটে জল উঠিল দুলে, –
আমি চেয়ে দেখি মোরও আঁখি সলিল-ছাওয়া॥
প্রিয় তুমি কোথায় আজি কত সে দূর
পিলু – কারফা
প্রিয় তুমি কোথায় আজি কত সে দূর।
প্রাণ কাঁদে ব্যথায় বিরহ-বিধুর॥
স্বপন-কুমারী, স্বপনে এসে
মিশাইলে কোন ঘুমের দেশে,
তড়িৎ-শিখা ক্ষণিক হেসে
লুকালে মেঘে আঁধারি হৃদি-পুর॥
আপনা নিয়ে ছিনু একেলা,
কেন সে কূলে ভিড়ালে ভেলা
জীবন নিয়ে মরণ-খেলা
খেলিতে কেন আসিলে নিঠুর॥
উষার গাঙে গাহন করি
দাঁড়ালে নভে রঙের পরি,
প্রেমের অরুণ উদিল যবে
মিশালে নভে, হে লীলা-চতুর॥
ছিনু অচেতন বেদনা পিয়ে
জাগালে সোনার পরশ দিয়ে,
জাগিনু যখন ভেঙেছে স্বপন
প্রিয় তুমি নাই ঝুরিতেছে সুর॥
কাঁদি মোরা আজ একূল ওকূল
মাঝে বহে স্রোতে বিরহ বিপুল
নাহি পারাপার, বেদনা-বিথার
কাঁদন-পাথার লুটায় ব্যথাতুর॥
প্রিয়া গেছে কবে পরদেশ
পাহাড়ি মিশ্র – কারফা
প্রিয়া গেছে কবে পরদেশ
পিউ কাহাঁ ডাকে পাপিয়া।
দোয়েল শ্যামার শিসে তারই
হুতাশ উঠিছে ছাপিয়া॥
পাতার আড়ালে মুখ ঢাকি
মুহুমুহু কুহু ওঠে ডাকি,
বাজে ধ্বনি তারই উহু উহু
বিরহী পরান ব্যাপিয়া॥
‘বউ কথা কও’পাখি ডাকে,
কেন মনে পড়ে যায় তাকে,
কথা কও বউ ডাকিত সে
নিশীথ উঠিত কাঁপিয়া॥
প্রিয়ার চেয়ে শালি ভালো, বাবার চেয়ে মামা
মিশ্র খাম্বাজ – কারফা
প্রিয়ার চেয়ে শালি ভালো,
বাবার চেয়ে মামা।
ডাইনের চেয়ে ডুগি ভালো
অর্থাৎ কিনা বামা॥
একশালা-সে দোশালা আচ্ছা,
চণ্ডুর চেয়ে গাঁজা,
‘তেনার’চেয়ে ভালো ‘তেনার’
হাত দিয়ে পান সাজা,
ধাক্কার চেয়ে গুঁতো ভালো
উকোর চেয়ে ঝামা।
টিকির চেয়ে বেণি ভালো,
ধুতির চেয়ে শাড়ি,
পাঁঠার চেয়ে মুরগি ভালো,
থানার চেয়ে ফাঁড়ি,
ঠুঁটোর চেয়ে নুলো ভালো,
প্যান্ট চেয়ে পায়জামা॥
পেয়াদার চেয়ে যম ভালো ভাই,
শালের চেয়ে বাঁশ,
দাড়ির চেয়ে গুম্ফ ভালো
আঁটির চেয়ে শাঁস,
ছেলের চেয়ে ছালা ভালো,
পেতের চেয়ে ধামা॥
পাকার চেয়ে কাঁচা ভালো,
কালোর চেয়ে ফরসা,
পেতনির চেয়ে ভূত ভালো ভাই
ছাড়বার থেকে ভরসা।
ঝগড়ার চেয়ে রগড়া ভালো,
কাল্লুর চেয়ে গামা॥
ফুল-ফাগুনের এল মরশুম
ভৈরবী – কারফা
ফুল-ফাগুনের এল মরশুম
বনে বনে লাগল দোল।
কুসুম-শৌখিন দখিন হাওয়ার
চিত্ত গীত-উতরোল॥
অতনুর ওই বিষ-মাখা শর
নয় ও দোয়েল শ্যামার শিস,
ফোটা ফুলে উঠল ভরে
কিশোরী বনের নিচোল॥
গুলবাহারের উত্তরি কার
জড়ালো তরু লতায়,
মুহুমুহু ডাকে কুহু
তন্দ্রা-অলস, দ্বার খোল॥
রাঙা ফুলে ফুল্ল-আনন
দোলে কানন-সুন্দরী,
বসন্ত তার এসেছে আজ
বরষ পরে পথ-বিভোল॥
বাজায়ে কাচের চুড়ি
খাম্বাজ মিশ্র – কারফা
বাজায়ে কাচের চুড়ি
পরানে দোল দিয়ে কে যায়।
কাঁকনে চুড়িতে বাজে সুর মধুর আওয়াজ,
নাচনের লাগিল ছোঁয়াচ এ তনুর কাচ-মহলায়॥
আঁচলে বাঁধা তার কোন বীণ,
রিনিঝিন বাজে চাবির রিং,
কারে রাখি কারে শুনি,
চলে যায় সে যে চপল পায়॥
চরণ-কমল ধরি নূপুর মিনতি করে,
ভ্রমর সম গুজরি চরণ ঘেরি গুঞ্জরে।
কারে দেখি কারে শুনি–
চলনের দোলন-গতি, না তাহার নূপুর-ধ্বনি,
হিয়া মোর পথে তার লুটায়
চরণ-পরশ আশায়॥
বিজলি চাহনি কাজল কালো নয়নে
কাজরি – দাদরা
বিজলি চাহনি কাজল কালো নয়নে।
রহি রহি কেন হানিছে ক্ষণে ক্ষণে॥
ভীরু প্রণয় মম
ঝড়ের পাখির সম
শিরণ মাগে তোমার মনো-বনে॥
আমার প্রণয় প্রদীপ-শিখা তোমার শ্বাসে থেকে থেকে
কেঁপে মরে, ওগো প্রিয়, বাঁচাও তারে আঁচল ঢেকে।
ধ্যান যাহার ওই রাঙা চরণ, বেঁধো না তায় বেণির ফাঁদে;
কী হবে পিঞ্জরে রাখি বেঁধেছ যায় বাহুর বাঁধে ;
কেন হান আঘাত যে হেরে আছে রণে॥
বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ওই
ভীমপলশ্রী – একতালা
বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ওই
ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার যাত্রা-পথ
অশ্রু-পিছল কোরো না আর॥
এসেছিনু ভেসে স্রোতের ফুল
তুমি কেন প্রিয় করিলে ভুল
তুলিয়া খোঁপায় পরিয়া তায়
ফেলে দিলে হায় স্রোতে আবার॥
ধরণির প্রেম কুসুম-প্রায়
ফুটিয়া নিমেষে শুকায়ে যায়,
সে ফুলে যে মালা গাঁথিতে চায়
তার চোখে চির-অশ্রু-ধার॥
হেথা কেহ কারও বোঝে না মন,
যারে চাই হেলা হানে সে জন,
যারে পাই সে না হয় আপন
হেথা নাই হৃদি ভালোবাসার॥
তুমি বুঝিবে না কী অভিমান
মিলনের মালা করিল ম্লান,
উড়ে যাই মোর দূর বিমান
সেথা গাব গান আশে তোমার॥
বিরহের গুলবাগে মোর ভুল করে আজ
পাহাড়ি মিশ্র – রূপক
বিরহের গুলবাগে মোর ভুল করে আজ
ফুটল কি বকুল।
অবেলায় কুঞ্জবীথি মুঞ্জরিতে
এলে কি বুলবুল॥
এলে কি পথ ভুলে মোর আঁধার রাতে
ঘুম-ভাঙানো চাঁদ,
অপরাধ ভুলেছ কি, ভেঙেছ কি
অভিমানের বাঁধ।
প্রদীপ নিভে আসে ইহারাই ক্ষীণ আলোকে,
দেখে নিই শেষ দেখা যত সাধ আছে চোখে,
মরণ আজ মধুর হল পেয়ে তব চরণ রাতুল॥
হে চির-সুন্দর মোর, বিদায়-সন্ধ্যা মম
রাঙালে রাঙা রঙে উদয়-উষার সম,
ঝরে পড়ুক তব পায়ে আমার এ জীবন-মুকুল॥
বিরহের নিশি কিছুতে আর
সাহানা – একতালা
বিরহের নিশি কিছুতে আর
চাহে না পোহাতে ওগো প্রিয়।
জাগরণে দেখা দিলে না নাথ
স্বপনে আসিয়া দেখা দিয়ো॥
হেরিব কবে সে মোহন রূপ,
শুকায়েছে মালা, পুড়েছে ধূপ,
নিভে যদি যায় জীবন-দীপ
তুমি এসে নাথ নিভাইয়ো॥
তব আশা-পথ চাহি বৃথায়
দিবস মাস বরষ যায়,
এ জনমে যদি ভুলিলে হায়
পরজনমে না ভুলিয়ো॥
বুকের ভিতর জ্বলছে আগুন
কাফি – ঝাঁপতালা
বুকের ভিতর জ্বলছে আগুন
দমকল ডাক ওলো সই।
শিগগির ফোন কর বঁধুরে
নইলে পুড়ে ভস্ম হই॥
অনুরাগ-দেশালাই নিয়ে
প্রেমের স্টোভ জ্বালতে গিয়ে,
আমার প্রাণের খোড়ো ঘরে
লাগল আগুন ওই লো ওই॥
প্রেমের কেরোসিন যে এত
অল্প জ্বলে, জানিনে তো!
কী দাবানল জ্বলছে বুকে
জানবে না কেউ আমি বই॥
প্রণয় প্রীতির তোষক গদি
রক্ষে করতে চায় সে যদি,
তারে আনতে বলিস মনে করে
আদর সোহাগ–বালতি মই॥
ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি
গৌড়সারং – দাদরা
ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি।
ভোলা মোর সে অপরাধ, আজ যে লগ্ন গোধূলি॥
এমনই রঙিন বেলায়
খেলেছি তোমায় আমায়
খুঁজিতে এসেছি তাই
সেই হারানো দিনগুলি॥
তুমি যে গেছ ভুলে ছিল না আমার মনে,
তাই আসিয়াছি তব বেড়া-দেওয়া ফুলবনে।
গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি,
আজও হেথা গাহে গান আমার পোষা বুলবুলি॥
চাহো মোর মুখে প্রিয়, এসো গো আরও কাছে,
হয়তো সেদিনের স্মৃতি তব নয়নে আছে,
হয়তো সেদিনের মতোই প্রাণ উঠিবে আকুল॥
মন কার কথা ভেবে এমন উদাস করে
ভৈরবী – কারফা
মন কার কথা ভেবে এমন উদাস করে।
দেখেছি ভোরবেলাতে স্বপ্নে কারে
জেগে তায় মনে নাহি পড়ে।
কবে সে ভোরবেলাতে
গেছিলাম ফুল কুড়াতে,
পথে কার নয়ন-ফণী দংশিল বুকের পরে!
আজি কি সেই চাহনির বিষের জ্বালা
উঠিল ব্যাথায় ভরে॥
মনে করিতে তারে শিহরি উঠি ভয়ে,
ভুলিতে গেলে আরও ব্যথা বাজে হৃদয়,
এমনই করে কি গো বন-মৃগ
মরুতে ছুটে মরে॥
মা ষষ্ঠী গো তোর গুষ্টির পায়ে পড়ি
বাউল – কারফা
মা ষষ্ঠী গো, তোর গুষ্টির পায়ে পড়ি।
আর অস্থির করিসনে মা আমায় দয়া করি॥
ষষ্ঠী মা, তোর কৃপার চেয়ে যষ্টি-প্রহার ভালো,
কৃপা যদি করলি মা গো, মেয়েগুলোই কালো!
শিলাবৃষ্টির মতো যে তোর কৃপা পড়ে ঝরি॥
ছাদে বারান্দায় উঠানে ধরে না লেপ কাঁথা,
খোরাসানি গন্ধে মা গো নাড়ি করে ব্যথা,
রাত্রিবেলায় গুনতে–মাথায় খুন যায় যে চড়ি॥
পূর্বজন্মে ছিলেন গিন্নি সগর রাজার রানি,
যত বলি আন্নাকালি ততই কি আমদানি!
মা গো কাঁঠাল গাছকে হার মানাল আমার প্রাণেশ্বরী॥
কসুর করেছিলাম মা গো শ্বশুরকন্যে এনে,
আর ঘোড়া ছুটাবি কত, ধর এবার রাশ টেনে,
মানুষ না রেলগাড়ি আমি তাই ভেবে মা মরি॥
ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভের প্রথমটি বাদ দিয়ে
দিলি সবই, এবার ফিরে যা মা বেড়াল নিয়ে।
কালো মেয়ের পারের মাশুল দে মা সাদা কড়ি॥
মানবতাহীন ভারত শ্মশানে দাও মানবতা
ইমন মিশ্র – একতালা
মানবতাহীন ভারত শ্মশানে
দাও মানবতা, হে পরমেশ!
কী হবে লইয়া মানবতাহীন
ত্রিশ কোটি এই মানুষ-মেষ॥
কলের পুতুল এরা প্রাণহীন
পাষাণ আত্মবিশ্বাসহীন
নিজেরে ইহারা চিনে না, কেমনে
চিনিবে ইহারা নিজের দেশ॥
ফিরিছে শ্মশানে যেন প্রেত-পাল
নর নাই, শুধু নর-কঙ্কাল,
এই চির-অভিশপ্তের মাঝে
জাগাও হে প্রভু প্রাণের রেশ॥
ভায়ে ভায়ে হেথা নাহি প্রেম-বোধ
কেবলই কলহ কেবলই বিরোধ,
দেয়ালের পরে তুলিয়া দেয়াল
নিজেরে নিজেরা করিছে শেষ।
হে দেশ-বিধাতা, দূর করো এই
লজ্জা ও গ্লানি, এ দীন বেশ॥
মোর হৃদি-ব্যথার কেউ সাথি নাহি
পাহাড়ি – দাদরা
মোর হৃদি-ব্যথার কেউ সাথি নাহি।
লয়ে আহত প্রাণ একা গান গাহি।
দিবস বরষ মাস
বুকে চাপি হা-হুতাশ
চলি মরুপথে মেঘ-ছায়া চাহি॥
কানন রচি বৃথা, কুসুম নাহি ফোটে,
বাসি হয় গাঁথা মালা পথের ধুলায় লোটে,
কবে বহিবে নিঝর-ধারা পাষাণ বাহি॥
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান
ভৈরবী – একতালা
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।
মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলে একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই,
মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান॥
চিনতে নেরে আঁধার রাতে করি মোরা হানাহানি,
সকাল হলে হবে রে ভাই ভায়ে ভায়ে জানাজানি।
কাঁদব তখন গলা ধরে,
চাইব ক্ষমা পরস্পরে,
হাসবে সেদিন গরব ভরে এই হিন্দুস্থান॥
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল নিশিদিন
সিন্ধু মিশ্র – কাহারবা
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল নিশিদিন
উঠিছে দুলে।
তারই ঢেউ এ সংগীতে মোর মুরছায়
সুরের কূলে॥
ভালোবাস তোমরা যারে
দুদিনে ভোলো গো তারে,
শরতের সজল কালো মেঘ
কেঁদে-যাও নিমেষে ভুলে॥
কঠিন পুরুষের মন
গলিয়া বহে গো যখন,
বহে সে নদীর মতন
চিরদিন পাষাণ-মূলে॥
আলোর লাগি জাগে ফুল,
নদী ধায় সাগরে যেমন,
চকোর চায় চাঁদ, চাতক মেঘ,
যারে চায় তারেই চায় এ মন।
নিয়ে যায় সুদূর অমরায়
পূজে তায় বাণী-দেউলে॥
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল হে প্রিয়
ভীমপলশ্রী – কাওয়ালি
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল হে প্রিয়
উঠিছে দুলে,
তারই ঢেউ এ সংগীতে মোর মুরছায়
সুরের কূলে॥
ভালোবাস তোমরা যারে
দুদিনে ভোলো গো তারে,
শরতের সজল কালো মেঘ কেঁদে যাও
নিমেষে ভুলে॥
আমার হৃদি যারে চায়
নিয়ে যায় তারে অমরায়,
পূজি তায় হে সুন্দর মোর, নিশিদিন
বাণী দেউলে॥
কঠিন পুরুষের মন
গলিয়া বহে গো যখন
বহে সে নদীর মতন চিরদিন,
রহে না ভুলে॥
রাম-ছাগী গায় চতুরঙ্গ বেড়ার ধারে
চতুরঙ্গ
রাম-ছাগী গায় চতুরঙ্গ বেড়ার ধারে।
গাইয়ে ষাঁড়-সাথে বাছুর হাম্বা রবে
ভীষণ নাদ ছাড়ে,
ফেটে বুঝি গেল কান, প্রাণে মারে!
শুনিয়া হাই তোলে ভেউ ভেউ রোলে–
ভুলোটা পগার-পারে॥
তেলেনা –
ডিম নে রে, তা দেরে, আমি না রে,
তুই দে রে; নে রে ডিম, দে রে তা,
তা দে না,
ওদের না না, তাদের না না, তুই
দে রে ডিম!
ওদের নাড়ি তাদের নারী দেদার নারী,
দে রে নারী, যা ধেত, টানাটানি!
সরগম –
ধা পা র ধা রে গা, গা রে গা ধা,
গা রে গা ধা, নি ধা মা মা
পা রে নি, মা রে গা, সা রা শা মা।
তবলার বোল –
ভেগে যা, মেগে খা, মেরেকেটে খা,
মেরে কেটে খা, তেড়ে ধরে কাট দুম,
মেরে কেটে খা, তেড়ে ধরে কাট দুম,
নাক ধরে টান, কান দুটি যাক,
শুধু কাটা থাক দুম॥
লক্ষ্মী মা তুই আয় গো উঠে সাগর-জলে সিনান করি
মাঢ় – কারফা
লক্ষ্মী মা তুই আয় গো উঠে সাগর-জলে সিনান করি।
হাতে লয়ে সোনার ঝাঁপি, সুধার পাত্রে সুধা ভরি॥
আন মা আবার আঁচলে তোর নবীন ধানের মঞ্জরি সে,
টুনটুনিতে ধান খেয়েছে, খাজনা মাগো দিব কীসে,
ডুবে গেছে সপ্ত ডিঙা, রত্ন-বোঝাই সোনার তরি॥
ক্ষীরোদ-সাগর-কন্যা যে তুই, খেতে দে ক্ষীর সর মা আবার,
পান্তা লবণ পায় না ছেলে, রাজরানি মা-র এ কোন বিচার,
কার কাছে মা নালিশ করি, অনন্ত শয়নে হরি॥
তোরেও কী মা ধরল ঘুমে নারায়ণের ছোঁয়াচ লেগে,
বর্গি এল দেশে মা গো, খোকারা তোর কাঁদে জেগে,
তুই এসে তায় ঘুম পাড়া মা হাতে দিয়ে ঝিনুক কড়ি॥
কোন দুখে তুই রইলি ভুলে বাপের বাড়ি অতল-তলে,
ব্যথার সিন্ধু মন্থন শেষ, ভরল যে দেশ হলাহলে,
অমৃত এনে সন্তানে বাঁচা, মা তোর পায়ে ধরি॥
শা আর শুঁড়ি মিলে শাশুড়ি কি হয় গো
পিলু খাম্বাজ – কারফা
শা আর শুঁড়ি মিলে
শাশুড়ি কি হয় গো।
শ্যাম-প্রেমে বাধা দেয়
স্বামী তারে কয় গো॥
নয় নদী মিলে হয় ননদি সে দজ্জাল,
জুতো জামা-ই সার যার – জামাই সে মহাকাল,
যার কসুর হয় না সে শ্বশুর মহাশয় গো॥
সে ভাদ্দর-বউ, যার ভাদ্দর মাসে বিয়ে,
দেবর সে জন, দেয় বর যে দাদারে দিয়ে।
ভাসুর সে, অসুরের মতো যারে ভয় গো॥
বেহায়া চশম-খোর, তাই কি বেহাই কই,
পিষিয়া মারেন বলে নাম কি পিসিমা ওই,
সবিরই সে ভাগ নেয় ভাগনেরই জয় গো॥
শূন্য আজি গুল-বাগিচা
কাফি মিশ্র – কারফা
শূন্য আজি, গুল-বাগিচা
যায় কেঁদে দখিন হাওয়া।
রাঙা গুলের বাজার আজি
স্মৃতির কাঁটায় ছাওয়া॥
ধূলি-ঢালা ফুল-সমাধি
আজি সে গুলিস্তানে
ছিল যথায় জলসা খুশির
বুলবুলির গজল গাওয়া॥
শুকনো পাতায় ছেয়েছে আজ
সাকির চরণ-রেখা,
নাহি সেথায় বঁধুর লাগি
বধূর আসা যাওয়া॥
নাহি মিঠা পানির নহর
পড়ে আছে বালুচর,
এ যেন গো হৃদয়ের
ভরা-ডুবির পথ বাওয়া॥
শ্যামের সাথে চল সখী খেলি সবে হোরী
পিলু – হোরি
শ্যামের সাথে
চল সখী খেলি সবে হোরী।
রং নে রং দে মদির আনন্দে
আয় লো বৃন্দাবনি গোরী।
আয় চপল যৌবন-মদে মাতি
অল্প-বয়সি কিশোরী॥
রঙ্গিলা গালে তাম্বুল-রাঙা ঠোঁটে
হিঙ্গুল রং লহো ভরি;
ভুরু-ভঙ্গিমা সাথে রঙ্গিম হাসি
পড়ুক মুহুমুহু ঝরি॥
সই ভালো করে বিনোদ বেণি বাঁধিয়া দে
সিন্ধু – কারফা
সই ভালো করে বিনোদ বেণি বাঁধিয়া দে।
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিনুনি-ফাঁদে॥
সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ-কাঁটায়
রাখিব খোঁপার সাথে বিঁধিয়া লো তায়,
তাহে রেশমি জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে॥
বাঁধিতে সে বাঁধন-হারা বনের হরিণ,
জড়ায়ে দে জরিন ফিতা মোহন ছাঁদে॥
প্রথম প্রণয়-রাগের মতো আলতা রঙে
রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনই ঢঙে,
পায়ে ধরে বঁধু যেন আমারে সাধে॥
সখী ওই শোনো বাঁশি বাজে
আশাবরি – আদ্ধা কাওয়ালি
সখী ওই শোনো বাঁশি বাজে।
মন লাগে না গৃহ-কাজে॥
কত সুরে কত ছলে
বাঁশিতে সে কথা বলে,
মোর মন প্রাণ ছুটে চলে
যথা বাঁশি বাজে বন-মাঝে॥
এপারে ঘরে ননদি,
ওপারে যমুনা নদী,
কেঁদে মরি নিরবধি
যাইতে পারি না লাজে॥
সখী কেন সে বাঁশিতে সাধে
নিশিদিন রাধে রাধে,
প্রাণ গুমরি গুমরি কাঁদে
হৃদে এনে দে রাখাল-রাজে॥
সখী লো তায় আন ডেকে
মাঢ় – রূপক
সখী লো তায় আন ডেকে
যে গান গেয়ে যায় পথ দিয়ে।
সই দিব তারে কণ্ঠহার তার কণ্ঠেরই ওই সুর নিয়ে॥
কারুর পানে নাহি চায়
সে আপন মনে গেয়ে যায়,
হিয়া কাঁপে সুরের নেশায়,
নয়ন আসে মোর ঝিমিয়ে॥
সখি লো শুধিয়ে আয়
সে শিখিল এ গান কোথায়,
এত মধু তার গলায়
কাহার অধর-সুধা পিয়ে॥
যার গানে এত প্রাণ মাতায়
না জানি কি হয় দেখলে তায়,
তার সুর শুনে কেউ প্রাণ পায়
কেউ ফেলে লো প্রাণ হারিয়ে॥
সাগর হতে চুরি ডাগর তব আঁখি
সিন্ধু মিশ্র – দাদরা
সাগর হতে চুরি ডাগর তব আঁখি
গভীর চাহনিতে করুণা মাখামাখি॥
শফরী সম তাহে ভাসিছে আঁখি-তারা,
তাহারই লোভে যেন উড়িছে ভুরু-পাখি॥
দুলে তরঙ্গ তাহে কভু ঘোর কভু ধীরে
আঁখির লীলা হেরি আঁখিতে আঁখি রাখি॥
ভীরু হরিণ চোখে অশনি হানো কেন,
শারাব-পিয়ালাতে জহর কেন সাকি ॥
আঁখির ঝিনুকে কবে ফিলবে প্রেম-মোতি,
ডুবিবে আঁখি-নীরে সেদিনের নাহি বাকি॥
সাত ভাই চম্পা জাগো রে
ভাটিয়ালি – কারফা
সাত ভাই চম্পা জাগো রে, ওই পারুল তোদের ডাকে।
ভাই আর কত ঘুমাবি সবুজ পাতা-ঘেরা শাখে॥
কী জাদু করিল তোদের বিদেশি সৎ-মায়ে,
রাজার দুলাল ঘুমিয়ে আছিস আঁধার কানন-ছায়ে,
নিজেরা না জাগলে কবে মুক্ত করবি মাকে॥
তোদের বোন এনেছে জিয়ন-কাঠি প্রাণের পরশ-মণি,
মায়া-নিদ্রা ভোলাতে ওই গায় সে জাগরণী।
গুবরে পোকায় মউ খেয়ে যায় তোদের ওই মৌচাকে॥
তোদের চাঁপা রঙে চাপা আছে অরুন-কিরণ-রেখা,
তোরা জাগবি রে যেই, অমনি পাবি দিনমণির দেখা;
বোনের সাথে ভাই জাগিলে ভয় করি আর কাকে॥
সামলে চলো পিছল পথ গোরী
খাম্বাজ – দাদরা
সামলে চলো পিছল পথ গোরী।
ভরা যৌবন তায় ভরা গাগরি॥
নীর ভরণে এসে সখী নদী-তীর,
তির খেয়ো না হৃদয়ে ডাগর আঁখির,
জলে ভাসিবে নয়ন কিশোরী॥
হৃদি নিঙাড়ি এ পথে প্রেমিক কত
সখী করেছে রুধির-পিছল এ পথ,
কেহ উঠিল না এ পথে পড়ি॥
তব ঘটের সলিল চাহিয়া সই
কত তৃষ্ণা-আতুর পথিক দাঁড়ায়ে ওই,
মরু-ভূমে তুমি মেঘ-পরি॥
সুরের ধারার পাগল-ঝোরা
মান্দ মিশ্র – কারফা
সুরের ধারার পাগল-ঝোরা
নামিল সখী মোর পরানে।
যেন কাহারবায় গজল কে গায়
সাকির সাথে গুল-বাগানে॥
ভরি মোর নিশীথ নিঝুম
বাজে নূপুর কার রুমুঝুম
মোর চোখে নাহি ঘুম,
পাষাণ টুটে লো যায় ছুটে
মন-তটিনী মোর সাগর পানে॥
পানসে চাঁদের জোছনাতে ওই বেলের কুঁড়ি মুঞ্জরে,
মোর মন যেতে চায় ফুল-বিছানো বকুল-বীথির পথ ধরে।
আজ চাইবে যে, দিব তাকে
সই ফুল ছুঁয়ে এই আপনাকে,
বাহির আমায় ডাক দিয়েছে আর কি ঘরে মন থাকে।
অরুণ রাগে হৃদয় জাগে,
ভাসিয়া যাব নৃত্যে গানে॥
সে চলে গেছে বলে কি গো
পাহাড়ি-মাঢ় – কারফা
সে চলে গেছে বলে কি গো
স্মৃতিও তার যায় ভোলা। (হায়)
মনে হলে তার কথা
আজও মর্মে যে মোর দেয় দোলা॥
ওই প্রতিটি ধুলিকণায়
আছে তার ছোঁয়া লেগে হেথায়,
আজও তাহারই আসার আশায়
রাখি মোর ঘরের সব দ্বার খোলা॥
হেথা সে এসেছিল যবে
ঘর ভরেছিল ফুল-উৎসবে,
মোর কাজ ছিল শুধু ভবে
তার হার গাঁথা আর ফুল তোলা॥
সে নাই বলে বেশি করে
শুধু তার কথাই মনে পড়ে,
হেরি তার ছবিই ভুবন ভরে
তারে ভুলিতে মিছে বলা॥
হারানো হিয়ায় নিকুঞ্জপথে
বাগেশ্রী – লাউনী
হারানো হিয়ায় নিকুঞ্জপথে
কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি।
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি॥
চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল
শুকানো পাতা মলিন ফুলদল,
বৃথায় সেথা হায় তব আঁখি-জল
ছিটাও অবিরল দিবস যামী॥
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিঁধিছে কাঁটা নাহি যবে ফুল,
কী দিয়া বরণ করি ও-চরণ
নিভিছে জীবন, জীবন-স্বামী॥
হায় স্মরণে আসে গো অতীতকথা
মাঢ় – পাঞ্জাবি ঠেকা
হায় স্মরণে আসে গো অতীতকথা।
নয়নে জল ভরে তাই হৃদয় করে ব্যথা।
মুখ তার রহি রহি পড়ে মোর মনে॥
তার স্মৃতি ভুলিতে চাহি যতই
সখী মনে পড়ে তারে ততই,
সে কাঁদায় সখি মোরে ঘুমে জাগরণে॥
তার সাথে গেছে প্রাণ, দেহ আছে পড়ে,
বাঁচার অধিক আমি সখী গো আছি মরে॥
নাহি ফুল, আছে কাঁটার স্মৃতি,
নাহি আর সে চাঁদিনি তিথি,
নাহি আর সুখ শান্তি সখী এ জীবনে॥
হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই ভারতের দুই আঁখি-তারা
ছায়ানট – দাদরা
হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই
ভারতের দুই আঁখি-তারা
এক বাগানের দুটি তরু দেবদারু আর কদম-চারা॥
যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি,
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা॥
বুলবুল আর কোকিল পাখি
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।
ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননির কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠি ভায়ের পারা॥
পেটে-ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরার মায়া বেশি,
অতিথি ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলি
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তারা, আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা॥
হৃদয় কেন চাহে হৃদয়
পিলু-খাম্বাজ – কারফা
হৃদয় কেন চাহে হৃদয়
আমি জানি মন জানে।
জানে নদী কেন যে সে
ছুটে যায় সাগর পানে॥
কেন মেঘ বারি চাহে
জানে চাতক জানে মেঘ,
জানে চকোর দূর গগনের
চাঁদ কেন তারে টানে॥
কুসুম কেন শিশির
জানে শিশির জানে ফুল,
জানে বুলবুল আছে কাঁটা
তবু যায় গুল-বাগানে॥
নয়ন চাহে নয়ন-বারি
মন চাহে মনোব্যথা,
প্রাণ আছে যার সেই জানে
কেন চায় প্রাণে প্রাণে॥
হেনে গেল তির তিরছ তার চাহনি
পিলু মিশ্র – দাদরা
হেনে গেল তির তিরছ তার চাহনি।
বিঁধিল মরম-মূলে চাহিল যেমনই॥
হৃদয়-বনের নিষাদ নিঠুর,
তনু তার ফুলবন, আঁখি তাহে ফণী॥
শেয়র :- এল যবে স্বপন-পরি উড়ায়ে আঁচল সোনালি,
ধেয়ান-লোক হতে গো যেন রূপ ধরে এল রূপওয়ালি।
দেহে তার চাঁদিনি-চন্দন মাখা, হায় চাহিল সে যেই
তার চোখের চোখা তির খেয়ে গেয়ে উঠিল হৃদি এই–
হেনে গেল তির হেনে গেল তির,
তিরছ তার চাহনি॥