হয় বাড়িতে একটা কাঠের পুতুলের মতো চেয়ারে বসে থাকতাম, না হলে ভবঘুরের মতো লাহোরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। মানুষের মুখ চোখের হাবভাব দেখতাম, কথাবার্তা শুনতাম, হ্যাঁ মন দিয়ে শুনতাম, তারা কী পেয়েছে, কী পায়নি, স্বপ্নগুলো কীভাবে চুরমার হয়ে গেছে, এমনকী আলতু ফালতু কথাও গোগ্রাসে গিলতাম। হাঁটতে হাঁটতে, মানুষের কথা শুনতে শুনতে আমার মাথায় জমে থাকা ধোঁয়াশা কেটে যাচ্ছিল। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কথারা, তাদের গায়ে জড়িয়ে থাকা উত্তাপ, দীর্ঘশ্বাস শুকিয়ে যাওয়া কান্না আমার ভিতরে ঢুকে পড়ছিল; বাড়িতে ফিরে যখন চুপচাপ বসে থাকতাম, তখন কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইত, মনে হত, আমার প্রতিটি রোমকূপ যেন ফেটে যাবে-ওরা-কথারা বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্ষোভে-ঘৃণায় দুঃখে; রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া কথারা তো কারও না কারও কাছে পৌঁছতে চায়, মির্জাসাব। তারা যেন আমাকে খুঁজে পেয়েছে-আমার ভিতরেই কথারা মেলে ধরতে চায় তাদের উদ্বাস্তু জীবন।
আমি আস্তে আস্তে লিখতে শুরু করলাম। এছাড়া তো করারও ছিল না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নেই। তাদের জন্য গল্প লিখে রোজগার করব। তাই কাগজে পত্রিকায় লিখেই যেটুকু পাওয়া যায়। আমি সারাদিনের জন্য একটা টাঙ্গা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়তাম। গল্পের ফিরিওয়ালা বলতে। পারেন। কাগজের অফিসের সামনে টাঙ্গা দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে গল্প লিখতে বসে যেতাম। গরামাগরম গল্প নাও, হাতে-হাতে টাকা দাও। তারপর চলো আরেক পত্রিকার। দফতরে। এরা চায় আমার ব্যঙ্গরচনা; বসে গেলাম লিখতে। টাকা পকেটে খুঁজে টাঙ্গায় চেপে আবার ছুট। টাকা পয়সা কোন দিনই গুনিনি; ও সব আমার ধাতে ছিল না। মোটামুটি রোজগার হলেই প্রথমেই চাই মদ, তারপরের সংসারের জন্য খরচ।
লাহোরে এসে আমার মদ্যপান অসম্ভব বেড়ে গেল, মির্জাসাব। চারপাশে বন্ধুবান্ধব কেউ নেই, সামনের দিনগুলো একেবারে অন্ধকার, আমি মরে গেলে বিবি-বাচ্চারা একেবারেই পথে গিয়ে বসবে-মাঝে মাঝেই ওই এক ঘোর-আমি তো বম্বেতেই আছি-ভেবেছিলাম, পাকিস্থান আমাকে লেখক হিসেবে মর্যাদা দেবে, আমি তো নিজের দেশ মনে করেই এখানে এসেছি, কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলাম, আমাকে ওরা রাস্তার কুকুর ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। সবসময় নেশার ঘোরের মধ্যেই থাকতে ইচ্ছে করত, যেন কুয়শাচ্ছন্ন এক টিলায় একা একাই বসে আছি। লিখে রোজগার করার জন্য যেটুকু সময় জেগে থাকা, তা ছাড়া নেশার ঘুমঘোরে ডুবে থাকার মত শান্তি আর কিছুতেই নেই। সেই ঘোরের ভিতরে কত যে মানুষ এসে হানা দিত-ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট তাদের চেহারা-আমি যেন একটা ভুতে পাওয়া বাড়ির মতো বেঁচে আছি। ছায়া মানুষগুলোর সঙ্গে আমি অনর্গল কথা বলে যেতাম। শফিয়া এসে আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোর ভেস্তে দিত। ঘোর কেটে যেতেই শরীর তার নিজের নিয়মে মদের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠত। আমার উন্মাদনা আরও বেড়ে যেত। নেশার এই চক্র থেকে বের করে আনার জন্য শফিয়া তো কম চেষ্টা করেনি। আমি ততই নতুন ফন্দি-ফিকির বার করে ঘোরের জগতে ঢুকে পড়তাম। কয়েকজন স্যাঙাত জুটেছিল; আমি জানতাম, লেখক মান্টোকে ওরা চেনে না-জানে না; আমরা শুধু এক গ্লাসের ইয়ার; হাতে পয়সা না থাকলে ওরাই তো আমাকে বাঁচাত, তাই ওদের ছাড়ব কী করে বলুন? মদ খেতে খেতে শরীর-মনের এমন একটা অবস্থা, কেউ ভাল। কথা বলতে এলেও আমি ক্ষেপে উঠতাম। আহমদ নাদিম কাসিমি কতবার আমাকে বুঝিয়েছে; কিছুদিন চুপ করে শুনেছিলাম, তারপর একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেললাম, কাসিমি তুমি আমার দোস্ত। মসজিদের মোল্লা নও যে আমার চরিত্র দেখভাল করার ভার তোমার উপর দেওয়া হয়েছে। কাসিমি এর পর থেকে আর কিছু বলেনি। লাহোরের পুরনো যে দু-একজন বন্ধু ছিল, তারাও দূরে সরে যেতে থাকল। আত্মীয়রাও কেউ আর কথা বলত না। সবাই আমাকে দেখে পালায়। আরে ওই যে মান্টো-পালাও, পালাও-শালা আবার টাকা ধার চাইবে। হ্যাঁ, এতটাই নীচে নেমে গিয়েছিলাম আমি। লিখে আর কটা টাকা রোজগার হত বলুন? রোজ নেশা করার জন্য তো টাকা চাই। হাতের কাছে যাকেই পেতাম, তার কাছেই ধার চাইতাম। কখনও শফিয়ার শরীর খারাপ, কখনও মেয়েরা অসুস্থ-এইসব মিথ্যা কথা বলে। মির্জাসাব নেশা যে আমাকে কোন অতল সুড়ঙ্গের ভিতরে নিয়ে চলেছে, বুঝতে পারতাম, কিন্তু সেই অন্ধ প্রবৃত্তি তখন আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। পেটে মদ না পড়লে স্থির থাকতে পারি না, হাত-পা-কাঁপে, মেজাজ আরও তিরিক্ষে হয়ে যায়।
সবচেয়ে নোংরা কাজটা করে বসলাম বড় মেয়ে নিঘাতের টাইফয়েডের সময়। ওর ওষুধ কেনার জন্য এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে মেয়ের ওষুধের বদলে হুইস্কির বোতল নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রোজ এত চিৎকার চেঁচামেচি করে, কিন্তু শফিয়া সেদিন আর একটাও কথা বলল না। অনেকক্ষণ আমার দিকে শূণ্য চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর একগ্লাস জল রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে নিঘাতের জ্বরে আছন্ন গোঙ্গানি। জল না মিশিয়ে কিছুটা খেতেই বমি করে ফেললাম। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি নিঘাতের মাথার কাছে বসে ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে শফিয়া। আমি শফিয়ার পা জড়িয়ে ধরে বললাম, আমাকে ক্ষমা করো।