-তাই তো। মান্টোসাবের স্বপ্নের দস্তান। আপনি নিয়ে যান, দেখুন ছাপতে পারেন কি না।
-উর্দুতে কেউ ছাপবে না?
-কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। আমি আর কতদিন বইব, বলুন। কবে আছি, কবে নেই। তারপর তো একেবারে হারিয়ে যাবে। ফরিদ মিঞা আমার দুই হাত চেপে ধরেন।
-আমাকে এই দস্তানের হাত থেকে রেহাই দিন। আমাকে সবাই এখন পাগল বলে। বলে, কিস্সা আমাকে খেয়ে নিয়েছে।
মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা মান্টোর অপ্রকাশিত উপন্যাস, আসল কি নকল আমরা কেউই জানি না, আমার সঙ্গে এই শহরে এসে পৌঁছল। উর্দু জানি না, তাই এমনি এমনি মাঝে মাঝে পাণ্ডুলিপিটা দেখি। সত্যিই মান্টোর লেখা, না অন্য কারোর? তারপর একদিন মনে হল, আমরা সবাই যদি কারও দেখা স্বপ্ন হই, তা হলে স্বপ্নের গালিবকে নিয়ে একজন স্বপ্নের মান্টো উপন্যাস লিখতেই পারেন। এখানে সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে?
উপন্যাসটা পড়ার জন্যই আমাকে উর্দু শেখার কথা ভাবতে হল। আমার বন্ধু উজ্জ্বল একজন শিক্ষিকা ঠিক করে দিলেন। তার নাম তবসুম মির্জা। আমি তার কাছে শিখতে যাওয়া শুরু করে কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝলাম, নতুন করে ভাষা শেখার মতো ধৈর্য ও অভিনিবেশ আমি হারিয়ে ফেলেছি। একদিন তবসুমকে বলেই ফেললাম, ‘উর্দু শেখাটা এ-জীবনে আমার আর হবে না।’
তবসুম বলল, ‘তা হলে উপন্যাসটি পড়বেন কী করে?
-আপনি যদি পড়ে পড়ে অনুবাদ করে দেন, আমি লিখে নেব।
-আমি কোথাও কোথাও ভুলও তো করতে পারি। আপনি বুঝবেন কী করে?
-ভুল ছাড়া কিছু হয় কি তবসুম?
-কেন?
-ভুল করেই তো আমি আপনার কাছে উর্দু শিখতে এসেছিলম।
-তার মানে?
কয়েকদিন পরেই আপনার নিকাহ্। জানলে তো আসতাম না। বিয়ের পর আপনি মুখে মুখে অনুবাদ করে যাবেন, আমি লিখে নেব। জীবন একরকম অনুবাদ, জানেন তো তবসুম? তবসুমের চোখদুটো বাতিঘরের ঘূর্ণায়মান আলোর মতো আমাকে কাটছিল।
এক বৃস্টি ঘনঘোর সন্ধ্যায় আমি তবসুমের কাছে উর্দু শেখার জন্য প্রথম গিয়েছিলাম। দীর্ঘ, অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তবসুমের বাবার নাম করে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িটা কোথায়?
-কার কাছে যাবেন?
তবসুমের বাবার নাম বললাম।
দোকানি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সাব তো মর গিয়া। আপনি জানেন না?’
-তবসুম মির্জা—
-উসকা লেড়কি। দোকানি হেঁকে ওঠেন, আনোয়ার, সাব কো কোঠি দিখা দে।
আনোয়ারের পিছন পিছন হেঁটে আমি একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। নিঝুম দোতলা বাড়িটা বৃষ্টিতে ভিজছে। আনোয়ার দরজা ধাক্কাতে থাকে। একসময় দরজা খুলে যায়, কিন্তু কাউকে দেখা যায় না, শুধু কথা শোনা যায়, কওন হ্যায়?
-ম্যায় আনোয়ার হুঁ, সাব।
-কী হয়েছে?
-মেহমান, সাব।
বৃষ্টির ভিতরে একটা মুখ ডেকে ওঠে। ‘কে? কে-রে আনোয়ার?’
আনোয়ার আমার মুখের দিকে তাকায়।
-তবসুম মির্জা আছেন? আমি সেই দেখা-না -দেখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলি।
-কী দরকার?
-আমার আসবার কথা ছিল।
-স্টুডেন্ট?
-হ্যাঁ।
আসুন-চলে আসুন আগে বলবেন তো—
আমি ভিতরে ঢুকে পড়ে আরও ভিজে যেতে থাকি। এই বাড়ির মাঝের খোলা চত্ত্বরের ওপর উন্মুক্ত আকাশ। যে আমাকে ডেকেছিল, তাঁকে দেখতে পাই না, কিন্তু সে চিৎকার করতে থাকে, ‘তবসুম দরজা খোল্-দরজা খো তবসুম-স্টুডেন্ট-স্টুডেন্ট—‘
দরজা খুলে যায়। বৃষ্টিছায়া ও অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে, তবসুম, আমার শিক্ষিকা, তার মাথায় ঘোমটা। গভীর রাতের ট্রেনের হুইসলের মতো তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আসুন আসুন-এত বৃষ্টি-ভেবেছিলাম আপনি আর আসবেনই না।’
বৃষ্টির জলে আমার জুতোকে ভিজতে দিয়ে তরমুজের মতো একফালি বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি। ছোট ঘরে বিরাট এক পালঙ্ক, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ-হয়তো দু-তিন পা হাঁটা যায়।
-চা খাবেন তো?
-না-না–
-এত বৃষ্টিতে ভিজে এলেন।
-তাতে কি?
-বসুন, আগে একটু চা খেয়ে নিন।
তবসুম পাশের ছোট বারান্দায় চা বানাতে চলে গিয়েছিল। ভাবছিলাম আমি একটা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি। তবায়েফদের খোঁজে লখনউ গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম সাদাত হাসান মান্টোর অপ্রকাশিত উপন্যাসের সঙ্গে আর সেই উপন্যাস পড়বার জন্য প্রস্তুত হতে আমাকে হাজির হতে হল মধ্য কলকাতার অন্ধকার গলিতে তবসুম মির্জার ঘরে। কী আশ্চর্য, আমার আগে খেয়াল হয়নি, মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়বার জন্য উর্দু শিখতে আমি এসেছি তবসুম মির্জার কাছে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি একটা রাক্ষুসে আয়নার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। খেয়ালই করিনি, দেওয়াল থেকে ঝুলছিল প্রায় চারফুট লম্বা একটা আয়না, তার ফ্রেম কারুকাজ করা সেগুন কাঠের, মহার্ঘ বেলজিয়ান কাচ, যার ভিতরে পুরো ঘরটাই প্রায় ঢুকে পড়েছে,আর সেই ঘরের ভিতরে আমি, আমার দিকে নিমেষনিহত তাকিয়ে আছি। আয়নাটা যেন তার দিকে আমাকে টানছিল। এই ঘোর কাটল চায়ের কাপ নিয়ে তবসুম ঘরে আসায়।
-কী দেখছিলেন? তবসুমের ঠোঁটের কোণে ফালিচাঁদের হাসি।
-আয়নাটা, কোথায় পেলেন?
-আয়নাটা কার ছিল জানেন?
-কার?
-ওয়াজিদ আলি শাহর এক বেগমের।
-এখানে এল কী করে?
-আমার দাদা-দাদা জানেন তো-বাবার বাবা এনেছিলেন।
আমি আয়নার দিকে ফের তাকালাম। ওয়াজিদ আলি শাহ’র সেই বেগম এখন কোথায়? আয়নার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় ঘোমটা দেওয়া তবসুম মির্জা।