পড়তে পড়তে ইয়াজউদ্দিনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। শুভ্ৰ কি পরে ঘর থেকে বের হয়েছে তার এত বিতং করে লিখতে তাকে কে বলেছে?
শুভ্র সাহেব রিকশা নিলেন রাস্তার মোড়ে এসে। রিকশার নম্বর–ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি ৭১১। তিনি রিকশার হুড ফেলে দিলেন। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের কাছে এসে রিকশা ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে–অন্য একটা রিকশা নিলেন। এই রিকশার নম্বর–ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি ২০০৩। এইবার তিনি রিকশার হুড ফেললেন না। তবে রিকশা হাইকোর্টের কাছাকাছি যাবার পরে তিনি রিকশার হুড ফেলে দিলেন।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব ঘড়ি দেখলেন। পুলিশকে টেলিফোন করার সময় হয়ে গেছে।
মিজান সাহেব বেশ স্বাভাবিক আছেন
মিজান সাহেব বেশ স্বাভাবিক আছেন। তিনি নাপিতের দাকান থেকে চুল কাটিয়েছেন। একেবারে কদমছাট। মাথাটা কালো রঙের কদম ফুলের মতই দেখাচ্ছে। চুল কাটার জন্যেই তাঁকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। এ ছাড়া তার মধ্যে আর কোন অস্বাভাবিকতা নেই। কথাবার্তা, চালচলন খুব স্বাভাবিক। হঠাৎ হঠাৎ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দু-একটা কুৎসিত বাক্য বলে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। যেমন, আজ দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় সহজভাবে ভাত খাচ্ছিলেন, হঠাৎ মনোয়ারার দিক তাকিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, মাগী, তুই তরকারিতে লবণ দেস না কেন? আমার কি লবণ কেনার পয়সাও নাই? মানোয়ারা কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলেন, কাঁদলেন না। কাঁদলে আবার কোন বিপত্তি ঘটে। তিনি ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে লবণ নিয়ে এলেন। ততক্ষণে মিজান সাহেব স্বাভাবিক। তিনি কোমল গলায় বললেন, মনু, তুমি একসঙ্গে খেয়ে ফেল না কেন? একসঙ্গে খেয়ে ফেললে ঝামেলা কমে। কাজের লোক একটা রাখতে হবে। কাজের লোক ছাড়া সংসার চালানো সম্ভব না। তুমি একা কাদিক দেখবে?
সৌভাগ্যের সংবাদ বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতে হয়। দুর্ভাগ্যের সংবাদ দিতে হয় না। সবাই জেনে যায়। ঢাকায় মিজান সাহেবের সব আত্মীয়স্বজনই খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা দেখতে আসছেন। পাগল দেখা এবং পাগলের সঙ্গে কথাবার্তা বলার এক আলাদা মজা। মিজান সাহেব সবাইকেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করলেন। কোন রকম পাগলামি দেখালেন না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বললেন, হাসলেন।
জাহেদ সন্ধ্যবেলা মামাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার মিজান সাহেবের অফিসের এক কলিগের ভায়রা ভাই। সেই কলিগই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মস্তিক বিকৃতির জন্যে খুব ভাল ডাক্তার। অর্ধেক ফি-তে তিনি রোগী দেখে দেবেন। অর্ধেক ফি-তে যে সব রোগী দেখা হয় তাদের পেছনে ডাক্তাররা অর্ধেকেরও কম সময় ব্যয় করেন। উপসর্গ শোনার আগেই ব্যবস্থাপত্র লেখা হয়ে যায়। তবে এই ডাক্তার অনেক সময় ব্যয় করলেন। নানান ধরনের প্রশ্নট্রিশ্ন করে বললেন, আমি তো কিছু পাচ্ছি না। আমার মনে হয় আপনারা অকারণে বেশি দুঃশ্চিন্তা করছেন। উনার মূল সমস্যা কি?
।জাহেদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, হঠাৎ রেগে যান। মামীর সঙ্গে কুৎসিত ব্যবহার করেন। গালাগালি করেন।
স্ত্রীর প্রতি মাঝে মাঝে রেগে যাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক? আমবা সবাই কখনো কখনো রাগি।
জাহেদ বলল, কিন্তু উনার মনে থাকে না যে উনি রেগেছেন। তাছাড়া মামা আগে কথা প্রায় বলতেন না, এখন প্রচুর কথা বলেন। সারাক্ষণই কথা বলেন।
উনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন?
জ্বি বলেন। রাত জেগে গল্প করেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার ধারণা, এক ধরনের নাভাস শকের ভেতর দিয়ে উনি গেছেন। স্নায়ুর উপর দিয়ে বড় ধরনের কোন ঝড় বয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে স্নায়ুর তন্ত্রীতে এক ধরনের ধাক্কা লেগেছে। সাময়িক বিকল অবস্থা যাচ্ছে। এটা কিছুই না। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ঘুমুতে হবে। সবচে ভাল হয় যদি স্থান পরিবর্তন করা যায়। আপনি বরং আপনার মামাকে নিয়ে কোথাও যান, ঘুরে-টুরে আসুন।
কথাবার্তা মিজান সাহেবের সামনেই হচ্ছে। তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। ডাক্তার সাহেব থামতেই বললেন, এটা মন্দ বুদ্ধি না। জাহেদ, চল গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। টাটক-টাটকা খেজুরের রস খেয়ে আসি। অনেকদিন খেজুরের রস খাওয়া না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ভাল বুদ্ধি। যান, গ্রাম থেকে ঘুরে আসুন।
জাহেদ তার মামাকে নিয়ে বিমর্ষ মুখে বের হয়ে এল। ডাক্তার সাহেব লম্বা প্রেসক্রিপশন করেছেন। নানান ধরনের ভিটামিন, হজমের অষুধ, ঘুমের অষ্ণুধ। তিনশ টাকা চলে গেল। অষুধে। মিজান সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, অষুধে কোন কাজ হবে না। আমার দরকার গ্রামের খোলা হাওয়া। রাত এগারোটায় বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস আছে। চল বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে চলে যাই। টেনেও অনেকদিন চড়া হয় না। ভালই হল। আজ লজ্জা ভেঙ্গেই যাবে।
মামাকে বাসায় রেখে জাহেদ গেল কেয়ার সঙ্গে দেখা করতে। পুরো দুদিন চলে গেছে কেয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি। গতকাল একবার এসেছিল। লজ্জায় সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে পারেনি।
জালিল সাহেব দরজা খুলে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, আরে দুলামিয়া যে! হা হা হা। আসুন, আসুন। আপনি আসবেন বুঝতে পারছিলাম।
জাহেদ শুকনো গলায় বলল, কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ। ভাল আছি। আপনার ব্যাপারটা কি বলুন দেখি? বিয়ে করে বৌ ফেলে চলে গেলেন। নো পাত্তা। ব্যাপারটা কি? আমার আটত্রিশ বছরের জীবনে এমন ঘটনা শুনি নি।
জাহেদ বলল, কেয়া আছে?