মহলসরায় গিয়ে দেখি বেগম তখন কালুর মা, মাদারির বিবিকে খুব গম্ভীর হয়ে কী সব যেন বলে যাচ্ছে। মাই বাইরে দাঁড়িয়ে শোনবার চেষ্টা করলুম। বেগম ওদের বলছিল, ‘হজরতের কত বিবিই না ছিলেন। কারুর প্রতি কম নজর ছিল না নবির। পালা করে সব বিবির কাছে থাকতেন তিনি। শুধু বিবি সুদা নিজের পালা বিবি আয়েশাকে দিয়েছিলেন। সুদা, সফিয়া, জ্ববিরা, ওম্মহবিবা, ময়মুনা-এই পাঁচ বিবিকে দূরে রাখলেও, তাদের বঞ্চিত করেননি। তাঁর কাছে ছিলেন আয়েশা, হা, ওম্মসলম, জয়নব। হজরতের মতো সমান নজর ক’জনের থাকে?’ বেগম থামতেই আমি গলা খাঁখরি দিয়ে ঘরে ঢুকলুম। কাল্লুর মা, মাদারির বিবি সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। উমরাও বেগম আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘বসুন মির্জাসাব।‘
-সবাইকে সমান দেওয়া যায় বেগম? আমি তাকে হেসে জিজ্ঞেস করলুম।
-নবি ছাড়া আর কে পারবেন জি? কিন্তু আপনি হঠাৎ জেনানামহলে? কোনও ফরমায়েস থাকলে কাল্লুকে বলতে পারতেন।
-ফরমায়েস? আমি কি তোমার কাছে কখনও ফরমায়েস পাঠিয়েছি বেগম?
-তা হলে, আমার মহলে এলেন? আমি তাঁর হাত চেপে ধরে বললুম, ‘আমার গায়ের গন্ধ একবার শুকবে বেগম?’
-ইয়া আল্লা! আপনি কী বলছেন মির্জাসাব?
উমরাও বেগম অনেক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সে সব তো অনেক আগের কথা। আপনার কী হয়েছে মির্জাসাব?’
-বেগম তুমি কি বদু পাও?
-বদু?
-এই যে আমি তোমার সামনে-বদু পাও না?
-কেন মির্জাসাব?
-আমার শরীর থেকে সবসময় বন্ধু পাই। পচা মাংসের।
ইয়া আল্লা! সে আর্তনাদ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে। দুই হাতে আমার পিঠ ডলতে ডলতে বলে, কী হয়েছে আপনার মির্জাসাব? কী হয়েছে? জাদা পি লিয়া আজ? বদ খোয়াব দেখেছেন?
আমি হেসে ফেলেছিলাম-বদ খোয়াব? আমিই তো তো একটা বদ খোয়াব। আল্লা বোধহয় সারা জীবনেও আমার মতো বদখোয়াব আর দেখেননি।
-মির্জাসাব
-বলো।
-আল্লার কাছে দোয়া মাঙুন।
-আল্লার কাছে তো আমি দোয়া করি বেগম।
-কী মাঙ্গেন?
-হম্ হৈঁ মুস্তাক অওর বোহ্ বেজার, য়া ইলাহী য়ে মাদ্রা কেয়া হৈ?
-কে সে? কে আপনার ওপর বেজার?
-খোদা। বলতে বলতে আমি তাঁর কাঁধের ওপর মাথা রেখেছিলুম।
-চলুন। মির্জাসাব, আপনাকে দিবানখানায় দিয়ে আসি।
-কেন?
আমরা দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলুম। আমি বুঝতে পারছিলুম, এই বরফ ভাঙার সাধ্য আমাদের নেই। বেগমও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিল। তার দুই গাল ভিজে যাচ্ছিল। এই বয়েসে এসব কার সহ্য হয় মান্টোভাই? কী হবে কান্না দিয়ে? কান্না আর আমার ভাল লাগে না। কান্না শুনলেই আমি কারবালা দেখতে পাই। কাসেমের মৃত্যুর পর সখিনার সারা শরীর যেমন কান্নার সমুদ্র হয়ে উঠেছিল।
বেগম আমাকে সেদিন দিবানখানায় পৌঁছে দিয়েছিল, আমাকে বিছানায় শুইয়ে অনেক সময় আমার মাথায় হাত রেখে পাশে বসেছিল। বেশ কয়েকবার ডেকেছিল, ‘মির্জাসাব-মির্জাসাব-’। আমি কোনও উত্তর দিইনি। কী হবে উত্তর দিয়ে? সব তো শেষ হয়ে গেছে, কারোর কথা আর কারোর কাছে পৌঁছবে না। চোখ বুজে আমি বিড় বিড় করে সেই গজলটা বলে যাচ্ছিলুম!
বোহ ফিরাক অওর বোহ্ বিসাল কহাঁ,
বোহ্ শব ও রোজ ও মাহ্ ও সাল কহাঁ।।
প্রদীপ নিভিয়ে বেগম একসময় চলে গেল। অন্ধকারে, রোজকার মতো, আমার কয়েদখানায়। শুয়ে রইলুম, আর খুব শীত লাগছিল, মাঝে মাঝে মনে হয় শীত ছাড়া আমার জীবনে যেন আর কোনও ঋতুই নেই। ঘুমের ঘোর এসেছিল, একসময় কাল্লুর গলা শুনতে পেলুম, হুজুর মেহরবান-হজুর-মির্জাসাব-’।
কাল্লু কখনও সময় ভোলে না, রোজ ঠিক সময়ে আমার দাওয়াই নিয়ে আসে। বাক্সের চাবি ওর কাছেই থাকে। ও ঠিক মাপমতন আমাকে এনে দেয়। একফোঁটা দারুও কালু বেশী দেবে না। খেতে খেতে আমি রোজ কালুর কাসে কিস্সা শুনি। কিস্সা বলতে পারলে কাল্লু আর কিছু। চায় না। আমি সেদিন বললুম, ‘কাল্লু, আজ আমি তোকে কিস্সা বলি শোন।
-জি জনাব।
-ক’টা দুনিয়া আছে তুই জানিস?
কালু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-দো দুনিয়া। একটা আল্লার, সেখানে তিনি থাকেন। জিব্রাইল আর ফেরেস্তাদের নিয়ে। আর একটা আমাদের, এই পৃথিবী, মাটি-জলের পৃথিবী। দুই দুনিয়ার মালিক একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়ামতের দিন এই দুনিয়া কার হবে?’ উত্তর কে দিলেন? সেই মালিক। তিনি ছাড়া কে উত্তর দেবেন? মালিক বললেন, ‘সব, সবই আল্লার। কালু, কী মজা দেখ, আল্লা শুধু আল্লার সাথে কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে কে? আল্লা খুব একা কাল্লু।
-ইয়া আল্লা। আর্তনাদ করে ওঠে কাল্লু।
-কী হল?
-আল্লা
-ধুত্তোরি আল্লা। তুই আগে আমার কিস্সাটা শোন। এই পৃথিবীতে যারা গুনাহ্ করে, আল্লার দরবারে তো তাদের শাস্তি পেতেই হবে। আল্লার দুনিয়াতেও কারও কারও গুনাহ থাকে। তাদের আল্লা কী করে জানিস? এই দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন শাস্তি পাওয়ার জন্য। আমি আল্লার দুনিয়ায় গুনাহ্ করেছিলুম কাল্লু।
-জনাব
-তাই আল্লা আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠালেন। কালু, তেরো বছর কয়েদখানায় কাটানোর পর আমাকে যাবজ্জীবন দেওয়া হল। কবে জানিস? বেগমের সঙ্গে যেদিন আমার নিকাহ্ হল। তারপর দিল্লী। এ এক ভয়ঙ্কর কয়েদখানা কাল্লু। কে আমার বেড়ি খুলে দেবে বল তো? কে কে খুলে দেবে? সারা জীবন ধরে লিখে চলা কী যে শাস্তি কাল্লু, তুই বুঝবি না।