-হুজুর
-আর হুজুর বলিস না কাল্লু। তুই আমার বাপ-তুই আমার বেটা-কী কষ্ট হয়েছিল কাল্লু?
-দস্তানগোর-রা সব কোথায় গেল হুজুর?
-আমিই তো রোজ এসে কত দস্তান বলতুম তোকে কাল্লু।
-মাফ কিজিয়ে হুজুর। আপনার দস্তানে কোন রং ছিল না।
-রং দেখবি? আয়, তা হলে আমার হার ধর।
-কোথায় যাব হুজুর?
-জাঁহাপনা সলোমনের দরবারে।
-মাশাল্লা।
-কত মণি-মুক্তো-হিরে-জহরত থেকে রং ঠিকরোচ্ছে দেখতে পাচ্ছিস?
-জি হুজুর। আঃ। কী আলো-কী আলো-হুজুর, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। দস্তানের ভেতরে তো এরকম আলো দেখতে পেতাম হুজুর।
-ওই দেখ, সভাকবি শাহেদ এসে জাঁহাপনার পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না-কথা জড়িয়ে গেছে তাঁর।
সলোমন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে আপনার? এমন উদভ্রান্ত কেন?
ভয়ে শাহেদের ঠোঁট নীল হয়ে গিয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, আমাকে বাঁচান জাঁহাপনা
-কী হয়েছে বলুন? কে আপনাকে মারতে চায়?
-হাওয়া হুজুর-রাস্তায় রাস্তায় শুধু একই হাওয়া-কী যে ঠাণ্ডা-তলোয়ারের মতো আমার বুকে, পেটে, চোখে এসে ঢুকছে-আমাকে বাঁচতে দেবে না।
-কে?
ইস্রাফিল হুজুর।আপনার দরবারে আসতে আসতেই তাঁকে দেখলাম। কালো কাপড়ে তাঁর মুখ ঢাকা। তাঁর দৃষ্টি ছোরার মত আমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। হুজুর, ইস্রাফিলের নিশ্বাস থেকে আমাকে বাঁচান। কত কাজ আমার বাকি রয়ে গেছে। আমি এখনই মরতে চাই না।
-আমি কী করব, বলুন?
-হাওয়া তো আপনার ক্রিতদাস।
-হুঁ।
-তাঁকে বলুন আমাকে ভারতবর্ষে নিয়ে যেতে। ইস্রাফিলের থেকে দূরে মহাসাগরের ওপারে থাকব আমি।
-তাই হোক।
জাঁহাপনা সলোমন হাওয়াকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর প্রিয় কবিকে পাহাড়-সমুদ্র পেরিয়ে হিমালয়ের ওপর দুর্গম অরেণ্যে রেখে আসতে বললেন।
পরদিন তার দরবারে ভিড়ের মধ্যে ইস্রাফিলকে দেখতে পেলেন জাঁহাপনা। তিনি মৃত্যুর ফরিস্তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কাল আপনি আমার প্রিয় কবিকে ভয় দেখিয়েছেন?
-না জাঁহাপনা। কবি শাহেদকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। খোদা আমাকে বলেছিলেন, কালকের মধ্যেই তাঁকে ভারতবর্ষে পৌঁছে দিতে। তো আমি ভাবলাম, কবির ডানা থাকলেও তো তিনি একদিনে পৌঁছতে পারবেন না। তাই—
-হুজুর-। কাল্লু চোখ মেলে তাকাল।
-বল কাল্লু।
-এটা কোন দেশ হুজুর?
-ভারতবর্ষ।
-সালাম আলেকুম, হুজুর। কাল্লু আবার চোখ বুজল।
কাল্লুকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসে আমার কুঠুরিতে বসেছিলুম। যেন নক্ষত্রহীন আকাশের মধ্যে বসে আছি। বেগম কখন এসেছে টের পাইনি। একসময় কান্নার শব্দ পেয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কে?
-আমি মির্জাসাব।
-উমরাও-কী হয়েছে-ঘুমাওনি?
-আপনিও তো ঘুমোননি।
-কিছু বলবে?
-চলুন এই দেশ ছেড়ে আমরা চলে যাই।
-কোথায়?
-আপনি জানেন।
-কবর ছাড়া তো আর কোনও জায়গা নেই, বেগম। খোদা কখন কাকে ডাকবেন, তিনিই জানেন। কয়েকটা দিন তোমাকে শুধু স্বপ্ন দেখতে হবে বেগম। তুমি শাহজাহানাবাদেই আছো। কান খাড়া করে শোনো-ওই তো ফতেপুর সিক্রি থেকে মিঞা তানসেনের পুকার ভেসে আসছে
বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। আমার ধর্মরাজ মিঞা ভিজতে ভিজতে কুইকুই করে ডাকছে।
মান্টোভাই, রহম করুন, এবার আমাকে শেষবারের মতো ঘুমোতে দিন। আল্লা মেহেরবান।
হম-নে বহশৎকদহ-এ বজম-এ জঁহা-মেঁ জুঁ শমা
শোনহ-এ ই কো অপনা সর ও সাঁমা সমঝাঁ।
(দুনিয়ার এই ভয়ানক উজাড় মজলিসে প্রদীপের মতো আমি
প্রেমের শিখাকেই আমার সর্বস্ব জ্ঞান করলাম।)
৪৪. লাহোরে পৌঁছনোর পর
মেহ্ লাশ-এ বেকফান অসদ খুস্ত জাঁ-কী হৈ;
হক মগিফরৎ করে, অজব আদাজ মর্দ যা।
(এই কফনহীন মৃতদেহ ভগ্নহৃদয় আসাদেরই;
ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন, বড়ো স্বাধীনচিত্ত পুরুষ ছিলো।)
লাহোরে পৌঁছনোর পর তিন মাস যেন আমার ভিতরে একটা ঘূর্ণিঝড় চলছিল, মির্জাসাব। কখনও মনে হত বম্বেতেই আছি, কখনও করাচিতে দোস্ত হাসান আব্বাসের বাড়িতে, আবার কখনও মনে হত, লাহোরেই তো আছি। তখন লাহোরের হোটেলে হোটেলে কয়েদ-এ-আজম জিন্নার তহবিলের জন্য নিয়মিত নাচ-গানের আসর বসানো হত। কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না; মাথার ভিতরের মরুভূমিতে বালির ঝড়। যেন সিনেমার একটা বিরাট পর্দায় জটপাকানো সব দৃশ্য ভেসে উঠছে। বম্বের বাজার, রাস্তাঘাট দেখতে পাচ্ছি; তার সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে করাচির পথের ছোট ছোট ট্রাম আর গাধায় টানা গাড়ি; পরক্ষণেই ভেসে উঠছে লাহোরের কোন উদ্দাম পানশালার ছবি। আমি তাহলে কোথায় আছি? মমির মতো চেয়ারে বসে বসে ভাবনার ঢেউয়ে লুটোপুটি খেতাম। শফিয়া প্রায়ই বলত, এভাবে কতদিন ঘরে বসে থাকবেন মান্টোসাব?
-কোথায় যাব বলো তো?
-একটা চাকরি বাকরির তো ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সংসারটা চলবে কী করে?
-কে আমাকে চাকরি দেবে শফিয়া?
-ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়া আসা শুরু করলে ইন্ডাস্ট্রি মানে লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। শফিয়া তো জানত না, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলে লাহোরে তখন কিছু নেই বলতে গেলে। অনেক ফিল্ম কোম্পানির নাম শোনা যেত বটে, তাদের ছোটখাটো অফিসও ছিল, কিন্তু বাইরে সাইনবোর্ডের শোভা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
প্রযোজকরা লাখ-লাখ টাকার ছবির কথা বলত, অফিস তৈরি করত, ভাড়া করে অফিসের জন্য আসবাব আনাত, তারপর অফিসের কাছাকাছি ছোট ছোট রেস্তোরার টাকা না মিটিয়েই চম্পট দিত। এরা সবাই এক-একটা জোচ্চোর। যারা নিজেরাই ধার করে জীবন চালায়, তারা দেবে চাকরি? কিন্তু সত্যিই তো আমার কিছু কাজ করা দরকার। বম্বে থেকে যেটুকু টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তা ফুরিয়ে এসেছে। শুধু সংসার খরচ নয়, ক্লিফটন বার-এ আমার মদের বিলও মেটাতে হয়েছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমি লাহোরেই আছি আর এই ছন্নছাড়া। লাহোরেই আমাকে বাকি জীবনটা থেকে যেতে হবে। মোহাজিররা তো বটেই, যারা উদ্বাস্তু নয় তারাও নানা ফিকিরে কোনও দোকান বা কারখানা বানিয়ে নেওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত। আমাকেও সবাই বলেছিল, এই সুযোগে কিছু গুছিয়ে নাও। লুঠেরাদের দলে গিয়ে আমি ভিড়তে পারি নি, মির্জাসাব একটা ভুল রাজনীতির জন্য দেশভাগ আর তার সুযোগ নিয়ে একদিন বড়লোক হয়ে যাব আমি? নিজেকে এত দূর নীচে নামানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। চারপাশে এত বিভ্রান্তি আমি আর কখনও দেখিনি। একজন মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে তো আরেকজন হতাশ্বাসে ডুবে গেছে। একজনের বেঁচে থাকার মূল্য অন্যজনের মৃত্যু। যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় আমরা বেঁচে আছি। রাস্তার রাস্তার স্লোগান পাকিস্থান জিন্দাবাদ, কয়েদ-ই-আজম জিন্দাবাদ; আর স্লোগানের ভেতরে আমি শুনতে পেতাম গুমরে ওঠা কান্না। শুধু তো মানুষের নয়; গাছেদের, পাখিদের কান্না। যে-সব মোহাজিরের রাস্তা ছাড়া আশ্রয় জোটেনি, তারা বড়-বড় গাছের বাকল খুলে শীতের রাতে আগুন জ্বালাত; নইলে ওরা বাঁচবেই বা কী করে? উনুন। জ্বালানোর জন্যও কত যে গাছ আর গেছের ডাল-পালা কাটা হয়েছিল। লাহোরের পথে পথে শুধু নগ্ন গাছ-গাছেদের কান্না একটু খেয়াল করলেই শোনা যেত। বাড়িগুলো যেন শোকে অন্ধকার হয়ে আছে। মানুষের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কেউ তাদের শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়েছে-সবাই যেন কাগজে তৈরি মানুষ।