৪৫. হে আমার দোসর পাঠক
হে আমার দোসর পাঠক, মান্টো এবার তার কলম বন্ধ করবে। মির্জাসাব গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। আর কীই বা বলবার আছে তাঁর? শাহজাহানাবাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে-তজীবের মৃত্যু তা একইসঙ্গে মির্জা গালিবেরও মৃত্যু, পরবর্তী বারো বছর তো জীবন্মাতের মতো থেকে যাওয়া। রোগ আর জরার আক্রমণ, হাঁটতে পারেন না, কানে শুনতে পান না, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা, স্মৃতিও দিনে-দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংসস্তূপের কাহিনী আমি আর লিখতে চাই না। এখন শুধু অপেক্ষা সামনের সেই দিনটার জন্য; সেদিন খুদা হাফিজ বলে আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নেব।
তবে কাল রাতের স্বপ্নটা আপনাদের বলে যেতে চাই। আমি জামা মসজিদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ কে যেন এসে আমার হাত চেপে ধরল। মুখ তুলে দেখলাম, কাল্লু।
-এখানে কী করছেন মান্টোভাই?
-তুমি আমাকে চেনো?
-চিনব না? কাল্লু হাসে, কবরে শুয়ে শুয়ে এতদিন মির্জাসাব আর আপনার কত কিস্স শুনলাম
-কবরে?
-আপনিও তো কবরে ছিলেন, মনে নেই?
-আমি তো এখনও মরি নি কাল্লু।
-তাই? কাল্লু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, তা হলে হয়তো স্বপ্ন দেখেছি।
-স্বপ্নে! তুমি তো মরে গেছ কাল্লু।
-তাতে কী মান্টোভাই?
-মরা মানুষ স্বপ্ন দেখে?
-আলবাত দেখে। দুনিয়াময় তামাম খোয়াব ঘুরে বেড়াচ্ছে জানেন? যত মানুষ আছে দুনিয়ায়, খোয়াব তার চেয়ে অনেক বেশী। মুর্দাদের ঘাড়েও ওরা চেপে বসে। আপনি কি কিস্সা শুনতে চান, মান্টোভাই?
-কিস্সা? কে শোনাবে?
-আরে আমি তো রোজই একবার এখানে আসি। একজন না একজন দস্তানগোকে ঠিক পেয়ে যাই। ওই যে দেখুন।
-কে?
-ওই যে লোকটা, কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে, ও ঘুরে ঘুরে তো সবাইকে কিস্মাই শোনায়।
-তুমি কী করে বুঝলে কাল্লু?
-দেখুন না-লোকটা আপন মনে হেসেই যাচ্ছে। কেন জানেন? যাদের পেটে কিস্সা গিজ গিজ করে তারা কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। আসুন-আমার সঙ্গে আসুন।
কাল্লু লোকটার সামনে গিয়ে বসে পড়ে।-মিঞা—
-কে? লোকটা কাল্লুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।-আরে কাল্লু মিঞা—
-তুমি আমাকে চেনো মিঞা?
-তামাম দুনিয়ায় কে তোমাকে চেনে না। শালা কাল্লু কিস্সাখোর।
কাল্লু হা-হা করে হেসে ওঠে। আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, বসে পড়ন, মান্টোভাই, বসে পড়ন।
-তুমি তো বিখ্যাত দেখছি, কাল্লু। আমি হেসে ফেলি।
কম্বল মুড়ি দেওয়া লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিস্সা শোনার মতো কটা লোক আছে, জনাব? শুনতে শুনতে কেউ কান চুলকায়, পোঁদ চুলকোয়, এদিক-ওদিক তাকায়। কিস্সা শোনারও তজ্জীব আছে। খোদাকে যেমন বিশ্বাস করেন, কিস্সাকেও তেমনি বিশ্বাস করে শুনে যেতে হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই -মানুষ খুঁজি- আজকাল কারুর কিস্সা শোনার অবসরই নেই। দুনিয়াটা বড় অশান্ত হয়ে গেছে, জনাব। কেউ বোঝে না, কিস্স শুনতে-শুনতে মনে শান্তি ফিরে আসে।
-মিঞা, তা হলে শুরু করো। কাল্লু উত্তেজিত হয়ে বলে।
-অত তাড়াহুড়ো করো না কাল্লু মিঞা। দিলকেতাবটা একটু উল্টোনোর সময় তো দাও। মন যদি না-ভরে, তেমন কিস্যা শুনিয়ে আমিই বা খুশ হব কী করে?
লোকটা অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকে, নিজের মনে বিড় বিড় করে কথা বলে, অস্ফুট গান গায়, তারপর একসময় হাসতে-হাসতে বলে, আজ শেখের কিস্সাটাই জমবে ভাল। এ হচ্ছে হৃদয়ের ভিতরে যে চোখ আছে, তাকে খোঁজার গল্প।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকে সে, তারপর গল্প শুরু করে।
এক শেখের দুই ছেলেই অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিল। কিন্তু তাকে কখনও কেউ কাঁদতে দেখেনি, সন্তানদের জন্য বিলাপ করতেও শোনেনি। সে রোজ সময়মত ব্যবসার কাজে যেত, কাজ করতে করতে গানও গাইত, বাড়ি ফিরে সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টাও করত। শেখের মা-বিবি তাকে এইরকম দেখে দিনে দিনে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। একদিন শেখ যখন সকালের খাবার খাচ্ছিল, মা হঠাৎ বলে উঠল, বেটা বাড়ির তাজা দুটো ছেলেকে হারিয়ে আমাদের কী অবস্থা তুমি বুঝতে পারো? সবসময় বুকের ভেতরে রক্ত ঝরছে। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। বিবির দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছ? দিনে দিনে চুলের মতো হয়ে যাচ্ছে। তুমি রোজ ঠিকমতো কাজে যাচ্ছ, যেন কিছুই হয় নি..। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে শেখের মা।
তার বিবিও রাগে ফেটে পড়ে, আপনার হৃদয় বলে কিছু আছে? একফোঁটা জলও দেখিনি আপানার চোখে। বাচ্চাদের ভালবাসলে আপনি এইরকম থাকতে পারতেন? যেন কিছুই। বদলায়নি…যেন ওরা এখনও বেঁচে আছে…
-কিছুই বদলায় নি বিবি। ছেলেরা আমার ভেতরেই বেঁচে আছে। আমি তো সবসময় ওদের দেখতে পাই।
-আর আমি ওদের সব জায়গায় খুঁজি। রাতে ঘুমোতে পারি না। ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আম্মা, বড় শীত লাগে, বড় খিদে পায়। আমাদের ভেতরে নিয়ে চলো। আমি কেন ওদের দেখতে পাই না?
-বিবি, হৃদয়ের চোখ দিয়ে ওদের খোঁজো, ঠিক দেখতে পাবে।
-আপনার ওই চোখটা অন্ধ। আপনি কিছু দেখতে পান না।
-না, অন্ধ নয়। আমাদের দুটো চোখ দিয়ে আমরা ভুল দেখি। দুরকম দেখি। আমার কাছে সব একাকার। আমি আমার সন্তানদের সবসময় দেখতে পাই। ওরা আমার চারপাশেই খেলাধুলা করে।
-কোথায়? আমাকে দেখান। আমি তো ওদের দেখতে পাই না।
-আমাদের চোখ দিয়ে ওদেরে দেখা যায় না। জলের ওপর জংলা গাছ দেখেছ? আমাদের। অনুভূতি সেই জংলা গাছের মতো। ওগুলো সরাতে সরাতে এগোলেই তুমি দেখতে পাবে। চোখ বুজে কল্পনা করো তাকে, যা দেখা যায় না। তোমার সন্তানরা তখন তোমাকে এসে জড়িয়ে ধরবে, বিবি।