- বইয়ের নামঃ রুমালী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
বকু তুই রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন
বকু তুই রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমি পাশ ফিরে মাকে দেখলাম। মা কোন ফাঁকে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিড়ালের চেয়েও নিঃশব্দে হাঁটতে পারেন। আশে পাশে কেউ নেই, আমি হয়ত নিজের মনে গল্পের বই পড়ছি। এক সময় হঠাৎ দেখব মায়ের মাথাটা আমার ঘাড়ের পাশে। তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বলবেন, কী পড়ছিস? আমি যদি বলি গল্পের বই মা বলবেন, আজে বাজে গল্প নাতো? দেখি বইটা। মা বইটা হাতে নেবেন। বই এর নাম পড়বেন। নামের মধ্যে প্রেম ভালবাসা জাতীয় কিছু থাকলে তার ভুরু কুঁচকে যাবে। আমি যে পাতাটা পড়ছি সেই পাতাটা পড়ে দেখবেন। এই হচ্ছে আমার মা–সাবিহা বেগম। বয়স আটত্রিশ। সেই বয়স তিনি নানান ভাবে কমানোর চেষ্টা করছেন। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। সেই ভাঁজ দূর করার অনেক চেষ্টা চলছে। তিনি কোত্থেকে একটা বই জোগাড় করেছেন। নজিবুর রহমান নামের এক ভদ্রলোকের লেখা—যৌবন ধরে রাখুন। সেই বই-এ মুখের চামড়ার ভাঁজ দূর করার যে সব প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা আছে তার কিছু কিছু প্রয়োগ করছেন। তেমন লাভ হচ্ছে না। আমার ধারণা খানিকটা ক্ষতি হচ্ছে। মার চোখ দুটা ভিতরে ঢুকে চেহারায় খানিকটা ইঁদুর ভাব চলে এসেছে।
এখন বাজছে সকাল নটা এর মধ্যেই মা গোসল করে ফেলেছেন। চোখে কাজল দিয়েছেন। ম্যাচ করে শাড়ি ব্লাউজ পরেছেন। হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগও অছে। সেই ব্যাগের রঙও শাড়ির রঙের সঙ্গে মেলানো সবুজ। মা বললেন, কিরে বন্ধু রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মার গলায় প্রবল উৎকণ্ঠা—যেন রোদে দাঁড়ানোর কারণে আমার শরীরে কিছুক্ষণের মধ্যে ফোসকা পড়ে যাবে। অথচ আমি মোটেই রোদে দাঁড়িয়ে নেই। আমি দাড়িয়ে আছি বিশাল একটা শিমুল গাছের নীচে। শিমুল গাছে কোন পাতা নেই— শুধুই থোকা থোকা ফুল। এমন কড়া লাল রঙ যে–তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মনে হয় গাছে আগুন ধরে গেছে। এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর আগুন জ্বলছে। দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে! গাছে হেলান দিতে পারলে আরো ভাল হত— কিন্তু হেলান দেবার উপায় নেই–গাছ ভর্তি বড় বড় কাটা। আমি মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। এই মিষ্টি হাসি হচ্ছে নকল মিষ্টি! অভিনয়ের মিষ্টি হাসি। আমি যখন তখন এই হাসি হাসতে পারি। মা আবারো বললেন, কিরে কথা বলছি জবাব দিচ্ছিস না কেন?
আমি বললাম, মা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
মা এই প্রশংসাতেও উললেন না। প্রায় ধমকের গলায় বললেন–শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কারণ আছে বলেই দাঁড়িয়ে আছি।
কারণটা কী?
কারণটাতো মা তোমাকে বলা যাবে না।
ফাজলামি করবি না।
আমাকে ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বলেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে মার মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা গেল। মা খুশি : ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বললেতো থাকতেই হবে। এই মুহূর্তে তিনিই সব কিছু আমাদের সম্রাট। সম্রাটের প্রতিটি কথা পালন করতে হবে। তাকে খুশি রাখতে হবে। মার এখন প্রধান কাজ হয়ে দাড়িয়েছে সম্রাটকে খুশি রাখা। তার আশেপাশে থাকা। সম্রাটের সস্তা ধরনের রসিকতায় হা হা হি হি করে হাসা আমাদের এই সম্রাটের ধারণা তিনি খুব রসিক মানুষ। ডিরেক্টর সাহেবের নাম মঈন খান। বয়স ঠিক কত এখনো জানি না— চল্লিশের উপরতো বটেই। রোগা পাতলা মানুষ। ভদ্রলোকের মধ্যে একটা বহুরূপী ব্যাপার আছে। একেক দিন তাকে একেক রকম দেখা যায়। আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঘটে তার চশমার কারণে। ভদ্রলোকের অনেকগুলি চশমা। একেক দিন একেক রকমের চশমা পরেন। চশমার সঙ্গে মিলিয়ে চুল আচড়ানোর মধ্যেও কিছু একটা নিশ্চয়ই করেন। তাঁর চেহারা পাল্টে যায়। চেহারার সঙ্গে সঙ্গে ভাবভঙ্গি পাল্টে যায়। আজ তিনি সোনালী ফ্রেমের চশমা পরেছেন।
মা বললেন, মঈন ভাই তোকে এখানে থাকতে বলেছেন?
হ্যাঁ।
কেন?
কাজ দেখতে বলেছেন।
তাতো বটেই–কাজ না দেখলে কাজ শিখবি কীভাবে?
মা লম্বা লম্বা পা ফেলে ডিরেক্টর সাহেবের দিকে এগুচ্ছেন। আমি শংকিত বোধ করছি। কারণ ডিরেক্টর সাহেব আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন নি। শিমুল গাছটা দেখে আমার এত ভাল লেগেছে যে আমি ইচ্ছা করে এখানে এসে নড়য়েছি। শুটিং এর কাজ হচ্ছে রাস্তার ঐ পাশে। নদশ বছরের একটা মেয়ে এবং চার পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেই সকাল থেকে। মেয়েটার পরণে ফ্রক। ছেলেটা সম্পূর্ণ নগ্ন। শুধু তার কোমরে কালো সুতা বাঁধা। সুতার সঙ্গে তিনটা শাদা কড়ি।
যে দৃশ্যটা এখন নেয়া হবে সেই দৃশ্যটা এরকম—এই দুই ভাই-বোন পানিতে ঝাপাঝাপি করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল শহুরে কিছু মানুষ চারটা গরুর গাড়িতে করে যাচ্ছে। শহুরে মানুষদের গায়ে ঝলমলে পোষাক, তারা আনন্দ করতে করতে যাচ্ছে। এই দেখেই দুই ভাই-বোন পানি থেকে উঠে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াবে। কৌতূহলী চোখে গরুর গাড়ির ভেতরের মানুষগুলিকে দেখতে চেষ্টা করবে। গরুর গাড়ির ভেতরে সাব্বির নামের এক ভদ্রলোক ক্যামেরায় তাদের ছবি তুলতে যাবেন—ওমি মেয়েটা হেসে ফেলবে, আর ছেলেটা দু হাতে তার নেংটো ঢেকে ফেলবে।
খুব সহজ দৃশ্য। অন্য কেউ হলে ফট করে নিয়ে নিত। কিন্তু আমাদের ডিরেক্টর সাহেব এই দৃশ্যটাকে যথেষ্ট জটিল করে ফেলেছেন। রাস্তার পাশে ট্রলী পেতেছেন। দৃশ্যটা নেয়া হবে ট্রলীতে। রিফ্লেক্টর বোর্ড হাতে তিনজন লাইটম্যান দাঁড়িয়ে আছে। এরা একটু পরপর ধমক খাচ্ছে। ট্রলীও বোধ হয় ঠিকমত বসছে না— ক্যামেরা কাঁপছে। কোদাল দিয়ে রাস্তাটা সমান করে ট্রলী বসানো হয়েছে। তারপরেও বোধ হয় রাস্তা সমান হয় নি! ডিরেক্টর সাহেবের কাছ থেকে ক্যামেরাম্যানও ছোট্ট একটা ধমক খেলেন।