-শফিয়া, এর চেয়ে বড় মুক্তি আমার জীবনে নেই।
-তা হলে আমার কথা শুনবেন!
-বলো।
-কিছুদিন চিকিৎসা প্রয়োজন আপনার।
-কোথায়?
-পাঞ্জাব মেন্টাল হসপিটালের অ্যালকোহলিক ওয়ার্ডে ভর্তি হতে হবে আপনাকে। ওরা ঠিক আপনাকে সারিয়ে তুলবে। আর মদ খেতে ইচ্ছে করবে না।
-ঠিক বলছ?
-অনেকে সুস্থ হয়ে গেছে মান্টোসাব।
-ঠিক হ্যায়। আমি ভর্তি হব। হামিদকে ডাক।
হামিদ এলে ওকে বললাম, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করো হামিদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
পরদিন হামিদ সব ব্যবস্থা করে ফেলল। ওরা যখন হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তার কিছু আগে অবশ্য আমাকে পালাতে হয়েছিল। শুনেছিলাম, হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্টের ফি নাকি বত্রিশ টাকা। টাকাটা তো জোগাড় করতে হবে। হাসপাতাল থেকে ফিরে লেখা দিয়ে ধার মিটিয়ে দেব বলে দু-একটা পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়া গেল। আরও দুয়েকজনের কাছে ধার করে টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। ওরা ভেবেছিল, আমি হাসপাতালে ভর্তি হব না বলে পালিয়ে গেছি। হাসপাতালে ভর্তিও হলাম। প্রথম কয়েকটা দিন খুব কষ্ট পেয়েছি। শরীরের ভিতরে একটা দৈত্য নড়েচড়ে উঠত, তার খাবারের জন্য। ছয় সপ্তাহ পরে এক অন্য মান্টো বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। শরীর ভেঙে গেছে ঠিকই, তবু যেন পুরনো জেল্লা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন, ভাইজানেরা, এর পর আট মাস মদ খাইনি। একের পর এক গল্প ছাড়াও কতরকম লেখা লিখেছি।
একদিন শফিয়াকে বললাম, আমি তো ভাল হয়ে গেছি। চলো এবার পাকিস্থান ছেড়ে চলে যাই।
-কোথায় যাবেন, মান্টোসাব?
-বম্বে।
-বম্বের কথা ভুলতে পারেন না?
-বম্বে আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান শফিয়া।
-কে আপনাকে চাকরি দেবে বম্বেতে?
ইসমতকে চিঠি লিখি-ও নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করবে।
ইসমত বহিন আপনার কোনও খোজ নেয় না, মান্টোসাব।
-ও একটা পাগলি। আমি বম্বে ফিরতে চাইলে ও ঠিক সাড়া দেবে। তুমি যেতে রাজি তো?
-আপনি যেখানে যাবেন, আমি সেখানেই যাব।
-ইসমতকে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে ফেললাম।-আমি বম্বেতে ফিরতে চাই। ভারতেই থাকতে চাই। কিছু একটা ব্যবস্থা করো ইসমত। যাতে আমরা সবাই যেতে পারি। আমি এখন একেবারে সুস্থ। কোনও স্টুডিওতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা সবাই একসঙ্গে জীবন কাটাতে পারব।
এরও দু-তিনবার ইসমতকে চিঠি লিখেছিলাম। ও কোনো উত্তর দেয় নি। ইসমত কি তা হলে শেষ জীবন পর্যন্ত মনে করত, আমি বিশ্বাসঘাতক, নিজের আখের গোছানোর জন্য পাকিস্থানে চলে গেছি? বা ও হয়তো জেনে গিয়েছিল, মদ আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছে, আমার ফেরার আর কোন পথ নেই। কিন্তু আমি ওর চিঠির জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে গেছি। আমার মদ খাওয়ার মাত্রাও তত বেড়ে গেছে। নেশার ঘোরের ভিতরে আমার গল্পের চরিত্রের সঙ্গে কথা বলে কেটে যায় দিনের পর দিন।
হ্যাঁ, আমি মরছিলাম, মির্জাসাব, সচেতনভাবেই একটু একটু করে মরছিলাম। গলায় দড়ি দিয়ে, বিষ খেয়ে বা হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার ছিল না। নিজেকে, শফিয়াকে, তিন মেয়েকে-আমি পাগলের মতো ভালবাসতাম। তাই শরীরে ধীরে। বিষক্রিয়া চালিয়ে আমি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলাম। যে দেশ আমাকে শুধু অপমান আর। ধিক্কার দিয়েছে, সেখানে বেঁচে ইচ্ছে আমার ছিল না। আর আমি বুঝতে পারছিলাম, দিনে দিনে পরিবারের কাছেও আমি বোঝা হয়ে উঠছি। ঘৃণা নয়, অনুকম্পাও নয়, ওরা তখন আমাকে। মানুষ বলেই মনে করে না।
একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে শুনতে পেলাম, কে যেন ফিসফিস করে ডাকছে, মান্টোভাই মান্টোভাই-।
তাকিয়ে দেখি আমার মাথার পাশে বসে আছে ইসমত। কড়মড় করে আইসক্রিম খাচ্ছে আর হাসছে।
-ইসমত বহিন,তুমি কখন এলে?
-অনেকক্ষণ-কখন থেকে ডাকছি।
-শহিদ কোথায়? শহিদ আসেনি?
-এসেছে তো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
-কেন?
-তুমি বম্বে যাবে।
-বম্বে! আমি লাফিয়ে উঠলাম।-আমার চাকরি পাকা করে এসেছ তো?
-আলবৎ?
-শফিয়া-শফিয়া-। আমি চিৎকার করে উঠলাম।-তাড়াতাড়ি এসো শফিয়া। আমি তোমাকে বলেছিলাম না, আমার চিঠি পেলে ইসমত চুপ করে বসে থাকতে পারবে না।
শফিয়া এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।-কী হয়েছে, মান্টোসাব? কোনও খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?
ইসমতকে নাস্তা-পানি দাও। শহিদ কোথায়-ডাকো ওকে—
ইসমত কোথায়, মান্টোসাব?
-এই তো-এই তো ইসমত-কোথায় গেল ইসমত? ও নিশ্চয়ই তোমার ঘরে গিয়ে লুকিয়েছে শফিয়া।
শফিয়া ওর বুকের ভিতরে আমাকে শিশুর মতো আঁকড়ে ধরে। আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বিছানায় শুইয়ে দেয়।-ঘুমিয়ে পড়ুন মান্টোসাব, ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার সারা শরীরে তার আঙুলগুলি পালকের মতো খেলতে থাকে।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। কবেকার শোনা একটা পাঞ্জাবি লোকগানের সুর যে কোথা থেকে ভেসে আসছিল। দেখলাম শফিয়া আমার পায়ের কাছেই ঘুমিয়ে রয়েছে। যেন এই ভোরেই সদ্য জন্ম হয়েছে শফিয়ার এমনই দীপ্তিময় হয়ে আছে তার মুখ। সেই মুখে দেশভাগের ছায়া নেই, দাঙ্গার রক্তের ছিটে লাগেনি। পাহাড়ি ছবিতে আঁকা ঘুমন্ত নায়িকা সে, তাকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছে নতুন পৃথিবী। আকাশ, জল, বাতাস, মেঘ, উড়ন্ত সারসদল, হরিণ হরিণী-আমার ঘর যেন হয়ে উঠেছে এক উৎসব।
হঠাৎ পেট মুচরে বমির দমক উঠে এল। বাথরুমের বেসিনে নীলচে-হলুদ জলের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল রক্ত। তারপর শুধু রক্ত আর রক্ত। মুখ ধুয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, মির্জাসাব। এ কে? সাদাত হাসান মান্টো? না, স্বয়ং মৃত্যু? আমি তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, এবারের মতো জিতে গেলে মান্টো। শুধু আর কয়েকটা দিন দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে থাকো।