-আশাকে তাই হালাল করে জবাই করতে হয়। আমি হেসে বলি।
-একজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবক আমাকে বলেছিল, ওঁকে বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই, একেবারে পাগল হয়ে গেছেন। তার চেয়ে পাকিস্থানে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ঢুকিয়ে দেওয়াই ভাল। আমি তা চাইনি, মান্টোসাব।
-কেন?
-মেয়েকে ফিরে পাবেন, এই আশাতেই তো বেঁচে ছিলেন তিনি। এই বিরাট পাগলাগারদে তিনি অন্তত নিজের মতো করে ঘুরে-ফিরে মেয়েকে খুঁজে চলেছেন। কিন্তু একটা কুঠুরিতে আটকে ফেললে, উনি তো আর বাঁচবেনই না। শেষবার ওঁকে অমৃতসরে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, মান্টোসাব। তখন ভেবেছিলাম, এবার ওঁকে সত্যিই পাকিস্থানে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ভরে দেব।
-তোমার বিবেকের কামড়ানিটা তা হলে কমত, কি বলো?
-হয়তো।
-তারপর বলো।
-ফরিদ চকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রায় দৃষ্টিহীন চোখে চারপাশে তাকাচ্ছেন আর খুঁজছেন। আমি তখন একজনের সঙ্গে অপহৃত একটা মেয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলাম। মেয়েটা সাবিনিয়া বাজারে এক হিন্দু বানিয়ার সঙ্গে থাকত। এমন সময় দোপাট্টায় মুখ ঢেকে একটি মেয়ে এক পাঞ্জাবি যুবকের হাত ধরে সেই পথে হাজির। বৃদ্ধার সামনে এসেই পাঞ্জাবি যুবকটি দুপা পিছিয়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টানল। মেয়েটির মুখ থেকে হঠাৎ দোপাট্টার আড়াল সরে গিয়েছে আর ঝলসে উঠল তার গোলাপি মুখ। মান্টোসাব, সেই মুখের সৌন্দর্য আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না।
-জানি।
-মানে?
-আমরা সেই ভাষা ভুলে গেছি, ভাই। তারপর বলো।
-আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, পাঞ্জাবি যুবকটি মেয়েটিকে বলল, ওটাই তোমার আম্মিজান। মেয়েটা একবার ফিরে তাকাল বৃদ্ধার দিকে, তারপর যুবকটিকে বলল, তাড়াতাড়ি চলো। আর তখনই বৃদ্ধা চিল্কার করে উঠলেন, ভাগভরী! ভাগভরী! আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, কী হয়েছে?
-আমি ওকে দেখেছি, বেটা।
-কাকে?
-ভাগভরী- আমার বেটি। ওই তো চলে গেল।
-ভাগভরী কবেই মারা গেছে আম্মিজান। বিশ্বাস করুন, আপনার বেটি আর বেঁচে নেই। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর চওকের রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন। নাড়ি টিপে দেখলাম, তিনি মারা গেছেন।
-খোদা কখনও তাঁর এতিম কে দয়া করবেন না, তা কখনও হয়?
-দয়া? এই-ই খোদার দয়া?
-মৃত্যুই তার সেরা দান, ভাই।
দাঙ্গার দিঙ্গুলিতে যে-মৃত্যু আমাদের কাছে এসেছিল, তা তো খোদার দান নয়, ভাইজানেরা। তাদের জন্য জানাজা হয় নি; শুনতে পাবেন, এখনও তাদের অতৃপ্ত আত্মারা ডানা ঝাপটায় তাদের হাত-পায়ের শিকলের ঝনঝন শোনা যায়-এখনও কাসিম পুরনো দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, চিৎকার করে ডাকে, শরিফান-শরিফান—
বম্বের জে জে হসপিটালের সামনের ফুটপাতে সহায়-এর মৃত্যুযন্ত্রণার স্বর এখনও চাপা পড়ে আছে, আমি জানি। ফরিস্তারা হয়তো সহায়-এর মতো মানুষ হয়েই এই দুনিয়াতে আসেন। সহায় দালাল-হ্যাঁ, বেশ্যাদের দালাল। কিন্তু তার মতো নিষ্ঠাবান হিন্দু আমি দেখিনি, ভাইজানেরা। সহায়-এর বাড়ি ছিল বেনারসে। এমন নিখুঁত মানুষ খুব কম দেখা যায়। একটা ছোট্ট ঘরে বসে সে ব্যবসা চালাত, কিন্তু পরিচ্ছন্নতার অভাব ছিল না কোথাও। সহায়-এর মেয়েদের খদ্দেরদের জন্য বিছানা ছিল না; মাদুরের ওপর চাদর পাতা আর বালিশ। চাদরে কখনও নোংরা লেগে থাকতে দেখিনি। একজন চাকর ছিল, তবু সহায় নিজেই দেখেশুনে সব পরিস্কার রাখত। আমি জানি, মির্জাসাব, ও কখনও কাউকে মিথ্যে কথা বলেনি, কাউকে ঠকায় নি। একবার আমাকে বলেছিল। মান্টোসাব, তিন বছরে আমি কুড়ি হাজার টাকা রোজগার করেছি।
-কী করে?
-মেয়েরা তো দশ টাকা করে পায়। আমার কমিশন আড়াই টাকা।
-তাহলে তো অনেক টাকা জমিয়েছ।
-আর দশ হাজার টাকা হলেই আমি কাশীতে চলে যাব।
-সে কী? কেন?
-একটা কাপড়ের দোকান খুলব। এই ধান্দাতে আর থাকব না।
কাপড়ের দোকান কেন? অন্য ব্যবসাও তো করতে পার। সহায় কিছু বলেনি। সে নিজেই যেন জানত না, কেন কাপড়ের দোকান খুলতে চায়। মাঝে মাঝে সহায়ের কথা। শুনে মনে হত, লোকটা একটা বুজরুক, ফ্রড। কে বিশ্বাস করবে বলুন, যে মেয়েদের ও ব্যবসায় খাটায়, তাদের নিজের কন্যাসম মনে করে? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েগুলোর জন্য সহায় পোস্ট অফিসে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। দশ-বারোটা মেয়ের থাকা-খাওয়ার খরচও সে দিত। আমার হিসাব কিছুতেই মিলত না। সহায়-এর ছোট্ট কোঠায় সবাইকে নিরামিষ খেতে হত। তাই সপ্তাহে একদিন সে মেয়েদের ছুটি দিত বাইরে গিয়ে আমিষ খেয়ে আসার জন্য। একদিন আমি যেতেই সহায় খুশিতে ফেটে পড়ল, মান্টোসাব,দাতা সাহেব আমাকে দয়া করেছেন।
-মতলব?।
-ইরফান এই কোঠায় আসত, মান্টোসাব। চন্দ্রার সঙ্গে ওর খুব ভাল-ভালবাসা হয়ে গেল। তা। ওদের বিয়ে দিয়ে দিলাম। চন্দ্রা এখন লাহোরে থাকে। আজই চিঠি এসেছে, দাতা সাহেবের দরগায় আমার জন্য দোয়া করেছিল। দাতা সাহেব নাকি চন্দ্রার কথা শুনেছেন। বাকি দশ হাজারের জন্য আমাকে আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এরপর সহায়-এর সঙ্গে বেশ কিছুদিন দেখে হয় নি। শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। কারফিউ চলছে, রাস্তায় লোকজন, ট্রাম-বাস নেই। একদিন সকালে আমি ভিন্ডিবাজারের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। জে জে হসপিটালের কাছে এসেই দেখলাম, একটা লোক ফুটপাথে পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। দাঙ্গার আরেক শিকার। হঠাৎ দেখলাম, শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাস্তায় কেউ কোথাও নেই। আমি ঝুঁকে পড়ে লোকটার দিকে তাকালাম। আরে, এ যে সহায়, রক্তের কুয়াশা ছড়িয়ে আছে তার মুখে। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে যখন উঠতে যাব, তখনই সহায় চোখ মেলে তাকাল।-মান্টোসাব—