এবার আপনার ওয়ালিদ আবদুল্লা বেগ খান ছুটলেন লখনউতে, নবাব আসফ-উদ-দৌলার বাহিনীতে চাকরি নিতে হল তাঁকে। ভাড়াটে সেনার যা ভবিতব্য হয়; এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছোটো; নবাব-বাদশাকে খুশি করো, যখনই দেখলে তাঁর সিংহাসন টলোমলো, তখন অন্য নবাব-বাদশার কাছে ছোটো। সেইসব মেয়েদের মতো, মির্জাসাব, যাদের আমি অমৃতসরের কাচ্চা ঘানিয়া, লাহোরের হিরামাণ্ডি, দিল্লীর জি টি রোদ, বম্বের ফরাস রোডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সারা রাতের লড়াই তাদের। মির্জাসাব, তাদের গল্প আমি আপনাদের একদিন বলব; তাদের মাংসের গল্প। তাদের হৃদয়ের গল্প, তাদের ঘাম-রক্ত-চোট-অশ্রুর গল্প। তাদের গল্পগুলো আমাকে দিনের পর দিন খুঁজে ফিরছিল, আর সেইসব গল্পের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি একদিন আল্লাকে বিশ্বাস করেছি; তাদের সারা জীবনের সঙ্গী তিনিই, রহিম- বিসমিল্লা। সেইসব গল্প কেউ বিশ্বাস করতে চায় নি; বলেছে, আমি বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। তাদের কথা লেখার জন্য আমাকে বেশ্যাদের লেখক -পর্নোগ্রাফার বলা হয়েছে; কিন্তু আমি কী করে চুপ করে থাকব মির্জাসাহাব? এত – এতগুলো-এত হাজার হাজার মেয়ের হিরামাণ্ডি, ফরাস রোডে এসে। দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল? মির্জাসাব, আমাকে মাফ করবেন, শাফিয়া বেগম, আমার বিবিও বলত, সাদাতসাব আপনি এত এলোমেলো কথা বলেন কেন?
গোস্তাকি মাফ করুন হুজুর, পুরনো কথাগুলো তড়িঘড়ি বলে নিই। ওই যে, কথায় পেয়ে বসলে, আমি যে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাব নিজেই জানি না। লোকজনকে গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে মারতেও বেশ লাগে আমার। একবার রটিয়ে দিলাম, আমেরিকা আমাদের তাজমহল কিনতে আসছে। তার মানে? সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, তাজমহল কিনবে কী করে? কিনলে নিয়ে যাবেই বা কী করে? আমি বললাম আমেরিকানরা সব পারে, ওরা একটা নতুন যন্ত্র বানিয়েছে, সেই যন্ত্র দিয়েই তাজমহলকে তুলে নিয়ে যাবে। কত লোকে যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল, মির্জাসাহেব। বিশ্বাস করবে নাই বা কেন? সবাই তো বিশ্বাস করে, আমেরিকা যা খুশি তাই করতে পারে, আমেরিকা যেন একটা জাদুকর। কাকে বোঝাবেন বলুন, হাতে যন্ত্রপাতি থাকলেই সবকিছু করা যায় না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, এবার তা হলে বলেই ফেলি, লখনউতে আপনার ওয়ালিদ বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। তাঁকে চলে আসতে হল হায়দরাবাদে, নবাব নিজাম আলি খানের বাহিনীতে। তিনশো পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি হলেন। বেশ কয়েক বছর ছিলেন নিজামের বাহিনীতে। কী যে গণ্ডগোল হল- সব ইতিহাস তো লেখা নেই মির্জাসাব, লেখা থাকলেই বা আর কী-আবদুল্লা বেগ চলে এলেন আলোয়ারে। রাও রাজা বক্তওয়ার সিংয়ের সেনাবাহিনীতে। ইতিহাস লেখেনি, কোন যুদ্ধে, কীভাবে আপনার ওয়ালিদের মৃত্যু হয়েছিল। ভাড়াটে সৈন্যদের কথা তো ইতিহাস লেখে না; কিন্তু চমকদার সব ইতিহাস বানানোর জন্য ভাড়াটে সৈন্যদেরই কাজে লাগানো হয়। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, তখন আপনার পাঁচ বছর বয়স।
আপনি এতিম হলেন পাঁচ বছর বয়েসে। ওয়ালিদ নেই মানেই তো এতিম। শুধু আপনি নন, আপনার ভাই ইউসুফ, বোন ছোটি খানম। আপনার ওয়ালিদের কোনও বাড়ি ছিল না। আপনারও সারা জীবনে কোন বাড়ি হয়নি। আগ্রার কালে মহল – আপনার দাদুর বিরাট হাভেলি-আপনাদের তিন ভাই-বোনের শৈশব-কৈশোর কেটেছিল সেখানে, কিন্তু কবে বুঝেছিলেন। বলুন তো, আপনার আসলে কোন বাড়ি নেই? কালে মহলের ভিতরে কেমন দিন কাটত আপনার, জানতে খুব ইচ্ছে করে আমার। আপনার মা, শোকজর্জর মা, জেনানামহলের এককোণে নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকতেন। আমি দেখতে পাই, আপনারা তিন ভাই-বোন তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন, তিনি আপনাদের দু’হাতের ডানায় আঁকড়ে ধরতেন, আর হয়তো বিড়বিড় করে বলতেন, ‘ইয়া আল্লা, ইয়া আল্লা! ইস বাচ্চোকো ইনসাফ করো।
কবরের ভিতরে আপনি এক একদিন ছটফট করছেন দেখতে পাই, আর গোঙাতে থাকেন, আম্মা-মেরি আম্মাজান–’
আমি সেই বেগমের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, যাঁর নাম আমরা কেউ জানি না, আপনার আম্মা ডাকছেন, ‘আসাদ, মেরি জান—‘
-ঘর লে চলল আম্মা।
-কাঁহা?
-কাঁহি হো।
মির্জাসাব, আপনি আবার শুয়ে পড়লেন কেন? আমার কথা শুনতে আপনার ভাল লাগছে না? তা। হলে আপনি কিছু বলুন মির্জাসাব। আমার বখোয়াস ভুলে যান।
০৩. এত দূর থেকে কি আমার কথা
বুদকদহ্মে মানীকা কিস্মে করে সওয়াল
আদম নহী হ্যয়, সুরৎ-এ আদম বহুৎ হয় য়াঁ
(এই মাটির পুতুলের রাজ্যে কার কাছে বিশ্বরহস্যের অর্থ শুধাব?
এখানে মানুষ নেই, মনুষ্যাকৃতি অবশ্য অনেকেই আছে।)
এত দূর থেকে কি আমার কথা শুনতে পাবেন মান্টোভাই? আপনি বড় নাছোড়বান্দা, তাই এতদিন বাদে আবার আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। ১৮৫৭-র পর বারো বছর আমি বেচেছিলুম ঠিকই, কিন্তু কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হত না। তবুও কথা বলতে হত, কথা বেচেই তো রোজগার করতে হত আমাকে। রুজি-রোজগারের জন্য যতটুকু, তা বাদে কথা আমার কাছে হারাম হয়ে গেছিল। ভাঙাচোরা দিবানখানায় আমি শুধু শুয়ে থাকতুম। কাল্লু এসে ওখানেই আমার দু’বেলার খাবার, ওই একটু পরোটা, কাবাব বা ভুনা গোস্ত আর দারু দিয়ে যেত। শুধু ঘুম আর ঘুম। একটা গজলও মাথায় আসত না। কী করে আসবে বলুন? আমি তো তখন। পচে যাচ্ছি, সারা শরীরে বন্ধু, কেউ না পেলেও আমি সেই গন্ধ পেতুম, পচে যাওয়ার গন্ধ। একদিন ওই গন্ধ সহ্য করতে না পেরে সন্ধেবেলা মহলসরায় গেলুম। আমি ওখানে পারতপক্ষে যেতুম না। উমরাও বেগম সারাদিন নামাজ-তসবিমালা নিয়ে পড়ে থাকত; তার কাছে আমি থাকা-না-থাকা তো সমান। আমারও তো তার সঙ্গে কোনও কথা ছিল না। ভাবুন মান্টোভাই, দু’টো মানুষ পঞ্চাশ বছরের ওপর পাশাপাশি রয়ে গেল, তাদের মধ্যে কোনও কথা হল না, কেউ কাউকে জানতেই পারল না। এরই নাম নিকাহ্; এখানে মহব্বত-এর কী দরকার? ভাববেন না, আমি উমরাও বেগমের ওপর দোষ চাপাচ্ছি, আমিই তো একটা কাফের। মীরসাব একটা শের এ বলেছিলেন না, তাকে কীভাবে নিজের কাছে নিয়ে আসব আমি জানতুম না; সে কখনও আসেনি, কিন্তু সে তো তার দোষ নয়।