- বইয়ের নামঃ মেঘের ওপর বাড়ি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি
আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি—এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হয়, মারা গেছি। মৃত অবস্থা থেকে অলৌকিকভাবে যারা বেঁচে ওঠে, তাদের মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়। এর নাম এনডিই (নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স)। বাংলায় মৃত্যু-অভিজ্ঞতা। তারা সবাই দেখে, লম্বা এক সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় চোখধাঁধানো আলো। এই আলোর চুম্বকের মতো আকর্ষণী ক্ষমতা। কঠিন আকর্ষণে অন্ধের মতো আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হয়।
আমি কোনো সুড়ঙ্গ দেখছি না। সুড়ঙ্গের মাথায় আলোও না। তবে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। জীবিত অবস্থায় কোনো মানুষেরই (আয়নার সামনে ছাড়া) নিজেকে দেখার উপায় নেই। আমি যেহেতু নিজেকে দেখছি, কাজেই ধরে নিতে পারি, আমি মারা গেছি। নিজেকে দেখে আমার মায়া লাগছে। হাসপাতালের কেবিনে ডান দিকে পাশ ফিরে আমি শুয়ে আছি। নাকে অক্সিজেনের নল। বাঁ হাতে ক্যানোলা লাগানো। ক্যানোলা দিয়ে রক্তের শিরায় স্যালাইন যাচ্ছে। স্যালাইনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক। নাভির নিচে একটা ফুটো করা হয়েছে। কেন করেছে, কে জানে।
মোবাইল ফোনের শব্দ হচ্ছে। আমি যেদিক ফিরে শুয়ে আছি, শব্দটা আসছে তার উল্টো দিক থেকে। রুবিনার মোবাইল ফোন। আমি মাথা না ঘুরিয়েই রুবিনাকে দেখলাম। রোগীর অ্যাটেনডেন্টের ডিভানে সে শুয়ে আছে। ডিভানটা ছোট। তার একটা পা বিছানার বাইরে। অন্য পা গোটানো। বেচারি বালিশ ছাড়া ঘুমাচ্ছে।
রুবিনা ঘুমের মধ্যেই বলল, কে?
ওপাশ থেকে বলল, আমি জুঁই। ভাইয়া কেমন আছে?
ভালো আছে। তোমার ভাইয়া ভালো।
ভাইয়া কি ঘুমাচ্ছে?
ঘুমাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। রাখি, কেমন? আই লাভ ইউ।
রুবিনা টেলিফোন হাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে বলল, প্রতিবার রাত তিনটায় টেলিফোন। দিনে কী করিস? ফাক ইউ বিচ!
রুবিনার টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে কয়েকটা জিনিস স্পষ্ট হলো। মৃত মানুষ টেলিফোনের ওপাশ থেকে যে কথা বলে, তার কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। কেউ মনে মনে কোনো কথা বললে তা-ও শুনতে পায়। এ জন্যই ‘ফাক ইউ বিচ’ এত পরিষ্কার শুনেছি।
এত রাতে জুঁই নামের কে টেলিফোন করল? চিনতে পারছি না তো!
নতুন পরিবেশে নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছি। জীবিত অবস্থায় আমার চারপাশের পৃথিবী যেমন ছিল, এখন তেমন নেই। কিছু গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আলো অনেক কোমল হয়ে গেছে। লেন্সে হালকা জেলি লাগিয়ে ছবি তুললে ছবি যেমন কোমল দেখায়, তেমন। রুবিনা যে ডিভানে শুয়ে আছে, তার কিনারা কোমল। ইংরেজিতে সহজ করে বলি—নো শার্প এজেস।
টুপ করে শব্দ হলো। রুবিনার হাতে ধরা মোবাইল ফোন মেঝেতে পড়ে গেছে। যেখানে পড়েছে, তার কাছেই রাশি বিচারের একটা বই। বইয়ের নাম সাল সাইন লেখিকা লিন্ডা গুডম্যান। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পা দুলিয়ে দুলিয়ে রুবিনা এই বই পড়ছিল এবং বলছিল, আশ্চর্য, সব মিলে যাচ্ছে। কী লিখেছে পড়ে শোনাব?
আমি বললাম, না।
আমার বুকে তখন প্রচণ্ড চাপ। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। দুটা কান বন্ধ। প্লেন অনেক ওপরে উঠলে কান যেমন বন্ধ হয়, তেমন। আমি ঘন ঘন সেঁক গিলে কানের তবদা ভাব কাটানোর চেষ্টা করছি, এই সময় রাশিফলের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না।
আমার না’ কোনো কাজে দিল না। রুবিনা পড়তে শুরু করল, ‘লিব্রানস লাভ পিপল, বাট দে হেইট লার্জ ক্রাউড়। এই শুনছ?
শুনছি।
আমরা মানুষ পছন্দ করলেও জনতা পছন্দ করি না। আরও শোনো, লিব্রা ইজ অল লাভ অ্যান্ড বিউটি অ্যান্ড সুইটনেস অ্যান্ড লাইট। পড়তে পড়তে রুবিনা সিগারেট ধরাল। এমনিতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, তার ওপর সিগারেটের কটু গন্ধ। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, সিগারেট ফেলো।
রুবিনা বলল, দুটা টান দিয়ে ফেলে দেব।
টয়লেটে চলে যাও, টয়লেটে দরজা বন্ধ করে সিগারেট টানো।
রুবিনা বই হাতে টয়লেটে ঢুকে গেল। আমি বললাম, দরজাটা বন্ধ করো, প্লিজ।
রুবিনা বলল, পারব না।
কিছুক্ষণ পর তার হাসির শব্দ শুনলাম। রাশিফলের বইয়ে এমন কী লেখা থাকতে পারে যে সে খিলখিল শব্দ করে হাসছে! টয়লেট থেকে সিগারেটের দুর্গন্ধ আসছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিনাইলের গন্ধ। টয়লেটের বেসিনের একটা কল নষ্ট, সারাক্ষণ টিপটিপ করে পানি পড়ে। পানি পড়ার শব্দটা আগে কঠিনভাবে কানে লাগত। মনে হতো, নখ দিয়ে কেউ ব্ল্যাকবোর্ডে আঁচড়াচ্ছে।
এখন অবস্থা ভিন্ন। বেসিনের কল দিয়ে পানি পড়ছে, আমি তার শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা আমাকে পীড়িত করছে না, বরং শুনতে ভালো লাগছে। যেন পানির ফোঁটা পড়ার শব্দটায় লুকানো গল্প আছে। গল্পটা কী ভাবতেই মনে পড়ল। গল্পটার নাম ‘ফুড়ুৎ’। পানির ফোঁটা পড়ছে আর ফুড়ুৎ শব্দ হচ্ছে। খুব ছোটবেলায় বাবা গল্প করছেন, আমি তার সামনে দুই হাঁটু গেড়ে কুকুরের মতো বসে আছি। মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছি–
এক দেশে ছিল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি পাখি। পাখির যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে রাজা বললেন, ‘সব পাখি জালে বন্দী করো। প্রকাণ্ড জাল বানাও।’ রাজার হুকুমে প্রকাণ্ড জাল বানানো হলো। জাল দিয়ে সব পাখি আটকে ফেলা হলো। জালের এক কোনায় একটা ছিদ্র ছিল, এটা কেউ লক্ষ করেনি। ছিদ্র দিয়ে একটা হলুদ পাখি ফুড়ুৎ করে বের হয়ে গেল।