কাকে বলে হেমন্ত? ওরা কাকেই বা বলে বসন্তকাল? সারা বছর আমরা খাঁচার ভিতরে বেঁচে থাকি, এখনও বিলাপ করি, একসময় আমরা উড়তে পারতাম। একটা গজলে মির্জা এইসব কথা লিখেছিলেন। মির্জা কখনও উড়তে পারেননি, আমিও পারিনি। কিন্তু এবার কবরের অন্ধকারে আমরা ডানা লাগিয়ে নেব; বন্ধুরা, আমরা সেইসব কিস্সা বলে যাব, যা আপনারা কখনও শোনেননি; সেইসব পর্দা সরিয়ে সেব, যার ওপারে কী আছে, আপনারা দেখেন নি। মির্জাকে বাদ দিয়ে মান্টো নেই, হয়তো মান্টোকে বাদ দিয়েও মির্জা নেই।
কবরের ভিতরে তা হলে কথাবার্তা শুরু হোক। আদাব।
সাদাত হাসান মান্টো
১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫
ভূমিকা অনুবাদের পর আমি মান্টোর সাক্ষরের নীচের তারিখটির দিকে তাকিয়ে থাকি। তারিখটা যেন এক প্রহেলিকার মতো জেগে আছে। দীর্ঘ সময় নীরব নিশ্চলতায় আমি পাথর। গভীর শীত এসে ঘিরেছে কি আমাকে? বহু দূর থেকে তবসুমের গলা ভেসে আসে, ‘আজ আর লিখবেন না?’ আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে একখণ্ড কুয়াশা দেখতে পাই।
-কী হল?
-হুঁ–
-আজ লিখবেন না আর? আপনি বড় অলস, ফাঁকিবাজ।
-ঠিক বলেছেন।
-কী?
-অলস, ফাঁকিবাজ।
-কী হয়েছে আপনার? তবসুমের কণ্ঠস্বরে বেহালার দ্রুত ছড়।
-এই তারিখটা–
-হ্যাঁ, মান্টো ওইদিন ভূমিকাটা লিখেছিলেন।
-তা কী করে সম্ভব?
-কেন?
-মান্টো তো ওইদিন মারা যান।
-ওইদিন? তবসুম যেন কোনও গহ্বরের ভিতর থেকে কথা বলছে।
-হ্যাঁ। যেভাবে মারা যান, তাতে মান্টোর পক্ষে কলম ধরা সম্ভব ছিল না।
-তা হলে?
-এটা একটা নকল উপন্যাস।
-তার মানে?
-অন্য কেউ মান্টোর নাম নিয়ে লিখেছে। তবসুম এবার হেসে ওঠে।
-ভালই তো।
-কেন?
-একটা নকল উপন্যাস মান্টোর নামে ছাপা হয়ে যাবে।
-সে কী করে হয়?
-হোক না।
-কিন্তু তা কি ঠিক তবসুম?
-ঠিক ভুলের কথা বাদ দিন। আপনি মির্জা গালিবকে নিয়ে মান্টোর লেখা একটা উপন্যাস পড়তে চান তো?
-হ্যাঁ।
-তা হলে ধরে নিন, এটাই মান্টোর লেখা উপন্যাস।
-কেন?
-আপনি কি জানেন, মান্টো যা লিখেছেন, সবই তাঁর লেখা? কেউ হয়ত বলে গেছে, মান্টো লিখে গেছেন। যেমন আমি বলছি, আপনি লিখছেন। আপনি, আমি, মির্জা গালিব, মান্টো-কেউ হয়তো একদিন থাকবে না, তাদের নামটুকুও নয়, কিন্তু গল্পগুলো ঠিক ভেসে বেড়াবে। তাই বা কম কী? নিন, এবার লিখতে শুরু করুন তো।
তবসুমের মুখ পাণ্ডুলিপির অক্ষরের নৈঃশব্দে হারিয়ে যায়।
মিহারবাঁ হো কে বুলা লো মুঝে চাহো জিস ওয়ক্ত হো
মৈঁ গয়া ওয়ক্ত নহি হুঁ ফির আ না সকুঁ।
(দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও।
আমি বিগত সময় নই যে আবার আসতে পারব না।)
অনেক দূর থেকে আপনাকে দেখতে পাই মির্জাসাব, এই চিত হয়ে শুয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন, কখনও কুণ্ডলী পাকিয়ে এমনভাবে শুয়ে থাকেন, মনে হয় যেন কবর আপনার মাতৃগর্ভ, হয়তো উঠে বসে দুলে দুলে নিজের মনে কী বলে যাচ্ছেন, কখনও মাথা নিচু করে আপনাকে পায়চারি করতে দেখতে পাই। তবে আমার এখন বেশীর ভাগ সময় শুয়ে থাকতেই ভালো লাগে, এই অন্ধকারে। সেই ১৮৬৯ থেকে আপনি শুয়ে আছেন, কবরটা ঘরবাড়িই হয়ে গেছে, তাই না? আমি তো সবেমাত্র এসেছি ওপরের জগৎ থেকে, বড় ঝড়ঝাপটা গেছে সারা জীবন, তাই শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আপনারও নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম এইরকম অবস্থাই ছিল। আমি তো জানি, শেষ পর্যন্ত আর জীবনটাকে বইতে পারছিলেন না আপনি। ইউসুফ মির্জাকে লেখা একটা চিঠিতে ফুটে উঠেছিল সেই ক্ষত, আপনার জীবন; আপনি লিখেছিলেন, ‘আমি তো একটা মানুষ, দৈত্য নই, জিনও নই।’
আপনি আসলে কে, শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন আপনার কাছে অবান্তর হয়ে গেছিল। অথচ আপনার জীবনের মূল প্রশ্ন ছিল এটাই; কিন্তু শেষের বছরগুলোতে সবকিছু আপনার কাছে অর্থহীন মনে হত; শুধু মৃত্যু আর আল্লার কথাই বার বার বলেছেন। আপনি নামাজ পড়েননি, রোজা রাখেননি, ঠাট্টা করে নিজেকে অর্ধেক মুসলমান বলতেন, আর এজন্য উমরাও বেগমের থেকেও ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে হয়েছিল আপনাকে; অথচ, সেই আপনি, শেষের বছরগুলোতে শুধু খোদার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিঠির চিঠির পর চিঠিতে আপনি লিখেছেন, খোদা যেন দয়া করে আপনাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেন। আমি জানি, আপনি আর লড়াই করতে। পারছিলেন না, গজল অনেকদিন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, মুনিরাবাইয়ের স্মৃতিও তখন কয়েকটা হাড়গোড় মাত্র, এমনকী আপনার প্রিয় সুরাও আর নিয়মিত জোটে না, এই অবস্থায়। একজন মানুষ খোদা ছাড়া আর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? আপনার শেষ জীবনের কথা ভাবলে আমার সেই গজলের কথাই মনে পড়ে :
য়া রব, জমানা মুঝকো মিটাতা হৈ কিসলিয়ে
লওহ্-এ জহাঁ-পে হর-এ মুকরর নহি হু মৈ।
(হে ঈশ্বর, কাল আমাকে মুছে ফেলছে কেন?
পৃথিবীর পৃষ্ঠার ওপর আমি বাড়তি হরফ তো নই।)
কিন্তু এভাবে, প্রায় না-খেতে পেয়ে, রোগে ভুগতে ভুগতে, অন্ধ হয়ে মুছে যাওয়াই কি আপনার নিয়তি ছিল?
আপনার জীবনের কথা ভাবলে, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা ধুলোর ঝড়। ঘোড়ার পিঠে চেপে তারা আসছে নদী পেরিয়ে আসছে সমরখন্দ থেকে। সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে তাদের হাতের ঘুরন্ত তরবারি। কত দূর দূর প্রান্তর পেরিয়ে, কত হত্যা ও রক্তপাতের কারবালা পেরিয়ে তারা আসছে ভারতবর্ষের দিকে। মনে হয় যেন স্বপ্নে দেখছি, নাকি সিনেমার পর্দায়? ওই আপনার পূর্বপুরুষেরা, তাদের সারাদিন কেটে যায় ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে, পথে কোনও জনপদ পড়লে চলে খুন, লুঠতরাজ, তারপর রাতে মরুভূমিতে তাঁবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম। জ্বালানো হয়েছে আগুন, ঝলসাচ্ছে মাংস, বেজে উঠছে রবাব বা দিলরুবা। দূরে বসে কেউ একা একা মরুভূমির বেদুইনদের গান গাইছে, নিঃসীম আকাশের জন্য। কোনও কোনও তাঁবুতে লুঠ করে আনা মেয়েদের নিয়ে জমে উঠেছে শরীরের উৎসব। সৈনিক পূর্বপুরুষদের নিয়ে আপনার গর্ব কিছু কম ছিল না মির্জা সাহেব; নিজে হাতে অবশ্য কখনও তরবারি ধরেননি। গর্ব থাকলেও মনে মনে জানতেন, অন্যের প্রাণ নেওয়া আর নিজের প্রাণ দেওয়া ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছু ছিল না। মাঝে কিছু নারীসঙ্গ, সুরা আর ক্ষমতার দম্ভ। আমি জানি, এই সৈনিক পূর্বপুরুষদের জীবন ছিল আপনার কাছে স্বপ্নের মতো। দু’জন গালিব আছে, আপনি একবার বলেছিলেন, একজন সেলজুক তুর্কি, সে বাদশাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, আর অন্যজন হা ঘরে, মাথায় ঋণের বোঝা, অপমানিত। বাদশাদের সঙ্গে মেলামেশা করা, তুর্কি সৈনিকদের উত্তরাধিকারী গালিব ছিল আপনার স্বপ্নের গালিব। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যে যখন সূর্য পাটে বসতে বসেছে, তখন সেই স্বপ্নের গালিবককে আপনি খুঁজে পাবেন কোথায়? আর নিয়তিও তত ছিল, আপনার নিজস্ব নিয়তি, যা আপনার জীবনে কবিতার বীজ বুনে দিয়েছিল। একজন ফরাসি কবি যাঁবো বলে ছিলেন, ‘I am the other’. আপনি তো সেই ‘other’ -কে সঙ্গে করে জন্মেছিলেন। তাকে তো ঘেয়ো কুকুরের মতোই মরতে হয়।