-জি আজাদি। আমার জন্য আজাদি নিয়ে আসবেন মিঞা। পাখি বলে।
-আজাদি? সওদাগর হেসে ওঠে।-তার মানে তো তোকে ছেড়ে দিতে হবে। তা কখনও হয়? অন্য কিছু বল।
-তাহলে যে বনে আমি থাকতাম সেখানে একবার যাবেন। ওখানকার পাখিদের আমার কথা বলে আসবেন। জেনে আসবেন, ওরা কেমন আছে?
-বেশ। তুই চিন্তা করিস না। সক্কলের খবর নিয়ে আসব আমি।
সওদাগর বানিজ্যে চলে গেলেন। সব কাজ শেষ হওয়ার পর মনে পড়ল, পাখির পরিজনদের খোঁজ নেওয়ার কথা। বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর খাঁচার পাখিরই মতো একটা পাখি দেখতে পেলেন তিনি। সওদাগর তাঁর খাঁচার পাখির কথা বলতেই বনের পাখিটা ঝপ করে নীচে পড়ে গেল। সওদাগর বুঝলেন, এতদিন পরে আত্মীয়ের খবর পেয়ে পাখিটা মারা গেছে। খুব দুঃখও হল তাঁর; ইস্, পাখিটা আমার জন্যই মারা গেল।
একদিন দেশে ফিরে এলেন সওদাগর। খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পাখি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছে আমার বন্ধুরা? মিঞা, ওদের কথা বলুন।
-কী বলব, বল? তোরই মতো দেখতে একটা পাখিকে তোর কথা বলতেই ঝপ করে গাছ থেকে পড়ে মরে গেল।
সওদাগরের কথা শুনেই তাঁর পাখিও ডানা মুড়িয়ে, চোখ বুজে খাঁচার নীচে পড়ে গেল। আঙুল দিয়ে অনেকবার খোঁচাতেও পাখিটা নড়ল না। পাখিকে খাঁচা থেকে বার করে তার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে সওদাগর ভাবল, খবরটা না দিলেই ভাল হত, বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে আমার পাখি তাহলে এভাবে মরত না। পাখিটাকে সে জানলার উপর রেখে দিয়ে এল।
সঙ্গে সঙ্গেই পাখি উড়ে গিয়ে বসল সামনের গাছের ডালে। সওদাগর তো অবাক, সে ছুটে গিয়ে গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল, পাখিকে ডাকতে লাগল। পাখিটা তখন উড়তে উড়তে বলছিল, ‘আমার বন্ধু মরেনি মিঞা। কীভাবে আবার উড়তে পারব,সেই পথটাই সে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে। খবরটা আপনিই আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন মিঞা। সালাম।
বলতে বলতে সেই পাখি অনেক দূর উড়ে গেল।
-এই কিস্যাটা শোনার পর আসাদ সেই দরবেশকে কী বলেছিল, তুমি জান আবিদ মিঞা? মির্জা গালিব বললেন। -না হুজুর।
-এই জীবন যে কী, তা আজও বুঝতে পারলাম না, আবিদ মিঞা। দস্তানও তাকে ছুঁতে পারে না। শুধু কুয়াশা-তা ছাড়া কিছু নেই। তাহলে শোনো, পরের কিস্সাটা তোমাকে বলি।
-কোন কিস্সা হুজুর?
-আসাদ সেই দরবেশকে বলেছিল, আপনার সঙ্গে আমাকে নিয়ে চলুন, খিদ্র।
-কোথায়? দরবেশ বললেন।
-আপনি যেখানে যাবেন।
তিনি অনেকক্ষণ আসাদের মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কী বললেন, সে জানে না। যমুনার তীরে, রোদুরে বসেও আসাদের বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। একসময় দরবেশ বললেন, ‘তুই কোথাও যাস না আসাদ। তোর ওয়ালিদ, তোর হাতে তলোয়ার তুলে দিয়ে যাননি। তুই কখনও তলোয়ার চালাতে পারবি না আসাদ। তলোয়ার চালানো বড় কঠিন কাজ; এক একটা কোপের সঙ্গে তুইও মরবি আসাদ।
-তাহলে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন আমাকে। আসাদ বলে।
-কোথায়?
-আপনি যেখানে যাবেন। আমিও আপনার মতো দরবেশ হব।
-সে-পথ তোর নয় আসাদ। বলতে বলতে তিনি তাঁর ঝোলা থেকে একটা আয়না বের করে আসাদের হাতে দিলেন। আয়নায় ফুটে ওঠে আসাদের ঝাপসা মুখ।
-মোছ, ভালো করে মোছ আয়নাটা।
আসাদ আয়নাটা মুছতে থাকে। দরবেশ দুলে দুলে গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন।
-তারপর আবিদ মিঞা?
-আসাদ তো আয়নাটা মুছেই চলেছে; যত মোছে ততই ঝকঝক করতে থাকে আয়না।
একসময় দরবেশের গান থামল। তিনি বললেন, ‘আয়নায় একবার তাকিয়ে দেখ।‘
আসাদ আয়নার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। আয়নায় তো তাকেই দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু সে নেই, আয়নার ভিতরে ফুটে উঠেছে আম্মাজানের পশমিনার মতো নীল আকাশ। পশমিনাতে যেমন কতরকমের নকশা, এখানেও তাই, এই আকাশে জেগে আছে পাখিদের নকশা। একটা বড় পাখির পিছন উড়ে যাচ্ছে অগুনতি পাখি, তাদের হরেক রং আর চলনে তৈরী হয়ে উঠেছে নকশাটা। আসাদ মুখ তুলে দরবেশের দিকে তাকাল।
দরবেশ বললেন, ‘ওই পাখিটাকে চিনিস।
-না।
-ও হল গিয়ে হোদহোদ। আর ওই যে পাখিদের দেখছিস, ওরা হোদহোদের সঙ্গে চলেছে ওদের রাজার খোঁজে।
-ওদের রাজা কে?
-সিমুর্গ।
-সে কোথায় থাকে?
-কাফ পাহাড়ে।
-সিমুর্গকে পেলে কী হবে?
-তুই পরে বুঝতে পারবি। আয়নাটা যত মুছবি, ততই দেখতে পাবি, পাখিরা একের পর এক উপত্যাকা পেরিয়ে যাচ্ছে। সাতটা উপত্যাকা পেরোতে হবে ওদের। তারপর একদিন সিমুর্গকে দেখতে পাবি। ততদিন পর্যন্ত তোকে লিখে যেতে হবে।
-কী লিখব?
ইসকের কথা। সেই ইককে তুই কখনও পাবি না, কিন্তু তার কথাই তোকে লিখতে হবে আসাদ।
-তারপর আবিদ মিঞা? মির্জা গালিবের চোখ যেন কোনও শূন্য প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই প্রান্তর জুড়ে শুধু জেগে আছে কাঁটাঝোপ।
০৫. অরূপের সমুদ্রে আমার তরী ভাসাল
গুল ও আঈনহ্ কেয়া খুরশীদ ও ম্যহ্ কেয়া
জির দেখা তিধর তেরা হী রূ থা।।
(ফুলের দিকে তাকাই, আয়নার দিকে তাকাই,
চন্দ্ৰসূর্যের দিকে তাকাই।
যেদিক তাকাই, তোমারই মুখ দেখতে পাই।)
অরূপের সমুদ্রে আমার তরী ভাসাল, মান্টোভাই। যাকে কখনও দেখা যায় না, তার পেছনে আমার সারা জীবনের দৌড় শুরু। তারপর থেকে কলমই আমার নিশান। আমার কলমগুলো কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল জানেন? আমার যোদ্ধা পূর্বপুরুষদের ভাঙা তির দিয়ে। যেদিন প্রথম একটা শের লিখলুম, মনে হল, অনাদি-অনন্ত থেকে যেন আমি কবিতার বীজ বুকে নিয়েই এসেছি। কবিতা তো চেষ্টা করে লেখা যায় না; যায় বলুন? কবিতা যার কাছে আসে, সে-ই শুধু পারে। কিন্তু কেন সে আসে, কী ভাবে আসে, তা তো আমরা জানি না। আমার কী মনে হয় জানেন, হাজার হাজার দারুন গজল লিখলেও তাকে কবি বলা যায় না, কিন্তু এমন একটা। শেরও যদি সে লিখতে পারে, আর্তনাদের মতো, যাতে তার হৃদয়ের সব রক্ত লেগে আছে, তবেই তাকে কবি বলতে পারি আমরা। কবিতা তো মসজিদে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া নয়; খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ানো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ কয়েকটা কথা বলা। মান্টোভাই, রক্তমাখা কাগজে আমি আমার ইস্কের কথা লিখে গেছি দিনের পর দিন, আমার হাত অবশ। হয়ে গেছে, তবু লিখে গেছি। আমি জানতুম, একদিন আমার গজল অনেক মানুষকে আশ্রয়। দেবে। গর্ব নয় মান্টোভাই, ক্ষত-আমার ক্ষতর পর ক্ষতের কথা লিখে গেছি-তা কাউকে ছোঁবে।