অবশ্য বনহুরের চিন্তা ধারা মিথ্যা নয়, বনহুরের আস্তানায় অনাথ সেন এসেছিল এবং তার সঙ্গে এসেছিলো অনাথ সেনের বিশস্ত কুকুরটি। এ কথা যখন জানতে পারে হেমাঙ্গিনী তখন অনাথ সেনকে বন্দী করে এবং তার উপর চালায় নির্মম নির্যাতন। বুঝতে পারে হেমাঙ্গিনী অনাথ সেন গোপনে বনহুরের আস্তানায় গিয়ে হয়তো তার সবকথা ফাঁস করে দিয়েছে।
কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে ইঙ্গিতে বলেছিলো হেমাঙ্গিনী-যা ভোলা এই চিঠি তার কাছে পৌঁছে দিয়ে আয় যার কাছে তোর মনিব গিয়েছিলো। ভোলা বুঝতে পারে হেমাঙ্গিনীর কথা এবং সে পাহাড় পর্বত বন জঙ্গল পেরিয়ে চলে এসেছিলো কান্দাই। এসে সে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিলো বনহুরের আস্তানায়। চিঠিখানা ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিলো বনহুরের হাতে। এটা হেমাঙ্গিনীর সেই চিঠি।
বনহুর হেমাঙ্গিনীর চিঠিখানা বার বার পড়ে বুঝতে পারলো-হেমাঙ্গিনী ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছে বনহুরের উপরে কারণ শুধু হারা হত্যা নয় এর পিছনে আছে আরও রহস্য……
এবার বনহুর রিভলভারটা হাতে তুলে নিলো এবং সেটা নাড়তে নাড়তে বললো–হেমাঙ্গিনীর স্বর্ণ সিংহাসনের স্বাদ গ্রহণে তাকে সহায়তা করবে এটা। তাই এই চিঠি আর এটার আমার প্রয়োজন।
বললো নূরী-তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না হুর?
এখন না বুঝলে পরে বুঝবে? এবার বলো নূরী তুমি কোনটি চাও? স্বর্ণ সিংহাসন না তোমার স্বামীকে?
আজও টুমি জানোনা কোনটা আমার কাছে মূল্যবান।
যে স্বর্ণ সিংহাসনের জন্য একটি নারী তার স্বামীকে হত্যা করেছে এবং অন্য একটি পুরুষের প্রেম ভালবাসা প্রার্থী হয়েছে। তুমি ও একজন নারী।
বুঝতে পারছি তুমি আমাকে স্বর্ণ সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে আমাকে যাচাই করতে চাও। আমি যদি তোমার সঙ্গিনী হয়ে থাকি তাহলে স্বর্ণ সিংহাসন না হয়ে হীরা মনি মুক্তা ঘটিত সিংহাসন হতো তবুও আমি আমার প্রিয়তমকেই ভালবাসবো, প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয় তুমি হুর।
নূরী! গভীর আবেগে টেনে নিলো বনহুর তার কাছে।
ছিঃ ছেড়ে দাও, কেউ এসে পড়বে যে। ছাড়ো বলছি।
বনহুর বলে নুরী সত্যি তুমি বনফুল। গভীর জঙ্গলে থেকেও তোমার সৌন্দর্য এতোটুকু ম্লান হয়নি। যেখানেই থাকি তোমার মুখ খানা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
এ সব আজ নতুন করে বলছো কেন হুর?
মনের কথা বলার অবসর কোথায় বলো? আজ তোমাকে বড় কাছে পেয়েছি, তাই…।
তাই মনের কথা ব্যক্ত করছো তুমি?
তুমি যে কত সুন্দর আগে তেমন করে বুঝবার সময় হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি বনফুল।
নূরী স্বামীর বুকে মাথা রাখে। অনাবিল আনন্দে ভরে উঠে তার হৃদয়।
*
অনাথ সেন আপনি বহুদিন আমাদের নিমক খেয়েছেন, নিমক হারামি করতে আপনার বাধলো না? আপনি ভোলাকে নিয়ে আমাদের চরম শত্রু দস্যু বনহুরের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। তারই শাস্তি আপনার এই নির্মম অবস্থা। কথাগুলো রাণী হেমাঙ্গিনী দৃঢ় কণ্ঠে বললো।
অনাথ সেন কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলোনা। আজ কয়েক দিন তার মুখে খাবার পড়েনি এমন কি এক বিন্দু পানিও দেওয়া হয়নি তাকে। লৌহ শিকলে তার হাত এবং পা শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাকে একটি জমাট অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে হেমাঙ্গিনীর সহচরগণ এসে তাকে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করে তোলে। বৃদ্ধ অনাথসেনের জীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। মাথার চুল এলো মেলো তৈল বিহীন। হেমাঙ্গিনী, তার চুল গুলো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছিলো কথা গুলো, অসহ্য যন্ত্রণায় মুখ খানা বিকৃত করে বলে অনাথ সেন-আমাকে কষ্ট দিয়েও কোন ফল হবেনা। আমাকে হত্যা করো তবুও ফল হবেনা। তোমার পাপের উপযুক্ত শাস্তি পাবেই, তোমার স্বর্ণ সিংহাসন ধূলায় লুণ্ঠিত হবে……
হেমাঙ্গিনী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–এভোবড় কথা বলতে পারলে অনাথ সেন! তোমার মস্তক ধুলায় লুষ্ঠিত হবে আর ক’দিন অপেক্ষা করো। শুধু তোমাকে নয়, তুমি সন্তান সম স্নেহ করো সেই তাকেও আমি তোমার মতই কঠিন শাস্তি দিয়ে হত্যা করবো। এই রাজ পরিবারে একমাত্র আমিই সম্রাজ্ঞী। যা বলবো তাই হবে……
অনাথ সেন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো-সবার উপরে একজন সম্রাট আছেন যার ইঙ্গিতে তুমি তৃণ কুটার মত উড়ে যাবে হেমাঙ্গিনী। রাজা মঙ্গল সিংহকে তুমি হত্যা করে হিন্দল রাজ্যের একচ্ছত্রি সম্রাজ্ঞী হয়েছে। কিন্তু পারবেনা নিজকে রক্ষা করতে।
এত কথা তোমার মনে আছে অনাথ সেন? কে বলেছে আমি রাজা মঙ্গল সিংহকে হত্যা করেছি। তাকে ব্যাঘ্র হত্যা করে ভক্ষণ করেছে আমি স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখেছি।
মিথ্যে কথা! এতো খানি মিথ্যা বলতে বাধলোনা তোমার….।
ভিখারী এত বড় সাহস তোমার।
হাঁ, আমি ভিখারীই বটে, এ কথা মিথ্যা নয়। পিতৃ মাতৃ হারা অনাথ একদিন এসেছিলো রাজ দরবারে। রাজা মঙ্গল সিংহর বাবা রাজা চন্দ্রনাথ সিংহ আমাকে করুণা দেখিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন রাজ দরবারে। সেই দুয়ার কথা আমি ভুলিনি কোনদিন……
তবে নিমক হারামী করতে গেলে কেনো?
না, আমি নিমক হারামী করিনি, করবোনা কোনদিন, তবে আশ্রয়দাতার ক্ষতি সাধনও আমি করতে দেবোনা। জীবন দিয়েও আমি রক্ষা করবো রাজ বংশ।
তুমি তা পারবেনা অনাথ সেন কথা শেষ করেই হেমাঙ্গিনী তার কাপড়ের ভিতর থেকে একটা পিস্তল বের করে অনাথ সেনের বুক লক্ষ্য করে ধরলো তারপর বললো–তোমাকে হত্যা করার পূর্বে বিজয়কে হত্যা করার ইচ্ছা ছিলো। তুমি যেন দেখে যেতে পারো রাজ বংশ তুমি রক্ষা করতে পারলেনা কিন্তু তা হলো না। তোমার আর সময় নেই..