-আমার বুক খালি হয়ে গেছে শেখ। আপনার সুন্দর সুন্দর কথায় তা ভরবে না। শেখের বিবি কাঁদতে কাঁদতে নিজের বুকে আঘাত করতে থাকে।
শেখের মা বলে, তুমি যে চোখের কথা বলছ, আমরা তা বুঝি না, বেটা, কথা দিয়ে আমাদের ভুলিও না। শেখ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। মা-বিবির প্রতি প্রাথমিক বিরক্তি কেটে গিয়ে দুঃখে মন ভরে উঠল তার মন। ওদের শোক দূর করার ক্ষমতা তার নেই। ওরা তো বিচ্ছেদকেই সত্য। বলে মেনে নিয়েছে। শেখ তখন একটা গল্প বলতে শুরু করল।-একটা মেয়ের কথা শোনো। তার যত সন্তান জন্মেছিল, জন্মের কয়েকমাস পরেই তারা মারা গিয়েছিল।
-আমাদের ছেলেরা তো কয়েক বছর বেঁচে ছিল। তার মা বলে ওঠে।
-আর মেয়েটা? শেখের বিবি জিজ্ঞেস করে।-ও নিশ্চয়ই শোকে মারা গিয়েছিল। আমিও তো মরতে চাই-কেন তবু মৃত্যু আসে না।
-মেয়েটার কুড়িটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল। দুটো নয়, কুড়িটা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত আর খোদাকে অভিশাপ দিত। একদিন রাতে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
-কী?
-স্বপ্নের ভেতর মেয়েটা মরুভূমি পেরিয়ে যাচ্ছিল। ওর পেট থেকে রক্ত ঝরছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে বালি। ও একটা ছোট্ট দরজার কাছে এসে পৌঁছল। দরজা পেরিয়ে মাতৃগর্ভের মতো সরু পথ ওকে পৌঁছে দিল এক আশ্চর্য দুনিয়ায়। সেখানে অনন্ত জীবনের ঝরনা আর বাগানের মধ্য দিয়ে বইছে জন্নতের নদী। সেই বাগানের গাছেরা কখনও মরে না। বাগানটা কেউ কখনও চোখে দেখেনি। যারা বিশ্বাস করে, এমন বাগান আছে, তারাই শুধু দেখতে পায়। সব আনন্দের উৎসব এই বাগানেই।
শেখের বিবির চিৎকার করে ওঠে, সব আপানার খোয়াব, এমন বাগান কোথাও নেই।
-এই বাগানের কোন নাম নেই, তার রূপ বর্ণনা করা যায় না। তবু সে এই দুনিয়াতেই আছে, বিবিজান।
-মেয়েটার কী হল, বলুন। এতগুলো সন্তান হারিয়ে বাগানে গিয়ে সে কী পেল?
-জন্নতের নদীতে গিয়ে সে নামল। সঙ্গে তার সব দুঃখ, সন্দেহ ময়লার মতো মিলিয়ে গেল। স্নান করতে-করতে সে তার সন্তানদের হাসি শুনতে পেল। সত্যিই, বিশ্বাস করো, কুড়িটি সন্তান তার চারপাশে সাঁতার কাটছিল, হাসছিল। আনন্দে উৎসব জেগে উঠল মেয়েটির হৃদয়ে।
-তাহলে আমাকে নিয়ে চলুম সেখানে। বলুন, কী করে যাব?
-ফকিরদের কথা ভাবো, বিবিজান। তাদের জীবনে যা ঘটে, তা নিয়ে কোনও অভিযোগ তাদের নেই। আল্লা যা নিয়েছেন, তার চেয়েও অনেক বেশী দেবেন। ফকিররা আল্লার কাছে কিছু চান না। তিনি যে পথে নিয়ে যাবেন, সেই পথেই যেতে হবে।
-আমরা কী করে এই কঠিন পথে যাব?
-সহজ নয়। এমনকি দাকুকিরও সন্দেহ হয়েছিল।
-দাকুকি কে?
-তবে সেই পথিকদের গল্প শোনো, যারা পথের সব ঘটনাকেই মেনে নেয়।
-বলো বেটা, তোমার গল্প শুনে বুকের ভিতরটা অনেক হাল্কা লাগছে। শেখের মা বলতে বলতে রুটি খেতে শুরু করল।
-দাকুকি এক তীর্থযাত্রী। সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলেছে, কারুর কাছে, কোনও জায়গায় সে আটকে পড়ত না।
-আশ্চর্য! এমন মানুষ হয় না কি?
-তবে একটা টান তার ছিল।
-সন্তানদের প্রতি? শেখের স্ত্রী বলে ওঠে।
-না। ফকিরদের প্রতি। সে যে কী অমোঘ টান। ফকিরদের মধ্যেই সে বিন্দুতে সিন্ধু দেখতে পেত। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে আছেন খোদা, ফকিররাই তাকে জানিয়েছিল। ফকিরদের খোঁজে কোথায় কোথায় না ঘুরে বেড়াত দাকুকি। পথ চলতে চলতে তার পা থেকে রক্ত ঝরত। কেউ যখন বলত, এমন রক্তাক্ত পায়ে তুমি মরুভূমিতে হেঁটে যাবে কীভাবে, দাকুকি হেসে বলত, ও কিছু নয়।
-তারপর?
-একদিন সন্ধেবেলা দাকুকি এক সমুদ্রসৈকতে এসে পৌঁছল। দাকুকি দেখল, অনেক দূরে তাল গাছের চেয়েও লম্বা সাতটা মোমবাতি জ্বলছে। আলোয় ভরে গেছে চারদিক। দাকুকি সেই মোমবাতির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছল। গ্রামের মানুষরা হাতে আলোহীন প্রদীপ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-কী হয়েছে তোমাদের? দাকুকি একজনকে জিজ্ঞেস করল।
-দেখতে পাচ্ছ না? আমাদের প্রদীপে তেল নেই, পলতে নেই। পেট ভরানোর মতো খাবারও আমাদের গ্রামে নেই।
-আরে ভাই, তাকিয়ে দেখো। আকাশ তো আলোয় ভরে আছে।সাতটা মোমবাতি দেখতে পাচ্ছ না? খোদা তো এমনি-এমনিই আমাদের আলো দেন।
-আলো কোথায়? সারা আকাশ অন্ধকার, আর তুমি আলো দেখেতে পাচ্ছ? পাগল কাহিঁ কা।
দাকুকি লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর চোখ খোলা হলেও আসলে তা সেলাই করা। চারপাশের সবার চোখ একইরকম। ভোলা কিন্তু বন্ধ।
সকাল হতেই সাতটা মোমবাতি হয়ে গেল সবুজ সাতটা গাছ। মরুভূমি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠল, দাকুকি গাছেদের ছায়ায় গিয়ে বসল, ফল পেড়ে খেল। সে দেখল, গ্রামের লোকেরা সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছেড়া জামাকাপড় দিয়ে শামিয়ানা বানিয়েছে। দাকুকি চিৎকার করে গ্রামবাসীদের ডেকে বলল, আরে তোমরা গাছের ছায়ায় এসে বসো। কত ফল হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না? ফল খেলেই তো তৃষ্ণা মিটে যাবে।
-আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গাছ? সব তো মরুভূমি। আমাদের বুরবাক বানাচ্ছ? আমরা আজই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।
-কোথায় যাবে?
-ওই যে সমুদ্রে জাহাজ নোঙর করা আছে, আমরা সবাই সেই জাহাজে চেপে যেখানে খুশি চলে যাব।
-আমার কথা শোনো বন্ধুরা। তোমরা সবাই সবাইকে মিথ্যে দিয়ে ভোলাচ্ছ।