-জানি।
-তা হলে?
-আমি তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি।
-কেন?
-আপনি কে?
-আমি মিঞার নোকর হুজুর। মিঞা আবার পাগল হয়ে যাবেন।
-কেন?
-আবার একা একা কথা বলবেন।
-কেন?
-কিস্সার কথা তুললেই—
ভিতর থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতেই কালো লোকটি ‘এবার চলে যান, হুজুর’ বলে দৌড়ে পালাল। আমার চোখে আবার সেই মৎসকন্যার শরীরে ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগল। একটু পরেই ফরিদ মিঞা পর্দা সরিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পরিতৃপ্তির আলো তাঁকে ঘিরে আছে, আমার মনে হল। একটু আগেও তাঁকে বেশ অস্থির মনে হয়েছিল। তিনি বুকের কাছে ধরে রেখেছেন নীল মখমলে মোড়া একটা পুঁটুলি। সেইরকম নামাজ আদায়ের ভঙ্গিতেই বসলেন। তিনি, যেন এক সদ্যোজাত শিশুকে শোয়াচ্ছেন তেমন ভাবেই পুঁটুলিটি রাখলেন ফরাসের ওপর। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।-এবার আপনাকে আমি যা দেখাব, মনে হবে খোয়াব দেখছেন।
কী খোয়াব দেখাবেন আমাকে ফরিদ মিঞা? স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো আমি এই পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এলাম। আর আমি এও জানি যে, আমাদের এই জীবন, যাকে বাস্তব জীবন বললে। বেশির ভাগ মানুষ খুশি হয়, তাও অন্য আরেকজনের দেখা স্বপ্ন। তখন মনে হয়, আমি একটা। ছবি মাত্র, যে ভেসে উঠেই হারিয়ে গেছে। কে যেন একজন প্রজাপতির স্বপ্ন দেখেছিল। জেগে উঠে তার মনে হয়েছিল, আসলে কি প্রজাপতিটাই তাঁকে স্বপ্ন দেখেছিল।
মখমলের আবরণ খুলতেই একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি জেগে উঠল আলোয়। কোথাও কোথাও পোকায় কাটা। পাণ্ডুলিপিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই কবিতাটা মনে পড়ল আমার।
আমি তো ওই নদীর ওপার থেকেই এসেছিলাম
বিশ্বাস না হলে অপ্রকাশিত
উপন্যাসকে জিজ্ঞাসা করো তার মাংস খুঁটে
খাওয়া রুপোলি পোকাদের জিজ্ঞাসা করো
আর আরশোলার বাদামী ডিমদের,
জিজ্ঞাসা করো পাণ্ডুলিপির শরীরে উইয়ে
কাটা নদীদের সেই সব নদীরা, যারা
মোহনায় পৌঁছানোর আগেই মরে যায়
কে লিখেছিল কবিতাটা? অনেক ভেবেও তার নাম মনে পড়ল না। নিশ্চয়ই মনে পড়ার মতো বিখ্যাত সে ছিল না। সে হয়তো এমন একজন কবি, কবিতার মধ্যে যে শুধু আমাদের জীবনের ক্ষতচিহ্নগুলি এঁকে রাখে, তারপর একদিন অনায়াসে হারিয়েও যায়।
পাণ্ডুলিপিটাকে ফরিদ মিঞা শিশুর মত আদরে দু’হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন।
মানুষ যেভাবে পুরোহিতের হাত থেকে অঞ্জলির ফুল নেয়, সেভাবেই তাঁর কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিলাম। খর খর শব্দ পেলাম। পাতারা কি এই সামান্য স্পর্শেও ভেঙে যাচ্ছে? ফরাসের ওপর পাণ্ডুলিপিটা রেখে পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করলাম। উর্দুতে লেখা; এই ভাষা তো আমি বুঝি না। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টে আমি স্থির হয়ে যাই, লিপির সৌন্দর্য আমাকে সম্মোহিত করে রাখে। শুধু বুঝতে পারি, হারিয়ে যাওয়া অনেক সময় এখন আমাকে ছুঁয়ে আছে। একসময় ফরিদ মিঞাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কার পাণ্ডুলিপি?’
-সাদাত হাসান মান্টোর। আপনি নাম জানেন?
পাণ্ডুলিপির ওপর আমি ঝুঁকে পড়ি। আমার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, সাদাত হাসান মান্টো!
-কিস্সারা তাঁকে খুঁজে বেড়াত।
-আপনি কী করে পেলেন?
-এন্তেকালের কিছুদিন আগে আব্বাজান আমাকে দিয়ে যান। তাঁর কাছে কীভাবে এসেছিল বলেননি।
-কী লিখেছেন মান্টো?
-দস্তান। আপনারা যাকে নভেল বলেন। তবে কী জানেন, দস্তান ঠিক নভেল নয়। দস্তানের গল্প শেষ হতেই চায় না, আর নভেলের তো শুরু শেষ থাকে।
-কিন্তু মান্টো তো নভেল লেখেন নি।
-এই একটাই লিখেছিলেন।
-তা হলে ছাপা হয় নি কেন?
-কেউ যে বিশ্বাস করতে চায় না। আমি কতজনকে বলেছি। অনেকে হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে বলেছেন, এ ঠিক মান্টোসাবের হাতের লেখা নয়। কিন্তু উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর জীবনের সব কথা মিলে যায়। আপনি দেখবেন, ছাপা যায় কি না?
-আমি?
-আপনি তো আখবারে কাজ করেন। দেখুন না। মান্টোসাবের লেখা এভাবে পোকায় কাটতে কাটতে শেষ হয়ে যাবে?
আমি পাণ্ডুলিপির শরীরে হাত বোলাতে থাকি। আমার সামনে সাদাত হাসান মান্টোর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি? বিশ্বাস হয় না। তবু আমি পাণ্ডুলিপিকে ছুঁয়ে থাকি। এই তো সেই কাহিনী-লেখক, তাঁর কবরের ফলকে লিখতে চেয়েছিলেন, কে বড় গল্প লেখক, খোদা না মান্টো?
-আপনি পড়েছেন? আমি জিজ্ঞেস করি।
-আলবৎ। কতবার পড়েছি মনে নেই।
-কী লিখেছেন মান্টোসাব?
-মির্জা গালিবকে নিয়ে। মির্জাকে নিয়ে উপন্যাস লেখার খোয়াব দেখতেন মান্টোসাব। মির্জাকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিল বম্বেতে। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন মান্টোসাবই। আপনি জানেন?
-না।
-মান্টোসাব তখন বম্বেতে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখেন। গালিবকে নিয়ে তাঁর লেখা ছবিটাই হিট করেছিল। তবে দুঃখের কথা, ফিল্মটা যখন তৈরী হল, মান্টোসাব তখন ইন্ডিয়া থেকে। পাকিস্থানে চলে গেছেন। মির্জা গালিবের সেই প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুরাইয়া বেগম। ফিল্মটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল। প্রথম হিন্দি ফিল্মের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া, বুঝতে পারলেন? মির্জাকে সারা জীবন মান্টোসাব ভুলতে পারেননি। মির্জার গজল তাঁকে পাগল করত, মির্জার জীবনও। কত যে মিল দু’জনের মধ্যে। মির্জার গজল তাঁর মুখে মুখে ফিরত।
-এই উপন্যাস তাহলে পাকিস্থানে লিখেছিলেন?