আমি তাঁকে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না সহায়-এর। কোনওমতে বলতে পারল, আমি আর বাঁচব না, মান্টোসাব।
তখন এক অদ্ভুত অবস্থা হয়েছিল, মির্জাসাব। একটা মুসলিম মহল্লায় সহায় রক্তের ভিতরে পড়ে আছে-কোনও মুসলইমই তাকে মেরেছে-আর আমিও একজন মুসলিম, তাঁর মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। কেউ দেখতে পেলে, আমাকে তো তার হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। একবার ভেবেছিলাম, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাব; পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, ও যদি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকেই ফাঁসিয়ে দেয়! দাঙ্গা এভাবেই আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, আমি তখন পালিয়ে যেতে চাইছি।
সহায় আমার নাম ধরে ডাকল। আমি কিছুতেই যেতে পারলাম না। সহায় ওর জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু বার করার চেষ্টা করছিল। শেষপর্যন্ত না পেরে বলল, মান্টোসাব, আমার জামার ভেতরের পকেটে কিছু গয়না আর বারো হাজার টাকা আছে.সবগুলোই সুলতানার..আপনি তো ওকে চেনেন..ওকে ফেরত দিতে যাচ্ছিলাম..দিনকে দিন যা অবস্থা দাঁড়াচ্ছে…কে কোথায় থাকবে, কেউ তা জানে না…আপনি দয়া করে ওগুলো সুলতানাকে দিয়ে দেবেন..বলবেন, ও যেন এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়…হ্যাঁ আপনি.আপনিও কোথাও চলে যান..নইলে বাচবেন না…। সহায়-এর বাকি কথাগুলো তার রক্তের সঙ্গেই ফুটপাতে জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ওর মতো আমিও তো বম্বের রাস্তায় খুন হয়ে যেতে পারতাম। সে এক সময় ছিল, ভাইজানেরা, যখন বাঁচা আর মরার মধ্যে সত্যিই কোন পার্থক্য ছিল না। একদিন মান্টোর বন্ধুরা করাচিগামী জাহাজে তার মৃতদেহ তুলে দিয়ে এসেছিল।
৪৩. মৃতের শহর দিল্লি
জের-এ ফলক্ ভলা তূ রোতা হ্যয় আপকো মীর,
কিস কিস তরহ্ কা আলম য়াঁ খাক্ হো গয়া হ্যায়।।
(আকাশতলায় বসে তুমি নিজের দুঃখ নিয়েই কাঁদছ মীর;
কত সমাজ সংসার এখানে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।।)।
মৃতের শহর দিল্লির দিকে তাকিয়ে কত পুরোন কথাই মনে পড়ত, মান্টোভাই। সেসব দিন তো আমরা দেখি নি, শরিফ আদমিদের মুখে-মুখে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গল্পগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। সব বাস্তবই তো একদিন না একদিন গল্প হয়ে যায়। তারা যেন জাঁহাপনা জাহাঙ্গীরের তসবিরখানার এক-একটা ছবি-কী রং, কী জেল্লা, কী সুক্ষ্মতা-যেন একবিন্দু জলের ভিতরে প্রতিবিম্বিত আশ্চর্য দুনিয়া। মুঘলরা তো শুধু একটা সাম্রাজ্য তৈরি করেনি, লুঠপাট করে এই দেশ থেকে সম্পদ নিয়ে যায়নি। তজীবেরও জন্ম দিয়েছিল। এই তজীব-ই আমাদের শিখিয়েছে, আদব ও আখলাখ ছাড়া কেউ শরিফ হতে পারে না। সুফি কবি খাজা মীর দর্দ বলতেন, আদবের শেষ কথা ছিলেন তার ওয়ালিদ। অন্তরের সৌন্দর্য ফুটে উঠত মানুষটির বাইরের চেহারাতেও। দিল্লির রাস্তা দিয়ে যখন ঘোড়ায় চেপে যেতেন চেনা-অচেনা সবাই এসে তাঁকে কদমবুসি করত। আমরা যে সালাম-আলেকুম সম্ভাষণ করি, শুধুই তো দুটো শব্দ নয়, এই অভিবাদনে বলা হয়েছে, আপনার ওপর খোদার শান্তি বর্ষিত হোক। কত শতাব্দীর আদব এই সম্ভাষণের মধ্যে রয়ে গেছে, ভাবুন তো। দিল্লির মৃত্যু আমার কাছে আদব ও আখলাকের মৃত্যু।
ব্রিটিশদের মধ্যে কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছিল, কেল্লাকে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হোক, জামা মসজিদকে ধুলোয় মিশিয়ে দাও। সেখানে তৈরী হবে রানি ভিক্টোরিয়ার নামে প্রাসাদ আর গির্জা। এতটা না হলেও লাহোর আর দিল্লি দরজার নাম দেওয়া হল ভিক্টোরিয়া ও আলেক্সান্দার গেট। পুরো কেল্লাটাকেই ওরা বানিয়ে ফেলল সেনাছাউনি। জামা মসজিদ আর গাজিউদ্দিন মাদ্রাসারও একই হাল হল। ফতেপুরি মসজিদ বিক্রি করে দেওয়া হল হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছে। জিনাতুল মসজিদে তৈরি হল বিলিতি রুটি বানানোর কারখানা। আমি তখন অন্ধকার কুঠুরিতে বসে কী দেখতে পাচ্ছি জানেন? ওই তো কিলা মুবারক তৈরি হয়ে গিয়েছে। সরকারি। দস্তাবেজে, সবার মুখে মুখে প্রাসাদ দূর্গের নাম কিলা মুবারক-পূণ্য দুর্গ। ১৬৪৮ -এর ১৯ এপ্রিল। জাঁহাপনা শাহজাহান দৌলতখানা-ই-খাস এ প্রবেশ করলেন। জ্যোতিষীরা এই দিনটাই স্থির করে দিয়েছিলেন। সেই উৎসবের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারব না, মান্টোভাই। হিন্দুস্থান, কাশ্মীর, ইরান থেকে কত যে গাইয়ে-বাজিয়ে এসেছিলেন। পেশকার সাদাউল্লা খান যেসব আসবাব ও গালিচা দিয়ে ঘরটিকে সাজিয়েছিলেন, তার দাম নাকি ষাট হাজার টাকা। শুনেছি তিনি একটা কবিতা লিখে খোয়াবগাহ্-র দেওয়ালে খোদাই করে দেন। খোয়াবগাহ্ জানেন তো? সম্রাট সেই বাড়িতে ঘুমাতেন আর খোয়ব দেখতেন। ঘুমোনোর বাড়ির নাম খোয়াবগাহ্; এই নামের সঙ্গে কত কল্পনা জড়িয়ে আছে, ভাবুন মান্টোভাই।
পাথরের বিরাট পাঁচিল ঘিরে রেখেছিল শাহজাহানাবাদকে। যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছিল সাতটা বড় দরজা-কাশ্মীর, মোড়ি, কাবুলি, লাহোরি, আজমিরি, তুর্কোমানি ও আকবরাবাদি। লাহোরি আর আকবরাবাদি ছিল প্রধান দুই দরজা। জাঁহাপনা শাহজাহান জোড়া হাতির মূর্তি বসিয়েছিলেন সেখানে। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব এসে মূর্তিগুলো ভেঙে দিয়েছিলেন। তারপর দিল্লির ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে জানেনই তো মান্টোভাই। নাদির শাহ, মারাঠাদের আক্রমণে দিল্লি বারবার নাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। মীরসাব লিখেছিলেন :