দিল্লি যো এক শহর থা, আলম মে ইন্তিখাব
রহতে থে মুন্তাখাব হি, জাঁহা রোজগার কি
উসকে ফলক নে লুঠকে, বরবাদ কর দিয়া
হাম রহনেওয়ালা হ্যায়, উসি উজরে দিয়ার কে।
আপনি হাসছেন, মান্টোভাই? ঠিকই ধরেছেন, আপনারই মতো বদভ্যাস আমার, কথা বলতে শুরু করলে কোথায় যে চলে যাই, তাল থাকে না। আসলে কী জানেন, কথা বলতে গিয়ে মনে হয়, আরে এরা সব আসছে কোথা থেকে, তখন তো আমি দুনিয়াতেই আসিনি। আমার ভেতর থেকে তা হলে কে কথা বলছে? তাজ্জব বনে যাই মান্টোভাই, সত্যিই তাজ্জব, এক একজন। মানুষের ভেতরে ক’টা মানুষ লুকিয়ে থাকে? মানুষটার জন্মের আগের মানুষরাও তাঁর ভেতরে রয়ে যায়? কী মনে হয় জানেন? মাথার ভেতরে বহু দূর থেকে আসা কুয়াশা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
বারোমাসা তসবিরের কথাই তো বলছিলুম, তাই না? এসব তসবিরের জন্ম পাহাড়ি দেশে। আমার ওয়ালিদ যেভাবে আম্মাজানের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাতে সেই বারোমাসা তসবিরের কথা মনে পড়েছিল আমার। পাহাড় থেকে মুসাব্বিররা মাঝে মাঝে শাহজাহানাবাদে আসতেন তসবির বিক্রি করতে। তাঁদেরই কারো কাছে ভাদোঁর একটা তসবির দেখেছিলুম। ভাদোঁর রহস্যটা আগে আপনাকে বলতে হয় মান্টোভাই। এই প্রেমের মাসে আশিককে ছেড়ে কেউ থাকতে পারে না। বানিজ্য করতে যারা বাইরে যেত, তারাও ভাদোঁতে বিবির কাছে ফিরে আসত। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘ, সারারাত গাছের পাতা থেকে জল ঝরছে, তারা হাওয়ায় কাঁপছে, তখন আশিককে ছেড়ে থাকা যায় বলুন? বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় হাওয়ায় জুইফুল আরা। চাঁপার গন্ধে এক শরীর তো অন্য শরীরকে চাইবেই। সেই তসবিরে ঘন কালো মেঘকে আদর করছিল সোনালি বিদ্যুতের রেখা, সারসের দল তৃষ্ণার্তের মতো মেঘের গভীরে উড়ে যাচ্ছে, হাওয়া সোহাগ করছে গাছেদের সঙ্গে, দোতলার বারান্দায় বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা, আপনি দেখলেই বুঝতেন, তারা আসলে রাধা ও কৃষ্ণ, বিদ্যুতের গর্জনে কপট ভয়ে রাধা জড়িয়ে ধরলেন কৃষ্ণকে, বারান্দায় নীচের আলসেয় বসে ময়ূর তাকিয়েছিল ঘনকৃষ্ণ আকাশের দিকে, আর নীচের তলায় খোলা বারান্দায় বসেছিলেন এক নারী, বেখোদ, যেন কারও অপেক্ষায়। সেই হয়ত আমার আম্মাজান। আম্মাজান যেন আকাশজোড়া ঘন কালো মেঘ, আবদুল্লা বেগ খান সোনালি বিদ্যুতের মত হটাৎই তাঁর কাছে এসেছেন। কত দীর্ঘ অপেক্ষার পর দু’জন। দু’জনকে এভাবে কাছে পেতে চায় মান্টোভাই, যেমন আজান আল্লার কাছে পৌঁছতে চায়। আবদুল্লা বেগ খান সেদিন তাঁর বিবিকে খুব আদর করলেন, বিবির সঙ্গে মিলিত হলেন। আমি বসে বসে সেই খোয়াব দেখলুম। সেজন্য আমার ভিতরে এতটুকু পাপবোধ নেই মান্টোভাই; কৃষ্ণ রাধার উপগত হয়েছেন দেখলে কি কোনও পাপ হতে পারে? খোয়াবের মধ্যে একবারই ওয়ালিদকে দেখেছিলুম আমি।
আম্মাজানের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারতুম না। সারাদিন জেনানামহলে কত কাজ তাঁর; আমরা তিন ভাই-বোন তাঁর আশপাশ ঘোরাফেরা করতুম, তিনিও চোখ তুলে তাকানোর ফুরসৎ পেতেন না। ছোটি খানম অবশ্য রাতে আম্মাজানের কাছে থাকতে পারত। আমি আর ইউসুফ থাকতুম দিবানখানায়। মান্টোভাই, খুব ছোটবেলাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম, কালে মহল আমার ঘর নয়, এখানে আমরা থাকি ঠিকই, কিন্তু তিন ভাই-বোন সবার থেকে আলাদা হয়ে। ইউসুফ হয়তো এজন্যই পাগল হয়ে গিয়েছিল। ছোটি খানমও বেশীদিন বাঁচেনি। শুধু আমাকে আল্লা শাস্তি দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন, দোজখের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে কালো করে দিলেন। রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো মানুষ যেতে পারে না। কালে মহলের আসাদের জন্যই হয়ত মীর সাব লিখেছিলেন:
কেয়া মীর হ্যয় য়হী জো তেরে দরপে থা খাড়া
নমনাক চশ্ম ও খুশক্লব ও রংগজর্দ থা।।
(সেই কি মীর যে তোমার দরজায় দাঁড়িয়েছিল,
ভেজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, বর্ণ ফ্যাকাশে?)
আসাদকে শেষ পর্যন্ত দু’টো খেলাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল, মান্টোভাই। পতঙ্গবাজি আর সতরঞ্জ। দু’টো খেলায় একা একা লড়তে হয়, পাশে কেউ থাকে না। দু’টো খেলাতেই চোখ এক জায়গায় আটকে রাখতে হয়-আকাশে আর সাদা-কালো চৌখুপির মধ্যে। না হলেই আপনি হারবেন। খেলায় আমি জিতে গেছি মান্টোভাই; জীবনে শুধু পরাজয়ের পর পরাজয়।
পতঙ্গবাজি, কবুতরবাজির দিনগুলো এখনও বড় মনে পড়ে। সেই সময় আমার তুর্কি রক্তে যেন ঝড় উঠত, মান্টোভাই। কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগত না; হয় আগ্রার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতুম, নয়তো কারো বাড়ির ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতুম; একেক দিন বংশীধরের মহলে অনেক রাত অবধি দাবা খেলে কেটে যেত। কালে মহলের পাশেই একটা বড় হাভেলির ছাদ থেকে আমরা ঘুড়ি ওড়াতুম। আমি, ইউসুফ, কানহাইয়ালাল, আরও অনেকে ছিল, সবার নাম মনে নেই। প্রায়ই রাজা বলবন সিংয়ের সঙ্গে ঘুড়ির প্যাঁচ খেলতুম। যেদিন হেরে যেতুম, মনে হত, আরে সামনেই তো কালকের দিন, কাল বলবন সিংকে হারাবই। মান্টোভাই, আমার শরীরে তুর্কি রক্ত বইছে, রোজ রোজ কি আমি হেরে যেতে পারি? অনেক বছর পর কানহাইয়ালাল দিল্লিতে এসে একটা মসনবি দেখিয়েছিল আমাকে; আমারই লেখা-আট-ন বছর বয়েসে লিখেছিলুম। পতঙ্গবাজির রহস্যের কথা। একদিন মসল্-ই-পতঙ্গ-ই-কাগজি, লে কে, দিল, সর রিস্তা-ই-আজাদগি…