কাল্লু খুব ভাল কিস্সা বলতে পারত, মান্টোভাই। সময় পেলেই দৌড় লাগাত জামা মসজিদে। মসজিদের চাতালে দস্তানগোদের পাশে বসে বসে কিস্সা শুনত। দাস্তানগোরা ভারী আশ্চর্য মানুষ। সারা দিন জামা মসজিদের চাতালে বসে বসে তারা কিস্সা বলত, মানুষকে কিস্সা শুনিয়েই তাদের রোজগার। ঝোলা ভরা কিস্স, কখনও ফুরাত না, যেন সারা পৃথিবী ঘুরে তারা সেইসব কিস্সা খুঁজে নিয়ে এসেছে। পয়সা না দিতে পারলেও শোনাত; শুধু তো। রোজগারের ধান্দা নয়, কিস্সা বলতে বলতে তারা নিজেরাই খোয়বে ডুবে যেত। মান্টোভাই, আমাদের সময়টাই ছিল কিস্সর সুতোয় বোনা একটা চাদর। কোনটা যে জীবনের, আর কোনটা কিস্যার সুতো বোঝাই যেত না। সিপাই বিদ্রোহের পর গোরারা দিল্লির দখল নিল, সে এক দিন গেছে মান্টোভাই, গোটা দিল্লি যেন কারবালা হয়ে গেল, তারপর থেকে দস্তানগোরাও হারিয়ে গেল দিল্লি থেকে। গোরাদের দিল্লিতে কিস্সার আর কোনও জায়গাই রইল না; আপনি তো জানেন,গোরারা কিস্সা চায় না, ওরা চায় ইতিহাস। আমাকেও তো একবার ইতিহাস লেখার কলে জুতে দিয়েছিলেন জাঁহাপনা, সে যে কী বিরক্তিকর কাজ! গোরাদের ইতিহাসের কথা দু’একজনের মুখে শুনেছি; সে এক দমবন্ধ-করা অন্ধকূপ মনে হয় আমার।
আপনি তো কিস্সা লিখতেন, তাই বুঝতে পারবেন, কিস্সা ক’টা লোক বলতে পারে, ক’জনের লেখার ক্ষমতা আছে? ইতিহাস সবাই লিখতে পারে। সেজন্য দরকার শুধু দানেশমন্দি! কিন্তু কিস্সা লেখার জন্য চাই খোয়াব দেখার ক্ষমতা। তাই কি না বলুন? খোয়াব ছাড়া লায়লা মজনুনের কিস্সা জন্ম নিতে পারত? খোয়াব না দেখলে কেউ ইউসুফ-জুলেখার কিস্স বিশ্বাস করবে? কিস্সা বলেই কি তা মিথ্যে? কত যুগ যুগ ধরে এই কিস্সা বেঁচে আছে। আর সিকন্দর? তাঁর নামই লোকে জানে; তাঁর সাম্রাজ্য আজ কোথায়? ইতিহাস একদিন ধুলো হয়ে যায় মান্টোভাই; কিস্সা বেঁচে থাকে।
দিল্লি কারবালা হয়ে যাওয়ার পর, কাল্লুকে মাঝে মাঝেই দেখতাম দিবানখানার কোনও কোণে বসে কাঁদছে। কী হয়েছে কাল্লু? কাল্লুর ফোপানি বেড়ে যেত; সেই সময় ওকে মনে হত গুলি খাওয়া একটা জন্তু, মৃত্যু ওকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কী হয়েছে কালু? কাল্পর ভেতর থেকে যেন মরণ-চিৎকার ভেসে আসত।
-জনাব, দস্তানগোরা আর দিল্লিতে ফিরবে না?
-না রে কাল্প।
-কিঁউ হুজুর?
-বাদশাকেই ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। দাস্তানগোরা কী করে ফিরবে বল? একদিন আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। আমি সকালবেলা বাড়ির সামনের বারান্দায় বসেছিলুম। হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক এসে হাজির হল, ছেড়াফাটা আলখাল্লা পরা, চুলে জট ধরে গেছে, চোখ টকটকে লাল। সে এসে সরাসরি আমার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসল।
-মিঞাসাব, ক’দিন কিছু খাইনি।
-তা আমি কী করব? রাস্তার কুকুরের মত আমি খেঁকিয়ে উঠলুম।
-কিছু দানাপানি যদি দেন হুজুর
-আমারই বলে জোটে না।
-দু’টি খেতে দ্যান হুজুর। আমি দস্তান শোনাই আপনাকে।
হঠাৎ কাল্লু এসে হাজির। সে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘দাস্তান?’
লোকটা তার সবক’টা হলুদ দাঁত বার করে বলল, ‘দস্তান বলাই আমার কাজ জি।’ কাল্লু সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে বসে পড়ে বলে, ‘শোনাও, তবে, শোনাও।
-আগে কিছু খেতে দাও।
কাল্লু সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে দৌড়ল, একটু পরেই কোথা থেকে যে ও কয়েকটা কাবাব আর ছেড়া পরোটা নিয়ে এল, কে জানে! লোকটা নিমেষের মধ্যেই কাবাব-পরোটা শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল।
-বলো, বলো। কাল্লু লোকটাকে তাড়া দেয়। -কিস্সাটা কাকে নিয়ে মিঞা?
-মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব।
কালু একবার আমার মুখের দিকে, তারপর লোকটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
-মির্জা আসাদুল্লা খান গালিবকে তুমি চেনো মিঞা? আমি জিজ্ঞেস করলুম।
-না, হুজুর।
-তার কিস্সা তবে জানলে কোথায়?
-আগ্রাতে।
-তুমি আকবরাবাদে থাকো?
-জি হুজুর?
-কিন্তু মির্জা তো কবেই আকবরাবাদ ছেড়ে দিল্লি চলে গেছেন, মিঞা।
-জানি হুজুর। আগ্রাতে আমরা মির্জার দস্তান বলি। বহুত লোক ভিড় করে শুনতে আসে।
-তা হলে, বলো শুনি। আমি কালুর দিকে তাকিয়ে হাসলুম; কাল্লুর মুখেও দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল।
লোকটা প্রথমে পতঙ্গবাজি নিয়ে একটা মসনবি আবৃত্তি করল। মান্টোভাই, নয় বছর বয়েসে পতঙ্গবাজি নিয়ে মসনবিটা লিখেছিলুম। তখন আমার তখল্লশ অসদ্।
আপনি জানেন তো, নবাব হুসাম-উদ-দৌলা লখনউ গিয়ে মীরসাবকে আমার গজল দেখিয়েছিলেন? মীরসাব বলেছিলেন, ‘অগর ইস লড়কে কো কোই কামিল উস্তাদ মিল গয়া অওর ইসে সিধে রাস্তে পর ডাল দিয়া তো লা-জওয়াব শায়র বনেগা-বরনা মোহমল বকনে লাগে গা।’ মীরসাব আমার সম্পর্কে এই কথা বলেছিলেন, ভেবে দেখুন।
ইরতেদা-এ ইশকমেঁ রোতা হ্যয় কেয়া।
আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যয় কেয়া।
(সবে তো প্রেমের শুরু, এখনই কাঁদছ?
দেখো ক্রমে ক্রমে আরো কত কী ঘটে।)।
ইশক্। ভালবাসার জন্য মীরসাবকে পাগল হয়ে যেতে হয়েছিল, পাগল বানানো হয়েছিল তাঁকে। তাঁর খানদানেরই একজন বেগমের জন্য ইশক -এ দেওয়ানা হয়েছিলেন মীরসাব। সেজন্যই তাঁর ওপর চলেছিল লাগাতার নির্যাতন। আগ্রা থেকে দিল্লি পালিয়ে গিয়েও রেহাই পাননি। শেষে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, ছোট একটা কুঠুরিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। দূর থেকে খাবার ছুঁড়ে দেওয়া হত। চিকিৎসার নামে কী যন্ত্রণাই না দেওয়া হয়েছিল মীরসাবকে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এতসবের পরেও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন মীরসাব। দিল্লিতে আর থাকতে পারেননি, চলে গিয়েছিলেন লখনউ। ১৮১০-এ লখনউতে মারা গেলেন মীরসাব। তখন আমার বয়স তেরো। সেই বছরেই উমরাও বেগমের শেকলে আটকে গেলাম।