- বইয়ের নামঃ লীলাবতী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
রেললাইনের উপর একটা বক
পূর্বকথা
আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মোহনগঞ্জে, আমার নানার বাড়িতে। ছায়াময় একটি বাড়ি, পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর সারদেয়াল–পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। সব কিছুই রহস্যময়। সন্ধ্যাবেলায় সারদেয়ালে ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটাহাঁটি করে। গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ভূতে ঢিল মারে। কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। অশরীরী কিছু যন্ত্রণা তো করবেই। এদেরকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। মূলবাড়ি থেকে অনেক দূরে বিশাল এক তেঁতুলগাছের পাশে টাট্টিখানা। সন্ধ্যার পর যারা টাট্টিখানায় যায় তারা না-কি প্রায়ই তেঁতুলগাছে পা বুলিয়ে পেততুনি বসে থাকতে দেখে।
দিনমানে অন্য দৃশ্য। বাড়ির কাছেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠভর্তি বক। আমার নানাজান আবুল হােসেন শেখ দোনলা বন্দুক হাতে বক শিকারে বের হন। আমি তাঁর সঙ্গী। ছররা বন্দুকের গুলি হলো। অনেকগুলি বিক একসঙ্গে মারা পড়ল। তাদের গায়ের ধবধবে পালক রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে–আমি চোখ বড় বড় করে দেখছি। মাথার উপর মৃত বকদের সঙ্গীরা ট্যা ট্যা শব্দে ঘুরছে, অদ্ভুত সব দৃশ্য।
নানার বাড়ির স্মৃতি মাথায় রেখেই লীলাবতী উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই সময়ের রহস্যময়তাকে ধরার চেষ্টা। লেখাটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল অন্যদিন পত্রিকায়। কোনো ধারাবাহিক লেখাই আমি শেষ করতে পারি না। খেই হারিয়ে ফেলি। আগ্রহ কমে যায়। লীলাবতীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। একসময় লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, ভালো লেখা যত্ব নিয়ে লিখতে হয়, তাড়াহুড়া করা যায় না। তুমি মন খারাপ করো না। একসময় এই লেখা আমি শেষ করব।
আমি আমার কথা রেখেছি। বইমেলায় লীলাবতী বের করতে পেরে মাজহার নিশ্চয়ই খুশি। আমিও খুশি। লেখাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন ঘাড়ে চেপে ছিল— এখন নেমে গেছে।
লীলাবতী উপন্যাসের সব চরিত্ররা ভালো থাকুক। তাদের প্রতি এই আমার শুভকামনা।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর
০১.
রেললাইনের উপর একটা বক বসে আছে। মেছো বাঁক। এ ধরনের বক বিলের উপর উড়াউড়ি করে। অল্প পানিতে এক ঠ্যাঙ ড়ুবিয়ে মাছের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ডাঙায় আসার কথা না। আর যদি আসেও গম্ভীর ভঙ্গিতে রেললাইনে বসে থাকার কথা না। সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে বকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর ঘটনাটা কী? এ কী চায়?
বকটা ধবধবে সাদা। পানির বকের পালক সাদাই হয়। সারাক্ষণই পানিতে ডোবাড়ুবি করছে। পালকে ময়লা লেগে থাকা? কোনো কারণ নেই। ডাঙার বকের পালক এত সাদা না— বাদামি রঙ। মেছো।ক পানিতে যেমন এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনের উপরও এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাথ, নড়াচ্ছে না, শরীর নড়াচ্ছে না, স্থির দৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমানের বিস্ময় আরো প্রবল হলো, বকটা কী দেখছে? বিলের পানিতে এভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অর্থ আছে— মাছের গতিবিধি লক্ষ করা। এখানে বকটার একদৃষ্টিতে রেললাইনের পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী? সে কি রেললাইনের পাথর দেখছে?
ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেন চলে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। ঘন জংলায় আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেন দেখা যাবে। বকটা এখনো নড়ছে না। রেললাইনের কম্পন তার অনুভব করার কথা। ধ্যান ভঙ্গ হবার সময় এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান বুকের ভেতর সামান্য চাপ অনুভব করলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার এরকম হয়। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়।
রেলের ইঞ্জিনটা এখন দেখা যাচ্ছে। কয়লার ইঞ্জিন। বুনকা বুনকা ধোঁয়া ছাড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! বকটাকেও দেখা যাচ্ছে। বক আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সিদ্দিকুর রহমান অস্থির বোধ করলেন। হুশ! হুশ! শব্দ করে বকটাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু গলা কেমন যেন আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ ব্যথা। তিনি তাকালেন রেলের ইঞ্জিনের দিকে। ভালো স্পিড দিয়েছে। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে বকটার দিকে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। গাঢ় ঘুমে তার চোখের পাতা নেমে এসেছে। চারদিকে অদ্ভুত এক শান্তি-শান্তি নীরবতা। বাতাস মধুর ও শীতল। বুকের ব্যথাটা নেই। নিঃশ্বাসের কষ্ট নেই।
একসময় তিনি চোখ মেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাঠের উপর তিনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। তার বাঁ-দিকে প্ৰকাণ্ড শিমুল গাছ। গাছটার ছায়া পড়েছে তাঁর শরীরে। ছায়াটা এমনভাবে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি একটা ছায়ার চাঁদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখের সামনে আশ্বিন মাসের মেঘশূন্য আকাশ। আকাশে দুটা চিল উড়ছে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়ছে। তাদের দেখাচ্ছে বিন্দুর মতো। তিনি উঠে বসলেন।
ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও না। রেললাইনের উপর বকটা দাঁড়িয়ে নেই। সে ট্রেনের নিচে চাপাও পড়ে নি। চাপা পড়লে তার রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমান দুই হাতে ভর দিয়ে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছে। রেললাইনের ওপাশের জলে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা ক্যাচ ক্যাচি পাখি তার পায়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে। তিনি চাপা গলায় বললেন–‘হুশ! হুশ! সেইসঙ্গে ডান পায়ে মাটিতে বাড়িও দিলেন। পাখিগুলি একটু দূরে চলে গেল— তবে ভয় পেয়ে উড়ে চলে গেল না। ক্যাচক্যাচি পাখিগুলি চড়ুই পাখির মতোই সাহসী। এরা মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। ধূসর বর্ণের পাখি। চোখ হলুদ। সারাক্ষণ ক্যাচক্যাচ করে বলেই নাম ক্যাচ ক্যাচি পাখি। তাদের আরো একটা বিশেষত্ব আছে–এরা সাতজনের একটা দল বানিয়ে থাকে। ক্যাচ ক্যাচি পাখির বাকে সবসময় সাতটা পাখি থাকবে। সাতের বেশিও না, কমও না। যদি কখনো কেউ দেখে দলে সাতটার কম পাখি আছে, তাহলে তার ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের মৃত্যু ঘটে। অর্থহীন প্রচলিত প্রবাদ, তার পরেও ক্যাচক্যাচি পাখি দেখলেই সবাই পাখি গোনে। সিদ্দিকুর রহমানও গুনতে শুরু করলেন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়। একটা পাখি তো কম! তিনি আবারো গুনলেন। পাখি ছয়টা। এর মানে কী? পাখি ছয়টা কেন?