আমার উর্দু শিখতে আসার কারণ শুনে অবাক হয়ে গেল তবসুম। শুধু একটা উপন্যাস পড়ার জন্য উর্দু শিখবেন? আর কিছু করবেন না?
-আর কী করব?
-আপনি লেখেন শুনেছি। গজলও লিখতে পারেন।
-গজলের দিন শেষ হয়ে গেছে।
-গজলের দিন কখনও শেষ হবে না। আয়নার তবসুমের দিকে তাকিয়ে আমি তার কথা শুনি। গজলের দিন কখনও শেষ হবে না, তার এই কথা যেন একটা মেঘপ্রবাহের মত ভেসে যায়।
-এই গজলটা জানেন? তবসুম বলতে থাকেঃ
গলি তক্ তেরি লায়া থা হর্মে শওক্
কহাঁ তাকত কেহ্ ফির জায়ে ঘর তক।
শব্দগুলো তবসুমের গলা থেকে ঝরনার মত ছড়িয়ে পড়ে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘কার গজল জানেন?’
-কার?
-মীর। মীর তকি মীর। মীরসাব কি বলছেন দেখুন। তোমার ঘরের দুয়ার পর্যন্ত তো টেনে এনেছিল আমার বাসনা, এখন শক্তি কই যে নিজের ঘরে ফিরে যাই? এরপরও বলবেন, গজলের দিন শেষ হয়ে গেছে?
-তবু
-বাদ দিন, এসব নিয়ে তর্ক চলে না। আপনার উপন্যাসটার কথা বলুন।
আমি কোন্ উপন্যাস পড়তে চাই, কার লেখা, কাকে নিয়ে লেখা, কীভাবে পেলাম এই উপন্যাস, সব কথা মাথা নীচু করে শোনে তবসুম। তাঁর এই শোনার মধ্যে একধরনের ধ্যানের মুদ্রা আছে। এই শহরের অধিকাংশ মানুষদের মতো নয় সে, যারা শুনতে ভুলে গেছে, আর তাই অপেক্ষা শব্দটাই তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমার সব কথা শোনবার পর অনেকটা নীরবতা ঘনিয়ে উঠতে দিয়ে সে ধীরে ধীরে বলে, ‘হঠাৎ এই উপন্যাসটা পড়ার ইচ্ছে হল কেন?’
-মান্টো আমার প্রিয় লেখক। তিনি যে উপন্যাস লিখেছেন, জানতাম না, তাও মির্জা গালিবকে নিয়ে।
-গালিবও আপনার প্রিয়?
-হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী, আমি অনেকদিন ধরে মির্জা গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি।
-কবে লিখবেন?
-দেখি। আমার খুব তাড়াতাড়ি কিছু হয়ে ওঠে না। যদি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতাম, তা হলে সহজেই লিখে ফেলা যেত। কিন্তু আমি—
তবসুম কোনও কথা বলে না, আমিও না। আয়নার ভিতরে আমাকে ও তবসুমকে দেখতে থাকি আমি।
এরপর আমার উর্দু শিক্ষা শুরু হয়েছিল। আলিফ… বে… পে… তে.। সে আমার হাত ধরে ধরে লেখা শিখিয়েছে, হয়তো কখনও বলে উঠেছে, বাঃ! কত সহজে আপনি লিখতে পারেন।’ কিন্তু একদিন আমি ঘোষণা করে দিলাম, এই বয়েসে শেখার ধৈর্য ও অভিনিবেশ আমার নেই।
অনেক তর্কাতর্কির পর তবসুম বলেছিল, ‘আমি জানি, আপনি কিন্তু পারতেন। আমার প্রস্তাব তবসুম মেনে নিয়েছিল। সে উপন্যাসটা পড়ে মুখে মুখে অনুবাদ করে যাবে আর আমি লিখে নেব। তবসুমের বিয়ের বেশ কিছুদিন পর থেকে আমি রোজ সন্ধ্যায় তার কাছে যেতে থাকি। তবসুমের উচ্চারণে মান্টোর গালিবকে নতুন করে আবীস্কার করতে থাকি এবং বাধ্য লিপিকরের মতো একটা হারানো, অপ্রকাশিত উপন্যাস বাংলায় লিখতে থাকি।
তবসুমের বলা মান্টোর উপন্যাসের অনুবাদ লিখতে লিখতে আমি একসময় বুঝে যাই, মির্জা গালিবকে নিয়ে আমি কখনও উপন্যাস লিখতে পারব না।
এরপর আপনারা যা পড়বেন, তা মির্জা গালিবকে নিয়ে মান্টোর উপন্যাসের অনুবাদ। মাঝে মাঝে আমি ও তবসুম ফিরে আসতেও পারি।
০২. ভূমিকা – এই দস্তান কে লিখছে
০২. ভূমিকা
এই দস্তান কে লিখছে? আমি, সাদাত হাসান মান্টো, না আমার ভূত? মান্টো সারা জীবন একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। মির্জা মহম্মদ আসদুল্লা খান গালিব। আব্দুল কাদির বেদিলের একটা গজল মির্জার খুবই প্রিয় ছিল, মাঝে মাঝেই দু’টো লাইন বলে উঠতেন। আমার গল্প সারা পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হয়, কিন্তু আমি তো একটা শূণ্যতা। বেদিল যেন মির্জার কথা ভেবেই লাইন দু’টো লিখেছিলেন। আমার কথাও কি ভেবেছিলেন?
আমার সবসময়েই মনে হয়েছে, মির্জা আর আমি যেন মুখোমুখি দু’টি আয়না। সেই আয়না দু’টোর ভিতরে শূণ্যতা। দুই শূণ্যতা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শূন্যতারা কি কথা বলতে পারে নিজেদের মধ্যে?
আমি কতদিন মির্জার সঙ্গে একা একা কথা বলেছি। মির্জা চুপ করে থেকেছেন। কবরে শুয়ে থেকে কীভাবেই বা কথা বলবেন আমার সঙ্গে? কিন্তু এখন, এত বছর অপেক্ষা করার পর আমি জানি, মির্জা এবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমিও আমার কবরে গিয়ে ঢুকেছি। ১৯৪৮-এ পাকিস্থানে আসার পর থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, এবার আমার কবর আমাকে খুঁড়তে হবে, যাতে তাড়াতাড়ি মাটির গভীরের অন্ধকারে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারি। আমার কবরের ফলকে লেখা থাকবেঃ ‘সাদাত হাসান মান্টো এখানে চিরনিদ্রায়। তার সঙ্গে সঙ্গে গল্প লেখার সব। রহস্যও কবরে চলে গেছে। টন টন মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে সবচেয়ে বড় গল্প লেখক, মান্টো না আল্লা’? ওরা তো জানে না, খোদার পাগলামি মাথায় নিয়ে মান্টো এসেছিল বলেই। সারা জীবন ধরে গল্পরা মান্টোকে খুঁজে ফিরেছে। মান্টো কখনও গল্পদের খুঁজতে যায়নি।
মির্জা এবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন, আমরা কথা বলে যাব অনর্গল, মির্জা যা সারা জীবন। কাউকে বলতে পারেননি, আমি যে কথা কাউকে বলতে পারিনি, সব- সব কথাই এবার আমরা বলব, কবরের ভিতর শুয়ে শুয়ে। মির্জা শুয়ে আছেন, সেই দিল্লীতে, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে সুলতানজির কবরে, আর আমি লাহোরের মিঞাসাহেতার কবরে। একসময় তো একটাই দেশ ছিল, ওপরে যতই কাঁটাতারের বেড়া থাকুক, মাটির গভীরে তো একটাই দেশ, একটাই পৃথিবী। মৃতের সঙ্গে মৃতের কথাবার্তা কেউ আটকাতে পেরেছে?