রমিলা জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চলো পাকা ঘরে যাই। টিনের এই ঘরের অবস্থা ভালো না। যে-কোনো সময় চাল উড়ে যাবে।
আমি এইখানেই থাকব।
এইখানে থাকবা?
জি।
কেন?
এই ঘর ছাইড়া কোনোখানে যাইতে আমার ভালো লাগে না।
ভালো লাগালাগির কিছু তো নাই বউ। ঝড়-তুফানের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়।
ঝড়-তুফান শেষ হয়েছে। আর হবে না।
আর হবে না?
না।
সিদ্দিকুর রহমান কান পাতালেন। আসলেই তো তাই, শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শুধুই বৃষ্টির শব্দ। রমিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। পাগল মানুষের হাসি-কান্না কোনো ব্যাপার নয়। পাগলমানুষ কারণ ছাড়াই হাসে। কারণ ছাড়াই কাদে। তবু সিদ্দুিকুর রহমান অভ্যাসবশে জিজ্ঞেস করলেন, হাসো কেন বউ?
রমিলা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, বাড়িতে কুটুম আসতেছে। আমার মনে আনন্দ, এইজন্যে হাসতাছি।
কুটুমটা কে?
সেটা আপনেরে বলব না।
রমিলা এখনো হাসছে। সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
খাড়াইয়া আছেন ক্যান?
সিদ্দিকুর রহমান রমিলাকে তালাবন্ধ করে চলে এলেন। রমিলা ঠিক আগের জায়গায় গুটিসুটি মেরে বসে গেল। এখন সে আর হাসছে না।
রাত চারটা বাজে। ফজরের আজানের বেশি দেরি নেই। এখন ঘুমোতে যাবার অর্থ হয় না। সিদ্দিকুর রহমান ঠিক করলেন, অজু করে বারান্দায় বসে ভোরের প্রতীক্ষা করবেন। ফজরের নামাজের পর তুফানে গ্রামের কী ক্ষয়ক্ষতি হলো তা দেখতে বের হবেন। ইতিমধ্যে মাসুদ চলে আসবে। তার বিষয়ে ব্যবস্থা কী নেয়া যায় সেটাও ভাবা দরকার।
সিদ্দিকুর রহমান বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার পাশেই সুলেমান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুফান কি কমেছে?
সুলেমান বলল, জি।
মাঝে মাঝে বড় রকমের ঝড়-তুফান হওয়া ভালো। বন্যার সময় কী হয় দ্যাখো— জমিতে পলি পড়ে, ফসল ভালো হয়। ঝড়-তুফানেরও সেরকম উপকার আছে।
সুলেমান কিছু বলল না। যেভাবে বসে ছিল সেইভাবেই বসে রইল। সিদ্দিকুর রহমান ভেবেছিলেন সুলেমান বলবে, ঝড়-তুফানের কী উপকার আছে? তখন তিনি উপকার ব্যাখ্যা করবেন। সুলেমান কিছু জানতে চাইল না বলে তাঁরও বলা হলো না। অবিশ্যি ঝড়-তুফানের কী উপকার তিনি জানেন না। ভেবে বের করতে হতো। জটিল জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগে। নানান কাজ-কর্মে তিনি ব্যস্ত থাকেন। চিন্তার সময় পাওয়া যায় না। দিনের কিছুটা সময় যদি আলাদা করে রাখা যেত তাহলে ভালো হতো। এই সময় তিনি চিন্তা করবেন। আর কিছু করবেন না।
সুলেমান!
জি?
চা চানাও, চা খাব।
জি আচ্ছা।
একটা পাতলা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়ে দাও, শীত–শীত লাগছে।
জি আচ্ছা।
চা বানিয়ে আনার পর যদি দেখ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তাহলে আমাকে ডাকবে না।
জি আচ্ছা।
লোকমােন কি মাসুদকে আনতে গেছে?
জি।
পাখি কিচিরমিচির করতেছে, শুনতেছ?
জি।
তুফান শেষ হয়েছে এইজন্যে এরা আনন্দ করতেছে। এ তার গায়ে ঠোকর মারতেছে। পশুপাখিরা মারামারি কামড়াকামড়ি করে আনন্দ প্রকাশ করে। পশুপাখির জগতের নিয়মকানুন বড়ই অদ্ভুত। সুলেমান শোনো, আমার গায়ে চাদর দেয়ার দরকার নাই। শীত-শীত ভাবটা ভালো লাগতেছে।
জি আচ্ছা।
সুলেমান চা বানিয়ে এনে দেখে, সিদ্দিকুর রহমান ঘুমোচ্ছেন। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। সে চায়ের কাপ পাশে রেখে আগের ভঙ্গিতেই বসেই পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান পড়ল। সুলেমান ভেবে পেল না। সে এখন কী করবে। চাচাজিকে ডেকে তুলবে? তিনি বলেছিলেন তার ঘুম যেন ভাঙানো না হয়। সুলেমান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
সিদ্দিকুর রহমানের ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর। তিনি চোখ মেলে দেখলেন অসম্ভব রূপবতী অপরিচিত একটি তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর মুখ হাসিহাসি। চোখে বিস্ময়। তাকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল— বাবা, আমি লীলা। লীলাবতী। আপনার কি শরীর খারাপ?
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লীলাবতী অসঙ্কোচে তার বুকের উপর হাত রাখল। সিদ্দিকুর রহমানের দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। কতদিন পর নিজের মেয়েকে দেখছেন। কী সুন্দর মেয়ে! তাকে অবিকল দেখাচ্ছে কিশোরী আয়নার মতো। আবার সে আয়নাও না, অন্য কেউ। মেয়েকে কিছু বলা দরকার। কোনো কথা মনে আসছে না। আহারে! মেয়েটা খবর দিয়ে কেন এলো না! খবর দিয়ে এলে তিনি সুসং দুর্গাপুর থেকে ভাড়া করে হাতি আনতেন। স্টেশন থেকে মেয়ে আসত হাতিতে চড়ে। সঙ্গে থাকত বাদ্যবাজনা। আহারে! মেয়েটা কেন আগে খবর দিল না?
আচ্ছা এটা কি সম্ভব যে পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নে ঘটছে? কেউ তাঁর কাছে আসে নি। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাপূরণ জাতীয় একটি স্বপ্ন দেখছেন। আগেও এরকম হয়েছে। দুপুরবেলা ঘুমুচ্ছিলেন— স্বপ্নে দেখলেন, আয়না এসেছে। সে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, জ্বর কি বেশি? তিনি বললেন, হু, কপালে হাত দিয়ে দেখো। আয়না বলল, কপালে হাত দিতে পারব না। আমি হলুদ বেটেছি, হাতে হলুদ। তারপরেও আয়না। কপালে হাত দিল। তিনি নাকে কাঁচা হলুদের গন্ধ পেলেন। তার ঘুম ভেঙে গেল। কপালে হলুদের গন্ধ কিন্তু চলে গেল না। সেই গন্ধ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল।
লীলা কি সত্যি এসেছে? সত্যি কি মেয়েটা তার বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে? সে তার মায়ের মতো কপালে হাত রাখল না কেন?