-জি হুজুর।
মির্জা গালিবের কদমবুশি করে আবিদ মিঞা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর বলে, ‘চোখে জল আসে জনাব, যখন তাকে দেখি।
-কাকে?
-আসাদ মিঞা।
-কেন, চোখে জল আসে কেন?
-সবে ন’বছর বয়স, ওয়ালিদ নেই, দেখভাল করার চাচাও কবরে চলে গেল, আসাদ মিঞা একা একা কালে মহলে ঘুরে বেড়ায়।
-একা একা?
-জি হুজুর। শুনেছি সে নাকি মহলে কারো সঙ্গে কথা বলত না। কেউ কথা বললেও উত্তর দিতে চাইত না। সে ঘুরে বেড়াত, কখন আম্মাজানের সঙ্গে দেখা হবে। একা একা আগ্রার গলির পর গলিতে দৌড়াত। তাজমহলের সামনে গিয়ে বসে থাকত। রোজ রাতে মহলের ছাদে উঠে বসে থাকত, তারা গুনে যেত।
-আসাদ তারা গুনত না, মিঞা।
-তবে? আপনি জানেন হুজুর?
-তাহলে কে জানে? কাল্লু চিৎকার করে ওঠে।-হুজুর ছাড়া কে জানে, মিঞা?
-কী করত আসাদ?
-একটা তারা খুঁজত।
-কোন তারা জি?
-যে তারা থেকে আসাদকে দুনিয়াতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তার ইসক।
-তারাটা চিনতে পেরেছিল আসাদ?
-না, মিঞা। তারায় একরকম জীবন, আর এই দুনিয়ায় আরেক রকম। দুনিয়ায় এলে তারাটাকে আর চেনা যায় না। কী করেই বা চেনা যাবে? তারারা কত খতরনক, তুমি জানো আবিদ মিঞা? আকাশে আজ রাতে যে -তারাটাকে তুমি জ্বলতে দেখবে, সে আসলে কয়েক। লক্ষ বছর আগে মরে গেছে। এতদিনে তার আলো এসে পৌঁছল আমাদের দুনিয়ায়। কী করে বুঝবে বলো, কোন তারায় তোমার ঘর ছিল? তুমি তার চেয়ে কিস্সাটা বলো মিঞা।
-জি হুজুর। একদিন আসাদ ঘুরতে ঘুরতে তাজমহলের পাশে যমুনার তীরে এসে বসেছে। বেশ কয়েকদিন আম্মার সঙ্গে দেখা হয় না তার। তাকে তো থাকতে হয় দিবানখানায়; মহলসরা থেকে আম্মা ডাকলে তবেই যেতে পারবে। আম্মা তাকে ডাকে না কেন? সে বেশীর ভাগ সময় মহলসরার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, আর ধমক শোনে, এখানে কেন রে আসাদ? জেনানামহলের সামনে ঘুরে বেড়াস কেন? তোর আর কোনও কাজ নেই? সে মহলের ছাদে উঠে যায়, রাগে ফুসতে থাকে, একা একা কথা বলে, আব্বাজান, কোথায় তুমি, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় চলে গেছ, আর কখনও ফিরবে না, আমাকে এই মহলে রেখে গেলে… আব্বাজান, ওরা তো আম্মার সঙ্গেও দেখা করতে দেয় না, কেন দেয় না আব্বাজান?
-কেন দেয় না মিঞা?
-কেন হুজুর?
-দস্তান বলছো তুমি, আর তুমিই জানো না? মির্জা গালিব হা-হা করে হেসে ওঠেন।
-ওয়ালিদ তো আসাদের জন্য কিছু রেখে যায়নি জাঁহাপনা। আবদুল্লা বেগ খানের ঘর ছিল না; ঘর থাকলে তবেই না বিবির কথা; তবেই না আসাদ তার আম্মাজানকে পাবে। কেমন যে। নিকাহ্ হয়েছিল আবদুল্লা আর আসাদের মায়ের। কে কাকে কতটুকু পেয়েছিল বলুন? আবদুল্লার তো দিন কাটত এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে; আসাদের মা কালে মহলে শুধু অপেক্ষায় দিন কাটাতেন। তারপর একদিন আবদুল্লার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছল। খবরটুকু মাত্র, হুজুর। আবদুল্লা বেগ খান যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কোথায় কোন অচেনা দেশে তাকে গোর দেওয়া হয়েছিল কে জানে! তুর্কীদের এক আজিব তরিকা ছিল হুজুর, জানেন তো? কেউ মারা গেলে তার তলোয়ার পেত ছেলে আর বাড়িঘর-সম্পত্তি পেত মেয়ে। আবদুল্লা বেগ কোথায় হারিয়ে গেল; আসাদ আর তলোয়ার পেল না। বাড়িঘর সম্পত্তি বলতে তো কিছুই ছিল না আবদুল্লার।
-আবিদ মিঞা
-হুজুর।
-সেই দিনটার কথা ভুলে গেলে?
-কোন দিন হুজুর?
-আসাদ তাজমহলের পাশে যমুনার তীরে গিয়ে বসল। তারপর কী হয়েছিল মিঞা?
-গোস্তাকি মাফ করবেন হুজুর। দস্তানের কখন যে কী মর্জি হয়, বুঝতে পারি না। হুজুর, আমার চাচা বলত, দস্তান বড় আজিব, তুমি যদি ভাবো, এই পথে যাব, একটু পরেই দেখবে, দস্তান তোমাকে অন্য পথে নিয়ে গেছে।
-ঠিকই তো বলত। মির্জা গালিব হাসেন।-গোরাদের ইতিহাসই শুধু সোজা, একটাই পথ ধরে চলে। দস্তানের তো হাজার হাজার পথ। আমির হামজার দস্তান শোনেননি?
-জি হুজুর। ওই যে বলে না
মৎ সহল হমেঁ জানো, ফিরতা হ্যয় ফলক বরসোঁ
তব খাককে পর্দেসে ইনসান নিকলতে হয়।।
-ঠিক, ঠিক মিঞা। আমরা সামান্য না কি? কত কত বছর-হাজার-লক্ষ বছর ধরে নক্ষত্রমণ্ডলী ঘুরেছে, তারপরেই না মাটির পর্দা ঠেলে মানুষের জন্ম হয়েছে। কিস্সা কি কখনও একটা সোজা পথে চলতে পারে?
-আসাদ যমুনার তীরে বসেছিল হুজুর। শুনেছি, তাজমহল নাকি আসাদের তেমন ভাল লাগত
না।
-কেন ভাল লাগবে, মিঞা?
-হুজুর
-মমতাজমহলের সমাধি কোথায় জান? বুরহানপুরে। কেউ সেখানে যায় না। ছোট একটা সমাধি। তাহলে তাজমহল বানানো কেন? এসব রাজা-বাদশার খেয়াল মিঞা। আর যদি মহলের সৌন্দর্যের কথাই বলল, তবে ফতেপুর সিক্রির পাশে তাজমহল দাঁড়ায় না। আর জামা মসজিদের কথা যদি বলো, সে তো জন্নতের ফুল। –
যমুনার নীল জল থেকে এক দরবেশ উঠে এলেন। আবিদ মিঞা চোখ বড় বড় করে বলে।
-মিঞা, তুমি কি খোয়াব দেখ? যমুনার জল থেকে দরবেশ উঠে এলেন?
-জি হুজুর। দরবেশ-ফকিররা কোথায় না থাকে, হুজুর?
-তারপর?
-দরবেশ আসাদকে বললেন, তুই একা একা ঘুরে বেড়াস কেন আসাদ? তুই পাখি হবি?
-আমাকে পাখি বানিয়ে দেবেন? আসাদ অবাক হয়ে দরবেশের দিকে তাকায়।
-দেবো। দরবেশ আসাদের মাথায় হাত রাখেন।-আশমানে উড়ে যেতে চাস না? সেই পাখিটার গল্প বলি, শোন। এক সওদাগরের খাঁচায় ছিল তার প্রিয় পাখি। একবার সওদাগর ব্যবসার। কাজে ভারতবর্ষে যাবে। পাখিটাকে এক সময় ভারতবর্ষ থেকেই এনেছিল সে। যাওয়ার আগে সওদাগর খাঁচার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর জন্য কী নিয়ে আসব, বল।