মা তোমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তুমি চুপ করে শুয়ে থাক।
আমার কোন অসুখ বিসুখে তোর বাবা খুবই অস্থির হয়ে পড়ত। অফিস কামাই দিয়ে ঘরে বসে থাকত।
ভাল। বাবার পত্নী প্রেমের কথা শুনে আমি মুগ্ধ।
আমি মাঝে মাঝে অসুখের ভান করতাম। অসুখ বিসুখ কিচ্ছু না। সকালবেলা তোর বাবার অফিসে যাবার সময় শুয়ে পড়ে উহ্ আহ্।
এইসব ন্যাকামীর কথা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগছে না মা। চুপ কর।
আচ্ছা যা–চুপ করলাম।
তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতো মা। আমি সোহরাব চাচাকে ডাক্তারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আসি।
আমি মার ঘর থেকে বের হয়েই দেখি সোহরাব চাচা ডাক্তার নিয়ে এদিকেই আসছেন। অল্পবয়সের একজন ডাক্তার। দেখে মনে হয় কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সোহরাব চাচা বললেন, রুমালী তুমি আমার ঘরে গিয়ে একটু বোস। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমি ডাক্তারকে রুগী দেখিয়ে আসি।
রুগী দেখার সময় আমিও সঙ্গে থাকি।
তোমার সঙ্গে থাকার কোন দরকার নেই। তোমাকে যা করতে বলছি কর।
আমি সোহরাব চাচার ঘরের দিকে রওনা হলাম। চারদিক কেমন ফাকা ফাকা লাগছে। মনে হচ্ছে ক্যাম্প খালি–কেউ নেই। একজন লাইটবয় ইলেকট্রিক তার নিয়ে কী যেন করছে। তাকে বললাম, লোকজন সব কোথায়?
সে বলল, শুটিং স্পটে চলে গেছে আপা।
কখন গেছে।
দশ পনেরো মিনিট আগে।
আমাকে ফেলে রেখে সবাই চলে গেল কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সোহরাব চাচা গম্ভীর ভঙ্গিতে চৌকির উপর বসে আছেন। আমি তার সামনে চেয়ারে বসে আছি। সোহরাব চাচার হাতে মগভর্তি চা। তিনি ঘন ঘন চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছেন। চা তাঁর অপছন্দের পানীয় বলে জানতাম। আজ দেখি তিনি আগ্রহ করেই চা খাচ্ছেন।
আমি বললাম, ডাক্তার কী বলেছে সোহরাব চাচা?
বলেছে— প্রেশার খুব হাই। জ্বর কমার অষুধ দিয়েছে। আশংকা করছে নিউমোনিয়া। এরা নতুন ডাক্তার কেঁচো দেখলে ভাবে সাপ। আমার ধারণা সন্ধ্যার মধ্যে জ্বর কমবে। তুমি থাক তোমার মার পাশে-— তাঁর সেবা যত্ন কর। রোগের আসল চিকিৎসা সেবা যত্ন। অষুধ রোগের কোন চিকিৎসা না।
আমি থাকব কী করে? আজ আমার শুটিং হবে!
সোহরাব চাচা কথা না বলে চায়ের কাপে ঘন ঘন কয়েক বার চুমুক দিলেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে হুট করে বললেন, বকুল শোন আসল ব্যাপারটা তোমাকে বলি। তোমাকে ছবি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
আমার উচিত ছিল প্রচন্ড ধাক্কা খাওয়া। কেন জানি ধাক্কা খেলাম না। হয়ত আমার অবচেতন মন ব্যাপারটা আগেই বুঝে ফেলেছিল। কিংবা আমি হয়ত অসাধারণ অভিনেত্রী। বড় বিপর্যয়েও শান্ত থাকার অভিনয় করছি। আমি শান্ত গলায় বললাম, আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে?
হ্যাঁ।
যেসব অংশ শুট করা হয়েছে সেগুলো কী হবে?
রিশুট হবে।
নতুন যে মেয়েটা এসেছে সেই আমার অংশ করবে?
হ্যাঁ।
মেয়েটার নাম কী?
ওর নাম তিথি। তিথিকণা।
তুমি বাদ পড়লে কেন জানতে চাও না?
জ্বি না। বাদ পড়েছি এইটাই বড় কথা। কেন বাদ পড়েছি এটা বড় কথা air
সোহরাব চাচা চায়ের মগ নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বললেন, নীরা ম্যাডাম তোমাকে বাদ দেবার কথা বলে দিয়ে গেছেন। তাঁর কথার বাইরে যাবার সাধ্য স্যারের নেই। নীরা ম্যাডাম এই ছবির প্রযোজক।
বুঝতে পারছি। ডিরেক্টর সাহেব যে জরুরি কথাটা বলতে চাচ্ছিলেন সেটা কি এটাই যে আমি বাদ পড়েছি?
হুঁ। স্যার বলতে পারেন নি বলেই আমাকে বলতে হল।
আমরা কি এখন ঢাকায় চলে যাব?
তোমার মার শরীরটা একটু ভাল হোক— তারপর যাও। আমি গাড়ি দিয়ে দেব।
গাড়ি লাগবে না। বাসে তুলে দিলেই আমরা চলে যেতে পারব। চাচা শুনুন–আমি যে বাদ পড়েছি এটা এখন মাকে শুনানোর দরকার নেই। মাকে বললেই হবে যে আমার অংশ শেষ। অসুস্থ অবস্থায় মা যদি শোনেন আমি বাদ পড়েছি খুব কষ্ট পাবেন।
ঠিক আছে তাকে কিছু বলার দরকার নেই। সবাইকে বলে দেব তাকে কিছু না জানাতে।
আমি যে বাদ পড়েছি এটা সবাই জানে?
হ্যাঁ জানে।
কী কারণে বাদ পড়েছি এটা জানে?
স্যার বলেছেন— তুমি অভিনয় খুব ভাল করলেও চরিত্রটার গেটাপের সঙ্গে তোমার গেটাপ মিশছে না। দিলু খুব হাসি খুশি লাইভলী একটা মেয়ে। আর তুমি হলে বিষণ্ণ প্রকৃতির। ঠিকই বলেছেন।
বকুল শোন— পরে তোমাকে সুযোগ দেয়া হবে। তুমি মন খারাপ করো
বাদ পড়েছি বলে মন খারাপ করছি না। আমি মন খারাপ করছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে।
অন্য কারণটা কী?
আগে আপনি কথায় কথায় আমাকে মা ডাকতেন। বাদ পড়ার পর একবারও মা ডাকেন নি। তার মানে হচ্ছে— আগে যে আপনি মা ডাকতেন ভালবেসে ডাকতেন না। হিসেব নিকেশ করে ডাকতেন।
সোহরাব চাচা চুপ করে আছেন। আমি সহজ গলায় বললাম, চাচা শুনুনআমি শুটিং স্পটে যাব। কাউকে বিরক্ত করব না। দূর থেকে শুটিং দেখব। এখন মার কাছে গিয়ে বসে থাকলেই মা সন্দেহ করবেন।
ঠিক আছে। যাও শুটিং স্পটে যাও। তবে বাদ পড়া নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলবে না। স্যারের কনসানট্রেশন নষ্ট হবে।
আপনি মোটেই চিন্তিত হবেন না চাচা। আমি কাউকেই বিরক্ত করব না। আমি অত্যন্ত লক্ষ্মী টাইপ মেয়ে এবং ভাল অভিনেত্রী।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
দিলু সেজে থাকলেও আমি এখন আর দিলু না, আমি রুমালী। শুটিং স্পটে চলে যাব। রুমালী হয়ে চুপচাপ বসে থাকব। শুটিং দেখব। ক্যামেরাম্যান বলবেন, অল লাইটস। সব বাতি জ্বলে উঠবে। খুলে যাবে অন্য ভুবনের দরজা। যে ভুবনে আমার জায়গা নেই।
শুটিং স্পটে যাবার আগে মেকাপ তুলে ফেলব? না যে ভাবে আছে সে ভাবে যাব? বুঝতে পারছি না। মেকাপ নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। মুখে মেকাপ থাকলে মনে হবে আমি সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছি— সবাইকে বলতে চেষ্টা করছি— তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, আমি তৈরি হয়ে এসেছিলাম তারপর ওরা আমাকে বাদ দিল। তার কোন দরকার নেই। এখন আমি মার কাছ যাব। মাকে বলব, শুটিং-এ যাচ্ছি, দোয়া করোতো মা। এই বলে বিদায় নিয়ে নীচে এসে মেকাপ তুলব। তারপর এক কোণায় চুপচাপ বসে শুটিং দেখব। শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে আশে পাশের মানুষের সঙ্গে টুকটুক করে গল্প করব। হাসব। পাপিয়া ম্যাডামের গম্ভীর মেয়েটার সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করব।