-আরে, আসল দস্তান তো বলো। কাল্লু লোকটাকে কাঁধ ধরে ঝাঁকায়।
-সে এক বিরাট মহল। কালে মহল। খাজা গুলাম হুসেন খানের মহল। ইয়া ফটক, মহলের ভিতরে বিরাট চবুতরা, সেই চবুতরায় কত রকমের খাঁচা, মোর দ্যাখো, হিরণ দ্যাখো, কত রকমের পাখি, একটা খাঁচায় নাকি তোদহোদও ছিল।
আমি হা হা করে হেসে উঠলুম।-হোদহোদ? আরে সে পাখীর কথা তো কোরানে লেখা আছে, সোলয়মানের কাছে ছিল। সেই হোদহোদ তুমি খাজা গুলাম হুসেন খানের মহলে দেখেছ মিঞা?
-আমি দেখিনি। তবে অনেকে বলে দেখেছে।
-বেশ, তারপর?
-খাজা গুলাম হোসেন খানের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আবদুল্লা বেগ খানের। তিনি কখনও লখনউতে, কখনও হায়দারাবাদে, কখনও আলোয়ারে-নবাব-রাজাদের সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন তো। তাঁর নিজের ঘরবাড়ি ছিল না। মির্জা আসাদুল্লার জন্ম হয়েছিল কালে মহলেই।
-মির্জার পাঁচ বছর বয়েসে তার ওয়ালিদ যুদ্ধে মরেছিল, তাই না?
-হুজুর, জানেন?
-কিছু কিছু শুনেছি। মির্জা গালিব বলে কথা, তার কিস্সা তো হাওয়াতেই উড়ে বেড়ায়। তারপর?
-মির্জার চাচা ছিলেন নসরুল্লা বেগ খান। তিনি-–
বখোয়াস বন্ধ করো। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম।–তোমার কাজ কী? বলো, কী কাজ?
-জি, আমি তো দস্তান বলি।
-ইয়ে দস্তান হ্যায়? কে জানতে চায় নসরুল্লা বেগের কথা? যারা ইতিহাস লেখে, তাদের ওসব বলো গিয়ে। ওসব জেনে আমার লাভ কী? হঠো, হঠো, ইধর সে।
-হুজুর। কাল্লু এবং লোকটা আর্তনাদ করে ওঠে।
-আমি জানি। হাসতে হাসতে তাঁকে বললুম।
-জি হুজুর। লোকটা আমার পা জড়িয়ে ধরে।
-আমি জানি, সেই পাঁচবছর বয়স থেকে নিকাহ্ হওয়া পর্যন্ত আসাদুল্লা কীভাবে কালে মহলে থাকত।
-বলুন হুজুর। কাল্লু এবার আমার হাত চেপে ধরে।
-মির্জা একটা গজল লিখেছিল অনেক পরে। শুনে রাখ, কালে মহলের সেই দিনগুলো–
নওম্মীদী-এ মা গার্দির্শ-এ আয়াম নহ দারদ্;
রোজ কেহ্ সিয়হ্ শুদ সহর ও শাম নহ্ দারদ্।।
(আমার ঘন নৈরাশ্যের মধ্যে কালের গতি রুদ্ধ;
যে-দিন মিশকালো তার প্রভাতই বা কী, সন্ধ্যাই বা কী।।)
মান্টোভাই, আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে এবার একটু শুয়ে থাকতে দিন। তারপর না হয় আপনার কথাগুলো শোনা যাবে। কবরে শুয়ে এইসব খোয়াব কতদিন দেখতে হবে, কে জানে!
০৪. মির্জাসাবকে একটু ঘুমোতে দেওয়া দরকার
একদিন মসল-ই-পতঙ্গ-ই কাগজি,
লে কে, দিল, সর রিস্তা-ই-আজাদগি
(একদিন আমার হৃদয়, ঘুড়ির মতো
মুক্তির পথে উড়ে যেতে চেয়েছিল)
মির্জাসাবকে একটু ঘুমোতে দেওয়া দরকার। আরও আরও মৃতরা, যাঁরা আমাদের আশেপাশে শুয়ে আছেন, আমাদের দুজনের কথা আপনারা শুনছেন, চলুন এবার আমরা উড়ে যাই, বাল্লিমারোঁ মহল্লায়, কাসিম জানের গলিতে মির্জাসাবের বাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ব আমরা, চলুন, চলুন, উঠে পড়ুন, মির্জাসাব আর কাল্লুকে দস্তানগো যে-কিস্সাটা বলছিল, লুকিয়ে লুকিয়ে তা শুনে আসা যাক। সত্যি বলতে কী, লুকনোর তো প্রয়োজন নেই আমাদের, কেই বা। আমাদের দেখতে পাবে? তবে মির্জাসাব টের পেলেও পেতে পারেন, শুনেছি সারা রাত ঘুমের মধ্যে নাকি উনি মৃতদের সাথে কথা বলতেন।
কাল্লু মির্জাসাবের হাত ধরে বলে চলেছে, বলুন হুজুর, আপনার মুখেই মানাবে ভাল।
-না। এই মিঞাই বলুক। কিন্তু তোমার নামটা তো জানা হল না মিঞা।
-জি বান্দার নাম আবিদ।
-বলো, আবিদ মিঞা। মির্জা গালিবের কিস্সাটা তোমার মুখ থেকেই শোনা যাক।
-এ হুজুর আমাদের কিস্সা।
-আসাদ?
-জি। তখনও তো মির্জা গালিব হননি। আগ্রায় সবাই তাকে আসাদ বলে ডাকত। গোস্তাকি মাফ করবেন হুজুর, নসরুল্লা বেগ খানের কথাটা
-আবার?
-কিন্তু ওয়ালিদ মরে যাবার পর চাচা নসরুল্লাই তো আসাদের সব দায় নিয়েছিলেন হুজুর। সে কথা ভুলি কী করে? হাতির পিঠ থেকে পড়ে মারা গেল আসাদের চাচা। হুজুর, আবার এতিম হল।
– কী যে আজেবাজে বকো। মির্জা গালিবের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে যায়। -আরে, মির্জা গালিব তো এতিম হয়েই এই দুনিয়াতে এসেছিল। নতুন করে আবার এতিম হবে কী!
-হুজুর, কথাটা বুঝলাম না।
-তাহলে একটা কিস্সা শোনো মিঞা। মির্জা গালিব হাসলেন। ধরো গিয়ে, তার নাম হামাজ। তো হামাজ একদিন তার ইশক্রের দরজায় গিয়ে টোকা দিল। অন্দর মহল থেকে কথা ভেসে এল, ‘কে বাইরে?’
হামাজ বলল, ‘আমি।‘
ভিতর থেকে শোনা গেল, এখানে তোমার-আমার জন্য কোনও ঘর নেই। দরজা খুলল না।
বছরখানেক একা একা নানা জায়গায় ঘুরে হামাজ আবার সেই দরজার সামনে ফিরে এসে টোকা দিল। ভিতর থেকে জিজ্ঞাসা ভেসে এল, বাইরে কে?
হামাজ বলল, ‘তুমি’। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল।
-তারপর হুজুর? কালু চোখ বড় বড় করে তাকায়।
-তারপর আর কিছু নেই রে। হামাজ যে-উত্তরটা দিয়েছিল, আসাদ সেই উত্তরটা দিতে পারেনি। তাই আল-মুক্তাদির তাকে এতিম করে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। দরজা খুলল না।
– কিস্সাটা কার কাছে শুনেছিলেন হুজুর? আবিদ মিঞা বলে।
-তোমারই মতো একজন দস্তানগোর কাছে। তবে কিস্সাটা অনেকদিন আগে বলেছিলেন শেখ জালালউদ্দিন রুমি তাঁর মসনবিতে।
নামটা শুনেই আবিদ মিঞা উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে কয়েক পাক ঘুরে নেয় আর হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় সুরেলা ঝরনা, ‘মওলা…মেরে মওলা…।’
-শেমা থামাও আবিদ মিঞা। কিস্সাটা শুরু করো। মির্জা গালিব চেঁচিয়ে ওঠেন।