-ওর খুব জ্বর। আপনি ও ঘরে যান মান্টোসাব।
-না, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। নিঘাতের কসম, আমি আর মদ ছোব না।
-আর কত কসম খাবেন আপনি মান্টোসাব?
-বিশ্বাস করো-এবার সত্যিই- আবার সব নতুন করে শুরু করব শফিয়া।
শান্ত গলায় শফিয়া বলল, আমার যে দম ফুরিয়ে গেছে মান্টোসাব।
-শফিয়া, শেষ বার আমাকে বিশ্বাস করো। তুমি তো আমার মনের জোর জানো। চেষ্টা করলে আমি সব পারি।
শফিয়া হাসে, ঠিক আছে। আপনি এবার শুয়ে পড়ুন গিয়ে।
আমি নিঘাতের পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ওকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। আমি মরমে মরে যাচ্ছিলাম, এ কীরকম পিতা আমি, মেয়ের ওষুধের টাকায় মদ কিনে আনি। নিঘাত, বেটি, আমাকে ক্ষমা করো। আমি ওকে কোলে তুলে নিতে চাইছিলাম, কিন্তু সেই শক্তি তখন আমার শরীরে নেই। শফিয়া এক সময় চিৎকার করতে করতে আমার হাত ধরে টানতে শুরু করল, যা করেছেন তো করেছেনই। এবার মেয়েটাকে শান্তিতে থাকেত দিন, মান্টোসাব।
-না, আজ রাতে আমি ওর পাশে থাকব।
-আপনি এইরকম করলে নিঘাত আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।
-ও আমার মেয়ে-আমি ওর পাশে—
-দয়া করুন মান্টোসাব। আমরা আপনার খেলার পুতুল নই। কী ভাবেন নিজেকে? তার চেয়ে নিজের হাতে আমাদের চারজনকে খুন করে ফেলুন।
চিৎকার-চেঁচামেচিতে কারা যেন ঘরে এসে ঢুকেছিল। হামিদের বিবি শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, বহুৎ হো গিয়া চাচাজি। ইয়ে দারুখানা নেহি হ্যায়। আপনি ও ঘরে যান।
জীবনে প্রথম কেউ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এভাবে কথা বলতে পারল, মির্জাসাব। আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। একটা শামুকের মতো খোলায় গুটিয়ে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উত্তর দেবার মতো মনের জোরই আমার ছিল না। অপমান নয়, নিজের ওপর ঘৃণাও নয়, মনে হচ্ছিল, আমার আর কোনও অবলম্বন নেই। আমাকে আঘাত করার অস্ত্র আমিই অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছি। ঠিক করলাম, এবার সত্যিই মদ নয়; বম্বেতে যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করতাম, লাহোরেও আবার তা নতুন করে শুরু করতে হবে।
পরদিন সকাল থেকেই ঘরের কাজে লেগে গেলাম। প্রত্যেকটা ঘর নিজের হাতে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করলাম, দেওয়ালের-আসবাবপত্রের ঝুল ঝাড়লাম। একটা চেয়ারের পায়া ভেঙে গিয়েছিল, বসে বসে সেটার মেরামতি করলাম। পুরনো কাগজপত্র, জমে ওঠা মদের বোতল বিক্রি করে দিলাম। বাচ্চাদের জন্য বারান্দায় টানিয়ে দিলাম দোলনা। বাজার থেকে বড় খাঁচাভর্তি এক ঝাঁক রংবেরংয়ের পাখি কিনে নিয়ে এলাম। নজত আর নসরত-নিঘাতের পরের দুই মেয়ে আমার-এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারার মতো জ্বলজ্বল করছিল ওদের চোখ। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, মির্জাসাব; দুটো ছোট ছোট মেয়ে কত ছোট কিছু পেয়েই খুশি হয়ে ওঠে, নেশার ঘোরে ডুবে থেকে আমি দেখতেই পাইনি।
শফিয়া এসে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ আবার নতুন কী পাগলামি মান্টোসাব?
-পাখি ছাড়া সংসার সুন্দর হয় না শফিয়া।
-কোন সংসারের কথা বলছেন,মান্টোসাব?
-কেন, আমাদের-আমাদের ছাড়া আর কোন সংসার আমি সাজাতে যাব শফিয়া?
-আবার সাজাবেন? নতুন করে ভাঙার জন্য?
শফিয়ার হাত চেপে ধরে বললাম, আমাকে এই শেষবার বিশ্বাস করো শফিয়া। আর আমাকে একটু সাহায্য করো। আমি সব নতুন করে সাজিয়ে তুলব।
-মান্টোসাব, শুধু আপনার ওপর বিশ্বাস নিয়েই আমি এতদিন বেঁচে আছি। নইলে কবেই খুদকুশি করতাম।
-ছিঃ শফিয়া, তোমার তিনটে মেয়ে আছে ভুলে যেও না।
-তারা আপনার মেয়ে নয়?
-আমাকে বিশ্বাস করো শফিয়া। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। কয়েকটা দিন একেবারে নতুন জীবন। মদ না খাওয়ার জন্য শরীর খুব দুর্বল লাগত, তার জন্য এল ভিটামিন ট্যাবলেট, টনিক। শধু আমার সংসারই নয়, চারপাশের আত্মীয় পরিজনরা মিলে যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল। মান্টো মদ ছেড়ে দিয়েছে-এর চেয়ে সুখবর তাদের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। তবে পুরোপুরি কেউই বিশ্বাস করে উঠতে পারত না। আগেও তো কতবার এরকম হয়েছে। এবারও একইভাবে সকলের বিশ্বাস ভেঙে দিল মান্টো। দিন কয়েক পরেই। ইয়ারদের সঙ্গে জুটে গেল সে। আবার বোতল এল বাড়িতে। আমি বুঝতে পারছিলাম, মদের ওপর আমার নির্ভরতা চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। যে কদিন মদ খেতাম না, একটা শব্দও লিখতে পারতাম না। না-লিখলে সংসার খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে? বাঁচি বা মরি, মদই আমার শেষ আশ্রয় হয়ে গেল মির্জাসাব।
অনেক আশা নিয়ে তো আমি পাকিস্থানে এসেছিলাম। সেই আশার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অনেক প্রশ্নও। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সাহিত্য কী আলাদা হবে? যদি হয়, তবে তার রূপ কেমন। হবে? অবিভক্ত ভারতে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, কারা তার যথার্থ অধিকারী? সেই সাহিত্যও কি দুভাগ হয়ে যাবে? ওপারে কি উর্দুকে একাবারে ধ্বংস করে দেওয়া হবে? পাকিস্থানেই বা উর্দু ভাষা কী চেহারা নেবে? আমাদের রাস্ট্র কি ইসলামি রাস্ট্র হবে? রাস্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও আমরা সরকারকে সমালচনা করতে পারব? ইংরেজ শাসনে যে অবস্থায় আমরা ছিলাম, তার চেয়ে কি ভালভাবে থাকতে পারব? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনি, মির্জাসাব। গল্প ফিরি করে যে সংসার চালায়, এত বড় বড় প্রশ্ন নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তার? তার ওপর পাকিস্থান সরকার তো সব সময় আমার পিছনে লেগেই ছিল। ঠাণ্ডা গোস্ত আর উপর, নিচ অওর দরমিয়াঁ গল্পের জন্য অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা, জরিমানা। পাকিস্থানের বহু। লেখক বুদ্ধিজীবী চাইছিল, আমাকে জেলে ভরে খুব এক চোট শিক্ষা দেওয়া হোক। প্রায়ই আদালতে হাজিরা দেওয়া, জেরার পর জেরা-এত মানসিক চাপ আমি আর বইতে পারছিলাম না মির্জাসাব। মদ খেলেও কষ্ট, না-খেলেও কষ্ট। ডাক্তার বলে দিয়েছে, আমার লিভার শেষ হতে বসেছে-মাথাও আর ঠিকঠাক কাজ করে না-একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ আমার সামনে খোলা ছিল না। তবু কতবার যে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি! তখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছি। একবার শফিয়া বলল, মান্টোসাব আপনি সত্যিই মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে চান?