- বইয়ের নামঃ গুল-বাগিচা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অচেনা সুরে অজানা পথিক
পিলু কাহারবা
অচেনা সুরে অজানা পথিক
নিতি গেয়ে যায় করুণ গীতি।
শুনিয়া সে গান দুলে ওঠে প্রাণ
জেগে ওঠে কোন হারানো স্মৃতি॥
ঘুরিয়া মরে উদাসী সে সুর
সাঁঝের কূলে বিষাদ-বিধুর,
নীড়ে যেতে হায় পাখি ফিরে চায়,
আবেশে ঝিমায় কুসুম-বীথি॥
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে
মুলতান-কানাড়া মিশ্র দাদরা
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে।
নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি আমার নয়ন-পাতে॥
ভেজা মাটির গন্ধ সনে
তোমার স্মৃতি আনে মনে,
বাদলি হাওয়া লুটিয়ে কাঁদে আঁধার আঙিনাতে॥
হঠাৎ বনে আসল ফুলের বন্যা
পল্লবেরই কূলে,
নাগকেশরের সাথে কদম কেয়া
ফুটল দুলে দুলে।
নবীন আমন ধানের খেতে
হতাশ বায়ু ওঠে মেতে,
মন উড়ে যায় তোমার দেশে
পুব-হাওয়ারই সাথে॥
আঁখি-বারি আঁখিতে থাক, থাক ব্যথা হৃদয়ে
ভৈরবী মিশ্র কাহারবা
আঁখি-বারি আঁখিতে থাক, থাক ব্যথা হৃদয়ে।
হারানো মোর বুকের প্রিয়া রইবে চোখে জল হয়ে॥
নিশি-শেষে স্বপন-প্রায়
নিলে তুমি চির-বিদায়,
ব্যথাও যদি না থাকে হায়,
বাঁচিব গো কী লয়ে॥
ভালোবাসার অপরাধে
প্রেমিক জনম জনম কাঁদে,
কুসুমে কীট বাসা বাঁধে
শত বাধা প্রণয়ে।
আজকে শুধু করুণ গীতে
কাঁদিতে দাও, দাও কাঁদিতে,
আমার কাঁদন-নদীর স্রোতে
বিরহের বাঁধ যাক ক্ষয়ে॥
আঁচল হংস-মিথুন আঁকা
ভৈরবী কাহারবা
আঁচল হংস-মিথুন আঁকা
বলাকা-পেড়ে শাড়ি দুলায়ে।
চলিছে কিশোরী শ্যামা একা
রুমুঝুমু বাজে নূপুর মৃদু পায়ে॥
ভয়ে ভয়ে চলে আধো-আঁধারে
বিরহী বন্ধুর দূর-অভিসারে
পথ কাঁদে যেয়ো না যেয়ো না যেয়ো না ওগো
থামো ক্ষণেক এ ঠাঁয়ে।
আজি এ বাদল-দিনে কত কথা মনে পড়ে
কাজরি দাদরা
আজি এ বাদল-দিনে
কত কথা মনে পড়ে।
হারাইয়া গেছে প্রিয়া
এমনই বাদল-ঝড়ে॥
আমারই এ বুকে থাকি
ঘুমাত সে ভীরু পাখি,
জলদ উঠিলে ডাকি
লুকাত বুকের পরে॥
মোর বুকে মুখ রাখি নিবিড় তিমির কাঁদে
আমার প্রিয়ার মতো বাঁধিয়া বাহুর বাঁধে॥
কোথায় কাহার বুকে
আজি সে ঘুমায় সুখে,
প্রদীপ নিভায়ে কাঁদি
একা ঘরে তারই তরে॥
আজি কুসুম-দিপালি জ্বলিছে বনে
ভীমপলশ্রী-মিশ্র দাদরা
আজি কুসুম-দিপালি জ্বলিছে বনে॥
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
জ্বলে দীপ-শিখা আম-মুকুলে
রাঙা পলাশে অশোকে বকুলে,-
আসে সে আলোর টানে বনতল
মৌমাছে প্রজাপতি দলে দল,
পুড়ে মরিতে সে রূপ-শিখাতে,
প্রাণ সঁপিতে বাসন্তিকাতে
পরিমল-অঞ্জন মাখিয়া নয়নে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
জ্বলে গগনে তারার দীপালি
আজি ধরাতে আকাশে মিতালি।
ধরা চাঁপার গেলাস ভরিয়া
মধু ঊর্ধ্বে তোলো গো ধরিয়া,
পান করিতে সে মধু-পরিরা
আসে নেমে কাননে স-শরীরা।
বাজে উৎসব-বাঁশি গগনে পবনে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
আজি বাতাবি নেবুর কুঞ্জে
শ্যামা দোয়েল মধুপ গুঞ্জে,
ফেরে আকাশে পক্ষ প্রসারি
ফুল- কিশোর স্বপন-পসারি।
সাড়া জাগে বনে বনে সাজ-সাজ
ওই এল রে এল রে ঋতুরাজ,
তাই সেজেছে প্রকৃতি কুসমি বসনে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
আমার দেশের মাটি
বাউল লোফা
আমার দেশের মাটি
ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি॥
এই দেশের মাটি-জলে
এই দেশেরই ফুলে ফলে
তৃষ্ণা মিটাই, মিটাই ক্ষুধা
পিয়ে এরই দুধের বাটি॥
এই মায়েরই প্রসাদ পেতে,
মন্দিরে এর এঁটো খেতে
তীর্থ করে ধন্য হতে আসে কত জাতি॥
এই দেশেরই ধুলায় পড়ি
মানিক যায় রে গড়াগড়ি,
বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙাল
এই দেশেরই জিয়ন-কাঠি॥
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হল নিখিল ভুবন দিব্য পরিপাটি॥
এই সন্ন্যাসিনী সকল দেশে,
জ্বালল আলো ভালোবেসে
মা আঁধার রাতে একলা জাগে
আগলে রে এই শ্মশান-ঘাঁটি॥
আমার বিজন ঘরে হেসে এল পথিক মুসাফির-বেশে
বারোয়াঁ-মিশ্র কাহারবা
আমার বিজন ঘরে হেসে এল পথিক মুসাফির-বেশে।
শরমে মরিয়া তারে শুধাই, তরুণ পথিক, কী তব চাই।
সে কহে, – যা দাও লইব তাই॥
দিনু তারে খোঁপার ফুল,
সে কহে, – এ নহে, করেছ ভুল।
কহিনু, – ভিখারি কী তবে চাও?
সে কহে, – গলার মালাটি দাও॥
বসিতে তারে দিনু আসন,
দাঁড়ায়ে রহে সে করুণ-নয়ন।
কহিনু, – কী চাহ ওগো শ্যামল?
সে কহে, – তোমার আধেক আঁচল॥
কহিনু, – কেন এ আঁখি-পানে
চাহিয়া রয়েছ এক ধ্যানে?
আমার চোখে কী চাও বঁধু?
সে কহে, – অনুরাগের মধু॥
কহিনু, – হে প্রিয়, নাহি যে ঠাঁই,
ভাঙা কুটির, চাঁদে কোথায় বসাই।
কহিল না কথা অভিমানী –
কী হল শেষে সই নাহি জানি।
হেরিনু প্রভাতে পাশে মম
ঘুমায় আমার প্রিয়তম॥
আমার ভাঙা নায়ের বইঠা ঠেলে
ভাটিয়ালি কাহারবা
আমার ভাঙা নায়ের বইঠা ঠেলে
আমি খুঁজে বেড়াই তারেই রে ভাই
যে গিয়াছে আমায় ফেলে॥
আমার, তোদের মতোই ঘর ছিল ভাই
এমনি গাঙের কূলে,
সেই ঘরেতে রূপের জোয়ার
উঠত দুলে দুলে।
সেই সোনার পরি উড়ে গেছে
সোনার পাখা মেলে॥
পায়ে চলে খুঁজি তারে,
গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজি,
নাইতে চলে বউ-ঝি,
আমি ভাবি সে-ই বুঝি।
চাঁদের দেশের মেয়ে সে ভাই
গেছে বাপের বাড়ি,
মাটিতে মোর পা বাঁধা ভাই,
উড়ে যেতে নারি।
হারালে সব যায় পাওয়া ভাই,
শুধু মানুষ নাহি মেলে॥
আসিলে কে গো বিদেশি
দেশি টোড়ি মিশ্র কাহারবা
আসিলে কে গো বিদেশি
দাঁড়ালে মোর আঙিনাতে।
আঁখিতে লয়ে আঁখি-জল
লইয়া ফুল-মালা হাতে॥
জানি না চিনি না তোমায়,
কেমনে ঘরে দিব ঠাঁই,
অমনি আসে তো সবাই
হাতে ফুল, জল নয়ন-পাতে॥
কত-সে প্রেম-পিয়াসি প্রাণ
চাহিছে তোমার হাতের দান,
কাঁদায়ে কত গুলিস্তান
আমারে এলে কাঁদাতে॥
ফুলে আর ভোলে না মোর মন, গলে না নয়নজলে,
ভুলিয়া জীবনে একদিন আজিও জ্বলি জ্বালাতে॥
পাষাণের বুকে নদী বয়, যে পাষাণ সে পাষাণই রয়,
ও শুধু প্রতারণা ছল, নয়নে নীর, নিঠুর হৃদয়।
আমারে মালারই মতন দলিবে নিশি-প্রভাতে॥
আসে রজনি সন্ধ্যামণির প্রদীপ জ্বলে
পিলু কাহারবা
আসে রজনি, সন্ধ্যামণির প্রদীপ জ্বলে।
ছায়া-আঁচল-ঢাকা কাননতলে॥
তিমির দু-কূল দুলে গগনে
গোধূলি-ধূসর সাঁঝ-পবনে,
তারার মানিক অলকে ঝলে॥
পূজা-আরতি লয়ে চাঁদের থালায়
আসিল সে অস্ত-তোরণ নিরালায়।
ললাটের টিপ জ্বলে সন্ধ্যাতারা,
গিরি-দরি-বনে পেরে আপনহারা,
থামে ধীরে বিরহীর নয়নজলে॥
ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ওই
ভৈরবী কাহারবা
ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ওই
এল আবার দুসরা ঈদ।
কোরবানি দে কোরবানি দে,
শোন খোদার ফরমান তাকীদ ॥
এমনি দিনে কোরবানি দেন
পুত্রে হজরত ইব্রাহিম,
তেমনি তোরা খোদার রাহে
আয় রে হবি কে শহিদ॥
মনের মাঝে পশু যে তোর
আজকে তারে কর জবেহ
পুলসরাতের পুল হতে পার
নিয়ে রাখ আগাম রসিদ॥
গলায় গলায় মিল রে সবে
ভুলে যা ঘরোয়া বিবাদ,
শিরনি দে তুই শিরীন জবান
তশতরীতে প্রেম মফিদ ॥
মিলনের আরফাত ময়দান
হোক আজি গ্রামে গ্রামে,
হজের অধিক পাবি সওয়াব
এক হলে সব মুসলিমে।
বাজবে আবার নূতন করে
দীন-ই ডঙ্কা, হয় উমীদ ॥
উম্মত আমি গুনাহ্গার তবু ভয় নাহি রে আমার
সিন্ধু – ভৈরবী কাহারবা
উম্মত আমি গুনাহ্গার
তবু ভয় নাহি রে আমার।
আহ্মদ আমার নবি
যিনি খোদ হবিব খোদার॥
যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবি,
তাঁহারই দামন ধরি
পুলসরাত হব পার॥
কাঁদিবে রোজ-হাশরে সবে
যবে নফসি-য়্যা-নফসি রবে,
য়্যা উম্মতি বলে একা
কাঁদিবেন আমার মোখতার ॥
কাঁদিবেন সাথে মা ফাতেমা
ধরিয়া আর্শ আল্লার
হোসায়নের খুনের বদলায়
মাফি চাই পাপী সবাকার॥
দোজখ হয়েছে হারাম
যেদিন পড়েছি কলেমা
যেদিন হয়েছি আমি
কোরানের নিশান-বর্দার ॥
এ কুঞ্জে পথ ভুলি কোন বুলবুলি আজ
ভৈরবী লাউনি
এ কুঞ্জে পথ ভুলি কোন বুলবুলি আজ
গাইতে এলে গান।
বসন্ত গত মোর আজ পুস্প-বিহীন
লতিকা-বিতান॥
এলে কি দলিতে আজ ধূলি-ঢাকা
ফুল-সমাধি মোর,
নাহি আর চৈতি হাওয়া, বহে আজি
বৈশাখী তুফান॥
সাজায়ে ফুলের বাসর ছিনু তব পথ চেয়ে,
সে-বাসর বাসি হল, কেঁদে নিশি হল অবসান॥
বাজে মোর তোরণ-দ্বারে
খেলা-শেষের বিদায়-বাঁশরি,
ফিরে যাও শেষ-অতিথি,
দাও যেতে দাও লয়ে অভিমান॥
এ কোথায় আসিলে হায়, তৃষিত ভিখারি
কাফি মিশ্র কাহারবা
এ কোথায় আসিলে হায়, তৃষিত ভিখারি
হায় পথভোলা পথিক হায় মৃগ মরুচারী॥
তোমার আসার পথে প্রিয় ছিলাম যবে আমার পরান পাতি
সেদিন যদি আসিতে নাথ হইতে ব্যথার সাথি।
ধোয়ালে নয়নজলে পা মুছাতাম আকুল কেশে
আজ কেন দিবাশেষে এলে নাথ মলিন বেশে
হায় বুকে লয়ে ব্যথা আসিলে ব্যথাহারী॥
স্মৃতির যে শুকাল মালা যতনে রেখেছি তুলি
ছুঁইয়ে সে হার ঝরায়ো না ম্লান তার কুসুমগুলি
হায় জ্বলুক বুকে চিতা, তায় ঢেলো না আর বারি॥
এই দেহেরই রংমহলায়
ভৈরবী একতালা
এই দেহেরই রংমহলায়
খেলিছেন লীলা-বিহারী।
মিথ্যা মায়া নয় এ কায়া
কায়ায় হেরি ছায়া তাঁরই॥
রূপের রসিক রূপে রূপে
খেলে বেড়ায় চুপে চুপে,
মনের বনে বাজায় বাঁশি
মন-উদাসী বনচারী॥
তার খেলাঘর তোর এ দেহ,
সে তো নহে অন্য কেহ,
সে যে রে তুই, – তবু মোহ
ঘুচল না তোর হায় পূজারি॥
খুঁজিস তারে ঠাকুর-পূজায়,
উপাসনায় নামাজ রোজায়,
চালকলা আর শিন্নি দিয়ে
ধরবি তারে, হায় শিকারি!
পালিয়ে বেড়ায় মন-আঙিনায়
সে যে শিশু প্রেম-ভিখারি॥
একলা ভাসাই গানের কমল সুরের স্রোতে
বেহাগ-মিশ্র দাদরা
একলা ভাসাই গানের কমল সুরের স্রোতে।
খেলার ছলে ওপার পানে এপার হতে॥
আসবে গো এ গাঙের কূলে হয়তো ভুলে
আমার প্রিয়া,
খোঁপায় নেবে আমার গানের কমল তুলে
আমার প্রিয়া।
খুঁজতে আমায় আসবে সুরের নদী-পথে॥
নাম-হারা কোন গাঁয়ে থাকে অচেনা সে
না-ই জানিলাম, গান ভেসে যাক তাহার আশে।
নদীর জলে আলতা-রাঙা পা ডুবায়ে
রয় সে মেয়ে,
গানের কমল লাগে গো তার কমল-পায়ে
উজান বেয়ে।
সেদিন অমর হয় মোর গান
যায় অমরায় পুষ্পরথে॥
এল শোকের সেই মোহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে
মর্সিয়া
এল শোকের সেই মোহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে।
আজি বেতাব বিশ্ব-মুসলিম সেই শোকে রোয়ে রোয়ে॥
মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুধের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদত হোসেনের বক্ষে রয়ে॥
এক হাতে বিবাহের কাঙন এক হাতে কাসেমের লাশ,
বেহোশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা সয়ে॥
ঝরিছে আঁখিতে খুন হায় জয়নাল বেহোশ কেঁদে
মানুষ বলে সহে এত পাথরও যেত ক্ষয়ে॥
শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হজরত হোসেন শহিদ,
আশমানে শোকের বারেষ ঝরে আজি খুন হয়ে॥
এসো এসো রসলোকবিহারী
ভৈরবী একতালা
এসো এসো রসলোকবিহারী
এসো মধুকরদল।
এসো নভোচারী স্বপনকুমার
এসো ধ্যান-নিরমল॥
এসো হে মরাল কমল-বিলাসী,
বুলবুল পিক সুরলোকবাসী,
এসো হে মরাল কমল-বিলাসী,
বুলবুল পিক সুরলোকবাসী,
এসো হে স্রষ্টা এসো অ-বিনাশী
এসো জ্ঞান-প্রোজ্জ্বল॥
দিওয়ানা প্রেমিক এসো মুসাফির,
ধূলি-ম্লান তবু উন্নত শির,
অমরা-অমৃতজয়ী এসো বীর
আনন্দ-বিহ্বল॥
মাতাল মানব করি মাতামাতি
দশ হাতে যবে লুটে যশ-খ্যাতি,
তোমরা সৃজিলে নব দেশ জাতি
অগোচর অচপল॥
খেলো চির-ভোলা শত ব্যথা সয়ে,
সংহাত ওঠে সংগীত হয়ে,
শত বেদনার শতদল লয়ে
লীলা তব অবিরল॥
ভুলি অবহেলা অভাব বিষাদ
ধরণিতে আনো স্বর্গের স্বাদ,
লভি তোমাদের পুণ্য প্রসাদ
পেনু তীর্থের ফল॥
এসো বঁধু ফিরে এসো, ভোলো ভোলো অভিমান
ইমন মিশ্র দাদরা
এসো বঁধু ফিরে এসো, ভোলো ভোলো অভিমান।
দিব ও চরণে ডারি মোর তনু-মন-প্রাণ॥
জানি আমি অপরাধী তাই দিবানিশি কাঁদি,
নিমিষের অপরাধের কবে হবে অবসান॥
ফিরে গেলে দ্বারে আসি বাসি কিনা ভালোবাসি,
কাঁদে আজ তব দাসী, তুমি তার হৃদে ধ্যান॥
সেদিন বালিকা-বধূ শরমে মরম-মধু
পিয়াতে পারিনি বঁধু আজ এসে করো পান॥
ফিরিয়া আসিয়া হেথা দিয়ো দুখ দিয়ো ব্যথা,
সহে না এ নীরবতা হে দেবতা পাষাণ॥
কত কথা ছিল তোমায় বলিতে
সারং কাহারবা
কত কথা ছিল তোমায় বলিতে।
ভুলে যাই হয় না বলা পথ চলিতে॥
ভ্রমর আসে যবে বনের পথে,
না-বলা সেই কথা কয় ফুল-কলিতে॥
পুড়ে মরে পতঙ্গ, দীপ তবু
পারে না বলিতে, থাকে জ্বলিতে॥
সে কথা কইতে গিয়ে গুণীর বীণা
কাঁদে কভু সারং-এ কভু ললিতে॥
যত বলিতে চাই লুকাই তত,
গেল মোর এ জনম হায় মন ছলিতে॥
কত কথা ছিল বলিবার, বলা হল না
ভীমপলশ্রী কাহারবা
কত কথা ছিল বলিবার, বলা হল না।
বুকে পাষাণসম রহিল তারই বেদনা।
মনে রহিল মনের আশা,
মিটিল না প্রাণের পিপাসা,
বুকে শুকাল বুকের ভাষা
মুখে এল না॥
এত চোখের জল এত গান,
এত সোহাগ আদর অভিমান
কখন যে হল অবসান
বোঝা গেল না॥
ঝরিল কুসুম যদি হায়,
কেন স্বৃতির কাঁটাও নাহি যায়,
বুঝিল না কেহ কারও মন
বিধির ছলনা।
কপোত কপোতী উড়িয়া বেড়াই
পিলু-বারোয়াঁ ত্রিতাল
(দ্বৈত গান)
উভয়ে॥ কপোত কপোতী উড়িয়া বেড়াই
সুদূর বিমানে আমরা দুজনে।
কানন-কান্তার শিহরি ওঠে
মোদের প্রণয়-মদির কূজনে॥
স্ত্রী॥ ভ্রমর গুঞ্জে মঞ্জুল গীতি
হেরিয়া আমার বঁধুর প্রীতি,
পুরুষ॥ আমার প্রিয়ার নয়নে চাহি
কুসুম ফুটে ওঠে বিপিনে বিজনে॥
স্ত্রী॥ তোমা ছাড়া স্বর্গ চাহি না, প্রিয়!
মোদের প্রেমে চাঁদ আসে নেমে
মাটির পাত্রে পান করি অমিয়।
পুরুষ॥ বিশ্ব ভুলায়ে ওই রাঙা পায়ে
আমারে বেঁধেছ জীবনে মরণে॥
কাঁদিছে তিমির-কুন্তলা সাঁঝ
ধানশ্রী একতালা
কাঁদিছে তিমির-কুন্তলা সাঁঝ
আমার হৃদয়-গগনে।
এসো প্রিয়া এসো বধূ-বেশে এই
বিদায়-গোধূলি-লগনে॥
দিনের চিতার রক্ত-আলোকে
শুভদৃষ্টি গো হবে চোখে চোখে,
আমার মরণ-উৎসবক্ষণে
শঙ্খ বাজুক সঘনে॥
চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া হেরো
খুঁজিছে মোদেরে তারাদল,
সজল-বসনা বাদল-পরির
নয়ন করিছে ছলছল।
মরণে তোমারে পাইব বলিয়া
জীবনে করেছি আরাধনা প্রিয়া,
এসো মায়ালোক-বিহারিণী মোর
কুহেলি-আঁধার স্বপনে॥
কাঁদিছে তিমির-কুন্তলা সাঁঝ
ধানশ্রী একতালা
কাঁদিছে তিমির-কুন্তলা সাঁঝ
আমার হৃদয়-গগনে।
এসো প্রিয়া এসো বধূ-বেশে এই
বিদায়-গোধূলি-লগনে॥
দিনের চিতার রক্ত-আলোকে
শুভদৃষ্টি গো হবে চোখে চোখে,
আমার মরণ-উৎসবক্ষণে
শঙ্খ বাজুক সঘনে॥
চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া হেরো
খুঁজিছে মোদেরে তারাদল,
সজল-বসনা বাদল-পরির
নয়ন করিছে ছলছল।
মরণে তোমারে পাইব বলিয়া
জীবনে করেছি আরাধনা প্রিয়া,
এসো মায়ালোক-বিহারিণী মোর
কুহেলি-আঁধার স্বপনে॥
কেন ফোটে, কেন কুসুম ঝরে যায়
পিলু-বারোয়াঁ কাহারবা
কেন ফোটে, কেন কুসুম ঝরে যায়!
মুখের হাসি চোখের জলে মরে যায়॥
নিশীথে যে কাঁদিল প্রিয় বলে
নিশি-ভোরে সে কিন হায় সরে যায়॥
হায় আজ যাহার প্রেম করে গো রাজাধিরাজ
কাল কেন সে চির-কাঙাল করে যায়॥
মান অভিমান খেলার ছলে
ফেরে না আর যে যায় চলে,
মিলন-মালা মলিন ধুলায়, ভরে যায়॥
কোন কুসুমে তোমায় আমি
ভজন
কোন কুসুমে তোমায় আমি
পূজিব নাথ বলো বলো।
তোমার পূজার কুসুম-ডালা
সাজায় নিতি বনতল॥
কোটি তপন চন্দ্র তারা
খোঁজে যারে তন্দ্রাহারা
খুঁজি তারে লয়ে আমার
ক্ষীণ এ নয়ন ছলছল॥
বিশ্ব-ভুবন দেউল যাহার
কোথায় রচি মন্দির তাঁর,
লও চরণে ব্যথায়-রাঙা
আমার হৃদয়-শতদল॥
কোন দূরে ও কে যায় চলে যায়
ভৈরবী – মিশ্র কা
কোন দূরে ও কে যায় চলে যায়,
সে ফিরে ফিরে চায়
করুণ চোখে।
তার স্মৃতি মেশা হায়, চেনা-অচেনায়,
তারে দেখেছি কোথায় যেন সে কোন লোকে॥
শুনি স্বপ্নে তারই যেন বাঁশি মন-উদাসী
তারই বার্তা আসে নব মধুমাসে
পলাশ অশোকে॥
কৃষ্ণচূড়ার তার মালা লুটায়
চৈত্রশেষে বনের ধুলায়।
কান্না-বিধুর
তার ভৈরবী সুর
প্রভাতি তারায় অশ্রু ঘনায়।
চির-বিরহী চিনি ওকে॥
খোদার হবিব হলেন নাজেল
ভৈরবী মিশ্র কাহারবা
খোদার হবিব হলেন নাজেল
খোদার ঘর ওই কাবার পাশে।
ঝুঁকে পড়ে আর্শ কুর্শি,
চাঁদ সুরুজ তাঁয় দেখতে আসে॥
ভেঙে পড়ে মুরত-মন্দির,
লাত-মানাত , শয়তানি তখ্ত,
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র
উঠিছে তক্বীর আকাশে॥
খুশির মউজ তুফান তোরা
দেখে যা মরুভূমে,
কোহ-ই-তুরের পাথরে আজ
বেহে্শতি ফুল ফুটে হাসে॥
য়্যোতিম-তারণ য়্যেতিম হয়ে
এল রে এই দুনিয়ায়,
য়্যোতিম-মানুষ-জাতির ব্যথা
নইলে এমন বুঝত না সে॥
সূর্ব ওঠে, ওঠে রে চাঁদ,
মনের আঁধার যায় না তায়,
হৃদ-গগন যে করল রওশন,
সেই মোহাম্মদ ওই রে হাসে॥
আপন পুণ্যের বদলাতে যে
মাগিল মুক্তি সবার,
উম্মতি উম্মতি কয়ে
দেখ আঁখি তাঁর জলে ভাসে॥
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই
খাম্বাজ দাদরা
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই,
বহিয়া চলেছে আগের মতন
কই রে আগের মানুষ কই॥
মৌনী স্তব্ধ সে হিমালয়
তেমনই অটল মহিমময়,
নাহি তার সাথে সেই ধ্যানী ঋষি,
আমরাও আর সে জাতি নই॥
আছে সে আকাশ, ইন্দ্র নাই,
কৈলাসে সে যোগীন্দ্র নাই,
অন্নদাসুত ভিক্ষা চাই,
কী কহিব এরে কপাল ব-ই॥
সেই আগ্রা সে দিল্লি ভাই,
পড়ে আছে, সে বাদশা নাই
নাই কোহিনূর ময়ূর-তখ্ত্
নাই সে বাহিনী বিশ্বজয়ী॥
আমরা জানি না, জানে না কেউ,
কূলে বসে কত গণিব ঢেউ,
দেখিয়াছে কত, দেখিব এ-ও
নিঠুর বিধির লীলা কতই॥
গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি রঙিন প্রেমের গাই গজল
রাগ: সিন্ধু–কাফি ।। তাল: লাউনি
গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি
রঙিন প্রেমের গাই গজল!
অনুরাগের লাল শারাব মোর
চোখে ঝলে ঝলমল।।
আমার গানের মদির ছোঁওয়ায়
গোলাপ কুঁড়ির ঘুম টুটে যায়,
সে গান শুনে প্রেমে-দীওয়ানা
কবির আঁখি ছলছল।।
লাল শিরাজীর গেলাস হাতে তন্বী সাকি পড়ে ঢুলে,
আমার গানের মিঠা পানির লহর বহে নহর–কূলে।
ফুটে ওঠে আনারকলি
নাচে ভ্রমর রঙ-পাগল।।
সে সুর শুনে দিশেহারা
ঝিমায় গগন ঝিমায় তারা,
চন্দ্র জাগে তন্দ্রাহারা
বনের চোখ শিশির-জল।।
ঘন-ঘোর-মেঘ-ঘেরা দুর্দিনে ঘনশ্যাম
দেশ – জয়জয়ন্তী একতালা
ঘন-ঘোর-মেঘ-ঘেরা দুর্দিনে ঘনশ্যাম
ভূ-ভারত চাহিছে তোমায়।
ধরিতে ধরার ভাব, নাশিতে এ হাহাকার
আরবার এসো এ ধরায়॥
নিখিল মানবজাতি কলহ ও দ্বন্দ্বে,
পীড়িত শ্রান্ত আজি কাঁদে নিরানন্দে,
শঙ্খ-পদ্ম হাতে এ ঘোর তিমির-রাতে
তিমিরবিদারী এসো অরুণ-প্রভায়॥
বিদূরিত কারো এই নিরাশা ও ভয়,
মানুশে মানুষে হোক প্রেম অক্ষয়।
কলিতে দলিতে এসো এই দুখ-পাপ-তাপ,
দেহো বর সুন্দর, শেষ হোক অভিশাপ!
গদা ও চক্র করে অরিন্দম এসো,
হতমান দুর্বল মাগিছে সহায়॥
চম্পক-বরনি টলমল তরণি
গৌড় সারং কাওয়ালি
চম্পক-বরনি টলমল তরণি
চলে শ্যামা তরুণী যৌবন-গরবি।
ডাকে দূর পারাবার ডাকে তারে বনপার,
লালসে ঝরে তার পায়ে রাঙা করবী॥
চলে বালা দুলে দুলে,
এলো-খোঁপা পড়ে খুলে,
চাহে ভ্রমর কুসুম ভুলে
তনুর তার সুরভি॥
নাচের ছন্দে দোদুল
টলে তার চরণ চটুল,
হরিণী চায় পথ-বেভুল,
মায়া-লোক-বিহারিণী রচি চলে ছায়াছবি॥
চারু চপল পায়ে যায় যুবতি গোরী
খাম্বাজ কাহারবা
চারু চপল পায়ে যায় যুবতি গোরী।
আঁচলের পাল তুলে সে চলে ময়ূরপঙ্খি-তরি॥
আয় রে দেখবি যদি ভাদরের ভরা নদী,
চলে কে বেদরদি, ভেঙে বূল গিরি-দরি॥
মুখে চাঁদের মায়া, কেশে তমাল-ছায়া,
এলোচুলে দুলে দুলে নেচে চলে হাওয়া-পরি॥
নয়ন-বাণে মারে প্রাণে, চরণ-ছোঁয়ায় জীবন দানে,
মায়াবিনী জাদু জানে, হার মানে উর্বশী অপ্সরি॥
চোখের নেশার ভালোবাসা সে কি কভু থাকে গো
বাগেশ্রী কাহারবা
চোখের নেশার ভালোবাসা সে কি কভু থাকে গো।
জাগিয়া স্বপনের স্মৃতি স্মরণে কে রাখে গো॥
তোমরা ভোল গো যারে
চিরতরে ভোল তারে,
মেঘ গেলে আবছায়া থাকে কি আকাশে গো॥
পুতুল লইয়া খেলা
খেলেছ বালিকা-বেলা,
খেলিছ পরান লয়ে তেমনই পুতুল-খেলা,
ভাঙিছ গড়িছ নিতি হৃদয়-দেবতাকে গো॥
চোখের ভালোবাসা গলে
শেষ হয়ে যায় চোখের জলে,
বুকের ছলনা সে কি নয়ন-জলে ঢাকে গো॥
জগতে আজিকে যারা আগে চলে ভয়-হারা
পেগ্যান
জগতে আজিকে যারা আগে চলে ভয়-হারা
ডেকে যায় আজি তারা, চল রে সুমুখে চল।
পিছু পানে চেয়ে মিছে পড়ে আছি সব নীচে,
চাসনে রে তোরা পিছে অগ্র-পথিক দল॥
চলার বেগে উঠবে জেগে বনে নূতন পথ,
বর্তমানের পানে মোদের চলবে অরুণ-রথ,
অতীত আজি পতিত রে ভাই, রচব ভবিষ্যৎ
স্বর্গ মোরা আনব, না হয় যাব রসাতল॥
রইব না পিছে পড়ে
অতীতের কঙ্কাল ধরে
বইবে নব জীবন-স্রোত
যৌবন-চঞ্চল।
বিশ্ব-সভাঙ্গনে সকল জাতির সনে
বসিব সম আসনে গৌরব-উজ্জ্বল॥
ঝুমকো-লতার চিকন পাতায়
মালবশ্রী-মিশ্র লাউনি
ঝুমকো-লতার চিকন পাতায়
দেখেছি তোমার লাবণি প্রিয়া।
মহুয়া-ফুলের মদির গন্ধে
তোমারই মুখ-মদের অমিয়া॥
শুকতারায় তব নয়নের মায়া,
তমালবনে তারই স্নিগ্ধ ঘন ছায়া,
তাল পিয়ালে হেরি দীহল তনু তব,
ইহুদি দুল দুলে শশী-লেখায় নব,
ডালিম-দানাতে তব গালের লালি,
তোমারই সুরে গাহে পিয়া পাপিয়া॥
তওফিক দাও খোদা ইসলামে
ইমন-মিশ্র পোস্তা
তওফিক দাও খোদা ইসলামে
মুসলিম-জাঁহা পুন হোক আবাদ।
দাও সেই হারানো সলতানত
দাও সেই বাহু, সেই দিল্ আজাদ॥
দাও বেদেরেগ তেগ জুলফিকার
খয়বর -জয়ী শেরে-খোদার ,
দাও সেই খলিফা সে হাশমত
দাও সেই মদিনা সে বোগদাদ॥
দাও সে হামজা সেই বীর ওলিদ
দাও সেই ওমর হারুণ-অল-রশিদ,
দাও সেই সালাহ্উদ্দীন আবার
পাপ দুনিয়াতে চলুক জেহাদ॥
দাও সেই রুমী সাদী হাফিজ
সেই জামী খৈয়াম সে তব্রিজ ।
দাও সেই আকবর সেই শাহ্জহান
দাও তাজমহলের স্বপ্ন-সাধ॥
দাও ভায়ে ভায়ে সেই মিলন
সেই স্বার্থত্যাগ দৃপ্ত মন,
হোক বিশ্ব-মুসলিম এক-জামাত
উড়ুক নিশান ফের যুক্ত-চাঁদ॥
তুমি বর্ষায়-ঝরা চম্পা
সিন্ধু – মিশ্র দাদরা
তুমি বর্ষায়-ঝরা চম্পা,
তুমি যূথিকা অশ্রুমতী।
তুমি কুহেলি-মলিন উষা
তুমি বেদনা-সরস্বতী॥
কদম-কেশর-কীর্ণা
তুমি পুষ্প-বীথিকা শীর্ণা,
হলে ধরণিতে অবতীর্ণা
ক্ষীণ তারকা স্নিগ্ধ জ্যোতি॥
মন্দস্রোতা মন্দাকিনী
তুমি কি অলকানন্দা,
আঁধারের কালো-কুন্তল-ঢাকা
তুমি কি ধূসর সন্ধ্যা?
পাষাণ-দেবতা চরণে
তুমি মরেছ অমর মরণে,
তুমি অঞ্জলি ঝরা-কুসুমের
তুমি ব্যর্থ ব্যথা-আরতি॥
তোমাদের দান তোমাদের বাণী
দেশ একতালা
তোমাদের দান তোমাদের বাণী
পূর্ণ করিল অন্তর।
তোমাদের রস-ধারায় সিনানি
হল তনু শুচিসুন্দর॥
শান্ত উদার আকাশের ভাষা
মলিন মর্তে অমৃত-পিপাসা
দিলে আনি, দিলে অভিনব আশা
গগন-পবন-সঞ্চর॥
বুলায়ে মায়ার অঞ্জন চোখে
লয়ে গেলে দূর কল্পনালোকে,
রাঙাল কানন পলাশে অশোকে,
তোমাদের মায়া-মন্তর॥
ফিরদৌসের পথ-ভোলা পাখি
আনন্দলোকে গেলে সবে ডাকি,
ধূলি-ম্লান মন গেলে রঙে মাখি
ছানিয়া সুনীল অম্বর॥
তোমার আকাশে উঠেছিনু চাঁদ
টোড়ি একতালা
তোমার আকাশে উঠেছিনু চাঁদ
ডুবিয়া যাই এখন।
দিনের আলোকে ভুলিয়ো তোমার
রাতের দুঃস্বপন॥
তুমি সুখে থাকো, আমি চলে যাই,
তোমারে চাহিয়া ব্যথা যেন পাই,
জনমে জনমে এই শুধু চাই
না-ই যদি পাই মন॥
ভয় নাই রানি, রেখে গেনু শুধু
চোখের জলের লেখা,
জলের লিখন শুকাবে প্রভাতে
আমি চলে যাব একা।
ঊর্ধ্বে তোমার প্রহরী দেবতা,
মধ্যে দাঁড়ায়ে তুমি ব্যথাহতা,
পায়ের তলার দৈত্যের কথা
ভুলিতে কতক্ষণ॥
তোমার কুসুমবনে আমি আসিয়াছি ভুলে
খাম্বাজ-মিশ্র কাহারবা
তোমার কুসুমবনে আমি আসিয়াছি ভুলে।
তবু মুখপানে প্রিয় চাহো আঁখি তুলে॥
দেখি সেদিনের সম
ওগো ভুলে-যাওয়া স্মৃতি মম
তব ও-নয়নে আজও ওঠে কি না দুলে॥
ওগো ভুল করে আসিয়াছি, জানি ভুলেছ তুমিও,
তবু ক্ষণেকের তরে এ-ভুল ভেঙো না প্রিয়।
তীর্থে এসেছি মম দেবীর দেউলে॥
তোমার মাধবী-রাতে
আসিনি আমি কাঁদাতে,
কাঁদিতে এসেছি একা বিদায়-নদীর কূলে॥
তোমারই প্রকাশ মহান এ নিখিল দুনিয়া জাহান
দেশি-টোড়ি-মিশ্র কাহারবা
তোমারই প্রকাশ মহান এ নিখিল দুনিয়া জাহান।
তোমারই জ্যোতিতে রওশন নিশিদিন জমিন ও আশমান॥
নিভিল কোটি তপন চাঁদ খুঁজিয়া তোমারে প্রভু,
কত দাউদ ইশা মুসা করিল তব গুণগান॥
তোমারে কত নামে হায় ডাকিছে বিশ্ব শিশুর প্রায়,
কত ভাবে পূজে তোমায় ফেরেশতা হুরপরি ইনসান॥
নিরাকার তুমি নিরঞ্জন ব্যাপিয়া আছ ত্রিভুবন,
পাতিয়া মনের সিংহাসন ধরিতে চাহে তবু প্রাণ॥
দুধে আলতায় রং যেন তার সোনার অঙ্গ ছেয়ে
ভাটিয়ালি কাহারবা
দুধে আলতায় রং যেন তার সোনার অঙ্গ ছেয়ে—
সে ভিন-গাঁয়েরই মেয়ে।
চাঁদের কথা যায় ভুলে লোক তাহার মুখে চেয়ে।
সে ভিন-গাঁয়েরই মেয়ে॥
ও-পারের ওই চরে যখন চুল খুলে সে দাঁড়ায়,
কালো মেঘের ভিড় লেগে যায় আকাশের ওই পাড়ায়।
পা ছুঁতে তার নদীর জলে জোয়ার আসে ধেয়ে।
সে ভিন-গাঁয়েরই মেয়ে॥
চোখ তুলে সে মেঘের পানে ভুরু যখন হানে,
অমনি ওঠে রামধনু গো সেই চাহনির টানে।
কপালের সে ঘাম মুছে গো আঁচল যখন খুলে,
ধানের খেতে ঢেউ খেলে যায়, দরিয়া ওঠে দুলে।
আমি চোখের জলে খুঁজি তারেই দুখের তরি বেয়ে।
সে ভিন-গাঁয়েরই মেয়ে॥
দুপুরবেলাতে একলা পথে
দেশ দাদরা
দুপুরবেলাতে একলা পথে
ও কে হেলিয়া দুলিয়া চলিয়া যায়।
খ্যাপা হাওয়াতে উড়িছে আঁচলা,
খোঁপা খুলিয়া খুলিয়া খুলিয়া যায়॥
ছল করে জল যায় সে আনিতে
দেখিয়া গুরুজন ঘোমটা দিতে
ও সে ভুলিয়া ভুলিয়া ভুলিয়া যায়॥
কাহার গলার মালার তরে
আপন মনে আঁচল ভরে
ফুল তুলিয়া তুলিয়া তুলিয়া যায়॥
কার বিরহে পরান দহে,
কীসের নেশায় মদির মোহে
ও সে ঢুলিয়া ঢুলিয়া ঢুলিয়া যায়॥
দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান
মার্চের সুর
দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান
গাহে আজি উদ্ধত গান।
লঙ্ঘি গিরি-দরি
ঝঞ্ঝা-নূপুর পরি
ফেরে মন্থর করি অসীম বিমান॥
আমাদের পদভরে ধরা টলমল,
অগ্নিগিরি ভয়ে মন্থর নিশ্চল,
কম্প্রমানা ধরা শান্ত অটল,
চরণে লুটায় ঘোর সিন্ধু-তুফান॥
মোরা উচ্ছৃঙ্খল ঘোর স্পর্ধাভরে,
ভাঙি দ্বার, নিষেধের বজ্র-করে,
করি অসম্ভবের পানে নব অভিযান॥
মোদেরে প্রণমি যায় কাল-ভৈরব,
আমাদের হাতে মৃত্যুর পরাভব,
মৃত্যু নিঙাড়ি আনি জীবন-আসব,
মানুষে করেছি মোরা মহামহীয়ান॥
দুলিবি কে আয় মেঘের দোলায়
দেশ – মিশ্র দাদরা
দুলিবি কে আয় মেঘের দোলায়।
কুসুম দোলে পাতার কোলে
পুবালি হাওয়ায়॥
অলকা-পরি অলক খুলে
কাজরি নাচে গগন-কূলে,
বলাকা-মালার ঝুলন ঝুলায়॥
দাদুরি বোলে, ডাহুকি ডাকে,
ময়ূরী নাচে তমাল-শাখে,
ময়ূর দোলে কদম-তলায়॥
তটিনী দুলে ঢেউ-এর তালে
নিবিড় আঁধার ঝাউয়ের ডালে,
বেণুর ছায়া ঘনায় মায়া
পরান ভোলায়॥
দোপাটি লো, লো করবী, নেই সুরভি, রূপ আছে
ভৈরবী দাদরা
দোপাটি লো, লো করবী, নেই সুরভি, রূপ আছে।
রঙের পাগল রূপ-পিয়াসি সেই ভালো আমার কাছে॥
গন্ধ-ফুলের জলসাতে তোর
গুণীর সভায় নেইকো আদর
গুল্ম-বনে দুল হয়ে তুই দুলিস একা ফুল-গাছে॥
লাজুক মেয়ে পল্লি-বধূ জল নিতে যায় একলাটি,
করবী নেয় কবরীতে, বেণির শেষে দোপাটি।
গন্ধ লয়ে স্নিগ্ধ মিঠে
আলো করে থাকিস ভিটে,
নেই সুবাস সাথে, গায়ে কাঁটা,
সেই গরবে মন নাচে॥
নাচে সুনীল দরিয়া আজি দিল-দরিয়া
ভৈরবী – দাদরা
নাচে সুনীল দরিয়া আজি দিল-দরিয়া
পূর্ণিমা চাঁদেরে পেয়ে।
কূলে তার ঝুমুর ঝুমুর ঘুমুর বাজে মিঠে আওয়াজে
নাচে জল-পরির মেয়ে॥
তার জল-ছলছল কূলে কূলে
ফেনিল যৌবন ওঠে দুলে;
চাঁদিনি উজল তনু ঝলমল
পরানে উছল জাগে জোয়ার,
আধো ঘুমে আসে তার নয়ন ছেয়ে॥
জল-বালা মুক্তামালা গাঁথে নিরালা
চাঁদের তরে,
কাজল-বরনি তরুণী তটিনী চলেছে ধেয়ে॥
নাহি কেহ আমার ব্যথার সাথি
ভীমপলশ্রী কাহারবা
নাহি কেহ আমার ব্যথার সাথি।
জ্বলি পিলসুজে একা মোমের বাতি॥
পতঙ্গ সুখী, পুড়ে এক নিমেষে,
পুড়িয়া মরি আমি সারা রাতি॥
আসে যে সুখের দিনে বন্ধুরূপে,
অসময়ে যায় সরে চুপে চুপে।
উড়ে গেছে অলি ফুল ঝরেছে বলি,
কাঁদি একাকী কন্টক-শয্যা পাতি॥
কেহ কারও নয় তবু প্রাণ কাঁদে
চকোর চাহে যেন সুদূর চাঁদে,
শুধু বেদনা পাই প্রেম-মোহে মাতি॥
পথ চলিতে যদি চকিতে
বারোয়াঁ-মিশ্র কাহারবা
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়!
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনই মদির-চোখে চাহিয়ো॥
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
লুকাতে সে-জল করিয়ো না ছল,
যে প্রিয়-নামে ডাকিতে মোরে
সে-নাম ধরে বারেক ডাকিয়ো॥
তোমার বঁধু পাশে যদি রয়,
মোর-ও প্রিয় সে, করিয়ো না ভয়,
কহিব তারে, ‘আমার প্রিয়ারে
আমারও অধিক ভালোবাসিয়ো’।
বিরহ-বিধুর মোরে হেরিয়া
ব্যথা যদি পাও, যাব সরিয়া,
রব না হয়ে পথের কাঁটা,
মাগিব এ বর – মোরে ভুলিয়ো॥
পরো পরো চৈতালি-সাঁঝে কুসমি শাড়ি
চৈতি কাহারবা
পরো পরো চৈতালি-সাঁঝে কুসমি শাড়ি।
আজি তোমার রূপের সাথে চাঁদের আড়ি॥
পরো ললাটে কাচপোকার টিপ,
তুমি আলতা পরো পায়ে হৃদি নিঙাড়ি॥
প্রজাপতির ডানা-ঝরা সোনার টোপাতে,
ভাঙা ভুরু জোড়া দিয়ো রাতুল শোভাতে।
বেল-যূথিকার গোড়ে-মালা পরো খোঁপাতে,
দিয়ো উত্তরীয় শিউলি-বোঁটার রঙে ছোপাতে।
রাঙা সাঁঝের সতিনি তুমি রূপ-কুমারী॥
পাষাণ-গিরির বাঁধন টুটে
পিলু-মিশ্র রূপক
পাষাণ-গিরির বাঁধন টুটে
নির্ঝরিণী আয় নেমে আয়।
ডাকছে উদার নীল পারাবার
আয় তটিনী আয় নেমে আয়॥
বেলাভূমে আছড়ে পড়ে
কাঁদছে সাগর তোরই তরে,
তরঙ্গেরই নূপুর পরে
জল-নটিনি আয় নেমে আয়॥
দুই ধারে তোর জল ছিটিয়ে
ফুল ফুটিয়ে আয় নেমে আয়,
শ্যামল তৃণে চঞ্চল অঞ্চল লুটিয়ে
আয় নেমে আয়॥
সজল যে তোর চোখের চাওয়ায়
সাগর জলে জোয়ার জাগায় –
সেই নয়নের স্বপন দিয়ে
বনহরিণী আয় নেমে আয়॥
পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে
পিলু দাদরা
পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে।
‘পিউ পিউ পিউ কাঁহা’
পাপিয়া পিয়া বোলে॥
সে পিয়া-পিয়া সুরে
বাদল ঝুরে,
নদী-তরঙ্গ দোলে॥
কূলে কূলে কুলুকুলু
নদী-তরঙ্গ দোলে॥
ফুটিল দল মেলি
কেতকী, বেলি,
শিখী পেখম খোলে॥
দুলে দুলে দুলে নেচে
শিখী পেখম খোলে॥
পিয়ায় যারা নাহি পেল হেথায়, তাহারা কি
এসেছে ধরায় পুন হইয়া পাপিয়া পাখি?
দেখিয়া ঘরে ঘরে তরুণীর কালো আঁখি
‘পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা আজিও উঠিছে ডাকি!
পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে॥
ফিরি পথে পথে মজনুঁ দিওয়ানা হয়ে
ফিরি পথে পথে মজনুঁ দিওয়ানা হয়ে।
বুকে মোর এয়্ খোদা তোমারই এশ্ক্ লয়ে॥
তোমার নামের তসবীহ লয়ে ফিরি গলে,
দুনিয়াদার বোঝে না মোরে পাগল বলে,
ওরা চাহে ধনজন আমি চাহি প্রেমময়ে॥
আছ সকল ঠাঁয়ে শুনে বলে সবে,
এমনি চোখে তোমার দিদার কবে হবে,
আমি মনসুর নহি যে পাগল হব আনাল্হক কয়ে॥
তোমার হবিবের আমি উম্মত এয় খোদা,
তাইতো দেখিতে তোমায় সাধ জাগে সদা,
আমি মুসা নহি যে বেহোশ হয়ে পড়ব ভয়ে॥
তোমারই করুণায় যাবই তোমায় জেনে,
বসাব মোর হৃদে তোমার আর্শ এনে,
আমি চাই না বেহেশ্ত, রব বেহেশ্তের মালিক লয়ে॥
বকুল-চাঁপার বনে কে মোর
মাঢ় লাউনি
বকুল-চাঁপার বনে কে মোর
চাঁদের স্বপন জাগালে।
অনুরাগের সোনার রঙে
হৃদয়-গগন রাঙালে॥
ঘুমিয়ে ছিলাম কুমুদ-কুঁড়ি
বিজন ঝিলের নীল জলে,
পূর্ণ-শশী তুমি আসি
আমার সে ঘুম ভাঙালে॥
হে মায়াবী! তোমার ছোঁয়ায়
সুন্দর আজ আমার তনু।
তোমার মায়া রচিল মোর
বাদল-মেঘে ইন্দ্রধনু।
তোমার টানে, হে দরদি,
দোল খেয়ে যায় কাঁদন-নদী!
কূল-হারা মোর ভালোবাসা আজকে কূলে লাগালে॥
বনে চলে বনমালী বনমালা দুলায়ে
কাফি ঠুংরি
বনে চলে বনমালী বনমালা দুলায়ে!
তমালে কাজল-মেঘে শ্যাম-তুলি বুলায়ে॥
ললিত মধুর ঠামে কভু চলে কভু থামে,
চাঁচর চিকুরে বামে শিখী-পাখা ঢুলায়ে॥
ডাকিছে রাখালদলে, ‘আয় রে কানাই’ বলে
ডাকে রাধা তরুতলে ঝুলনিয়া ঝুলায়ে॥
যমুনার তীর ধরি চলুছে কিশোর হরি,
বাজে বাঁশের বাঁশরি ব্রজনারী ভুলায়ে॥
বরষ মাস যায় – সে নাহি আসে
পিলু-কাফি-মিশ্র ঠুংরি
বরষ মাস যায় – সে নাহি আসে,
বরষ মাস যায়।
সখী রে সেই চাঁদ ওঠে নভে
ফুলবনে ফুল ফোটে বৃথায়॥
একা সহি মৌন হৃদয়-ব্যথা,
আমার কাঁদন শুনি
সে মোর যদি ব্যথা পায়॥
মরমর ধ্বনি শুনি পল্লবে চমকিয়া উঠি সখী
ভাবি বুঝি বঁধু মোর আসিল।
যে যায় চলিয়া, চলিয়া সে যায় চিরতরে
ফিরে আর আসে না সে হায়॥
বহিছে সাহারায় শোকেরই লু-হাওয়া
দেশ কাওয়ালি
বহিছে সাহারায় শোকেরই লু-হাওয়া,
দোলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে।
নূহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন
ঘোর অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে॥
হায় হোসেনা, হায় হোসেনা বলি
কাঁদে গিরিদরি মরু বনস্থলী,
কাঁদে পশু ও পাখি তরুলতার সনে॥
ফকির বাদশাহ গরিব ওমরাহে
কাঁদে তেমনই আজও, তারই মর্সিয়া গাহে,
বিশ্ব যাবে মুছে, মুছিবে না এ আঁসু,
চিরকাল ঝরিবে কালের নয়নে॥
সেই সে কারবালা সেই ফোরাত নদী
মুসলিম হৃদে গাহিছে নিরবধি,
আশমান জমিন রহিবে যতদিন
সবে কাঁদিবে এমনই আকুল কাঁদনে॥
বাজিছে দামামা, বাঁধো রে আমামা
ইমন – মিশ্র একতালা
বাজিছে দামামা, বাঁধো রে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওত এসেছে নয়া জমানার
ভাঙা কিল্লায় ওড়ে নিশান॥
মুখেতে কলমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামি জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশ্ক্ আল্লার
চল আগে চল বাজে বিষাণ।
ভয় নাই তোর গলায় তাবিজ
বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান॥
নহি মোরা জীব ভোগ বিলাসের,
শাহাদত চিল কাম্য মোদের,
ভিখারির সাজে খলিফা যাদের
শাসন করিল আধা-জাহান
তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহোশ,
বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান॥
ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনও জাগিনি যখন জোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর,
মগরেবের আজ শুনি আজান।
জমাত্ -শামিল হও রে এশাতে
এখনও জমাতে আছে স্থান॥
শুকনো রুটিরে সম্বল করে
যে ইমান আর যে প্রাণের জোরে
ফিরেছে জগৎ মন্থন করে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
আল্লাহু আকবর রবে পুন
কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান॥
বাদল-বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি
দেশ আদ্ধা কাওয়ালি
বাদল-বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ উৎসবের রাতি।
তোমার আছে হাসি, আমার আঁখি-জল,
তোমার আছে চাঁদ, আমার মেঘ-দল;
তোমার আছে ঘর, ঝড় আমার সাথি॥
শূন্য করি মোর মনের বনভূমি,
সেজেছ সেই ফুলে রানির সাজে তুমি।
নব বাসরঘরে যাও সে সাজ পরে
ঘুমাতে দাও মোরে কাঁটার শেজ পাতি॥
বাসন্তী রং শাড়ি পোরো
সিন্ধু দাদরা
বাসন্তী রং শাড়ি পোরো
খয়ের রঙের টিপ।
সাঁঝের বেলায় সাজবে যখন
জ্বালবে যখন দীপ॥
দুলিয়ে দিয়ো দোলন-খোঁপায়
আমের মুকুল বকুল-চাঁপায়,
মেখলা কোরো কটি-তটে
শিউরে-ওঠা নীপ॥
কর্ণ-মূলে দুল দুলিয়ো দুলাল-চাঁপার কুঁড়ি,
বন-অতসীর কাঁকন পোরো, কনক-গাঁদার চুড়ি।
আধখানা চাঁদ গরব ভরে
হাসে হাসুক আকাশ পরে,
তুমি বাকি আধখানা চাঁদ
ধরার মণি-দীপ॥
বুকে তোমায় নাই-বা পেলাম
ভৈরবী-মিশ্র কাহারবা
বুকে তোমায় নাই-বা পেলাম
রইবে আমার চোখের জলে।
ওগো বঁধু! তোমার আসন
গভীর ব্যথায় হিয়ার তলে॥
আসবে যখন তিমির-রাতি
রইবে না কেউ জাগার সাথি,
আসব সেদিন জ্বালব বাতি,
মুছব নয়ন-জল আঁচলে॥
নাই-বা হলাম প্রিয় তোমার,
বন্ধু হতে দোষ কি বঁধু?
মুখের মধুর তৃষ্ণা শেষে
আমি দিব বুকের মধু।
আমি ভালোবাসিনিতো,
ভালোবাসা পাবার ছলে॥
বাহুর পাশে প্রিয়ায় বেঁধে
আমার তরে উঠবে কেঁদে,
সেই তো আমার জয় গো, প্রিয়,
অন্তরে রই, রই না গলে॥
বৃথা তুই কাহার পরে করিস অভিমান
তিলক-কামোদ মিশ্র কাহারবা
বৃথা তুই কাহার পরে করিস অভিমান।
পাষাণ-প্রতিমা সে-যে হৃদয় পাষাণ॥
রুপসির নয়নে জল নয়ন-শোভার তরে,
ও শুধু মেঘের লীলা নভে যে বাদল ঝরে,
চাতকের তরে তাহার কাঁদে না পরান॥
প্রণয়ের স্বপন-মায়া
ধরিতে মিলায় কায়া,
গোধূলির রঙের খেলা ক্ষণে অবসান॥
ফোটে ফুল কানন ভরে,
সে কি তো মালার তরে?
প্রেমে হায় জোর চলে না, নাহি প্রতিদান॥
ভুল করে কোন ফুল-বিতানে
মাঢ় মিশ্র লাউনি
ভুল করে কোন ফুল-বিতানে
গানের পাখি পথ হারালি।
প্রেম-সমাধির বুকে এ-যে
সাজানো ম্লান ফুলের ডালি॥
বাণ-বেঁধা বুক লয়ে কোথায়
উড়ে এলি শান্তি-আশায়,
চোখের জলের নদীর পাশেই
রয় নিরাশার চোরাবালি॥
জানিসনে তুই ফুলের বনে
কাল-সাপিনি রয় গোপনে,
তৃষ্ণা-কাতর হৃদয়ে তোর
বিষের জ্বালা দিলি ঢালি॥
আলেয়ারই আলোয় ভুলে
এলি এ-কোন মরণ-কূলে
হৃদয়ের এ শ্মশান-ভূমে
প্রেমের চিতা জ্বলছে খালি॥
ভেঙো না ভেঙো না বঁধু তরুণ চামেলি-শাখা
খাম্বাজ দাদরা
ভেঙো না ভেঙো না বঁধু তরুণ চামেলি-শাখা।
ফুলের নজরানা এর আজিও পাতায় ঢাকা॥
কুঞ্জ-দ্বারে থাকি থাকি বৃথা এত ডাকাডাকি,
আজিও এ বনের পাখি ঘুমায় হেরো গুটিয়ে পাখা॥
অসময়ে হে রসময় ভাঙিয়ো না লতার হৃদয়,
তনুতে এলে অনুরাগ হেরিবে না ফাঁকা-ফাঁকা॥
আসছে-ফাগুনমাসে আসিয়ো ইহার পাশে,
আজ যে-লতা কয় না কথা, সেদিন তায় যাবে না রাখা॥
মদির আবেশে কে চলে ঢুলুঢুলু-আঁখি
পিলু মিশ্র কাহারবা
মদির আবেশে কে চলে ঢুলুঢুলু-আঁখি।
মদির কার আঁখি।
হেরিয়া পাপিয়া উঠিছে পিউ পিউ ডাকি॥
আলতা-রাঙা পায়ে আলপনা আঁকে,
পথের যত ধূলি তাই বুক পেতে থাকে,
দুধারে তরুলতা দেয় চরণ ফুলে ফুলে ঢাকি॥
তারই চোখের চাওয়ায় গো দোলা লাগে হাওয়ায়,
তালীবন তাল দিয়ে যায় তাল-ফেরতায়।
আকুল তানে গাহে বকুল-বনের পাখি॥
তারই মুখ-মদের ছিটে
জোগায় ফুলে মধু মিঠে,
চাঁদের জৌলুসে তাহারই রওশনি মাখি॥
মনে যে মোর মনের ঠাকুর
কানাড়া – মিশ্র রূপক
মনে যে মোর মনের ঠাকুর
তারেই আমি পূজা করি,
আমার দেহের পঞ্চভূতের
পঞ্চপ্রদীপ তুলে ধরি॥
ফকির যোগী হয়ে বনে
ফিরি না তার অন্বেষণে,
আমি মনের দুয়ার খুলে দেখি
রূপের জোয়ার, মরি মরি॥
আছেন যিনি ঘিরে আমায়,
তাঁরে আমি খুঁজব কোথায়,
সাগরে খুঁজে বেড়াই
সাগর-বুকে ভাসিয়ে তরি॥
মন্দিরের ওই বন্ধ খোপে
ঠাকুর কি রয় পূজার লোভে?
পেতে রাখি ভক্তিবেদি
আসবে নেমে প্রেমের হরি॥
মরহাবা সৈয়দে মক্কি মদনি আল-আরবি
বেহাগ কাহারবা
মরহাবা সৈয়দে মক্কি মদনি আল-আরবি।
বাদশারও বাদশাহ নবিদের রাজা নবি॥
ছিলে মিশে আহাদে , আসিলে আহমদ হয়ে,
বাঁচাতে সৃষ্টি খোদার, এলে খোদার সনদ লয়ে;
মানুষে উদ্ধারিলে মানুষের আঘাত সয়ে;
মলিন দুনিয়ায় আনিলে তুমি সে বেহেশতি ছবি॥
পাপের জেহাদ-রণে দাঁড়াইলে তুমি একা,
নিশান ছিল হাতে ‘লা শরীক আল্লাহ্’ লেখা,
গেল দুনিয়া হতে ধুয়ে মুছে পাপের রেখা,
বহিল খুশির তুফান উদিল পুণ্যের রবি॥
মহুয়া ফুলের মদির বাসে
পিলু-মিশ্র কাহারবা
মহুয়া ফুলের মদির বাসে,
নেশাতে নয়ন ঝিমিয়ে আসে॥
মাতাল পাপিয়া পিয়া পিয়া ডাকে,
দোলন-চাঁপার ঝুলন-শাখে,
মদালস বায়ে মন উদাসে॥
নিদালি ছাওয়া চৈতালি হাওয়া,
স্বপনের ঘোর লাগে আকাশে
মৌমাছির পাখা জড়িয়ে আসে॥
মাধবীলতার আজি মিলন সখী
তিলক-কামোদ মিশ্র কাহারবা
মাধবীলতার আজি মিলন সখী
শ্যাম-সহকার তরুর সাথে।
আকাশে পূর্ণিমা-চাঁদের জলসা
হেরো গো তাই আজি চৈতালি রাতে॥
ফুলে ফুলে তার ফুল্ল তনু-লতা,
গাহিয়া ওঠে পাখি, বউ গো কও কথা;
স্বর্ণলতার শতনরী হার
দুলিছে গলায় রাতুল শোভাতে॥
তারই আমন্ত্রণ-লিপি থরে থরে
শ্যামল পল্লবে কুসুম-আখরে।
তরুলতা দুলে পুলকে নাচি নাচি,
মিলন-মন্ত্র গাহিছে মৌমাছি,
আলপনা আঁকে আলো ও ছায়াতে॥
মেঘের হিন্দোলা দেয় পুব-হাওয়াতে দোলা
পিলু কাফি দাদরা
মেঘের হিন্দোলা দেয় পুব-হাওয়াতে দোলা।
কে দুলিবি এ দোলায় আয় আয় ওরে কাজ-ভোলা॥
মেঘ-নটীর নূপুর
ওই বাজে ঝুমুর ঝুমুর,
শীর্ণা-তনু ঝরনা তরঙ্গ-উতরোলা॥
ফুল-পসারিনি ওই দুলিছে বনানী,
বিনিমূলে বিলায় সে সুরভি ফুল ছানি।
আজ ঘরে ঘরে ফুল-দোল সব বন্ধ দুয়ার খোলা॥
জলদ-মৃদঙ বাজে
গভীর ঘন আওয়াজে,
বাদলা-নিশীথ দুলে ওই তিমির-কুন্তলা॥
মোর পুষ্প-পাগল মধবী কুঞ্জে
কীর্তন
মোর পুষ্প-পাগল মধবী কুঞ্জে
এই তো প্রথম মধুপ গুঞ্জে,
তুমি যেয়ো না আজি যেয়ো না॥
মম চন্দ্র-হসিত মাধবী নিশীথ
বিষাদের মেঘে ছেয়ো না॥
হেরো তরুণ তমাল করুণ ছায়ায়
আসন বিছায়ে তোমারে সে চায়;
তোমার বাঁশির বিদায়-সুরে
বনে কদম্ব-কেশর ঝুরে;
ওগে অকরুণ! ওই সকরুণ গীতি গেয়ো না।
তুমি যেয়ো না আজি যেয়ো না॥
তোলা বনফুল রয়েছে আঁচলে
হয়নিকো মালা গাঁথা,
বকুলের ছায়ে নব কিশলয়ে
হয়নি আসন পাতা।
মুকুলিকা মোর কামনা সলাজ
দলিয়ো না পায়ে, হে রাজাধিরাজ!
মম অধরের হাসি করিয়ো না বাসি,
পরবাসী যেতে চেয়ো না!
তুমি যেয়ো না আজি যেয়ো না॥
মোহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লে আলা
ভীমপলশ্রী কাহারবা
মোহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লে আলা,
তুমি বাদশারও বাদশাহ কমলিওয়ালা॥
পাপে-তাপে পূর্ণ আঁধার দুনিয়া
হল পুণ্য বেহেশতি নূরে উজালা॥
গুনাহ্গার উম্মত লাগি তব
আজও চয়ন নাহি, কাঁদিছ নিরালা॥
কিয়ামতে পিয়াসি উম্মত লাগি
দাঁড়ায়ে রবে লয়ে তহুরার পিয়ালা॥
জ্বলিবে রোজহাশরে দ্বাদশ রবি,
কাঁদিবে নফসি বলে সকল নবি,
‘য়্যা উম্মতি, য়্যা উম্মতি’ , একেলা তুমি
কাঁদিবে খোদার পাক আর্শ চুমি –
পাপী উম্মতত্রাণ তব জপমালা॥
করে আউলিয়া আম্বিয়া তোমারই ধ্যান,
তব গুণ গাহিল খোদ আল্লাহ্তালা॥
যেন ফিরে না যায় এসে আজ
বেহাগ খেমটা
যেন ফিরে না যায় এসে আজ
বঁধুয়া ফিরে না যায়।
সখী দিসনে তোরা তারে লাজ
বঁধুয়া ফিরে না যায়॥
পথ ভুল করে
যায় আন-ঘরে জানি সই,
তবু আমারই সে রাজাধিরাজ
বঁধুয়া ফিরে না যায়॥
ফুল চুরি ওর পেশা
ও শুধু চোখের নেশা, জানি সই,
একা আমার ছবি তার হিয়া-মাঝ
বঁধুয়া ফিরে না যায়॥
সুন্দর বলে তায়
সকলে পাইতে চায়,
সে পরাল মোরে প্রেমের তাজ
বঁধুয়া ফিরে না যায়॥
যৌবন-সিন্ধু টলমল টলমল
সিন্ধু ত্রিতাল
যৌবন-সিন্ধু টলমল টলমল,
প্রেমের ইন্দু আকাশে ঝলমল।
হৃদয়-তটিনী জোয়ারে নেচে যায়,
তরঙ্গ-রঙ্গে ছলছল ছলছল॥
অন্তর-মন্দিরবাসিনী আজি
আসিল আলোকে ফুল-সাজে সাজি,
নাচুনি ছন্দে চলে সে আনন্দে
মৃদুল মন্দে দুলায়ে বনতল॥
মল্লিকা অতসী ওঠে বনে বিকশি
তার তনু-চন্দন-গন্ধে
বাজে চুড়ি ও কঙ্কণ মণিবন্ধে,
কোকিল কুহরে কুহু অবিরল॥
রিমি ঝিম রিমি ঝিম ওই নামিল দেয়া
পিলু কাহারবা
রিমি ঝিম রিমি ঝিম ওই নামিল দেয়া!
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া॥
ঝিলে শাপলা কমল
ওই মেলিল দল,
মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া॥
বারি-ধারে কাঁদে চারিধার,
ঘরে ঘরে রুদ্ধ দুয়ার;
তেপান্তরে নাচে একা আলেয়া॥
কাঁদে চখাচখি, কাঁদে বনে কেকা,
দীপ নিভায়ে কাঁদি আমি একা,
আজ মনে পড়ে সেই মন দেয়া-নেয়া॥
শিউলিতলায় ভোরবেলায়
বেহাগ – মিশ্র কাহারবা
শিউলিতলায় ভোরবেলায়
কুসুম কুড়ায় পল্লি-বালা।
শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে মুখে
খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা॥
ঘোমটা খুলিয়া তার পিঠে লুটায়,
শিথিল কবরী লুটিছে পায়,
নৃত্যের ভঙ্গে ফুল তোলে রঙ্গে,
আধো আঁধার বন তার রূপে উজালা॥
নিলাজ পাঁয়জোরে তার ওঠে ঝংকার রিনিঝিনি,
মন কয় চিনি চিনি,
এ কি গো বন-দেবীর সতিনি।
শিশির ধরে পায় আলতার রং চায়,
পাখি তারই গান গায় বনে নিরালা॥
শিউলিফুলের মালা দোলে
সিন্ধু মিশ্র কাহারবা
শিউলিফুলের মালা দোলে
শারদ-রাতের বুকে ওই।
এমন রাতে একলা জাগি
সাথে জাগার সাথি কই॥
বকুলবনে একলা পাখি,
আকুল হল ডাকি-ডাকি,
আমার প্রাণ থাকি-থাকি
তেমনই ডেকে ওঠে সই॥
কবরীতে করবীফুল পরিয়া প্রেমে গরবিনি
ঘুমায় বঁধুর বাহু-পাশে, ঝিমায় দ্বারে নিশীথিনী।
ডাকে আমায় দূরের বাঁশি
কেমনে আর ঘরে রই॥
শেষ হল মোর এ জীবনে ফুল ফোটাবার পালা
জৌনপুরী টোড়ি দাদরা
শেষ হল মোর এ জীবনে ফুল ফোটাবার পালা,
ওগো মরণ, অর্ঘ্য লহো সেই কুসুমের ডালা॥
কাটল কীটে ঝরল যে ফুল
শুকাল যে আশার মুকুল,
তাই দিয়ে হে মরণ তোমার গেঁথেছি আজ মালা॥
সুন্দর এই ধরণিতে কতই ছিল সাধ বাঁচিতে
হঠাৎ তোমার বাজল বেণু বিদায়-করুণ ভৈরবীতে।
তোমার আঁধার-শান্ত কোলে
শ্রান্ত তনু পড়ুক ঢলে,
আর সহে না কুসুমবিহীন কন্টকের জ্বালা॥
সাধ জাগে মনে পর-জীবনে
তিলং কাহারবা
সাধ জাগে মনে পর-জীবনে
তব কপোলে যেন তিল হই।
ভালোবাসিয়া মোরে দিল্ দিবে তুমি
যেন আমি তোমার মতো বে-দিল্ হই।
মোর দেওয়া হার নিলে না অকরুণা,
যেন হয়ে সে হার তব বক্ষে রই॥
যাহারে ভালোবেসে তুমি চাহ না মোরে
মরিয়া আসি যেন তাহারই রূপ ধরে,
তুমি হার মানিবে আমি হব জয়ী॥
হৃদি নিঙাড়ি মম আলতা হব পায়ে;
অধরে হব হাসি, রূপ লাবণি গায়ে,
আমার যাহা কিছু তোমাতে হবে হারা,
তুমি জানিবে না আমা বই॥
সাহারাতে ডেকেছে আজ বান, দেখে যা
হাম্বির – মিশ্র কাহারবা
সাহারাতে ডেকেছে আজ বান, দেখে যা।
মরুভুমি হল গুলিস্তান, দেখে যা॥
সেই বানেরই ছোঁয়ায় আবার আবাদ হল দুনিয়া,
শুকনো গাছে মুঞ্জরিল প্রাণ দেখে যা॥
বিরান মুলুক আবার হল গুলে গুলে গুলজার,
মক্কাতে আজ চাঁদের বাথান, দেখে যা॥
সেই দরিয়ায় পারাপারের তরি ভাসে কোরআন,
ওড়ে তাহে কলেমার নিশান, দেখে যা॥
কান্ডারি তার বন্ধু খোদার হজরত মোহাম্মদ,
যাত্রী – যারা এনেছে ইমান, দেখে যা॥
সেই বানে কে ভাসবি রে আয়,
যাবি রে কে ফিরদৌস,
খেয়াঘাটে ডাকিছে আজান, দেখে যা॥
সোনার মেয়ে সোনার মেয়ে
মিশ্র-পিলু দাদরা
সোনার মেয়ে! সোনার মেয়ে!
তোমার রূপের মায়ায় আমার
নয়ন ভুবন গেল ছেয়ে॥
ঝরে তোমার রূপের ধারা
চন্দ্র জাগে তন্দ্রাহারা,
আকাশ-ভরা হাজার তারা
তোমার মুখে আছে চেয়ে॥
কোন গ্রহ-লোক ব্যথায় ভরে
কোন অমরা শূন্য করে
ওলো রাখলে চরণ ধরার পরে
রং-সাগরের রঙে নেয়ে॥
শিল্পী আঁকে তোমার ছবি,
তোমারই গান গাহে কবি,
নিশীথিনী হারিয়ে রবি
চাঁদ হাতে পায় তোমায় পেয়ে॥
স্বদেশ আমার জানি না তোমার
কেদারা একতালা
স্বদেশ আমার! জানি না তোমার
শুধিব মা কবে ঋণ।
দিনের পরে মা দিন চলে যায়,
এল না সে শুভদিন॥
খাই দাই আর আরামে ঘুমাই,
পাগলের যেন ব্যথা-বোধ নাই,
ললাট-লিখন বলিয়া এড়াই
ভীরুতা, শক্তি ক্ষীণ।
অভাগিনি তুমি, সন্তান তব
সমান ভাগ্যহীন॥
কত শতাব্দী করেছে মা পাপ
মানুষেরে করি ঘৃণা,
জানি মা মুক্তি পাব না তাহার
প্রায়শ্চিত্ত বিনা।
স্বদেশ বলিতে বুঝেছি কেবল
দেশের পাহাড়, মাটি, বায়ু, জল,
দেশের মানুষে ঘৃণা করি চাই
করিতে দেশ স্বাধীন।
যত যেতে চাই তত পথে তাই
হই মা ধূলি-বিলীন॥
ক্ষুদ্র ম্লেচ্ছ কাঙাল ভাবিয়া
রেখেছি যাদেরে চরণে দাবিয়া
তাদের চরণধূলি মাখি যদি,
আসিবে সে শুভদিন।
নূতন আলোকে জাগিবে পুলকে
জননী ব্যথা-মলিন॥
স্বপনে দেখেছি ভারত-জননী
পাহাড়ি একতালা
স্বপনে দেখেছি ভারত-জননী
তুই যেন রাজরাজেশ্বরী।
নবীন ভারত! নবীন ভারত!
স্তবগান ওঠে ভুবন ভরি॥
শস্যে ফসলে ডেকেছে মা বান,
মাঠে ও খামারে ধরে নাকো ধান,
মুখভরা হাসি, হাসিভরা প্রাণ,
নদীভরা যেন পণ্য-তরি।
পড়ুয়ারা পড়ে বকুলছায়ে
সুস্থ সবল আদুল গায়ে,
মেয়েরা ফিরিছে মুক্ত বায়ে
কলভাষে দিক মুখর করি॥
ভুলিয়া ঈর্ষা ভোগ আসক্তি
ধরার ক্লান্ত অসুর-শক্তি
এসেছে শিখিতে প্রেম ও ভক্তি
নব-ভারতের চরণ ধরি॥
তব প্রেমে তব শুভ ইঙ্গিতে
অভাব যেন মা নাই পৃথিবীতে,
স্বর্গ নামিয়া এসেছে মাটিতে,
শুধু আনন্দ পড়িছে ঝরি॥
হে চির-সুন্দর, বিশ্ব-চরাচর
ভজন
ভৈরবী কাহারবা
হে চির-সুন্দর, বিশ্ব-চরাচর
তোমারই মনোহর রূপের ছায়া।
রবি-শশী-তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়
রূপে রূপে তব অরূপ কায়া॥
দেহের সুবাস তব কুসুমগন্ধে,
তোমার হাসি হেরি শিশুর আনন্দে।
জননীর রূপে তুমি আমাদের যাও চুমি
তব স্নেহ-প্রেমরূপ কন্যা জায়া॥
হে বিরাট শিশু! এ যে তব খেলনা –
ভাঙাগড়া নিতি নব, দুখ-শোক-বেদনা।
শ্যামল পল্লবে সাগর-তরঙ্গে
তব রূপলাবণি দুলে ওঠে রঙ্গে,
বিহগের কণ্ঠে তব মধু কাকলি,
মায়াময়! শত রূপে বিছাও মায়া॥
হেরি আজ শূন্য নিখিল
ভীমপলশ্রী দাদরা
হেরি আজ শূন্য নিখিল
প্রিয় তোমারই বিহনে।
কোথা হায় তুমি কোথায়,
উঠিছে কাঁদন পবনে॥
কেন বা এলে তুমি কেন বা বিদায় নিলে,
স্বপনে দিয়ে দেখা মিশালে জাগরণে॥
কান্তা-বিরহে হেথা ক্লান্ত কপোত কাঁদে,
সে কোথায় গেছে উড়ে সাথি তার কোন গগনে॥
আঁধার ঘরে মম কেন জ্বলালে বাতি
যদি নিভায়ে দেবে ছিল গো তোমার মনে॥
ভাসিয়া চলেছি আজ স্রোতের কুসুম-সম
নিরাশার পাথার-জলে তোমারই অন্বেষণে॥