দিল্লি যো এক শহর থা, আলম সে ইন্তিখাব
রহতে থে মুন্তাখাব হি, জাঁহা রোজগার কে
উসকো ফলক নে লুটকে, বরবাদ কর দিয়া
হম রহনেবালে হ্যায়, উসি উজরে দিবার কে।
ব্রীটিশরা আরও নৃশংস, ভাইজানেরা। ১৮৫৮-র নভেম্বরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রটিশ সরকার এ-দেশের শাসনভার নিয়ে নিল। মান্টোভাই, সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে। কয়েকদিন ধরেই আমি ধূমকেতু দেখতে পাচ্ছিলুম। ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। বুঝতে পারছিলুম, আমাদের ধ্বংস আসন্ন। ইংল্যান্ডেশ্বরীর হয়ে শাসনভার হাতে নিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বাহাদুর। হায় আল্লা! আমি জানতুম, এবার ওদের লক্ষ্য, শাহজাহানাবাদকে-তজ্জীবকে মিছে দেওয়া। গোরারা এবার নিজেদের মতো করে শহরটাকে গড়ে পিটে নেবে, আর আমরা, ভাঙাচোরা মানুষেরা, ক্ষতবিক্ষত ছায়ার মতো পড়ে থাকব।
আমার তখন একমাত্র বন্ধু মহল্লার একটা ঘেয়ো কুকুর। যারা পালিয়ে গেছে, তাদেরই কারও বাড়ির পাহারাদার কুকুর ছিল সে। হাড় জিরজিরে চেহারা, লোম ঝরে গেছে, সারা শরীরে। পোকা। একদিন আমার দরজার সামনে এসে শুয়ে কুঁইকুই করে কাঁদছিল। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল।
আমিও মজা করে ডাকলুম, ঘেউ-ঘেউ-।
-মির্জাসাব
আমি তো ভয়ে পিছিয়ে গেলুম। আরে, কুকুর আবার মানুষের মতো কথা বলে নাকি? কে জানে, গোরাদের রাজত্বে কখন কী হবে, কিছুই তো বলা যায় না। সে আবার ডাকল মির্জাসাব-।
-বেত্তমিজ কুত্তা কাঁহি কা।
-দুদিন কিছু খাইনি, মির্জাসাব।
আমি চিৎকার করে ডাকলুম, কালু, এই কাল্লু হারামজাদা।
কাল্লু দৌড়তে দৌড়তে হাজির। আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কাল্লু তখন প্রায় কথাই বলে না বলতে গেলে। দস্তান ছাড়া তো ও বাঁচতে পারত না। কারবালা দিল্লিতে তখন আর ওকে দস্তান শোনাবে কে?
-কুত্তাটাকে কিছু খেতে দে।
-খাবার কোথায় পাব হুজুর?
-কেন খাবার নেই কাল্লু? এখন তো ইংরেজ বাহাদুর এসেছেন-তাদের দেশে কতরকম খাবার, কত মদ-লাল, নীল,সাদা-আমাদের জন্য কেন খাবার নেই? ভিতরে গিয়ে দেখ একবার, শুকনো হাড়-টাড় কিছু পড়ে আছে কি না।
-হুজুর
-কী হুজুর? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? কুত্তাটা কি না খেয়ে মরবে নাকি?
-আপনিও তো না খেয়েই আছেন।
-তাতে কি? সাচ্চা মুসলমানের কাছে কেউ কিছু চাইলে, তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই, জানিস না?
-ঘেউ-ঘেউ—
-কী হল মিঞা? একটু অপেক্ষা করো, কিছু না কিছু জুটে যাবেই।
কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে বলে, চলুন না হয় রাস্তায় ঘুরে আসি। পথে ঠিক খাবার পাওয়া যাবে মির্জাসাব।
আমি তার কথা শুনে হেসে ফেলি। কাল্পর পিঠে হাত রেখে বলি, দ্যাখ, আমার ধর্মরাজ কেমন বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। এবার মহাপ্রস্থানের পথে যাব। তোর আর দুঃখ থাকবে না কাল্লু। এবার থেকে মহাপ্রস্থানের কিস্সা শুনতে পাবি। যা আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।
-কোথায় যাবেন হুজুর?
-শাহজাহানাবাদ হারিয়ে যাবার আগে একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।
সেই আমার মহাপ্রস্থানযাত্রা শুরু হল, মান্টোভাই। ধর্মরাজ আমার বাড়িতে বারান্দাতেই রয়ে গেলেন। আমি তাকে মিঞা বলেই ডাকতুম। হাঁটতে কষ্ট হয়, পা দিনে দিনে ফুলছে, চোখেও ঠিকঠাক দেখতে দেখি না; মিঞা আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখায়। গলির পর গলি,
মহল্লার পর মহল্লা মুছে যেতে থাকে। ব্রিটিশ শহরকে ঢেলে সাজাচ্ছে। সেখানে গোলকধাঁধার মতো গলি ও মহল্লা তো থাকতে পারে না। গোলকধাঁধা মানেই কোথাও না কোথাও বিপদ। লুকিয়ে থাকবে; বিদ্রোহীরা তো এইসব জায়গাতেই ডেরা বাঁধে। তাই বড় বড় রাস্তা বানাতে হবে, যাতে ব্রিটিশের নজরের বাইরে কিছু থাকতে না পারে। কেল্লার দেওয়ালের বাইরে। চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত যত বাড়ি-ঘর ছিল সব ভেঙে দেওয়া হল। শহরের বুজুর্গ আদমিদের আবেদনে কোনও মতে বেঁচে গেল দরিবা বাজার। মান্টোভাই, বাজার ছাড়া কি শাহজাহানাবাদের কথা ভাবা যায়? উর্দু বাজার, খাস বাজার, খরম-কা বাজার, সবার ওপরে চাঁদনি চক। শাহজাহানাবাদের প্রাণস্পন্দন তো বাজারগুলোয় হাঁটলেই শোনা যেত। বাজার তো শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়, কতরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হত বাজারেই। কতদিন আমি একা একা এইসব বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেন জানেন? শুধু রংয়ের ফোয়ারা দেখার জন্য আর হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে উঠত নতুন কোনও মুখ, যাকে আগে কখনও দেখিনি। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বাজারে ঘুরতে ঘুরতেই তো কত শের কুড়িয়ে পেয়েছি আমি। ভিড়ের মাঝে একা একা হেঁটে যাওয়ার মৌতাত আপনি বাজার ছাড়া কোথায় পাবেন বলুন? তো উর্দু বাজার, খাস বাজার, খড়ম-কা-বাজার- সব ওরা লোপাট করে দিল।
-ঘেউ-ঘেউ-মির্জাসাব—
-বলুন মিঞা। ঘেউ-ঘেউ–
-আমরা তাহলে কোথায়?
-মাটির তলায়। শাহজাহানাবাদে যখন প্রথম এসেছিলুম, মাটির গভীর থেকে উঠে এসে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। কারা জানেন, মিঞা? শাহজাহানাবাদ তৈরির সময় যাদের মেরে। মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। এটাই শহর তৈরির তরিকা। ইংরেজরা এবার নতুন শহর তৈরি করছে, আমাদের তো মাটির তলাতেই যেতে হবে। তা খারাপ হবে না মিঞা, একে অপরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।
মান্টোভাই, ইংরেজদের নতুন শহরে আমার মতো মানুষ বেঁচে থেকে কী করবে? বলুন? আমাদের শহর আর ওদের শহর তো আলাদা। আমাদের দেশে যে-সব শহর তৈরি হয়েছিল, সেখানে চওড়া সিধে রাস্তা আপনি খুব কমই দেখতে পাবেন। এখানে গলির পর গলি, সেইসব গলিকে ঘিরে একের পর এক মহল্লা। শহর নির্মানের এই পরিকল্পনার পিছেনে রয়ে গিয়েছে আমাদের অন্য জীবনবোধ। আমরা সবাই কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। গলিপথে আমরা ঢিমেতালে চলতে পেরেছি, চলতে-চলতে কারুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু খোশগল্প করেছি। কারুর বারান্দায় বসে এক ছিলিম তামাক খেয়েছি, আড়চোখে তাকিয়ে কোনও বাড়ির জানলায় হঠাৎই কোনও সুন্দরীকে দেখে ফেলেছি, কত অমরুওয়ালা, ফুলওয়ালা, কুলপিওয়ালারা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে, এইসব পথ তো শুধু হাঁটার জন্য ছিল না, বলতে পারেন এ একরকম মণ্ডপ, যেখানে চেনা অচেনা মানুষরা মিলতে পারতুম। ব্রিটিশ যে নতুন শহরটা তৈরি করছিল তা আমাদের ওপর নজরদারির জন্য। জামা মসজিদের চারপাশের বিরাট এলাকা জুড়ে সব ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হল। আজুদার তৈরি দার-উল-বাকাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সেখানে বিনে পয়সায় সাহিত্য, চিকিৎসা, ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হত। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে, চিকিৎসায়, ধর্মতত্ত্বে ওদের কী প্রয়োজন? খোদা মেহেরবান, আমি কানে কম শুনতে শুরু করেছিলুম, নইলে তো সারাক্ষণ শুধু ভাঙনের আওয়াজেই আমার মাথা ভরে যেত।