না, তা কি হতে পারে? কিভাবে হৃদয় থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে, আমি দিনের পর দিন দেখে গেছি। ছোটবেলার। কয়েকটা কথা তবে আজ আপনাকে বলি। তখন থেকেই তো রক্ত চুইয়ে পড়ছে, আর জমাট বেঁধে আমার বুকের ভেতরে এক একটা পাথর তৈরী হয়েছে। মীরসাব একটা শের-এ কী বলেছিলেন জানেন তো?
হুঁ শমা-এ আখির –এ শব, সুন সরগুজ মেরী,
ফির সুবহ্ হোনে এক তো কিস্সা হী মুখৎসর হ্যায়।।
সত্যিই তো আমি শেষ রাত্রির চিরাগ। ভেবে দেখুন, আমি যখন জন্মালুম, তখন একটা সাম্রাজ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। কতবার স্বপ্ন দেখেছি, যদি জাঁহাপনা আকবরের সময়ে জন্মাতুম; জাঁহাপনা। জাহাঙ্গীর, শাজাহানের সময়ে জন্মালেও আমাকে সারা জীবন এমন রাস্তার কুকুরের মতো কাটাতে হত না। খোদা আমাকে পাপের জন্য এমন নরকে এনে ফেললেন, যখন দরবার। বলতে আছে সামান্য খুদকুঁড়ো। আর ওই বাহাদুর শাহ, এক লাইনও গজল লিখতে পারতেন না, তাঁর খিদমতগারি করতে হল আমাকে।তবে কিনা আল্লা রহিম, তাঁর হয়তো আমার জন্য। এই ইচ্ছাই ছিল।
আমি আমার ওয়ালিদকে কখনও দেখিনি। আনেকে বলত, তাঁর সঙ্গে নাকি আমার অনেক মিল আছে। একটু বড় হওয়ার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মুখের প্রতিচ্ছবিতে আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুরকে খুঁজতুম। কোথায়, কোন যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন তিনি, আম্মাজান তাঁর মরা মুখটাও দেখতে পাননি। একটা মানুষ হঠাৎই হারিয়ে গিয়েছিলেন, কোন চিহ্ন ছিল না তাঁর, কেউ তো তাঁর তসবিরও এঁকে রাখেনি যে তাঁকে মনে পড়বে। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেবের সময় থেকে তো তসবির আঁকাকে হারাম মনে করত সবাই। না হলে ভাবুন, মুঘল দরবারের মত তসবিরখানা দুনিয়ার আর কোথাও কেউ কখনও দেখেছে? পারস্যের মতো মুসাব্বিররা আর কোথায় জন্মেছে বলুন তো? আপনি বিঞ্জাদের নাম শুনেছেন? হাজার বছরেও অমন একজন। শিল্পী জন্মান কি না সন্দেহ হয়।
হায়, আমার আম্মাজান। তাঁর জন্য একটা তসবিরও রইল না। আম্মাজানের কথা জানলে আমার শৈশব-কৈশোরকে বুঝতে পারবেননা মান্টোভাই। অনেক পরে, আমি যখন বুড়ো হতে চলেছি, আম্মাজানের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হত, তাঁর জীবন আসলে একটা শব্দ : অপেক্ষা। অপেক্ষার রং নীল, জানেন তো? বিষাদ থেকে চুইয়ে পড়া নীল রং। অপেক্ষা ছাড়া তাঁর জীবনে আর কী ছিল বলুন? তাঁর নিজের কোনও সংসার ছিল না, মহল ছিল না। তিনি শুধু অপেক্ষা করে থাকতেন, কবে আমার ওয়ালিদ আসবেন। হয়তো কয়েকদিনের জন্য আসতেন তিনি। কয়েকটা রাত্রি কাটাতেন আম্মাজানের সঙ্গে। তাই আমি, ইউসুফ, ছোটি খানম পয়দা হয়েছিলুম। আমাদের মাঝে আর কেউ জন্মেছিল কি না জানি না। মাঝে মাঝে এ-ও মনে হয়, আবদুল্লা বেগ খান সত্যি সত্যিই আমাদের ওয়ালিদ তো? কালে মহলের দেওয়ালে কান পাতলে নাকি অনেক গোপন কিস্সা শোনা যেত। সে যাক গে। দিল্লি-আগ্রা মানেই তো কিস্সা।
আম্মাজানকে নিয়ে আমার একটা দস্তান লেখার ইচ্ছে ছিল, মান্টোভাই। কিন্তু দস্তান লেখা তো সহজ কাজ নয়। মুটে-মজুর যেমন কাজ করে, সেইভাবে লিখে যেতে হয়। আমার সে ক্ষমতা কোথায়? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, আমি দস্তষু লিখেছি, এত খতুত্ লিখেছি, তাহলে আম্মাজানকে নিয়ে দস্তানটা লিখতে পারতুম না? হয়তো পারতুম। মাঝে মাঝে কলম নিয়ে বসতুমও, কিন্তু কী এক ক্লান্তির অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরত, আমি একটা শব্দও লিখতে পারতুম না-আমার চোখ জলে ভরে যেত-মনে হত, এই দুনিয়ায় কোনও ঘর ছিল না আমাদের আম্মাজানের।
একদিনের কথা বলি আপনাকে। হটাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দেখলুম, ঘরের এককোণে চৌকিতে বসে আছেন আমার ওয়ালিদ আর আম্মাজান। তিনি আম্মাজানের দু’হাত ধরে আছেন; তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা রক্তমাখা তলোয়ার। বাইরে থেকে ভেসে আসছিল হ্রেষাধ্বনি, ঝড়ের আওয়াজের মতো একটানা। আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুরের বুকে মাথা রেখে আম্মাজান।
-এত ভয় পাও কেন? আব্বাজান জিজ্ঞেস করেছিলেন।
-জনাব, আপনি কোথায়, কখন থাকেন, জানতে পারি না। তাই—
-আমি অনেক দূরে থাকি বিবিজান।
-কোথায়?
-যেখানে শুধু রক্ত আর রক্তের স্রোত। আব্বাজানের গলায় ক্লান্তির কুয়াশা।
-আপনি আবার কবে আসবেন জনাব?
-জানি না। যদি কখনও মরে যাই, দুনিয়ায় আমার কবর খুঁজো না বিবিজান। তোমার দিল-এ গোর হবে আমার।
-জনাব–
-বিবিজান।
-আমাদের মহল হবে না কখনও?
-যদি শেষবার ফিরে আসি।
-কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগে না, জনাব। এ তো আমার ঘর নয়। আপনার মহল হবে না? আব্বাজান হা-হা করে হেসে উঠলেন, ‘আমার মহল যুদ্ধক্ষেত্রে। তুমি কখনও সেখানে যেতে পারবে না।’
-আমি যাব।
-কোথায়?
-আপনার সঙ্গে জনাব। আপনি যেখানে যাবেন, সেখানেই আমার মহল। আমি দেখলুম, আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুর আম্মাজানকে আরো কাছে টেনে নিলেন। আম্মাজানের প্রতি তিনি এমনভাবে তাকিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল মরুভূমির আকাশে যেন মেঘ। ঘনিয়ে এসেছে। আপনি কখনও বারোমাসা তসবির দেখেছেন মান্টোভাই? কী সব তসবির যে এক কালে দেখেছি, কী সব কিতাব, সে-ও এক একটা তসবির। আমির হামজার দস্তানের কিতাব দিয়ে শুরু হয়েছিল-জাঁহাপনা আকবরের সময়ে-সেই কিতাবের ছবি এঁকেছিলেন মীর সৈয়দ আলি। জাঁহাপনা হুমায়ুন তাঁকে পারস্য থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সম্রাটদের প্রাসাদের কারখানায় কত যে মুসাব্বির ছিলেন, তাঁরা সব পারস্য থেকে আসতেন। খাজা আবদুস সামাদকে বলা হত ‘শিরিন কলম’। কত কত ছবিওয়ালা কিতাবের জন্ম হয়েছিল। রামায়ণ, মহাভারত, নল-দয়মন্তীর কিতাবও ছিল; আর, হ্যাঁ, কেশবদাসের রসিকপ্রিয়া। সে এক আশ্চর্য কিতাব মান্টোভাই। রসিকপ্রিয়া’তে কতরকম নায়িকার কথাই না বলেছেন কেশব দাস, মুসাব্বিরা একের পর এক নায়িকাদের ছবি এঁকে গেছেন। কী যে সৌন্দর্য সেই নায়িকাদের, যেন পূর্ণ চাঁদের আলো। চকোর পাখি পূর্ণিমার আলো খেয়ে বেঁচে থাকে জানেন তো? পূর্ণিমায় এক নায়িকাকে দেখে তো চকোর পাখির বেভুল অবস্থা; কোন চাঁদের আলো দেখবে সে, বুঝতেই পারে না। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব সব শেষ করে দিলেন। তসবির ছিল তাঁর কাছে হারাম। মুঘল কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শাহজাহানাবাদ ছেড়ে মুসাব্বিররা পাহাড়ি দেশের রাজাদের দরবারে কাজ নিয়ে চলে গেলেন। দিল্লির তসবিরখানা শূণ্য হয়ে গেল; যেটুকু খুদকুঁড়ো পড়ে ছিল, তাও ধুয়েমুছে সাফ করে দিল নাদির শাহ আর মারাঠারা, তারপর গোরারা। নাদির শাহ দিল্লি লুঠ করে চলে যাওয়ার পর মীরসাব কি লিখেছিলেন জানেন?