- বইয়ের নামঃ রূপা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আপনার নাম রূপা
আপনার নাম রূপা?
রূপা জবাব দিল না। একটু আগে সে একবার বলেছে তার নাম রূপা। দ্বিতীয়বার আবার নাম জানতে চাওয়া কেন? কিছু কিছু মানুষ আছে, একই প্রশ্ন কয়েকবার করতে ভালোবাসে। তার বাবার বন্ধু সুলতান চাচা এরকম একজন। একই কথা দুবার করে বলবেন, কেমন আছিস মা? কেমন আছিস মা? মুখটা শুকনা কেন? মুখটা শুকনা কেন? অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার।
সোফায় যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে অবশ্যি সুলতান চাচার কোনো মিল নেই। সুলতান চাচা ভোতা চেহারার মানুষ। ইনি তা-না। কাটা কাটা চোখ মুখ। পাতলা ঠোঁট। গায়ের রঙ ফর্সা। ফর্সা একটু কম হলে ভাল হত। চোখ মেয়েলি ধরনের সুন্দর। চোখের পল্লব দীর্ঘ। রূপা মনে করার চেষ্টা করলকার লেখায় সে পড়েছে, তার দীর্ঘ আঁখি পল্লব সব সময় চোখে ছায়া ফেলে রাখে। মনে পড়ছে না।
রূপা বলল, আপনি কি চা খাবেন?
খাব।
চায়ে চিনি খান?
চিনি কেন খাব না?
রূপা বলল, অনেকেই চায়ে চিনি খায় না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।
তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছ?
রূপা তাকিয়ে রইল। তাকে লোকটা তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় আপনি থেকে তুমি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাপারটা কি বুঝিয়ে দেয়া যায় না? ভদ্রভাবে কাজটা কীভাবে করা যায়? রূপা যদি বলে, না তোর কথায় আমি বিরক্ত হই নি। তুই চুপ করে বসে থাক, আমি তোর জন্যে চা বানিয়ে আনছি। তাহলে সে বুঝবে। ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের কথা বলা সম্ভব না। রূপা রানাঘরের দিকে গেল।
রান্নাঘরের দুটা চুলার কোনটাই খালি নেই। রাতের খাবার রান্না হচ্ছে। রূপাদের কাজের মেয়ে মলিনা হাড়িতে চামুচ নাড়ছে। রূপা বলল, উনি চা খাবেন।
লোকটা কে আফা?
রাশেদ নাম। বাবার কাছে এসেছেন।
মলিনা বলল, লোকটার চেহারা কত সুন্দর দেখছেন আফা? আমি অবাক মানছি। রাজার কুমারের মতো চেহারা।
রূপা বলল, রাজার কুমার হলেই চেহারা সুন্দর হয় না। আফ্রিকার সব রাজকুমার কুচকুচে কালো মোটা ঠোঁট। মোটা নাক।
আফা, উনি বিদেশ থিক্যা আসছে?
হ্যাঁ।
কেমনে বুঝছি জানেন? যারা বিদেশ থাইক্যা আসে তারার স্যুটকেসের হাতায় কাগজ থাকে
রূপা বলল, মলিনা তুমি এত বেশি কথা বল যে মাঝে মাঝে আমার অসহ্য লাগে। ভাল করে দুকাপ চা বানাও।
এখন পারব না আফা। চুলা বন। চুলা খালি হোক চা বানায়া দিব। আপনে যান, উনার সাথে গফ করেন। আমি চা নিয়া আসতেছি। উনি কি রাইতে খাকবে?
জানি না। জিজ্ঞাস করেন। যদি থাকে গেস্টরুম ঠিক করা লাগবে। তিন আইটেম পাকাইছি। অতিথি থাকলে আইটেম বাড়াইতে হবে। ফিরিজে সরপুঁটি মাছ আছে। ড়ুবা তেলে ভাইজা দিব।
এত কথা বল কেন মলিনা?
আপনের সাথেই তো কথা বলি। ছাদে গিয়া অন্য বাড়ির কারো সাথে গফ করি না। আমার অত শখ নাই।
রূপা বসার ঘরে ঢুকল। রাশেদ নামের মানুষটা মেরুন কালারের বিশাল স্যুটকেস খুলে ঘাটাঘাটি করছে। মেয়েদের স্যুটকেসের রঙ হয় মেরুন। এই মানুষটার চোখ যেমন মেয়লি, রুচিত্ত মেয়েলি। স্যুটকেসের কিছু কাপড় মেঝেতে, কিছু সোফায়। রূপা বলল, দুটা মাই বন্ধ। চা দিতে সামান্য দেরি হবে।
চুলা বন্ধ মানে কি? গ্যাস আসছেন? আমি ঠিক করে দিতে পারি। আমার সঙ্গে টুল সেট আছে।
রূপা বলল, চুলা বন্ধ মানে দুটা বানরই এনগেজড। রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে।
রাতে কি রান্না?
রূপা অনেক কষ্টে বিরক্তি চাপা দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, জানিনা কি রান্না।
আপনার খুব জানতে ইচ্ছে হলে মলিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে দিতে পারি।
মনিনা কে?
আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।
তার সঙ্গেতে আমার দেখা হয়েছে। সে-ই দরজা খুলে দিয়েছে। এত মিষ্টি চেহারা। সে যে House Maid বুঝতে পারিনি। রূপা আমি তোমার জন্যে এক প্যাকেট চকলেট এনেছি। ব্রাজিলের চকলেট, একটু তিতকুট ভাব আছে।খেতে খুব ভাল।
থ্যাংক য়্যু।
তোমার নাম তাহলে রাপা!
হ্যাঁ। বারবার নাম জিজ্ঞেস করছেন কেন? নাম পছন্দ হচ্ছে না?
না।
সরি। বাবা আমার নাম রাখার সময় আপনার কথা চিম্বা করেন নি। আপনার কথা মাথায় থাকলে তিনি হয়ত অন্য নাম রাখতেন।
তুমি মনে হচ্ছে আমার কথায় রাগ করেছ। ঘটনা হচ্ছে, আমার সঙ্গে আন্ডার। গ্রাজুয়েটে রূপা ব্যানার্জি নামে এক মেয়ে পড়ত। মেয়েটা গাধা টাইপ ছাত্রী,ঔীষন পাজি। গাঁজা-টাজা খেত। সমস্যাটা এইখানেই।
কী সমস্যা?
তোমার নাম রূপ শোনার পর থেকে বারবার তোমার মধ্যে রূপার ছায়া চলে। আসছে।উচিত না, কিন্তু চলে আমছে।এই ফিলিংসের ইংরেজি একটা নাম আছে। নামটা মনে করতে পারছি না, সরি।
অকারণে সরি বললেন কেন?
তুমিই বা অকারণে রাগ করছ কেন? রূপা ব্যানার্জি অতি পাজি এক মেয়ে, সেই দোষ তো আমার না।
আমার নাম যে রূপা, এই দোষও আমার না। আমি আমার নিজের নাম রাখি নি।
রাশেদ বলল, সরি।
মলিনা ট্রেতে করে দুকাপ চা নিয়ে ঢুকল। রাশেদ বলল, মলিনা আরেক কাপ চা নিয়ে এসো, তিনজন মিলে চা খেতে খেতে গল্প করি। আর এই নাও, এই চকলেটের প্যাকেট তোমার জন্য।
মলিনা হতভম্ব হয়ে তাকালো রূপার দিকে। রূপা বলল, আমি চা খাব না। মলিনা তুমি আমার চা-টা খেতে খেতে উনার সঙ্গে গল্প কর। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে আসি।
রাশেদ অবাক হয়ে বলল, মলিনা তো আমাকে দরজা খোলার সময় বলেছে উনি রাজশাহী গেছেন।
রূপা বলল, রাজশাহীর মানুষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। বাংলাদেশের টেলিফোন সার্ভিস যথেষ্ট উন্নত।
আরে তাই তো। সরি। রূপা দেখ তো এটা কি তোমার পছন্দ হয়?
জিনিসটা কি?
দেখতে অবিকল কলম। তাই না? আসলে ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার। দশ ফুট দূরের শব্দও সে রেকর্ড করবে। নিখুঁত সাউন্ড! ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ বাদ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। নাও।
নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা হাত বাড়াল। নিতান্ত অপরিচিত কারো কাছ থেকে উপহার নেয়া যায় না। ভদ্রলোক তার বাবার পরিচিত। তাতে কি?
আরো অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস নিয়ে এসেছি। লাই ডিটেকটর। খেলনা ভাসান, তবে ভাল কাজ করে। মিথ্যা বললেই লাল বাতি জ্বলবে। পিপ পিপ শব্দ হবে। চা খেয়ে বের করে দিচ্ছি। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে এসো।
রূপার বাবা হারুনুর রশিদ, একটা প্রাইভেট কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। দুবছর হলো রিটায়ার করেছেন। অবসর জীবনে তার দুটা কাজ। বঙ্গ ইতিকথা নামে একটা ইতিহাসের বই লেখা এবং পীর ফকিরের অনুসন্ধানে যাওয়া। রূপার ধারণা পীর ফকিরের অনুসন্ধান তার একটা উপলক্ষ। তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন বলেই পীর ফকির। তাঁর মাথা সামান্য এলোমেলো। কারণ বঙ্গ ইতিকথা নামে যে বিশাল গ্রন্থ তিনি লিখছেন তার সবটাই কবিতার ছন্দে। সুলতানি আমলের লেখা এইভাবে শুরু করেছেন।
ছটফটে স্বভাব হলে ধৈর্য ধরুন
সুলতানি আমল কথা মন দিয়ে শুনুন।
১৩৪২ থেকে আমলে শুরু
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে মানা যাক গুরু।
বখতিয়ার খিলজিতে পূর্ণ হয় নাম
সুলতানি আমল কথা শুরু করিলাম॥
হারুন এখন আছেন রাজশাহীর বিরামপুরে। সেখানে মদিনা নামের একজনকে পেয়েছেন। মদিনার প্যারানরমাল ক্ষমতা দেখে তিনি মুগ্ধ। হারুনুর রশিদ অতি দ্রুত মুগ্ধ হন আবার তারচেয়েও দ্রুততায় তাঁর মুগ্ধতা ভাঙে।
রূপার টেলিফোন পেয়ে তিনি প্রথম কথা যেটা বললেন, তা হল, রূপা। মাই ডটার। অনেক দিনের চেষ্টার পর জেনুইন জিনিস পেলাম। বাংলাদেশ হয়েছে ফ্রন্ডের আখড়া। সব নকল। এই প্রথম আসল পেয়েছি। ঘটনা শোন।
রূপা বলল, আগে আমার কথা শোন, তারপর তোমার আসল জিনিসের কথা শুনব।
না না শোন, আমি এত এক্সাইটেড যে আমি আমার পেটের কথা না বললে তোর কথা শুনতেই পারব না। মন বসবে না।
আচ্ছা বল।
রাজশাহীর একটা লোকাল নিউজ পেপারে প্রথম খবরটা পড়লাম। খবরের হেডিং–ঘড়ি-কন্যা। মূল বিষয়, ঘড়ি-কন্যা ঘড়ি না দেখে টাইম বলতে পারে। মনে কর কেউ গেল মদিনার কাছে। সে বলল, মদিনা! আমার ঘড়িতে কয়টা বাজে? মদিনা সঙ্গে সঙ্গে টাইম বলে দেবে। আমি চিন্তা করলাম মেয়েটার কাছে লুকানো ঘড়ি থাকতে পারে। হয়ত জামার আড়ালে এমনভাবে রাখী যে সে শুধু দেখতে পায়। অন্যরা পায় না। আমি করলাম কি নিজের ঘড়ি পঁয়তাল্লিশ মিনিট পিছিয়ে রাখলাম। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম–সে হুবহু বলে দিল। এক মিনিট এদিক ওদিক হল না। অদ্ভুত না?
অদ্ভুত। প্যারানরমাল ক্ষমতা নিয়ে অনেক মানুষ জন্মায় আমরা তার খবর রাখি। এই নিয়ে বিখ্যাত কবিতা আছে
Full many a flower is born to blush unseen
And washed its sweetness in the desert air.
রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা তোমার কথা মন দিয়ে শুনলাম। এখন আমার কথা শোন, রাশেদ সাহেব এসেছেন।
রাশেদ সাহেব কে?
জানি না কে।
আরে গর্দভ মেয়ে জিজ্ঞেস করবি না? আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? কি করেন?
বাবা আমি কোর্টের উকিল না। জেরা করতে পারি না। ভদ্রলোক বলেছেন তুমি তাকে খুব ভাল করে চেন। বেশ কয়েকবার টেলিফোনে তার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হারুন বললেন, রাশেদ নামের একজনকেই আমি চিনি। সে চিটাগাংয়ে থাকে। কাঠের দোকান আছে। চেড়াইকল আছে। কাঠের গুতা খেয়ে তার একটা চোখ নষ্ট হয়েছে বলে সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ। আমেরিকার কোনো রাশেদের সঙ্গে আমার কথা হয় নাই।
বল কি?
আমার তো মনে হচ্ছে বাজে মতলব নিয়ে কেউ ঢুকেছে। ঢাকা শহরে এরকম আজকাল হচ্ছে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঢুকে সর্বনাশ করে চলে যাচ্ছে। খুন-খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে। আজকের পেপারেই তো আছে। গাধা মেয়ে, খবরের কাগজ পড়িস না। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম কাজ খবরের কাগজ পড়া।
তুই বুঝতে পারছিস না যে ভয়ঙ্কর কেউ ঢুকেছে?
আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে উনি ভুল করে এ বাড়িতে এসেছেন।
এক্ষুণি বিদায় কর।
উনি চা খাচ্ছেন। চা খাওয়া হোক তারপর বলব।
চা খাচ্ছে মানে কি? তাকে তো ঘরেই ঢুকতে দেয়া ঠিক হয় নাই। গেট থেকে বিদায় করে দেয়া উচিত ছিল। দারোয়ান একটাকে রেখেছি গাধার গাধা। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আন ওয়ান্টেড লোকজন কোলে করে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। আর তুইও এমনি অতিথিপরায়ণ, কিছু জিজ্ঞেস না করেই চা-কফি-কেক-পেস্ট্রি।
বাবা! তুমি উত্তেজিত হয়ো না। আমি ব্যবস্থা করছি।
ব্যবস্থা করাকরির কিছু নাই। তুই তাকে বলবি, আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন। Now get fost. বিদায় হবার পর আমাকে টেলিফোনে জানাবি যে বিদেয় হয়েছে। আমি দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব।
বসার ঘর ফাঁকা। মলিনার হাতে চায়ের ট্রে। সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রূপা বলল, উনি কোথায়?
মলিনা বলল, ঘুমাইতাছে! গেস্টরুম খুইল্যা দিলাম। সাথে সাথে বিছানায় শুইয়া ঘুম। আমারে বলেছেন খাওয়ার সময় ডাক দিতে। আগে ডাক দিলে আমার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা। কি শাস্তি দিব কে জানে। কি সুন্দর কইরা বলছে–ডাকলে শাস্তি।
রূপা বলল, শাস্তি দিলে দিবেন। এক্ষুণি ডাক। উনি ভুল বাড়িতে এসেছেন।
কি কন আপা?
ডেকে তোল। তোমাকে যে চকলেটের প্যাকেট দিয়েছে সেটা ফিরত দাও।
মলিনা বলল, সর্বনাশ প্যাকেট খুইল্যা তিনটা চকলেট খায়া ফেলছি। খেয়ে ফেলেছ ভাল করেছ। এখন উনাকে ডেকে তোল।
মলিনা চিন্তিত মুখে গেস্টরুমে ঢুকল। পেছনে পেছনে গেল রূপা। রাশেদ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকির পর চোখ খুলল। তার চোখ টকটকে লাল। দৃষ্টি এলোমেলো। রূপা বলল, আপনি ঠিকানা ভুল করেছেন। বাবা আপনাকে চেনেন না। তার সঙ্গে আপনার কথাও হয় নি। তিনি একজন রাশেদকেই চেনেন যার একটা চোখ নষ্ট। সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ।
ও আচ্ছা।
রূপা বলল, আমি দারোয়ানকে বলছি সে একটা সিএনজি এনে দেবে। আপনি সিএনজি নিয়ে চলে যাবেন।
সিএনজি কি?
সিএনজি হল ইয়েলো ক্যাব। গ্যাসে চলে। Concentrated Natural Gas, CNG.
ও আচ্ছা।
ও আচ্ছা বলেই রাশেদ আবার বিছানায় শুয়ে চোখ বুজল। মলিনা বলল, আফা উনারে জাগানি অসম্ভব। দেখেন না কি ঘুম ঘুমাইতাছে।
রূপা বলল, কিছুক্ষণ পর আবার ডাক।
রাইতে খাওয়ার সময় ডাকি আফা? খাওয়া দাওয়া কইরা চইলা যাবে। জিগাইতেছিল রাইতে রান্ধা কি? বিদেশ থাকে। দেশি খানা খায় না। আমি বললাম, মুরগির সালুন করেছি, বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, মাষের ডাল, সরপুঁটি ভাজি।
মলিনা কথা বন্ধ। আরেকবার ডাক।
মলিনা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। রাশেদ চোখ মেলে আবারও চোখ বন্ধ করল। মলিনা বলল, ভাইজানরে এখন হাতি দিয়া টাইন্যাও তুলতে পারবেন না।
এর মধ্যে ভাইজান পাতিয়ে ফেলেছ?
আমি তো উনারে রাশেদ বইল্যা ডাক পাড়তে পারি না। ভাইজান ছাড়া উপায় কি?
তুমি যেভাবেই পার তোমার ভাইজানকে ডেকে তোল। প্রয়োজনে গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দাও।
দশটা মিনিট পরে পানি ঢালি আপা? আরামের ঘুম দিছে মায়া লাগে। ঘুমন্ত মানুষরে জোর কইরা তুলতে নাই। যে তোলে তার শইল কাঁপানি রোগ হয়।
শইল কাঁপানি রোগ কি?
ঘুমের মধ্যে শইলে ঝুঁকির মতো হয়।
অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কোথায় পাও?
মলিনা বলল, আপনি আপনার ঘরে যান। এক ঘণ্টা পরে আসেন দেখবেন সব কিলিয়ার। আমি নিজে সিএনজিতে তুইল্যা বলব–ভাগ।
একটু আগে বলেছ দশ মিনিট। এখন বলছ এক ঘণ্টা।
হাতে কিছু সময় রাইখা বলছি। উনার জিনিসপত্র গুছাইতেও সময় লাগব। দেখেন কি করছে, দুইটা সুটকেসের সব জিনিস বাইর করছে। ঐ যে হইলদা জিনিসটা দেখতেছেন, এইটা মিথ্যা যন্ত্র। এই যন্ত্রে মিথ্যা বললে ধরা খাইতে হয়। লাল বাতি জ্বলে। পিপ পিপ শব্দ হয়।
রূপা বলল, উনি আমাকে এক প্যাকেট চকলেট অরি ভয়েস রেকর্ডার দিয়েছেন। তোমাকে দিচ্ছি তুমি উনাকে ফেরত দেবে। আমি নিজের ঘরে এক ঘণ্টা থাকব। এর মধ্যে তুমি সব ব্যবস্থা করবে। যাবার সময় উনি যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তুমি বলবে আপার জ্বর এসেছে। আপা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
মিথ্যা কথা বলব? উনি যন্ত্রপাতি নিয়া আসছে। মিথ্যা বললে কোন বিপদ জানি হয়।
রূপা জবাব না দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। এখানে যতক্ষণ থাকবে মলিনার বকবকানি শুনতে হবে। মেয়েটা নন-স্টপ কথা বলতে পারে। রূপার ধারণা সুযোগ দিলেই মলিনা এক নাগারে কথা বলার একটা বিশ্ব রেকর্ড করে গিনিজ বুকে নাম তুলে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের কাজের মেয়ে বলে সুযোগটা সে পাচ্ছে না।
দোতলায় রূপাদের তিনটা কামরা। একটায় তার বাবা থাকেন। সেটা সবচে ছোট। বড় ঘরে তার নাকি ফাপড় লাগে। ঘুম ভাঙলে মনে হয় মাঠে শুয়ে আছেন। তার ধারণী শোবার ঘর এমন হবে যে বিছানায় শুয়ে সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। বুকশেলফ, টেবিল, ওয়ারড্রোব সব থাকবে বিছানার সঙ্গে লাগানো।
দোতলার বিশাল সাইজের দুটা ঘরই রূপার। একটাকে রূপা ছবি আঁকার স্টুডিও বানিয়েছে। এই ঘরের ছোট দুটা জানালা ভেঙে বড় একটা জানালা করা হয়েছে। ঘরে প্রচুর আলো আসে। এই ঘরের সঙ্গে টেরাসের মতো আছে। টেরাসে সুন্দর বাগান। এক কোনায় বিশাল চৌবাচ্চা বানানো হয়েছে হারুন সাহেবের উৎসাহে। সেখানে দেশী মাছ ছাড়া হয়েছে, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া মাছগুলি আনন্দে আছে। হারুন চৌবাচ্চা আরো বড় করে সেখানে গলদা চিংড়ি চাষের চেষ্টা করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। রূপা রাজি হচ্ছে না। সে বলেছে বাড়ির ছাদে পুকুর বানানোর কিছু নেই। ছাদ হচ্ছে সুন্দর বেড়ানোর একটা জায়গা। সেখানে মাছ চাষ করতে হবে কেন?
হারুন বলেছেন, মাছ কি অসুন্দর?
মাছ অসুন্দর না। চৌবাচ্চা থেকে ছিপ দিয়ে তোমার মাছ ধরাটা অসুন্দর।
অসুন্দরকে বাদ দিয়ে সুন্দর হয়? বাবা তোমার সঙ্গে আমি বাজে তর্কে যাব না। যাবি না কেন?
কোনো একটা তর্কে গেলেই তুমি টিচার ভাব ধরে ফেল। ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছ এরকম ভঙ্গি। আর আমি যেন তোমার ছাত্রী। তাও বুদ্ধিমান কোনো ছাত্রী না। বোকা ছাত্রী।
রূপা যদিও বলে মাছের চৌবাচ্চা তার খুব অপছন্দ, ঘটনা তা না। সে চৌবাচ্চার পাশে বসে মাছ দেখে অনেকটা সময় কাটায়। গত মাসে মাছের একটা জল-রঙ ছবি এঁকেছে। ছবিতে একটা ড়ুবন্ত মাছের গায়ে আলো পড়েছে। ছবির নাম–জনে মীন রাশি। পুরো ছবিতে একটাই রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। নীল রঙের নানান শেড।
হারুন ছবি দেখে বলেছেন, নামের অর্থ কি? জন্মে মীন রাশি বলতে তুই কি বুঝাচ্ছিস?
ছবিটা দেখে তোমার কেমন লাগছে সেটা বল। নাম কোনো ব্যাপার না।
হারুন বললেন, দর্শক নামের সঙ্গে ছবি রিলেট করবে। নাম ব্যাপার হবে না কেন? মনে কর আমি একটা গোলাপের ছবি এঁকে ছবির নাম দিলাম হংস ডিম্ব! তার কোনো অর্থ হবে?
বাবা! ধরে নাও ছবিটার কোনো নাম নেই। এখন বল ছবি কেমন লাগছে।
হারুন গম্ভীর গলায় বললেন, ছবি দেখে মনে হচ্ছে পেইন্টারের কাছে নীল রঙের একটা টিউবই ছিল। সে তা দিয়েই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে তাও না।
বাবা তুমি ইতিহাস বুঝ, ছবি বুঝ না।
সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। তোরা যারা ছবি আঁকিস তারা ছবি বুঝবি। ইতিহাস বুঝবি না।
বাবা, আমি ওয়াটার কালারে গোল্ড মেডেল পাওয়া মেয়ে।
ক্রিয়েটিভ ক্ষেত্রে গোল্ড মেডেল কোনো কাজের কথা না। পিকাসো কখনো গোল্ড মেডেল পান নি। জয়নুল আবেদিন কোলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাস করেছিলেন। তার রেজাল্ট ভাল ছিল না। পাকিস্তানের ওরিয়েন্টাল পেইন্টার আবদুর রহমান চুঘতাই আর্ট কলেজের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
বক্তৃতা বন্ধ কর বাবা।
শেষ কথাটা শোন Louvre Museum-এ ভারতবর্ষের মাত্র একজন পেইন্টারের ছবি আছে। তিনি কখনো আর্ট স্কুলে বা কলেজে পড়েন নি। তার নাম জানতে চাস?
না।
জেনারেল নলেজ বাড়াবি না?
না।
তার নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কে হন সেটা বল।
আমি জানি না। দয়া করে এখন চুপ কর।
আচ্ছা যা চুপ করলাম। জন্মে মীন রাশি নিয়ে মন খারাপ করিস না। যখন ভাল ছবি আঁকবি আমিই প্রথম বলব।
তোমার কিছু বলার দরকার নেই। রূপা বসে আছে চৌবাচ্চার দক্ষিণ দিকে। আকাশে মেঘ জমছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চৌবাচ্চার পানিতে বিদ্যুৎ চমকের প্রতিবিম্ব পড়ার সঙ্গে মাছদের জগতে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি হচ্ছে। রূপার দেখতে মজা লাগছে। মাছরা ভয় পাচ্ছে। সবচে বেশি ভয় পাচ্ছে তেলাপিয়াগুলি। বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে এরা লাফিয়ে পানি থেকে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। একটা মাছ তো রূপার কোলে এসে পড়তে পড়তে পড়ে নি।
রূপাদের দোতলা বাড়িটা কলাবাগানের ভেতরের দিকে। তাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ভূতের গলি গিয়েছে। রূপার দাদা এক বিঘা জমিতে ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ভূতের বাড়ি। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। বাড়ি ঘিরে নানান ধরনের গাছপালা লাগিয়েছিলেন।
ভূতের বাড়ি নামকরণের জন্যেই কি-না কে জানে এই বাড়িতে ভূতের খুব উপদ্রপ শুরু হয়। নিশিরাতে ছাদে নূপুর পায়ে হাঁটার শব্দ। ঝড় নেই, বাতাস নেই, আপনাআপনি জানালা বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। রান্নাঘরের মিটসেফের সব খাবার দেখা যায় রান্নাঘরময় ছড়ানাে।
রূপার দাদা হাজী শরিফউদ্দিন নিজেও একদিন ভূতের হাতে পড়লেন। রাতে বাথরুমে গিয়েছেন। তারপর আর বাথরুম থেকে বের হতে পারেন না। দরজা খুলে না। তিনি ছিলেন দোতলায় একা। এক তলায় একজন দারােয়ান আর রান্নার ছেলে। শরিফউদ্দিন চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন। কেউ শুনছে না।
দরজা খুলল ফজরের আযানের পর। শরিফউদ্দিন বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে গেলেন। ভূতের বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে গেল।
রূপার জন্মের পর বাড়ির নাম বদলে হারুন বসবাস শুরু করলেন। বাড়ির নতুন নাম হল রূপা। রূপার ধারণা তাদের বাড়িতে এখনাে ভূত আছে তবে ভূতদের আগের সেই ক্ষমতা নেই। আশেপাশে বিশাল সব অ্যাপার্টমেন্ট হাউস হওয়ায় তারা কোনঠাসা হয়ে আছে।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। রূপা দোতলা থেকে একতলায় নামল। মলিনার সঙ্গে সিঁড়ির গােড়াতেই দেখা। মলিনা বলল, আফা খানা লাগামু?
উনি বিদায় হয়েছেন?
জ্বে না। একবার আমারে বললেন, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও। পানি দিলাম। পানি খাইয়া আবার ঘুম। আমারে বললেন, তােমার নাম মলিনা, অর্থাৎ মলিন। নামটা সুন্দর না। এখন থেকে আমি তােমাকে ডাকব মলি। আমি বললাম, ভাইজান আপনের যা মনে চায় ডাকবেন। আমার কোনাে সমস্যা নাই। আমারে মহারানী ডাকলেও যা, মরনি ডাকলেও তা।
রূপা বলল, তুমি কি তাকে বলেছ যে উনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন ?
বলার সুযোগ কই পাইলাম আফা। উনি আছেন ঘুমের মধ্যে। আমারে বলেছেন প্লেইনে উঠলে কি জানি হয়। তখন খালি ঘুম ধরে। দুই তিন দিন সমানে ঘুমাইতে হয়। আজব ব্যাপার না আফা? আল্লাহ বাচাইছে যে আমি কোন দিন প্লেইনে উঠি নাই।
হারুন আবার টেলিফোন করেছেন। তাঁর উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল।
ব্যাটা বিয়ে হয়েছে?
না।
কেন? কি করছে?
ঘুমাচ্ছে।
রূপা! তুই ঠিক করে বল তো সমস্যা কি?
আমি তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না। জেট লেগের ধাক্কায় পড়ে ঘুম দিয়েছে। তার ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না।
আমি টেলিফোন ধরে আছি–যা থাপ্পড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। কষে থাপ্পড় দিবি যেন আমি টেলিফোনে থাপ্পড়ের শব্দ শুনতে পাই।
বাবা অস্থির হয়ো না।
অজানা অচেনা একজন ট্রেসপাস করেছে আমি অস্থির হব না?
না। কারণ এতদূর থেকে অস্থির হয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। যে ট্রেসপাস করেছে সে কোনো সন্ত্রাসী না।
বুঝলি কি করে?
চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি।
চোখের ডাক্তার হয়ে গেছিস? ফাজিল মেয়ে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে যন্ত্রণা বিদায় করবি। পাঁচ মিনিট পর আবার টেলিফোন করব।
বাবা, তোমার ঐ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর মেয়ের বিষয়ে একটা কথা জানতে চাচ্ছি। তোমার রাগ একটু কমিয়ে প্রশ্নের জবাব দাও।
কি জানতে চাস?
মনে কর তুমি মদিনার কাছে গেলে। তোমার হাতে হাতঘড়ি সেখানে বাজে বঁটা, পকেটে আছে পকেট ঘড়ি। তার টাইম সেট করা হয়েছে আটটায়। তোমার সঙ্গের মোবাইল টেলিফোনের ঘড়িতে নয়টা। এখন মদিনা কোন সময়টা বলবে?
এই পরীক্ষা তো করি নি। ইন্টারেস্টিং পরীক্ষা।
বাবা! তুমি ইন্টারেস্টিং ঘড়ি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাক। এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।
মেয়েদের বুদ্ধি কাজে লাগে না।
বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারলেই কাজে লাগে। বেশির ভাগ মানুষ কাজে লাগাতে পারে না। বাবা টেলিফোন রাখি ঐ লোকের ঘুম মনে হয় ভেঙেছে।
রাশেদ গেস্টরুম থেকে বসার ঘরে এসেছে। রূপাকে দেখে বলল, আপনি বললে হয়ত বিশ্বাস করবেন না, আমার জীবনটা ভুলে ভর্তি। ছোটখাটো ভুল না। বড় বড় ভুল। আপনি যখন বললেন, আপনার নাম রূপা তখনই আমার বুঝা উচিত ছিল, যে ঠিকানায় আমার যাবার কথা সে বাড়ির মেয়েটির নাম রুনা। রুনার সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। একবার না অনেক বার। যাই হোক, আমি তিন মিনিটের মধ্যে বিদায় হচ্ছি।
রূপা বলল, এখন রাত দশটা চল্লিশ। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় বের হবেন এবং ভুল করে আবারও অন্য একটা বাড়িতে উঠবেন। সেই বাড়ির মেয়ের নাম হয়ত রুমা। তাকে ব্রাজিলের চকলেট দেবেন, ভয়েস রেকর্ডার দেবেন। এটা ঠিক হবে?
আমি হোটেলে উঠব। দিনে ঠিকানা খুঁজে বের করব।
যাদের কাছে যাচ্ছেন তাদের টেলিফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আছে। তাদের টেলিফোন করে দিন তারা এসে আপনাকে নিয়ে যাক।
টেলিফোন বুক আনতে ভুলে গেছি।
ভাল করেছেন। আসুন খেতে বসি। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যাবেন।
থ্যাংক য়্যু। তুমি খুবই ভাল মেয়ে।
আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। তুমি বলার মত ঘনিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে আমার হয় নি।
সরি।
যান হাত মুখ ধুয়ে আসুন। আমরা ডিনার করি। ক্ষিধে লেগেছে না?
হুঁ।
রূপা খাবার টেবিলের দিকে রওনা হল। তার মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করেছে। হারুন টেলিফোন করেছেন। রূপা ধরল না। খাওয়া-দাওয়া শেষ হোক তারপর বাবাকে সব জানানো যাবে।
মলিনা শুকনা মুখে খাবার ঘরে ঢুকে বলল, আফা উনি তো চলে গেছেন। জিনিসপত্র সব ফালায় ধুইয়া বৃষ্টির মধ্যে রওনা।
সে কি!
আমি বললাম, বৃষ্টির মধ্যে যান কই? উনি বললেন, হোটেলে। তারপর ইংরেজিতে কি যেন বললেন। মনে হয় ভাবছেন আমি ইংরেজি জানি। আমিও ভাব ধরলাম ইংরেজি জানি। আমি বললাম, ইয়েস। ইয়েস।
রূপা বলল, কথা বন্ধ করে খাবার দাও। আগে মোমবাতি জ্বালাও। যে রকম ঝড়-তুফান হচ্ছে এক্ষুণি কারেন্ট চলে যাবে।
কারেন্ট গেল মোমবাতি জ্বালানোর পর। রূপা টেলিফোন করল তার বাবাকে।
বাবা, ঢাকায় ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে–তোমার দিকের খবর বি কি হচ্ছে।
না। ঐ লোক কি গেছে?
হ্যাঁ বাবা, চলে গেছে। তুমি শোকরানা নামাজ পড়তে পার।
ভেরি গুড। আমি তো টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম
ভদ্রলোক তিনটা স্যুটকেস ফেলে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমেছে। রাস্তাঘাট কিছুই চিনে না, কোথায় যাবে কে জানে। হয়ত মলম পার্টির হাতে পড়বে মলম পার্টি চোখে মলম ডলে মানিব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। কিংবা ক্ষুর পার্টির হাতে পড়বে। তারা পেটে ক্ষুর বসাবে। রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে।
এত রাতে ছাড়লি কেন?
বাবা! তোমার কি এখন মায়া লাগছে।
হারুন চুপ করে রইলেন। রূপা বলল, তোমার মায়া লাগছে তার কারণ কি জান বাবা? তার কারণ লোকটা তার সবকিছু ফেলে গেছে। জিনিসপত্র সব নিয়ে গেলে মায়া লাগত না। এই লোক কিন্তু তার জিনিসপত্র নিতে ফিরে আসবে না।
কীভাবে জানিস ফিরে আসবে না।
তুমি তো প্যারানরমাল ক্ষমতাধর মানুষের খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়াও, তোমার নিজের মেয়েরই যে এই ক্ষমতা আছে তা জান না। বাবা রাখি? প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে।
কি রান্না করেছে?
জানি না কি রান্না করেছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আর ভাল লাগছে
রূপা লাইন কেটে দিল। হারুন লাইন কাটার পরেও হ্যালো হ্যালো করতে লাগলেন।
রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই
রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই রাশেদ পুরোপুরি ভিজে গেল। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। দমকা বাতাস। বাতাস পেছন দিক থেকে আসছে। তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। রাশেদের একবার মনে হল সে ফিরে যায়। হট সাওয়ার নিয়ে খেয়েদেয়ে কম্বল গায়ে শুয়ে থাকে। রূপাদের বাড়ি খুঁজে বের করা সমস্যা না। গাছপালায় ভর্তি বাড়ি। বাড়ির নাম রূপা। ফিরে গেলেই হয়, রূপা যদি জিজ্ঞেস করে, চলে গিয়েছিলেন কেন? তখন সত্যের মতো করে কিছু মিথ্যা বলতে হবে। যেমন হঠাৎ সিগারেট খাবার ইচ্ছা করল। ডিনারের শেষে সিগারেট খাব। এই জন্যেই সিগারেটের সন্ধানে গিয়েছিলাম। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়ব ভাবিনি।
রাশেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ভেতরের লজিক অংশ বলছে ফিরে যাও। আবেগ অংশ বলছে না।
রূপার ওপর হঠাৎ রাগ উঠে যাওয়াতেই সমস্যা হয়েছে। এমন মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে, কি কোমল গলার স্বর, সে কি করে বলে, আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। তুমি বলার মতো ঘনিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে আমার হয়নি। সে কি ভেবেছে ঘনিষ্ঠতা করার জন্যে তুমি বলা? মেয়েটিকে অনেকগুলি কারণে তুমি সে বলতে পারে। কারণগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটা যাক। কোনকিছু নিয়ে ব্রেইনকে ব্যস্ত রাখলে সে ঝড়-বৃষ্টি তুচ্ছ করবে। ক্ষিধের কষ্টও কমিয়ে দেবে। আচ্ছা এখন তুমি সমস্যা–
আমি বয়সে তোমার চেয়ে বড়। কাজেই তুমি বলেছি। এটা বড় কোনো অন্যায় না। অসৌজন্যমূলক কোনো আচরণও না। সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণ ব্যবস্থা।
আমি যে দেশে বাস করছি সেখানে আপনি তুমি তুই নেই। সবাই তুমি। আমার ভুল সেখান থেকেও হতে পারে।
কোনো মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক। তুমি আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করেছ। ভুল করে তোমার বাড়িতে উঠে পড়েছি জেনেও তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বের করে দাওনি। বরং ঝড়-বৃষ্টিতে বের না হয়ে রাতে ডিনার করে থেকে যেতে বলেছ। কাজেই তোমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি তা-না। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি তোমাকে তুমি বলতে পারি।
আচ্ছা ঠিক আছে ধরে নিলাম আমি তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার জন্যে তুমি বলেছি। এতেই সমস্যা কি? মানুষের স্বভাব হচ্ছে ঘনিষ্ঠ হওয়া। দূরে সরে যাওয়া না।
রাশেদের হঠাৎ পা পিছলালো। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে উঠে দাড়াল। বিদেশের অচেনা পথঘাটে সাবধানে হাঁটতে হয়। বাংলাদেশ এখন তার কাছে বিদেশ। তার পাসপোর্ট আমেরিকান। তার অনেক সাবধানে হাঁটা উচিত ছিল।
ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে। বুকে ঠা না বসলেই হল। তার লাংসে সমস্যা আছে। যে পরিমাণ রক্ত তার লাংসের পরিষ্কার করার কথা সে পরিমাণ করতে পারে না।
চারদিক জনশূন্য। এমন কিছু রতি হয়নি যে সব লোকজন ঘরে ঢুকে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ঝড়-বৃষ্টির দেশ। সামান্য দমকা বাতাসে শহরের পথঘাট জনশূন্য হবার কথা না। রাশেদ অন্যমনস্কভাবে কিছুদূর হাঁটল। রাস্তার মাথায় একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। চুলায় আগুন জ্বলছে। আগুন দেখা যাচ্ছে। দোকানি চাদর গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দোকানির সঙ্গে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে। সে একই চাদরের নিচে। সম্ভবত দোকানির ছেলে। রাশেদ এগিয়ে গেল।
শীতে তার শরীর কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে কটকট শব্দ হচ্ছে। রাশেদ বলল, আমাকে আগুন গরম এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?
দোকানি বলল, পারব স্যার। ইশ আপনার কি অবস্থা!
পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।
আপনার কপাল কাটছে? রক্ত পড়তাছে।
পড়ুক রক্ত। আপনার দোকানে খাবার কি আছে? আমি খুব ক্ষুধার্ত। দুপুরে লাঞ্চে দিয়েছিল স্যালমন মাছ। মাছ খেতে পারি না বলে খাইনি। এখন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।
কেক আছে, খাবেন? কেক কিন্তু টাটকা না, বাসি।
কত দিনের বাসি?
এক হপ্তা।
কেক বাদ। আর কি আছে?
ডিম আছে। ডিম সিদ্ধ করে দিলে খাবেন?
হ্যাঁ খাব। থ্যাংক য়্যু।
আপনে বাইরে দাঁড়ায়া বিষ্টিতে ভিজতেছেন। ভিতরে আসেন। একটা গামছা দেই। মাথাটা মুছেন।
থ্যাংক য়্যু এগেইন। ভাই আপনার নাম কি?
সামছু।
সামছু আমি একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি কোনো টাকা নেই। আমেরিকান টাকা আছে, ডলার।
স্যার টেকা পরে দিয়েন অসুবিধা নাই। আপনে কই মেলা দিছেন?
মেলা দিছেন মানে কি?
যান কই?
ভাল কোনো হোটেলে যাব। রাতটা হোটেলে থাকব।
সামছু চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। কেটলিতে দুটা ডিম ছেড়ে দিতে দিতে বলল, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে স্যার? একটা সিগারেট দেই। টান দিলে শীতটা কমব।
সিগারেট খাই না।
স্যার গরিবের একটা কথা কি শুনবেন?
অবশ্যই শুনব।
ঢাকা শহর নষ্ট হয়ে গেছে, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, মরিচগুড়া পার্টি। এত রাইতে হোটেলে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন।
রাতে থাকব কোথায়? আমার রাতে থাকার কোনো জায়গা নেই।
আমার এই দোকানে থাকবেন? আমরা বাপ-বেটায় রাইতে দোকানে থাকি। নয়া একটা লুঙ্গি খরিদ করেছি। সেলাই হয় নাই বইল্যা পরি নাই। লুঙ্গি পেঁচায়া শুইয়া পড়বেন। এক ঘুমে রাইত পার।
আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে এবং আনন্দের সঙ্গে আপনার দোকানে থাকব। এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আপনার দয়ার কথা সারাজীবন মনে রাখব।
সামছু জিভে কামড় দিয়ে বলল, স্যার কি যে কন। আমি গরিব মানুষ, আমার কি দয়া করার কোনো ক্ষমতা আছে? গরম পানি দেই সিনান করেন।
গরম পানি কোথায় পাবেন?
কেতলিতে গরম পানি বলক উঠতাছে। সিনান কইরা দোকানে উঠেন। তারপর খানা।
রাশেদের হট বাথের শখ ছিল সে আয়েশ করেই হট বাথ নিল। বালতিতে গরম পানি, মাথায় পড়ছে ঠাণ্ডা পানি। একইসঙ্গে হিমশীতল পানি এবং গরম পানির ধারা স্নান। খেতে বসেও চমক। খিচুড়ি সঙ্গে ডিমের ভর্তা। রাশেদ আনন্দিত গলায় বলল, খিচুড়ি কোথায় পেয়েছেন?
সামছু বলল, বাপ-বেটা না খায়া থাকব? খিচুড়ি সইন্ধ্যা ওয়াক্তে আমরা খাইছি। সকালের নাশতার জন্য কিছু ছিল সেইটা আপনারে দিলাম! খাইতে কি সোয়াদ হইছে স্যার?
অমৃতের মতো লাগছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
আমারে খামাখা ধন্যবাদ দেন কি জন্যে? আল্লাপাক আপনের রিজিক রাখছে এইখানে, প্রত্যেকটা দানার মধ্যে আপনার নাম লেখা।
প্রতি দানায় আমার নাম লেখা?
জ্বে। যে দানায় নাম লেখা নাই সেই দানা মুখে দিতে পারবেন না। ভুলক্রমে মুখে দিলেও থু করে ফেলে দিতে হবে। আল্লাহ পাকের এমনই হিসাব।
দোকানে পাটিপাতা। তার উপরে পত্রিকার কাগজ বিছানো হয়েছে। সামছু বলল, কম্বলটা গায়ে দেন। গত বছর শীতের সময় দুইটা কম্বল পাইছিলাম। কমিশনার সাব দিছিলেন। রাতটা কষ্টমষ্ট কইরা পার করেন।
রাশেদ বলল, আমি খুব আনন্দ করে রাতটা পার করব।
সামছু বলল, আমার পুলা কিন্তু গাতক আছে।
গাতক কি?
সংগীত যে জানে তারে কয় গাতক। আপনেরে সরম পাইতেছে। সরম ভাঙলে গানে টান দিব। খুব ইচ্ছা ছিল তারে ক্ষুদে গান রাজ-এ দিব। ক্যামনে দিতে হয় জানি না বইল্যা পারলাম না।
ক্ষুদে গান কি?
টেলিভিশনে পুলাপানের গান। যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা লাখ লাখ টেকা পায়, বাড়ি পায় তারপর ধরেন লন্ডন যায়, বিলাত যায়।
আপনার ছেলে কি ফাস্ট হওয়ার মতো গান গায়?
অবশ্যই। যদি না পায় তাইলে আমি একটা কান কাইট্যা আপনেরে দিয়া দিব। আপনে কুত্তারে দিয়া খাওয়ায় দিবেন। বাকি জীবন এক কান নিয়া ঘুরব। এই ওয়াদা করলাম।
রাশেদ বলল, খোকা শুনি একটা গান।
পামু না।
কেন না?
আমি আপনেরে সরমাই।
বৃষ্টির জোড় বেড়েছে। টিনের ছাদে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ। রাশেদ বলল, I am a blessed person no doubt of that, what an experience.
সামছু বলল, স্যার কি কইছেন বুঝি নাই।
বললাম, আমি একজন সুখী মানুষ।
সামছু বলল, অনেক বকর বকর করেছি। স্যার ঘুম দেন। মশা নাই। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মশা আসে না। আর যদিও আসে মশার কয়েল দিয়া দিব।
বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে রাশেদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই শুনল কে যেন গান করছে—
মানুষ ধর মানুষ ভজ শুন বলি এ পাগল মন।
মানুষের ভিতর মানুষ করিতেছে বিরাজন॥
সামছুর ছেলে গান করছে। সামছু একটু পর পর বলছে–সব্বাস ব্যাটা। সাব্বাস। স্যার ঘুমায়া পড়ছেন। স্যার জাগনা থাকলে পুরস্কার পাইতি।
স্বর্গের অপ্সরাদের আরেক নাম কিন্নর। কিন্নরদের আছে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। হতদরিদ্র সামছুর মাতৃহারা শিশুটি পৃথিবীতে এসেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে। সেই কিন্নর কণ্ঠ প্রকাশিত হবার জন্যেই হয়ত বৃষ্টিস্নাত রজনিতে রাশেদের প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতি রাশেদকে নিয়ে এসেছে কিন্নর কণ্ঠের কাছে। প্রকৃতি লীলাময়, তার লীলা বোঝা বড়ই কঠিন।
সামছু মিয়া খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুলা ধরাল। বৃদ্ধের দলের কেউ কেউ মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় তার স্টলে চা খায়। দুধ চিনি ছাড়া লিকার চা, আদা চা এবং লেবু।
আজ কেউ আসবে না, এখনো বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘন কালো। দীর্ঘ জীবন পিয়াসী বৃদ্ধের দল আজ এই বৃষ্টিতে বের হবে না। সকালের প্রথম ব্যবসা মার গেল।
রাশেদ জেগেছে। তার চোখ খোলা। সামছু বলল, ঘুম ভাল হইছে স্যার?
রাশেদ বলল, না। সারারাত আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি।
স্বপ্ন কি দেখছেন?
জন্তুর মতো একটা কি যেন কামড়ে কামড়ে আমার পা খাচ্ছে। আমার প্যারালাইসিস। হাত পা নাড়াতে পারছি না। চিৎকার করে কাউকে ডাকতেও পারছি না। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।
একটা মুরগি ছদকার ব্যবস্থা করেন স্যার।
মুরগির ছদকা ব্যাপারটা কি?
একটা মুরগি কিনবেন। গরিব মিসকিনরে দিয়া দিবেন। স্বপ্নের দোষ কাটা যাবে। স্যার চা খাবেন?
না। আমার ধারণা আমার জ্বর এসেছে। মুখ দিয়ে ভাপ বের হচ্ছে। আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে? জ্বর মাপার যন্ত্র?
জ্বে না। আমরা গরিব মানুষ। মাথায় হাত দিয়া জ্বর মাপি।
আমার মাথায় হাত দিয়ে জ্বরটা মাপুন তো।
সামছু রাশেদের মাথায় হাত রাখল। রাশেদ বলল, জ্বর আছে?
আছে।
বেশি? জী বেশি। খুব বেশি।
আমার নিজেরও তাই ধারণা। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। জনু থেকেই আমার লাংসে কিছু সমস্যা আছে। আপনি কি আমাকে ভালো কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন?
অবশ্যই পারব।
ঢাকার সবচে বড় হাসপাতালের নাম কি?
সেটা তো স্যার জানি না।
সামছু লক্ষ করল মানুষটার চোখ লাল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুখ থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসছে।
সামছু বলল, কি করি কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না। স্যার পানি খাবেন?
না। বমি আসছে। আপনি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
স্যার পারব। ডাক্তারের ভিজিট ক্যামনে দিব?
আমার কাছে ডলার আছে।
রাশেদ কথা শেষ করতে পারল না। বমি শুরু করল। বমির সঙ্গে রক্ত আসছে।
সামছু বলল, ইয়া খোদা এখন কি করি? বাবা কেনতু! এখন করবটা কি?
কেনতু বলল, ডাক্তার ডাক। দৌড় দেও।
সামছু দোকান থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল।
রূপা ছবি আঁকতে বসেছে
রূপা ছবি আঁকতে বসেছে। জলরঙের ছবি আঁকার আয়োজন অনেক। পেপারে ট্রিটমেন্ট দিয়ে আয়োজনের শুরু। বাথটাবে হ্যান্ডমেড পেপার ভেজানো হয়েছে। ভেজা কাগজ রোদে খানিকটা শুকিয়ে রঙের প্রথম ওয়াশ দিতে হবে। জলরঙ ছবির বিষয়বস্তু আগেভাগে ঠিক করা কঠিন। ছবি তার নিজের প্রাণে এগিয়ে চলে। তারপরেও রূপা ঠিক করে রেখেছে তার ছবির মূল বিষয় হবে জানালা। জানালা দিয়ে ঘরে রোদ ঢুকছে এ রকম ছবি। ছবির নাম রোদ্র। কিংবা রোদ। রোদের আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে Sunshine, একইভাবে জোছনা Moonshine. কবি-সাহিত্যিকরা নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন। ইংরেজি ভাষার কেউ রোদ এবং জোছনার কোনো প্রতিশব্দ কেন করলেন না ভাবতে ভাবতে রূপা একটা শব্দ নিজেই তৈরি করল, রোদ হল Sube. তার ছবির নাম Sube. কেউ যদি জিজ্ঞেস করে Sube কি? সে বলবে রোদ। একইভাবে জোছনা হল Mube.
রূপা ডিকশনারি খুলল, হয়ত দেখা যাবে sube বলে কোনো শব্দ আছে। Oxford Advanced Learners Dictionary-তে Sube বা Mube নামে কোনো শব্দ নেই। কাজেই ছবির নাম sube রাখা যেতে পারে।
আফা, খালুজান আসছে। সাথে একটা মাইয়া নিয়া আসছে। মাইয়াটারে দেইখা মনে হয় দোয়াইতের কালি দিয়া সিনান কইরা আসছে। এমুন কালা মাইয়া আমি বাপের জন্মে দেখি নাই। মা কালীও এই মাইয়ার কাছে ফর্সা।
রূপা উঠে দাঁড়াল। বাথটাবে কাগজ আরো কিছুক্ষণ ভিজলেও ক্ষতি হবে না। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা করছে বাবার ব্যস্ত মুখ দেখতে। বাবা যেখানেই যান মাইক্রোবাস ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে আসেন, কলার কাদি, মানকচু। মাটির হাঁড়িতে জিয়ল মাছ। একবার দুটা রাজহাঁস নিয়ে এসেছিলেন। ছাড়া পেয়েই দুটা হাঁসের একটা ছুটে এসে রূপার হাঁটুতে ঠোকর দিয়েছিল।
রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। একটু দূরে কাপড়ের পুঁটলি হাতে দশ-এগারো বছরের এক বালিকা। বালিকার গাত্রবর্ণ ঘন কালো। তার মুখ গোলাকার। এতই গোল যে দেখে মনে হয় কাঁটা কম্পাস দিয়ে আঁকা।
গোলাকার মুখের সঙ্গে মিলিয়ে বড় বড় গোল চোখ। গোল চোখে আপনাতেই বিস্ময় ভাব চলে আসে। বালিকার চোখের বিস্ময় নেই, বিষণ্ণতা আছে।
হারুন রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো ইয়াং লেডি।
রূপা বলল, হ্যালো ওল্ড বাবা। এই কি তোমার ঘড়ি-কন্যা?
হারুন বললেন, ইয়েস।
জীবন্ত ঘড়ি নিয়ে চলে এসেছ?
হুঁ। ঘরের টুকটাক কাজ করবে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। পড়াশোনা করবে।
বাবা-মা ছেড়ে দিল?
না দিয়ে করবে কি? একবেলা খাওয়া জুটে তো দুই বেলা জুটে না এমন অবস্থা। আমি যখন বললাম, মেয়েটাকে আমার কাছে দিয়ে দাও, তারা মনে হল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। মেয়েটাকে কাছে ডেকে দুএকটা কথা বল। ঘড়ির সময় জিজ্ঞেস কর। ওর ভয়টা কাটিয়ে দে।
সে ভয় পাচ্ছে না বাবা।
ভয় অবশ্যই পাচ্ছে। বস্তি থেকে উঠে আসা মেয়ে। প্রথম ঢাকা শহরে এসেছে। ভয় পাবে না মানে?
নাম মদিনা! তাই না বাবা?
হুঁ। বাবা-মা ডাকে লতি।
নাম মদিন, বাবা-মা লতি ডাকবে কেন?
আমি জানব কীভাবে? আমাদের বাড়িতে তার স্টেটাস কি?
কাজের মেয়ে? তার স্টেটাস হচ্ছে A gifted child.
হারুন গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, লতি এদিকে আস। তোমার আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।
মদিনা এগিয়ে এল। তার আসার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। রূপার আবার মনে হল, নতুন পরিবেশে এসে মেয়েটা মোটেই ভয় পাচ্ছে না। ভয় না পেলেও কৌতূহল থাকবে। মেয়েটার চোখে কৌতূহলও নেই।
হারুন বললেন, লতি! রাজকন্যার মতো যে মেয়েটাকে দেখছ সে হচ্ছে আমার মেয়ে। তার কথা তোমাকে বলেছি। ছবি আঁকে। আমার মেয়ের নাম রূপা তাকে তুমি আপা ডাকবে।
রূপা বলল, মদিনা এসো আমার সঙ্গে। আমি জরুরি কিছু কাজ করছি। কাজ করতে করতে গল্প করব।
মদিনা মেঝেতে মাথা নিচু করে বসেছে। আরচোখে রূপার কাজ দেখছে। রূপা বাথটাব থেকে ভেজা কাগজ মেঝেতে বিছিয়ে দিল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে মদিনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মদিনাও চোখ তুলে তাকালো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
রূপা বলল, নতুন জায়গায় এসে তোমার কি ভয় লাগছে?
মদিনা মুখে কিছু বলল না, তবে মাথা নেড়ে জানালো তার ভয় লাগছে। রূপা বলল, ভয় লাগার কিছু নেই। আমার বাবা অত্যন্ত ভাল মানুষ। ভাল মানুষের ছেলেমেয়েরাও ভাল মানুষ হয়। আমিও ভাল মেয়ে।
মদিনা বলল, আপনি যে ভাল মেয়ে আমি জানি।
রূপা বলল, কীভাবে জান?
মদিনা জবাব দিল না।
রূপা বলল, এ বাড়িতে তোমার প্রধান কাজ কি হবে জান? তোমার প্রধান কাজ হবে আমাকে সাহায্য করা। কাগজ পানিতে ভেজানো, শুকানো, বোর্ডে কাগজ বসিয়ে টেপ লাগানো, রঙের টিউবের মুখ বন্ধ করা, ব্রাশ পরিষ্কার করা এইসব। আমি কি করি দেখবে। দেখে দেখে শিখবে।
মদিনা ঘাড় কাত করে জানালো সে শিখবে।
তুমি কি লেখাপড়া জান?
ক্লাস ফাইভ পাস করছি।
খুব ভাল। এখন তুমি একটা কাজ কর। তোমার এই মুহূর্তে কি কি লাগবে একটা কাগজে লিখে আমার কাছে দাও। আমি আনিয়ে দেব। একই সঙ্গে তোমার হাতের লেখারও একটা পরীক্ষা হবে।
আমার কিছু লাগবে না।
অবশ্যই লাগবে। তুমি খালি পায়ে এসেছ। তোমার একজোড়া স্যান্ডেল লাগবে। টুথপেস্ট, ব্রাশ লাগবে। মুখে মাখার ক্রিম লাগবে, নারিকেল তেল লাগবে, সাবান, তোয়ালে লাগবে।
মদিনা হাসল। রূপা লক্ষ করল মেয়েটার হাসি অস্বাভাবিক সুন্দর। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে শুধু তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। এই মেয়েটার ঠোঁট এবং চোখ একসঙ্গে হাসছে।
আফা একটা কথা বলব?
বল।
আপনার এই বাড়িতে ভূত আছে।
তাই নাকি?
জী। খারাপ ভূত।
ভূতের ভাল-খারাপ আছে?
হুঁ।
তুমি কি ভূতটাকে দেখতে পাচ্ছি?
হুঁ! ঘরের কোনায় খাড়ায়া আপনার দিকে তাকায়াছিল। এখন নাই।
রূপা হাতের কাজ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মদিনার দিকে তাকিয়ে বলল, মদিনা শোন, ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্কস এইসব পৃথিবীতে নেই। মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে বলে এইসব কল্পনা করে। তুমি এখন মলিনার কাছে। যাও। মলিনা দেখিয়ে দেবে তুমি কোথায় থাকবে। তোমাকে যে লিস্ট করতে বলেছি লিস্টটা করবে। মলিনাকে বল আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। তুমি কি চা বানাতে পার?
না।
মলিনার কাছ থেকে শিখে নেবে কীভাবে চা বানাতে হয়। পারবে না?
পারব।
রূপা মদিনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বল কয়টা বাজে।
মদিনা বলল, বলতে পারব না।
বাবা বলছিল, জিজ্ঞাস করা মাত্র তুমি সময় বল।
সবসময় পারি না। মাঝে মাঝে পারি।
আচ্ছা যাও।
মদিনা উঠে দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, আফা ভূতটা আবার আসছে। ঐ যে কোনায় খাড়ায়া আছে।
রূপা বলল, ভূত ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকুক। তোমাকে যা করতে বলেছি কর।
দুপুরে খেতে বসে হারুন বললেন, ঐ ছেলে রাশেদ না ফাসেদ কি যেন নাম, সে কি তার জিনিসপত্র নিয়ে গেছে?
রূপা বলল, না।
কতদিন হল গেছে?
তিন দিন দুই রাত।
টেলিফোনে কোনো খোঁজ খবর করেছে?
না।
হারুন বিস্মিত হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো।
রূপা বলল, আশ্চর্যের কিছু নেই। উনি ইচ্ছা করেই এটা করছেন। আমার উপর মানসিক চাপ দেয়ার চেষ্টা। জিনিসপত্র ফেলে রেখে Mental pressure.
তোকে মেন্টাল প্রেসার সে কেন দিবে? তুই তার কে?
আমি তার কেউ না। তিনি আমার উপর মানসিক চাপ কেন দেবেন তাও। জানি না। হয়তো তিনি এক ধরনের খেলা খেলছেন। কিছু মানুষ আছে, আশেপাশের মানুষদের নিয়ে খেলতে পছন্দ করে, যেমন তুমি।
আমি?
তুমি জীবন্ত ঘড়ি নিয়ে চলে এসেছ। এটা তোমার খেলার একটা অংশ। তাকে নিয়ে এসেছ তোমার সব আগ্রহের সমাপ্তি।
তোর জ্ঞান তো বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর তোকে আর রূপা ডাকা যাবে না। ডাকতে হবে জ্ঞান রূপা।
জ্ঞান রূপা নাম আমার পছন্দ হয়েছে। বাবা থ্যাংক য়্যু।
ঐ ছেলেকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার নেক্সট প্রজেক্ট–অপারেশন রাশেদ কিংবা ফাসেদ হান্ট।
রূপা বলল, ঢাকা শহরে এক কোটি মানুষ বাস করে। কেউ যদি এক কোটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে চায় সে সারাজীবন লুকিয়ে থাকতে পারবে।
হারুন বললেন, কোনো বুদ্ধিমান লোক চেষ্টা করলে খুঁজে বের করতে পারবে।
রূপা বলল, বাবা তুমি বুদ্ধিমান মানুষ না। তুমি পারবে না।
আমি বুদ্ধিমান না?
না। যে কবিতায় ইতিহাসের বই লেখে সে বুদ্ধিমান না।
হারুন কঠিন গলায় বললেন, আমি গাধা মানব?
রূপা বলল, বাবা তুমি রেগে যাচ্ছ।
আমি তাকে কীভাবে খুঁজে বের করব শোন–ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব। শিরোনাম হবে–রাশেদ কিংবা ফাসেদ তোমাকে খুঁজছি।
রূপা বলল, বারবার রাশেদ কিংবা ফাসেদ বলবে না। তার নাম রাশেদ। এখন বল তার ছবি কোথায় পাবে?
থানায় ডায়েরি করাব। পুলিশ ছবি জোগাড় করবে।
তোমার কি ধারণা ডায়েরি করানোর সঙ্গে সঙ্গে থানার সব পুলিশ হাতে রাশেদ সাহেবের ছবি নিয়ে তাকে খুঁজতে বের হয়ে যাবে?
হারুন বললেন, আচ্ছা যা, তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না এটা মানলাম। আমি যে একজন গাধা মানব সেটাও মানলাম।
হারুন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখন হন্তদন্ত হয়ে মলিনা চুকল। তার হাতে রূপার মোবাইল ফোন সেট। মলিনা বলল, আফা আম্মা টেলিফোন করছেন। রূপার মা টেলিফোন করলেই মলিনার মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যস্ততা দেখা যায়।
রূপা বলল, মাকে বল আমি ভাত খাচ্ছি। এখন টেলিফোন ধরব না। তোমাকে আগেও বলেছি খাওয়ার সময় আমাকে টেলিফোন দিবে না।
হারুন বললেন, তুই যে কাজটা করলি তা অভদ্রতা এবং অসভ্যতা। বাইরের কেউ টেলিফোন করেনি, তোর মা টেলিফোন করেছে। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা।
রূপা বলল, যে কোনো কথা জরুরি ভাবলেই জরুরি, না ভাবলেই জরুরি না।
এটা কার কথা?
জ্ঞান রূপার কথা।
হারুন রাগি গলায় বললেন, এইসব বাণীগুলি তুই একটা খাতায় লিখে ফেল। আমি নিজ খরচে ছাপিয়ে দেব। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বের হবে। বইয়ের নাম হবে কথামৃত। লেখিকা জ্ঞান রূপা।
রেগে রেগে কথা বলছ কেন বাবা?
তুই তোর মার সঙ্গে অভদ্রতা করেছিস দেখে রাগ উঠেছে। সন্তানরা মাবাবার সঙ্গে অদ্ৰতা করবে এটা আমার পছন্দ না।
রূপা বলল, বাবা-মা অকারণে আমার উপর রাগ করবে এটাও আমার পছন্দ না। কাজেই এখন অপছন্দে অপছন্দে কাটাকাটি।
রূপার মার নাম শায়লা খানম। বাংলা সাহিত্যে এম.এ, তিনি স্কুল শিক্ষক বাবার পাঁচ ছেলেমেয়ের সর্বশেষ জন। তরুণী বয়সে অসম্ভব রূপবতী ছিলেন। এখনো সেই রূপ ধরে রেখেছেন। হারুনের ধারণা এখন শায়লা আগের চেয়েও রূপবতী। যতই দিন যাচ্ছে ততই না-কি তার রূপ বাড়ছে।
রূপার যখন সাত বছর বয়স তখন এক ঝড়বৃষ্টির রাতে তিনি রূপার ঘরে ঢুকলেন। নরম গলায় বললেন, ভয় লাগছে না-কি মা?
রূপা বলল, হ্যাঁ।
শায়লা বললেন, ভয় লাগারই কথা, মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও বাজ পড়ছে।
রূপা বলল, আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাবে?
শায়লা বললেন, হ্যাঁ।
রূপার আনন্দের সীমা রইল না। রূপার ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। ফ্যানের হুক থেকে একটা দোলনা ঝুলে। রূপার খাটটা কুষ্টিয়ার এক জমিদার বাড়ি থেকে কেনা। খাটের চারদিকে আয়না বসানো। খাটে বসলেই আয়নায় অনেকগুলি রূপ দেখা যায়। কিন্তু রূপা তার ঘরে রাতে একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। আকবরের মা কাজের বুয়া মেঝেতে বিছানা করে রূপার সঙ্গেই ঘুমায়। তারপরেও রূপার ভয় যায় না। শুধু মা পাশে থাকলে তার ভয় লাগে না।
রাতের খাবার শেষ করে শায়লা রূপার সঙ্গে ঘুমুতে এলেন। রূপা মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার আর ভয় লাগছে না মা।
শায়লা বললেন, খুব ভালো।
রূপা বলল, মা গল্প বল।
শায়লা বললেন, গল্প না, আজ রাতে তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শোন।
রূপা বলল, আচ্ছা। শুধু যখন বজ্রপাত হবে তখন মন দিয়ে শুনতে পারব না।
শায়লা বললেন, জরুরি কথাটা হচ্ছে, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তোমাকে ঠিক করতে হবে, তুমি আমার সঙ্গে যাবে না-কি তোমার বাবার সঙ্গে থাকবে?
তুমি কোথায় যাবে?
চিটাগাং। সেখানের এক কলেজে আমি চাকরি পেয়েছি। যাবে আমার সঙ্গে?
রূপা বলল, হুঁ।
হুঁ না, স্পষ্ট করে বল–আমি তোমার সঙ্গে যাব।
রূপা কি বলল, বুঝা গেল না, সেই সময় প্রচণ্ড বজ্রপাত হল।
শায়লা বললেন, এখন কি কবিতা বলে তোমাকে ঘুম পাড়াব?
রূপা বলল, হুঁ।
শায়লা রূপার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কবিতা শুরু করলেন। সক মায়েরা সন্তানদের ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। শায়লা কবিতা আবৃত্তি করেন। একটি কবিতাই আবৃত্তি করেন
দিনের আলো নিবে এল সূয্যি ডোবে ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঠঙ ঠঙ।
পরের অংশ রূপার কাছে অস্পষ্ট। রূপা দেখল এক সন্ধ্যাবেলা তার মা ব্যাগ। স্যুটকেস নিয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও তিনি বলেছেন, চিটাগাং যাবেন আসলে তী-না, তিনি থাকবেন ঢাকাতেই। আকবরের মা বুয়া রূপাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার বাপ-মার ছাড়াছাড়ি হইছে।
রূপা বলল, ছাড়াছাড়ি কি?
ছাড়াছাড়ি হইল তালাক। তারার তালাক হইছে।
তালাক কি?
তোমার মা অন্য এক লোকরে হাঙ্গা বইছে।
হাঙ্গা বইছে মানে কি?
অত কিছু বলতে পারব না। তোমার কপাল ভাঙছে।
পুরো বিষয়টা হারুন মেয়েকে ব্যাখ্যা করলেন। সুন্দর করেই ব্যাখ্যা করলেন। তিনি মেয়েকে বললেন, তোমাদের ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পার না। দেখলেই রাগ লাগে।
রূপা বলল, আছে সুমি নাম।
সে কি করে?
পেনসিল দিয়ে আমাকে খোঁচা দেয়। একদিন আমার স্যান্ডেলে থুথু দিয়েছিল। আমার অংক বইয়ের পাতা ছিঁড়েছে।
সুমি অন্য সেকশানে চলে গেলে ভালো হয় না?
খুব ভালো হয় বাবা।
তোমার মার সঙ্গে আমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমার মা চলে গেছেন অন্য সেকশানে।
মা তো তোমাকে পেনসিল দিয়ে খোঁচা দেয় না।
বড়রা পেনসিলে খোঁচা দেয় না। কথা দিয়ে খোঁচা দেয়। তোমার মা কথার খোঁচা দেন। আমিও দেই। খোঁচাখুঁচি করতে করতে দুইজনই ক্লান্ত। তোমার মা অনেক বেশি ক্লান্ত বলেই এখন অন্য এক ভাল মানুষকে বিয়ে করেছেন। বুঝেছ?
হুঁ।
তোমার মা চাচ্ছেন তুমি তাদের সঙ্গে গিয়ে থাক। আমিও তাই চাচ্ছি। তোমার বয়স খুব কম। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্যে মায়ের আদর দরকার। মা তুমি কি যাবে তোমার মার সঙ্গে?
রূপা বলল, না।
হারুন বললেন, তোমার জন্যে যা ভাল তাই তোমার করা উচিত। তোমার জন্যে ভাল হল তোমার মার সঙ্গে থাকা। আমি প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে যাব। খেলনা চকলেট এইসব নিয়ে যাব।
আমি মার সঙ্গে থাকব না। তোমার সঙ্গে থাকব।
রূপা! তুমি তোমার মায়ের মতই জেদি হচ্ছ।
আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
আচ্ছা যাও আমার সঙ্গে থাকবে। একটু বড় হও দেখবে কত ধানে কত চাল। আমি কথার খোঁচা দিতে শুরু করব। তুমি পালাবার পথ পাবে না।
শায়লা মেয়েকে নিজের কাছে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কোনো লাভ হয় নি।
রূপী তার মাকে টেলিফোন করল। শায়লা বললেন, তোর খবর কি?
রূপা বলল, ভাল।
জরুরি একটা বিষয় নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
বল।
কথাটা তোর বাবার বিষয়ে। সে আশেপাশে নাই তো?
না।
তোর বাবা ইদানীং খুব বিরক্ত করছে।
কি করছে?
মাছ পাঠাচ্ছে, তরিতরকারি পাঠাচ্ছে। টেলিফোনে খোঁজ-খবর করছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল লাগে না, টগরের বাবার কাছেও না। টগরের বাবা অতিমাত্রায় ভদ্র। সে কখনো কিছু বলবে না। কিন্তু সে যে বিরক্ত হচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে। এই মাসের ১২ তারিখ সে কি করেছে তা-কি জানিস?
জানি না।
আমাকে দামী একটা শাড়ি পাঠিয়েছে। ১২ তারিখ তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল এই উপলক্ষে শাড়ি। এখন ব্যাপারটা আমার জন্যে কতটা অস্বস্তিকর বুঝতে পারছিস? যে বিয়ের অস্তিত্বই নেই সেই বিয়ের দিন আবার কি?
ঠিক বলেছ মা।
টারের বাবা আমাকে বলল, তুমি তোমার প্রথম হাজব্যান্ডকে নিয়ে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করে এসো। ঘণ্টা দুই স্মৃতি রোমণ কর।ভদলোককে কিছু সময় দাও। ভদ্রলোক তোমার হাত ধরতে চাইলে হাত ধরতে দাও। তিনি তোমাকে মিস করেন। কি রকম বিব্রতকর অবস্থা বুঝতে পারছিস?
পারছি।
তুই কি তোর বাবাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে পারবি?
পারব তবে বলব না।
বলবি না কেন?
কারণ সমস্যাটা তোমার, আমার না। তোমার সমস্যা তুমি সমাধান করবে। বাবাকে টেলিফোন করে বলবে, স্টপ দিস ননসেন্স। মা টেলিফোন রাখলাম। রূপী ফোনের লাইন কেটে দিন। হারুন তখনি মেয়ের পাশে এসে দাড়ালেন, আগ্রহ নিয়ে বললেন, এতক্ষন তুই কি তোর মার সঙ্গে কথা বলছিলি?
রূপা বলল, হ্যাঁ।
কি বলল তোর মা?
হাবিজাবি কথা।
হাবিজাবি কি কথা?
আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছে এই জাতীয় কথাবার্তাকে বলে হাবিজাবি muit
আর কিছু বলেনি?
না।
আমার বিষয়ে তোর মা কিছু বলেছে?
না।
আজ একটা বিশেষ দিন তো। আমি ভাবলাম এই বিষয়ে তোকে কিছু বলল কি না।
বিশেষ দিনটা কি?
তোর মার সঙ্গে আজ আমার প্রথম দেখা হয়।
তোমাদের তো আর প্রেমের বিয়ে না। প্রথম দেখাটা এত ইস্পর্টেন্ট কেন হবে?
হারুন লজ্জিত গলায় বললেন, তোর মাকে দেখে বাসায় ফিরে বিরাট এক কবিতা লিখেছিলাম। বয়স কম ছিল তো। খানিকটা বোকাও ছিলাম। পুরো কবিতাটা আমার মুখস্ত আছে। শুনবি?
রূপা বলল, না শুনব না। তুমি ছাদে চলে যাও। নিজের মনে কবিতা আবৃত্তি করতে থাক। ছাদে অনেক গাছপালা আছে, তারা তোমার কবিতা শুনে মজা পাবে। বাবা প্লিজ।
চারা লাইন শোন। চার লাইন কবিতায় তোর তেমন কোনো ক্ষতি হবার কথা না।
রূপা হতাশ গলায় বলল, শুনাও।
হারুন সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলেন। তাকে আনন্দে অভিভূত হতে দেখা গেল। রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।
আষাঢ়ের কলি ছিল
সময় সন্ধ্যা
চারদিক সুনসান
জীবন বন্ধ্যা॥
গিয়েছিলাম মালিবাগ
বাড়ি নম্বর সাত
কিছু সময় কাটালাম
হয়ে গেল রাত।
আমার এক বন্ধু
নাম সুমন
বলল সে আজ তুমি
থাকে কিছুক্ষণ
শায়লা নামে এক মেয়ে
ঐ বাড়িতে থাকে।
দেখবে তার শান্ত মুখ
কোন এক ফাঁকে…
রূপা বলল, চার লাইন বলার কথা। তুমি দেখি ফেরদৌসির শাহানামা শুরু করেছ। কবিতা বন্ধ।
হারুন বন্ধ করলেন না, আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলেন।
সুমনের কথা সত্য
মিথ্যা মোটেই নয়
শায়লার সঙ্গে আমার
হল পরিচয়॥
রাশেদ বুঝতে পারছে না সে কোথায় আছে
রাশেদ বুঝতে পারছে না সে কোথায় আছে। তার গায়ে নীল রঙের কম্বল। কম্বল থেকে ওষুধের গন্ধ আসছে। ফরমালডিহাইডের গন্ধ। HCHO. সোডিয়ামের সঙ্গে ফরমালডিহাইড কি কোন বিক্রিয়া করে?
Na + HCHO
কি হয়? আচ্ছা হঠাৎ সোডিয়ামের কথা কেন মনে হল? প্রচুর সোডিয়াম আমরা লবণের কারণে খাচ্ছি। এই সোডিয়াম শরীর কীভাবে বের করে? হেভি মেটাল শরীর বের করতে পারে না। লেড পয়জনিং হয়। মারকারি পয়জনিং হয়, মারকারির ইংরেজি কুইক সিলভার। রাশেদের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার নাম সিলভার। না না সিলভার না, অন্য কিছু, সেটাও সিলভার। তা কি করে হয়।
আপনি এখন কি একটু ভাল বোধ করছেন?
রাশেদ বলল, আমি কোথায়?
আপনি হাসপাতালে।
ও আচ্ছা হাসপাতাল। আপনি ডাক্তার?
জী।
রাশেদ বলল, সোডিয়াম অতি রিএ্যাকটিভ একটা ধাতু। আমাদের শরীর ভর্তি সোডিয়াম। এখন…
ডাক্তার বললেন, আপনি কথা বলবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। আপনার নিঃশ্বাসের কষ্ট কি কমেছে? অক্সিজেন মাস্ক কে খুলেছে, আপনি নিজেই খুলেছেন?
জানি না।
আপনার পরিচিত কেউ কি আছে যে আপনার টেক কেয়ার করবে। রাতে আপনার সঙ্গে থাকবে।
না।
ডাক্তার রাশেদের মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিলেন।
আপনি চোখ বন্ধ করুন। তাকিয়ে থাকবেন না।
রাশেদ চোখ বন্ধ করল। তারপরেও নানান ধরনের আলো সে দেখতে পাচ্ছে। অনেক দূরে তারার আলোর মতো আলো দেখা যায়। সেই আলো ছুটে কাছে আসছে। ব্যাপারটা কি? আলোর গতিবেগ আমরা জানি। সেকেণ্ডে কত যেন? আচ্ছা অন্ধকারের গতিবেগ কত? আলো হল ফোটন। একটা সোডিয়াম এটমের গায়ে যদি ফোটন এসে আঘাত করে তাহলে কি সোডিয়াম থেকে ইলেকট্রন ছুটে বের হবে?
ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট। যিনি প্রথম ফটো ইলেকট্রিক এফেক্টের ব্যাখ্যা দেন তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। তার নাম কি বলতে হবে। সময় তিন সেকেন্ড। ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান, ওয়ান থাউজেন্ড টু, ওয়ান থাউজেন্ড থ্রি। তিন সেকেন্ড শেষ। নাম বলতে না পারার জন্যে শাস্তি। কানে ধরে উঠবস কর। তার নাম আইনস্টাইন। এখন বললে হবে না, তিন সেকেন্ড পার হয়ে গেছে। ভিসকোয়ালিফাইড। ইউ লস্ট দ গেম। সেকেন্ড চান্স। এখন বলতে হবে মানুষ ধর মানুষ ভজ গান যে করেছে তার বাবার নাম। হিন্টস দেয়া হবে। তার একটা চায়ের দোকান আছে। তার নামের প্রথম অক্ষর হল সা। এখন রাশেদের মাথায় গান হচ্ছে–
মানুষ ধর মানুষ ভজ শুন বলিরে পাগল মন
মানুষের ভিতর মানুষ করিতেছে বিরাজন।
দুটা লাইন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে। রাশেদ বলল, পানি খাব।
তার পাশে কেউ নেই। রাশেদ আবার বলল, পানি খাব।
এ্যাপ্রন পরা একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন, নিশ্চয়ই ডাক্তার। তার চেহারার সঙ্গে কোথায় যেন পরিচিত একজনের চেহারার মিল আছে। পরিচিত জনের নাম মনে আসছে না। ভুল হয়েছে, পরিচিত জনের নকল নাম মনে আসছে আসল নাম মনে আসছে না।
ডাক্তার বললেন, কোন কিছুর প্রয়োজন হলে এই বোতামটা চাপবেন। আমি ছুটে আসব। আমি ডিউটি ডাক্তার। অক্সিজেন মাস্ক আবার আপনি খুলেছেন?
রাশেদ বলল, আপনার নাম কি?
রুবিনা।
আপনার চেহারার সঙ্গে একজনের চেহারার কোথায় যেন মিল আছে। তার নাম বলতে পারবেন? নাম বলতে পারলে পুরস্কার। বলতে না পারলে তিরস্কার। তিন সেকেন্ড সময়। ওকে স্টার্ট ওয়ান থাঊজেণ্ড ওয়ান, ওয়ান থাউজেন্ড টু, ওয়ান থাউজেন্ড থ্রী। পারলেন না। আপনি ডিসকোয়ালিফাইড। আর সুযোগ দেয়া হবে না। ফ্লাই উইথ দ্য উইন্ড।
রাশেদ চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছে সে দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা সে কি মারা যাচ্ছে? মৃত্যুর আগে নাকি যাপিত জীবন পুরোটা চোখের সামনে ভেসে যায়। যদি সত্যি হয় তাহলে মৃত্যুর এই অংশটা ভালো। দ্বিতীয়বার পুরো জীবনযাপন করা।
ঘরের ভেতর কে যেন সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটের কড়া গন্ধ নাকে আসছে। রাশেদ বাঁ দিকে তাকালো। পায়ের উপর পা তুলে রূপা ব্যানার্জি বসে আছে। তার হাতে সিগারেট।
রাশেদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল ঘটনা সত্যি না। হাসপাতালের ঘরে সিগারেট খাওয়া যায় না। তার হেলুসিনেশন হচ্ছে।
রূপা ব্যানার্জি বলল, মারা যাচ্ছি না-কি?
রাশেদ বলল, জানি না।
জানি না বলার জন্যে তাকে ঠোঁট নাড়তে হল না। হেলুসিনেশনের পুরো ব্যাপারটা মাথার ভেতরে ঘটে। ঠোঁট না নেড়েও কথা বলা যায়। চোখ বন্ধ করেও দেখা যায়।
রূপা ব্যানার্জি বলল, আমার কাছ থেকে পালিয়ে এসেও তো রক্ষা পাও নি। আমি চলে এসেছি।
রাশেদ বলল, হুঁ।
আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?
রাশেদ বলল, সিগারেট খেও না। গন্ধ নাকে লাগছে।
মরেই তো যাচ্ছ। সিগারেটের কড়া গন্ধ থাকুক কিছুক্ষণ। তাছাড়া সিগারেট আমি খাচ্ছি না। আমি খাচ্ছি চুরুট। হাভানা ব্র্যান্ড। একটান দিয়ে দেখবে?
না।
কিছু হবে না। একটা টান দাও।
না রূপা, না।
‘না রূপা না’ অনেক শুনেছি। এবার শুনব না।
রূপা ব্যানার্জি উঠে দাঁড়িয়েছে। রাশেদের মুখের উপর লাগানো অক্সিজেন মাস্ক টান দিয়ে খুলে সে চুরুট ঠোঁটের ভেতর খুঁজে দিল। রাশেদ তাকে আটকাতে পারল না। তার হাত-পা অনড় হয়ে গেছে।
টান দাও, জোড়ে টান দাও। তোমার নষ্ট ফুসফুস চুরুটের ধোঁয়ায় শুদ্ধ করে নাও। এটা শুদ্ধি প্রক্রিয়া। রাশেদের জগত অন্ধকার হয়ে গেল।
এক সময় সে চোখ মেলল। কত সময় সে পার করেছে তা বুঝতে পারছে না। দিন না রাত তা বুঝতে পারছে না। সে বাঁ দিকে তাকালো, রূপা ব্যানার্জি নেই। আধবুড়া একজন কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে বাচ্চা একটা ছেলে। ছেলেটার চোখ বড় বড়। লোকটা কথা বলছে তবে কথা স্পষ্ট না। কিছু বুঝা যাচ্ছে, কিছু বুঝা যাচ্ছে না।
স্যার, আমাকে চিনেছেন? আমি সামছু। আমার দোকানে এক রাইত ছিলেন। আমার পুলাটারে নিয়া আসছি। এর নাম কেনতু।
রাশেদ বুঝার চেষ্টা করছে–এই দুটা চরিত্র কি বাস্তব। না তার মাথার কল্পনা। একটা বাচ্চা ছেলের নাম কিন্তু হবে না। কিন্তু কারো নাম হয় না। কাজেই এ দুজন আন রিয়েল। এখন সমস্যা What is reality? মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যা ধরতে পারে তাই কি রিয়েলিটি।
স্যার, আপনের শইল খুবই খারাপ করল। একজন ডাক্তার ডাইকা আনলাম। উনি আপনেরে হাসপাতালে ভর্তি করাইছে। আমি স্যার প্রত্যেক দিন আপনেরে দেখতে আসি। কাইলও আসছি। আপনার কি ইয়াদ আছে? এখানের এক ডাক্তার সাব বলেছেন আমি আমার পুলারে নিয়া রাতে থাকতে পারি। স্যার আমি কি থাকব? মুখে কথা বলতে না পারলে মাথা নাড়েন।
রাশেদ কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ল।
স্যার, আপনার চিন্তা নাই, আমরা বাপ-বেটা আপনের সাথে আছি। উপরে আল্লাহ আর নিচে আমরা দুই বাপ-বেটা।
রাশেদের খুব জানতে ইচ্ছা করছে লোকটা তার ছেলের নাম কিন্তু কেন রেখেছে। নিশ্চয়ই কারণ আছে। মানুষ কারণ ছাড়া কিছুই করে না। মানুষের জগত cause and effect এর জগত। কিন্তু নিয়ে শৈশবের একটা ছড়া মাথায় এসেছে
If যদি is হয়
But কিন্তু Not নয়
What মানে কি?
লোকটা হড়বড় করে কথাই বলছে। মানুষ এত কথা বলে কেন।
স্যার আপনার একটা চিকিৎসা আমি করব বলে ঠিক করেছি। কচি পান পাতার উপরে কালিজিরা তেল দিয়া সেই পান পাতা গরম কইরা আপনার পায়ের পাতায় ঘষব। সাথে সাথে বল পাইবেন। আধুনিক ডাক্তার এইসব চিকিৎসা জানে না। এইগুলো গেরাইম্যা চিকিৎসা। একটাই সমস্যা পান পাতা গরম করব কেমনে? ঠাণ্ডা পান পাতা ঘষলে হিতে হবে বিপরীত। দেখি কি করা যায়। একবার যখন পান পাতা ঘষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন ঘষব ইনশাল্লাহ। স্যারের মাথা আস্তে কইরা টিপ্যা দেই?
রাশেদ টের পেল তার কপালে হিমশীতল আঙুল। আঙুল কপালের উপর দিয়ে যাচ্ছে আর রাশেদের শরীর কেঁপে উঠছে। তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল, ঐ কেনতু বাপধন! স্যারের পায়ের আঙ্গুল আস্তে কইরা ফুটা। স্যার আরাম পাই।
ছেলেটার নাম তাহলে কেন। কিন্তু না। কেনতু শব্দটার মানে কি? মাথার কাছে সব সময় দুটা ডিকশনারি রাখা দরকার। একটা বাংলা একটা ইংরেজি। ভুল হয়ে গেছে। বিরাট ভুল। Life is a bundle of mistakes. এটা কার কথা? জীবন হচ্ছে এক বান্ডেল ভুলের… 1 Bandle শব্দটার বাংলা কি? ডিকশনারি খুবই প্রয়োজন।
বোমা ফাটার মতো শব্দ হচ্ছে কোথায়? ও আচ্ছা কেনতু নামের ছেলেটা, আঙুল ফুটাচ্ছে। আঙুল ফুটানোর এত শব্দ। আশ্চর্য।
রাশেদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। চুরুটের গন্ধ আবার নাকে আসছে। শরীর গুলাচ্ছে।
সামছু বলল, কেনতু বাপধন! স্যারের সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকতে পারবি?
কেনতু বলল, হুঁ।
আমি বুদ্ধি পাইছি। ঘরে খবরের কাগজ জ্বালায় আগুন করব। সেই আগুনে পান গরম করব। আমি যাই, পান আর কালিজিরা তেলের জোগাড় দেখি।
রাত এগারোটায় বাপ-ছেলেকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হল। সামছু হাসপাতালের দারোয়ানের চড়-থাপ্পড় খেলো। অপরাধ? বাপ-বেটা রুমে আগুন জ্বালিয়ে পান গরম করছিল।
ঘড়ি-কন্যা মদিনার ক্ষমতা পরীক্ষা
ঘড়ি-কন্যা মদিনার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে হারুন তার বাল্যবন্ধু সুলতানকে খবর দিয়ে এনেছেন। তারা দুজন বসেছে গেস্টরুমে। রূপা। ঢুকল।
ঘড়ি পরীক্ষায় সেও থাকবে। সুলতান পকেটে করে দুটা ঘড়ি এনেছেন। একটার সময় তিন ঘণ্টা বাড়ানো। অন্যটায় ঘণ্টার কাটা নেই, বন্ধ ঘড়ি। রূপা বলল, সুলতান চাচা আপনাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে।
সুলতান বললেন, আমি কি করেছি রে মা? আমি কি করেছি?
রূপা বলল, আপনি প্রতিটি কথা দুবার করে বলেন। ভয়ংকর অস্বস্তিকর ব্যাপার।
আর বলবনা রে মা। আর বলব না।
রূপা বলল, অসহ্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনারা করুন। আমি ছাদে যাচ্ছি।
হারুন বললেন, তোকে থাকতে হবে। তুই না থাকলে মেয়েটা ফ্রি ফিল করবে না। কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছে।
এক শর্তে থাকব। সুলতান চাচা কোনো কথা দুবার বলতে পারবেন না।
সুলতান বললেন, দুবার বলব না। বলব না। অবশ্যই বলব না।
রূপা হতাশ গলায় বলল, এখন তত তিনবার করে বলছেন।
হারুন বললেন, কথা বন্ধ। পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। মদিনা মদিনা।
মদিনা ঘরে ঢুকল। তার মুখ শুকনা। যে কোনো কারণেই হোক সে ভয় পেয়েছে। হারুন বললেন, মদিনা! আমার বন্ধু সুলতান সাহেবের পকেটে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়ির টাইম ঠিক নেই। অর্থাৎ এখন ১১টা বাজে। তার ঘড়িতে ১১টা বাজে না। তুমি বল তার ঘড়িতে কয়টা বাজে।
মদিনা বলল, পারব না স্যার।
হারুন বললেন, আমার পকেটে দুটা ঘড়ি আছে। একটা কালো বেল্টের আরেকটা মেটালিক বেল্টের কোনটায় কত বাজে।
মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, পারব না স্যার।
পারবে না মানে? অবশ্যই পারবে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা কর তারপর বল।
মদিনা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় থেকে চোখ মেলে বলল, পারব না স্যার।
সুলতান বললেন, তুমি কোত্থেকে কি শুনেছ। মেয়ে ফ্রড। মেয়ে ফ্রউ। এই মেয়ে ফ্রউ।
হারুন বললেন, মেয়েকে নিয়ে পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। পেপার কাটিং আমার কাছে আছে। দেখবে?
না। ফালতু নিউজ। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। ঠিক না।
হারুনকে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে। তিনি আশাই করেন নি ঘটনা এ রকম ঘটবে। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, থাপড়ায়ে এই মেয়ের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার।
রূপা বলল, শুধু শুধু চিৎকার করবে না বাবা। মেয়ে এমন কোনো অপরাধ করেনি যে থাপড়ায়ে তার দাঁত ফেলতে হবে। মদিনা! তুমি আমার ঘরে যাও কিছু হ্যান্ড মেড পেপার বাথটাবে ভেজাও। ছবি আঁকব।
মদিনা বের হয়ে গেল। তার চোখভর্তি পানি। রূপা বলল, বাবা তুমি তো তাকে পরীক্ষা করেছ। তোমার ঘড়ির সময় ঠিক ঠিক বলেছে। তাই না?
হুঁ।
রূপা বলল, আমার ধারণা তুমি কোনো পরীক্ষা নাও নি। পত্রিকায় খবর দেখে মদিনাকে নিয়ে চলে এসেছ। তোমার ঘড়ির টাইম বলে দিয়েছে এই গল্পটা তোমার বানানো।
খামাখা গল্প বানাবো কেন?
সেটা আমি কি করে বলব.
বেশি জ্ঞানী হবার চেষ্টা করিস না। কাগের ঠ্যাং বগের ট্যাং ছবি আঁকছিস ছবি আঁক। আমি মদিনা মেয়েটাকে কানে ধরে তার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমি সহজ চিজ না।
কবে পাঠাবে?
আজই পাঠাব। বদ মেয়েটাকে রেডি হতে বল। আমি মাইক্রোবাসে গ্যাস ভরে নিয়ে আসি। সুলতান যাবে নাকি আমার সাথে?
সুলতান হাই তুলতে তুলতে বললেন, যেতে পারি। একা মানুষের এই সুবিধা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারি।
এখন তোর দুপা
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা
যখন হবে চার পা
ভাত কাপড় দিয়া যা,
যখন হবে ছয় পা
বাবা! তুমি যাবা না।
ছড়া স্টপ কর। সত্যি যাবে?
অবশ্যই। রাগে আমার শরীর চিড়বিড় করছে। এক কাজে দুই কাজ হবে। রথ দেখব, কলাও বেচব। পথে বগুড়ার কাছে একটা কুয়া আবিষ্কার হয়েছে তার কোন তল নেই।
শুল নেই মানে? তল নেই মানে?
হারুন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, মনে কর তুমি পাথরের বড় একটা চ্যাং কুয়াতে ফেললে। পাথরটা কোথাও না কোথাও হিট করবে। শব্দ হবে। সেটাই লজিক, কিন্তু এই কুয়ায় কিছু ফেললে শব্দ হয় না।
বল কি? বল কি?
দড়ি ফেলেও মাপার চেষ্টা করা হয়েছে। দড়ি নেমেই যায় নেমেই যায়।
সুলতান বললেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় ছাপা হবার মত নিউজ। ঠিকানা জান তো?
খুঁজে বের করব।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে দুজন মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মদিনাকে সঙ্গে নেবার কথা তাদের মনে রইল না।
রূপা রাশেদের সুটকেস ঘাটছে। তার ঠিকানা যদি কোথাও পাওয়া যায়। বইপত্রের সঙ্গে একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে অনেক কিছু লেখা কিন্তু কোথাও ঠিকানা নেই। অন্যের ডায়েরি পড়ার প্রশ্নই উঠে না।
তারপরেও দুই লাইনের একটা লেখা রূপা পড়ে ফেলল। লেখাটা ইংরেজিতে। শিরোনাম suspicion.
My own suspicion is that the Universe is not only queerer than we suppose, but qucerer then we can suppose.
বাংলায় কি হবে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমরা যত অদ্ভুত মনে করি তার চেয়েও অদ্ভুত। অন্য কেউ এই ব্যাপারটা জানুক বা না জানুক, রূপা জানে। খুব ভাল করেই জানে।
আফা একটা কথা বলব?
রূপা তাকালো। তার সামনে মদিনা দাঁড়িয়ে, সে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে। মনে হয় পরীক্ষায় ফেল করে ভালই কান্নাকাটি করেছে। তার চোখ লাল।
রূপা বলল, বল কি বলবে?
আমার উপরে রাগ হইয়েন না আফা।
তুমি ঘড়ির সময় বলতে পার নি। এটাই তো স্বাভাবিক। ঘড়ি না দেখে আমরা কেউ সময় বলতে পারি না। খানিকটা অনুমান হয়ত করতে পারি। এর বেশি না।
আফা অন্য একটা কথা বলব। আপনের পায়ে ধরি রাগ হইয়েন না।
বল কি বলবে। রাগ হব না।
মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, উনার অবস্থা ভাল না।
রূপা বলল, কার অবস্থা ভাল না?
মদিনা আঙ্গুল দিয়ে রূপার হাতের ডায়েরি দেখাল। রূপা গম্ভীর গলায় বলল, আমি যার লেখা পড়ছি তার অবস্থা ভাল না?
মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, বোস আমার সামনে।
মদিনা বসল। রূপা বলল, তোমার কথাবার্তা যথেষ্টই বিরক্তিকর। সুলতান চাচার চেয়েও বিরক্তিকর। তুমি এ বাড়িতে পা দিয়েই ভূত দেখে ফেললে। এখন আবার দেখছ একজনের অবস্থা ভাল না। বেশি বেশি দেখা ভাল না। এখন থেকে কম কম দেখবে।
মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
আমি একজন ভদ্রলোকের একটা খাতা হাতে নিয়েছি তাই দেখে তুমি তার শারীরিক অবস্থা বলে ফেললে? শারীরিক অবস্থা দেখার জন্যে মানুষের শরীর পরীক্ষা করতে হয়। তার জন্যে ডাক্তার আছেন। তুমি কি ডাক্তার?
না আফা।
তোমাকে কিছু জ্ঞানের কথা বলি, মানুষ তার ক্ষমতার সবটাই অর্জন করে। জন্ম থেকে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নিয়ে কেউ আসে না। তুমি আর কখনো ভূত দেখা, অমুকের শরীর ভাল না, তমুক দুর্ঘটনায় মারা যাবে এইসব বলবে না।
জী আচ্ছা বলব না।
এখন সামনে থেকে যাও। তোমাকে দেখলেই রাগ লাগছে।
মদিনা উঠে গেল।
হারুন অনেক ঝামেলা করে তলহীন কুয়া খুঁজে পেয়েছেন। বগুড়া জেলার ভেতর কাহালু রেল স্টেশন। রেল স্টেশনে মাইক্রোবাস রেখে রিকশায় গেছেন উত্তরে এগারো কিলোমিটার। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সাত কিলোমিটার। সুলতান বললেন, তোমার সঙ্গে বের হওয়া বিরাট বোকামি হয়েছে। তুমি বিপজ্জনক ব্যক্তি। অবশ্যই বিপজ্জনক ব্যক্তি।
হারুন বললেন, আমার মেয়ে ঠিকই বলে তুমি বিরক্তিকর মানুষ। প্রতিটা কথা দুবার তিনবার বল।
তোমার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বিরাট ভুল করেছি। বিরাট ভুল করেছি। দেখো আমার পায়ের অবস্থা হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে। পা ফুলে গেছে।
চুপ একটা কথা বলবে না। একটাও কথা বলবে না।
সুলতান অবাক হয়ে বললেন, এখন তো তুমিও দুবার করে বলছ।
হারুন চিৎকার করে উঠলেন, আমার সঙ্গে আসতে চাইলে আস। না আসতে চাইলে স্টেশনে ফিরে যাও।
একা একা কীভাবে ফিরব? আমি তো পথ চিনব না। পথ চিনব না।
দুজন যখন তলহীন কুয়ার পাশে উপস্থিত হলেন তখন রাত দশটা। গ্রামের সবাই খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকাডাকির পর তলহীন কুয়ার মালিক বের হয়ে এলেন। মধ্যম বয়সের মানুষ। গালভর্তি শাদা দাড়ি। দাড়িতে মেহেদি দিয়েছেন। এখন মুখভর্তি লাল-শাদার সমারোহ।
হারুন বললেন, জনাব আপনার নাম কি?
আমি মেরাজ ফকির।
তলহীন কুয়া আপনার?
জী, এই কুয়ার আরেক নাম জিন্দা কুয়া।
সুলতান বললেন, কুয়া আবার জিন্দা মুর্দা হবে কীভাবে?
মেরাজ ফকির বললেন, সবাই জিন্দা কুয়া বলে। কেন বলে জানি না।
কুয়াটা দেখতে এসেছি।
দেখতে এসেছেন দেখেন। একশ টাকা করে হাদিয়া। কুয়ার রক্ষণাবেক্ষণ আছে।
হারুন বললেন, আমরা আপনার কুয়ার ছবি তুলব। একটা পাথর ফেলব। পাথর ফেললে শব্দ হয় না এটা যদি নিশ্চিত হই তাহলে আপনাকে দুশ টাকা দিব।
মেরাজ ফকির বললেন, কুয়া হাত দিয়া ছোঁয়া নিষেধ, ছবি ভোলা নিষেধ। কিছু ফেলাও নিষেধ। জিন্দা কুয়া, তারে ইজ্জত করতে হয়।
সুলতান বললেন, আমরা দুজন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কিছু খাওয়াতে পারবেন। টাকা দিব।
আমি হোটেল খুলি নাই। নিশি রাইতে অনেক ত্যাক্ত করেছেন, এখন ফিরত যান।
ফেরার পথে হারুনের সঙ্গে সুলতানের বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে গেল।
আমি যে কজন গাধা মানুষকে চিনি
আমি যে কজন গাধা মানুষকে চিনি তোর সুলতান চাচা তাদের মধ্যে এক নম্বর। গাধা শ্রেষ্ঠ।
সুলতান চাচা মোটেই গাধা মানুষ না। ভাল মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ। কথা রিপিট করলেই মানুষ গাধা হয় না।
চুপ করে ভাত খা। তোর জ্ঞানী কথা ভাল লাগছে না।
চুপ করেই তো খাচ্ছি। কথা তুমি শুরু করেছ। তুমি একতরফা কথা বলবে আমি চুপ করে থাকব এটা তো ফেয়ার না।
তোর সুলতান চাচাকে গাধা মানব প্রমাণ করে দেব। প্রমাণ করাব?
কর।
থাক। তোর সঙ্গে কোন কথা নেই। আমি নিঃশব্দে খাব।
নিঃশব্দে তুমি খাচ্ছ না বাবা। কড়মড় করে শসা কামড়াচ্ছ। আমার উপরের রাগ শসার উপরে ঢালছ।
হারুন মেয়েকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেছেন। খাবার সময় হালকা গল্প-গুজব করতে তিনি পছন্দ করেন। রূপা বেশির ভাগ সময় আলোচনা হালকা পর্যায়ে রাখে না। কঠিন পর্যায়ে নিয়ে যায়। হারুনকে মেজাজ খারাপ করে আলোচনা শেষ করতে হয়।
রূপা বলল, বাবা। তোমার ইতিহাস কাব্য কেমন চলছে?
হারুন বললেন, তোর কথার মধ্যে ফাজলামী ভাব লক্ষ করছি। এটা আমার পছন্দ না।
রূপা বলল, তাহলে ঐ প্রসঙ্গ থাক। অন্য প্রসঙ্গ। তলাবিহীন কুয়া সম্পর্কে তো কিছুই বললে না। কুয়া পেয়েছিলে?
হুঁ।
সত্যি তলা নেই?
মস্ত বড় একটা পাথর ছুড়ে মেরেছিলাম। সেই পাথর পানিতে হিট করেছে এমন শব্দ পাই নি।
রূপা বলল, মনে হয় কুয়ায় পানি নেই।
হারুন বললেন, পানি না থাকলে মাটি তো থাকবে। মাটিতে পড়ার শব্দ হবে না?
হয়ত নিচে মাটি নেই। নরম কাদামাটি। পাথর কাদামাটিতে শব্দ না করেই দেবে গেছে।
হতে পারে।
বাবা! তুমি মেজাজ খারাপ করে খচ্ছি। বদ হজম হবে। মেজাজ ঠিক কর। আমি একটা থিওরি বের করেছি। শুনবে?
বল শুনি।
আমার ধারণা এই পৃথিবীর প্রতিটি মানব সন্তানকে কোনো না কোনো Special gift দিয়ে পাঠানো হয়। বেশির ভাগ মানুষই তাদের এই গিফট সম্পর্কে জানে না। তোমার ঘড়ি বালিকা, ঘড়ি না দেখে সময় বলতে পারে। তার মতো আমিও হয়ত কিছু পারি। তুমিও পার। যদিও এখন কোনো কারণে পারছো না।
হারুন কিছু বললেন না। রূপা বলল, বাবা তুমি কি গিফট নিয়ে এসেছ বলে তোমার ধারণা?
আমি কোন গিফট নিয়ে আসিনি।
অবশ্যই এসেছ। চিন্তা করে বল।
হারুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কোনো কারণ ছাড়া মানুষকে বৈরী করার ক্ষমতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি। এটাই আমার Special Gift. উদাহরণ হল তোর মা। আমি এমন কি করেছি যে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল? তুই একটা কারণ দেখা সে কেন গেছে।
রূপা বলল, মানুষ হিসেবে তুমি খুবই Predictable. কোন কাজের পর তুমি কোন কাজ করবে তা আগে থেকে বলে দেয়া যায়। প্রেডিকটেবল মানুষ হল যন্ত্রের মতো। মেয়েরা যন্ত্র মানব পছন্দ করে না। মা এই জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং ভাল করেছে।
হারুন বললেন, যার কাছে গেছে সে খুব আনপ্রেডিকটেবল? সে তো চশমা চোখে ছাগল ছাড়া কিছু না। ছাগলের সঙ্গে তার একটাই তফাৎছাগল ব্যা ব্যা করে আর সে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। যখন কথা বলে তখন মনে হয় জাবর কাটছে। ছাগলার ছাগলা।
রূপা বলল, বাবা তুমি উনার উপর শুধু শুধু রাগ করছ। উনি মাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যান নি। মা স্বেচ্ছায় গেছেন। রাগ করলে তুমি মার উপর রাগ করতে পার।
ঐ ছাগলাটা তোর কাছে রসগোল্লা?
রূপা বলল, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা ঠিক না, তবে উনি মানুষ ভাল। যথেষ্টই ভাল।
ছাগলাটার ভাল কি আছে যা আমার নেই?
আলোচনাটা থাক না বাবা।
থাকবে না। আমি শুনতে চাচ্ছি। তোর কাছে ছাগলাটা কীভাবে মহামানব হয়ে গেল।
বাবা। তুমি প্রচণ্ড রেগে গেছ। আমি তোমার রাগ আর বাড়াব না। খাওয়া শেষ কর। মটরশুটি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল ক্লাসিক পর্যায়ের ভাল হয়েছে!
তোর ক্লাসিক কৈ মাছের আমি গুষ্ঠি কিলাই। হারুন খাওয়া ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।
রূপা হতাশ গলায় বলল, বাবা তুমি ছেলেমানুষ না। দুই মাস আগে আমরা তোমার ষাট বছর পূর্তির উৎসব করেছি। এই বয়সে তুমি যদি রাগ করে ভাত না খাও সেটা হবে খুবই হাস্যকর।
হারুন বললেন, গোদের উপর বিষফোঁড়ার কথা আমরা বলি। তুই হচ্ছিস গোদের উপর ক্যানসার কিংবা এরচেয়েও খারাপ কিছু গোদের উপর এইডস। তুই কাল ভোরে চলে যাবি। তোর মা এবং তার মহামানব স্বামীর সঙ্গে বাস করবি। আমার মতো প্রেডিকটেবল মানুষের সঙ্গে থাকার তোর কোনো দরকার নেই। কাল ভোরে তুই অবশ্যই আমার সংসার থেকে অফ হয়ে যাবি। অবশ্যই, অবশ্যই।
রূপা বলল, তুমি যে খুব প্রেডিকটেবল মানুষ তার উদাহরণ আমি এখন দেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আমাকে বলবে, আমি খেতে বসছি, রূপা তুই আমার সামনে বোস। কেউ সামনে না বসলে আমি খেতে পারি না।
হারুন বললেন, এমন কথা আমি যদি বলি তাহলে আমি মানুষ জাতির কেউ না। আমি কুকুর প্রজাতির। ভাল জাতের কুকুরও না। দেশী নেড়ি কুত্তা।
হারুন টেবিল থেকে কফি মগ তুলে দেয়ালে ছুড়ে মারলেন। কফি মগটা রূপার ছোটবেলার এবং খুবই পছন্দের। স্কুলে ড্রেস এস ইউ লাইক টোকাই মেয়ে সেজে পেয়েছিল। টোকাই রূপার বড় বাঁধানো ছবি তাদের বাসায় ছিল। রূপার মা বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় ছবিটা সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
হারুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন শিক্ষা হয়েছে?
রূপা বলল, হয়েছে। আজকের ডিনার আমার জন্যে বিশেষ শিক্ষা সফর।
হারুন বললেন, এত কিছুর পরেও তুই হাসিমুখে খাওয়া-দাওয়া করতে। পারছিস?
রূপা বলল, পারছি। তোমার মেজাজ খারাপ হয়েছে। আমার তো হয় নি। ক্লাসিক কৈ মাছের ঝোলের পুরো বাটি আমি শেষ করব। তুমি রাতে কোনো সময় না কোনো সময় খেতে আসবে। তখন দেখবে কৈ মাছের বাটি খালি।
ভারভ্যারানি বন্ধ কর। ফাজিল মেয়ে।
রূপা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল।
হারুন দোতলায় উঠে গেলেন। মলিনা কফি মগের ভাঙা টুকরা তুলতে তুলতে বলল, খালুজান আইজ বেজায় রাগছে। অবশ্য পুরুষ মানুষের রাগ ভাল জিনিস। মেনা বিলাইয়ের মত পুরুষ কোনো কামের না। নারী চিনি লাজে, পুরুষ চিনি রাগে।
রূপা বলল, কথা কম বল মলিনা, তোমার কথার যন্ত্রণায় আমি অস্থির।
মলিনা বলল, আপনি আমার কথার যন্ত্রণায় অস্থির আর আমি অস্থির মদিনার কথার যন্ত্রণায়। এই মেয়ে রাইতে ঘুমায় না। খালি কথা কয়।
কার সাথে কথা বলে?
আমি বললে তো বিশ্বাস যাবেন না, সে কথা কয় ভূতের সাথে। এই বাড়িতে না-কি একটা ভূত আছে। ভূতটার সাথে মদিনা গফ করে। আমি তারে বলেছি, আমার লগে রাইতে থাকবা না। আফার সাথে গিয়া থাক। আফাও শুনুক তোমার ভূতের গফ। আমি একলা শুনব কোন দুঃখে।
রূপা বলল, মদিনাকে থাকতে বল আমার সঙ্গে। আমার অসুবিধা নাই।
মলিনা বলল, বুঝছেন আফা, হে ভূতের সাথে গফ করে। ভূত তো দুই একটা কথা বলবে। আমি ভূতের কথা কিছু শুনি না। মদিনা একলাই কথা কয়। মাইয়াটা পাগল। তার মাথা কামাইয়া তালুতে পাগলের তেল দিলে ভাল হয়। আমাদের অঞ্চলের বশির কবিরাজ পাগলের তেল বেচে। পঞ্চাশ টাকা বেতিল। দুই বোতল একত্রে কিনলে পঁচাশি টেকা। পনরো টাকা কমিশন।
রূপা নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। মলিনার কথার হাত থেকে বাঁচার একটাই উপীয় সামনে থেকে সরে যাওয়া।
মদিনা বিছানা বালিশ নিয়ে রূপার সঙ্গে ঘুমুতে এসেছে। মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছে। রূপার একবার মনে হল মেয়েটাকে বলে, মদিনা মেঝেতে শোবার দরকার নেই। এসো খাটে উঠে এসে আমার সঙ্গে শোও। আমরা দুজনই মহাশক্তিধর মানব প্রজাতির অংশ। টাকা-পয়সা নামক একটি বিষয়ের কারণে আমরা আলাদা হয়ে গেছি। টাকা-পয়সার বিষয়টা অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে নেই বলে তারা আলাদা হয় নি।
রূপা বলল, তোমার ভূতটার কি অবস্থা? ভূত এখনো দেখ?
দেখি। আপনের ঘরে খাড়ায়া ছিল। আমারে দেইখা চইলা গেছে।
তোমাকে ভয় পায়?
জী না, তয় হে আমার উপরে নারাজ।
নারাজ কেন?
আমি তারে দেখতে পারি এই জন্যে হে নারাজ। হে চায় না কেউ তারে দেখুক।
রূপা গায়ে চাদর টানতে টানতে বলল, তোমার মাথায় সমস্যা আছে। তোমাকে আমি একজন ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ডাক্তার তোমার
দরজায় টোকা পড়ছে। রূপা বলল, কে?
হারুন বললেন, রূপা মা, ভাত খেতে যাচ্ছি। তুই এসে বোস। তুই না বসলে খেতে পারব না।
ক্ষুধায় অস্থির হয়েছ বাবা?
হুঁ।
রূপা বলল, তুমি টেবিলে যাও আমি আসছি।
মদিনা চাপা গলায় বলল, আফা আপনার পিতা খুবই ভালোমানুষ। আমি এমন ভালোমানুষ দেখি নাই।
হারুন আগ্রহ করে খাচ্ছেন। তার বাঁ পাশে রূপা বসেছে। সে বাবার খাওয়া দেখছে। তার মুখ হাসি হাসি। হারুন বললেন, আমি ডিসিসান নিয়েছি এখন থেকে আনপ্রেডিকটেবল সব কর্মকাণ্ড করব।
রূপা বলল, ভাল তো! এই বয়সে আমার বিয়ে করাটা হবে সবচে আনপ্রেডিকটেবল ঘটনা। বিয়ে করবে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্রী খুঁজব। তারপর ধুমধাম করে বিয়ে। আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।
রূপা বলল, সত্যি সত্যি তুমি যদি বিয়ে কর তাহলে ভালই হবে। তুমি মোটামুটি নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বিয়ে করলে সার্বক্ষণিক সঙ্গী পাবে। পীর-ফকিরের সন্ধানে যখন যাবে নতুন মা তোমার সঙ্গে যাবে।
তাকে মা ডাকবি?
কেন ডাকবো না।
তোর মা যে মহামানবকে বিয়ে করেছে তাকে কি তুই বাবা ডাকিস?
না।
তাহলে আমি যাকে বিয়ে করব তাকে মা ডাকবি কোন লজিকে?
বাবা ডাকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। মা ডাকা সহজ।
বাবা ডাকা কঠিন কেন?
জানি না কেন।
হারুন বললেন, নবীজির একটা হাদিস আছে। নবীজি বলেছেনআল্লাহর পরে আমি যদি আর কাউকে সিজদা করার হুকুম দিতাম সে হত বাবা। এর অর্থ হচ্ছে বাবা অনেক বড় ব্যাপার। এই কারণেই বাবা ডাকা এত কঠিন।
হতে পারে।
হারুনের খাওয়া শেষ। তিনি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন, সুন্দর করে একটা বিজ্ঞাপন রেডি করে দিস। পাত্রী চাই লিখবি না। লিখৰি জীবনবান্ধবী চাই।
সঙ্গে কি তোমার যুবক বয়সের কোনো ছবি যাবে?
ঠাট্টা করবি না। আই মিন বিজনেস। বিজ্ঞাপনে আমার বয়স উল্লেখ থাকবে। আমার যেসব ত্রুটি আছে, তারো উল্লেখ থাকবে।
তোমার ত্রুটিগুলি কি?
তোর মার কাছ থেকে জেনে নিস। স্ত্রীরাই স্বামীর ত্রুটি সবচে ভাল জানে।
রূপা বলল, বাবা! তুমি একজন ত্রুটিহীন মানুষ।
হারুন বললেন, আমাকে খুশি করা টাইপ বলবি না। কাজের কথায় আয় জীবন বান্ধবী চাই লেখা ঠিক হবে না। লোকজন অন্য অর্থ করতে পারে। জীবন সঙ্গিনী লেখাই ভাল।
যদিদং হৃদয়ং তব
অদিদং হৃদয়ং মম
এর মানে কি? এর মানে হল, তোমার হৃদয় যা। আমার হৃদয়ও তা।
রাত তিনটা বাজে।
রূপার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের বাতি নেভানো। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রূপা দেখল মদিনা বিছানায় বসে আছে। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।
আপনারে বললাম, আপনে আফার ঘরে ঢুকবেন না। আফার ক্ষতি করলে আমি কিন্তু আফনেরে ছাড়ব না। এই বাড়ির মেলা ঘর আছে খালি পইড়া থাকে। সেই খানে থাকেন। আফার পিছে ঘুর ঘুর করেন কি জন্যে?
রূপা ডাকলো, মদিনা!
মদিনা চমকে তাকালো।
রূপা বাতি জ্বালালো। বিছানার পাশে রাখা টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চুমুক দিল।
মদিনা মাথা নিচু করে বসে আছে। রূপার দিকে তাকাচ্ছে না। রূপা বলল, কার সঙ্গে কথা বল মদিনা?
মদিনা নিচু গলায় বলল, ভূতটার সাথে।
তোমার ভূতটা কি এখনো আছে?
না।
তুমি একাই ভূতের সঙ্গে কথা বল? ভূত কথা বলে না?
টুক টাক কথা কয়! বেশি না।
ভূতটার কি কোনো নাম আছে?
না। ভূতটা আপনের পিছে লাগছে। তাড়াতাড়ি বিয়া করেন আফা। এই ভূতটা কুমারী মেয়ের পিছে ঘুরে আপনার বিয়া হইলে অন্য মেয়ের সন্ধানে চইলা যাবে।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, ভূতের আলাপটা শুনতে ভাল লাগছে না। তুমি ঘুমাও। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি। ভূত যদি আসেও তার সঙ্গে কথা বলতে যাবে না।
রূপা বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুমের সমস্যা আর কখনো হয়। আজ। সে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ভূত-প্রেত বলে সত্যি কি কিছু আছে? যদি থাকে তাদের জগতটা কেমন? তাদের চিন্তা-ভাবনাই বা কেমন?
আফা।
এখনো জেগে আছো। ঘুমাও।
আপনে কি আমার উপর রাগ হইছেন?
রাগ হব কেন?
আমি যে একজনের বিষয়ে বলেছি উনার অবস্থা ভালো না।
রূপা বলল, যা মনে আসে তাই বলে ফেলা ঠিক না।
আফা আমি মিথ্যা বলি নাই।
অনেক সময় আমরা ভাবি সত্যি কথা বলছি, আসলে তা না।
উনার শইলে নীল রঙের চাদর। নাকে নল। আমি পরিষ্কার দেখলাম।
কখন দেখলে?
এই কিছুক্ষণ আগে। উনার মাথার কাছে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়িতে তিনটা বিশ বাজে।
ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।
আমি ঘড়ির সময় কীভাবে দেখি আপনারে বলব?
না। বকবকানি বন্ধ। এক মলিনাকে নিয়ে কুল পাচ্ছি না। তুমি হয়েছ দ্বিতীয় মলিনা। ঘুমাও।
মদিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, মনে করেন আপনে আমারে বললেন, মদিনা! কয়টা বাজে? ঘর অন্ধকার আমি কিছু দেখতেছি না কিন্তু চউখ বন্ধ করলেই, এই বাড়ির যে কোন একটা ঘড়ি দেখব। আফা আমার মনে হয় আমার বিরাট কোনো অসুখ আছে।
রূপা বলল, আমারও তাই ধারণী। এখন আর কথা না।
রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে রাশেদকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার লাংসের কার্যক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। কৃত্রিম যন্ত্রে ফুসফুসে অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সকালের আগে তা করা যাচ্ছে না। সকাল পর্যন্ত সময়টা রাশেদকে নিজের উপরে টিকে থাকতে হবে।
রাশেদের মনে হচ্ছে ট্রেনে করে সে যাচ্ছে। ট্রেনটা টানেলের ভেতর ঢুকেছে। টানেলের ভেতর সারি সারি হলুদ আলো। টানেলের দুপাশে ছোট ছোট ঘর। রাশেদ বিড়বিড় করে বলল,
রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম
ইস্টিশনের মিষ্টি কুল, শখের বাগান ‘গোলাম’ ফুল।
গোলাম ফুলটা আবার কি? গোলাপ ফুল হবার কথা না? সে আবারও ছড়াটা বলল, গোলাপ ফুলের জায়গায় আবারও গোলাম ফুল হয়ে গেল।
এতক্ষণ সে ট্রেনে যাচ্ছিল হঠাৎ দেখল ট্রেনটা হাসপাতালের ট্রলি হয়ে গেছে। ট্রলি ঠেলছে রূপা ব্যানার্জি। তার গায়ে রাতে শোবার পাতলা পোশাক। শরীর দেখা যাচ্ছে। তার ঠোঁটে সিগারেট। সে ধোয়া ফেলছে রাশেদের মুখে। সিগারেটের ধোঁয়ায় রাশেদের গা গুলাচ্ছে।
রূপা ব্যানার্জি বলল, তুমি কি ভেবেছিলে? আমাকে ছেড়ে পালিয়ে বাঁচবে? পালাতে পেরেছ?
না।
মাইকেল মধুসূদনের কবিতা শুনবে?
না।
আহা শোন না–জলধির অতল সলিলে, পষিস যদিও তুই, পষিব সে দেশে। এর অর্থ হচ্ছে–সাগরের নিচে লুকিয়ে থাকলেও আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।
হুঁ।
তুমি যে মারা যাচ্ছ এটা বুঝতে পারছ?
হুঁ।
কি মজার কথা। মারা যাবার কথা ছিল আমার। আমি ঠিকই বেঁচে আছি। তুমি মরে যাচ্ছ।
হুঁ।
তোমার কবরে কি এপিটাফ হবে তুমি চিন্তা করেছ?
না।
আমি একটা বলব?
বল।
তোমার কবরে লেখা থাকবে–পাখি উড়ে গেছে।
আচ্ছা।
কালো গ্রানাইট পাথরে সাদা অক্ষরে লেখা। সেখানে উড়ন্ত একটা পাখির ছবিও থাকবে। তোমার কী পাখি পছন্দ?
ঘুঘু পাখি।
আচ্ছা ঠিক আছে–ঘুঘু পাখিই থাকবে। পাখিটার নিচে লেখা থাকবে। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। হি হি হি।
রূপা ব্যানার্জি শব্দ করে হাসছে। সে একা হাসছে না। আরো অনেকেই হাসছে। যারা হাসছে তারা কি সবাই ট্রেনের যাত্রী? ট্রেন থেমে আছে কেন?
রূপা ছবি নিয়ে বসেছে
রূপা ছবি নিয়ে বসেছে। লেমন ইয়েলোর প্রথম ওয়াশ দেয়া হয়েছে। রঙ শুকানোর পর দ্বিতীয় ওয়াশ। ওয়াটার কালার মানেই ম্যাজিক। প্রথম ওয়াশেই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। কাগজের বাম পাশে ঘূর্ণির মতো তৈরি হয়েছে সেখানে এক দানা লবণ ফেলে কি দেখবে কিছু হয় কি-না। কিংবা ড্রপার দিয়ে একফোঁটা নারকেল তেল ফেলে দেখা যেতে পারে। তেল পানিকে বিকর্ষণ করবে। হলুদ রঙের পানি সরিয়ে দেবে। রূপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কাগজ শুকানোর আগে সে চোখ খুলবে না। লবণ এবং নারকেল তেল আপাতত বাদ। বাইরের সাহায্য ছাড়াই যা হবার হোক। চোখ বন্ধ করে রঙের সঙ্গে কথা বলার খেলা এখন খেলা যেতে পারে। রঙকে নির্দেশ দিয়ে প্রভাবিত করা। রূপা মনে মনে বলল, লেমন ইয়েলো! তুমি আমার অতি প্রিয় একটা রঙ। আমি তোমাকে আমার কাগজে বিছিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে সাহায্য কর। তুমি তোমার ক্ষমতা দেখাও। কাগজের উপর সামান্য নাচ। ছোট্ট একটু ঢেউ উঠুক। অদ্ভুত কোনো ঘূর্ণি। বিচিত্র কোনো ডিজাইন।
আফা। আফা গো।
রূপা চোখ মেলল। মলিনা উত্তেজিত গলায় বলল, বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আম্মা আসছে। গাড়িতে বসা। নামতে বলছি, নামব না। আপনারে যাইতে বলছে। রূপা একবার ভাবল বলে, এখন ছবি আঁকতে বসেছি যেতে পারব না। এই চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে হল। বড় কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কোনো কারণ ছাড়া তার মা গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবেন না।
বিশাল পাজেরো গাড়ির পেছনের সিটে শায়লা বসা। তাঁকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত দেখাচ্ছে। কফি কালারের চাদর দিয়ে শরীর এবং মাথা ঢেকে রেখেছেন। তার হাতে ইনহেলার। রূপাকে দেখে তিনি হাঁ করে ইনহেলার মুখের কাছে ধরলেন। দুবার চাপলেন। রূপা বলল, মা কি ব্যাপার?
শায়লা বললেন, গাড়িতে উঠে আয়।
এখন আমি কোথাও যাব না মা।
কোথাও যেতে হবে না। গাড়িতে উঠ। কথা বলব।
বাসায় এসো। সেখানে কথা বলব। গাড়িতে বসে কথা বলতে হবে কেন?
ঐ বাড়িতে আমি কখনো গিয়েছি? যাই নি, যাবও না। গাড়িতে উঠতে বলছি উঠে আয়। জরুরি কথা।
রূপা গাড়িতে উঠল। শায়লা ড্রাইভারকে বললেন, তুমি গাড়ি থেকে নাম। আমি মেয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলব। তোমার শুনার প্রয়োজন নেই। তবে আশেপাশেই থাকবে। নিরুদ্দেশ হয়ে যেও না।
ড্রাইভার নেমে গেল। রূপা বলল, বল কি বলবে।
শায়লা বললেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম, জীবন সঙ্গিনী চাই।
রূপা বলল, বিজ্ঞাপন বের হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি?
তুই ব্যাপারটা জানতি?
জানতাম। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞাপনের কপি আমি লিখে দিয়েছি। প্রথম ড্রাফটটা বাবা লিখেছেন। যথারীতি কুৎসিত ছড়া দিয়ে শুরু–
জীবন সঙ্গিনী চাই
আর সময় নাই।
শায়লা বললেন, এই বয়সে এমন একটা হাস্যকর কাণ্ড তোর বাবা করল? তুই কিছু বললি না? তুই হয়ে গেলি তার এসোসিয়েট। কপি রাইটার?
রূপা বলল, হাস্যকর কোনো কাণ্ড বাবা করে নি। বাবা নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। আমি চলে যাব ফ্রান্সে। বাবা আরো একা হয়ে যাবে, তখন তাকে কে দেখবে?
তুই ফ্রান্সে যাবি মানে কি?
ছবি আঁকা শেখার জন্যে যাব। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।
আমি তো কিছু জানলাম না।
এই তো জানলে।
শায়লা কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, তোর বাবা বুড়ো বয়সে বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে গেছে এটা তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
রূপা বলল, তুমি যদি জোয়ান বয়সে আরেকটা বিয়ের জন্যে পাগল হতে পার তাহলে বাবার সমস্যা কি? অল্প বয়সে পাগল হওয়া যাবে বেশি বয়সে হওয়া যাবে না। এই তোমার যুক্তি?
আমাকে এখানে কেন টানছিস?
তোমাকে সব কিছুর বাইরে রাখব এটা কি করে ভাবছ? যাই হোক, বাবার বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ো না। শেষ পর্যন্ত বাবা বিয়ে করবে আমার তা মনে হয় না। কোনো কিছুতেই বাবার আগ্রহ বেশিদিন থাকে না। আর যদি বিয়ে হয় সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে।
আমার জন্যে ভাল হবে কীভাবে?
বাবা তখন আর হুটহাট টেলিফোন করে তোমাকে বিরক্ত করবে না। ঝুড়ি ভর্তি মাছ-মাংস পাঠাবে না। জন্মদিন উপলক্ষে শাড়ি পাঠাবে না। তুমি ব্ৰিত হবে না। বাবা ব্যস্ত থাকবে ছোট মাকে নিয়ে।
ছোট মা?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, তুমি আমার মা, উনি ছোট মা। নতুন মাও ডাকতে পারি। তোমার কোনটা পছন্দ? নতুন মা না-কি ছোট মা?
শায়লা বললেন, you hate me. তাই না?
রূপা বলল, না, তা না। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলি। আমি সব মানুষের মধ্যে একটা রঙ দেখি। বাবার রঙ হচ্ছে কচি কলাপাতার রঙ। মলিনা মেয়েটা মেজেন্টা রাশেদ সাহেব লেমন ইয়েলো। তুমি গ্রে।
আমি গ্রে?
হুঁ। তবে রঙ নিয়ে মন খারাপ করো না। একজন ভাল পেইন্টার কিন্তু গ্রে কালার দিয়েও চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন।
রাশেদ সাহেবটা কে?
আছেন একজন। গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। মা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আরো কিছু বলবে?
ফ্রান্সে যে স্কলারশিপ পেয়েছিস সেটা কি রকম স্কলারশিপ?
আলতু ফালতু টাইপ। পেটে ভাতে স্কলারশিপ বলতে পার। যা পাব তা দিয়ে কোনমতে দিন গুজরান হবে। ছুটির দিনে কফি শপে কফি খাওয়ার পয়সা জুটবে না।
চল কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। দুজন মিলে কফি খাই। তোর মুখে কফির কথা শুনে কফি খেতে ইচ্ছা করছে।
অন্য আরেক দিন। আজ না কেন?
আমি একটা ছবি আঁকতে শুরু করেছি। আমার মন পড়ে আছে ছবিতে। সেকেন্ড ওয়াশ দেব।
তোর বাবা নিজের বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করছে, তোর বিয়ে নিয়ে ভাবছে না।
আমার বিয়ে নিয়ে আমি ভাবব। বাবা কেন ভাববে?
শায়লা বললেন, কি রকম ছেলে তোর পছন্দ?
যার ইনার কালার হবে ডার্ক বু! ঝগড়ায় তাকে পারদর্শী হতে হবে। তর্কে আমাকে হারানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। তার প্রচুর টাকা না থাকলেও চলবে। তবে সে বাবার মতো কৃপণ হতে পারবে না।
এটা ভাল বলেছিস। কৃপণ পুরুষ আমারও অসহ্য। থ্যাংক গড়, টগরের বাবা কৃপণ না। ঐ দিন কি হয়েছে শোন। এক বিয়ে বাড়িতে যাব। টগরের বাবার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। সোনার কিছু দিতে হবে। হঠাৎ কানের একজোড়া টপ দেখে আমার নিজের জন্যে পছন্দ হয়ে গেল। ডায়মন্ডের টপ। দাম এক লাখ পনেরো। টগরের বাবা বলল, এত যখন পছন্দ কিনে ফেল। দামের দিকে তাকানোর দরকার নেই।
রূপা বলল, এই টপজোড়াই কি পরে আহু মা?
হুঁ। সুন্দর না?
অদ্ভুত সুন্দর, তবে তোমার উচিত এই টপ না পরা। এক্ষুণি খুলে ফেল।
কেন?
তোমার কান দেখতে খুব খারাপ। ইঁদুরের কানের মতো কান। ডায়মন্ডের টপ পরার কারণে সবার চোখ যাবে কানের দিকে। তোমার বিশ্রী কান দেখবে। তোমার উচিত চুল দিয়ে বিশ্রী কান দুটা ঢেকে রাখা।
শায়লা আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন।
রূপা বলল, মা তুমি কিছু মনে করো না। টপের ডায়মন্ড দুটা নকল। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। নিজের মেয়ের সঙ্গে ভান করার কিছু আছে? মা! অনেকক্ষণ বকবক করেছি এখন আমি যাব। ছবি আঁকব।
দুটা মিনিট বস। দুই মিনিটে তোর ছবি পালিয়ে যাবে না। বসলাম দুমিনিট। বল কি বলবে।
শায়লা আবার ইনহেলার নিলেন। রূপা হাসল। শায়লা বললেন, হাসছিস কেন?
রূপা বলল, ইনহেলার নিয়ে যে ঢঙটা তুমি কর তা দেখে হাসি। তুমি অসুস্থ। তোমার হাঁপানি এটা দেখানোর জন্যেই তোমার হাতে ঐ বস্তু থাকে।
আমাকে তুই এতটা ছোট ভাবতে পারলি?
তুমি তো ছোটই মা। ছোট কেন ভাবব না।
আমি ছোট?
হ্যাঁ, তুমি ছোটবেলায় আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছ যে বাবা তোমাকে শারীরিক নির্যাতন করত বলেই তুমি তাকে ছেড়ে চলে গেছ। একটা ভয়ংকর মিথ্যা তুমি তোমার মেয়ের মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করেছ। এটা অন্যায়। তুমি বলতে পারতে তোর বাবা ভয়ংকর বোকী। এই জন্যে তাকে ছেড়ে গেছ। আমি একসেপ্ট করতাম। মা এখন কি আমি যেতে পারি?
শায়লী কিছু বললেন না।
রূপা বলল, টগর কেমন আছে মা?
শায়লা বলল, টগরের প্রসঙ্গ থাক। ওকে নিয়ে বাইরের কারো সঙ্গে আমি কথা বলতে পছন্দ করি না। তুই গাড়ি থেকে নেমে যা ছবি শেষ কর।
রূপা মুগ্ধ হয়ে তার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথম ওয়াশের ফলাফল আশাতীত ভাল হয়েছে। ঘূর্ণনটা শেষপর্যন্ত আসে নি, তার বদলে ঢেউ খেলানো একটা ব্যাপার এসেছে। দ্বিতীয় ওয়াশের ফলাফল কি হবে কে জানে। রূপা গাঢ় হলুদ রঙের সঙ্গে বালি মিশাল। দ্বিতীয় ওয়াশে বালি মেশানো থাকবে। ওয়াশের পর কাগজ খাড়া করে রাখবে তখন গ্রেভিটেশনের কারণে বালির কণাগুলি নিচে নামতে থাকবে। এতে সুন্দর কোনো টেক্সচার তৈরি হতে পারে। এটা রূপার নিজের আবিষ্কার না। ভেনিজুয়েলার ওয়াটার কালারের গ্রান্ডমাস্টার হানমুনের আবিষ্কার। তিনি তার বেশির ভাগ ওয়াটার কালারে বালির দানা ব্যবহার করে টেক্সচার তৈরি করেন।
আফা। অফা গো।
রূপ চোখ না তুলেই বলল, বল কি ব্যাপার। হড়বড় করে এক গাদা কথা বলবে না।
একটা মেয়ে আফনেরে বুলায়, তার নাম রুবিনা।
চায় কি?
জানি না।
বসতে বল। আমি জরুরি কাজ করছি কাজ শেষ হলেই যাব। চা বানিয়ে দাও। বসে বসে চা খাক। খবরের কাগজ পড়ুক।
বলছিলাম আফা! উনার নাকি বারোটা থাইকা ডিউটি। ডাক্তার মাইয়া। সময় মতো না গেলে রোগী মইরা ভূত হয়া যাবে। দোষ পড়বে উনার। দোষ ধরতে তো মানুষের সময় লাগে না।
রূপা উঠে দাড়াল। তার স্র সামান্য কুচকে আছে। এমন কি হতে পারে। তার বাবার বিজ্ঞাপনের কারণে ক্যান্ডিডেটরা সরাসরি ইন্টার দিতে চলে আসছে? ঘটনা এ রকম হলে ভাল ঝামেলা হবে। পাত্রীদের ইন্টারভ্য তাকেই নিতে হবে। অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থা। রূপা দোতলা থেকে নামল।
বসার ঘরে অল্পবয়েসী মেয়ে বসে আছে। ডাক্তার বলে মনে হচ্ছে না। কলেজে পড়ে পর্যন্ত ঠিক আছে।
রূপা বলল, আপনি আমার কাছে এসেছেন।
আপনার নাম কি সিলভার?
আমার নাম রূপা। তবে রূপা এবং সিলভার অবশ্যি একই। কেন বলুন তো?
আমি এ্যাপলো হসপিটালে কাজ করি। আমাদের একজন পেশেন্টের অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। তিনি তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ দিতে পারছিলেন না, যার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এই বাড়ির ঠিকানাও কিন্তু তিনি দিতে পারেন নি। কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর ঘোর কেটেছিল। তখন তিনি কলাবাগানের গাছপালায় ঢাকা দোতলা বাড়ির কথা বলেছেন। বলেছেন বাড়ির নাম সিলভার।
তার নাম কি রাশেদ?
জী। রাশেদ রহমান। তিনি আমেরিকান এক ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের লেকচারার। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটি। আমি আজ চেষ্টা করব তাঁর ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
আপনি ডাক্তার?
জী। আমার নাম রুবিনা।
রূপা বলল, রাশেদ সাহেবকে সেভাবে আমি চিনি না। তিনি ঠিকানা ভুল করে আমাদের বাড়িতে উঠেছিলেন। কিছুক্ষণ ছিলেন।
সরি। সরি।
সরি কেন হবেন? আপনি যে কাজটা করেছেন কতজন এটা করে? আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন। আমি আপনার সঙ্গেই যাব। এক কাপ চা দিতে বলি?
বলুন।
রাশেদ সাহেবের অবস্থা কতটা খারাপ?
বেশ খারাপ। সারভাইব নাও করতে পারেন। পরিচিত কেউ তার পাশে নেই। মানুষটা মারা যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছিল।
রূপা স্যান্ডেল খুঁজছে। দরজার আড়াল থেকে দেখছে মদিনা। চোখে চোখ পড়তেই সে সরে গেল। রূপা বলল, মদিনা কাছে আস।
মদিনা ভীত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। যেন সে বড় কোনো অপরাধ করেছে। অপরাধের বিচার সভা বসেছে। অপরাধের কারণে তাঁর কঠিন শাস্তি হবে। রূপা বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি তুমি জান?
মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
রূপা বলল, তুমি অত্যন্ত বিপজ্জনক এক মেয়ে। আগেভাগে সব জেনে ফেলছে। এটা ঠিক না। এতে আমাদের পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়।
মদিনা বলল, আমারে মাফ করে দেন আফা।
মাফ দেয়ার মত কোনো অপরাধ তুমি করোনি, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ কেন?
মদিনা ভয় পাচ্ছে কারণ সে আরো একটা ঘটনা জানে। যে ঘটনা ঘটে নি কিন্তু ঘটবে। ঘটনাটা সে রূপাকে বলার সাহস করে উঠতে পারছে না।
নিজের উপর মাঝে মাঝে তার ভয়ংকর রাগ লাগে। সবাই এক রকম, সে আলাদা কেন? কেউ ভূত দেখে না সে কেন দেখে? এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে সে যদি পুকুরের পাড়ে না যেত তাহলে হয়ত সে অন্য রকম হত না। স্বাভাবিক থাকতো।
তার যখন চার বছর বয়স সে স্কুল ঘরের সামনের দিঘিতে ড়ুবে গিয়েছিল। দিঘির পানি কি পরিস্কার! ড়ুবে যাবার পর মানুষ বাঁচার জন্যে ছটফট করে। সে কিছু করেনি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কি যেন ঘটল। সে অবাক হয়ে দেখলো তার মুখের উপর একটা মুখ। এমন এক নারীর মুখ যা দেখে শান্তিতে মন ভরে যায়। সেই অদ্ভুত নারী ফিসফিস করে বলল, যা তোকে জিনিস দিলাম। অনেক বড় জিনিস দিলাম।
ততক্ষণে স্কুলের ছেলেরা ছুটে এসেছে, ড্রিল মাস্টার লাফ দিয়ে পানিতে পড়লেন। মদিনাকে টেনে তুললেন।
কতদিন পার হয়েছে। মদিনার বয়স এখন এগারো। দিঘির পানির মেয়েটিকে মদিনা এখনো হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্নে দেখে। মেয়েটি কোমল গলায় বলে, কি রে মনে আছে আমার কথা?
মদিনার খুব ইচ্ছা এই মেয়েটির কথা সে রূপা আপাকে বলে।
রূপী আপা রাগ করবেন। করলে করবেন। কাউকে তো বলতে হবে। তার যদি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয়ে থাকে রূপা আপাই চিকিৎসা করবেন। তারা কত বড়লোক। তাদের তো আর টাকার অভাব নাই।
রূপা ডাকল, মদিনা।
মদিনা বলল, কি আপা।
তুমি কি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে? যদি যেতে চাও স্যান্ডেল পর।
মদিনার খুব যেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে বলল, আফা আমি যাব না।
রূপা বলল, রাশেদ নামের মানুষটা সম্পর্কে তুমি কি আরো কিছু জান?
জানি। বলব?
না।
শায়লা মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। রূপা বলল, একটু আগেই না তোমার সঙ্গে কথা হল।
শায়লা বললেন, একটু আগে কথা হলে এখন কথা বলা যাবে না?
না, যাবে না। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে ফিরে কথা হবে।
হাসপাতালে কেন?
এক ভদ্রলোক মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে গোপন কিছু কথা বলতে চান।
কি আশ্চর্য কথা, তার নাম কি? আমি কি যাব তোর সঙ্গে?
তুমি কেন যাবে? তার গোপন কথা শুনতে? অন্যের গোপন কথা তুমি কেন শুনবে?
রূপা টেলিফোনের লাইন কেটে দিল।
মদিনা ছাদে। চৌবাচ্চার পাশে বসে আছে। চৌবাচ্চার পানি স্কুল ঘরের সামনের দিঘির পানির মত পরিষ্কার। মদিনার ইচ্ছা করছে চৌবাচ্চার পানিতে শুয়ে তাকিয়ে থাকতে। পানির মেয়েটিকে অনেকদিন সে স্বপ্নে দেখে না। আজ খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
রাশেদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে
রাশেদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাঁর বাঁ পাশে ডিউটি ডাক্তারের চেয়ার টেবিল। দেয়ালে চারকোনা ঘড়ি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা লাল। লাল কাটা লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটাকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবন্ত প্রাণীর মতো লাগছে। সেই তুলনায় ডাক্তারকে সারা রাত জেগে থাকার কারণেই বোধহয় ক্লান্ত লাগছে। রাশেদ হাত উঁচু করল। ডাক্তার ছুটে এলেন। রাশেদের মনে হল ডাক্তারকে যতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তত ক্লান্ত তিনি না।
ডাক্তার রাশেদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাশেদ বলল, আমি ভাল হয়ে গেছি। Good morning.
ডাক্তার কিছু না বলে রোগীর মাথার উপরের মনিটরের দিকে তাকালেন। তাঁকে খানিকটা বিস্মিত মনে হল। রাশেদ বলল, আমাকে অন্য কোনো ঘরে কি দেয়া যায়? যেখানে বড় জানালা আছে।
ডাক্তার জবাব না দিয়ে রোগীর পালস দেখলেন। তার প্রয়োজন ছিল। মনিটরে পালস রেট উঠছে। তিনি প্রেসার মাপলেন। রাশেদ বলল, দুটা পূর্ণ সংখ্যা গুণ করে ৭ বানাতে পারবেন? আপনাকে প্রশ্নটা করলাম বোঝানোর জন্যে যে আমার মেন্টাল ফেকাল্টি এখন ঠিক আছে। পূর্ণ সংখ্যা একটা হল ১ অন্যটা ৭, ১X ৭ = ৭।
এক ঘণ্টা আগেও তো আপনার ভয়ংকর খারাপ অবস্থা ছিল। সাড়ে দশটার দিকে আপনাকে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেটারে দেবার কথা। আমি খুবই অবাক হচ্ছি। স্যারকে খবর দিচ্ছি। স্যার এসে আপনাকে দেখুক। ভাল বোধ করছেন?
হ্যাঁ।
নিঃশ্বাসের কষ্ট নাই?
না।
ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবেন?
হ্যাঁ! ঝাল মাংস দিয়ে পরোটা খেতে ইচ্ছা করছে।
ডাক্তার বললেন, ভেরি সারপ্রাইজিং।
রাশেদ বলল, তিনটি পূর্ণ সংখ্যা যোগ করলে যা হবে গুণ করলেও তাই হবে। বলতে পারবেন?
না।
১, ২ এবং ৩, এক যোেগ দুই যোগ তিন সমান ৬, আবার ১ গুণন ২ গুণন ৩ সমান ৬।
প্রফেসর চলে এসেছেন। তিনি দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করলেন। আবারও পালস দেখা হল, আবারও প্রেসার মাপা হল। প্রফেসর বিড়বিড় করে বললেন, মিরাকুলাস রিকভারি।
রাশেদ বলল, ডাক্তার সাহেব! মিরাকল প্রায়ই আমাদের জীবনে ঘটে। আমরা বুঝতে পারি না। আমাকে কি কেবিনে পাঠানো যাবে?
প্রফেসর বললেন, যাবে। অবশ্যই যাবে।
এমন একটা কেবিন দিন যেখানে বড় জানালা আছে। তাকালেই আকাশ দেখা যায়।
আমাদের সব কেবিন থেকেই আকাশ দেখা যায়।
রাশেদ বলল, আমার আর হাসপাতালে থাকতে ভাল লাগছে না। যদি মনে করেন আমি মোটামুটির চেয়ে ভাল তাহলে আমাকে ছেড়ে দেবেন। প্লীজ।
রিপোর্টগুলি আগে আসুক।
সব রিপোর্ট ভাল পাবেন।
রাশেদকে কেবিনে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নার্স এসে একগাদা রক্ত নিয়ে গেছে, ইউরিন নিয়ে গেছে। আপাতত রুগীকে ভাল মনে হচ্ছে। তবে শরীরের ভেতরের অবস্থাটা জানতে হবে। ইলেকট্রলাইট ব্যালেন্সের অবস্থা, রক্তে সুগারের অবস্থা কিডনি ফাংশান সব পরীক্ষা হবে।
রাশেদ শেভ করে শাওয়ার নিয়েছে। হট শাওয়ারের পর পরই তার মনে হল শরীরটা যতটা ভাল ছিল তারচেয়ে অনেকটা ভাল হয়েছে।
গোশত পরোটার ব্রেকফাস্ট হল না। তাকে হাসপাতালের ব্রেকফাস্ট করতে হল। দুধ, পাউরুটি, হাফবয়েলড ডিম, কলা।
হাসপাতালের বিছানার সামনে রঙিন টিভি। সেখানে নাটক হচ্ছে। রাশেদ আগ্রহ নিয়ে নাটক দেখছে। অন্ধ নায়িকা এবং নায়ক পার্কে বসে আছে। নায়ক জানে না যে মেয়েটি অন্ধ। নায়ক বলল, এশা! দেখেছ কি সুন্দর ডালিয়া ফুটেছে।
এশা বলল, হুঁ। আমাকে একটা ডালিয়া এনে দাও।
নায়ক বলল, কোন রঙ আনব? লাল না হলুদ?
এশা বলল, আমার কাছে লাল এবং হলুদের কোনো আলাদা Identity নেই। আমার কাছে লালও যা, হলুদও তা।
নায়ক টকটকে লাল রঙের ডালিয়া এনে দিল। নায়িকা সেই ফুল নাকের কাছে ধরে বলল, আহা কি গন্ধ! নায়কও সেই ফুলের গন্ধ শুকে মোহিত হয়ে বলল, ঠিক বলেছ, ভারি মিষ্টি গন্ধ।
রাশেদ খানিকটা ভড়কে গেছে। ডালিয়া ফুলের গন্ধ নেই। এরা গন্ধ পাচ্ছে কেন? না-কি এই ডালিয়া বিশেষ কোনো শংকর জাতের। হতেও পারে। ফুল নিয়ে নানান কর্মকাণ্ড হচ্ছে। জাপানি এক কোম্পানি নীল গোলাপ বের করেছে। এই কোম্পানির কিছু নীল গোলাপ পাওয়া গেলে সে রূপাকে দিত। রূপা গোলাপ দেখে চমকে উঠে বলত, নীল রঙের গোলাপ কোথায় পেলেন? সে বলতো…
আসব?
রাশেদ চমকে তাকালো। রূপা দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সুন্দর লাগছে রূপাকে। রাশেদ আনন্দিত গলায় বলল, রূপা কেমন আছেন?
রূপা বলল, আমি ভাল আছি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনিও ভাল আছেন। আমাকে বলা হয়েছিল আপনি মৃত্যুপথযাত্রী।
রাশেদ বলল, আমরা সবাই মৃত্যুপথযাত্রী। আপনি আসবেন আমি কল্পনাও করি নি। আপনাকে ডালিয়া ফুলের মতো লাগছে। হলুদ ডালিয়া। তবে এই ডালিয়ায় গন্ধ আছে। আপনি হলুদ শাড়ি পরেছেন এবং আপনার গায়ে হলুদ রোদ পড়েছে। মনে হয় এই কারণে ডালিয়া। আর একটা কথা, আপনি হয়ত রাগ করবেন। তাতে কিছু যায় আসে না। আমার মাথায় যে কথাটা এসেছে সেটা বলে ফেলব। কারণটা আগে স্পষ্ট করি, মরতে বসেছিলাম, সেখান থেকে ফিরেছি। পরের বার হয়ত ফিরতে পারব না। যে কথা বলতে চেয়েছি সেটা বলা হবে না।
রূপা বলল, হড়বড় করে এত কথা বলার কোনো প্রয়োজন নাই। যা বলতে চাচ্ছেন বলে ফেলুন।
ভুলে গেছি।
এত আগ্রহ করে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলেন সেটা ভুলে গেছেন?
রাশেদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কথাটা স্বপ্নের মতো মাথায় এসেছে। স্বপ্ন শর্টটাইম মেমোরি বলেই ভুলে গেছি। মানুষ জেগে থেকেও স্বপ্ন দেখে। খুব কম দেখে কিন্তু দেখে। আপনি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন, না ভেতরে আসবেন?
রূপা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, টেলিভিশন বন্ধ করুন।
রাশেদ বলল, অল্প কিছু সময় আপনি এই চেয়ারে বসে থাকুন। আমি নাটকটা দেখে শেষ করি। ঐ যে মেয়েটা দেখছেন সে অন্ধ। নায়ক এখনো বুঝতে পারছে না। যখন বুঝবে তখন টিভি বন্ধ করব।
রূপা বলল, আপনাকে পুরো নাটকটা দেখতে হবে। আমার ধারণা শেষ দৃশ্যে বুঝতে পারবে, তার আগে না। তখন নয়িক তার একটা চোখ দান করবে। দুই কানী সুখের সংসার করবে।–
কানি বলবে কানা
কানা বলবে কানি
এই বলে দুইজনে
করবে কানাকানি॥
রাশেদ বলল, প্লিজ কথা বলবেন না।
রূপার মোবাইল ফোন বাজছে। সে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। শায়লা টেলিফোন করেছেন।
তুই কোথায়?
মা আমি হাসপাতালে। বলেছিলাম না এক মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখতে এসেছি।
তার অবস্থা কি?
সে এখন জীবন পথযাত্রী। মহা উৎসাহে কানাকানির নাটক দেখছে।
তুই কি স্পষ্ট করে আমার কথার জবাব দিবি? লোকটা কে?
একবার তোমাকে বলেছি, আবারও বলছি। লোকটা কে আমি জানি না। তবে এখন জানব। নাড়ি নক্ষত্র বের করে ফেলব। তার সম্পর্কে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য অবশ্য জানি। বলব?
বল।
তার ব্লাড গ্রুপ ০ পজেটিভ। বেডের সঙ্গে লাগানো মেডিকেল রিপোর্টে লেখা।
ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ এটা গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন?
মা! এরা ইউনিভার্সেল ডোনার। তোমার রক্তের প্রয়োজন হলে তার কাছ থেকে নিতে পারবে।
রূপা আমার সঙ্গে সিরিয়াসলি কথা বল। ঠাট্টা তামাশা কিছুক্ষণ বাদ রাখ। প্লিজ। লোকটা কে, কি ব্যাপার, ঘটনা কি আমাকে বল।
মা! রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি–যদি জানতেম কি ঘটনা, তোমায় জানাতাম।
ইউ স্টুপিড গার্ল।
শায়লা টেলিফোন রেখে দিলেন। রূপা ঘরে ঢুকল না। নাটক শেষ হোক তারপর ঘরে ঢুকবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে তার খারাপ লাগছে না। পৃথিবীর সবচে বড় বড় নাটকগুলি হাসপাতালের বারান্দায় ঘটে। রূপার বা দিকে বারান্দায় হেলান দিয়ে এক মধ্য বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। তার হাতে অনেকগুলি কলা। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা কলা হাতে নিচ্ছে এবং অতি দ্রুত খাচ্ছে। মাথা বাইরের দিকে তাকিয়ে কলার খোসা নিচে ফেলে দ্রুত মাথা টেনে নিচ্ছে। আবার আরেকটা কলা খাচ্ছে। লোকটা সবদিকে তাকাচ্ছে শুধু রূপার দিকে তাকাচ্ছে না।
রাশেদ ভেতর থেকে ডাকল, নাটক শেষ। আসুন।
রূপা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, শেষটা কি? আমি যা বলেছিলাম তাই?
না। মেয়েটা অন্ধ না। অন্ধের অভিনয় করছিল। নায়ক যখন জানবে মেয়েটা অন্ধ তখন কি করবে তাই জানতে চেয়েছিল।
জেনেছে?
হুঁ। নায়ক অন্ধ শুনে বলেছে, তুমি অন্ধ তাতে কিছু যায় আসে না। আজ থেকে আমার চোখই তোমার চোখ। এখন থেকে তুমি দেখবে আমার চোখে। তখন নায়িকা হাসতে হাসতে বলল, আমি অন্ধ না। ঠাট্টা করছিলাম।
নাটক দেখে আনন্দ পেয়েছেন?
আমি সবকিছুতেই আনন্দ পাই। আমার ধারণা আমার জন্মই হয়েছে আনন্দ পাবার জন্যে। সকালে শেভ করে আনন্দ পেয়েছি, গোসল করে আনন্দ পেয়েছি, ব্রেকফাস্ট করে আনন্দ পেয়েছি, আপনাকে দেখে আনন্দ পেয়েছি, নাটক দেখে আনন্দ পেয়েছি, এখন কথা বলে আনন্দ পাচ্ছি।
আপনাকে কি আজ ছেড়ে দেবে?
জানি না, তবে ছেড়ে দেয়া উচিত। আমি পুরোপুরি সুস্থ।
ছেড়ে দিলে কোথায় উঠবেন? হোটেলে?
হোটেলে আমার সেকেন্ড অপশন। ফাস্ট অপশন আপনাদের বাড়ি। যে কয়দিন থাকব পেইং গেস্ট হিসেবে থাকব।
পার ডে, কত করে দেবেন?
আপনি ঠিক করে দিন। পনেরো বিশ দিনের বেশি থাকব না।
ঐ বাড়িটা খুঁজে বের করবেন না?
কোন বাড়িটা?
যে বাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, ভুলে আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। যে বাড়ির মেয়ের নাম রুনা। ভাল কথা রুনা কে?
আরেক দিন বলি?
কোনো অসুবিধা নেই, আরেকদিন বলবেন, আর বলতেই যে হবে তাও। শুধু একটা জিনিস এই মুহূর্তে জানতে চাচ্ছি। ঐ রাতে আপনার জন্যে খাবার সাজানো হচ্ছিল, আপনি কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন কেন?
রাগ করে চলে গেছি।
কার উপর রাগ? আমার উপর?
হ্যাঁ। আমাকে তুমি বলতে নিষেধ করেছিলাম এই জন্যে রাগ?
হ্যাঁ।
অন্যায় রাগ করেছিলেন।
হ্যাঁ, অন্যায় রাগ করেছিলাম, তার জন্যে শাস্তিও পেয়েছি।
কি শাস্তি পেয়েছিলেন?
বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধিয়েছি।
ডাক্তার রুবিনার কাছে শুনলাম আপনি মরতে বসেছিলেন।
হ্যাঁ। মানুষের হার্টে সমস্যা থাকে, আমার লাংসে সমস্যা।
ডাক্তার রুবিনাকে স্পেশাল থ্যাংকস দিতে ভুলবেন না। উনি আপনার জন্যে অনেক করেছেন।
সবার আগে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি ঘরে ঢুকেছেন হঠাৎ মনে হল ঘাতঘাত ঘরে এক খ রোদ ঢুকেছে। আপনাকে খুশি করার জন্যে বলছি না। সত্যি বলছি।
রাশেদকে বিকেলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিল। রাশেদ আনন্দিত গলায় রূপাকে বলল, কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে প্রকৃতি আপনাকে পাঠিয়েছে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর বাড়ি যাচ্ছি।
রূপা একবার ভাবল বলে, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমাদের বাড়িতে না। আমাদের বাড়ি ভুল বাড়ি। আপনি ভুল করে এসেছিলেন বলেই ভুল বাড়ি। আমি আপনাকে শুদ্ধ বাড়িতে নিয়ে যাব।
রাশেদ বলল, আচ্ছা আপনি কি গান জানেন?
রূপা বলল, না।
রাশেদ বলল, আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কিছু কিছু মানুষকে দেখে আমার মনে হয় এই মানুষটা গান জানে। তাদের সবাইকেই আমি জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি গান জানেন? সবাই বলেছে, না। শুধু একজনকে দেখে আমার মনে হয়েছে সে আর যাই জানুক গীন জানে না। অথচ সে এত সুন্দর গান করে।
রূপা ব্যানার্জির কথা বলছেন?
রাশেদ জবাব দিল না। কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। রূপা তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল। রূপা জানে কাজটা ভুল হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভুল কাজ করতে ইচ্ছা করে।
বাড়িতে ঢুকেই রাশেদ বলল, যে কথাটা আপনাকে বলতে গিয়ে ভুলে গেছি সেটা মনে পড়েছে। বলব?
বলুন।
আবার ভুলে গেছি।
রূপা বলল, এবার আপনি ভুলেন নি, আপনার মনে আছে। কিন্তু আপনি বলতে চাচ্ছেন না।
রাশেদ বলল, আপনার এত বুদ্ধি কেন? আমি একটা ব্যাপারে খুব অবাক হচ্ছি। আমি দেখেছি রূপা নামের মেয়েদের খুব বুদ্ধি হয়।
সন্ধ্যাবেলা হারুন বাসায় ফিরে দেখেন
সন্ধ্যাবেলা হারুন বাসায় ফিরে দেখেন গেস্টরুমের দরজা খোলা। সেখানে কে যেন শুয়ে আছে। বাইরে থেকে জুতা দেখা যাচ্ছে। জুতা পায়ে বিছানায় শোয়া। আশ্চর্য তো।
হারুন বললেন, গেস্টরুমে কে ঘুমাচ্ছে?
মলিনা বলল, ভাইজান ঘুমাইতাছে। আমারে বলল, মলি কফি খাব। ভাইজান আমারে পুরা নামে ডাকে না, মলি ডাকে। ঘরে ছিল না কফি। দারোয়ান দোকানে পাঠায়া কফি আনাইলাম। মগভর্তি কফি নিয়া গেলাম, ও আল্লা ভাইজান ঘুমে।
হারুন বললেন, ভ্যারভ্যার করবে না। ভাইজানটা কে? ঝেড়ে কাশ।
মলিনা বলল, কাশ থাকলে না কাশবো। ভাইজানের নাম রাশেদ।
যে জিনিসপত্র ফেলে চলে গিয়েছিল?
জ্বে।
আবার উদয় হয়েছে কেন?
আফা গিয়া নিয়া আসছেন। ভাইজান ছিলেন হাসপাতালে। খুবই খারাপ অবস্থায় ছিলেন। অবস্থা এমন যে ভাইজান বিছানায় শোয়া, আজরাইল খাটের নিচে ঘাপটি মাইরা বসা।
আর কথা বলবে না। রূপা কোথায়?
আফা বাজার সদাই করতে গেছে। ভাইজান গরুর মাংস দিয়া পরোটা খাইতে চাইছে। ঘরে মাংস নাই।
অচেনা এক লোক ঘরে ঢুকেই গরুর মাংস পরোটা খেতে চাইল আর তোমার আপা মাংস কেনার জন্যে ছুটল কসাইয়ের দোকানে?
মলিনা বলল, কসাইয়ের দোকানে যাবেন কেন? আগুরায় গেছে। সহজ কথা বললে বুঝেন না। আপনে এমন মসিবতের মানুষ।
ডেকে তোল তোমার ভাইজানকে।
একটা রোগী মানুষ। ঘুমাইছে। আমি তারে ডাইকা তুলব, এমুন পাষাণী আমি না। প্রয়োজনে বাসার কাম ছাইড়া গারমেন্টে চাকরি নিব। গারমেন্টে ছুটি আছে, ওভাবটাইম আছে, মেডিকেল আছে। বাসাবাড়ির কামে বকা ছাড়া কিছুই নাই।
হারুন গেস্টরুমে ঢুকলেন। সব রহস্যের এখনই মীমাংসা হওয়া দরকার।
রাশেদ মনে হয় জেগেই ছিল হারুনকে ঢুকতে দেখে সে বিছানা থেকে নামলো। হাসিমুখে বলল, আপনি নিশ্চয়ই রূপার বাবা।
হারুন বললেন, হ্যাঁ। আপনার পরিচয় প্রথম শুনি। আপনি কে? আপনার ব্যাপারটা কি?
রাশেদ বলল, আপনি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছেন? আমার সঙ্গে রাগ করার মতো বড় কোনো অপরাধ আমি করিনি। আপনি কি জানতে চান বলুন। আমি বলছি। আমার নাম নিয়েই এর মধ্যে জেনেছেন। আবারও বলি–আমার নাম রাশেদ রহমান।
থাকেন কোথায়?
আমেরিকায়। মোরহেড স্টেটে।
করেন কি?
মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গত বছর অঙ্কের লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি।
হারুন চেষ্টা করছেন রাগটা ধরে রাখতে পারছেন না। রাগ দ্রুত কমা শুরু হয়েছে। তাঁর সামনে দাঁড়ানো রাজপুত্রের মতো ছেলের উচিত সিনেমায় নায়কের রোল করা। সে শেখাচ্ছে অঙ্ক। পুরনো দিনের এক নায়কের সঙ্গে। ছেলেটার চেহারার মিল আছে। সে কে? উত্তম কুমার না তো? না উত্তম কুমার না। উত্তম কুমার এত সুন্দর না।
ম্যাথমেটিক্সের কোন ব্রাঞ্চে আপনার পড়াশোনা?
টপলজি।
Ph.D ডিগ্রী নিশ্চয়ই আছে?
জী আছে।
মলিনাকে কফির কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লেন। কফি কি এখন খাবেন? খাব।
আপনি অঙ্কের লোক ইতিহাসের বিষয়ে আপনার আগ্রহ থাকার কথা না। আগ্রহ কি আছে?
আমার সব বিষয়েই প্রবল আগ্রহ।
হারুন ইতস্তত করে বললেন, আমি ইতিহাসের মানুষ। একটা এক্সপেরিমেন্টাল ইতিহাসের বই লিখছি।
এক্সপেরিমেন্টাল মানে কি?
বইটা লিখছি কবিতায়।
রাশেদ আগ্রহের সঙ্গে বলল, প্রফেসর গ্যামো একটা অঙ্কের বই কবিতায় লিখেছিলেন। বইটার নাম Math in Rhymes.
বলেন কি?
অসম্ভব সুন্দর বই। আপনি পড়তে চাইলে আমি ব্যবস্থা করব।
অবশ্যই পড়তে চাই।
ইন্টারনেটে বইটা আছে। আমি ডাউন লোডের ব্যবস্থা করছি। আমাকে দয়া করে আধঘণ্টা সময় দিন।
হারুন বললেন, আগে কফি খাও। তারপর ডাউন লোড, আপ লোড যা করার করবে। তুমি বয়সে ছোট এই জন্য তুমি করে বলেছি।
রাশেদ বলল, আপনি আমাকে অবশ্যই তুমি করে বলবেন। আমি, বয়সে ছোট বলে আপনার মেয়ে রূপাকে তুমি বলেছিলাম। সে রাগ করেছিল।
হারুন দুঃখিত গলায় বললেন, আমার এই মেয়ে নিজেকে মনে করে মহাজ্ঞানী। মায়ের স্বভাব পেয়েছে। তার মা নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবে। রূপার মায়ের সঙ্গে যে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এটা কি রূপা তোমাকে বলেছে?
জী না।
ওইসব কথা বলতে সে লজ্জা পায়। তার সম্মানের হানি হয়। তোমার কাছে বলতে কি সমস্যা কিছুই বুঝলাম না। সে তো আর ঢাক পিটিয়ে বলছে না, নিজের লোকের কাছে বলছে। মান সম্মান নিয়ে বসে থাকার কোনো অর্থ আছে, তুমি বল।
রাশেদ বলল, কোনো অর্থ নেই।
আমি যে ছাদে মাছ চাষ করি, রূপা তোমাকে বলেছে?
বলে নি। কি মাছ চাষ করেন?
দেশি মাছ, কৈ, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া। কৈ মাছগুলি কেন জানি মরে যায়। সাত দিনের মাথায় মরে ভেসে ওঠে।
রাশেদ বলল, মৎস্য বিশেষজ্ঞ কারোর সঙ্গে আলাপ করা দরকার।
মৎস্য বিশেষজ্ঞ পাব কোথায়?
মৎস্য বিশেষজ্ঞ তো আপনার ঘরেই আছে।
কে? তুমি না-কি?
ইন্টারনেট। গুগল সার্চ দিলেই বের হয়ে পড়বে। আমি বের করে দেব। তার আগে চলুন আপনার মাছের খামার দেখে আসি।
হারুন আনন্দের সঙ্গে বললেন, চল যাই। কফি ছাদে বসে খাওয়া যাবে। ছাদে বাগান করেছি। বাগান তোমার পছন্দ হবে। রূপার অবশ্য পছন্দ না। তার ধারণা ছাদে আমি জঙ্গল বানিয়েছি। যে কোনো সময় জঙ্গলে বাঘ দেখা যাবে। সস্তা মেয়েলি রসিকতা। বাগান সম্পর্কে তোমার যদি কোনো সাজেশান থাকে দিতে পার।
দুজন ছাদে উঠে গেল।
রূপা বাজার নিয়ে ফিরেছে। গেস্টরুমে কেউ নেই। বসার ঘরেও কেউ নেই। রূপা বলল, মলিনা! উনি কি চলে গেছেন?
মলিনা হাসিমুখে বলল, ভাইজান ছাদে। বিরাট গফ চলতাছে। খালুজান এমন গফ দিতাছে, আমি অবাক মানছি। যান দেইখা আসেন। দেখলে মজা পাইবেন।
মদিনা কোথায়?
দরজা বন কইরা বসা। খালুজান কফি চাইছে, আমি মদিনারে বললাম, যা কফি দিয়া আয়। সে বলল, যামু না। আমি বললাম, যাবি না কেন? তুই ভূতের সাথে পীরিত করতে পারবি আর মেহমানের সামনে যাইতে পারবি না।
রূপা নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরের কোনায় মদিনা চুপচাপ বসে আছে। তার মাথা নীচু। রূপা বলল, কোনো সমস্যা মদিনা?
মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।
রাশেদ সাহেবকে দেখেছ?
হুঁ।
উনি মানুষ কেমন?
মানুষ কেমন আমি তো আফা বলতে পারি না।
মদিনা তোমার সঙ্গে আজ রাতে আমি আলাদা করে বসব। তোমাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ। বলতে পারছ না।
আফা চা খাবেন? চা আইন্যা দেই?
চা খাব না। বাবাকে ডেকে নিয়ে আস।
মদিনা বলল, আমি ছাদে যাব না আফা।
যাবে না কেন?
মদিনা চুপ করে রইল।
তুমি কি কোন কারণে রাশেদ সাহেবের সামনে যেতে চাচ্ছ না?
মদিনা এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
হারুন তাঁর রহস্য খাতা খুলেছেন। রহস্যময় যেসব খবর পত্রিকায় ওঠে তিনি তার পেপার কাটিং জমা করেন।
হারুন রহস্য খাতা রাশেদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, রাশেদ! এই ছেলেটাকে দেখ–বালক পীর। সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সে যাকে যা বলে তাই হয়। নাম ওসমান। বাবা দিনমজুর। আমি গিয়েছিলাম দেখতে। হাজার হাজার মানুষ। ভিড় ঠেলে এগুতে পারলাম না।
ব্যাপারটা কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
আমার উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এবং না। জগৎ রহস্যময় এটা তুমি মান, না-কি মান না?
রাশেদ বলল, আমার উত্তরও হ্যাঁ এবং না। একইসঙ্গে রহস্যময় আবার রহস্যময় না।
হারুন বললেন, আমার এখানে মদিনা নামের একটা মেয়ে আছে। তার নাম আমি দিয়েছি ঘড়ি-কন্যা। সে হল জীবন্ত ঘড়ি।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
ধীরে ধীরে বুঝবে। একদিনে সব জেনে ফেললে হবে না। মেয়েটা সম্পর্কে রাজশাহীর দৈনিক প্রভাতে কি লিখেছে পড়ে দেখ, আমি আরেক দফা কফির কথা বলে আসি। না-কি চা খাবে?
আপনি যা খাবেন। তাই খাব।
টক দৈয়ের শরবত খাবে? টক দৈ, গোল মরিচ আর লবণ ব্লেন্ডারে দিয়ে বানানো হয়। সঙ্গে থাকে এক ফালি কাঁচামরিচ আর এক চিমটি ধনেপাতা। গ্রাসের উপর দুই ইঞ্চি পরিমাণ কুচি বরফ। এক চামচ চিনি।
শুনেই তো খেতে ইচ্ছা করছে।
সমস্যা একটাই, রূপা ছাড়া কেউ বানাতে পারে না। সে ফিরেছে কি-না কে জানে। দেখি ব্যবস্থা করি। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নেমে গেলেন। তার এই ব্যস্ততা দেখার মতো।
বসার ঘরেই রূপাকে পাওয়া গেল। হারুন বললেন, দুটা টক দৈয়ের শরবত। কুইক।
রূপা বলল, বাবা বসো তো।
এখন বসতে পারব না। রাশেদের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি একটা আলাপ করছি। তুই শরবতটা বানিয়ে ছাদে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।
শরবত বানানো যাবে না। ঘরে টক দৈ নেই।
ড্রাইভারকে পাঠা। নিয়ে আসবে।
রূপা বলল, বাবা! তুমি বসো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। রাশেদ সাহেবের সঙ্গে আলাপের চেয়েও আমারটা জরুরি।
বল।
তুমি বস তারপর বলব।
তুই এত ঝামেলা করিস কেন? জরুরি কথা বসে শুনতে হবে? অতি জরুরি কথা শুয়ে শুনতে হবে? আচ্ছা যা বসলাম।
রূপা বলল, বাবা শোন। রাশেদ নামের মানুষটাকে আমরা কেউ চিনি। তার বিষয়ে কিছুই জানি না। তুমি প্রথম দেখাতেই তাকে কোলে নিয়ে বসে আছ এটা কি ঠিক হচ্ছে?
হারুন বললেন, কোনো একজন মানুষকে আমার পছন্দ হাতে পারবে না?
পাঁচ মিনিটের পরিচয়ে হতে পারবে না।
পঞ্চাশ বছরের পরিচয় লাগবে? তোর মার সঙ্গে এগারো বছরের পরিচয় ছিল। তাকে চিনতে পেরেছি?
বাবা! তুমি লজিক গোলমাল করে ফেলছ।
আমাকে লজিক শিখাবি না। স্টুপিড মেয়ে।
রেগে না গিয়ে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তুমি উঁচু তারে বাধা একজন মানুষ। কাউকে অতি দ্রুত পছন্দ হওয়া এবং অতি দ্রুত অপছন্দ হওয়া তোমার চরিত্রের অংশ। এটা ঠিক না।
কাকে অতি দ্রুত অপছন্দ করলাম? সুলতান চাচাকে।
যে ছাগলা একটা কথা চারবার করে বলে তাকে অপছন্দ করতে পারব না?
তাঁর এই স্বভাবের পরেও তাঁর সঙ্গে তোমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরপর দুদিন না দেখলে তুমি অস্থির হয়ে যেতে।
মূল কথাটা বল। রাশেদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারব না। এইটাই তো মূল কথা?
মূল কথা হচ্ছে তোমার ভোলাটাইল নেচার চট করে অপরিচিত একজনকে দেখিও না। সে তোমার নেচার বুঝতে পারবে না। তোমাকে নিয়ে মনে মনে হাসবে। আমোদ পাবে। তোমার কর্মকাণ্ডে কেউ আমোদ পাবে এটা আমার পছন্দ না।
হারুন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, তুই কি মনে করে অচেনা অজানা একজনকে বাড়িতে এনে তুলেছিস এটা বল। তুই নিজেই তো তাকে এ বাড়িতে কোলে করে এনেছিস। আমি আনি নি।
রূপা বলল, বাবা। উনি আমার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঝড়বৃষ্টিতে পড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। আমি অপরাধ বোধ থেকে তাঁকে এ বাড়িতে এনেছি। তিনি সে রাতে ডিনার না করে চলে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে ডিনার করাব। তিনি যে ঠিকানায় যেতে গিয়ে ভুল করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমি নিজে তাকে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দেব। রাতে ডিনারের পরপর এই কাজটা করা হবে।
এত দেরি করে লাভ কি? এখনি লাথি দিয়ে বের করে দে। যেখানের জিনিস সেখানে চলে যাবে।
বাবা। তুমি আবার ছেলেমানুষি শুরু করেছ।
হারুন বললেন, আমি ছেলেমানুষ তাই ছেলেমানুষি করছি। তুই বুড়ি, তুই করবি বুড়ি মানুষী। যা আমি তার সঙ্গে বাস করব না।
কোথায় যাবে?
বনে জঙ্গলে চলে যাব। গাছের ডালে ঝুলে থাকব। ক্ষুধা লাগলে গাছের পাতা খাব।
হারুন হন হন করে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নেমে গেলেন।
রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের ডিনারের আয়োজন করতে গেল। রাশেদ নামের মানুষটার পরোটা মাংস খেতে মন চাইছে। ঝাল মাংস সঙ্গে বিসকিটের মতো পরোটা।
ছাদে আলো নেই। বাড়ির চারপাশের গাছপালার কারণে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। রাশেদ চৌবাচ্চার পাশে বসে ছিল। টক দৈয়ের শরবতের অপেক্ষা। হারুন ফিরছেন না। মনে হয় শরবত বানানোর প্রক্রিয়া জটিল। সময় লাগবে। রূপার বাবাকে রাশেদের ভাল লেগেছে। তার নিজের বাবা খানিকটা এ রকমই ছিলেন। রাশেদের মা বলতেন, মানুষ ক্যামনে চিনবি বলব?
ঘোড়া চিনি কানে
রাজা চিনি দানে
মেয়ে চিনি হাসে
পুরুষ চিনি কাশে।
ভাল জাতের ঘোড়া কান দেইখা চিনতে হয়। রাজা কত বড় তার পরিচয় হয় তাঁর দানে। মেয়েদের চেনা যায় তাদের হাসি দিয়ে। আর পুরুষ চিনতে হয় তার কাশিতে।
রাশেদ বলেছিল একজন পুরুষ মানুষ কাশবে সেই কাশির শব্দে বোঝা যাবে সে কেমন পুরুষ!
হুঁ। কাশ হইল তার গলার আওয়াজ। মানুষের গলার আওয়াজই তার পরিচয়।
হারুন নামের মানুষটার গলার আওয়াজ মোটেই ভাল না, কিন্তু মানুষটা ভাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশেদ ছাদের গাছপালা দেখছে। ছাদে বাগানের সুযোগ আমেরিকার নেই। আমেরিকার আকাশ থেকে বরফ পড়ে। বাংলাদেশের আকাশ থেকে পড়ে বৃষ্টি। গাছপালার প্রাণদায়িনী বৃষ্টি।
ড্রাম কেটে একটা কাগজি লেবুর গাছ লাগানো হয়েছে। গাছভর্তি লেবু। কি সুন্দর দৃশ্য। গাছটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। গাছ নিয়ে রাশেদের মার ছড়া আছে–
আমড়া গাছে আম হয় না
কাঠাল গাছে কলা
তেঁতুল গাছে জাম হয় না
হয় না ত্রিফলা।
রাশেদ গাছ থেকে একটা লেবু ছিঁড়ল। Fresh Lemon Smell Purifies Thc Heart. লেবুর ঘ্রাণ নিয়ে হৃদয় শুদ্ধ করা যাক। রাশেদ ঘ্রাণ নিল।
অন্ধকারে ছাদে ঘুরছেন। এই যে রুফ গার্ডেন সুইচ। বাতি জ্বেলে দেই?
রূপার কথায় রাশেদ হঠাৎ চমকে উঠল। কেন চমকালো সে নিজেও বুঝতে পারল না।
মানুষের প্রতিটি কার্যের পেছনে কারণ থাকে। চমকানোর পেছনের কারণটা কি? এমন কি হতে পারে অন্ধকারে রূপার গলার স্বর অন্য রকম শুনাচ্ছে। দিন রাত্রির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গলার স্বর বদলায়।
রাশেদ বলল, বাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারে হাঁটতে আমার ভাল লাগছে। আপনার বাবা কোথায়?
আমার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
কি সর্বনাশ!
রূপা বলল, সর্বনাশের কিছু না। মাসে একবার আমার উপর রাগ করে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঘণ্টাখানিক পর ফিরে আসেন। বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। বাবাকে কেমন লাগল?
রাশেদ বলল, ছড়া দিয়ে বলি–
কলমে কায়স্থ চিনি
গোঁপে রাজপুত
ভাল মানুষ সেই হয়
যার কলিজা মজবুত।
আপনার বাবার কলিজা মজবুত।
রূপা বলল, অদ্ভুত ছড়া কোত্থেকে শিখেছেন?
রাশেদ বলল, আমার মার কাছ থেকে। সবকিছু নিয়ে তাঁর ছড়া আছে।
রূপা বলল, আরেকটা ছড়া বলুন তো?
রাশেদ বলল, গলা নাই গান গায়। বৌ নাই শ্বশুর বাড়ি যায়।
বাহ্ সুন্দর তো। আপনার মা কি আপনার সঙ্গে থাকেন?
না। তিনি নেত্রকোনা জেলার বাইরে কোনদিন যাননি।
বেঁচে আছেন?
না।
আপনার বাবা বেঁচে আছেন?
জানি না।
জানেন না মানে কি?
রাশেদ বলল, আমার বাবা খানিকটা আপনার বাবার মতো। তিনি মার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন। তাঁর রাগ সহজে পড়ত না। এমনও হয়েছে দুমাস ফিরেন নি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একবার রাগ করে বাড়ি ছাড়লেন আর ফিরেন নি। মনে হয় এখনো রাগ কমেনি। বাবাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে যদি কোনদিন গুনতে চান শুনাব।
অবশ্যই শুনব। রান্না হয়ে গেছে। আপনি যখন খেতে চান বলবেন টেবিলে খাবার দিতে বলব। বাবা গাড়ি নিয়ে যান নি। গ্যারাজে গাড়ি আছে। ডিনার শেষ করে গাড়ি নিয়ে রুনাদের বাড়ি খুঁজে বের করবেন।
তাড়িয়ে দিচ্ছেন না-কি?
রূপা বলল, না। যেটা শোভন সেটা করছি। আমাদের এখানে কেন থাকবেন।
পেইং গেস্ট হিসেবে থাকব।
আমরা পেইং গেস্ট রাখি না। এই কথায় আবার রাগ করে ঐ রাতের মতো না খেয়ে চলে যাবেন না। আপনি গোশত পরোটা খেতে চেয়েছিলেন। মাংস আমি নিজে রান্না করেছি। পরোটা তৈরি আছে। খেতে বসলেই মলিনা ভেজে দেবে।
রাশেদ বলল, আপনি আপনার বাবার মতো না। আপনি আমার খুব পরিচিত একজনের মতো। আপনার স্বরও তার মতো। প্রথম দিন ধরতে পারিনি। আজ ধরতে পেরে চমকে উঠেছি।
রূপা বলল, তার নাম কি রূপা ব্যানার্জি?
রাশেদ অবাক হয়ে বলল, কীভাবে বললেন?
রূপা বলল, আমি থট রিডিং জানি না। প্রথম দিনই তার কথা আপনি বলেছিলেন। মনে হয় ভুলে গেছেন।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমি বলেছিলাম।
রূপা বলল, যার বাসায় যাচ্ছেন রুনা যার নাম, তিনি কে?
রাশেদ বলল, আমার স্ত্রী।
ছাদ অন্ধকার। আলো থাকলে দেখা যেত রূপা চমকে উঠেছে। তার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়েছে। যদিও তার কোনো কারণ নেই। রূপা এই মানুষটার প্রেমে পড়ে নি। তার তিনটা স্ত্রী থাকলেও রূপার কিছু যায় আসে না। রূপা বলল, খাবার কি দিতে বলব?
বলুন।
আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে খেতে বসব না। বাবার জন্য অপেক্ষা করব। অতিথি একা খাবে এটা অভদ্রতা, আগেই ক্ষমা চাচ্ছি।
রাশেদ বলল, আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি মলিনার সঙ্গে গল্প করতে করতে খাব।
রাশেদ বলল, আপনার কাছে পরোটা খেতে চেয়েছিলাম। এখন ত খেতে ইচ্ছা করছে, ভাত কি আছে?
অবশ্যই আছে। ভাত খেতে ইচ্ছা করলে ভাত খাবেন।
আমার বাবার প্রিয় খাবার ছিল ধোঁয়া ওঠা ভাতের উপর দুই চামচ ঘি। তার সঙ্গে ভাজা শুকনা মরিচ। আপনাদের রান্নাঘরে কি ঘি আছে?
আছে। খুব ভাল পাবনার ঘি আছে। আসুন খেতে বসুন। যেভাবে খাবার গল্প করছেন মনে হয় আপনার খুব ক্ষিধা পেয়েছে। কোক আনিয়ে রেখেছি। আপনারা যারা আমেরিকায় বাস করেন তারা খাওয়া শেষ করেই সোড় খেতে চান। ভাল কথা, আপনারা কোককে সোডা কেন বলেন?
রূপা! আমি জানি না।
রূপা আবারও চমকালো। মানুষটা এত সহজে তাকে রূপা ডাকল কেন?
রূপা ব্যানার্জির কারণে? ডেকে ডেকে অভ্যাস?
বাড়ির নাম মঞ্জুরী।
চারতলা বাড়ি। গেটে বাগান বিলাসের ঝাড়। গেটের দারোয়ান রাশেদকে ঢুকতে দিচ্ছে না। দারোয়ান রাশেদের কথা জানিয়ে ইন্টারকম করেছিল। বাড়ির মালিক দেওয়ান সাহেব বলেছেন, গেস্টকে বল সকালে আসতে। আমার শরীর ভাল না, জ্বর।
রাশেদ বলল, উনার সঙ্গে কথা না বললেও চলবে। তার মেয়ে রুনার সঙ্গে কথা বলব।
দারোয়ান বলল, আপনি অপেক্ষা করেন আপার সাথে কথা বলে দেখি।
রাশেদ অপেক্ষা করছে। রাতের আকাশে মেঘ। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আজ বৃষ্টি নামলে ভেজা যাবে না। আবার হাসপাতাল। আবার দুঃস্বপ্ন।
গেট খুলছে। দারোয়ান বলল, গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না।
রাশেদ বলল, আমি যে ঢুকতে পারছি এতেই খুশি।
রাশেদ বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। ঘরের সাজসজ্জা খানিকটা উগ্র। একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। পাথরের অর্ধ নগ্ন নারীমূর্তির পাশে থালাভর্তি প্রাস্টিকের ফলমূল। দেয়ালে কামরুল হাসানের পেইনটিং আছে। অতি কুৎসিত ফ্রেমে চমৎকার একটা ছবি। সমুদ্রে পানি হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবানো একটা মেয়ের ছবি আছে। এই মেয়েটা রুনা। রুনার অনেকগুলি ছবি রাশেদের কাছে। মেয়েটার মুখ শান্ত। চোখে স্বপ্ন আছে।
রুনার বাবা দেওয়ান সাহেব ঢুকলেন। রাশেদ উঠে দাঁড়াল।
তুমি রাশেদ?
জী।
ছবিতে দেখেছি। হকির চেহারা এবং সামনা-সামনি চেহারা এক না। বসো।
রাশেদ বসলো। তার কাছে দৈওয়ান সাহেবকে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। তবে ভয়ংকর বিরক্ত মনে হচ্ছে। দেওয়ান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি কাটা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে। তারপরেও কেন এসেছ বুঝলাম না। দ্য গেম ইজ ওভার।
রাশেদ বলল, আমি রুনার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলে চলে যেতাম।
তার সঙ্গে কি কথা বলবে। সে ভয়ংকর আপসেট। টেলিফোনে বিয়েতে সে শুরু থেকে রাজি ছিল না। আমিও ছিলাম না। কু-পরামর্শে কাজটা করেছি। ছেলে রাজপুত্র, PhD, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। What a shame.
রাশেদ চুপ করে আছে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড রেগেছেন। হাতের সিগারেটে দুটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরিয়েছেন। ভদ্রলোকের রাগ কমার আগে কথা বলা অর্থহীন।
রাশেদ শোন, তুমি রসগোল্লা পান্তুয়া যাই হও না কেন, তুমি মূলত স্ট্রিট বয়। ভুল বললাম, তার চেয়েও খারাপ। তোমাকে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। সারারাত ডাস্টবিনে পড়েছিলে। তোমার ফুসফুস এই কারণেই নষ্ট।
রাশেদ বলল, কথাগুলি আপনাকে যে জানিয়েছে সে ভুল জানিয়েছে। এটা আপনাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি।
তুমি কি অস্বীকার কর যে তোমার লাংস নষ্ট না?
লাংস ক্ষতিগ্রস্ত এটা ঠিক আছে। পরের কথাগুলি ঠিক না।
রূপা ব্যানার্জি নামে যে মেয়েটার সঙ্গে তুমি লিভ টুগেদার করতে এটাও ভুল?
জী ভুল।
বাঙালি মেয়ে না?
হ্যাঁ, কোলকাতার মেয়ে।
একটা বাঙালি মেয়ে জেনেশুনে এত বড় অপবাদ মাথায় নিয়ে বলবে সে তোমার সঙ্গে লিভ টুগেদার করত এবং তোমাদের একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স। তার নাম নিহি।
রাশেদ বলল, আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। তিন মিনিটে চারটা সিগারেট ধরিয়েছেন। একজন উত্তেজিত মানুষকে কিছু বোঝানো যায় না। আপনাকে বোঝাতেও চাচ্ছি না।
দেওয়ান সাহেব বললেন, আমার কথা শেষ হয় নি। কথা শেষ হোক তারপর ফড়ফড় করবে।
অবশ্যই। কথা শেষ করুন।
টেলিফোনের বিয়ে কোনো বিয়ে না। এর আইনগত কোনো ভেলিডিটি নেই। আমরা এই বিয়ে স্বীকার করছি না।
রাশেদ বলল, কোনো সমস্যা নেই। আমি বিয়ে বজায় রাখার চেষ্টা করতে আসি নি।
তাহলে কি জন্যে এসেছ?
রুনা আমাকে জঘন্য একজন মানুষ ভাবছে এটাই খারাপ লাগছে। আমি নিশ্চিত সে চমৎকার কোনো ছেলেকে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটাবে। তবে কখনো কখনো তার মনে হবে টেলিফোনে বিয়ে করে কি ভুলই না করেছিলাম। প্রথম স্বামী ছিল ভয়ংকর। এটা তাকে কষ্ট দিবে। আমি তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। সে যদি জানে তার প্রথম স্বামী খারাপ মানুষ ছিলেন তাহলে তার কষ্ট কম হবে।
প্রথম স্বামী, প্রথম স্বামী করছ কেন? তোমার সঙ্গে কি রুনার বিয়ে হয়েছে? টেলিফোনে বকর বকর করা মানে বিয়ে না। তোমরা এখনো চাক্ষুষ কেউ কাউকে দেখনি। যাই হোক আমার কথা শেষ। এখন বিদেয় হও। ফর ইওর ইনফরমেশন, এই মাসের আঠারো তারিখ আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। জামাই লেফটেনেন্ট কর্নেল।
রাশেদ বলল, আমি কি তাকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে পারি।
তুমি গিফট দেবে কেন? তুমি কে?
রুনার কাছে আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম দেশে যখন আসব তখন তোমার জন্যে কি আনব? সে বলেছিল একটা লাই ডিটেক্টর আনতে। তার এক বান্ধবীর আছে। সবাই এটা নিয়ে মজা করে। আমি একটা লাই ডিটেক্টর তার জন্যে এনেছি। খেলনা ভার্সান। গাড়িতে আছে। নামিয়ে দিয়ে যাই?
তুমি লাই ডিটেক্টর নিয়ে বিদায় হও। এই ডিটেক্টরে নিজের মিথ্যাগুলি ধরার চেষ্টা কর। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে বিয়ে করার জন্যে আমি যে তোমাকে পুলিশে দিতে পারি এটা জান? পুলিশের এডিশনাল আইজি রুনার বড় মামা।
রাশেদ উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। সে হোটেলের সন্ধানে বের হবে, না চায়ের দোকানে রাতের জন্যে আশ্রয় নেবে তা বুঝতে পারছে না। আচ্ছা গাড়ি চলতে শুরু করুক তারপর চিন্তা করা যাবে। কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলে কেমন হয়? রাতে যদি কোনো ট্রেন পাওয়া যায় সেই ট্রেনে করে নেত্রকোনা চলে যাওয়া। স্টেশনের নাম আঠারোবাড়ি। সে গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হল, আর একটা মিরাকল ঘটল। জগতে মিরাকল যে একেবারেই ঘটে না, তাও না। মাঝে মাঝে ঘটে। প্লেন ক্রাশ হয়েছে। প্লেনের দুশ আশিজন যাত্রীর সবাই মারা গেছে। একজন বেঁচে আছে, সতুর বছরের বৃদ্ধ। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সংসারে কেউ নেই। বৃদ্ধ নিবাসে থাকে। মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল। ফেরার পথে দুর্ঘটনা।
বৃদ্ধ ব্যাংকারের জীবনে যদি মিরাকল ঘটতে পারে তার জীবনেও ঘটতে পারে। সে বাড়িতে ঢুকে দেখল কুয়াতলায় এক বৃদ্ধ বসে আছেন। বৃদ্ধকে দেখে রাশেদ এগিয়ে গেল। স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা কেমন আছ? বৃদ্ধ বলল, তুই রাশেদ? কেমন আছিস? তোর মা গেল কই? মরে গেছে না-কি?
রূপাদের ড্রাইভার বলল, স্যার এখন কোথায় যাবেন?
রাশেদ বলল, প্রথম একটা পরিচিত চায়ের দোকানে যাব। এক কাপ চা খাব। তারপর রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরব। ঘুরতে ঘুরতে চিন্তা করব কোথায় যাওয়া যায়। তোমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারি আবার দেশের বাড়িতেও চলে যেতে পারি।
হারুন বাড়িতে ফিরলেন রাত এগারোটায়। রূপা দরজা খুলে দিল। হারুন বললেন, টক দৈ এনেছি। শরবত বানিয়ে দে।
রাশেদ সাহেব চলে গেছেন বাবা। তুমি খেতে চাইলে তোমার জন্যে বানিয়ে দেই।
আমাকে কিছু না বলে চলে গেল। রূপা বলল, তুমি ছিলে না। তুমি কখন ফিরবে তাও বলে যাও নি। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। খেতে এসো।
আমি খাব না।
বাবা! আমি তোমার জনো না খেয়ে অপেক্ষা করছি।
হারুন বললেন, you go to hell. বলেই হাতের টক দৈয়ের হাঁড়ি ছুড়ে ফেললেন।
বোম ফাটার মতো হাঁড়ি ভাঙার আওয়াজ হল। মলিনা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে হারুনের রুদ্রমূর্তি দেখে ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
রূপা রাতে ঘুমুতে গেল না খেয়ে। অভুক্ত অবস্থায় ঘুম আসে না। বিছানায় শোয়ামাত্র রূপার চোখ বন্ধ হয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। শায়লা টেলিফোন করেছেন।
তোর বাবা কি কাণ্ড করেছে জানিস।
বাবা অনেক কাণ্ডই করে। কোনটার কথা বলছ?
আজ রাতে আমার এখানে এসেছিল তুই জানিস?
না।
আমার আর টগরের বাবার আজ একটা বিশেষ দিন। ম্যারেজ ডে। আমরা ঠিক করেছি দুজনে ঘরোয়াভাবে দিনটা পালন করব। রাতে ঘরেই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। এ উপলক্ষে টগরের বাবা সাত হাজার পাঁচশ টাকা দিয়ে একটা শ্যাম্পেনের বোতল এনেছে ঢাকা ক্লাব থেকে। সব জলে গেছে।
শ্যাম্পেন খেতে পার নি?
কীভাবে খাব। তোর বাবা উপস্থিত। তাকে ভদ্রতা করে টগরের বাবা বলেছে, আসুন আমাদের সঙ্গে ডিনার করুন। সে সঙ্গে সঙ্গে বসে গেছে। তার সামনে তো আর আমরা ম্যারেজ ডে সেলিব্রেট করতে পারি না।
করলে অসুবিধা কি? বাবা তোমার আনন্দ শেয়ার করত। অন্যের আনন্দ বাবার মতো কেউ শেয়ার করতে পারে না। তোমাদের ডিনারের মেনু কি ছিল?
খাবার এসেছে ঢাকা ক্লাব থেকে। চিকেন স্টেক। দেশি কায়দায় প্রণ। বিফ আইটেম ছিল। ঘটনা শোন, চিকেন স্টেক এসেছে দুটা। মানুষ তিনজন। এখন আমি যদি আমারটা দিয়ে দেই টগরের বাবা অন্যকিছু ভেবে বসতে পারে। সমস্যাটা বুঝতে পেরেছিস?
সমস্যার সমাধান কীভাবে হল?
টগরের বাবা সমাধান করল। সে বলল, আমাকে চিকেন স্টেক কেন দিয়েছ? আমি ব্রয়লার চিকেন খাই না। সঙ্গে সঙ্গে বেকুবটা বলল, আমাকে দিয়ে দিন। ব্রয়লার চিকেনে আমার সমস্যা নেই।
রূপা বলল, মা শোন আমি জানি বাবা বোকা। কিন্তু তোমার মুখ থেকে বেকুব শব্দটা শুনে খারাপ লাগছে। আমি বাবাকে সামলাব, সে যেন আর কখনো তোমাকে বিরক্ত না করে। মা আমি টেলিফোন রাখছি। আমার মনটা ভাল না।
মন ভাল না কেন?
রূপা জবাব না দিয়ে টেলিফোন রাখল। বাবা খেয়ে এসেছে কাজেই তার না খেয়ে রাত পার করায় সমস্যা কিছু নেই। সে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মদিনা? জেগে আছ?
জী আফা।
খাবার গরম কর। আমি খাব। মলিনাকে ডেকে তুলবে না। সে বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিবে। পরোটা ভেজে দিতে পারবে না?
পারব।
আমি শুয়ে থাকব। সবকিছু রেডি করে আমাকে খবর দিবে। যদি দেখ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তাহলে আর আমাকে ডাকবে না।
রূপা খেতে বসেছে। পাশেই মদিনা দাঁড়িয়ে আছে।
আগ্রহ নিয়ে রূপার খাওয়া দেখছে। সে হঠাৎ রূপাকে চমকে দিয়ে হাসি মুখে বলল, ভূতটা চইলা গেছে।
রূপা বলল, ভাল খবর। চলে গেল কেন?
উনারে দেইখা খুবই রাগ হইছে, তারপর চইল্যা গেছে।
রাশেদ সাহেবকে দেখে?
রূপা বলল, ভয় পেয়ে চলে গেল কেন? উনি কি ভূতের ওঝা?
মদিনা জবাব দিল না। রূপা নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। হাত ধুতে ধুতে বলল, তুমি বলেছিলে উনি হাসপাতালে। কাকতালীয়ভাবে তাকে হাসপাতালে পাওয়া গেল। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে তুমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। আমার কাছে অনেকবার মনে হয়েছে আজ সুলতান চাচা আসবেন। তিনি এসেছেন তাতে প্রমাণিত হয় না যে আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। বুঝেছ?
তুমি কি বলতে পারবে রাশেদ সাহেব এখন কোথায় আছেন?
জী।
আমি হঠাৎ হঠাৎ বলতে পারি, সব সময় পারি না। একটা মেয়ে আইসা আমারে যখন বলে তখন বলতে পারি। মেয়েটা পানিতে থাকে।
জলকন্যা?
জানি না আফা।
শোন মদিনা। যারা মৃগী রোগী তাদের যখন এটাক হয় অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, ফিটের মতো হয় তখন তারা অনেক কিছু দেখে। আমার নিজের ধারণা তোমার এই রোগ আছে। আমাকে মনে করিয়ে দিবে কাল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
জী আচ্ছা।
কাল তোমাকে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দেব।
আফা মেয়েটার শইল নাই। খালি মাথা। মাথা ভর্তি চুল। চোখের মণি অনেক বড়। শাদা অংশ নাই বললেই চলে।
কোন মেয়ে?
যে আমারে ঘটনা বলে।
রূপা বলল, কাল তোমাকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তখন তাকে এইসব বলবে। আমাকে এইসব বলার দরকার নাই। টিভিটা ছাড়। আমার ঘুম কেটে গেছে। কিছুক্ষণ টিভি দেখব।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে মঙ্গলগ্রহের পানির সম্ভাবনা নিয়ে ছবি দেখাচ্ছে। রূপা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের তৈরি করা মঙ্গলের কিছু কাল্পনিক ছবিও দেখালো। লাল পাহাড়ের দেশে দুটি চাঁদ উঠেছে। জোছনার কি অপূর্ব খেলা। রূপা ঠিক করে ফেলেছে তার পরবর্তী ছবির নাম
মঙ্গলগ্রহে জোছনা।
ডাক্তার কথা বলছেন
ডাক্তার কথা বলছেন। শ্রোতা রূপা। মদিনাকে পাশের কামরায় রাখা হয়েছে। ডাক্তার মধ্যবয়স্ক। সাইকিয়াট্রিস্টরা পেশাগত কারণে প্রচুর কথা বলেন। ইনি তার ব্যতিক্রম না। এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন। রূপা মন দিয়ে শুনছে। ডাক্তার ভদ্রলোক কথা বলে আরাম পাচ্ছেন তা বুঝা যাচ্ছে।
মদিনা মেয়েটির সমস্যা স্নায়ুবিক। নিউরো ট্রান্সমিটার বিকার বলা যেতে পারে। তার রক্তে হিমোগ্লোবিন আশঙ্কাজনকভাবে কম। হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ করা। সেই অক্সিজেনের ৭০ ভাগের বেশি প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কের। মস্তিষ্ক যখন অক্সিজেন কম পায় তখন সে অদ্ভুত সব জিনিস দেখে। অদ্ভুত শব্দ শুনে।
যারা এভারেস্টের চূড়ায় উঠেন তারা অক্সিজেনের বোতল নিয়ে উঠেন। যখন বোতলের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায় তখন শুরু হয় অক্সিজেন ডিপ্রাইভেশনজনিত হেলুসিনেশন। প্রায় সবাই বলেছেন ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় তারা উড়ন্ত মানুষ দেখেছেন। আশেপাশে অদ্ভুত জন্তু-জানোয়ার দেখেছেন যারা মানুষের ভাষায় কথা বলে। আপনি কি এভারেস্ট অভিযান নিয়ে লেখা–Into thin air বইটা পড়েছেন? লেখকের নাম, Jon Krakauer.
রূপা বলল, না।
বইটিতে হেলুসিনেশনের কথা বলা আছে। এভারেস্ট অভিযাত্রীদের ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় ওঠার পর যা হয় মদিনা মেয়েটিরও তাই হচ্ছে। সে একবার পানিতে ড়ুবে গেল। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হল। হেলুসিনেশনের শুরু। সে দেখল একটা মেয়ের মুখ।
তারপর যতবার অক্সিজেন ঘাটতি হল ততবারই সে এই মেয়েটিকে দেখল।
মাসের কিছুদিন মেয়েদের শরীরে রক্ত কমে যায়। আমি নিশ্চিত মদিনা ঐ সময়েই ভবিষ্যৎ দেখার কথা বলে।
ডাক্তার দম নেবার জন্যে থামলেন। রূপা বলল, আমাদের করণীয় কি?
ডাক্তার বললেন, আপনাদের কিছুই করণীয় নেই। আমি ওষুধ দিচ্ছি। ভিটামিন দিচ্ছি। আয়রণ ট্যাবলেট দিচ্ছি। আপনারা মদিনার কথার কোনো রকম গুরুত্ব দেবেন না। তার কথায় গুরুত্ব দেবার অর্থ তাকে উৎসাহিত করা। যত বেশি সে উৎসাহিত হবে এই ধরনের আজগুবি কথা সে তত বেশি বলবে। তাকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। মেয়েটার ভাল ঘুম দরকার। সে বলেছে রাতে তার ঘুম হয় না। মেয়েটার ব্রেইনের একটা সিটি স্ক্যান কি করাবেন? ব্রেইনে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে এতে ধরা পড়বে। ব্রেইন টিউমারেও এমন সমস্যা হয়। টিউমার থাকলে সিটি স্ক্যানে ধরা পড়বে।
আপনি সিটি স্ক্যান করাতে বললে করাব।
বেশ খরচ পড়বে। একটা কাজের মেয়ের পেছনে এত টাকা খরচ করবেন?
হ্যাঁ করব।
তাহলে সিটি স্ক্যান করান। এর রিপোর্ট আমাকে দেখাবেন না। দেখাবেন একজন নিউরোলজিস্টকে। আমি তার নাম লিখে দিচ্ছি। ওষুধগুলি আগেই শুরু না করে সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট দেখার পর শুরু করুন।
রূপা উঠতে যাচ্ছিল, ডাক্তার বলল, চা খান। চা খেয়ে তারপর যাবেন। আপনার সঙ্গে কথা বলে আরাম পেয়েছি। বেশির ভাগ সময় আমি কথা বলে আরাম পাই না। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করুন। রোগ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার ভাল লাগে।
রূপা বলল, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা দাবি করে যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তাদের সবারই কি হেলুসিনেশন সমস্যা?
অবশ্যই।
তাদের বলা ভবিষ্যৎ যদি মিলে যায় তার ব্যাখ্যা কি?
দুএকটা হয়ত মিলে। কাকতালীয়ভাবে মিলে। যেটা মিলে যায় সেটাই আমরা মনে রাখি। যেগুলি মিলে না সেগুলি মনে রাখি না। মৃগী রোগ কি নিশ্চয়ই জানেন?
রূপা বলল, জানি।
মৃগী বা এপিলেপসি শব্দটা এসেছে গ্রীক শব্দ এপিলেপসিয়া থেকে। যার অর্থ ভর করা। অপদেবতা বা দেবতা ভর করলেই এই রোগ হয় বলে ভাবা হত। মৃগী রোগের ক্ষেত্রেও এটাকের সময় রোগী ভবিষ্যতের কথা বলে।
অনেক কিছু দেখে। সবই মস্তিষ্কের ভেতরে।
মদিনার সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোবে একটি টিউমার পাওয়া গেল। টিউমার মেলিগনেন্ট হবার সম্ভাবনা। নিউরোলজিস্ট বললেন, অবিলম্বে ফ্রন্টাল লুবোটমি করা প্রয়োজন।
রূপা এই খবর মদিনাকে দিল না। তার বাবাকেও জানালো না।
মদিনা রাতে ঘুমুতে গেছে। রূপা বলল, নীল দুটা ট্যাবলেট খাওয়ার কথা খেয়েছ?
মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
ভূত যেটা চলে গিয়েছিল সেটা কি ফিরে এসেছে?
না।
আরাম করে ঘুমাও।
মদিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমারে মার কাছে পাঠায়া দেন আফা। আমি বেশিদিন বাঁচুম না।
কে বলেছে, দিঘির পানিতে যে মেয়ে দেখা দিয়েছিল সেই মেয়েটা?
জী আফা।
ভুয়া মেয়েটার কথা ভুলে যাও। তুমি অনেকদিন বাঁচবে। বাতি নিভিয়ে দেই?
দেন।
মদিনা কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাত জেগে রইল রূপা। তার একফোঁটা ঘুম এল না।
হারুনের কাছে চিঠি
হারুনের কাছে চিঠি নিয়ে কে একজন এসেছে। ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হারুন খবরের কাগজ পড়ছিলেন এই সময় তার মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে। আজ অতিরিক্ত খারাপ কারণ প্রথম পৃষ্ঠাতেই খবর–
ঘাতক ট্রাক ছিনিয়ে নিল ছোট্ট মীলাকে
মীলার বয়স চার। সে নার্সারিতে পড়ে।
সে তার লবণ মাখানো দুটা আমড়ার স্টিক হাতে নিয়ে মার দিকে ছুটে আসছিল। হঠাৎ ট্রাকের নিচে পড়ে গেল। আটকে গেল ট্রাকের চাকায়। এই অবস্থাতেই ট্রাক ছুটে বের হয়ে গেল।
ছোট্ট মীলার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। মাথার চুল পনিটেল করে বাঁধা। মীলাকে দেখাচ্ছে ছোটবেলার রূপার মতো।
কাগজ দূরে ছুড়ে ফেলে হারুন বললেন, কার চিঠি?
পত্রবাহক ভয়ে ভয়ে বলল, নাম জানি না স্যার। আমারে বলেছেন আপনারে দিতে। বাসা চিনায়ে দিয়েছেন।
যে চিঠি লিখেছে সে কোথায়?
উনি কোথায় জানি না। উনি বলেছেন, দেশের বাড়ি চলে যাবেন।
দেশের বাড়ি কোথায়?
জানি না স্যার।
হারুন বললেন, তোমার ভাওতাবাজি আমি বুঝতে পরছি না এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। চাদাবাজ চাঁদা চেয়ে চিঠি লিখে তোমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে। তোমাকে আমি ছেড়ে দেব তা ভাববে না। যদি ভাব তাহলে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ। তোমাকে আমি পুলিশে দেব। জীবন যাবে জেলের ল্যাপসি খেতে খেতে। ল্যাপসি চেন?
জী না স্যার।
রূপা বলল, কেন শুধু শুধু ফেনাচ্ছ বাবা? হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড় তারপর যা করার করবে।
হারুন বললেন, নাম-গোত্রহীন কারোর লেখা চিঠি তো আমি পড়ব না। এই চিঠি ডাকে আসে নি। কুরিয়ার সার্ভিসেও আসে নি। কাজেই চিঠিতে সমস্যা আছে।
তাহলে তাকে বলে দাও চিঠি নিয়ে চলে যেতে।
হারুন কঠিন গলায় বললেন, তোমার এই চিঠি আমি পড়ব না। যে চিঠি লিখেছে তার নাম-ঠিকানা নিয়ে এসো তারপর দেখা যাবে।
রূপা বলল, বাবা! আমার সাজেশন হচ্ছে চিঠিটা পড়ো। হয়ত চিঠিতেই নাম-ঠিকানা আছে।
হারুন নিতান্তই অনিচ্ছায় চিঠি হাতে নিলেন। চিঠিতে লেখা–
শ্রদ্ধাভাজনেধু
রূপার বাবা।
আমি দুটি কারণে অত্যন্ত লজ্জিত। প্রথম কারণ, আপনার নাম জানা হয়নি। যে কারণে বাধ্য হয়ে রূপার বাবা লিখছি। দ্বিতীয় কারণ ঐ দিন আপনার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি।
আশা করি বুঝতে পারছেন আমি রাশেদ। ঐ রাতে আপনাদের গাড়ি নিয়ে প্রথম কলাবাগান গেলাম। সেখান থেকে গেলাম এক চায়ের দোকানে। সেখানে বসেই এই চিঠি লিখছি। চিঠি লেখা শেষ হলে সামছুর হাতে দিয়ে রওনা হব কমলাপুর রেল স্টেশনের দিকে। যাব নেত্রকোনা। রেল স্টেশনের নাম আঠারোবাড়ি। রেল স্টেশন থেকে মাইল দশেক দূরে আমাদের বাড়ি। বাড়ির নাম উকিল বাড়ি। উকিল বাড়ি নাম কেন হয়েছে আমি জানি না। আমাদের গুঠিতে কোনো উকিল নেই। একজন পীর ছিলেন। আমার দাদার বাবা। নাম বলতে পারব না। বাড়ির নাম পীর বাড়ি হলে যুক্তিযুক্ত হত। পীরের প্রসঙ্গ আনলাম কারণ আপনি পীর ফকির খুঁজে বেড়ান।
যে জন্যে এই চিঠি লেখা সেটা ব্যাখ্যা করি। চায়ের দোকানের মালিক সামছুর ছেলের নাম কেনতু, সে অপূর্ব গানের গলা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। আমি গান বুঝি না। আধো ঘুম আধো জাগরণে তার গান শুনে মনে হয়েছে, প্রকৃতি হাত ভরে তাকে সুর দান করেছে।
আপনার নিশ্চয়ই অনেক জানা-শোনা। আপনি কি কোনোভাবে এই ছেলেটিকে সাহায্য করতে পারেন? প্রকৃত প্রতিভা কখনো পাথরচাপা থাকে না। তবে পাথর সরাতে বাইরের কিছু সাহায্য লাগে।
অতি অল্প সময়ে আপনার যতটুকু পরিচয় পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে আপনি এই কাজ আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে করবেন।
বিনীত
রাশেদ রহমান।
রূপা বলল, চিঠিতে কি লেখা বাবা? কত টাকা চাঁদা চেয়েছে? না-কি পাত্রী চেয়ে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে তার উত্তরে কেউ লিখেছে।
হারুন বললেন, পড়ে দেখ।
যে চিঠি নিয়ে এসেছে সে এখনো পঁাড়িয়ে। হারুন বললেন, তোমার ছেলেকে নিয়ে আস আধা ঘণ্টা সময়। আধা ঘণ্টা পরে এলে ট্রেন মিস করবে।
রূপা চিঠি শেষ করে হাসল। হারুন বললেন, এমন বিশ্রীভাবে হাসছিস কেন? মনে হচ্ছে পেত্নী হাসছে।
চিঠি পড়ে তুমি কি পরিমাণ আনন্দ পেয়েছ এটা বুঝতে পেরে হাসছি। তোমার পরবর্তী কাজকর্ম কি হবে সেটা বুঝতে পেরেও মজা লাগছে।
আমার পরবর্তী কর্মকাণ্ড কি?
মাইক্রোবাসের দুটা চাকা নষ্ট হয়ে গেছে। চাকা দুটা প্রথম ঠিক করাবে তারপর সুলতান চাচাকে নিয়ে রওনা হবে। আঠারোবাড়ি যাবে সেখান থেকে শুরু উকিল বাড়ি অনুসন্ধান অভিযান।
অর্ধেক ঠিক হয়েছে। বাকি অর্ধেক হয় নি।
কোন অর্ধেক ঠিক হয়েছে?
আমি রাশেদকে খুঁজে বের করব এটা ঠিক। তবে গাধা সুলতানকে সঙ্গে নেব না। সুলতান নামে কাউকে এখন আমি চিনি না।
চাচাকে নিতে না চাইলে নেবে না। কিন্তু উনাকে গাধা সুলতান বলবে না। যাদের আমি পছন্দ করি তাদের সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনতে আমার ভাল লাগে না।
আচ্ছা আর বলব না।
রূপা বলল, আমি টেলিফোনে লাইন করে দিচ্ছি তুমি সুলতান চাচার সঙ্গে কথা বল।
কোন বিষয়ে কথা বলব?
কেনতু ছেলেটির গান শুনার জন্যে আসতে বল। তুমি তো গানের কিছু বুঝ না। উনি গানের সমজদার মানুষ।
তোর কথা সামান্য হলেও যুক্তি আছে। দে লাইন করে দে।
রূপা বাবার হাতে টেলিফোন দিয়ে উঠে গেল। মঙ্গলগ্রহে জোছনা ছবিটা আজ আঁকবে। ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবে না। রঙ দেয়ার পর পর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাবে। বৃষ্টি বাদলার দিনে আপনাআপনি কাগজ শুকাতে অনেক সময় লাগে।
হারুন বললেন, সুলতান কেমন আছ?
ভাল।
একবার ভাল বলেছ কেন? তোমার তো দুবার ভাল বলার কথা। তুমি বলবে, ভাল ভাল।
সুলতান বললেন, ভাল ভাল।
হারুন বললেন, বাসায় চলে এসো, কাজ আছে।
কখন আসব? কখন আসব?
আধা ঘণ্টার মধ্যে আসবে। এক মিনিট দেরি হলে ট্রেন মিস করবে। কাপড়-চোপড় নিয়ে এসো ঢাকার বাইরে যেতে হতে পারে।
সুলতান বললেন, পাত্রী চেয়ে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে তার জবাব এসেছে? জবাব এসেছে?
গোটা বিশেক চিঠি পেয়েছি। এখনো খুলে দেখিনি। বাড়িতে চলে এসো। দেখবে।
আচ্ছা। আচ্ছা। অবশ্যই দেখবো। অবশ্যই দেখবো।
রূপা মঙ্গলগ্রহে জোছনার ছবি আঁকছে। এই ছবি আঁকায় কোনো বন্ধন নেই। মাটির রঙ লাল করা যাবে। নীল করা যাবে। জোছনার খেলাও বন্ধনমুক্ত। রূপা যা ইচ্ছা করতে পারে।
মদিনা সামনেই বসা। ছবি আঁকা দেখছে। তার চোখে আগ্রহ নেই, অনাগ্রহও নেই। এক ধরনের নির্লিপ্ততা যা সচরাচর দেখা যায় না। মানুষের পক্ষে নির্লিপ্ত হওয়া কঠিন ব্যাপার। রূপা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ?
মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।
মন খারাপ?
মদিনা আবারও না সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, আমি তোমার বাবাকে একটা চিঠি লিখব। আমাকে ঠিকানা দিও।
মদিনা বলল, আমার বাবা লেখাপড়া জানেন না। মা জানে। চিঠি মারে লেখেন।
তার নাম কি?
সখিনা বিবি।
রূপী বলল, তোমার সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না। তোমরা কয় ভাইবোন?
চাইর ভইন। ভাই নাই। আমি সবচে ছোট। দুই ভইনের বিয়া হইছে। এক দুলাভাই রিকশা চালায় আরেক দুলাভাই ভ্যান চালায়।
তুমি যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বল এই বিষয়ে তারা জানে?
জী জানে।
কিছু বলে তোমাকে?
না তারা থাকে পেটের ধান্দায়। পেট ছাড়া তারার অন্য চিন্তা নাই।
আমি যে ছবিটা আঁকছি সেটা কি ভাল হচ্ছে?
জী। জায়গাটা কোনখানে আফা?
মঙ্গল গ্রহ। সেখানে জোছনা ফুটেছে, তার ছবি।
এই রকম জায়গা সত্যই আছে?
রূপা বলল, পৃথিবীতেই এরচে সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড কত বিশাল! কি অদ্ভুত সব জিনিসই না সেখানে আছে।
রূপাকে হঠাৎ চমকে দিয়ে মদিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল। নীচু গলায় বলল, আফা! এই বাড়িতে যে একটা ভূত ছিল সেটা তো আপনে জানতেন।
রূপা বলল, ভূতের আলাপ থাকুক। আগেই বলেছি ভূতের আলাপ আমার পছন্দ না।
মদিনা এক দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
সন্ধ্যা নাগাদ ছবি আঁকা শেষ হল। রূপা নিজেই মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ্!
মদিনা বলল, ছবিটা খুবই সুন্দর হইছে আফা। আমার জায়গাটায় যাইতে ইচ্ছা করে। ঐ দেশে দুইটা চান?
রূপা বলল, হ্যাঁ। একটার নাম ডিমোস আরেকটার নাম ফিবোস। এখন আমার জন্যে কাগজ আর কলম আন। আমি তোমার মাকে চিঠি লিখব। তোমার মার নাম সখিনা বিবি। ঠিক বলেছি না?
জী।
সখিনা বিবিকে লেখা রূপার চিঠি।
সখিনা বিবি।
আপনি কেমন আছেন? আমার নাম রূপা। আপনার মেয়ে মদিনা, আমার সঙ্গেই থাকে। নানান ভাবে আমাকে সাহায্য করে। সে খুব ভাল মেয়ে।
এখন আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। মদিনার খারাপ একটা অসুখ ধরা পড়েছে। ব্রেইন টিউমার। ডাক্তাররা বলেছেন দ্রুত অপারেশন করে টিউমার দূর করতে। এতেই যে রোগ সারবে তা-না। দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি রেডিও থেরাপি নামক চিকিৎসা চালাতে হবে। এতে প্রচুর টাকা-পয়সা লাগবে। আমাদের এত টাকা-পয়সা নেই। তারপরেও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আপনার মেয়ে অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে রাজি না। আমি তাকে আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি। আপনি এবং আপনার স্বামী তাকে রাজি করাবেন। সে আপনাদের সঙ্গেই থাকবে। অপারেশনের ব্যবস্থা করাতে পারলেই আমি তাকে নিয়ে আসব। আপনারা ভাল থাকবেন।
রূপা।
প্রতি সপ্তাহের সোমবারে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে শায়লা রূপাকে টেলিফোন করেন এবং দীর্ঘ সময় কথা বলেন। রূপা যতই বলে, আমার কাজ আছে বা ঘুম পাচ্ছে তাতে লাভ হয় না। শায়লা কথা বলতেই থাকেন।
দীর্ঘ কথোপকথনের জন্যে শায়লা এই দিন বেছে নিয়েছেন তার কারণ এই দিনে রাত আটটা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তার স্বামী তার এক বন্ধুর বাড়িতে হাইড্রোজেন নামের জুয়া খেলতে যান। ভদ্রলোকের জুয়ার ভাগ্য সর্বনিম্ন পর্যায়ের। তিনি প্রতিবারই হারেন। মধ্যরাত পার করে বাড়ি ফেরেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এমন থাকে যে গাড়ির ড্রাইভার এবং বাড়ির মালী দুজন মিলে ধরাধরি করে তাকে লিফটে তুলে। তিনি যেন লিফটে বমি না করেন তার জন্যে মুখের কাছে পলিথিনের একটা ব্যাগ ধরে রাখা হয়।
রাত নটা দশ। শায়লা তার মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা টেলিফোন ধরল।
কেমন আছিস রূপা?
ভাল।
তোর বাবা যে পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তার ফলাফল কি?
প্রচুর জবাব এসেছে। যাচাই বাছাই হচ্ছে।
যাচাই বাছাই কে করছে?
আমি করছি। সুলতান চাচা করছেন। দুই সদস্যের একটা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। মা তুমি কি এই কমিটিতে থাকতে চাও?
আমি থাকব কোন দুঃখে?
বাবার ভাল-মন্দতো তুমি সবচে ভাল জান। তোমার পক্ষেই সম্ভব সেই মেয়ে খুঁজে বের করা যে বাবার জন্যে পারফেক্ট।
শায়লা বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি যেসব কথায় আমি হার্ট হই, অপমানিত বোধ করি, তুই আমাকে সেইসব কথাই বলিস। এই জন্যেই তোর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।
রূপা বলল, তাহলে মা টেলিফোন রাখি। আমার নিজেরও কাজ আছে। সুলতান চাচা আজ আমাদের বাড়িতে থাকবেন। তিনি রাই সরিষা বাটা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চাচ্ছেন। আমাকেই না-কি রাঁধতে হবে।
শায়লা বললেন, জরুরি একটা কথা বলার জন্যে তোকে টেলিফোন করেছি। কথা শেষ হোক তারপর রাই সরিষা দিয়ে মুরগি রাধবি।
বল।
তোর বাবা যে আমাদের ম্যারেজ ডের ক্যান্ডেল লাইট ডিনার নষ্ট করেছে সেটা তো তোকে বলেছি।
হ্যাঁ বলেছ।
আমার জন্যে হয়েছে শাপে বর! কীভাবে জানতে চাস?
জানতে চাই না, তারপরেও তুমি জানাতে চাইলে বল। আমি শুনছি। অল্প কথায় শেষ করবে মা। মলিনার মত উপন্যাস পাঠ শুরু করবে না।
আজ সকালে টগরের বাবা বলল, শায়লা ঐ দিনের ডিনার নষ্ট হয়েছেচল সেটা কমপেনসেটের ব্যবস্থা করি। কাঠমাণ্ডু থেকে ঘুরে আসি। কাঠমাণ্ডুতে একরাত থাকব, সেখান থেকে চলে যাব পোখরায়। কাঠমাণ্ডু থেকে পোখরায় প্লেনে করে যাব। পোখরায় যে হোটেলে থাকব সেটা সেভেন স্টার। ওদের নিজস্ব হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে। টগরের বাবার ইচ্ছা হেলিকপ্টার রাইড নেয়া। আমি বলে দিয়েছি অসম্ভব। আমার হাইট ফোবিয়া আছে। হেলিকপ্টার রাইড তুমি নাও। আমি হোটেলে বসে থাকব।
রূপা বলল, বাবাকে ছেড়ে উনাকে বিয়ে করে তুমি খুব ভাল করেছ মা। বাবা সঙ্গে থাকলে তার ভাঙা মাইক্রোবাসে করে, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ এইসব জায়গায় পীর ফকিরের সন্ধানে যেতে হত। তোমার সঙ্গী হতেন সুলতান চাচা। তিনি প্রতিটি কথা দুবার তিনবার করে বলে তোমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতেন। তোমার জন্যে শুভেচ্ছা। সেভেন স্টার হোটেলে সুন্দরভাবে তোমার ম্যারেজ ডে পালিত হোক। মা এখন কি টেলিফোন রাখতে পারি। নাকি আরো কিছু বলবে? টগরের বাবা সম্পর্কে আরো ভাল কিছু কথা।
তুই আমাকে টিজ করে কথা বলছিস কেন?
রূপা শান্ত গলায় বলল, কেন টিজ করছি জানতে চাও? জানলে কিন্তু ধাক্কামত খাবে। আর রাতে ঘুমাতে পারবে না। সারারাত জেগে কাটাবে। প্রেসারের অষুধ খাবে। প্রেসার কমবে না।
বল কি বলবি। দেখি আমার প্রেসার কতটা বাড়ে।
রূপা বলল, তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী–একটি তরুণী মেয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেই ফ্ল্যাটে তিনি প্রায়ই সময় কাটান। মনে হয় তাকে বিয়ে করেছেন। মেয়েটার নাম আমি বলতে পারব না। তবে মেয়েটা এভারেজ বাঙালি মেয়ের চেয়ে লম্বা। গায়ের রঙ কালো। শব্দ করে হাসে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শায়লা বললেন, মেয়েটার নাম কি বেণু?
আগেই তো বলেছি নাম বলতে পারব না।
তোকে কে বলেছে?
আমাকে কেউ বলেনি মা। কেউ কিছু বলেনি।
তাহলে জানলি কি করে?
রূপা বলল, ঐ প্রসঙ্গ থাক। সরিষা বাটা দিয়ে মুরগি রাধার রেসিপিটা দাও। শুধু সরিষা বাটা দিলেই হবে? তেল দিতে হবে না? আমার তো ধারণা তেল না দিলেও চলবে। সরিষা বাটা থেকেই তেল উঠবে।
শায়লা জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন।
হারুন সুলতানকে নিয়ে খেতে বসেছে। রূপা খাচ্ছে না। তার না-কি শরীর খারাপ লাগছে। সে আগ্রহ নিয়ে সুলতানের খাওয়া দেখছে। সুলতান বললেন, মা তোমার সরিষা বাটা মুরগি অসাধারণ হয়েছে। তোমাকে আমি শ্রেষ্ঠ বঙ্গ রাধুনী স্বর্ণপদক দিলাম। পদকটা আমিই দেব। আধাভরি সোনার মেডেল। তোমার আগামী জন্মদিনে পদক গলায় পরিয়ে দেয়া হবে। ইনশাল্লাহ।
রূপা বলল, আমি মুগ্ধ, আমি আনন্দিত। পদক দিচ্ছেন সেই কারণে না চাচা। আপনি দীর্ঘ বাক্য বলেছেন এবং রিপিট করেন নি এই কারণে। আপনারা আঠারোবাড়ি যাচ্ছেন কবে?
হারুন বললেন, আগামীকালই যাবার কথা ছিল। কেনতু ছেলেটির একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারছি না। চ্যানেল আই-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা কেনতুর গান শুনতে রাজি হয়েছে। সেখানেও সমস্যা।
রূপা বলল, সমস্যা কি?
হারুন বললেন, ঐ ছেলে তো কারো সামনে গান গায় না। আমি প্রায় পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি। বদ ছেলের মুখ বন্ধ। রাশেদ চিঠিতে লিখেছে ছেলে অসাধারণ গান গায়। রাশেদের কথা অবশ্যই সত্য। কিন্তু গানটা শুনাতে তো হবে।
রূপী বলল, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তুই কীভাবে ব্যবস্থা করবি?
রূপা বলল, আমার কাছে একটা ভয়েস রেকর্ডার আছে। দেখতে কলমের মত। সেখানে দশ মিনিট ডিজিটালি ভয়েস রেকর্ড হয়। ভয়েস রেকর্ডারটা তুমি কেনতুর বাবাকে দেবে। কীভাবে চালাতে হয় শিখিয়ে দেবে। কেনতুর বাবা গোপনে ছেলের গান রেকর্ড করবেন। তোমরা রেকর্ড করা গান চ্যানেল আই-এর লোকদের শুনাবে।
ভয়েস রেকর্ডার কোথায় পেলি?
রূপা বলল, রাশেদ সাহেব আমাকে দিয়েছিলেন। প্রকৃতির একটা খেলা কি বাবা তুমি লক্ষ্য করেছ? কেনতু নামের ছেলেটির গান রেকর্ড করার জন্যে প্রকৃতি ব্যবস্থা করে রেখেছে। একটা ভয়েস রেকর্ডার আমার কাছে আছে। রাশেদ সাহেবের সঙ্গে কেনতুর পরিচয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা সবাই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছি। Nature is playing a garme, we all are players.
হারুন বললেন, চুপ কর। জ্ঞান ঝরে ঝরে পড়ছে! গাধা টাইপ কথাবার্তা।
সুলতান বললেন, ওর ভয়েস রেকর্ডারের আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে। আমার পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হয়েছে।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে রূপী। ঘন গাছপালার কারণে বৃষ্টির ফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আচ্ছা এমন যদি হত ছবির সঙ্গে শব্দ যোগ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে কেমন অদ্ভুত ব্যাপারই না হত। ধরা যাক সে একটা ছবি এঁকেছে–ঢাকা শহরে বৃষ্টি। সেখান থেকে এক রকম শব্দ আসছে আবার বনের বৃষ্টির ছবি থেকে আরেক রকম শব্দ।
মদিনা বলল, আফা ঘুমাইতে যাবেন না?
যাব। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখে তারপর ঘুমাতে যাব। আমার মার কাছে চিঠিটা কি লিখেছেন?
হুঁ।
চিঠি পাঠাইবেন না?
না। তুমি যখন যাবে হাতে হাতে নিয়ে যাবে।
আমি কবে যাব?
বাবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। খুব তাড়াতাড়ি পাঠাব। তুমি শুয়ে পড়।
মদিনা ঘুমুতে গেল না। রূপার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। রূপা বলল, কিছু বলবে মদিনা।
একটা কথা বলব আফা? ভূতটার কথা।
ভূতের আলাপ তো শেষ। আবার কেন?
আফা ভূতটারে কি আপনেও দেখতেন? আপনার পায়ে ধরি আফা বলেন।
রূপা বলল, ঘুমাতে যাও। কথায় কথায় পায়ে ধরার কিছু নেই।
মদিনা ঘুমুতে গেছে। রূপা দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। সে হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। স্ট্রিট লাইটের সামান্য আলো আসছে। ঘর অন্ধকার করায় বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।
রূপা নিজের মনে বলছে–
কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এলো সে কোথা–
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা!
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা!
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে!
না জানি কোন্ নদীর ধারে, না জানি কোন্ দেশে,
কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান–
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটা রূপার মুখস্ত। মার কাছ থেকে শুনে শুনে রূপার পুরো কবিতা মুখস্ত হয়ে গেছে। তবে শায়লা কবিতাটা সামান্য বদলে আবৃত্তি করতেন। কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গানের জায়গায় বলতেন, কোন মেয়েরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান।
সব সন্তানই বাবা-মার কাছ থেকে অনেক কিছু ধার করে। রূপা ঠিক করে রেখেছে সে তার মার কাছ থেকে কবিতা বলে ঘুম পাড়ানোর অংশটা ধার করবে। তার বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে সবদিন কবিতা আবৃত্তি করবে না। যেদিন ঝড়বৃষ্টি হবে সেদিন।
আফা!
এখনো ঘুমাও নি।
মন খুব অস্থির আফা।
রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মন অস্থির হবার মতো কিছু ঘটে নি। ঠিক আছে তোমার মন শান্ত করার ব্যবস্থা করছি। তুমি যে ভূতটাকে দেখতে আমিও দেখতাম। সুলতান চাচাকে একদিন বলেছিলাম। সুলতান চাচা বলেছিলেন, আরেকবার এই ধরনের কথা বললে থাপ্পড় খাবি। এরপর থেকে কাউকে বলিনি। ধরে নিয়েছিলাম, আমার নিজের কোনো সমস্যা।
আফা আপনারাও কি আমার মতো কোনো অসুখ?
হতে পারে।
মদিনা ফিসফিস করে বলল, রাশেদ ভাইজানের সঙ্গে আপনার যে বিবাহ হবে আপনি কি জানেন আফা?
জানি।
কবে জেনেছেন?
যেদিন তাকে প্রথম দেখি সেদিনই জেনেছি।
ত্যাগেই সব জানা কি ভাল আফা?
না ভাল না। হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়।
উনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এটা কি বুঝেছিলেন?
হ্যাঁ। বুঝেও না বুঝার ভান করেছি। আমি স্বাভাবিক মেয়ে হতে চেয়েছি। মদিনা! মেঝেতে শোবার দরকার নেই। এসো খাটে এসে শোও। তুমি বিশেষ এক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ। আমিও এসেছি। এই ক্ষমতার উৎস যদি ব্রেইনের টিউমার হয় তাহলে এই জিনিস আমারও আছে। এসো খাটে আস।
মদিনা বিনাবাক্য ব্যয়ে খাটে উঠে এল। ক্ষীণ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপনার খুব তাড়াতাড়ি রাশেদ ভাইজানের কাছে যাওয়া দরকার।
রূপা বলল, আমি জানি। আর কোনো কথা না। ঘুমাতে চেষ্টা কর। ঘুম এলে বৃষ্টির শব্দ শোন।
মদিনা জেগে আছে, বৃষ্টির শব্দ শুনছে। সে ঠিক করে রেখেছে রূপা আপা ঘুমুতে এলে সে একটা হাত আপার গায়ে রাখবে। আপা নিশ্চয়ই কিছু বলবে না।
তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে
তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে। একতলা পাকা দালান। বাড়ির পেছনে পুকুর। চারদিকে জঙ্গল। একসময় পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। এখন ভেঙে পড়েছে।
মূল বাড়িও ভেঙেছে। কোথাও কোথাও দেয়াল ধসে পড়েছে। ছাদের অবস্থা ভয়াবহ। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।
একটা ঘর মোটামুটি ঠিক আছে। তবে দরজা নেই। রাশেদ চৌকি কিনে সেখানেই বিছানা পেতেছে। বিছানা বলতে শীতল পাটি, একটা বালিশ। সে হারিকেন কিনেছে দুটা। একটা দিন-রাত সারাক্ষণই তার চৌকির নিচে জ্বালিয়ে রাখে। যেন ঘরে সাপ আসতে না পারে। রাশেদের ধারণা বাড়িভর্তি সাপ। ইটের ভাঙ্গাবাড়ি সাপদের বাসস্থানের জন্যে আদর্শ। তবে সে যেহেতু সাপদের বিরক্ত করছে না। সাপরাও সম্ভবত তাকে বিরক্ত করবে না।
বাড়ির দারা ঠিক আছে। ইদারা তেমন ভাঙে নি। ইদারার পানিও ভাল। ইদারার বাঁধানো অংশে বসে থাকতে রাশেদের ভাল লাগে। তার বাবা যখন বাড়ি থাকতেন বেশির ভাগ সময় এই জায়গায় বসে থাকতেন। মন ভাল থাকলে রাশেদের সঙ্গে গল্প করতেন, ও বাবা রাশেদ! আমার দাদা অর্থাৎ তোমার বড় বাবা জ্বীন সাধক ছিলেন এটা জান?
না।
তাঁর পালা একটা জ্বীনের মৃত্যু হয়েছিল। দাদাজান মানুষের মতো তারে কবর দেন।
কোথায়?
বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল আছে, সেইখানে পাকা কবর আছে। কবরের গায়ে আরবিতে লেখা তালিব। মনে হয় এইটাই জ্বীনের নাম। কবর দেখতে চাইলে একদিন নিয়া যাব। অজু করে যেতে হয়। যেতে চাও?
চাই।
আচ্ছা একদিন নিয়া যাক। এই জ্বীন দাদাজানরে টাকা-পয়সা আইন্যা দেয়। তিনি পাকা ঘর তুলেন। শুনেছি ঘর তুলতেও জ্বীন সাহায্য করেছে।
এইসব কি সত্য বাবা?
জানি না।
রাশেদ এসেছে শুনে তার দূর সম্পর্কের চাচা হাকিম উদ্দিন দ্বিতীয় রাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দেখা করতে এসেছেন। ধমক দিয়ে বলেছেন, ভাইস্তা ব্যাটা তোমার কি মাথা খারাপ হইছে? চল আমার সাথে আমার বাড়িত থাকবা। এইখানে থাকলে সাপে কাটব। বাড়িভর্তি সাপ। গত বিষুদবারে এই বাড়ির উঠানে সাপে কাটছে।
রাশেদ বলল, ব্যবস্থা নিয়েছি চাচা। কার্বলিক এসিড দিয়েছি। দুটা হারিকেন সারারাত জ্বলে। মশারি কিনেছি, রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। এই বাড়িতে থাকা আমার জন্যে বিশেষ প্রয়োজন।
প্রয়োজনটা কি?
আমি একটা মিরাকলের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বাড়িতে থাকলেই মিরাকলটা ঘটবে। অন্য কোধাও থাকলে ঘটাবে না।
মিরাকল জিনিসটা কি?
অসম্ভব কোনো ঘটনা। যা হবার কথা না তা হওয়া।
ভাত খাইবা কই?
সেটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ব্যবস্থা কে করব? আসমান থাইকা টিফিন কেরিয়ার হাতে নিয়া ফিরিশতা নামব?
যদি নামে সেটাও হবে একটা মিরাকল।
হাকিম উদ্দিন বললেন, যেতে না চাও জোর করে নিব না। তিন বেলা খাওয়া আমি পাঠাব। তোমার নেংটা কালে তোমাকে দেখেছি, এখন এত বড় হইছ। শুনছি বড় ডাক্তারও না-কি হইছ। আমার শূলবেদনা আছে। ডাক্তার কবিরাজ অনেক করাইছি, ফায়দা হয় নাই। শূলবেদনার একটা চিকিৎসা দিয়া যাবা।
রাশেদ হাসতে হাসতে বলল, আমি নকল ডাক্তার চাচা। রোগ-ব্যাধির ডাক্তার না। লেখাপড়ার ডাক্তার।
ও আচ্ছা। তোমার কি কি জিনিস লাগবে বল। বাড়িতে গিয়া পাঠাব। ফুটফরমাশ খাটার জন্য একজন আসবে তার নাম ইয়াসিন। চোখে চোখে রাখবা, বিরাট চোর।
চাচা আমার কিছু লাগবে না। শুধু যদি বইপত্র কিছু থাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি পড়ার কিছু নিয়ে আসি নি। রাতে কিছুক্ষণ বই না পড়লে আমার ঘুম আসে না।
বইপত্র কই পাব? বাড়িতে লেখাপড়ার কোনো কারবারই নাই। বিষাদসিন্ধু থাকতে পারে। বিষাদসিন্ধু পড়বা?
হ্যাঁ পড়ব। সাদা কাগজ পাঠাতে পারবেন?
এইটা পারব। কাগজ কলম সবই আছে। যে বাড়িতে লেখাপড়া নাই, সেই বাড়িতে কাগজ কলম থাকে। যাই হোক, শখ কইরা থাকতে আসছ। পূর্ব পুরুষের বাস্তুভিটা। থাক এক রাইত। তারপর আমার এইখানে চইল্যা আসবা। আমি ঘর ঠিক কইরা রাখব। পল্লী বিদ্যুতের লাইন নিয়েছি। মাঝে মধ্যে পাখা চলে। যে গরম পড়েছে। পাখা ছাড়া গতি নাই।
রাশেদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ঘুমুতে যাবার আগে বিষাদসিন্ধু পড়ছে। তার চাচা বিষাদসিন্ধু ছাড়াও মহুয়া সুন্দরীর কাহিনী এবং চল্লিশ আউলিয়ার কেরামত নামের দুটি বই পাঠিয়েছেন। কাগজ কলম পাঠিয়েছেন। রাশেদ বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চিঠি লিখছে। চিঠি লেখা হচ্ছে রূপা ব্যানার্জিকে। এক নাগারে লিখছে না। থেমে থেমে লিখছে। কারণ পাশাপাশি সে ঢাকার রূপাকেও চিঠি লিখছে। রাশেদের খুব ইচ্ছা দুটা চিঠিই যেন একই রকম হয়। সামান্য উনিশ বিশ হতে পারে। বেশি না।
রূপা (ব্যানার্জি)
কেমন আছ?
আমি পালিয়ে আছি।
এমন জায়গায় পালিয়েছি যে তুমি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।
তুমি আমার জীবনে শনি গ্রহের মত উপস্থিত হয়েছ।
তুমি ভয়ংকরভাবে আমার প্রেমে পড়েছ এটা আমি জানি। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না।
তুমি কি জান আমার প্রতিটি দুঃস্বপ্নে তুমি থাক।
রূপা (ঢাকা)
কেমন আছেন?
আমি পালিয়ে আছি।
এমন জায়গায় পালিয়েছি যে একটু চেষ্টা করলেই আপনি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবেন।
আপনি আমার জীবনে ধ্রুবতারার মত এসেছেন।
আমি ভয়ংকভাবে আপনার প্রেমে পড়েছি এটা আপনি জানেন না। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না।
আপনি কি জানেন আপনাকে প্রায়ই আমি স্বপ্নে দেখি।
এই ধরনের চিঠি হুড়হুড় করে লেখা যায় না। সময় লাগে। রাশেদ সময় দিচ্ছে। দুটা চিঠির কোনটাই সে পাঠাবে না। তারপরেও আগ্রহ করে সে কেন চিঠি লিখছে তাও জানে না।
ইয়াসিন তার জন্যে তিনবেলা খাবার নিয়ে আসছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল প্রতিবেলাতেই পোলাও থাকছে। সকালের নাশতাতেও পোলাও। যদিও রাশেদের চাচা বলে দিয়েছেন ইয়াসিন বিরাট চোর। তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি তবে সে অতি কর্মঠ একজন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একদিনে ঝোপঝাড় কেটে বাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলেছে। সে একা কাজ করছে না, একজন এসিসটেন্টও জুটিয়েছে।
রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছানো হয়েছে। এখন আর কাদা ভেঙে বাড়িতে ঢুকতে হবে না। পুকুরের ঘাট মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। কচুরিপানা তুলে ফেলায় পুকুরের টলটলে পানি বের হয়েছে।
রাশেদ বলল, ইয়াসিন তোমার মত কর্মী মানুষ আমি আমেরিকায় দেখেছি। বাংলাদেশে দেখিনি। তোমার কাজ করার ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ।
ইয়াসিন বলল, কিছু টেকা-পয়সা খরচ করা কি সম্ভব স্যার? দুই একটা জিনিস খরিদ করতাম।
কি খরিদ করবে?
আপনে বুকের নিচে বালিশ দিয়া লেখেন। আপনার জন্যে একটা চেয়ার, টেবিল। ছাদে পলিথিনের চাদর দিব যেন বৃষ্টির পানি চুয়াইয়া না পড়ে। কয়েকটা টিন দরকার, বেড়া দিব। একটা কেরোসিনের চুলা কিনব। চায়ের সরঞ্জাম কিনব। মাঝে-মধ্যে চা খাইবেন।
তোমার কত টাকা লাগবে বল।
হাজার দুই টেকা হইলে চলব।
তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি। যা লাগে খরচ করবে বাকিটা তোমার। একজন কর্মী মানুষকে আমার উপহার।
ইয়াসিন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, হেকিম চাচার সাথে আমি দেড় বছর আছি। মাসে পনেরশ টাকা বেতন দেওয়ার কথা। এখনও এক পয়সা পাই নাই। আপনে এক দিনের পরিচয়ে এতগুলো টেকা দিলেন। স্যার বলেন আপনার জন্য কি করব?
কিছুই করতে হবেনা ইয়াসিন। তুমি খুশি হয়েছ। এতেই আমি খুশি।
স্যার আপনার জন্য কিছু একটা আমার করাই লাগবে।
রাশেদ বলল, বাড়ির পেছনের জঙ্গলায় জ্বীনের কবর বলে একটা কবর আছে। শুনেছ এ রকম কথা।
স্যার শুনেছি। কবরটা দেখৈছি। গ্রামের কিছু মেয়েছেলেরা মানত করে। কবরে মোমবাতি দেই।
এই কবরটা ভাঙতে পারবে? দেখতাম ভেতরে কি আছে।
স্যার এইটা পারব না।
রাশেদ বলল, আমার ধারণী কবরে ধন-রত্ন লুকানো। বাবার দাদাজান হঠাৎ যে কোনো উপায়ে প্রচুর ধন-রত্ন পান। তায় লুকিয়ে রাখেন জ্বীনের কবরে। যাতে ভয়ে কেউ সে দিকে না যায়।
কবর খুঁড়তে পারব না স্যার। যদি বলেন, আপনার জন্য মানুষ খুন করব। স্যার। আপনার আহর দোহাই লাগে। কবরের ধারে কাছে যাবেন না।
আচ্ছা যাব না। ঢাকা থেকে হারুন সাহেবকে নিয়ে আসব। তাকে দিয়েই ভাব। উনি রহস্য পছন্দ করেন।
ইয়াসিন ঠিক করল, বাকি জীবন সে এই মানুষটার সেবা করে কাটাবে। মানুষটা চলে গেলে সে এই বাড়িতেই থাকবে। বাড়ি দেখাশোনা করবে। জ্বিনের কবরে বাতি দিবে। ইয়াসিনের নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। একজন ভাল মানুষের সঙ্গে থাকা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।
রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলেই
রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলেই সকালের রোদটা কোমল লাগছে। যেন রোদটা স্নান করেছে, রোদের নিজেরই শীত শীত লাগছে। চায়ের কাপ হাতে রূপা ছাদে হাঁটছে। অনেকদিন গাছপালার যত্ন করা হয়নি। গাছগুলিকে দেখাচ্ছে জঙ্গুলে ঝোপের মত। মাধুরীলতা গাছে ফুল ফুটেছে। এই গাছের নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রিয় কন্যা মাধুরীর নামে নাম। ছাদের বাগানে আরেকটা গাছ আছে যার নামও রবীন্দ্রনাথের রাখা–উদয় পদ্ম। এইসব তথ্য রূপা জানে তার মায়ের কাছ থেকে। এই মহিলার গাছপালার শখ ছিল, কবিতার শখ ছিল, গানের শখ ছিল। এখন সব শখ টগরের বাবা নামের মানুষটিতে স্থির হয়েছে।
মলিনা টেলিফোন হাতে ছাদে এসেছে। রূপাকে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
আফা আপনে এইখানে? আমি সারা দুনিয়া খুঁজছি। আম্মা ফোন করছে।
রূপা টেলিফোন হাতে নিল। মলিনা বলল, কাইল রাইত কি খোয়াব দেখছি আফা শুনেন। খোয়বে রাশেদ ভাইজান বললেন, মলি কফি খাব। আমি জাইগা উঠলাম। দৌড় দিয়া রান্নাঘরে ঢুইকা গ্যাসের চুলা জ্বালাইলাম তখন বুঝলাম, খোয়াব দেখছি। কি আচানক বিষয়।
রূপা বলল, আমি টেলিফোনে কথা বলব। তুমি নিচে যাও। নাশতার জোগাড় দেখ।
মলিনা অনিচ্ছায় চলে গেল। রূপা আফা যখন কারো সঙ্গে কথা বলে তখন তার দূর থেকে শুনতে ভাল লাগে। আফার গলার স্বর এমন মিড়া।
মা কেমন আছ?
ভাল। এতক্ষণ লাগে টেলিফোন ধরতে?
মা সরি।
বেনু মেয়েটার খবর তোকে কে দিয়েছে বল।
কেউ দেয়নি মা।
কেউ তোকে বলেনি, তোর কাছে আসমানি ওহি নাজেল হয়েছে?
অনেকটা সে রকম। ঐ বিষয়ে পরে কথা বলব। আমার মন বলছে তুমি খুব খারাপ অবস্থায় আছ। তোমার তো কোথায়ও যাবার জায়গা নেই। তুমি এ বাড়িতে চলে এসো। টগর ৈনিয়ে চলে এসো।
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই মানে কি? আমার তিন ভাই আছে। এক বোন আছে।
তোমার তিন ভাই দেশের বাইরে থাকেন। বোনের সঙ্গে তোমার কোনো যোগাযোগ নেই। ছোট খালা তোমাকে সহ্যই করতে পারেন না। ঐ বাড়িতে কীভাবে থাকবে ছোট খালা রাত্রি গেটই খুলবে না।
তোদের এখানে আমি কোন যুক্তিতে উঠব?
তুমি আমার মা সেই যুক্তিতে উঠবে। সুলতান চাচা যদি আমাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে আসতে পারেন। তুমি পারবে না কেন?
উনি তোদের এখানে থাকেন।
কয়েকদিন ধরে আছেন। বাবা তাকে স্থায়ীভারে থাকতে বলেছেন। তিনি রাজি। তার না-কি আর একা একা থাকতে ভাল লাগে না। মা! তুমি কি কাঁদছ? তোমার কান্নার শব্দ পাচ্ছি।
লায়লা জবাব দিলেন না
রূপা বলল, মা! তোমার লাগানো উদয় সই গাছে ফুল ফুটেছে। মাধুরীলতা গাছে ফুল ফুটেছে। এসে দেখে যাও।
না। টগরকে নিয়ে আমি ফার্মগেটের ওভারব্রিজে কাঁথা বিছিয়ে থাকব, তাদের বাড়িতে না।
টগরকে নিয়ে এভারব্রিজে থাকা ঠিক হবে না মা।
শায়লা কঁদছেন। আগে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। এখন শব্দ করে কাঁদছেন। রূপা বলল, মী গাড়ি পাঠাব? পাঠিয়ে দেই?
শায়লা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললেন, পাঠিয়ে দে।
নাশতার টেবিলে হারুনকে অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হল। তাঁর উত্তেজনার বিশেষ কারণ ঘটেছে। পত্রিকায় খবর এসেছে–নওগাঁর একটা পুকুরের পানি দশ মিনিটে হঠাৎ উধাও! প্রথম একটা বিকট শব্দ হল তারপর দেখা গেল হড়হড় করে পুকুরের পানি নেমে যাচ্ছে।
হারুন বললেন, সরেজমিন তদন্ত করা দরকার।
সুলতান বললেন, অবশ্যই দরকার। অবশ্যই দরকার।
হারুন বললেন, এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগে আমরা নওগাঁয় যাব, না নেত্রকোনা যাব।
সুলতান বললেন, নওগাঁ। পুকুর ঘাটে তাবু খাটিয়ে বাস করতে হবে। পুকুরের পানি যেভাবে নেমে গেছে সেইভাবে উঠেও আসতে পারে।
হারুন বললেন, আমার মনে হয় আগে নেত্রকোনা যাওয়া উচিত। রাশেদ সায়েন্সের ছেলে তাকে নিয়ে নওগাঁ যাব।
সুলতান বললেন, রূপার মতামত নেয়া যাক। সে যা বলে তাই হবে। সে যা বলে তাই হবে।
রূপা বলল, চল আগে নেত্রকোনা যাই। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। মদিনাও যাবে। সেখান থেকে ফিরে সবাই দলবেঁধে পুকুর দেখে আসব আর মদিনাকে তার বাবা মার কাছে রেখে আসব।
হারুন বললেন, মলিনা একা থাকবে কেন? সেও আমাদের সঙ্গে যাক।
রূপা বলল, মলিনা যেতে পারবে না। মা টগরকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে আসছেন। মার দেখাশোনার জন্যে একজনকে দরকার।
হারুন চা খাচ্ছিলেন। তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। রূপা বলল, বাবা! তুমি এখন থেকে সুলতান চাচার সঙ্গে একতলায় থাকবে। আমার বড় ঘরটা আমি মাকে আর টগরকে দিয়ে দিব। তোমার পায়রার খুপড়িটা আমি নিয়ে নেব। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে বাবা?
হারুনের গলা দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ বের হল। এই আওয়াজের কোনো অর্থ নেই।
সুলতান হতভম্ব গলায় বললেন, তোর মা কখন আসবে?
রূপা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, মাকে আনতে অনেকক্ষণ আগে গাড়ি গিয়েছে। মনে হয় যে কোনো সময় চলে আসবেন।
হারুনের গলা দিয়ে আবারও বিচিত্র আওয়াজ বের হল।
রাত অনেক
রাত অনেক। মাইক্রোবাস আঠারোবাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। রূপা বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। তার চোখে ঘুম নেই। পেছনের একটি সিটে বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন হারুন। আরেক সিটে ঘুমাচ্ছেন সুলতান। মদিনা আসে নি! শায়লা এবং টগরের দেখাশোনার জন্য সেও থেকে গেছে। অতি অল্প সময়ে টগরের সঙ্গে তার ভাল ভাব হয়েছে। এর খুব প্রয়োজন ছিল। টগরের বয়স তের। তার আচরণ চার বছরের শিশুর মত। সে একটি বাড়তি ক্রমোজম নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে।
রূপা বলল, ড্রাইভার সাহেব আমরা মনে হয় চলে এসেছি। ঐটা রেল স্টেশন না?
জী আফা।
রেল স্টেশনে নিশ্চয়ই চায়ের দোকান আছে। সেখানে জিজ্ঞেস করবেন উকিল বাড়ি কোথায়।
জী আচ্ছা।
প্রথম আমি এক কাপ চা খাব তারপর উকিল বাড়ি যাব।
রেল স্টেশনের চায়ের দোকান খোলা। উকিল বাড়ির সন্ধান সেখানেই পাওয়া গেল। চায়ের দোকানি একজনকে সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছে যে বাড়ি চিনিয়ে দেবে। দোকানের চা কখনোই ভাল হয় না। এই চা-টা ভাল। চা খাওয়ানোর জন্যে অনেক চেষ্টা করেও রূপা তার সুলতান চাচা বা বাবাকে জাগাতে পারল না। তাদের চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে।
মাইক্রোবাস রাশেদের পৈতৃক বাড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। আর যাবে না। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে।
রূপা বলল, বাবা আর সুলতান চাচা ঘুমাচ্ছেন। তাদের এখন জাগানোর দরকার নেই। আমি একা যাব। রাশেদ সাহেবকে একটা সারপ্রাইজ দেব।
রূপা এগুচ্ছে। আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। ড়ুবে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ড়ুবন্ত চাঁদের আলোয় অনেক রহস্যময়তা। চারপাশে প্রচুর জোনাকি। রূপা অনেক দিন পর এত জোনাকি একসঙ্গে দেখল। বাহ্! কি সুন্দর একটা পুকুর। চঁাদের আলোয় বনের ছায়া পড়েছে পুকুরে। রূপার ইচ্ছা করছে এখনই পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে। একটা কুটুম পাখি ডাকছে। কি সুন্দর পাখিটার গলা।
রূপা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরের দুজা নেই। রাশেদ কি এই ঘরেই থাকে? রূপা প্রথম কথা রাশেদকে কি বলবে ঠিক করছে। সে বলবে, প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে আমরা দুজন বাকি জীবন একসঙ্গে থাকব। আমি এসেছি।
ঘরের ভেতর থেকে রাশেদ ভয়ার্ত গলায় বলল, কে? কে? উঠানে কে?
রূপা বলল, ভয় পেও না। আমি রূপা।
হতভম্ব রাশেদ উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বিস্ময়ে অভিভূত গলায় বলল, এইমাত্র স্বপ্ন দেখেছি একগাদা ধবধবে শাদা ফুল নিয়ে তুমি এসেছ। ঘুম ভেঙে দেখি সত্যি তুমি। ফুল কোথায়?
ফুল আনতে ভুলে গেছি। সরি।
সপ্তমীর চাঁদ ড়ুবে গেছে। চারদিক অন্ধকার। তারপরও অন্য এক আলোয় উকিল বাড়ি আলোকিত। এই আলোর উৎস প্রকৃতি জানে। মানুষ জানে না। প্রকৃতি তার সব রহস্য কখনোই প্রকাশ করে না!