এই ধ্বংস্তূপে বসে আমি আর গজলকে স্পর্শ করতে পারতুম না, মান্টোভাই। আমি-আমিই একসময় গজল লিখতুম? ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যেতুম। ইবন সিনার দর্শন বা নাজিরি র কবিতা, কোথাও কোন শান্তি নেই। সব ফালতু-সব-কবিতা, সাম্রাজ্য, দর্শন-কিছুতেই কিছু এসে যায় না। শুধু একটু আনন্দে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আর কিছুই নয়। হিন্দুদের তো কতো অবতার, মুসলমানদের কত পয়গম্বর-তাতে কী এসে যায়? আমি হরগোপাল তাকে লিখেছিলুম, বিখ্যাত বা অনামা, যাই হও, তাতে সত্যিই কিছু এসে যায় না। খেয়ে পড়ে, সুস্থ হয়ে বাচাই বড় কথা। শিল্প আসলে এক বধ্যভূমি, তক্তা, যেখানে তুমিই দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত, তুমি জহ্লাদ। খোদা এই মায়াপাশ থেকে আমাকে মুক্ত করো। এতগুলো বছর আমি নিজের, আমার কাছের মানুষদের রক্ত ঝরিয়েছি, আর সেই রক্তেই রাঙা হয়ে উঠেছে আমার শিল্পের গুলবাগ। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব, আমি আপনাকে সমর্থণ করি। ধ্বংস করুন সব ছবি,মুর্তি-মিঞা তানসেনের শ্বাসরোধ করুন-গর্দান নিন মীর তকি মীরের.. এত মায়া নিয়ে আমরা কী করব বলুন? আমার অন্ধকার কুঠুরিতে বসে কিছুই আর চিনতে পারতুম না, মান্টোভাই। চারপাশের দুনিয়া-কাউকে নয়। যদি অনেক শতাব্দী পরে সাদি বা হাফিজসাবের সঙ্গে আমার নাম কেউ উচ্চারণ করে, তাতে কী এসে যায়? আমি তো একটা কুকুরের মতো তাড়া খেয়েই বেঁচেছিলুম।
ওদের চোখে মুসলমানরা রাস্তার কুকুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দিল্লি অধিকারের কিছুদিন পর থেকে হিন্দুরা শহরে ফিরে আসতে পারছিল, মুসলমানদের ফিরতে দেওয়া হয় নি। অনেক পরে তারা শহরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল। মান্টোভাই, বড় বড় খানদানের বেগম, ছেলেমেয়েরা তখন রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষে করছে। কেল্লার চাঁদপানা মুখের বেগমরা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের মনে বিড়বিড় করছে, হাসছে। আমার মহাপ্রস্তানের পথে এইসব ভাঙাচোরা, মরেও হেটে-চলে বাড়ানো মানুষকে দেখতে পেতুম মান্টোভাই। আর প্রার্থণা করতুম, খোদা, আমাকে কবরে নিয়ে চলো। এক টুকরো কাফন আমার জন্য রেখো।
একদিন হাটতে হাটতে জামা মসজিদের চত্বরে বসে পড়লুম। শ্বাস নিতে পারছিলুম না, মনে হচ্ছিল শেষ মুহূর্ত এসে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলুম, মান্টোভাই, দরজায় তার ছায়া এসে পড়েছে। রোজ মাঝরাতে বিছানায় উঠে বসতুম। ঘুমের মধ্যে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। একের পর এক গাছ থেকে ঝুলছে মৃতদেহ। বুকের বাঁদিকে ছুরি চালানোর ব্যাথা নিয়ে আমি জেগে উঠতুম। ভয় হত, যদি এই মুহূর্তে হৃৎপিণ্ড বোবা হয়ে যায়? খোদা, আমাকে রহ্ম করো, মৃত্যুকে এবার পাঠাও, মনে মনে সবসময় তো এ-কথা বলতুম, অথচ ভয় পেয়ে কেন জেগে উঠতুম, কেন বুকের বাঁদিক চেপে ধরে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতুম? জামা মসজিদের চত্বরে বসে যখন হাঁফাচ্ছি, আমার মিঞা ডেকে উঠল।
-ঘেউ-ঘেউ
-একটু জিরিয়ে নিতে দিন মিঞা। ঘেউ-ঘেউ–
-এখনই জিরোবেন? আরও কত দেখার বাকি আছে, মির্জাসাব।
-ঘেউ-ঘেউ-। আপনি চলে যান, মিঞা। আমি আর মহাপ্রস্থানের পথে হাঁটব না।
-বেশ তো তবে না হয় একটা কবিতা শুনুন।ঘেউ-ঘেউ
-কবিতার পেছনে আমি লাথি মারি।
-ঘেউ-ঘেউ-। ভালবাসার ধনকে এভাবে লাথি মারতে নেই, মির্জাসাব। আমি তো জানি, কবিতা ছাড়া আর কাউকেই ভালবাসেননি আপনি।
-কাউকে নয়?
-না। কাউকে নয়। দুনিয়ার সব রং-রূপ আপনি অক্ষরের ভিতরেই দেখেছিলেন, মির্জাসাব। অক্ষরই আপানার রক্তমাংস। আমি আপনার শেষ কবিতাটি বলছি, শুনুন।
-আমার শেষ কবিতা?
-ঘেউ-ঘেউ-। এক শতাব্দী পরে তা লেখা হবে।
-বলুন মিঞা।
-ঘেউ-ঘেউ-। কবিতা কেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যায়, তাই না মির্জাসাব?
আমার ধর্মরাজ স্থির হয়ে বসে জামা মসজিদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে
এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূণ্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয়
চোখের কোণে এই সমস্থ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমণী শিরা।
জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
নাকি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে
কোনই ত্রান নেই ভবিষ্যের
আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে।
নাকি এ প্রাসাদে আলোর ঝলকানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?
আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
কিন্তু আমার কোন স্বপ্ন ছিল না, মান্টোভাই। গোরারা সব স্বপ্ন কিমা করে ওদের তেলে কিমার গোল্লা ভাজছে। সেদিন ফিরে দেখলুম, বাড়ির সামনে কিছু লোকজন, উমরাও বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখেই উমরাও কান্নায় ভেঙে পড়ল, মির্জাসাব–
-কি হয়েছে, বেগম?
-কাল্লু—
-কী করেছে কাল্লু হারামজাদা?
এতদিনের কাল্লু আমাদের ছেড়ে চলে গেল, ভাইজানেরা। কী করেই বা বাঁচবে? ওকে কিস্স শোনাবে কে? কাল্লু তাই ঘুমিয়ে পড়ল, ওর মুখের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা নামছিল। আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ডাকলুম, কাল্লু-বেটা আমার—