আপনার পরদাদা সমরখন্দের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন শুনেছি। আপনার দাদা কুকান। বেগ খাঁ সেই অশ্বরোহীদের ঝড়ের সঙ্গে এসে পৌঁছলেন এ-দেশে। আমি কি ঠিকঠাক বলছি মির্জাসাব? ভুল হলে শুধরে দেবেন। আরে, আরে, আপনি উঠে বসে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! জানি, এসব কিস্সা শুনতে আপনার বেশ ভালই লাগবে। রক্ত কি টগবগ করে ফুটতে থাকে মির্জাসাব? আপনি সেই প্রথম গালিবকে দেখতে পান, তাই না? বাদশাদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর। আমি আপনাকে ব্যঙ্গ করছি না, মজাও করছি না আপনার সঙ্গে। কাশ্মীরি বলে আমারই বা কি কম গর্ব ছিল? জবাহরলালকে পর্যন্ত চিঠি লিখতে যে। সাহস পেয়েছিলাম, সে তো ওই কাশ্মীরি গর্বের জন্যই। মির্জাসাব, আমরা মাটির মানুষ, মাটির ভিতর তো কাঁকর থাকেই, তাও তো খোদারই দেওয়া। খোদা যেমন আপনাকে মেহেরবানি করেছিলেন, আমাকেও না করলে কি আমি এত তাড়াতাড়ি কবরে এসে শুতে পারতাম? আমিও তো আপনারই মত তাঁকে মানিনি, কিন্তু খোদার কাছে তাঁর সব সন্তানই সমান।
আপনাকে আবার আমি সব মনে করিয়ে দিচ্ছি নতুন করে মির্জাসাব। কবরের দীর্ঘ জীবনে হয়তো কত কিছুই ভুলে গেছেন আপনি। স্বাভাবিক। জীবনেই কতকিছু মনে রাখতে পারি না আমরা, আর মৃত্যু তো আসে একটা পর্দার মতো, যার ওপারে আর কিছুই দেখা যায় না। এক একটা মৃত্যুর পর্দা এসে কীভাবে সব মুছে দিয়ে গেছে, তা তো আমি ১৯৪৭ -এ দেখেছি। আল্লার দয়ায় আপনাকে তা দেখতে হয় নি। আপনি ১৮৫৭ দেখেছেন। কিন্তু ১৯৪৭ দেখলে আপনি আত্মহত্যা করতেন মির্জাসাব। বা হয়তো পূর্বপুরুষদের মতো আপনার হাতেও তরবারি ঝলসে উঠত। এত হত্যা, ধর্ষণ, নেমকহারামি পৃথিবী আর কখনও দেখেনি; ১৯৪৭ থেকে যা শুরু হয়েছিল, শুধু দু’টো দেশের নামে; এক দেশের কবরে আপনি শুয়ে আছেন, অন্য দেশের কবরে আমি।
মির্জাসাব, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, কোথা থেকে কোথায় চলে যাই, এই কবরের ঠাণ্ডাতে শুয়েও মনে হয়, ভিতরে কোথায় ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। আমি তাই অনেকক্ষণ এলোমলো কথা বলছি। কিন্তু আপনার দাদা কুকান বেগ খাঁর কথাই বলছিলাম, তাই না? ভুল হওয়ার কথা নয়। যদিও আমি অনেকদিন জনি ওয়াকার খাই না। পাকিস্থানে এসে তো দিশিই রপ্ত করতে হয়েছিল। আপনি তো ফ্রেঞ্চ ওয়াইন ভালোবাসতেন। শেষকালে রাম ছাড়া। উপায় ছিল না। কিন্তু আসল কথাটা তো বলতে হবে মির্জাসাব, ওই কুকান বেগ খাঁর কথা। ও বাবা, আপনি আবার নড়েচড়ে বসলেন দেখছি। পূর্বপুরুষদের কথা শুনতে খুব ইচ্ছে হয়, না? রক্তে ঘোড়ার খুরের ঝড় ওঠে বুঝি? ভুলতে পারেন না, আপনি একটা ভিখিরি জেলখাটা আদমি? আর কবি গালিবকে কী বলত লোকে? মুশকিল পসন্দ। মনে আছে? কেউ কেউ বলত, মুহমল-গো। কবিটা প্রলাপ বকে। সেই গজলটা আপনার মনে পড়ে?
য়া রব বহ ন সমঝে হৈঁ
ন সমঝেঙ্গে মেরি বাত।
দে উন দিল উনসে, জো ন দে
মুঝকে জবান ঔর।
(ঈশ্বর, তারা আমার ভাষা বোঝে না।
তুমি তাদের অন্য মন দিও।
তা যদি না দাও,
আমাকে অন্য ভাষা দিও।)।
কথার এই এক পাগলামি। আমি তো কথা বলতে শুরু করলে থামতেই পারতাম না। কেন জানেন? মনে হত, যা বলছি তা সবাই বুঝছে তো? আপনার খুতুত্ পড়লে বুঝতে পারি, কথা বলার কী নেশাই না ছিল আপনার। চিঠির পর চিঠিতে আপনি শুধু কথা বলে গেছেন, আপনার চিঠিগুলো পড়তে পড়তেই তো, মির্জাসাব একদিন আপনার গলা শুনতে পেয়েছিলাম আমি। আপনি কি বলেছিলেন, জানেন?
নহ্ গুল-এ নগ্মহ্ হুঁ, নহ্ পরদহ্-এ সাজ,
মৈঁ হুঁ আপনি শিক-কী আবাজ।
(রাগিণীর আলাপ নই, সেতারের তার নই;
আমি কেবল একটা আওয়াজ, পরাজয়ে ভেঙে পড়ার আওয়াজ।)
একজন দণ্ডিত, পরাজিত মানুষকে আমি সেই প্রথম দেখতে পেলাম। মির্জাসাব আপনি কখনও জানবেন না, আমার কত গল্পে তারা এসেছে, যারা নিজের পরাজয়ে ভেঙে পড়া আওয়াজ শুধু, কথা বলতে বলতে তাদের কিছু কিস্যাও আমি শোনাব আপনাকে। তাদের বাদ দিয়ে মান্টো কে? একটা ঝড়ো হাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু এবার কুকান বেগ খাঁর কথাটা বলে নিতেই হবে। আমি বুঝতে পারছি, গল্পটা শোনার জন্য আপনি অপেক্ষা করে আছেন। কবরের মাটি যেমন সব ধুয়ে মুছে দেয়, এইসব গল্পও হয়তো সেভাবে ফতুর হয়ে গেছে। কুকান বেগ খাঁ, আপনার দাদা, এই দেশে এসে লাহোরের নবাবের ফৌজে কাজ নিলেন। এই নবাব বেশিদিন বাঁচেননি। কুকান বেগ খাঁর মতো ভাড়াটে সৈনিক তা হলে কী করবেন? তাঁকে নতুন কোনও নবাব, বাদশা, নিদেনপক্ষে মহারাজা খুঁজে নিতে হবে। ভাড়াটে সেনারা তো এইভাবে রেণ্ডির মতোই বেঁচে থাকে, যতই তাঁর হাতে তলোয়ার ঝকমক করুক। মির্জাসাব ভাড়াটে সেনাদের এই জীবন আপনি জানতেন, তাই তলোয়ারকে পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। ঠিক কি না, বলুন? মান্টোর মত হারামির চোখকে আপনি ফাঁকি দেবেন কী করে?
আপনার দাদা এবার দিল্লী এসে পৌঁছলেন। হায় আল্লা, কখন? দিল্লী যখন ফতুর হতে বসেছে। আওরঙ্গজেব সব লাটে তুলে দিয়েছিল, তারপর বাইরে থেকে আক্রমণের পর আক্রমণ, বাদশা শাহ আলমের দিল্লী তখন মুঘল সাম্রাজ্যের কঙ্কাল ছাড়া কিছু নয়। মুঘল দরবার তখন একটা বেতো ঘোড়ার মত ধুকছে। শাহ আলমের পঞ্চাশ অশ্বরোহী বাহিনীর সেনাপতি হয়ে জায়গির পেলেও কুকান বেগ খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন, এই দরবারে উন্নতির আশা নেই। তারপর তো জয়পুরের মহারাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পত্তি বেশী কিছু করতে পারেন নি। শুনেছি, আগ্রাতেই এন্তেকাল হয়েছিল তাঁর।