-চুপ করো। বাজে কথা বলে আমাদের ভুলিও না। গাছ আমরাও দেখেছি, কিন্তু সব স্বপ্ন। ওতে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বাস্তবে ফিরতে চাই।
-বাস্তব? কী বাস্তব? খিদে, তৃষ্ণা, প্রখর রৌদ্র? গাছে এত ফল ফলে আছে, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না?
-না সমুদ্রের ওপারে ভালো জায়গা আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাব।
দাকুকি বিহ্বল হয়ে বসে রইল। সে ভাবছিল, আমিই কি তা হলে পাগল? এতগুলো লোক তো ভুল কথা বলতে পারে না। তারপর সে একটা গাছকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার কানে কানে বলল, আমি কুরবাক, তুমি তো জানো। শুকনো বুদ্ধির চেয়ে আমার সজল পাগলামি তোমার ভাল লাগে না?
হঠাৎ ছটি গাছ এক সারিতে এসে দাঁড়াল আর একটি গাছ তাদের সামনে যেন ইমামের মতো প্রার্থনায় মগ্ন হল। ধীরে ধীরে সাতটি গাছ মানুষ হয়ে গেল। তারা সমস্বরে ডাকল, দাকুকি।
-আমার নাম আপনারা জানলেন কী করে?
-যে হৃদয় আল্লাকে খোঁজে, তার কাছে কিছু গোপন থাকে না দাকুকি। আমাদের একটাই হৃদয়। আল্লার হৃদয়। আলাদা করে কোন হৃদয় খুঁজো না দাকুকি। এসো, এবার আমাদের নামাজ পড়াও।
-আমি কিছু জানি না। গাধারও অধম আমি।
-তোমার মতো পবিত্র গাধা সবার চেয়ে ওপরে।
শেখের স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমার বেটাদের সঙ্গে কোথায় আমার দেখা হবে, বলুন।
-আরও অপেক্ষা করো বিবিজান।
-দাকুকির কী হল বেটা? শেখের মা জিগ্যেস করে।
-নামাজ পড়তে পড়তে দাকুকির কানে ভেসে আসছিল বহু মানুষের আর্ত চিৎকার। দাকুকি চোখ খুলে দেখল, চাঁদের আলোয় উত্তাল হয়ে উঠেছে সামনের সমুদ্র। ঢেউয়ের ওপর খড়কুটোর মতো উথালপাথাল খাচ্ছে সেই জাহাজ। গ্রামের সব মানুষরা রয়েছে জাহাজে। তারা চিৎকার করছে, বাঁচাও…রহম করো খোদা..আমাদের বাঁচাও..। হঠাৎ জাহাজ দু-ভাগ হয়ে ভেঙে গেল
-সবাই মরে গেল বেটা?
-দাকুকির চোখ থেকে তখন অঝোর ধারায় জল ঝরছে। সে আকাশের দিকে দু-হাত তুলে প্রার্থনা করছিল, খোদা, ওদের বাঁচাও, ওদের অজ্ঞানতাকে ক্ষমা করো, ওদের চোখ খুলে দাও, তোমার জন্নতের পথে নিয়ে চলো।
বলতে বলতে শেখ কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার মা পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল, মানুষগুলো বেঁচেছিল তো, বেটা?
-হ্যাঁ, সমুদ্র শান্ত হল। ওরা সাতার কাটতে কাটতে তীরে এসে পৌঁছল।
অনেকদিন পর শেখের বউ এক টুকরো রুটি চিবোতে চিবোতে জল খেল।
-তারপর? শেখের মা জিগ্যেস করল।
-সেই সাতজন মানুষ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। খোদার ওপর খোদকারিটা কে করল হে? দাকুকি ছাড়া তো আর কেউ নয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
দাকুকিও আবার পথে পথে ঘুরতে শুরু করল, তার এতদিনের সাতজন সঙ্গীকে খুঁজে পেতে।
পথ চলতে চলতে একদিন কুয়োর ভিতরে তাকিয়ে পূর্ণচন্দ্রের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল সে। আমন্দে আত্মহারা হয়ে সে গান গাইতে লাগল, নাচতে শুরু করল। হঠৎ মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদকে। হারিয়ে গেল প্রতিবিম্ব। কুয়োর পাশে অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে দাকুকি উঠে বসল। চিৎকার করে বলতে লাগল, আহম্মক! আমি একটা আহম্মক। এখনও প্রতিবিম্ব দেখে ভুলে। যাই। আল্লা তো বাতি ছাড়াও আলো দেন। সাতটা লোককে কেন এখনও খুঁজছি আমি? আর কতদিন বাইরের রূপ আমাকে ভুলিয়ে রাখবে? খোদা একমাত্র তোমাকে স্মরণ করার শক্তি দাও আমাকে।
দস্তানগোর নীরবতা ভেঙে কালু উত্তেজিত হয়ে বলে, তারপর?
-তারপর আবার কী?
-দাকুকির কী হল?
-শেখের বাড়িতে সবাই নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল। দাকুকি আবার হাঁটতে শুরু করল।
-দাকুকি এবার কোথায় যাবে?
-কোথায় আবার যাবে? আমার ঝোলায় ছিল, ঝোলাতেই আবার ফিরে এসেছে। বলতে বলতে দস্তানগো তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা কাঠের পুতুল বের করে আনে। দ্যাখো মিঞা, এই হল দাকুকি।
-আর কে কে আছে তোমার ঝোলায় মিঞা?।
-দ্যাখো তবে-এটা কে, চিনতে পারো?
-হুজুর-মির্জাসাব—
-আর একে চিনতে পারো?
-জাঁহাপনা বাহাদুর শাহ।
-এইটে?
কাল্লু লাফিয়ে ওঠে, মান্টোভাই-আপনি-আপনি-আপনিও কাঠপুতলি হয়ে গেছেন?
দস্তানগো তার ঝোলা থেকে একের এক কাঠের পুতুল বের করে মসজিদের চত্বরে সাজিয়ে দিতে থাকে। আমি অবাক হয়ে দেখি, এরা সবাই আমার দোজামা উপন্যাসের চরিত্র। রঙিন পুতুলগুলো আলোয় ঝলমল করতে থাকে। ইতিহাসের ধুলোবালিতে ওরা মলিন হয়ে যায়নি।
হে আমার দোসর পাঠক, এবার মান্টোকে বিদায় দিন। খুদা হাফিজ।
.
তবসুম, মান্টোর উপন্যাস শেষ হওয়ার পর থেকে মিঞা তানসেনের জীবনের একটা আশ্চর্য ঘটনা মনে পড়ছে। মিঞা ছিলেন ভৈরব রাগে সিদ্ধ। শুধু জাঁহাপনা আকবরের ঘুম ভাঙার সময় এই রাগ আলাপ করতেন। জাঁহাপনার কাছে তানসেনের জায়গা ছিল সব উস্তাদের ওপরে। অন্যান্য উস্তাদরা তাই তানসেনকে ঈর্ষা করতেন। একবার তারা যুক্তি করে। তানসেনের জীবননাশের উপায় ভাবলেন। তারা বাদশাকে গিয়ে বললেন, জাঁহাপনা, আমরা কখনও দীপক রাগ শুনিনি। এবার শুনতে চাই। মিঞা তানসেন ছাড়া এই রাগ তো কেউ জানেন না। বাদশা তো আর উস্তাদদের অভিসন্ধি জানেন না। তিনি তানসেনকে বললেন, মিঞা, আমার দীপক রাগ শোনার খুব ইচ্ছে হয়েছে। আপনি শোনাবেন? তানসেন বললেন, জাঁহাপনা ওই রাগ শোনালে আমার মৃত্যু হবে।
-কেন?
-আপনি তা বুঝবেন না।
-একটা রাগ গাইলে কখনও মৃত্যু হতে পারে?