- বইয়ের নামঃ শুভ্র
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
শুভ্রর একটা বিশ্ৰী সমস্যা হয়েছে
শুভ্র
ভূমিকা
শুদ্ধতম মানুষ কেমন হবে?
অনেক প্রশ্নের মতো এই প্রশ্নটা আমার মনে প্রায়ই আসে। আমি আমার চারপাশের মানুষজন খুব মন দিয়ে দেখি। এক ধরনের গোপন অনুসন্ধান চলতে থাকে- যদি কোনো শুদ্ধ মানুষের দেখা পেয়ে যাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েতো আমি শুদ্ধতম মানুষ খুঁজে বের করতে পারব না। আমাকে খুঁজতে হবে। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে।
দীর্ঘ দিনের অনুসন্ধানে কোনো লাভ হয় নি। শুদ্ধ মানুষ আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে কল্পনায়। শুভ্র সে রকম একজন। বেচারার চোখ খুব খারাপ। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললে সে প্রায় অন্ধ। তার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে ডাকে কানাবাবা! শুদ্ধ মানুষের চোখ খারাপ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে চোখ খারাপ দেখানোর পেছনের প্রধান যুক্তি সম্ভবত আমি, আমার নিজের চোখও ভয়ঙ্কর খারাপ (পাঠকরা দয়া করে ভাববেন না যে আমি নিজেকে খুব সূক্ষ্মভাবে শুদ্ধতম মানুষ বলার চেষ্টা করছি। কোনো শুদ্ধ মানুষের একশ গজের ভেতর যাবার যোগ্যতা আমার নেই)। যাই হোক, শুভ্ৰ চরিত্রটি তৈরি হলো। বেশ কিছু উপন্যাস লিখলাম শুভ্রকে নিয়ে, যেমন রূপালী রাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ। তারপর হঠাৎ করেই শুভ্ৰকে নিয়ে লেখা বন্ধ করে দিলাম। আমার কাছে মনে হলো আমি ভুল করছি, শুদ্ধতম মানুষ বলে কিছু নেই। শুভ্র চরিত্রটি নতুন করে লিখতে হবে।
বর্তমান উপন্যাসটি শুভ্ৰ নামে পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। খুবই অনিয়মিতভাবে লিখেছি। এক সংখ্যায় লিখলাম, পরের দু সংখ্যায় লিখলাম না- এ রকম। শেষের দিকে এসে কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর পাঠক-পাঠিকা এবং বিশেষ করে পত্রিকা সম্পাদকের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। মানুষ মাত্রই ক্ষমা করতে পছন্দ করে। তারা আমাকে ক্ষমা করবেন বা ইতিমধ্যেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হুমায়ূন আহমেদ ধানমণ্ডি, ঢাকা
০১.
শুভ্রর একটা বিশ্ৰী সমস্যা হয়েছে।
রোজ ঠিক রাত তিনটায় অবধারিতভাবে তার ঘুম ভেঙে যায়। কাঁটায় কাটায় তিনটায়। পাঁচ মিনিট আগেও না, পরেও না। মনে হচ্ছে কোনো অদ্ভুত উপায়ে তাঁর শরীরের ভেতর একটা এলার্ম ক্লক ঢুকে গেছে। এলার্ম ক্লিকটা রাত তিনটা বাজার মিনিট তিনেক আগে বেজে ওঠে। রাত তিনটায় শুভ্ৰ ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর এলার্ম ক্লিক থামে।
গভীর রাতে অনেকেরই ঘুম ভাঙে। তাদের ঘুম ভাঙার সঙ্গে শুভ্রর ঘুম ভাঙার কোনো মিল নেই। তারা পানি খেয়ে, বাথরুম করে আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। শুভ্ৰ পারে না। তার ঘুম আসতে আসতে ছটা। তিনটা থেকে ছটা এই তিন ঘণ্টা সময় কাটানো খুব কষ্টের। আগে পড়াশোনা ছিল, হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলে সময় কেটে যেত। এখন পরীক্ষা শেষ। থিসিসের উপর ভাইভাও হয়ে গেছে। তিন ঘণ্টা জেগে থেকে সে করবে। কী? তিন ঘণ্টা তো কম সময় না। দশ হাজার অ্যািটশ সেকেন্ড। এই সময়ে আলো ১,৮৬,০০০ × ১০,৮০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে। পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। পৃথিবীতে অনেক কীটপতঙ্গ আছে যাদের আয়ু তিনঘণ্টারও কম। তিন ঘণ্টা তুচ্ছ করার ব্যাপার না। শুভ্ৰ তুচ্ছ করতে পারছে না। করতে পারলে ভাল হত।
শুভ্ৰ সময় কাটানোর মোটামুটি একটা রুটিন করে ফেলেছে। পনেরো মিনিট-— বাথরুম, দাঁত ব্ৰাশ করা, হাত-মুখ ধোয়া, পানি খাওয়া। পনেরো মিনিট— গান এবং চা পান। চা-টা সে নিজেই বানায়। ইলেকট্রিক হিটারে পানি গরম করে, বড় একটা মাগে দুটো টি ব্যাগ দিয়ে মগ ভর্তি চা বানিয়ে গান শুনতে বসে। হিন্দি গান। গভীর রাতে হিন্দি গান ছাড়া অন্য কোনো গান কেন জানি শুনতে।ভাল লাগে না। খুব লো ভল্যুমে সিডি প্লেয়ারে গান বাজে। গানের ভল্যুম একটু বাড়লেই শুভ্রর বাবা মোতাহার সাহেবের পাতলা ঘুম ভেঙে যাবে। তিনি মহাব্যস্ত হয়ে শুভ্ৰর ঘরে উপস্থিত হবেন এবং আতংকিত গলায় বলবেন, কী হয়েছে। বাবা? ঘুম আসছে না? বলিস কী? ঘুম আসবে না কেন?
যেন শুভ্রর ঘুম না হওয়াটা ভয়ংকর একটা ঘটনা। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে যাবার মত বড় ঘটনা। গান পর্ব শেষ হবার পরের এক ঘণ্টা পড়াশোনা। ইন্টারেস্টিং কোনো বই; যেমন–Life in Space, Magic of Number, Birth of God। এখন সে পড়ছে ব্রেইলী পদ্ধতির উপর একটা বই। অন্ধরা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কীভাবে পড়ে খুব সুন্দর করে উদাহরণ দিয়ে বইটাতে ব্যাখ্যা করা। এই বইটা শুভ্র খুব আনন্দের সঙ্গে পড়ছে এবং ব্ৰেইলী পদ্ধতিতে পড়া প্রায় শিখে ফেলেছে। একটা উঁচু ফোঁট মানে A, দুটো ফোঁটা একটি উপরে একটি নিচে B, দুটো ফোঁটা পাশাপাশি C, কোণাকুণি দুটো ফোঁট মানে E। সমস্যা হল A এর জন্য যে চিহ্ন, ফুলস্টপের জন্যে একই চিহ্ন। ব্ৰেইলী পদ্ধতি শুভ্র খুব আগ্রহ করে শিখছে কারণ তার চোখ ভয়ংকর খারাপ। চশমা ছাড়া সে কিছুই দেখে না। চশমা। চোখে শুভ্রকে প্রথম যে দেখে সেও একটা ধাক্কার মত খায়। শুভ্রর চোখের দিকে যেই তাকাবে তার কাছে মনে হবে কাচের সমুদ্রে দুটো চোখ ভাসছে। শুধু যে ভাসছে তা না, ঢেউ এর মত খানিকটা উঠা-নমাও করছে। শুভ্রর ধারণা— কোনো এক ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে সে কিছুই দেখবে না। ব্ৰেইলী পদ্ধতির পড়া এখন কাজে না লাগিলেও তখন কাজে লাগবে।