- বইয়ের নামঃ ম্যাজিক মুনশি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ঘেটুপুত্র কমলা নামের একটা ছবি বানাব
ম্যাজিক মুনসি
উৎসর্গ
জুয়েল আইচ
জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্টজয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন।
ভূমিকা
ম্যাজিক মুনশিকে কি উপন্যাস বলা যাবে?
উপন্যাস বললে প্রকাশকের সুবিধা হয়। পাঠকরা উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন। সমস্যা হচ্ছে ম্যাজিক মুনশিকে কোনো পর্যায়েই ফেলা যাচ্ছে না। ম্যাজিক মুনশি হলো রহস্যময়তার বর্ণনা এবং কিছুটা বিশ্লেষণ। উপন্যাসের কাঠামো অবশ্যি ব্যবহার করা হয়েছে।
এই লেখায় আমি কাউকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছি না। আমি নিজে বিভ্রান্ত মানুষ কোনোকালেই ছিলাম না, কাজেই নিজের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। তবে আমি সচেতনভাবেই জগতের রহস্যময়তার প্রতি ইঙ্গিত করেছি। এই অধিকার আমার আছে।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, ম্যাজিক মুনশি বইটি দুবার পড়বেন। প্রথমপাঠের অস্পষ্ট বিষয়গুলি দ্বিতীয়পাঠে স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। বইয়ে বর্ণিত কৃষ্ণশক্তি আহ্বানের ধারেকাছেও কেউ যাবেন না। মানব মস্তিষ্ক অতি বিচিত্র কারণে সাজেশনে বশীভূত। Trance অবস্থায় মস্তিষ্কের বিচিত্র কার্যকলাপের দিকে যেতে পারে। অকারণ হেলুসিনেশনের শিকার হওয়া হবে বিরাট মূর্খামি।।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
০১.
ঘেটুপুত্র কমলা নামের একটা ছবি বানাব। পুরনো রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। বাড়ির ভেতর নাচঘর থাকতে হবে। টানাবারান্দা থাকতে হবে। বড় দিঘি লাগবে, শ্বেতপাথরের ঘাট থাকতে হবে। দিঘিভর্তি পদ্ম লাগবে। যদি থাকে এখনই লাগাতে হবে। পদ্মগাছ বৈরী অবস্থাতেও ভালো থাকে।
বাংলাদেশের মানুষ পরামর্শ দিতে পছন্দ করে। অনেক পরামর্শদাতা জুটে গেল। একজন বলল, আপনি যেরকম চাচ্ছেন, অবিকল সেরকম বাড়ি একটা আছে মির্জাপুরে। এই বাড়ি আগে কেউ ব্যবহার করে নি। নাচঘরের দেয়ালে কাচ লাগানো। মেঝে কাঠের। কিছু কিছু কাঠ নষ্ট হলেও যা আছে তা-ই যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, দিঘিভর্তি পদ্মফুল। ঘাট আছে কি না মনে করতে পারছি না। থাকার কথা।
ভদ্রলোকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলাম। বাড়ি বলে কিছু নেই, ইটের স্তূপ। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। স্থানীয় এক ভদ্রলোক বললেন, ওদিকে যাবেন না স্যার। সাপের আস্তানা।
আমি বললাম, দিঘি কোথায়?
ভদ্রলোক বললেন, একসময় দিঘি ছিল। এখন ভরাট হয়ে গেছে।
মেজাজ খারাপ করে ফিরলাম। এরপর থেকে কেউ বাড়ির সন্ধান দিলে নিজে যাই না। নুহাশ চলচ্চিত্রের একজনকে ক্যামেরা দিয়ে পাঠিয়ে দেই। সে ছবি তুলে নিয়ে আসে। ছবি দেখে হই হতাশ। অ্যাসিসটেন্টের যাতায়াত খরচের বিল দেখে হই চমৎকৃত। একটি যাতায়াত বিলের নমুনা–
মাইক্রোবাস ভাড়া ৫,০০০ টাকা স্পিডবোট ভাড়া ৪,০০০ টাকা খাওয়াদাওয়া ৩,০০০ টাকা হোটেল ভাড়া ৭,০০০ টাকা পানি ৩,০০০ টাকা সর্বমোট ২২,০০০ টাকা মাত্র
আমি বললাম, সোনারগাঁ হোটেলের এক রাতের ভাড়া ৭০০০ টাকার কম। তোমার হোটেল বিল এত কেন?
অ্যাসিসটেন্ট বলল, রুম তো স্যার একটা নেই নাই। তিনটা নিয়েছি।
তিনটা কেন?
ঢাকা থেকে আমরা চারজন গিয়েছি। স্থানীয় যে মেম্বার সাহেব আমাদের স্পট দেখাবেন তিনিও আমাদের সঙ্গে হোটেলে ছিলেন। তার জন্যেও রুম নিতে হয়েছে।
পানি তিন হাজার টাকা-ঝলাম না। তিন হাজার টাকার পানি খেয়ে ফেলেছ?
মেম্বার সাহেব খেয়েছেন।
মেম্বার সাহেব এক রাতে নি হাজার টাকার পানি খেয়ে ফেলেছেন?
সাধারণ পানি না স্যার। পাগলাপানি। মেম্বার সাহেবের সন্ধ্যার পর পাগলাপানি খাওয়ার অভ্যাস।
শেষ পর্যন্ত ভিডিও দেখে একটা বাড়ি পছন্দ হলো। সুখিয়া জমিদারবাড়ি। নাচঘর আছে। ঘাট আছে। টানা বারান্দা আছে। অতি দুর্গম জায়গা। সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চে চারঘণ্টা যেতে হয়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চার কিলোমিটার।
ভিডিও ছবি দেখে লোকে পছন্দ করা কোনো কাজের কথা না। আমি ঠিক করলাম নিজে গিয়ে দেখব।
পাঠকদের জানাতে লজ্জা বোধ করছি, আমার যাত্রা উপলক্ষে সাজসাজ রব পড়ে গেল। সাজসাজ রবের কারণে আমার সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা। যেমন, একদল বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারি না। বিশেষ ধরনের চিকন চাল ছাড়া খেতে পারি না। খাওয়ার সময় অনেকগুলি পদ লাগে। খাওয়ার পানি হতে হয় বরফশীতল। রাতে গানবাজনার ব্যবস্থা থাকতে হয়। রাতে এসি ছাড়া ঘুমাতে পারি না। মাঘমাসের শীতেও এসি লাগে। তখনো ঘর হিমশীতল করে আমি নাকি ডাবল লেপের ভেতর ঢুকে থাকি। ইত্যাদি।
ব্যাপার মোটেই সেরকম না। আমি যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। আমার প্রয়োজন কিছু R।RM থাকলে কিছু লাগবে না। পাঠকদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন RM হলো মেম্বার সাহেবের পাগলাপানি। তা-না, RM হলো Reading Material. পড়ার বই। প্রতিদিনই নিয়ম করে আমাকে কিছু পড়তে হয় না পড়লে অসুস্থ বোধ করি।
Aisac Asirnov এর Book of Facts এবং স্টিফেন কিং-এর ভূতের গল্পের কালেকশন (Skeleton Crew) ব্যাগে ভরে যাত্রার প্রস্তুতি নিলাম।
নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুলের উপর যাত্রার পুরো দায়িত্ব। সে এসে রিপোর্ট করল, সব ঠিক আছে। এসএ পরিবহনের আধুনিক এসি বাস ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাবে। সুনামগঞ্জ থেকে দোতলা লঞ্চ যাবে। একটা পোর্টেবল এসি পাওয়া গেছে। সিঙ্গার কোম্পানির এসি যাচ্ছে। এসি চালানোর জন্যে জেনারেটর যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা নিরাপত্তার জন্যে দুজন পুলিশ সদস্য দিচ্ছেন। নুহাশপল্লীর বাবুর্চি আর তার দুই অ্যাসিসটেন্ট যাচ্ছে। রান্নাবান্নার সব দায়িত্ব তাদের। টেপিবুড়ো আর কালিজিরা চাল কেনা হয়েছে। দলের অন্য সদস্যদের জন্যে মিনিকেট চলি। গানবাজনা করবে ইসলাম বয়াতির দল। যেদিন রওনা হব তার আগের দিন তারা নেত্রকোনা থেকে চলে আসবে। গায়ক সেলিম চৌধুরীও যাচ্ছেন।
আমি বললাম, Holy cow.
ম্যানেজার বলল, গরুর মাংসের ব্যবস্থা স্থানীয়ভাবে করা হবে স্যার।
আমি বললাম, সব বাতিল। শুধু আমি যাব, শাওন যাবে আর নিষাদ যাবে। ক্যামেরাম্যান মাহফুজ আর সেট ডিজাইনার কুদ্দুস যাবে। বন্ধুবান্ধব দলবল না। ঢাকা থেকে নিজের গাড়িতে সুনামগঞ্জ যাব। গান শুনতে ইচ্ছা করলে শাওন গাইবে। সে খালি গলায় গান করতে পছন্দ করে, কাজেই হারমোনিয়াম তবলচি কিছু লাগবে না।
ম্যানেজার মাথা চুলকে বলল, ইতিমধ্যে অনেক খরচ হয়ে গেছে। অনেককে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করা হয়েছে।
আমি বললাম, হোক। যা গেছে তা গেছে। কে সারা সারা।
ভোরবেলা গাড়িতে উঠলাম আমি একা। হঠাৎ শাওনের শরীর খারাপ করেছে। সে যেতে পারছে না। নিষাদ মাকে ছেড়েই আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে তৈরি। তার মা ছাড়বে না।
আমি বললাম, তোমার ছেলের কোনো অসুবিধা হবে না। নিশ্চিন্ত মনে ছেড়ে দাও।
শাওন বলল, তুমি যখন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন ছেলের দিকে ফিরেও তাকাবে না। সে খেলতে খেলতে চলে যাবে হাওরের দিকে। তখন?
নিষাদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, আমি বাবার সঙ্গে যাব! আমি বাবার সঙ্গে যাব!
তার এই কান্না অবশ্যি খুবই সাময়িক। আমি চোখের আড়াল হওয়া মাত্র সে কান্না থামিয়ে নতুন কোনো খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিছুদিন ধরে চকলেট গাড়ি নামের এক খেলা সে আবিষ্কার করেছে। চকলেটের একটা প্যাকেট মেঝেতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। মুখে ট্রেনের মতো ঝিকঝিক শব্দ করে।
আমি যথেষ্টই মন খারাপ করলাম। শাওন তা বুঝতে পেরেও না-বোঝার ভান করে বলল, সাবধানে থেকো।
সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে গাড়ি রেখে লঞ্চে উঠব এমনই কথা ছিল। সার্কিট হাউসের কম্পাউন্ডে ঢুকে ধাক্কার মতো খেলাম। এস এ পরিবহনের বিশাল গাড়ি আগে থেকেই উপস্থিত। গাড়ির ভেতর এবং বাইরে নুহাশ চলচ্চিত্র এবং নুহাশপল্লীর পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছি। ইসলামউদ্দিন বয়াতি তার লোকজন নিয়ে দলবেঁধে হাঁটাহাটি করছে।
আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নুহাশপল্লীর ম্যানেজার ছুটে এল। আমি বললাম, এসব কী?
ম্যানেজার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, সব পেমেন্ট আগেই করা, তাই চলে এসেছে।
ছবির ক্যামেরাম্যান মাহফুজ কি এসেছে?
তাকে একবার মোবাইল করেছিলাম, তিনি ধরেন নি। পরে আবার করতে ভুলে গেছি।
সেট ডিজাইনার কুদ্দুস?
তাঁকে খবর দিতে বিস্মরণ হয়েছি।
তোমার চাকরি এই মুহূর্ত থেকে নট।
জি আচ্ছা স্যার।
ম্যানেজারকে চাকরি চলে যাওয়ায় মোটেই চিন্তিত এবং বিচলিত মনে হলো না। বরং আনন্দিত মনে হলো। নুহাশপল্লী থেকে বেশ কয়েকবার তার চাকরি গেছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর পরই সে ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে আমাকে কদমবুসি করে বাড়ি চলে যায়। পরিবারের সঙ্গে সপ্তাহখানিক কাটিয়ে আবার হাসিমুখে ফিরে এসে চাকরি শুরু করে, যেন চাকরি যাওয়ার মতো কিছু ঘটে নি।
বারান্দায় তেইশ চব্বিশ বছরের হলুদ গেঞ্জি পরা এক তরুণ ঘুরছে। তার গলায় ক্যামেরা, ঠোঁটে সিগারেট। এই বয়সের তরুণদের কাছ থেকে আমি কিছুটা সমীহ পাই। আমার সামনে পড়লে সিগারেট লুকানোর চেষ্টা করে। এই তরুণ তা করছে না। সে বেশ আয়েশ করে ধোয়া ছাড়ছে। আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই ছেলে কে?
ম্যানেজার বলল, স্যার সাংবাদিক। আমাদের সঙ্গে যাবে। পথে আপনার ইন্টারভ্যু করবে। ফটোসেশান করবে।
আমি বললাম, এর ভাবভঙ্গি তো প্রথম আলোর সাংবাদিকের মতো। ধরাকে সরা না, লবণের চামুচ জ্ঞান করছে।
ম্যানেজার বলল, প্রথম আলোর সাংবাদিক না স্যার। সুনামগঞ্জের লোকাল সাংবাদিক।
ডাকো তাকে।
তরুণ সাংবাদিক সিগারেট হাতেই এগিয়ে এল।
আমি বললাম, তুমি কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত?
স্যার আমি প্রথম আলোর লোকাল করস্পনডেন্ট।
ও আচ্ছা। ভাবভঙ্গি সেরকমই।
লঞ্চে আপনার বিশাল ইন্টারভ্যু নেব। আমাকে দুঘন্টা সময় দেবেন।
আমি তো সাংবাদিক নিয়ে চলাফেরা করি না। তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না।
তাহলে এখানেই ইন্টারভ্যু সেরে ফেলি? মিনি ইন্টারভ্যু।
আমি বললাম, তুমি দুটা প্রশ্ন করবে। এর বেশি না।
ঈদের ফ্যাশন নিয়ে দুটা প্রশ্ন করি?
করো। প্রথম প্রশ্ন, ঈদের দিন ভোরে আপনি কী পরবেন?
ঈদের দিন তো তোমাদের পত্রিকা বের হয় না, কাজেই ঠিক করেছি টাইম ম্যাগাজিন পড়ব। দ্বিতীয় প্রশ্ন কী?
আমি জানতে চাচ্ছিলাম নামাজের সময় আপনি কী পরবেন?
নামাজের সময় তো নামাজই পড়ব। আর কী পড়ব? দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, এখন বিদায় হও।
সাংবাদিক আহত চোখে তাকিয়ে রইল। আমার কঠিন রসিকতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় সুখকর হওয়ার কথাও না। আমার খানিকটা মায়া লাগল। আমি বললাম, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পার, তবে ইন্টারভ্যু, ফটোসেশন এইসব বাদ। ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে, এক শত হাত দূরে থাকুন। দেখেছ না?
জি স্যার।
আমার কাছ থেকেও এক শ হাত দূরে থাকবে।
তরুণ সাংবাদিক আগ্রহ নিয়ে বলল, স্যার আমি একজন কবি। আমার দুটো কবিতার বই বের হয়েছে।
আমি নির্বিকার গলায় বললাম, তাহলে দুই শ হাত দূরে থাকবে।
তরুণ সাংবাদিক ছাড়াও এক তরুণীকে দেখলাম মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চক্রাকারে ঘুরছে। তার পোশক যথেষ্টই উগ্র। আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই মেয়ে কে?
সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে স্যার।
কেন যাচ্ছে?
সেটা তো স্যার আমি জানি না। আপনি অর্ডার দিয়েছেন বলে সে যাচ্ছে।
আমি কাকে অর্ডার দিলাম।
মেয়েকে দিয়েছেন স্যার। সে আপনার আত্মীয় হয়। খালাতো বোন।
তাকে ডাকো।
খালাতো বোন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মধুর ভঙ্গিতে হাসল। এই হাসি অনেক সাধনা করে শেখা, নাকি প্রকৃতিপ্রদত্ত বুঝলাম না।
নাম কী?
আমার শোবিজের নাম সোনালি।
আসল নাম কী?
সালমা।
গ্রামের বাড়ি কোথায়?
দিনাজপুরে।
দিনাজপুরে আমার কোনো খালা থাকেন বলে জানি না। তুমি নাকি বলেছ তুমি আমার খালাতো বোন?
সরি স্যার, মিথ্যা করে বলেছি। মিথ্যা না বললে আসতে পারতাম না।
শোবিজে করো কী?
র্যাম্প মডেল। এখন অভিনয় করতে চাই বলেই আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। আজকাল পরিচয় ছাড়া কিছু হয় না।
একা এসেছ?
হুঁ।
বাবা-মা তোমাকে একা ছেড়ে দিল?
আমার বয়স একুশ। একা কেন ছাড়বে না? স্যার, আপনি নতুন যে ছবিটা বানাচ্ছেন সেখানে আমাকে ছোট হলেও একটা রোল দিতে হবে। আমি কোনো কথা শুনব না। যে-কোনো মূল্যে আমার একটা ব্রেক লাগবে।
আমি ম্যানেজারকে বললাম, এই মেয়েকে কানে ধরে বিদায় করে দাও।
ম্যানেজার বলল, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।
আমি লক্ষ করেছি, ইদানীং মানুষকে আহত করে আনন্দ পাচ্ছি। বয়সের একটা পর্যায়ে এরকম হয়।
জর্জ বার্নাড শ নাকি লাঠি হাতে মারার জন্যে তেড়ে যেতেন। মার্ক টোয়েন থান ইটের সাইজের বই ছুড়ে মেরে এক সাংবাদিককে আহত করেছিলেন।
আমি তাঁদের মতো বড় মাপের কেউ না বলে কঠিন রসিকতায় নিজেকে আটকে রেখেছি। এটাই বা খারাপ কী?
লঞ্চের নাম এম এল কুশিয়ারা
লঞ্চের নাম এম এল কুশিয়ারা। সাধারণত জলযানের নামের আগে এম এল কিংবা এম ভি থাকে। এম এল-এর অর্থ মোটর লঞ্চ। বড় লঞ্চগুলি হয় এম ভি, এর অর্থ মোটর ভেহিকেল।
ছোট্ট একতলা লঞ্চ। ছাদে সোফা পেতে আমার বসার ব্যবস্থা। নুহাশপল্লীর ম্যানেজার সামরিক আইন জারি করেছে—ছাদে কেউ থাকবে না। শুধু স্যার।
আকাশ মেঘলা বলে মাথার উপর শামিয়ানার প্রয়োজন নেই। তারপরেও শামিয়ানা খাটানো আছে।
লঞ্চ ছাড়ার পর মন বেশ খারাপ হলো।
নিষাদ থাকলে আনন্দে ছোটাছুটি করতে পারত। শাওন বেড়াতে পছন্দ করে। হাওর আগে দেখে নি। সে মুগ্ধ হতো। পৃথিবীর সমস্ত স্বামীদের মতো আমিও স্ত্রীর মুগ্ধ চোখ দেখতে পছন্দ করি। এই মুগ্ধতার জন্যে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। প্রকৃতি ব্যবস্থা করে রেখেছে।
লঞ্চ ছেড়েছে ভোরবেলায়, আমরা দুপুরের মধ্যে পৌছে যাব। আমাকে লোকেশনে নিয়ে যেতে সিলেট থেকে এসেছে নাট্যকর্মী আরজু। আমি তাকে ডাকি সর্পারাজ। কারণ একসময় তার মাথায় বাণিজ্যিকভাবে সাপ চাষের আইডিয়া এসেছিল। প্রকল্প অনেকদূর এগুনোর পর পরিত্যক্ত হয়। একটা দুষ্ট গোখরো সাপ তাকে তাড়া করেছিল। নিজের পোষা সাপের এই ব্যবহারে আরজু মর্মাহত হয়েই প্রকল্প ত্যাগ করল। তবে তার টাইটেল ত্যাগ করল না। সে টেলিফোন করলে আমি হ্যালো বলার আগেই বলে, স্যার আমি সর্পরাজ আরজু।
সর্পরাজ আডডাবাজ রসিক মানুষ। পান খেতে খেতে কঠিন মুখে রসিকতা করে। শুনতে ভালো লাগে। তার মুখ থেকে লাল পানের রস গড়িয়ে ধবধবে সাদা শার্ট পড়ে, সেটাও দেখতে ভালো লাগে।
আমার সামনে টি-পট ভর্তি চা। চা খেতে খেতে এগোচ্ছি। দুঘণ্টার মধ্যে হাওরে পড়লাম। যারা হাওর দেখেন নি তাদের হাওরের সৌন্দর্য বুঝানো যাবে না। চোখের দৃষ্টি কোথাও আটকাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি! সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউ উঠছে। পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। স্বচ্ছ পানিকে কাকের চোখের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বলা হয় কাকচক্ষু জল। হাওরের পানি তারচেয়েও স্বচ্ছ। প্রচুর পদ্ম ফুটেছে। পদ্মগুলি নাকি দুপুর বারোটার মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নেবে।
শীতের সময় হাওরের পানি নেমে যাবে। ধান চাষ হবে। পানির সমুদ্র থেকে হাওর হবে সবুজের সমুদ্র।
আমি সর্পরাজকে বললাম, হাওরের জমি নিশ্চয় কারোর একার না। অনেকের জমি এখানে আছে।
সর্পরাজ বলল, জি স্যার।
পানি শুকিয়ে গেলে কীভাবে বোঝা যাবে কার জমি কোনটা?
পানি শুকিয়ে গেলে জমির আল দেখা যায়। আল দেখে সীমানা নির্ধারণ হয়। সমস্যা হলে সালিশে মীমাংসা হয়। স্যার কি একটা পান খাবেন? ভালো খাসিয়া পান ছিল।
চা খাচ্ছি। পান খাব কীভাবে?
এক গালে পান রাখবেন, অন্য গালে চা। এর মজা অন্য। আমি তো এইভাবেই চা খাই।
তুমি খাও, আমি খাব না। এখন করছ কী? নতুন কোনো প্রকল্প?
কুমির চাষের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কুমির চাষ করব। বিদেশে রপ্তানি করব।
কুমির কে কিনবে?
সর্পরাজ বলল, কুমিরের মাংস অনেকেই খায়। বিরাট ডিমান্ড। কুমিরের চামড়ার ডিমান্ড।
সর্পরাজ মহা উৎসাহে কুমির চাষের নানান দিক ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। আমি কিছু শুনছি, বেশির ভাগই শুনছি না। চোখের পাতা থাকার কারণে চোখ বন্ধ করা যায়। কান বন্ধ করার কোনো সিস্টেম না থাকলেও আমি কান বন্ধ করতে পারি। যে হড়বড় করে কথা বলছে তার মনে হবে আমি গভীর আগ্রহে শুনছি। আসলে ভা-না।
লঞ্চের একতলায় মহা উৎসব শুরু হয়ে গেছে। গানবাজনার আসর বসেছে। ঢোলের প্রবল বাড়িতে গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না। গায়কের লম্বা টান শুনে মনে হচ্ছে বিচ্ছেদ সঙ্গীত।
নিচ থেকে আসছে গানের শব্দ, ডেকে সর্পরাজ এখন কুমিরের ডিম নিয়ে কী যেন বলছে। গান এবং কুমিরের ডিমে একাকার হয়ে গেছে। আমার ঝিমুনির মতো এসেছে। ঝিমাতে ঝিমাতে ছোট্ট স্বপ্নও দেখে ফেললাম। স্বপ্নে পুত্র নিষাদ বলছে, বাবা, আমার জন্যে একটা চকলেট রেলগাড়ি আনবে।
হঠাৎ করেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, লঞ্চ প্রবলভাবে দুলে উঠল। টেবিলে রাখা টিপট ছিটকে পায়ের কাছে পড়ল।
যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আকাশে হালকা মেঘ ছিল। এখন দেখি আকাশে ঘন কালো মেঘ। এই মেঘ ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি নেই। শুধুই প্রচণ্ড বাতাস। বাতাস একদিক থেকে আসছে না, ক্ষণে ক্ষণে দিক পরিবর্তন করছে।
আমি সর্পরাজকে নিয়ে লঞ্চের সারেং-এর ঘরে ঢুকলাম। ঝড়ের গতিপ্রকৃতি সে-ই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে।
লঞ্চের সারেং-এর সঙ্গে ল্যাব এইডের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বরেনের মিল আছে। চেহারায় না, কথায়। ডা. বরেন হাসিমুখে রোগীকে দুঃসংবাদ দিতে পছন্দ করেন। লঞ্চের সারেংও তাই। সে হাসিমুখে আমাকে বলল, স্যার লঞ্চ তো ডুবতে ধরছে। খেলনার মতো ছোট লঞ্চ। না ডুইবা উপায় কী?
আমি আঁতকে উঠে বললাম, বলেন কী?
সারেং বলল, বাতাসের নমুনা খুবই খারাপ। ঘূর্ণি বাতাস। বিনা নোটিশে লঞ্চ ডুবব। আপনি কি টাইটানিক ছবিটা দেখেছেন?
আমি প্রচণ্ড ঝড়ে সিনেমা নিয়ে আলাপে উৎসাহ পেলাম না, চুপ করে রইলাম।
সারেং নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এত বড় জাহাজ ডুবে গেল, আর এইটা তো পুলাপানের খেলনা।
শাওন এবং নিষাদ সঙ্গে না থাকার প্রবল দুঃখবোধ হঠাৎ আনন্দে রূপান্তরিত হলো। লঞ্চের সঙ্গে আমি একা তলিয়ে যাব। ওরা যাবে না। এরচেয়ে আনন্দময় সংবাদ আর কিছুই হতে পারে না।
সর্পরাজ বলল, স্যার ভয় পাবেন না। হাওরে পানির গভীরতা কম। দশ বারো ফুটের বেশি হবে না।
আমি বললাম, ডুবে মরার জন্য দশ ফুট পানি যা দশ হাজার ফুট পানিও ত।
আপনি সাঁতার জানেন তো?
আমি বললাম, সাঁতার জানি। সাঁতরে ব্রজেন দাশের পক্ষে হয়তো হাওর পাড়ি দেওয়া সম্ভব। আমার পক্ষে না।
সর্পরাজ বলল, কিছু ধরে ভেসে থাকতে পারবেন না?
কী ধরে ভেসে থাকব?
দেখি কিছু পাওয়া যায় কি না।
সর্পরাজ অনেক কষ্টে নিচে নেমে গেল। ঝড়ের গতি ক্রমেই দেখি বাড়ছে। দুএক ফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে। সমুদ্রঝড় আমি কখনো দেখি নি। শুনেছি তখন ঢেউ ফুলে ফেঁপে পাহাড়ের মতো হয়। এখানেও তাই হচ্ছে। প্রকাণ্ড ঢেউ লঞ্চের গায়ে আছড়ে পড়ছে। লঞ্চ ঢেউয়ের উপর উঠে যাচ্ছে না। ঢেউ লঞ্চের একতলায় ঢুকে যাচ্ছে। একতলা পানিতে ভর্তি হলে লঞ্চ ডুববে, এটাই স্বাভাবিক।
সারেং মনে হয় সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ হুইল ধরে ছিল, এখন হুইল ছেড়ে সিগারেট ধরিয়ে বলল, আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলাম।
সাৱেং-এর চেহারা দেখে মনে হলো না সে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। সিগারেট সে বেশ আয়েশ করে টানছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ এভাবে সিগারেট টানে না।
সারেং বলল, হাওরের এই জায়গায় প্রায়ই ঝড় উঠে। আকাশে মেঘের ছিটাফোটা নাই, তারপরেও ঝড়। অনেক নৌকা ডুবেছে। দুই বছর আগে একটা একতলা লঞ্চ ডুবেছে। এগারোজন মানুষ মারা গেছে।
আমি বললাম, এই জায়গাতেই ঝড় কেন উঠে?
এই পথে জ্বিনের বাদশার যাতায়াত, তার কারণে ঝড় উঠে।
লঞ্চের একতলা থেকে সমবেত কণ্ঠে আযানের আওয়াজ আসছে। আমি সারেংকে বললাম, আযান কেন দিচ্ছে, জ্বিনের বাদশা তাড়াবার জন্যে?
সারেং বলল, মহা দুর্যোগে আযান দেওয়ার বিধান আছে।
আমি বললাম, আযান হচ্ছে নামাজের জন্যে আহ্বান। দুর্যোগ কেটে গেলে সবাই কি নামাজ পড়বে?
সারেং বলল, দুর্যোগ কেটে গেলে কাউরে নামাজ পড়তে দেখি না। আপনি জটিল কথা বলেছেন।
ছোটবেলার ঝড়ের এক স্মৃতি আমার আছে। নানার বাড়িতে আছি। হঠাৎ বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় উঠল। এমন অবস্থা যে-কোনো মুহূর্তে বাড়িঘর ভেঙে পড়বে। ছোটদের সব চুকানো হয়েছে খাটের নিচে। মাথার উপর বাড়ি ভেঙে পড়লেও যেন জীবন রক্ষা হয়। পুরুষরা সবাই আযান দিচ্ছেন। উঠানে শিলপাটা ছুড়ে ফেলা হলো। শিলপাটা দেখে ঝড় নাকি তার রাগ সামলে অন্য বাড়ির দিকে যায়। আমার নানিজান জলচৌকিতে দাড়িয়ে যেদিক থেকে বাতাস আসছে সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সূরা পাঠ করছেন। ঝড়ের দিকপরিবর্তনের সঙ্গে তার আঙুলের দিকও পাল্টাচ্ছে। নানার বাড়ির সেই ভয়াবহ ঝড় হঠাৎ করেই থেমে গেল। ছোটরা দৌড়ে গেলাম আমবাগানের দিকে।
এই ঝড়ও কি হঠাৎ থামবে?
ফোটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল, এখন প্রবল বর্ষণ শুরু হলো। সারেং বলল, আর ভয় নাই বৃষ্টি নামছে।
বৃষ্টি নামলে ভয় নাই কেন?
জ্বিনের বাদশা আগুনে তৈয়ার। জ্বিন জাতি বৃষ্টির মধ্যে থাকতে পারে না। তার উপর ঘূর্ণি বন্ধ হয়েছে। দক্ষিণা বাতাস ছাড়ছে।
আমি বললাম, আপনার কাছে কম্পাস আছে?
না।
লঞ্চ যেভাবে ঘুরপাক খেয়েছে কম্পাস ছাড়া দিক বুঝবেন কীভাবে? যতদূর চোখ যায় পানি ছাড়া কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। সূর্যও মেঘে ঢাকা।
সারেং বলল, আপনি আরেকটা জটিল কথা বলেছেন।
সারেং অমির জটিল কথায় মুগ্ধ। আমি হাওরের ঝড় এবং বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ। ঝড়ের প্রকোপ মোটেই কমে নি, কিন্তু আমার ভয় কমে গেছে। মানুষ বেশিক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় থাকতে পারে না। প্রকৃতি ব্যবস্থা রেখেছে। আতঙ্কিত মানুষের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে প্রচুর এনড্রেলিন নামের জারক রস বের হয়। আতঙ্কিত মানুষের ভয় কেটে যায়।
লেখকদের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। তারা যে-কোনো সময় তাদের নিজেদের ভুবনে ঢুকে যেতে পারেন। আমি সেই প্রস্তুতি নিলাম। চোখের সামনে হিমুকে দেখলাম। সে লঞ্চে যাচ্ছিল। ঝড়ের মধ্যে লঞ্চ পড়েছে। হিমু তার স্বভাব অনুযায়ী বিচিত্র কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এই বিষয়ে উপন্যাসটি আমি লিখতে শুরু করেছি। নাম দিয়েছি হিমুর আছে জল।
জলযানে চমৎকার ঝড়ের বর্ণনা কোনো লেখকের লেখায় আমি তেমনভাবে পাই নি। তবে শরৎচন্দ্রের লেখায় সমুদ্রঝড়ের চমক্কার বর্ণনা আছে। শ্রীকান্ত দ্বিতীয় খণ্ডে শ্রীকান্ত সমুদ্রঝড়ে পড়েছিল।
শরৎচন্দ্র থাকতেন বার্মায়। বার্মা থেকে বঙ্গদেশে জাহাজে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতাই তিনি শ্রীকান্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। কয়েক লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না–
ছোটবেলায় অন্ধকার রাত্রে ঠাকুমার বুকের ভিতর ঢুকিয়া সেই যে গল্প শুনিতাম, কোনো এক রাজপুত্র এক ডুবে পুকুরের ভিতর হইতে রূপার কৌটা তুলিয়া সাতশ রাক্ষসীর প্রাণ সোনার ভোমর হতে পিষিয়া মারিয়াছিল এবং সেই সাতশ রাক্ষসী মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে পদভরে সমস্ত পৃথিবী মাড়াইয়া গুড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, এও যেন তেমনি কোথায় কী একটা বিপ্লব বাঁধিয়াছে; তবে রাক্ষসী সাতশ নয়, সাতকোটি, উন্মুক্ত কোলাহল এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে। আসিয়াও পড়িল। রাক্ষসী নয়—ঝড়। তবে এরচেয়ে বোধ করি তাহাদের আসাই ঢের ভালো ছিল। এই দুর্জয় বায়ুশক্তির বর্ণনা করাও ঢের দূরের কথা, সমগ্র চেতনা দিয়া অনুভব করাও যেন মানুষের সামর্থ্যের বাহিরে।
ঝড়ের প্রকোপ কিছুটা কমেছিল, হঠাৎ আবার বাড়ল। লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়ে গেল। আতঙ্কজনক অবস্থা। এর মধ্যে দেখি সর্পরাজ এবং ম্যানেজার বিশাল এক পিতলের ডেগ নিয়ে অনেক কষ্টে আসছে। আমি বললাম, ডেগ দিয়ে কী হবে?
ম্যানেজার বলল, স্যার আপনি ডেগের ভেতর বসে থাকবেন। ডেগ পানিতে ভাসবে।
সর্পরাজ বলল, ডেগের ভিতর একটা লোটা দিয়ে দিয়েছি। বৃষ্টির পানি জমলে পানি সেঁচবেন।
ম্যানেজার বলল, নিচে বিরাট এক ঝামেলা হয়েছে স্যার। আমি বললাম, ঝড়ের ঝামেলা তো চলছেই। আর কী ঝামেলা?
সোনালি মেয়েটা ভয়ে ফিট পড়েছে। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। ছোটানো যাচ্ছে না।
সে যাচ্ছে নাকি?
মেয়েটার হাতে টাকা নাই পয়সা নাই, শুরু করেছে এমন কান্দা।
সর্পরাজ বলল, ছবিতে ছোটখাটো একটা রোল তারে দিয়ে দিয়েন। মেয়েটা নাচও জানে। নিচে যখন গানবাজনা হচ্ছিল তখন তালে তালে নাচল। সবাই ভালো বলেছে।
আমি ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। ঝড়-তুফান চলছে, এর মধ্যে ফিল্মে ঢোকার সুপারিশ।
ম্যানেজার বলল, সোনালি বলেছে একটা পাসিং শট পেলেও নাকি তার জীবন ধন্য।
যেসব পাঠক পাসিং শট বুঝতে পারছেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি— পাসিং শট হচ্ছে মূল অভিনেতা অভিনেত্রী কথা বলছে, দূর দিয়ে কেউ হেঁটে চলে গেল। দূর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়াটাই শট।
নাটকে অভিনয় করার তীব্র আগ্রহ আমি মেয়েদের মধ্যেই বেশি দেখেছি। তারা যে-কোনো মূল্যে অভিনয় করতে চায়। মূল্যটা যে কত বড় তা জেনেও না-জানার ভান করে।
আমি একবার এক বিয়েতে গিয়েছিলাম। বিয়ের কনে আমাকে দেখে আবেগজর্জরিত গলায় বলল, আঙ্কেল, আমার সারা জীবনের স্বপ্ন অভিনয় করা।
আমি বললাম, স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তো পেয়ে গেছ। বিয়ে হয়ে গেল, বাকি জীবন কাটবে স্বামীর সঙ্গে অভিনয় করে।
ঝড় থেমে গেছে
ঝড় থেমে গেছে।
আমাদের লঞ্চ ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি একটা জায়গায় থেমে আছে। জায়গাটা দেখাচ্ছে খানিকটা সুন্দরবনের বাড়ির মতো। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘশূন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে রূপার থালার মতো প্রকাও চাদ উঠলেও আমি বিস্মিত হব না।
প্রবল উত্তেজনার অবসান হলে শরীরে কোমল আলস্য নেমে আসে। লেখকের ভাষায় কোমল আলস্য বললাম। সাধারণ ভাষায় শরীর ছেড়ে দেয়। আমার শরীর মন দুইই ছেড়ে দিয়েছে। ডেকে চেয়ার পেতে বসেছি। এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে চায়ের কাপ। আমার চমক্কার লাগছে।।
অসংখ্য ছেলেমেয়ে তীরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের চাঞ্চল্য দেখে মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম তারা লঞ্চ নামক জলযান দেখল। শিশুদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। ভাটি অঞ্চল সম্পর্কে প্রচলিত কথা হলো, সাতটার কম কারোর ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে আঁটকুড়া বলা হয়। কথা সত্যি হতে পারে।
সর্পরাজ মুখভর্তি পান নিয়ে আমার পাশে বসে আছে। শুধু ঝড়ের সময় তার মুখে পান দেখি নি। এই সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণ তার মুখে পান। আমার ধারণা ঘুমের মধ্যেও সে পান খায়। তার স্ত্রী (আমি ডাকি সর্পরানী) ঘুমন্ত স্বামীর মুখে পান ঠেলে দেয়।
সর্পরাজ বলল, স্যার, এই জায়গাটার নাম তারানগর।
আমি বললাম, এমন অজপাড়াগাঁর নাম নগর।
এর উত্তরে মুখভর্তি পান নিয়ে সে কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না। তার সিলেটি ভাষা আমার কাছে বেশিরভাগ সময় দুর্বোধ্য মনে হয়।
সর্পরাজ লঞ্চের ডেকে টকটকে লাল রঙের পিক ফেলে বলল, স্যার, মুনশি সাবরে খবর দিয়া আনব? আলাপ করলে মজা পাবেন।
আমি বললাম, কাউকে খবর দিয়ে আনতে হবে না। আমি যথেষ্ট মজা এমনিতেই পাচ্ছি। আমরা মূল লোকেশনের দিকে কখন রওনা হব?
সর্পরাজ বলল, সমইস্যা আছে।
সমস্যার বিষয়টা শুনলাম। আমরা মূল লোকেশন থেকে অনেক উত্তরে চলে এসেছি। সুনামগঞ্জ ফিরে যাওয়ার মতো ডিজেল লঞ্চে নেই। ডিজেলের সন্ধানে লোক গেছে।
আমি বললাম, এত সামান্য ডিজেল নিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম?
এই প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত কথা শুনলাম। লঞ্চ যখন আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা হলো তখনই এক ড্রাম ডিজেল ফেলে দেওয়া হলো। আল্লাহ যেন বোঝেন লঞ্চযাত্রীরা এখন সম্পূর্ণ অসহায়। তাঁর রহমত ছাড়া এদের গতি নেই।
শিশুদের সঙ্গে এখন কিছু বয়স্ক ব্যক্তিও যুক্ত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্যে সর্পরাজ এগিয়ে গেল।
সর্পরাজ : মুনশি সাব আছুইন নি?
সমবেত উত্তর : অয় অয়। (অর্থাৎ হ্যাঁ হ্যাঁ।)
সর্পরাজ : মুনশি সাবরে খবর দেউক্কা। লিখক হমায়ূন সাব লঞ্চে আইছুইন। মুনশি সাবের লগে উনার খুবই আলাপের খায়েশ।
শিশুর দলের একজন : লইয়া আইরাম। (অর্থাৎ নিয়ে আসছি)
এই শিশু ছুটে যাচ্ছে। তার পেছনে কম করে হলেও আরও কুড়িজন যাচ্ছে। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। সর্পরাজকে স্পষ্ট জানিয়েছি, আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছি না। নিতান্ত পরিচিত বলয়ের বাইরে আমি মুখ খুলতে পারি না। আশপাশে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ থাকলেই আমার মনে হয় আমি কোনো সেমিনারে এসেছি। সেমিনারে প্রধান বক্তা আমি। কোন বিষয়ে সেমিনার এখনো জানি না। বক্তৃতায় কী বলব তাও জানি না
সর্পরাজ আমার সামনে বসতে বসতে বলল, মুনশিরে খবর দিছি। চইলা আসবে।
মুনশি সাবকে খবর দিতে আমি বলি নি।
সর্পরাজ বলল, উনারে যদি আপনার পছন্দ না হয় আমার দুইগালে দুইটা চড় দিবেন।
উনি করেন কী?
মসজিদের ইমাম। মিজিক দেখায়।
কী দেখায়?
মিজিক। জুয়েল আইচ উনার কাছে দুধের শিশু।
মসজিদের ইমাম ম্যাজিক দেখান?
জি অয়।
আমি খানিকটা অবাক হলাম। মসজিদের ইমাম ম্যাজিশিয়ান? প্রায় দেড় শ বছর আগে নেত্রকোনায় মসজিদের জুনৈক ইমাম গান লিখতেন। গানে সুর দিয়ে গাইতেন। তাঁর নাম উকিল। মসজিদে ইমামতি করতেন বলে নামের শেষে মুনশি যুক্ত হয়েছে। তিনি পরিচিত হয়েছিলেন উকিল মুনশি হিসেবে।
উকিল মুনশির একটি গান—শোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? আমি শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে ব্যবহার করেছিলাম। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জ্ঞানী বিচারকরা শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার উকিল মুনশিকে দিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, উকিল মুনশির ঠিকানা কী? তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
আমি বললাম, কবর খুঁড়লেই পাওয়া যাওয়ার কথা। দেড়শ বছর পার হয়েছে এটা একটা সমস্যা।
কোনো ছবির মৌলিক গানের জন্যে গীতিকারকে পুরস্কার দেওয়ার বিধান আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাছন রাজার গান ব্যবহার করলে তাদের শ্রেষ্ঠ গীতিকার পুরস্কার দেওয়া যায় না। উকিল মুনশি যে সেই দলেরই পুরস্কার কমিটি তা জানতেন না। বাংলাদেশের যে-কোনো কমিটিতে বেশিরভাগ সদস্য মূর্খ থাকবেন এটা নিপাতনে সিদ্ধ।
গায়ক উকিল মুনশির পর আরেকজন পাওয়া গেল ম্যাজিক মুনশি। খারাপ কী!
সর্পরাজ বলল, স্যার কি আমার উপর নারাজ হয়েছেন? মিজিক মুনশি খবর দিলাম এই কারণে।
কিছুটা নারাজ হয়েছি। আমার একা থাকতে ভালো লাগছিল।
আপনি তো মিজিক ভালো পান।।
তা অবশ্য পাই।। তাহলে উনার মিজিক দেখলে আপনার দিলখোশ হবে।
আমি দিলখোশ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। মুনশি সাহেব আসছেন না। সন্ধ্যা পুরোপুরি মিলিয়েছে। আকাশে আলোর আভা নেই। শত শত জোনাকি পোকা বের হয়েছে। অনেকদিন পর একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখলাম।
এক যাত্রায় অনেক অভিজ্ঞতা। শাওন সঙ্গে থাকলে বলতাম, জোনাকি ঝিকিমিকি গানটা করো তো। সঙ্গে সঙ্গে সে গান ধরত কি না জানি না। বিয়ের আগে তাকে গান গাইতে বললে এক সেকেন্ডের মাথায় গান ধরত। বিয়ের পর সাধ্যসাধনা করতে হয়।
পুত্র নিষাদকে খুব মিস করছি। একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখে সে কী কত কে জানে। নুহাশপল্লীতে মাঝে মাঝে কিছু জোনাকি পোকা দেখা যায়। নিষাদ তাদের ধরার জন্য পেছনে পেছনে ছছাটে। তার কী আনন্দ!
শিশুর দল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত বাড়িতে তাঁদের করার কিছু নেই। বাবা-মারাও চান না তারা ঘরে ফিরুক।
আমি সর্পরাজকে বললাম, তোমার ম্যাজিক মুনশি সাহেব সম্ভবত আসবেন। আমি আমার কেবিনে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ একা থাকব।
লেখালেখি করবেন?
কাগজে-কলমে করব না, মনে মনে করব।
মনে মনে কীভাবে লিখবেন?
আমি বললাম, লেখকরা মনে মনে যত লেখা লিখেন তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ লিখেন কাগজে কলমে।
সর্পরাজ পান মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, অয় অয়। তার অয় অয় ধ্বনির পরপরই সোনালি মেয়েটি প্রায় দৌড়ে উপস্থিত হয়ে প্রথমে আমাকে তারপর সর্পরাজকে কদমবুসি করল। সর্পরাজ এই ঘটনায় কোনো অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পেল না। তরুণী মেয়েরা ছুটে এসে তাকে কদমবুসি করবে এটাই যেন স্বাভাবিক। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ব্যাপার কী?
সোনালি বলল, আপনি আমাকে সিনেমায় রোল দিবেন এটা শোনার পর থেকে মাথা আউলা হয়ে গেছে।
ঝোল দেব তোমাকে কে বলেছে?
ম্যানেজার স্যার বলেছেন।
সামনের চেয়ারটায় বসো।
মেয়েটি বসল। আমি বললাম, পড়াশোনা কতদূর করেছ?
ইন্টার পর্যন্ত পড়েছি। পরীক্ষা দিতে পারি নাই। পরীক্ষার আগের দিন ডিরেক্টর সবুজ ভাই বললেন, ব্যাংককে ধারাবাহিক নাটক করব, ভগ্ন সৈকত। চলো আমাদের সঙ্গে, একটা সাইড রেলি দিয়ে দিব।
সাইড রোল পেয়েছিলে?
জি-না। আমি আর সবুজ ভাই ব্যংককে গেলাম শনিবারে। রোববারে নাটকের দলের বাকি সবার আসার কথা। তারা ভিসা পায় নাই বলে আসতে পারল না।
তুমি সবুজ ভাইয়ের সঙ্গে কত দিন ব্যংককে ছিলে?
সাত দিন। সবুজ ভাই অপেক্ষায় ছিলেন যদি নাটকের দল চলে আসে। ব্যাংককে খুব মজা করেছিলাম। সবুজ ভাই খুব আমুদি মানুষ।
তুমি এখন যাও। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
সোনালি আনন্দিত গলায় বলল, আপনার মাথা বানায়ে দিব স্যার? আমি নাপিতের চেয়েও ভালো মাথা মালিশ করতে পারি।
আমি বললাম, মা মালিশ করতে হবে না।
সর্পরাজ বলল, দেখি আমার মাথা বানাও। মাথা বানানি কেমন হিখছ পরীক্ষা হউক।
সোনালি মহানন্দে সর্পরাজের মাথার চুল টানতে লাগল। আমি কেবিনের দিকে রওনা হলাম।
কেবিনে বসে আছি। নুহাশপল্লীর ম্যানেজার দুটি মোমবাতি এবং একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। দুটি মোমবাতির একটি বাতাসের ঝাপটায় নিভে গেছে। অন্যটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের বিরুদ্ধে তার জীবনযুদ্ধ দেখতে ভালো লাগছে।
ম্যানেজার বলল, স্যার আপনার জন্য একটা খাসি ছদকা দিয়েছি।
কেন?
আল্লাহপাক আপনার জীবন রক্ষা করেছেন এইজন্য।
ছদকার সিস্টেমটা কী? কোনো গরিব মানুষকে খাসি দিয়ে দেওয়া হয়েছে?
ম্যানেজার বলল, মুরগি দুদকায় এই বিধান। গরু-খাসির বেলায় অন্য বিধান। আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়। যার নামে ছদকা সে খেতে পারে না। অন্যরা পারে। আপনি যাতে খেতে পারেন তার জন্য আলাদা একটা খাসি কাটা হয়েছে। খানা দিতে সামান্য বিলম্ব হবে।
হোক বিলম্ব। এখন সামনে থেকে যাও।
আমি আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে আছি। ম্যাজিক মুনশির কারণেই হয়তো মাথায় ঘুরছে ম্যাজিক।
বলা হয়ে থাকে ম্যাজিকের শুরু প্রাচীন মিসরের ফারাওদের সময়ে। ফারাওরা (ফেরাউন) ছিলেন ম্যাজিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাদের রাজসভাতে নামী ম্যাজিশিয়ানরা মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকতেন। অবিশ্বাস্য সব কর্মকাণ্ড করে আঁরা সম্রাটকে আনন্দ দান করতেন। পবিত্র কোরান শরীফ এবং বাইবেলে তার উল্লেখ আছে।
সূরা আরাফের ১১৫ থেকে ১১৭ নম্বর আয়াতে আছে—
তারা (জাদুকররা) বলল, হে মুসা! তুমি ছুড়বে না আমরা ছুড়ব? মুসা বলল, তোমরাই ছোড়ো। যখন তারা ছুড়ল লোকের চোখে ভেলকি লেগে গেল। এবং তারা ভয় পেয়ে গেল যেন তারা ভোজবাজি দেখছে।
মুসার প্রতি আমি হুকুম করলাম, তুমিও তোমার লাঠি ছোড়। হঠাৎ লাঠিটা ওদের ভুয়া সৃষ্টি গ্রাস করে ফেলতে
লাগল। এখানে কিন্তু লাঠির সাপ হয়ে যাওয়ার কথা নেই। বাইবেলে আছে। বাইবেলে মুসা (আঃ)-এর কথা বলা হয় নি। বলা হয়েছে তার ভাই এরন-এর কথা।
এরন প্রথমে তার লাঠি ফেললেন, সেটা সাপ হয়ে গেল। তখন ফেরাউনের নির্দেশে তার জাদুকররা লাঠি ফেলল। সেগুলি সাপ হয়ে গেল। তখন এরনের সাপ সবগুলিকে গিলে খেয়ে ফেলল। {Exodus vil 10, 11, 12}
ঊনবিশং শতাব্দীর বিখ্যাত জাদুকর রবার্ট হেলার (১৮৩৩-১৮৭৮) দাবি করেন তিনি লাঠি সাপ হয়ে যাওয়ার জাদু কায়রো শহরে বেশ কয়েকবার দেখেছেন। তিনি এই জাদুর ব্যাখ্যাও করেন। তার মতে লাঠিটা আসলেই সাপ। হিপনোটিক পদ্ধতিতে কিংবা কোনো ড্রাগ খাইয়ে সাপকে শক্ত লাঠির মতো করা হয়। সাপকে ছুড়ে ফেললে তার হিপনোটিক spell কিংবা ড্রাগের প্রভাব কেটে যায়।
অতি প্রাচীন ম্যাজিকের কিছু তথ্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামের লাইব্রেরিতে সংক্ষিত আছে। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের ৩৭৬৬ বছর আগে সম্রাট কুফুর দরবারে এই জাদু দেখানো হয়। জাদুকরের নাম চাচা আংখ (Tchatcha-en-ankk}, জাদুকর একজনের মাথা কেটে তা জোড়া দিয়ে সম্রাটের বিস্ময় উৎপাদন করেন।
আধুনিক জাদুকররা ইলেকট্রিক করাতে তরুণীর দেহ দুভাগ করে আবার জোড়া দেন। এই কাজে তাদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়। প্রায় চার হাজার বছর আগেকার জাদুকরের হাতে নিশ্চয়ই এই প্রযুক্তি ছিল না। সম্রাট কুফুর দরবারের জাদুকর কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।
স্যার আসব?
আমি চমকে তাকালাম। দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তিনিই যে ম্যাজিক মুনশি তাতে সন্দেহ রইল না। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। মুনশি মাওলানারা দাড়ি রাখেন। গোঁফ রাখেন না। পানি পান করার সময় গোফ পানি স্পর্শ করলে পানি নষ্ট (বা হারাম হয়ে যায়, এই কথা প্রচলিত। যদিও হজরত আলী (রাঃ) -র গালপাট্টা ছিল। গোঁফ ছিল, দাড়িও ছিল।
দরজার সামনে যিনি দাড়িয়ে আছেন তার মাথার চুল গ্রামের বয়াতিদের মতো লম্বা। মধ্যবয়স্ক মানুষ। অত্যন্ত সুপুরুষ। চোখের তারা ঘন কালো। চোখ যক্ষা রোগীর মতো ঝকমক করছে। তবে মানুষটির যক্ষা নেই। থাকলে খুকখুক কাশি শুনতাম।
মুনশি সাহেব সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। নবিজী (দঃ) সবুজ রঙ পছন্দ করতেন। তার মাথার পাগড়ি ছিল সবুজ। ম্যাজিক মুনশির সবুজ পাঞ্জাবির পেছনে নবিজীর (দঃ) পছন্দের রঙ কাজ করতে পারে।
তিনি পাঞ্জাবির সঙ্গে লুঙ্গি পরেছেন। লুঙ্গির রঙ ধবধবে সাদা। পায়ে খড়ম। বিশেষ ধরনের খড়ম। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই খড়মকে বলে বউলওয়ালা
খড়ম।
আপনিই কি ম্যাজিক মুনশি?
জি জনাব। আসসালামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার খবর অনেক আগে পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আসা উচিত ছিল। মাগরেবের নামাজ শেষ করে এসেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি বললাম, ক্ষমা করার মতো কোনো অপরাধ আপনি করেন নি। ভাই, ভেতরে আসুন।
ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন। আতরের গন্ধে কেবিন ভরে গেল। আতরটা সাধারণ আতরের মতো না। চা-পাতা জাল দিলে চায়ের যে মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায় সেই গন্ধ। চা-পাতা থেকে আতর তৈরি হয় বলে আমার জানা নেই।
ভাই বসুন।
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, শাজারাতি মুমবারাকাতিন যাইতুনাতিন।
আমি বললাম, এর অর্থ কী?
মুনশি বললেন, এটা সূরা আননুনের একটা আয়াত। এর অর্থ পূতপবিত্র জয়তুন বৃক্ষ। আপনি আমার আতরের গন্ধে চমকেছেন। এই আতরটা জয়তুনের তেল থেকে তৈরি।
আমি চমকেছি কীভাবে বুঝলেন?
আপনার চোখের তারা চমকায়েছে। তার থেকে বুঝেছি।
আতরের গন্ধেই যে চমকেছি তা তো নাও হতে পারে।
আপনার চোখের তারা যখন চমকায়েছে তখন নাকের চামড়াও কুঁচকেছেন, সেই থেকে বুঝেছি।
আমি বললাম, আপনার পর্যবেক্ষণশক্তি ভালো। আমি বেশ অবাক হয়েছি। আপনার আতর খানিকটা কি আমাকে দিতে পারবেন? আমি আমার স্ত্রীকে দিতাম। অদ্ভুত আতরের গন্ধে সে খুশি হবে। সুগন্ধির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে।
মুনশি কিছু বললেন না। হাসলেন। ভদ্রলোকের হাসি সুন্দর।
আমি বললাম, শুনেছি আপনি খুব ভালো ম্যাজিক দেখান। আপনার কাছে নাকি জুয়েল আইচ শিশু। জুয়েল আইচকে চিনেছেন তো?
জি জনাব। বাংলাদেশে বাস করব উনাকে চিনব না, তা হয় না।
তাঁর কোনো জাদু কি দেখেছেন?
জি-মা। হাওর অঞ্চলে থাকি, কীভাবে দেখব?
আমি বললাম, মসজিদের একজন ইমাম জাদু দেখান এই প্রথম শুনলাম।
মুনশি জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে তিনি কম কথা বলেন। ভদ্রলোকের ভাষা শুদ্ধ, কিছুটা পোশাকি। বাড়ি মনে হয় সিলেট অঞ্চলে না। তবে কিছুদিন সিলেটে থাকলে ভাষায় সিলেটি ঢুকে যাওয়ার কথা। সিলেটি ভাষার আগ্রাসী রূপ আছে। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত কাহিনী বলি—
নিউইয়র্ক বইমেলায় গিয়েছি। আমি এবং শাওন গানের একটা অনুষ্ঠান দেখব। বইমেলার আয়োজক বিশ্বজিৎ সাহার জনৈক কর্মচারীর হাতে দুঘণ্টার জন্যে পুত্র নিষাদকে ছেড়ে দিয়েছি। নিষাদের বয়স তিন। বিশ্বজিতের কর্মচারীর নাম শাহীন, বাড়ি সিলেট।
দুঘণ্টা পর ফিরে আসতেই নিষাদ বলল, বাবা, আইসক্রিম খাইমু।
এই দুঘণ্টাতেই তার ভাষায় সিলেটি ঢুকে পড়েছে।
আমি ম্যাজিক মুনশির দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি কি চা খাবেন?
মুনশি বললেন, চা খাব না। চা খেলে অজু ভেঙে যাবে। এশার নামাজ শেষ করে চা খাব।
আপনার পড়াশোনা কতদূর?
খুবই সামান্য। উলা পাশ করেছি। মৌলানায়ে মুহাদ্দেস হওয়ার ইচ্ছা ছিল। দরিদ্র ঘরের সন্তান। অর্থের অভাবে পড়তে পারি নাই। কোরানে হাফেজ হওয়ার শখ ছিল। মেধার অভাবে পারি নাই।
মাঝখান থেকে ম্যাজিক শিখে ফেলেছেন?
ম্যাজিক মুনশি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছু বললেন না।
আমি বললাম, এখন কি আমি আপনার ম্যাজিক দেখব?
আপনি চাইলে অবশ্যই দেখবেন।
আমি ম্যাজিক দেখার প্রস্তুতি নিলাম।
অদ্ভুত কিছু দেখবু তা ভাবলাম না। গ্রামের মুনশি মানুষ শুত ম্যাজিক জানবেন কীভাবে? দড়ি কেটে জোড়া লাগানো, কিংবা পয়সার কোনো খেলা।
তবে ম্যাজিশিয়ান না এমন অনেকের কাছ থেকে আমি বিস্ময়কর কিছু ম্যাজিক দেখেছি। অভিনেতা রহমত (বিভাগীয় প্রধান, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এমন একজন।
নাটকের শুটিং শেষে রহমতকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ সে বলল, স্যার একটা কয়েন দিন।
আমি কয়েন দিলাম। রহমত বলল, স্যার দেখুন কয়েনটা ঘসতে ঘসতে কীভাবে ভ্যানিশ করি। বলেই সে কয়েনটা বাঁ হাতের কনুইতে ঘসতে শুরু করল। চোখের সামনে কয়েন অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আমার এক শিক্ষক ড. তৌফিকুর রহমান অপূর্ব সব তাশের ম্যাজিক জানেন।
একবার নুহাশপল্লীতে রাত্রি যাপন করতে এসে আমাদের এক ঘণ্টা তাশের ম্যাজিক দেখিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন।
পামিং-এর অদ্ভুত এক কৌশল আমি দেখেছিলাম একজন মাঝির কাছে। সে নিজের মনে সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লুকিয়ে ফেলল। তার দুটা হাতই আমার সামনে মেলে ধরা। হাতে সিগারেট নেই। অথচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধােয়া আসছে।
সিগারেট পামিং-এর কৌশল আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। তবে তার মতো ভালো পারি না।
ম্যাজিক মুনশি কী করবে কে জানে!
ম্যাজিকের জন্যে কেবিনঘর খুব উপযুক্ত
ম্যাজিকের জন্যে কেবিনঘর খুব উপযুক্ত। আলো কম। দুটি মোমবাতি, একটি হারিকেন। বাতাস আটকানোর জন্যে কেবিনের জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দর্শক আমি একা। সর্পরাজ ভেতরে আসতে চাচ্ছিল। আমি দেই নি। ম্যাজিক মুনশির গায়ের অদ্ভুত চা-পাতা গন্ধওয়ালা আতরের স্নিগ্ধ গন্ধ নষ্ট হোক তা চাই নি। সর্পরাজ ঢুকবে জর্দার কড়া গন্ধ নিয়ে। তার এই স্পেশাল জর্দা নাকি ইন্ডিয়া থেকে আসে। জর্দার নাম গোপাল জর্দা।
আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললাম, ভাই দেখন একটা ম্যাজিক।
স্যার, আপনার সিগারেটটা টেবিলে শুইয়ে রাখুন।
আমি তাই করলাম। সিগারেট গড়াতে গড়াতে আমার দিকে আসতে শুরু করল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি সিগারেট ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে। ম্যাজিক মুনশি শীতল চোখে তাকিয়ে আছে সিগারেটের দিকে।
চমকে ওঠার মতো কোনো ম্যাজিক না। এর কৌশল অত্যন্ত সহজ। সিগারেটে মুখ দিয়ে ফুঁ দিতে হয়। ফুটা এমনভাবে দিতে হয় যেন দর্শক দেখতে না পারে। নিচের ঠোঁট খানিকটা ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে ফুঁ দেওয়া নিয়ম। এইসময় মাথা খানিকটা ঝুঁকে থাকবে যেন দর্শক স্পষ্টভাবে ঠোঁট দেখতে পারেন। একই পদ্ধতিতে বই হাতে নিয়ে ফুঁ দিলে আপনাআপনি বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। যারা ম্যাজিকের ভেতরের কৌশল জানেন না তারা ঘটনা দেখে চমৎকৃত হন। সমস্যা হচ্ছে আমি কৌশলটা জানি।
কৌশল জানার পরেও ম্যাজিকের শেষ পর্যায়ে এসে চমকাতে হলো। সিগারেটটা আমার খুব কাছাকাছি এসে শোয়া অবস্থা থেকে দাড়িয়ে পড়ল। ফিল্টারটা নিচে, সাদা অংশ উপরে।
ফুঁ দেওয়ার কোনো বিশেষ টেকনিকে এটা কি করা সম্ভব? আমি জানি না। সিগারেটের মাথায় অদৃশ্য সুতা লাগিয়ে এটা করা যাবে। অদৃশ্য সুতা বিদেশের ম্যাজিক স্টোরে পাওয়া যাবে। ম্যাজিক মুনশি এই অদৃশ্য সুতা কোথায় পাবে! বিদেশ থেকে তার কোনো আত্মীয়স্বজন কি পাঠিয়েছে?
ধরে নিলাম পাঠিয়েছে। সুতার একটা মাথা সিগারেটের মাথায় লাগাতে হবে। ম্যাজিক মুনশি সেই সুযোগ তো পায় নি। সিগারেট সবসময় আমার হাতে ছিল।
আমি বললাম, আপনার ম্যাজিক দেখে ধাক্কার মতো খেয়েছি। এত সুন্দর ম্যাজিক কোথায় শিখেছেন?
মুনশি বলল, স্যার! কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। আপনার কাছে। তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
আপনি কি এই সিগারেটট শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে পারবেন?
না। তবে আমি নিজে কিছুক্ষণ শূন্যে ভেসে থাকতে পারি।
কতক্ষণ?
এক মিনিট।
মাটি থেকে কতদূর উপরে ভাসতে পারেন?
ছয় সাত ইঞ্চি, এর বেশি না।
শূন্যে ভাসার ম্যাজিককে বলে Levitation। এক দেড় মিনিট অনেক ম্যাজিশিয়ানই শূন্যে ভাসতে প ন। কৌশলটা আমার জানা আছে, তবে নিজে কখনো করি নি। শূন্যে ভাসার একটা Optical illuston করা হয়। চক্ষুবিভ্রমের জন্যে দরকার একজোড়া সাধারণ কাপড়ের জুতা।
ডেভিড ব্রেইন নামের আর রিকান স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান এই খেলা পথেঘাটে দেখান।
আমি বললাম, শূন্যে ভাসার ম্যাজিকটা দেখানোর সময় কি আপনার পায়ে জুতা থাকে?
ম্যাজিক মুনশি বললেন, জি-না স্যার।
পায়ে খড়ম থাকে?
না। তবে খড়ম থাকলেও কোনো সমস্যা নাই।
তাহলে তো পায়ে জুতা থাকলেও কোনো সমস্যা নেই।
জি-না স্যার।
আমি পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে বললাম, আমি আপনাকে একটা ম্যাজিক দেখাব। দেখি আপনি কৌশলটা ধরতে পারেন কি না।
ম্যাজিক মুনশি শিশুসুলভ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। আমি মুদ্রাটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিলাম। বাঁ হাতের মুঠি বন্ধ করলাম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে মুঠিবদ্ধ হাতের কাছে নিয়ে বললাম, খ সিগারেট খা। পাঁচ টাকার কয়েন খা।
হাতের মুঠি খুললাম। কয়েন নেই। সিগারেটে কয়েকবার ঝাকি দিতেই কয়েন বের হলো! যেন কয়েনটা সিগারেটের ভেতর ছিল। কঁকি দেওয়ায় বের হয়েছে।
ম্যাজিক মুনশি মুগ্ধ গলায় বলল, অদ্ভুত! সোবাহানাল্লাহ!
আমি চিন্তায় পড়লাম। এই খেলাকে অদ্ভুত বলার কিছু নেই। পামিং-এর অতি সাধারণ কৌশল। পামিং ম্যাজিকের ভাষা। এর অর্থ হাতের তালুতে কোনো বস্তু লুকিয়ে রাখা। সব ম্যাজিশিয়ানকেই অল্পবিস্তর পামিং জানতে হয়। এই পামিং শিখতে বৎসরের পর বৎসর লাগে। তবে বর্তমানের আধুনিক ম্যাজিকে পামিং লাগে না। নতুন প্রযুক্তি জাদুকরকে পামিং শেখার দীর্ঘ ক্লান্তিকর শিক্ষানবিশীর কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আমি ম্যাজিক মুনশির চোখমুখ দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছি তিনি পামিং বিষয়টা জানেন না। আমি বললাম, আপনি কি সিগারেটের পয়সা গিলে ফেলার কৌশলটা শিখতে চান? আপনি শিখতে চাইলে আমি শিখাতে পারি।
জনাব আপনার মেহেরবানি।
এই দেখুন মুদ্রাটা আমি ডান হাতের তালুতে নিলাম। ডান হাত থেকে বাম হাতের তালুতে দেখেছেন?
জি।
আমি কিন্তু বাম হাতের তালুতে মুদ্রাটা নেই নি। ডান হাতের তালুতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। একে বলে পামিং। বাংলায় বলে হাতসাফাই। হাতসাফাই শব্দটি শুনেছেন না?
শুনেছি।
আপনি হাতসাফাই জানেন না?
জি-না। স্যার আরেকটা ম্যাজিক দেখান।
আমি একটা কাগজ নিয়ে তাকে না দেখিয়ে লিখলাম—গোলাপ। কাগজটা বলের মতো বানিয়ে ম্যাজিক মুনশির হাতে দিয়ে বললাম, একটা ফুলের নাম বলুন।
তিনি বললেন, গোলাপ।
আমি কাগজের বল খুলে গোলাপ লেখাটি তাকে দেখিয়ে বললাম, আপনি যে গোলাপ বলবেন আমি আগেই সেটা জানতাম।
ম্যাজিক মুনশি বলল, স্যার অবাক মানলাম।
আমি বললাম, অবাক মানার কিছু নেই। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে কোনো একটা ফুলের নাম বলতে বলা হলে সে বলবে গোলাপ। কাজেই আমি কাগজে গোলাপ লিখে আপনার হাতে দিয়েছি। আমি ধরেই নিয়েছি আপনি শতকরা ৮০ ভাগের মধ্যে পড়বেন।
যদি গোলাপ না বলে অন্য কোনো ফুলের নাম বলতাম?
তাহলে ম্যাজিকটা করতে পারতাম না। আমি যে গোলাপ লিখে তার হাতে দিয়েছি তা জানতাম না। কাগজের গোল্লাটা দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করতাম। আচ্ছা মুনশি সাহেব, আপনি ম্যাজিক দেখান কেন?
পুলাপানরা আনন্দ পায় এইজনো দেখাই। বড়দের দেখাই না।
বড়রা আনন্দ পায় না?
জি-না। আনন্দ পাওয়ার জন্যে অবাক হতে হয়। বড়রা অবাক হয় না। তারা বলে, এইগুলান কিছু না, যন্ত্র।
আমি বললাম, মন্ত্র কি আছে?
ম্যাজিক মুনশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, স্যার আপনার এই প্রশ্নের জবাব দিব না। বেয়াদবির জন্য ক্ষমা চাই। স্যার, যদি আপনি আমাকে আধঘণ্টা সময় দেন তাহলে এশার নামাজটা পড়ায়ে আবার আসব।
নামাজ পড়িয়ে আসুন। আমরা রাতের খাবার একসঙ্গে খাব। আপনার অনেক মেহেরবানি।
ম্যাজিক মুনশি চলে যাওয়ার পর লক্ষ করলাম আমার সিগারেটের প্যাকেটের উপর একটা গোলাপ ফুল। এই ফুল আগে ছিল না। আমি গোলাপ ফুলের নাম নিয়েছি বলেই কি সিগারেটের প্যাকেটের উপর গোলাপ? বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া আমার পথ রইল না।।
এই লোকটির ম্যাজিক কোন পর্যায়ের? প্রাচীন ম্যাজিক দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল। একটিকে বলা হতো আসল ম্যাজিক। অন্যটিকে বলা হতো ভোজবাজি বা নকল ম্যাজিক।
ভোজবাজি শব্দটা এসেছে মালব দেশের রাজা ভোজরাজার কাছ থেকে। তিনি হাতসাফাই-এর খেলায় একজন গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন। ভোজরাজ মাসে একবার প্রজাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যে জাদুর খেলা দেখাতেন। রাজার একমাত্র মেয়ে ভানুমতি খেলা দেখানোয় বাবাকে সাহায্য করতেন। এই কারণেই জাদুবিদ্যার আরেক নাম ভানুমতির খেলা। আমাদের দেশের বেদিনীরা ভানুমতির খেলা নাম দিয়েই ম্যাজিক দেখায়।
ভারতের রোপ ট্রিককে আসল ম্যাজিকের পর্যায়ে ফেলা হয়। এই ম্যাজিকে জাদুকর তার সন্তান এবং এক গাছ দড়ি হাতে নিয়ে উপস্থিত হন।
ম্যাজিক শুরু হওয়ার পর দড়ি আপনাআপনি শূন্যে উঠে স্থির হয়ে যায়। তখন জাদুকরপুত্র দড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। অনেকদূর উঠে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর ম্যাজিশিয়ান ধারালো তলোয়ার কামড়ে ধরে দড়ি বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জাদুকরপুত্রের আর্তনাদ শোনা যায়। তার শরীরের কাটা অংশ একে একে শূন্য থেকে নিচে পড়তে থাকে। দর্শকরা আতংকে অস্থির হয়ে পড়েন। তখন জাদুকর দড়ি বেয়ে নেমে আসেন। পুত্রের শরীরের খণ্ড খণ্ড অংশগুলি ঝুড়িতে ভরে, ঝুড়ি চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জাদুকরপুত্র চাদর সরিয়ে বের হয়ে আসে। এই দড়ির ম্যাজিকের অনেক ভেরিয়েশন আছে, তবে মূলটা এক।।
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এই খেলা দেখেছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনামায় তার চমৎকার বর্ণনা লিখে গেছেন। সম্রাট বানিয়ে বানিয়ে জাদুকরের খেলা নিয়ে লিখবেন তা মনে হয় না।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজসভায় (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ) ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত Sir Tomas Roe নিজেও ছিলেন। তিনিও তার আত্মজীবনীতে বোপ ট্রিকের কথা লিখে গেছেন। তাঁর লেখায় একটি মজার তথ্য আছে। যে সাতজন জাদুকর সেদিন রাজসভায় অদ্ভুত সব জাদু দেখিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন বাঙালি। Sir Jomas Roe-র ভাষায় Seven Bengali jugglers।
সম্প্রতি আমার হাতে একটি বই এসেছে (জাদুবিদ্যার মাধ্যমে আপনাআপনি আসে নি, আমি নিউইয়র্ক থেকে কিনেছি), নাম The Rise of the Indian Rope Trick. লেখকের নাম Peter Lamort।
লেখক ২৫০ পৃষ্ঠার বই লিখে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন রোপ ট্রিক নামের কোনো কৌশল ভারতবর্ষে ছিল না। পুরো বিষয়টি কল্পনাবিলাসী ব্রিটিশদের বানানো।
আমি বইটির যুক্তির সঙ্গে একমত হব কি না বুঝতে পারছি না। অকারণে অদ্ভুত এক জাদু নিয়ে মিথ তৈরি হয় না।
জুয়েল আইচের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। তিনিও Peter Lamon এর সঙ্গে একমত। তারও ধারণা এটা মিথ। সাধারণ মানুষ মিথ তৈরি করতে ভালোবাসে বলেই মিথ তৈরি হয়। জাদুকর পি সি সরকারকে নিয়েও
এরকম একটা মিথ আছে। মিথটা এরকম—
হলভর্তি দর্শক। সাতটার সময় শো শুরু হওয়ার কথা। পি সি সরকার আসছেন না। তিনি এক ঘণ্টা পর রাত আটটায় উপস্থিত হলেন।
দর্শকরা চেঁচাচ্ছে, এক ঘণ্টা লেট। এক ঘণ্টা লেট।
পি সি সরকার বললেন, লেট হব কেন? আপনারা ঘড়ি দেখুন। সবাই দেখল, তাদের প্রত্যেকের ঘড়িতে সাতটা বাজে।
বলা হয়ে থাকে ঘড়ির এই মিথ ছড়ানোর পেছনে পি সি সরকারের নিজের ভূমিকা আছে। এই মিথ ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে তার উপর চড়াও হয়েছিল। গল্পটা বলা যেতে পারে।
পি সি সরকার রঙ্গমঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন। হলভর্তি মানুষ। হঠাৎ দর্শকদের একজন বলল, আমরা ঘড়ির ম্যাজিকটা দেখতে চাই।
পি সি সরকার ভান করলেন যেন শুনতে পান নি। তিনি তাঁর জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন। দর্শকদের গুঞ্জন শুরু হলো। এক পর্যায়ে সব দর্শকই বলল, আমরা ঘড়ির জাদু দেখব। অন্য জাদু না।।
পি সি সরকারকে জাদু প্রদর্শনী বন্ধ করতে হলো।
মিথ হিসেবে পরিচিত ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিকে ফিরে যাই। লাসভেগাসের এক জাদু অনুষ্ঠানে আমি ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক দেখেছি। জাদুকরের নাম মনে নেই। চমৎকার llusion। স্টেজে জাদু দেখানো আর পথেঘাটে জাদু দেখানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক পথেঘাটে দেখানো হতো।
আমার দাদাজান মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ দাবি করেন দড়ির জাদুর এই খেলা তিনি শম্ভুগঞ্জের হাটের দিন অনেকের সঙ্গে দেখেছেন। দাদাজান মাদ্রাসার শিক্ষক, কঠিন মৌলানা। মিথ্যা কথা তিনি বলবেন তা কখনো হবে না। তারপরও আমার ধারণা তিনি মিথ্যা বলেছেন। এই ধারণার পিছনে কারণ ব্যাখা করি।
দাদাজান গল্প করেছেন আমার সঙ্গে। আমার বয়স তখন পাট কিংবা ছয়। শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বানিয়ে গল্প বলা যেতে পারে। তিনি আমার সঙ্গে একদিন মৎস্যকন্যা দেখার গল্পও করলেন। জেলেদের জালে এক মৎস্যকন্যা ধরা পড়ল। তার কোনো হাত নেই। গাত্রবর্ণ নীল। সে শুশুকের মতো ভোঁস ভোস শব্দ করছিল। মৎস্যকন্যা বলে কিছু নেই। কাজেই মৎস্যকন্যার গল্পটি বানানো। যিনি একটি বানানো গল্প করতে পারেন তিনি আরও বানানো গল্প করতে পারেন।
বাকি থাকল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী। এই সম্রাট ডুবে থাকতেন মদ, আফিং এবং চরসের নেশায়। নেশাগ্রস্ত একজন মানুষ কী দেখতে কী দেখেছেন কে জানে!
প্রাচীন ভারত ছিল জাদুবিদ্যারই দেশ। বেদেরা জাদু দেখাত, সাধুসন্ন্যাসীরা জাদু দেখাতেন। জাদুর দেশ কামরূপ কামাক্ষা নিয়ে গল্পগাঁথা এখনো চালু।
যেসব বিদেশী পর্যটক ভারতবর্ষে এসেছিলেন, মার্কোপোলো (Marco Polo} তাঁদের একজন। তিনি কাশ্মিরের এক জাদুকরের কথা লিখেছেন, যিনি আবহাওয়া পরিবর্তন করতে পারতেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনকে অন্ধকার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, যা মার্কোপোলো নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। (মার্কোপোলো তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে অনেক আজগুবি কথা লিখে গেছেন। তাঁর বক্তব্য বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর আজগুবি কাহিনীর উদাহরণ : আন্দামানে তিনি একদল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। আচার-আচরণও কুকুরের মতো। তার প্রকাশ্যে যৌনক্রীড়া করে।
আবহাওয়া পরিবর্তনকারী জাদুকর এই বাংলাদেশে কিন্তু এখনো আছে। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষায় তাদের ব্যবহার করা হয়। তারা ফকির নামে পরিচিত। এমন একজনের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। তিনি কিছু মন্ত্র বলেছেন, যা আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। আমার স্মৃতিশক্তি মোটামুটি ভালো হলেও বৃতিশক্তি একেবারেই নেই। ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রের প্রথম দুটি লাইন মনে আছে—আলী কালী লালী ত্রিভুবন খালি। মন্ত্রের আলী কি হযরত আলী (রঃ)? কালী কি হিন্দু দেবী? আমি জানি না। লালী কি খালির সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্য?
মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীতে ভারতীয় জাদুকরদের অদ্ভুত সব জাদুর কথা আছে। শূন্যে ভেসে থাকা তার একটি। ইবনে বতুতা একবার জাদু দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন এই তথ্যও উল্লেখ আছে।
আমারও একবার ম্যাজিক দেখে জ্ঞান হারাবার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শৈশবের গল্প। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। সুযোগ পেলেই একা একা শহরে হেঁটে বেড়াই। মূল আকর্ষণ সিনেমা হলের পোস্টার। একদিন দিলশাদ সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। অদ্ভুত ম্যাজিক। কাঠের এক তার সঙ্গে গা লাগিয়ে দুহাত যীশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ ভঙ্গিতে তুলে এক মায়াকাড়া চেহারার বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরীটির দশ-বার ফুট দূরত্বে চোখ বাঁধা অবস্থায় ম্যাজিশিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতভর্তি চুরি।
তিনি বালিকাটির দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুরি ছুড়ে মারছেন। ছুরি বালিকার গা ঘেঁষে বিধে যাচ্ছে, বালিকাটির গায়ে লাগছেন না। তাকে ঘিরে ছুরির বলয় তৈরি হলো। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ম্যাজিক।
সেদিনই আমি প্রথম ম্যাজিকের প্রেমে পড়ি। ছুরি ছুড়ে মারার এই ম্যাজিকের কৌশল খুব সাধারণ। সব ছুরি কাঠের তক্তার পেছনে স্প্রিং দিয়ে লাগানো। ছুরিগুলি পেছন থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। দেখে মনে হয় ম্যাজিশিয়ানের হাতের ছুরি কাঠে বিধছে। আসলে তা-না। দর্শকদের দৃষ্টি মেয়েটির দিকে থাকে বলেই ম্যাজিশিয়ান তার হাতের ছুরি কীভাবে সরাচ্ছেন তা কেউ দেখেন না।
বাবার কাছে গণপতি নামের এক বাঙালি জাদুকরের অদ্ভুত ম্যাজিকের কথা শুনেছি। বাবা তার জাদু দেখেছেন কমলা সার্কাসে। বাবার ভাষ্যমতে, গণপতির জাদু যে না দেখেছে তার জীবন বৃথা। পিসি সরকারের অবস্থান গণপতি বাবুর হাঁটুর নিচে।
জাদুকর গণপতি সম্পর্কে আমি তেমন কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারি নি। তিনি জমিদারপুত্র ছিলেন এই তথ্য পেয়েছি। শখের বসে জাদু শিখেছেন। অসম্ভব খেয়ালি মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গেই তার বনত না।
স্যারের অবস্থা কী? একা বসা। মুনশি গেল কই?
গোপাল জর্দার প্রবল গন্ধ নিয়ে আরজু ঢুকল।
আমি বললাম, মুনশি এশার নামাজ পড়াতে গিয়েছেন। নামাজ শেষ করে আসবেন। তিনি আমাকে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে গেছেন। গোলাপ ফুলে কোনো গন্ধ পাচ্ছি না। তুমি গন্ধ পাও কি না দেখো তো।
সর্পরাজ নানান ভঙ্গিমায় গোলাপ শুকতে লাগল। জর্দার কড়া গন্ধ ছাপিয়ে গোলাপের হালকা সৌরভ তার নাকে যাওয়ার কথা না। তবু সে চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
ইউরোপ-আমেরিকার চাষের গোলাপে কোনো গন্ধ থাকে না। দেখতে অপূর্ব সুন্দর কিন্তু গন্ধহীন।
সর্পরাজের হাতের গোলাপটা তা-ই। গন্ধহীন। গ্রামের গোলাপ গাছের গোলাপে গন্ধ থাকতেই হবে। গন্ধ নেই কেন?
গোলাপ নিয়ে আমি একবার এক জাদু দেখিয়ে জনৈক দর্শকের মাথা নষ্ট করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলাম। দর্শক ভারতীয়। কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। নিজেও কবিতা লিখেন। বাংলাদেশে এসেছেন জাতীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পাঠ করার জন্যে। আমার কিছু উপন্যাস তিনি দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় পড়েছেন। আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা। আমার অতি অপছন্দের বিষয় সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। ওল্ড ফুলস ক্লাব নামে আমাদের যে আডড্রার ক্লাব আছে সেখানে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
দুজন মুখোমুখি বসেছি। আমি যথেষ্টই বিরক্ত। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না তিনি সহজে উঠবেন। কাঁধের ঝুলি থেকে চটি এক কবিতার বই বের করে বললেন, দাদা, আমার নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থ। নাম দিয়েছি শিশিরভেজী বিষের শিশি। নামটা কেমন হয়েছে?
আমি বললাম, খুব সুন্দর হয়েছে। মনে মনে বললাম, ছাগল কোথাকার!
কবি বললেন, নামের শুরু হয়েছে শিশি দিয়ে, শেষও হয়েছে শিশিতে।
আমি বললাম, অদ্ভুত। মনে মনে বললাম, বাচ্চাদের পিসাবকে শিশি বলে। তুই শুরু করেছিস পিসাব দিয়ে শেষও করেছিস পিসাব দিয়ে।
কবি বললেন, বিষের শিশিতে শিশির মাখিয়ে আমি এক ধরনের কোমলতা আরোপ করেছি।
আমি বললাম, খুব ভালো করেছেন। কঠিন পৃথিবীতে কোমলতার প্রয়োজন আছে।
কবি বললেন, দশ কপি বই নিয়ে এসেছিলাম। কাড়াকাড়ি করে সবাই নিয়ে গেছে। এটা লাস্ট কপি বলে আপনাকে দিতে পারছি না। তবে দাদা, আমি সবগুলি কবিতা আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি।
আমি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কবি এবং কবিতার হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা আমি করেই রেখেছিলাম। সেই পথে অগ্রসর হলাম। আমি বললাম, আপনার সব কবিতা আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনব। প্রথমে যে-কোনো একটা ফুলের নাম বলুন।
কবি বললেন, গোলাপ।
আপনার কবিতার বইটির দিকে তাকান তো।
ভদ্রলোক চমকে তাকালেন এবং দেখলেন তার কবিতার বইয়ের উপর একটা টকটকে লাল গোলাপ।
হতভম্ব কবি বললেন, দাদা! কীভাবে করলেন?
আমি বললাম, আবার তাকান। ভদ্রলোক তাকালেন এবং দেখলেন লাল গোলাপ না, কালো গোলাপ।
দাদা! এটা কীভাবে করলেন? হিপনোটিজম নাকি মেসমেরিজম?
আমি বললাম, আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে আপনি বরং কবিতার বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকুন।
ভদ্রলোক তাকালেন এবং দেখলেন বইয়ে কোনো গোলাপ নেই। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, হে ভগবান।
আমি বললাম, আমি পাঁচ মিনিটের বেশি কারও সঙ্গেই কথা বলি না। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। আপনি চলে যান।
গোলাপ ফুল কোথায় গেল?
আমি বললাম, লাল এবং কালো গোলাপ দুটি গোলাপই আপনার কাপড়ের ব্যাগে থাকার কথা।
ভদ্রলোক ব্যাগ খুলে দুটা গোলাপ পেয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ ভীত চোখে তাকিয়ে অতি দ্রুত বিদায় নিলেন। তিনি শেষ কপি শিশিরভেজা বিষের শিশি সঙ্গে নিতে ভুলে গেলেন।
অতি জটিল এই জাদু কীভাবে দেখানো হলো তা এখন ব্যাখ্যা করি। প্রিয় পাঠক! দীর্ঘ দিনের প্র্যাকটিস ছাড়া এই জাদু দেখাতে যাবেন না। ধরা খাবেন এবং অপমানিত হবেন। সেধে বাড়িতে অপমান নিয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা না।
জাদুবিদ্যার অতি সাধারণ একটি কৌশল এই জাদুতে ব্যবহার করা হয়েছে। কৌশলটার নাম মিসডিরেকশন (Misdirection}, এর কোনো বাংলা নেই। দৃষ্টিভ্রান্তি বলা যেতে পারে।
একজন জাদুকর যখন জাদু দেখান দর্শক তার চোখ এবং হাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। জাদুকর যদি ছাদের দিকে তাকান, দর্শকরা ছাদের দিকে তাকাবেন। এর অন্যথা হবে না। দর্শকরা ছাদের দিকে তাকানো মাত্র misdirection তৈরি হলো। এই সময় জাদুকর তার হাত দিয়ে যা করেন দর্শক দেখবে না। জাদুকর দর্শকদের misdirection পথে চালনা করলেন।
আমি কবি সাহেবকে ম্যাজিক দেখানোর প্রস্তুতি নিয়েই বসেছিলাম। আমার পেছনে ছিল একটা লাল গোলাপ এবং একটা কালো গোলাপ। কবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বা দিকের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। কবিও তাকালেন। এই ফাঁকে আমি তার কবিতার বইয়ের উপর লাল গোলাপ রেখে দিলাম। ম্যাজিকের বাকি অংশ এখন নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। সবই মিসডিরেকশনের খেলা।
সাধারণত দেখা যায় অতি রহস্যময় ম্যাজিকের কৌশল খুবই সাধারণ। অকৃবর লেখা জাদুকাহিনী থেকে উদাহরণ দিচ্ছি।
জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রি সন্ধ্যাবেলা ইভিনিং ওয়াকে বের হতেন। বয়সের কারণে তাঁর সঙ্গে থাকত লাঠি (walking stick}, তিনি ছিলেন অঞ্চলের সবার অতিপ্রিয় শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। তিনি মাঝে মধ্যেই কোনো এক বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলতেন, পাত্রে তেল গরম করো। তেল যখন টগবগ করে ফুটত, তখন তিনি তার হাতের লাঠিটা তেলে ছোঁয়াতেন। সঙ্গে সঙ্গে পাত্রে একটা ডিমপোচ কিংবা অমলেট তৈরি হতো। মানুষের বিস্ময়ের সীমা থাকত না।
এই ম্যাজিকের মূল কৌশল লাঠির মাথায়। লাঠির মাথা ফাঁপা। সেখানে অমলেট বা ডিমপোচ করার জন্যে খোসা ছড়ানো ডিম ভরা থাকত। লাঠির মাথা থাকত মোম দিয়ে আটকানো।
গরম তেলে লাঠির মাথা রাখা মাত্র মোম গলে ডিম বের হয়ে আসত। তৈরি হতো অলৌকিক ডিমের অমলেট বা ডিমপোচ।
ওল্ড ফুলস ক্লাবেরু এক ম্যাজিক আসরের কথা বলি। ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন গোলাম মুরশিদ সাহেব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন কালো বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক শফি আহমেদ (গাত্রবর্ণের কারণে তাকে আমরা কালো বুদ্ধিজীবী বলি। তাঁকে ছোট করার জন্য না। শ্রীকৃষ্ণকেও কালো কৃষ্ণ বলা হয়। প্রকাশক আলমগীর রহমান আছেন। সুইডেনের লম্বু মাসুদ আছে। আমি আছি। কালো বুদ্ধিজীবী এবং গোলাম মুরশিদ সাহেব কঠিন সাহিত্য আলাপ শুরু করলেন। সাহিত্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য বললাম, আসুন আপনাদের একটা ম্যাজিক দেখাই। কাগজ কলম হাতে নিন।
গোলাম মুরশিদ কাগজ কলম হাতে নিলেন।
তিন ডিজিটের যে-কোনো একটা সংখ্যা লিখুন।
গোলাম মুরশিদ লিখলেন ৬৪১।
আমি বললাম, এটাকে উল্টে লিখুন (Reverse).
গোলাম মুরশিদ লিখলেন ১৪৬।
আমি বললাম, দুটোর বিয়োগফল বের করুন। বড়সংখ্যা থেকে ছোটটি বাদ দিন।
বাদ দিলেন। পাওয়া গেল ৪৯৫।
আমি বললাম, এই সংখ্যাটি আবার Reverse করুন। এবং এই দুটি সংখ্যা যোগ করুন।
৪৯৫+৫৯৪=১০৮৯
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে যে বইটি আছে (Minority Report) তার ১০৮ পৃষ্ঠা বের করুন। কারণ আপনার যোগফলের প্রথম তিনটি ডিজিট হলো ১০৮। তিনি তা-ই করলেন। আমি বললাম, আপনার পরের সংখ্যাটি ৯। কাজেই ১০৮ পৃষ্ঠার নবম লাইনটি বের করুন। নবম লাইন শুরু হয়েছে Head শব্দটি দিয়ে। পরীক্ষা করুন।
উপস্থিত সবাই চমকৃত হলেন। চমৎকৃত হওয়ারই কথা। কৌশলটা এবার ব্যাখা করি। অংকের নিয়ম অনুযায়ী যে যোগ-বিয়োগ করা হলো তার শেষ উত্তর সবসময় হবে ১০৮৯। যে-কোনো তিন সংখ্যা নিয়ে করলেই একই উত্তর (তিনটি সংখ্যা আলাদা আলাদা হতে হবে)।
কোনো এক ফাঁকে বইটির ১০৮ পৃষ্ঠার ৯ম লাইন দেখে রাখা মোটেই কঠিন কর্ম না।
অতি বিস্ময়কর একটি জাদুর কথা এখন বলি।
প্রাচীন বইপত্রে পাওয়া যায়—মিশরের জাদুকর Dedi একটি বিশেষ খেলা দেখিয়ে ফেরাউনদের বোকা বানিয়েছিলেন। তিনি দুটা হাঁস নিয়ে খেলাটা দেখাতেন। একটি ছিল ধবধবে সাদা, অন্যটি কুচকুচে কালো। জাদুকর দেদি মন্ত্র পাঠ করা মাত্র সাদা হাঁসটির মাথা চলে যেত কালো হাসে। কালো হাঁসটির মাথা যেত সাদা হাঁসে। হাজার হাজার বৎসর এই জাদুর কৌশল অজ্ঞাত ছিল।
১৯৩৫ সনে আমেরিকান জাদুকর নিজের চেষ্টায় জাদুর কৌশল বের করে ফেলেন। নিউইয়র্কের রঙ্গমঞ্চে জাদুটা দেখানো হয়। জাদুকরের নাম ডেভিড। তিনি ছদ্মনাম Fu Manchu ব্যবহার করতেন। তাঁর সাজপোশাক ছিল চীনাদের মতো।
Fu Manchuকে বিশ্বের সেরা জাদুকরদের একজন ধরা হয়। হাঁসের মাথা বদলের জাদুর কৌশলটা আমার জানা আছে। কৌশল ব্যাখ্যা করলে বিস্ময়বোধ নষ্ট কন্যা হবে। তা ঠিক না।
মুনশির জন্যে অপেক্ষা করছি
মুনশির জন্যে অপেক্ষা করছি। এশার নামাজ শেষ করতে সময় লাগবে। মুনশি মানুষ, নামাজ শেষ করে জিকিরে বসবেন। তাতে সমস্যা নেই। আমার হাতে অনেক সময়। রান্না শেষ হতে দেরি হবে। আমার সম্মানে (!) খাসি জবেহ করা হয়েছে। রান্না শেষ হতে সময় লাগারই কথা। ডিজেলের সন্ধানে যে গেছে সে এখনো ফিরে নি। ফিরলেও লঞ্চ রাতে রওনা হবে না।
আমি মুনশির বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। গ্রামের মানুষ অতিরঞ্জন পছন্দ করে। তাদের কাছে কাউকে বৃহস্যময় মনে হলে তার উপর অতিরিক্ত বানানো রহস্যময়তা আরোপ করা হয়। আমাদের মধ্যে রহস্যময়তা নেই বলেই আমরা অন্যের উপর রহস্যময়তা আরোপ করতে পছন্দ করি।
প্রাইমারি স্কুলের জনৈক শিক্ষক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমাকে দেখে তিনি খুব হতাশ হলেন। তিনি শুনেছেন অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি নায়িকা নিয়ে এসেছেন। তার হতাশ হওয়ারই কথা। মুনশি-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। তিনি সব প্রশ্নের জবাব দিলেন কঠিন সিলেটি ভাষায়। এই ভাষা বোঝার সাধ্য আমার নেই। ইন্টারপ্রেটার হিসাবে সর্পরাজ সাহায্য করল।
কথোপখন
আমি : মুনশি সাহেব লোক কেমন?
উত্তর : (দার্শনিক উত্তর পাওয়া গেল। গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত হোন বা অশিক্ষিত হোন, দার্শনিক কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন। মানুষের ভালোমন্দ বুঝা কঠিন। যে ভালো তার মধ্যেও থাকে মন্দ। যে মন্দ তার মধ্যে থাকে কিছু ভালো।
আমি : মুনশির ম্যাজিক দেখেছেন?
উত্তর : এক দুইবার দেখেছি। তবে দেখা ঠিক না। কুফরি কালামের সাহায্যে এইসব করা হয়। কুফরি কালাম যে ব্যবহার করে সে কবিরা গুনাহ করে। যে দেখে সেও কবিরা গুনাহ করে।
প্রশ্ন : যে কবিরা গুনাহ করছে তাকে মসজিদের ইমাম করে রেখেছেন কেন?
উত্তর; অত্যন্ত জ্ঞানীর মতো একটা প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব, নাম আবদুল খালেক। হজ করেছেন দুইবার। উনি মুনশিকে অত্যধিক পছন্দ করেন বিধায় কিছু করার উপায় নাই।
প্রশ্ন : অতিরিক্ত পছন্দ করেন কেন?
উত্তর : আছে ঘটনা। আপনি বিদেশি মানুষ। আপনার কাছে সব প্রকাশ করা ঠিক না। লোকমুখের রটনা—খালেক সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে মুনশির লটরপটর।
প্রশ্ন : মুনশি কি বিবাহ করেছেন?
উত্তর : আমার জানামতে না। তবে অনেকেই বলে এক পরীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে।
প্রশ্ন : ডানা আছে এ রকম পরী?
উত্তর : জ্বিনদের মধ্যে যারা নারী তাদেরকে পরী বলে। সে স্ত্রী-জাতীয় একটা জ্বিন বিবাহ করেছে। তার স্ত্রী মাঝে মধ্যে আসে, কিছুদিন থেকে চলে যায়।
প্রশ্ন : কেউ কি তাকে দেখেছে?
উত্তর : কয়েকজন দেখেছে। জিনের আনাগোনার কারণে আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই। গাছগাছালি থাকলেই পাখি থাকবে এটা জগতের নিয়ম। আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই।
প্রশ্ন : আমি কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় প্রচুর পাখির ডাক শুনেছি।
উত্তর : দুই একটা পাখি ভুলক্রমে চলে আসে। যখন ঘটনা বুঝতে পারে তখন পালায়া যায়।
প্রশ্ন : পাখিরা জ্বিনদের ভয় পায়? উত্তর : জি। পাখির হাড় হলো জ্বিনের খাদ্য।
প্রশ্ন : ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত আরাম পেয়েছি। এখন বাড়িতে যান। বিশ্রাম করুন।
স্কুলশিক্ষক আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বাড়িতে চলে যাব কেন? আরজু সাব (সর্পরাজ) আপনার সঙ্গে রাতের খানা খাওয়ার জন্য আমাকে দাওয়াত করেছেন।
আমি বললাম, তাহলে তো অবশ্যই থাকবেন।
সর্পরাজ বলল, স্যার চাঁদ উঠেছে। বাইরে বড়ই সৌন্দর্য। আপনি কি ডেকে বসে চাদের আলোর সৌন্দর্য দেখবেন?
আমি বললাম, না। তুমি মাস্টার সাহেবকে নিয়ে যাও। রাতে খেতে যখন দেরি হবে উনাকে চা-নাস্তা খাওয়াও।
সর্পারাজ বিদায় নেওয়ার পরপর নুহাশপল্লীর ম্যানেজার উপস্থিত হলো। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। চোখে সুরমা। হাতে তসবি।
আমি বললাম, তোমার সমস্যা কী?
ম্যানেজার বলল, মিলাদ হবে স্যার। মিলাদের পর শোকরানা নামাজ। তারপর দোয়া। হাজি একরামুল্লাহ সাহেব এসেছেন। দোয়া উনি পড়াবেন।
হাজি একরামুতুল্লাহ সাহেব কে?
বিশিষ্ট আলেম। ম্যাজিক মুনশি যেখানে যায় উনি সেখানে যান না।। আপনার কথা শুনে এসেছেন।
শুনে খুশি হলাম। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয় সেটা দেখো। আমার প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। আমি শুয়ে থাকব।
কেবিনে আমি এখন একা। মোমবাতি এবং খরিকেন জ্বলছে না। কেবিনের খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। লঞ্চটাকে এখন মনে হচ্ছে। অলৌকিক লঞ্চ।।
আমি আধশোয়া হয়ে মুনশির কথা ভাবছি। আমরা রহস্যময়তা পছন্দ করি কিন্তু অতিরিক্ত রহস্যময়তা পছন্দ করি না। আমরা ধরেই নেই অতিরিক্ত রহস্যময় মানুষ কৃষ্ণশক্তির (Dark Power) সাহায্য নেয়। এই শক্তি শুদ্ধশক্তি না বলেই নিষিদ্ধ।
১৬০৪ সাল ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন কিং জেমস (King James I)। তিনিই প্রথম বাইবেল ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। মানুষটা অন্ধ কালোশক্তির ভয়ে প্রচণ্ড ভীত ছিলেন। তিনি কালোশক্তি প্রতিরোধ করার জন্যে প্রথম Witch Craft Act প্রণয়ন করেন। এই আইনে যারা কালোশক্তি ব্যবহার করবে (যেমন ডাইনি, ম্যাজিশিয়ান) তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হবে।
ডাইনিদের ভয়ে তিনি এতই ভীত ছিলেন যে, বাইবেলের কিছু অনুবাদও নিজের ইচ্ছামতো বদলে দেন। বাইবেলে এক জায়গায় আছে—Thou shalt not sfier a boisorder to live. তিনি লিখলেন_Thou shalt no suffer a witch to live.
কিং জেমসের এই কারণে বহু নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হলো।
সারা ইউরোপ তখন ডাইনি খুঁজে বের করে হত্যা করা শুরু করে। Witch Craft Act-এ ডাইনিদের ফাঁসিতে হত্যা করার বিধান থাকলেও ইউরোপের ডাইনিদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। বিস্ময়কর ঘটনা হলেও সত্যি—জ্বলন্ত আগুনে ইউরোপের ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
নিরপরাধ মানুষদের বাঁচাতে Scot নামের একজন সাহসী ভূমিকা নেন। তিনি একটি বই লেখেন, নাম he Discovery of Vitch Craf, এই বইতে তিনি দেখান যে, সাধারণ কৌশল মানুষ কেটে জোড়া দেওয়া যায়, শূন্যে ভাসা যায়। এর জন্যে কৃষ্ণশক্তি বা শয়তানের সাহায্য লাগে না।
পুড়িয়ে মারা হয়েছে এমন একজন ডাইনির নাম আপনারা সবাই জানেন। তাকে পরে Saint হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার নাম জোয়ান অব আর্ক (Saint Joan of Arc). তিনি চান্সকে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
আমেরিকার ম্যাসাচুয়েট রাজ্য ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। কিং জেমসের আইন সেখানেও চালু হলো। সেখানকার সালেস শহরে ১৯ জনকে ফাঁসি দেওয়া হলো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল নিতান্ত অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা। এইসব শিশুদের একজন পরিণত বয়সে স্বীকার করেছে তাদের অভিযোগ ছিল মিথ্যা। এরা সবাই নিরপরাধ ছি।
১৯৫১ সালে ব্রিটিশ পার্লা ন্ট কিং জেমসের আইন বাতিল করেন।
তার দুবছর পর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার হেনরি মিলার তাঁর বিখ্যাত নাটক Crucible লেখেন। এই নাটক ছিল ডাইনিদের অনুসন্ধান নিয়ে। ডাইনি ধরে পুড়িয়ে মারা Crucile নাটকের মূল বিষয়।
আর্থার মিলার প্রতীকী অর্থে নাটকটি লিখেছিলেন। ডাইনির অনুসন্ধান আসলে ছিল কমিউনিস্টদের অনুসন্ধান।
সাধারণ দর্শক নাটকটির Metaphor ধরতে পারল না। তাদের মধ্যে ডাইনি, ব্ল্যাক ম্যাজিক বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হলো। ডাইনি হওয়ার সাধনা শুরু হলো। ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা শুরু হলো।
আমেরিকায় ডাইনিরা এখন Legal rights পাচ্ছে। তাদের বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় যে-কেউ এখন ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করতে পারেন।
পাঠকদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে ডাইনিদের একটি মন্ত্র লিখে দিচ্ছি। অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে এই মন্ত্র পাঠ করতে হয়। নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিকে পাঠিয়ে দিতে হয় মোমবাতির শিখায়।
মন্ত্রপাঠের নিয়ম
ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকবে। ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আসন করে বসতে হবে। একটা সাদা মুরগির মাথা টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। মুরগির গা থেকে যে রক্ত বের হবে তা কপালে মাখতে হবে। খানিকটা জিভে ছোঁয়াতে হবে।
মন্ত্র ক্রমাগত পাঠ করে যেতে হবে। একসময় মন্ত্র পাঠ করতে করতেই মূত্রত্যাগ করতে হবে। ছেলেদের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে মোমবাতির চারপাশে চক্রের মতো।
পুরো বিষয়টায় যথেষ্ট নোংরামি আছে না?
নোংরামির এখানেই শেষ না, দলবেঁধে যখন কৃষ্ণশক্তির আরাধনা করা হয় তখন আরাধনা শেষ হয় নির্বিচার যৌনাচারে।
অনেকে এই লোভেও ডাইনি দলে নাম লেখান।
মন্ত্র
Loud is the message as the ravens cry
Send out this magick, send it high.
Make it work, mare it last,
Tell the Godess of this spell I have cast.
Have it happen without complexity:
This is my will so mote it be.
ডাইনিবিদ্যায় একজন ঈশ্বর থাকেন। তিনি অন্ধকারের ঈশ্বর। তার একজন স্ত্রী থাকেন। তিনিও অন্ধকারের। ডাইনিরা (রমণী এবং পুরুষ) যে ধর্ম পালন করে তার নাম Wicca. Wicca শব্দের অর্থ Wizard বা জাদুকর।
পশ্চিমা সভ্য দেশগুলি যখন ডাইনি হত্যা চালাচ্ছে তখন ভারতবর্ষের অবস্থা কী? আমরাও পিছিয়ে ছিলাম না। আমরা সতীদাহ নাম করে নিরপরাধ মেয়েগুলিকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তুলে দিচ্ছিলাম। তবে ডাইনি বলে কিছু আমাদের দেশে ছিল না। কালো মন্ত্রের চর্চা ছিল, বান মারা ছিল। যারা এইসব করতেন তাদেরকে নিয়ে আমাদের সামান্য কৌতূহল ছিল, এর বেশি কিছু না।
এখন কৌতূহলও নেই। পুরাতন ঢাকায় আমি একটা টিনের ঘরে সাইনবোর্ড দেখেছিলাম। সাইনবোর্ডে লেখা—
জাদু টোনা করা হয়। বান মারা এবং বান কাটান দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের সপ্তধাতু তাবিজ আছে। হারানো বস্তু, গুপ্তধন গ্যারান্টি সহকারে অনুসন্ধান করি।
এত ক্ষমতার অধিকারীকে দেখলাম, লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বারান্দার একটা কাঠের চেয়ারে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসা। আমি বললাম, এতসব কীভাবে করেন?
তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, সোলেমানি জাদুর মাধ্যমে করি। আপনার কী লাগবে বলেন? বাজে কথার সময় আমার নাই।
এই ভদ্রলোককে দেখেই আমার মাথায় একটা গল্প তৈরি হয়। গল্পটি লিখেও ফেলি। গল্পের নাম গুনীন।
ডাইনি বিষয়ে আমরা কখনো উৎসাহী ছিলাম না বলে আমাদের সাহিত্যে ডাইনি নিয়ে কোনো গল্প নেই। ভুল বললাম, একটি গল্প লেখা হয়েছে। লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার লেখা ডাইনী বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার মতো লেখা।
আগ্রহী পাঠকদের লেখাটি পড়তে অনুরোধ করছি।*
——–
* ঈদ সংখ্যা কালের কন্থে ম্যাজিক মুনশি ছাপা হওয়ার পর অনেকেই আমাকে জানান, ভারতবর্ষে অতীতে ডাইনি হত্যা হয়েছে এবং এখনো নাকি হচ্ছে। এই বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।
এশার নামাজ শেষ করে মুনশি এসেছেন
এশার নামাজ শেষ করে মুনশি এসেছেন। তার গায়ের চা-পাতা গন্ধি আতরের সুঘ্রাণ আগের চেয়েও বেশি। মনে হয় নামাজের সময় নতুন করে আতর মাখা হয়েছে। আমি বললাম, আরেকটা ম্যাজিক দেখান।
কঠিন ম্যাজিক দেখাব স্যার? অবশ্যই কঠিন ম্যাজিক দেখাবেন।
কেবিনের জানালা বন্ধ করে দেই? বন্ধ ঘর ছাড়া ম্যাজিক দেখানো যায় না।
জানালা বন্ধ করে দিন।
মুনশি জানালা বন্ধ করলেন। আমাকে বললেন দুহাতে দুটা মোমবাতি ধরে পাশাপাশি রাখতে। মোমবাতি দুটির দূরত্ব যেন ছয় ইঞ্চির বেশি না হয়। আমি তা-ই করলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দপ করে বাঁ হাতের মোমবাতি আপনাআপনি জ্বলে উঠল। পরের ঘটনা অদ্ভুত। বাঁ হাতের মোমবাতি নিভে ডান হাতেরটা জ্বলে উঠল। ঘটনা অতি দ্রুত ঘটতে লাগল। মনে হচ্ছে আলো লাফালাফি করছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে আলোর নাচানাচি দেখছি। এই আলো ঠিক মোমবাতির আলো না। হালকা নীলাভ দ্যুতি।
আধুনিক ম্যাজিশিয়ানরা আলোর নাচানাচি দেখাতে পারেন। আলো নাচানাচি করবে। এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হবে। এই আলোর নাচানাচি ম্যাজিকের কৌশল জটিল না। বুড়ো আঙুলের উপর নকল আঙুল পরতে হয়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না হাতে নকল আঙুল পরা আছে। ম্যাজিকের ভাষায় নকল আঙুলকে বলে Thumb TIp. Aplastic flesh colored gimmick that fits over the magicians thumb for the purpose of concealing very small objects, liquids and so on.)
Thumb tip-এ ব্যাটারিচালিত বাল্ব থাকে। ব্যাটারিতে চাপ দিলেই আলো জ্বলে ওঠে। হাত নাড়ালেই মনে হয় আলো নড়াচড়া করছে। নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলছে।
মুনশির ম্যাজিকের সঙ্গে আধুনিক আলোর নাচনের ম্যাজিকের কোনো মিল নেই। আমি দুই হাতের দূরত্ব খানিকটা বাড়াতেই মোমবাতি নিভে গেল। আমি বললাম, অদ্ভুত। এ রকম আগে কখনো দেখি নি। আপনার সবচেয়ে জটিল ম্যাজিক কোনটা?
মুনশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ছোট পুকুরে আমি পানির উপর হেঁটে পার হতে পারি। এটাই আমার সবচেয়ে জটিল ম্যাজিক। পূর্ণিমার চাঁদ যখন ঠিক মাথার উপর থাকে, তখন আমি এই ম্যাজিক দেখাতে পারি। অন্য সময়ে পারি না।।
আপনার এই ম্যাজিক কি কেউ দেখেছে?
জি-না। কারও সামনে এই ম্যাজিক করা যায় না।
আমি বললাম, যে ম্যাজিক কেউ দেখতে পারবে না সেই ম্যাজিক কোনো ম্যাজিক না।।
মুনশি সঙ্গে সঙ্গে বলল, কথা সত্য।
আপনি বিয়ে করেছিলেন?
করেছিলাম স্যার! ঝামেলার বিয়ে।
ঝামেলার বিয়ে মানে? পরী বিয়ে করেছিলেন নাকি?
মুনশি হেসে ফেলে বললেন, পরী কোথায় পাব স্যার! একটা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিলাম। তার নাম রেবতী। বিয়ের দুই মাসের মধ্যে মেয়েটা মারা যায়।
কীভাবে মারা যায়?
সাপের কামড়ে। রেবতীর মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্যে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ছয় মাস ছিলাম।
আমি বললাম, হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আপনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, ম্যাজিক দেখানোর কিছু ক্ষমতা আপনার মধ্যে হয়েছে। তাই না?
মুনশি চমকে উঠলেন, কিন্তু হ্যাঁ না কিছু বললেন না।
আমি বললাম, আমি যদি আমার কোনো ম্যাজিশিয়ান বন্ধু নিয়ে আসি, তাকে ম্যাজিক দেখাতে পারবেন?
মুনশি বলল, কেন পারব না? অবশ্যই পারব।
আমি যদি একটা ভিডিও ক্যামেরা রাখি, তার সামনে করতে পারবেন?
পারব।
আমি বললাম, পূর্ণচন্দ্র মাথার উপর নিয়ে পুকুর হেঁটে পার হওয়ার সময় কি আপনার মৃত স্ত্রী কোনো না কোনো কারণে উপস্থিত থাকেন?
মুনশি আবারও চমকাল। কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল। আমি বললাম, আপনি কি আমার কোনো বই পড়েছেন?
জি-না স্যার। আপনি কি রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শুনেছেন?
জি স্যার শুনেছি। আমার স্ত্রী ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে। তার কারণেই শুনেছি। তার কাছে পরমহংসের ছবিও ছিল।
আমি বললাম, পানির উপর দিয়ে হাঁটা নিয়ে পরমহংসের একটি সুন্দর গল্প আছে। গল্পটা বলি?
বলুন।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে এক সাধু এসে বললেন, আমি কুড়ি বছর সাধনা করে একটা বিদ্যা পেয়েছি।
পরমহংস বললেন, কী বিদ্যা?
আমি এখন জলের উপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হতে পারি।।
পরম হংস বললেন, এক আনা পয়সা দিলে মাঝি নৌকায় করে পার করে দেয়, এর জন্যে তুমি বিশটা বছর নষ্ট করলে?
মুনশি হো হো করে হেসে উঠল। গল্পটার ভেতর যে সূক্ষ্ম রস আছে তা সে ধরতে পারবে বলে আমি মনে করি নি।
আমার কাছে নলিনী বাবু B.Sc. উপন্যাসের একটা কপি ছিল। তাকে বইটা দিলাম। সে অত্যন্ত আগ্রহে হাত পেতে বইটা নিল যেন সাত রাজার ধন তাকে দেওয়া হয়েছে। তার এই বিনয়ও ভালো লাগল।
খাওয়ার ডাক এসেছে। আমি বললাম, চলুন খেতে যাই।
মুনশি বলল, জনাব গোস্তাকি মাফ হয়। আমি মাছ-মাংস খাই না। একবেলা আহার করি।
আপনি একাহারি?
জি জনাব। মাছ-মাংস খেলে শরীর ফুলে যায়। জ্বালাযন্ত্রণা হয়।
ম্যাজিক মুনশি চলে গেল।
সকাল আটটা।
ডিজেল পাওয়া গেছে। লঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই বিশেষ ঘটনা দেখার জন্যে অঞ্চলের সকল শিশুকিশোর জড়ো হয়েছে। টাইটানিক প্রথম যাত্রা করার সময়ও তীরে এত মানুষ ছিল না।
মুনশি আমাকে বিদায় দিতে এসে বললেন, স্যার কাল রাতেই আপনার বইটা পড়ে শেষ করেছি। বইয়ের ঘটনা কি সত্যি?
আমি বললাম, আপনি যেমন কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন না, আমিও দেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।
জনাব, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি আমার কাছে কিছু আতর চেয়েছিলেন। এই আতর আপনার স্ত্রীর কাছে আছে বলে দিলাম না।
আমার স্ত্রীর কাছে এই আতর আছে?
মুনশি উঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কোনো কথা বলল না।
ঢাকায় এসে শাওনকে প্রথম যে প্রশ্ন করলাম, তোমার কাছে কি কোনো আতর আছে?
শাওন বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে আতর থাকবে কেন? আতর পুরুষদের ব্যাপার, মেয়েদের না।
আমি বললাম, চা-পাতার গন্ধ আছে এমন কোনো আতর?
শাওন বলল, আমার কাছে একটা পারফিউম আছে, নাম Elizabeth Arden, যার অবিকল চায়ের গন্ধ। এটার কথা বলছ?
হুঁ।
কী করবে?
কিছু করব না। কিছুক্ষণ গায়ে মেখে বসে থাকব।
ঢাকা শহর অদ্ভুত এক শহর। এই শহর তার বাসিন্দাদের গিলে পেটের ভেতর রেখে দেয়। বাসিন্দারা কিছুদিন বাইরে থেকে ফিরে আসামাত্র শহর তাদের নিজের মধ্যে টেনে নেয়, বাইরের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়।
ম্যাজিক মুনশির ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গেলাম। ঢাকা শহরে এসে মুনশিকে আমার আর তেমন রহস্যময় মনে হলো না। তাকে নিয়ে আলাদা করে চিন্তাভাবনা করাও হয়ে উঠল না। আমি নানান ব্যস্ততায় জড়িয়ে গেলাম। ঘেটুপুত্র কমলা ছবির গান রেকর্ড করা, সেট বানানো, হাজারো সমস্যা।
তার চেয়েও বড় সমস্যা অর্থনৈতিক। যাঁরা এই ছবিতে অর্থলগ্নির কথা বলেছিলেন তাঁরা গা ঢাকা দিলেন! টেলিফোন করলে টেলিফোন ধরেন না। তাদের একজন (দেশ টিভির আসাদুজ্জামান নূর, নেতা এবং অভিনেতা) জার্মানি গিয়ে বসে রইলেন। মনে হয় আমার ভয়েই পালিয়ে যাওয়া।
এমন অবস্থায় তারানগরের ম্যাজিক মুনশি মাথায় থাকে না। থাকার কথাও। এই সময় মুনশি সাহেবের চিঠি পেলাম। চিঠি পেয়ে শুরুতে চমকালাম, কারণ আমি তাকে ঠিকানা দিয়ে আসি নি। চমকানো স্থায়ী হলো না। তাকে যে উপন্যাসটি দিয়ে এসেছিলাম সেই উপন্যাসের প্রকাশকের ঠিকানায় চিঠি এসেছে। মুনশি সাহেব কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে ঠিকানা বের করেন নি।
তিনি লিখেছেন–
শ্রদ্ধেয় স্যার হুমায়ূন আহমেদ সাহেব।।
আসসালামু আলায়কুম। জনাব, একটি বিষয় জানার জন্য আপনাকে পত্র লিখিয়াছি। আপনি আমাকে যে বইটি দিয়াছেন তা দ্বিতীয়বার পাঠ করিয়াছি। বইটির ঘটনা কতটুকু সত্য তা জানা আমার জন্য বিশেষ জরুরি।
আমার শরীর খুব খারাপ। এখন কিছুই খাইতে পারি। মসজিদের ইমামতি ছাড়িয়া দিয়াছি। এখন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই বিছানায় থাকি।
জনাব, বইটির ঘটনা সত্য কি না আপনি আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। বিনিময়ে আপনাকে আমি অতি গোপন অতি রহস্যময় বিষয় জানাই। ইহা মৃত্যুপথযাত্রীর ওয়াদা।
সালাম।
ইতি মুনশি রইসুদ্দিন
ম্যাজিক মুনশির নাম যে রইসুদ্দিন তা প্রথম জানলাম। তাকে সেদিনই চিঠি পাঠালাম। চিঠিতে লিখলাম—
মুনশি রইসুদ্দিন
প্রিয়জনেষু,
ভাই আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি অসুস্থ্য, কিছু খেতে পারছেন না জেনে খুব খারাপ লাগছে। আপনি চিঠি পাওয়া মাত্র ঢাকা আসার ব্যবস্থা করবেন। আপনার চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করব।
নলিনী বাবু B.Sc, বইটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বইটির গল্প বানানো। লেখকরা বিশ্বাসযোগাভাবে মিথ্যা গল্প লেখেন। তবে এই উপন্যাসে আমি যে প্যারালাল জগতের কথা লিখেছি বিজ্ঞান তা স্বীকার করে।।
আপনার শরীরের যে অবস্থা লিখেছেন তাতে আপনার পক্ষে একা ঢাকায় আসা সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
আমি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একজনকে পাঠাচ্ছি। সে আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আপনি ভালো থাকবেন।
ইতি
হুমায়ূন আহমেদ
আমি নুহাশ চলচ্চিত্রের দুজন স্টাফকে আমার চিঠি সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।
তারা মহা উৎসাহে রওনা হলো।
অনেক দিন পর মুনশি বিষয়ে আমি নিজেও উৎসাহী হলাম। বিশেষ কিছু ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে। এই ক্ষমতার উৎস কী?
তিনি যা দেখাচ্ছেন তা হলো আসল ম্যাজিক। এই ম্যাজিক অন্যভুবনের বাসিন্দাদের সাহায্যে করা হয়। পৃথিবীর কোনো ম্যাজিশিয়ানই তা স্বীকার করবেন না। বিজ্ঞান তো কখনোই না।
আমরা কিন্তু শৈশব থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের ভেতর বাস করি। শিশুর প্রথম যখন দাঁত পড়ে এই দাঁত ফেলা হয় ইঁদুরের গর্তে, যেন তার ইঁদুরের মতো দাঁত হয়। এখান থেকেই ম্যাজিকের শুরু। নজর কাটানোর জন্যে শিশুর মাথায় কালো টিপ দেওয়া হয়। এটাও ম্যাজিক।
আমাদের সমাজে কিছু মানুষ বাস করেন, যাদের নজর নাকি খারাপ। তারা কোনো কিছুকে ভালো বললে সেই ভালোর দফারফা। নজরলাগা এই ব্যক্তিরা তাদের ক্ষমতা নিয়ে বিব্রত থাকেন না, বরং অহঙ্কারের মতো ভাব তাদের মধ্যে থাকে।
মানুষের নজরের পরে আসে জ্বিন-পরীর নজর। মানুষের নজর কাটান দেওয়া যায়। জ্বিন-পরীরটা যায় না। তখন তাবিজ কবচ দোয়ার আশ্রয় নিতে হয়। সেই মন্ত্রতন্ত্রের কাছে ফিরে যাওয়া।
মুসলমানরা চিঠির শুরুতে ৭৮৬ লিখেন। এর অর্থ বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম। এটা কি এক ধরনের গুপ্ত ম্যাজিক না? ৭৮৬ কেন বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম এর প্রতীক হলো তা জানার চেষ্টা করেছি। যা জেনেছি তা হলো আরবিতে প্রতিটি অক্ষরের সংখ্যামান আছে। বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম উনিশটি অক্ষর আছে। উনিশটি অক্ষরের যোগফল হয় ৭৮৬।
আরবি হরফের সংখ্যামান নিচে দেওয়া হলো–
আরবি হরফের সংখ্যামান
৬৬৬ আরেকটি ম্যাজিক নাম্বার। বাইবেলে (Revelation, ১৩:১৮) এই সংখ্যাকে বলা হয়েছে পশুদের সংখ্যা। বাইবেলের এই পশু উভলিঙ্গ। পশুটি এমন যে তাকে দেখলে মনে হয় সে সর্বক্ষণ নিজে নিজেই যৌনকর্ম করে যাচ্ছে (পশুটির নিতম্ব দুদিকে)। চার্চ পুরোহিতরা এই সংখ্যাটির সঙ্গে যৌনতা সম্পর্কিত বলে নীতিবর্জিত ঘোষণা করেছেন।
৬৬৬ সংখ্যাটিকে ব্যাপক পরিচিতি যিনি দেন তার নাম Aleister Crowly. তিনি নিজেকে একজন মহান পশু (The great beast) পরিচয় দিতেন। তাঁর সীলমোহরে ৬৬৬ সংখ্যাটি ছিল। তিনি গুপ্ত ম্যাজিকের একটি দল গঠন করেন। তাঁর সংগঠনের নাম ছিল Order of the Golden dawn. তার সময়ের (১৮৬৫-১৯৩৯) অনেক বিখ্যাত মানুষ এই গুপ্ত ম্যাজিক দলের সদস্য ছিলেন। একজনের নাম শুনলে পাঠক চমকাবেন। তিনি কবি W. B. Yeats.
পৃথিবীর সেরা গণিতবিদদের একজন ছিলেন পিথাগোরাস। তিনি জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ছিল সংখ্যার জাদুতে। তার একদল অনুসারী ছিল। তারা সবাই গোপনে সংখ্যার জাদুর চর্চা করতেন। তারা তাদের জ্ঞান প্রকাশ করতেন না। পিথাগোরাস মনে করতেন মহাবিশ্বের সবকিছুর মূলে আছে সংখ্যা। তাঁর মতে সংখ্যারও নারী-পুরুষ আছে। জোড় সংখ্যা পুরুষ। বিজোড় সংখ্যা হলো নারী। তিনি মনে করতেন গ্রহরা যখন সূর্যের চারদিকে ঘুরে তখন মহান সঙ্গীত তৈরি হয়। এই সঙ্গীত সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব।
সংখ্যার শুভ-অশুভ নিয়েও পিথাগোরাস এবং তার দলের চিন্তাভাবনা ছিল। তাঁদের মতে, সাত একটি শুভ সংখ্যা।
ধর্মীয়ভাবে সাত সংখ্যাটিকে শুভ ভাবা হয়। কারণ রঙ হলো সাতটি। মানুষের মাথার ছিদ্র সাতটি (দুই কান, দুই নাক, দুই চোখ এবং মুখ)। সুর সাতটি।
মধ্যযুগে সংখ্যার ম্যাজিকের চর্চা আরও প্রবলভাবে হতে লাগল। তখন আবিষ্কার হলো Cabala of the nine chambers. নয়টি কক্ষের প্রতিটিতে থাকত রহস্যময় সংখ্যা। যেমন—
এই নয় কক্ষের মধ্যমণি পাঁচ। উপরে, নিচে, কোনাকুনিভাবে সংখ্যাগুলির যোগফল সবসময় হবে ১৫।* (* সূত্র : মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গণিত সংখ্যা।)
এই স্কয়ারের আরেকটি নাম হলো ম্যাজিক স্কয়ার। কৃষ্ণশক্তির আরাধনায় এই ধরনের স্কয়ার ব্যবহার করা হতো।
বাংলাদেশের মুসলমানদের বহুলপঠিত গ্রন্থের একটির নাম নেয়ামুল কোরআন। সেখানে অনেক তাবিজ দেওয়া আছে। একটি তাবিজ উদ্ধৃত করছি।
জ্বিন ভূত তাড়াবার তাবিজ
বদনজর, জ্বিন-ভূতের আছর এবং জাদুর আছর দূর করতে হলে এই তাবিজটি লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিতে হবে।
পাঠক লক্ষ্য করে দেখুন, এটিও একটি স্কয়ার। (ম্যাজিক স্কয়ার কি?) এই তাবিজে নয়টি কলাম এবং নয়টি সমান্তরাল লাইন আছে। বর্গের সর্বমোট সংখ্যা ৮১, এর যোগফল আবার ৯ (৮+১=৯)।
বিজ্ঞানের কঠিন ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ব্লাক ম্যাজিক এবং কালো বিপরীত শক্তির উপর মানুষের বিশ্বাস কিন্তু এখনো টিকে আছ। সারা পৃথিবীতে মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে পরিচিত জ্ঞানীরাও এই অন্ধবিশ্বাসের বাইরে যেতে পারেন নি। আধুনিক কোয়ান্টামবিদ্যার জনক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেইলস বোরের বাড়ির দরজায় আটকানো থাকত একটি ঘোড়ার খুর চুম্বক (Horse shoe magnet)। বিশ্বাস করা হয় এই চুম্বক সৌভাগ্য নিয়ে আসে। নেইলস ববারের এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতো বিজ্ঞানী এইসব বিশ্বাস করেন?
নেইলস বোর বললেন, বিশ্বাস করি না, তবে সৌভাগ্য তো বিশ্বাস না করলেও আসতে পারে।
আরব ঐতিহাসিক আবু সাকের-এর লেখা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, অ্যারিস্টটল মহাবীর আলেকজান্ডারকে কালো রঙের বাক্সে কয়েকটি মোমের তৈরি পুতুল উপহার দিয়েছিলেন। আলেকজান্ডারকে তিনি বললেন, এই পুতুলগুলি মন্ত্রপূত। তুমি কখনো পুতুলগুলি হাতছাড়া করবে না। হাতছাড়া করলেই মহা বিপদ।
অর্ধেক পৃথিবী জয়ের পর আলেকজান্ডার পুতুলের বাক্স হারিয়ে ফেললেন। তখন তার বয়স মাত্র ৩৩, সেই বয়সেই তার মৃত্যু হলো।
কালো ম্যাজিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সুগন্ধি। সুগন্ধি মানুষের মন পরিষ্কার করে। মন্দিরে ধূপ পোড়ানো হয়, আমরা আগরবাতি জ্বালাই।
ব্ল্যাক ম্যাজিকে নানান ধরনের সুগন্ধি গায়ে মেখে নিতে হয়। ইজিপ্টের গুপ্ত মাজিকে মৃতদের উদ্দেশে যা পাঠ করা হয় তার ইংরেজি অনুবাদ
The perfume of Arabia hath been brought to thee, To make perfect thy srnell through the scent of the God. Here are brought to thee, liquids which have come from Arabia to make perfect thy smell in the Halt.
কাছাকাছি বঙ্গানুবাদ—
আরব থেকে তোমার জন্যে সুগন্ধি আনা হয়েছে। তোমার ঘ্রাণ ত্রুটিহীন করে ঈশ্বরের ঘ্রাণের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে,..
তথা : Mysteries and Secrets of Magic, C.G.S, Thomson. প্রথম প্রকাশ ১৯২৭, বর্তমান মুদ্রণ ১৯৯৫, প্রকাশক Random House, UK.
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আরব থেকে যে সুগন্ধি আনা হয়েছে তা কি জয়তুন বৃক্ষের তেল থেকে তৈরি? ম্যাজিক মুনশির আতরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
রাতে ঘুমুতে গেছি, শাওন বলল, তোমার গা থেকে চা-পাতার কড়া গন্ধ আসছে। তুমি কি আবার আমার সেন্ট মেখেছ?
আমি বললাম, হুঁ।
শাওন বলল, তুমি দয়া করে মাথা থেকে ম্যাজিক মুনশি দূর করো। তুমি আধুনিক মানুষ, তোমার চিন্তাভাবনা হবে আধুনিক।
আমি বললাম, আমার চিন্তাভাবনা যথেষ্টই আধুনিক।
শাওন বলল, মোটেই না। তোমার মাথার কাছে টেলিভর্তি ব্ল্যাক ম্যাজিকের বই। প্রায়ই দেখছি তুমি বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছ। কী পড়ছ?
আমি বললাম, মন্ত্র।
কিসের মন্ত্র?
বনসি নামানোর মন্ত্র।
বনলি কী?
এক ধরনের মহিলা ভূত। মন্ত্রটা শুনবে?
না।
আরে শোনো না,
It was the Banshees lonely wailing,
well I knew the voice of death,
In the night wind slowly sailing
over the bleak and gloomy heath.
শীওন বলল, তোমার এই মহিলা ভূতের চেহারা কেমন?
আমি বললাম, সে অতি রূপবতী। আমার উপন্যাসের নায়িকাদের চেয়েও তার রূপ বেশি।
মন্ত্র পাঠ করলে সে এখানে উদয় হবে?
হুঁ। শুধু যে উদয় হবে তা-না। পারিবারিকভাবেও সে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবে।
তার মানে?
আইরিশরা বিশ্বাস করে, তাদের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে একজন বনসি ভূত নারী যুক্ত। সে বিপদে আপদে দেখা দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে।
শাওন বলল, তার মাঝে মাঝে উদয় হওয়ার দরকার কী? সে সারাক্ষণই উদয় হয়ে থাকুক। তুমি তাকে বিয়ে করে ফেল। তোমার একজন ভূতপত্নী থাকুক।
আমি বললাম, ওকে গ্রান্টেড।
শাওন বলল, আমার ঘরে দয়া করে বিড়বিড় করবে না। অন্য ঘরে যাও। ভূতনি দর্শন দিলে আমার কাছে নিয়ে এসো। আর দয়া করে মাথার কাছ থেকে ভূতপ্রেতের বই সরাও।
আমি বললাম, ম্যাজিক মুনশি ঢাকায় পৌছানোর আগ পর্যন্ত আমি বইগুলি পড়ব। সে এসে পৌছালেই পড়া শেষ।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, বনসি ভূত নামানোর যে মন্ত্র আমি লিখেছি তা মন্ত্র না। বনসিদের নিয়ে লেখা প্রাচীন আইরিশ Ballad. এই ব্যালাড় মন্ত্রের মতো পড়লে কোনো কাজ হওয়ার কথা না।
কৃষ্ণশক্তির সাধনা ভারতবর্ষের সাধনার একটি ধারা। এই সাধনা যারা করেন তাদের বেশির ভাগ কালী সাধক। তাদের আরেক নাম তান্ত্রিক। তন্ত্রের (মন্ত্রের সাহায্যে সাধনী। এই সাধনায় সাধকরা কারণ বারি (দেশি মদ পান করেন। ভাংজাতীয় নেশার দ্রব্য গ্রহণ করেন। সিদ্ধিলাভের জন্যে একটা পর্যায়ে তাদেরকে শব সাধনা করতে হয়। শব সাধনা হচ্ছে নগ্ন মৃতদেহের বুকের উপর বসে (অল্পবয়েসী তরুণীর মৃতদেহ হতে হবে। মন্ত্র পাঠ। একটি পর্যায়ে মৃতদেহের মুখ থেকে নানান উপদেশ আসতে থাকবে। উপদেশমতো কাজ করতে হবে।
তান্ত্রিকরা কঠিন সাধনা করে শরীরের ভেতরে সুপ্ত সাত শক্তিচক্রকে উজ্জীবিত করেন। তাদের প্রধান চেষ্টা থাকে কুণ্ডলিনি জাগ্রত করা। কুণ্ডলিনি সাপের মতো। শরীরের সর্বনিম্ন চক্রে তার অবস্থান। কুণ্ডুলিনি জাগ্রত করার অর্থ হলো পৃথিবীর সর্বশক্তির কর্তৃত্ব নেওয়া।
বলতে ভুলে গেছি, সাধনার এক পর্যায়ে মৃত তরুণীর সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হতে হয়। নরবলি (শিশু) এই ধরনের সাধনার অংশ।
মহান ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিনে তে এই সাধনার বিশদ বর্ণনা আছে।
আমি S.S.C পাস করি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে (১৯৬৫)। সেই সময় চক্রের সাহায্যে প্রেত নামানোর একটা বই বাবার লাইব্রেরিতে খুঁজে পাই। বইয়ে পরকালের মানুষ এবং জীবজন্তুর সাক্ষাৎ পাওয়ার বেশ কিছু পদ্ধতি লেখা।
একটি পদ্ধতিতে বিজোড়সংখ্যক নারী-পুরুষকে হাতে হাত রেখে চক্র বানিয়ে কোনো এক নির্জন স্থানে বসতে হয়। একমনে পরকাল এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিষয়ে চিন্তা করতে হয়। মাঝে মাঝে জিকিরের মতো (chanting) বলতে হয়, আয়রে! আয়রে!
পঠিত বিদ্যা কাজে লাগানোর জন্যে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ঠিক করি চক্রে বসা হবে। করতোয়া নদীর পাশে শ্মশানঘাট। শ্মশানঘাটে শ্মশানবন্ধুদের জন্যে বানানো একটা পাকা ঘর আছে। আমরা এক সন্ধ্যায় শশানঘাটে উপস্থিত হয়ে চক্রে বসি। আমার বন্ধুদের মধ্যে দুজনের নাম মনে আছে। একজন খালেকুজ্জামান ইলিয়াস। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। খালেকুজ্জামান নন্দিত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই।
আমার আরেক বন্ধুর নাম চিশতি হেলালুর রহমান। সে ছিল ছাত্রলীগের নিবেদিত কর্মী। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাকে ইকবাল হলে হত্যা করে।
মূল ঘটনায় ফিরে যাই। আমাদের চক্র ছিল অসম্পূর্ণ। চক্রে মেয়েদের উপস্থিতি অতি আবশ্যকীয়। সুগন্ধি লাগবে। আমাদের মধ্যে দুটাই ছিল অনুপস্থিত। আসলে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম ভূত ভূত খেলা করে মজা পাওয়ার জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনা অন্যরকম হয়ে গেল। চিশতির মুখ থেকে জন্তুর শব্দ বের হতে লাগল। শ্মশানঘর তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল (এখন মনে হচ্ছে Ammonia-র গন্ধ)। চিশতির শরীর কাঁপছে এবং সে কিছুক্ষণ পরপর বলছে, আমার সামনে এটা কী? আমার সামনে এটা কী?
একসময় সে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বন্ধুদের বেশির ভাগ এইসময় দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি পালাতে পারছি না, কারণ সবকিছুর মূলে আমি। আমার অসহায় মুখ দেখে খালেকুজ্জামানও পালাল না। আমরা দুজন অনেক কষ্টে চিশতিকে টেনে টেনে করতোয়া নদীর পাশে নিয়ে আসি। তার চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরাই। জ্ঞান ফেরার পর চিশতি বলে, ভয়ঙ্কর একটা মানুষের মতো প্রাণী দেখে সে জ্ঞান হারিয়েছে। এই প্রাণীটা তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল?
আমি এবং খালেকুজ্জামান ভয়ে অস্থির হয়ে গেলাম। চিশতির অসীম সাহস। সে আমাদের দুজনকেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজে একা ফিরে গেল শ্মশানঘাটে। অদ্ভুত প্রাণীটার সঙ্গে সে কথা বলবে।
ঐ রাতের ঘটনার পর থেকে চিশতির মনোজগতে একটা স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে গেল। সে প্রায়ই একা শ্মশানঘাটে বসে থাকত। সে আমাকে বলেছে প্রাণীটার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। কী কথা হয়েছিল তা আমাকে বলে নি।
আমার পর চক্র নিয়ে উৎসাহিত হলো আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল (লেখক, বিজ্ঞানী এবং আরও অনেক কিছু)। সে থাকে ফজলুল হক হলে। পড়ে Physics. প্রায়ই শুনি সে বন্ধুদের সঙ্গে চক্রে বসছে। ভূত-প্রেত নামাচ্ছে। এক রাতে ঘটনা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। (কী হয়েছিল পরিষ্কার না) তারা বাধ্য হলো হলের মাওলানা সাহেবকে ডেকে আনতে। মাওলানা তাদের ঘরে পা দিয়েই আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! আপনারা তো জ্বিন নামিয়ে ফেলেছেন! কীভাবে নামালেন?
জাফর ইকবাল তার বই রঙিন চশমা-তে ঘটনাটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছে।
এখন আমি বিশেষ এক চক্রের পূর্ণ বিবরণ দিচ্ছি, তবে কেউ যেন এই ঝামেলায় না জড়ান তার জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ভূত-প্রেত নামুক বা না-নামুক, এই পদ্ধতি এক ধরনের হিপনোটিক অবস্থার সৃষ্টি করবে। দৃষ্টিভ্রান্তি (Halliocination) ঘটার সমূহ সম্ভাবনা।
প্রস্তুতি
১. নয়জন সমবয়সী মানুষ একত্রিত হবেন (নয় সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ।
২. পাঁচজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে।
৩. সবাইকে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে। শরীরে সুগন্ধি দেবেন। গলায় মিষ্টি গন্ধের ফুলের (বেলী, গন্ধরাজ, কামিনি) মালা পরবেন।
৪. পরিষ্কার করা (কয়েকবার ন্যাকড়া দিয়ে মোছা) একটি ঘরে সবাই একত্রিত হবেন। কর্মকাণ্ড শুরু হবে মধ্যরাতের পর যখন চারদিক নীরব হয়ে আসবে।
৫. ঘরের চার মাথায় চারটা মোমবাতি জ্বালাবেন।
৬. দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাতাসে মোমবাতি নিভে না যায়।
৭. ঘরের বাইরে উৎসুক কোনো দর্শক থাকতে পারবে না।
৮. মহিলা সদস্যরা চুড়ি পরবেন না। চুড়ির টুং টাং শব্দে সমস্যা হবে।
৯. সবাই থাকবেন খালি পায়ে।
১০. ভরাপেটে চক্র করা যাবে না। সামান্য খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। ফলমূল দুধ। এর বেশি কিছু না।
পদ্ধতি
১. একজন ছেলে একজন মেয়ে—এইভাবে সবাই গোল হয়ে দাঁড়াবেন।
২. সবাই পাশের জনের হাত ধরে চক্র বানাবেন। চক্র কোনো অবস্থাতেই ভঙ্গ করা যাবে না, অর্থাৎ হাত ছাড়া যাবে না।
৩. এখন নাচের ভঙ্গিতে সবাই কেন্দ্রের দিকে আসবেন এবং আগের জায়গায় ফিরে যাবেন। এরকম চলতে থাকবে যতক্ষণ না সবাই খানিকটা ক্লান্ত এবং অবসন্ন। পনের বা কুড়ি মিনিট। এই সময় কেউ কোনো কথা বলবেন না। ফিসফিস করেও না।
৪. এখন মূল অংশ। চক্র বড় করে ঘুরতে শুরু করবেন। chanting (জিকির) শুরু হবে। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলতে হবে, আয় আয় আয়। যখন ছেলেরা বলবে তখন মেয়েরা চুপ করে থাকবে। যখন মেয়েরা বলবে তখন ছেলেরা চুপ করে থাকবে। ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া (নাচের ভঙ্গিতে) চলতেই থাকবে।
এইসময় একটা দুটা মোমবাতি বা সবকটি মোমবাতি নিভে যেতে পারে, আবার নাও নিভতে পারে।
চক্র সফল হলে চক্রের মাঝখানে অলৌকিক উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেবে।
যারা চক্র করছে তাদের কেউ গাঢ় আবেশে অজ্ঞান হয়ে পড়লে চক্র বন্ধ করে দিতে হবে। জ্ঞান ফেরানোর জন্যে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়া যেতে পারে বা স্মেলিং সল্টের গন্ধ শোকানো যেতে পারে।
কৃষ্ণশক্তির আরাধনা বা পরলোকের অনুসন্ধানে নৃত্য একটি বিশেষ অনুসঙ্গ। কেন এরকম তা জানি না। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি সুফিসাধনার সূত্রপাত করেন। এই সাধনায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরের জগতের অনুসন্ধান করা হয়।
সুফিসাধকরা শুরুতে তাদের ডানহাত যেখানে পণ্ড তার উপর রাখেন। ডানহাতের উপর ক্রশ করে বাঁ হাত রাখা হয়। তারা সবাই দাঁড়ান বা পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে। একসময় ঘুরতে শুরু করেন। পৃথিবী যেমন তার অক্ষের উপর ঘুরে সেরকম ঘূর্ণন। তারা এইসময় জিকির শুরু করেন (আল্লাহু)। বেশকিছু সময় ঘূর্ণনের পর সমবেত নাচ শুরু হয়। তারা প্রবেশ করেন তাদের দাবি) অন্য এক অপার্থিব ভুবনে।
ক্রিশানদের মধ্যেও একসময় এই ধরনের নাচের প্রচলন ছিল। St. Jhon তার বর্ণনা দিয়েছেন। নাচের সময় সুর করে বলা হতো–
And we all circled round him and responded to him; Amen. The twelfth of the numbers pales the round aloft; Amen to each and all it is given to dance, Amen.* (*The Mystic Sprial; Jilt Pruce. Thames and Hudon.)
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে ঘুরেন। আরবিতে এই ঘূর্ণনকে বলে tafa. এর অর্থ to attain the summit of a thing by spiraling round it.
অনেক বকবক করে ফেলেছি। নিজের বকবকানিতে আমি নিজেই মুগ্ধ। এখন চুপ করা যাক। নীরবতা হিরন্ময়।
ম্যাজিক মুনশিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে ছয়-সাত দিনের বেশি লাগার কোনো কারণ নেই। পনের দিন পার হয়ে গেল, আমার দুই কর্মচারীর কোনোই খোঁজ নেই। তারা সুনামগঞ্জ থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় রওনা হয়েছে এই খবর পাওয়া গেল। কোন নৌকায় গিয়েছে নৌকার মাঝি ফিরেছে কি না তা জানা গেল না।
নৌকাডুবি হয়ে তারা মারা গেছে তাও মনে হচ্ছে না। মারা গেলে খবর পাওয়া যেত। এর মধ্যে খবর রটে গেছে আমি দুই কর্মচারীকে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডে পাঠিয়েছিলাম, পথে সমুদ্রে ডুবে এরা মারা গেছে।
এর মধ্যে শাওন স্বপ্নে দেখল, নুহাশপল্লীর দিঘিতে দুটা লাশ উপুড় হয়ে ভাসছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। গায়ের কাপড় দেখে মনে হচ্ছে এরা আমার দুই নিখোঁজ কর্মচারী।
তাদের দুজনের নামে দুটা মুরগি ছদগা দেওয়া হলো (এটাও কিন্তু ম্যাজিক)।
কুড়ি দিনের মাথায় আমি ধানমণ্ডি থানার ওসি কামরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কামরুল আমার অনেক নাটকে ওসির ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
কামরুল বলল, স্যার, এরা কি টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে?
আমি বললাম, না। অযথা টাকা খরচ করার বিষয়ে তাদের অসাধারণ দক্ষতা আছে, কিন্তু টাকা নিয়ে পালানোর মানসিকতা নেই।
কামরুল বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সাত দিনের মধ্যে আমি পাত্তা লাগাব।
এক মাস পার হলো কোনো পাত্তা লাগানো গেল না। আমি থানায় জেনারেল ডায়েরি করালাম।
একমাস ছদিন পর তারা ফিরল। দুজনের চেহারাই কাকলাসের মতো। কাপড় মলিন। একজনের পায়ে জুতা স্যান্ডেল কিছুই নেই। সে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তারা নাকি ভুল করে ইন্ডিয়ান বর্ডারে চলে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ওদের জেলে এতদিন ছিল।
আমার চিঠি মুনশির হাতে তারা দিতে পারে নি। চিঠি আছে ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের কাছে। এই চিঠি দিয়েই তারা নাকি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছে বিশেষ একজনকে খুঁজতে এসে ভুলে বর্ডার ক্রস করেছে।
মুনশির সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ করা হয় নি। সর্পরাজ আরজুর কাছে জানলাম, এক ভরাপূর্ণিমায় মুনশির মৃতদেহ দিঘির জলে ভেসে উঠেছে। মুনশির বিছানায় উঠে বসা বা নড়াচড়ার কোনো সামর্থ্যই ছিল না। দিঘি পর্যন্তু সে কীভাবে গেল সেটাই তারানগরের বর্তমান আলোচ্য বিষয়।
রহস্যময় এই জগতের বিপুল রহস্যের অতি সামান্যই আমরা জানি। আমাদের উচিত এই সামান্য জ্ঞান নিয়েই তুষ্ট থাকা। বেশি জানতে না চাওয়া। Ignorence is bliss.
পাদটিকা – ডাইনী
কৌতূহলী পাঠকদের জন্যে তারাশঙ্করের ডাইনী গল্পটি দিয়ে দেওয়া হলো।
ডাইনী
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
কে কবে নামকরণ করিয়াছিল সে ইতিহাস বিস্মৃতির গর্ভে সমাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু নামটি আজও পূর্ণগৌরবে বর্তমান ছাতি-ফাটার মাঠে জলহীন ছায়াশূন্য দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরটির এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া অপর প্রান্তের দিকে চাহিলে ওপারের গ্রামচিহ্নের গাছপালাগুলিকে কালো প্রলেপের মত মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন যেন কেমন উদাস হইয়া উঠে। এপার হইতে ওপার পর্যন্ত অতিক্রম করিতে গেলে তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া মানুষের মৃত্যু হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়; বিশেষ করিয়া গ্রীষ্মকালে। তখন যেন ছাতি-ফাটার মাঠ নামগৌরবে মহামারীর সমকক্ষতা লাভ করিবার জন্য লালায়িত হইয়া উঠে। ঘন ধূমাচ্ছিন্নতার মত ধূলার একটা ধূসর আস্তরণে মাটি হইতে আকাশের কোল পর্যন্ত আছন্ন হইয়া থাকে; অপর প্রান্তের সুদূর গ্রামচিহ্নে সীমারেখা প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। তখন ছাতি-ফাটার মাঠের সে রূপ অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর! শূন্যলোকে ভাসে একটি ধূধূসরতা, নিম্নলোকে তৃণচিহ্নহীন মাঠে সদ্য-নির্বাপিত চিতাভস্মের রূপ ও উত্তপ্ত স্পর্শ। ফ্যাকাশে রঙের নরম ধূলার রাশি প্রায় এক হাত পুরু হইয়া জমিয়া থাকে। গাছের মধ্যে এত বড় প্রান্তরটার এখানে ওখানে কতকগুলি থৈৱী ও সেয়াকুল জাতীয় কণ্ঠকগুল্ম। কোনো বড় গাছ নাই—বড় গাছ এখানে জন্মায় না, কোথাও জল নাই, গোটাকয়েক শুভূগর্ভ জলাশয় আছে, কিন্তু জল তাহাতে থাকে না।
মাঠখানির চারিদিকেই ছোট ছোট পল্লী—সবই নিরক্ষর চাষীদের গ্রাম; সত্য কথা তাহারা গোপন করিতে জানে না—তাহারা বলে, কোন অতীতকালের এক মহানাগ এখানে আসিয়া বসতি করিয়াছিল, তাহারই বিষের জ্বালায় মাঠখানির রসময়ী রূপ, বীজপ্রসবিনী শক্তি পুড়িয়া ক্ষার হইয়া গিয়াছে। তখন নাকি আকাশলোকে সঞ্চরমাণ পতঙ্গ-পক্ষীও পঙ্গু হইয়া ঝরা-পাতার মত ঘুরিতে ঘুরিতে আসিয়া পড়িত সেই মহানগরের গ্রামের মধ্যে।
সে নাগ আর নাই, কিন্তু বিষজর্জরত এখনও কমে নাই। অভিশপ্ত ছাতিফাটার মাঠ! তাহারই ভাগ্যদোষে ঐ বিষজর্জরতার উপরে আর এক ক্রুর দৃষ্টি তাহার উপর প্রসারিত হইয়া আছে। মাঠখানার পূর্বপ্রান্তে দলদলির জুলা, অর্থাৎ অত্যন্ত গভীর পঙ্কিল ঝরনা জাতীয় জলটার উপরেই রামনগরের সাহাদের যে আমবাগান আছে, সেই আমবাগানে আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়া বাস করিতেছে এক ডাকিনী—ভীষণ শক্তিশালিনী নিষ্ঠুর ক্রুর একটা বৃদ্ধা ডাকিনী। লোকে তাহাকে পরিহার করিয়াই চলে, তবু চল্লিশ বৎসর ধরিয়া দূর হইতে তাহাকে দেখিয়া তাহার প্রতিটি অঙ্গের বর্ণনা তাহারা দিতে পারে, তাহার দৃষ্টি নাকি অপলক স্থির, আর সে দৃষ্টি নাকি আজ চল্লিশ বৎসর ধরিয়াই নিবদ্ধ হইয়া আছে এই মাঠখানার উপর।
দলদলির উপরেই আমবাগানের ছায়ার মধ্যে নিঃসঙ্গ একখানি মেটে ঘর; ঘরখানার মুখ ঐ ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে। দুয়ারের সম্মুখেই লম্বা একখানি খড়ে-ছাওয়া বারান্দা—সেই বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া বসিয়ী নিমেষহীন দৃষ্টিতে বৃদ্ধা চাহিয়া থাকে ঐ ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে। তাহার কাজের মধ্যে সে আপন ঘরদুয়ারটি পরিষ্কার করিয়া গোবরমাটি দিয়া নিকাইয়া লয়, তাহার পর বাহি হয় ভিক্ষায়। দুই-তিনটা বাড়িতে গিয়া দাড়াইলেই তাহার কাজ হইয়া যায়, লোকে ভয়ে ভয়ে ভিক্ষা বেশী পরিমাণেই দিয়া থাকে; সেরখানেক চাল হইলেই সে আর ভিক্ষা করে না, বাড়ি ফিরিয়া আসে। ফিরিবার পথে অর্ধেক চাল বিক্রি করিয়া দোকান হইতে একটু নুন, একটু সরিষার তেল, অরি খানিকটা কেরোসিন তেল কিনিয়া আনে। বাড়ি ফিরিয়া আর একবার বাহির হয় শুকনো গোবর ও দুই-চারিটা শুকনো ডালপালার সন্ধানে। ইহার পর সমস্তটা দিন সে দাওয়ার উপর নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকে। এমনি করিয়া চল্লিশ বৎসর সে একই ধারায় ঐ মাঠের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। বৃদ্ধার বাড়ি এখানে নয়, কোথায় যে বাড়ি সে কথাও কেহ সঠিক জানে না। তবে একথা নাকি নিঃসন্দেহ যে, তিন-চারখানা গ্রাম একরূপ ধ্বংস করিয়া অবশেষে একদা আকাশপথে একটা গাছকে চালাইয়া লইয়া যাইতে যাইতে এই ছাতি-ফাটার মাঠের নির্জন রূপে মুগ্ধ হইয়া নামিয়া আসিয়া এইখানে ঘর বাঁধিয়াছে। নির্জনতা উহারা ভালোবাসে, মানুষের সাক্ষাৎ উহারা চায় না।
মানুষ দেখলেই যে তাহার অনিষ্ট-স্পৃহা জাগিয়া উঠে। ঐ সর্বনাশী লোলুপশক্তিটা সাপের মত লকলকে জিভ বাহির করিয়া ফণা তুলিয়া নাচিয়া উঠে। না হইলেও সে তো মানুষ।
আপনার দৃষ্টি দেখিয়া সে আপনিই শিহরিয়া উঠে। বহুকালের পুরানো একখানি—আয়না—সেই আয়নায় আপনার চোখের প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাহার নিজের ভয় হয়—ক্ষুদ্রায়তন চোখের মধ্যে পিঙ্গল দুইটি তারা, দৃষ্টিতে ছুরির মত একটা ঝকঝকে ধার। জরা-কুঞ্চিত মুখ, শণের মত সাদা চুল, দন্তহীন মুখ। আপন প্রতিবিম্ব দেখিতে দেখিতে ঠোঁট দুইটি তাহার থরথর করিয়া কাপিয়া উঠিল। সে আয়নাখানি নামাইয়া রাখিয়া দিল। আয়নাখানার চারিদিকে কাঠের ঘেরটা একেবারে কালো হইয়া গিয়াছে, অথচ মৃত অবস্থায় কি সুন্দর লালচে রঙ, আর কি পালিশই না ছিল! আর আয়নার কাচখানা ছিল রোদ-চকচকে পুকুরের জলের মত। কাচখানার ভিতর একখানা মুখ কি পরিষ্কারই না দেখা যাইত। ছোট কপালখানিকে ঘেরিয়া একরাশ চুল ঘন কালো নয়, একটু লালচে আভা ছিল চুলে; কপালের নিচেই টিকোল নাক; চোখ দুইটি ছোটই ছিল— চোখের তারা দুইটিও খয়রা রঙেরই ছিল–লোকেও সে চোখ দেখিয়া ভয় করিত। কিন্তু তাহার বড় ভালো লাগত, ছোট চোখ দুইটি আরও একটু ছোট করিয়া তাকাইলে মনে হইত, আকাশের কোল পর্যন্ত এ চোখ দিয়া দেখা যায়। অকস্মাৎ সে শিহরিয়া উঠিল—সরুণ দিয়া চেরা, ছুরির মত চোখে, বিজলীর মত এই দৃষ্টিতে যাহাকে তাহার ভালো লাগে তাহার আর রক্ষা থাকে না। কোথা দিয়া যে কি হইয়া যায়, কেমন করিয়া যে কি হইয়া যায়, সে বুঝিতে পারে না; তবে হইয়া যায়।
প্রথম দিনের কথা তাহার মনে পড়িয়া যায়।
বুড়া শিবতলার সম্মুখেই দুর্গাসায়রের বাঁধাঘাটের ভাঙা রাণার উপর সে দাঁড়াইয়া ছিল—জলের তলে তাহার ছবি উল্টা দিকে মাথা করিয়া দাঁড়াইয়া জলের ঢেউয়ে আঁকিয়া-বাঁকিয়া লম্বা হইয়া যাইতেছিল—জল স্থির হইলে লম্বা ছবিটি অবিকল তাহার মত দশ-এগারো বৎসরের মেয়েটি হইয়া তাহারই দিকে চাহিয়া হাসিতেছিল। হঠাৎ বামুন-বাড়ির হারু সরকার আসিয়া তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া টানিয়া সানবাঁধানো সিঁড়ির উপর তাহাকে আছাড় দিয়া ফেলিয়া দিয়াছিল। তাহার সে রূঢ় কণ্ঠস্বর সে এখনও শুনিতে পায় হারামজাদী ডাইনী, তুমি আমার ছেলেকে নজর দিয়েছ? তোমার এত বড় বাড়? খুন করে ফেলব হারামজাদীকে।
হারু সরকারের সে ভয়ঙ্কর মূর্তি যেন স্পষ্ট চোখের উপর ভাসিতেছে।
সে ভয়ে বিহ্বল হইয়া চীকার করিয়া কাঁদিয়াছিল—ওগো বাবু গো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি গো!
—আম দিয়ে মুড়ি খেতে দেখে যদি তোর লোভই হয়েছিল, তবে সে-কথা বললি না কেন হারামজাদী?
হ্যাঁ, লোভ তো তাহার হইয়াছিল, সত্যই হইয়াছিল, মুখের ভিতরটা জলে ভরিয়া পরিপূর্ণ হইয়াছিল!
-হারামজাদী, আমার ছেলে যে পেট-বেদনায় ছটফট করছে।
সে আজও অবাক হইয়া যায়, কেমন করিয়া এমন হইয়াছিল—কেমন করিয়া এমন হয়! কিন্তু এ যে সত্য তাহাতে তো আর সন্দেহ নাই। তাহার স্পষ্ট মনে পড়িতেছে, সে হারু সরকারের বাড়ি গিয়া অঝোরঝরে কাদিয়াছিল, আর বার বার মনে মনে বলিয়াছিল—হে ঠাকুর, ভালো করে দাও, ওকে ভালো করে দাও। কতবার সে মনে মনে বলিয়াছিল—দৃষ্টি আমার ফিরাইয়া লইতেছি, এই লইলাম। আশ্চর্যের কথা, কিছুক্ষণ পরে বার-দুই বমি করিয়া ছেলেটি সুস্থ হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
সরকার বলিয়াছিল, ওকে একটা আমি আর দুটি মুড়ি দাও দেখি।
সরকার-গিন্নী একটা ঝাঁটা তুলিয়াছিল, বলিয়াছিল, ছাই দেব হারামজাদীর মুখে। মা-বাবা-মরা অনাথা মেয়ে বলে দয়া করি—যেদিন হারামজাদী আসে সেই দিনই আমি ওকে খেতে দিই। আর ও কিনা আমার ছেলেকে নজর দেয়! আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে দেখ। ওর ঐ চোখের দৃষ্টি দেখে বরাবর আমার সন্দেহ ছিল, কখনও আমি ওর সাক্ষাতে ছেলেপুলেকে খেতে দিই নি। আজ আমি খোকাকে খেতে দিয়ে ঘাটে গিয়েছি, আর ও কখন এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছে। সে কি দৃষ্টি ওর!
লজ্জায় ভয়ে সে পালাইয়া গিয়াছিল। সেদিন রাত্রে সে গ্রামের মধ্যে কাহারও বাড়ির দাওয়ায় শুইতে পারে নাই; ইয়াছিল গ্রামের প্রান্তে ঐ বুড়াশিবতলায়। অঝেরঝরে সে সমস্ত রাত্রি কাদিয়াছিল আর বলিয়াছিল—হে ঠাকুর, আমার দৃষ্টিকে ভালো করে দাও, না-হয় আমাকে কানা করে দাও।
গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস মাটির মূর্তির মত নিস্পন্দ বৃদ্ধার অবয়বের মধ্যে এতক্ষণে ক্ষীণ একটি চাঞ্চল্যের সঞ্চার করিল। ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাশিতে লাগিল।
পূর্বজন্মের পাপের যে খণ্ডন নাই—দেবতার দোষই বা কি, আর সাধ্যই বা কি? বেশ মনে আছে, গৃহস্থের বাড়িতে সে আর ঢুকিবে না ঠিক করিয়াছিল। বাহির-দুয়ার হইতেই সে ভিক্ষা চাহিত—গলা দিয়া কা যেন বাহির হইতে চাহিত না, কোনওমতে বহুকষ্টে বলিত, দুটি ভিক্ষে পাই মা! হরিবোল।
—কে রে? তুই বুঝি? খবরদার ঘরে ঢুকবি নে! খবরদার!
—না মা, ঘরে ঢুকব না মা।
কিন্তু পরক্ষণেই মনের মধ্যে কি যেন একটা কিলবিল করিয়া উঠিত, এখনও উঠে। কি সুন্দর মাছভাজার গন্ধ, আহা-হা! বেশ খুব বড় পাকা-মাছের খানা বোধ হয়।
—এই—এই! হারামজাদী বেহায়া! উঁকি মারছে দেখ! সাপের মত!
ছি ছি ছি! সত্যিই তো সে উঁকি মারিতেছে—রান্নাশালার সমস্ত আয়োজন তাহার নরুণ-চেরা ক্ষুদ্র চোখের এক দৃষ্টিতে দেখা হইয়া গিয়াছে। মুখের ভিতর জিবের তলা হইতে ঝরনার মত জল উঠিতেছে।
বহুকালের গড়া জীর্ণ-বিবর্ণ মূর্তি যেন কোথায় একটা নাড়া পাইয়া দুলিয়া উঠিল; ফাট-ধরা শিলিগ্রন্থি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শৃঙ্খলাহীন অসমগতিতে চঞ্চল হইয়া পড়িল; অস্থিরভাবে বৃদ্ধা এবার নড়িয়া-চড়িয়া বসিল বা হাতে শীর্ণ দীর্ঘ আঙুলগুলির নখাঘ দাওয়ার মাটির উপর বিদ্ধ হইয়া গেল। কেন এমন হয়, কেমন করিয়া এমন হয়, সে-কথা সারাজীবন ধরিয়াও যে বুঝিতে পারা গেল না। অস্থির চিন্তায় দিশাহারা চিত্তের নিকট সমস্ত পৃথিবীই যেন হারাইয়া যায়।
কিন্তু সে তার কি করিবে? কেহ কি বলিয়া দিতে পারে, তার কি করিবে, কি করিতে পারে? প্রহৃত পশু যেমন মরীয়া হইয়া অকস্মাৎ আঁ-আঁ গর্জন করিয়া উঠে, ঠিক তেমনই ই-ই শব্দ করিয়া অকস্মাৎ বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া শণের মত চুলগুলাকে বিশৃঙ্খল করিয়া তুলিয়া খাড়া সোজা হইয়া বসিল। ফোকলা মাড়ির উপর মাড়ি চাপিয়া, ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে নরুণ-চেরা চোখে চিলের মত দৃষ্টি হানিয়া হাঁপাইতে আরম্ভ করিল।।
ছাতি-ফাটার মাঠটা যেন ধোঁয়ায় ভরিয়া ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। চৈত্র মাস, বেলা প্রথম প্রহর শেষ হইয়া গিয়াছে। মাঠ-ভরা ধােয়ার মধ্যে ঝিকিমিকি ঝিলিমিলির মত কি একটা যেন ছুটিয়া চলিয়াছে। একটা ফুকার যদি সে দেয়, তবে মাঠের ধূলার রাশি উড়িয়া আকাশময় হইয়া যাইবে।
ঐ ধোঁয়ার মধ্যে জমাট সাদার মত ওটা কি নড়িতেছে যেন! মানুষ? হ্যাঁ, মানুষই তো! মনের ভিতরটা তাহার কেমন করিয়া উঠে। ফুঁ দিয়া ধূলা উড়াইয়া, দিবে মানুষটাকে উড়াইয়া? হি-হি-হি করিয়া পাগলের মত হাসিয়া একটা অবোধ নিষ্ঠুর কৌতুক তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছিল।
দুই হাতের মুঠি প্রাণপণ শক্তিতে শক্ত করিয়া সে আপনার উচ্ছল মনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিল–না-না-না। ছাতি-ফাটার মাঠে মানুষটা ধূলার গরমে শ্বাসরোধী ঘনত্বে মরিয়া যাইবে।
নাঃ, ওদিকে আর সে চাহিবেই না। তাহার চেয়ে বরং উঠানটায় আর একবার বঁটা বুলাইয়া, ছড়াইয়া-পড়া পাতা ও কাঠকুটাগুলাকে সাজাইয়া রাখিলে কেমন হয়? বসিয়া বসিয়াই সে ভাঙ্গিয়া-পড়া দেহখানাকে টানিয়া উঠানে ঝাঁটা বুলাইতে শুরু করিল। জড়ো-করা পাতাগুলা ফরফর করিয়া অকস্মাৎ সর্পিল ভঙ্গিতে ঘুরপাক খাইয়া উড়িতে আরম্ভ করিল। ঝটার মুখে টানিয়া-আনা ধূলার রাশি তাহার সহিত মিশিয়া বুড়ীকেই যেন জড়াইয়া ধরিতেছিল, মুখে-চোখে ধূলা মাখাইয়া তাহাকে বিব্রত করিয়া তুলিল। দ্রুত আবর্তিত পাতাগুলা তাহাকে যেন সর্বাঙ্গে প্রহার করিতেছে। জরাগ্রস্ত রোমহীন আহত মার্জারীর মত ক্রদ্ধ মুখভঙ্গি করিয়া বদ্ধী আপনার হাতের ঝাঁটাগাছটা আস্ফালন করিয়া বলিয়া উঠিল—বেরো বেরো বেরো।
বার বার সে ঝাটা দিয়া বাতাসের ঐ আবর্তটাকে আঘাত করতে চেষ্টা করিল, আবর্তটা মাঠের উপর দিয়া ঘুরপাক দিতে দিতে ছুটিয়া গেল। মাঠের ধূলা হু-হু করিয়া উড়িয়া ধূলার একটা ঘুরন্ত স্তম্ভ হইয়া উঠিতেছে! শুধু কি একটা! এখানে ওখানে ছোট বড় কত ঘুরপাক উঠিয়া পড়িয়াছে মাঠটা যেন নাচিতেছে। একটা যেন হাজারটা হইয়া উঠিতেছে! একটা অদ্ভুত আনন্দে বৃদ্ধার মন শিশুর মত অধীর হইয়া উঠিল; সহসা সে জ দেহে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঝাটাসুদ্ধ হাতটা প্রসারিত করিয়া সাধ্যমত গতিতে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে টলিতে টলিতে বসিয়া পড়িল। পৃথিবীর এক মাথা উঁচু হইয়া তাহাকে যেন গড়াইয়া কোন অতলের দিকে ফেলিয়া দিতে চাহিতেছে। উঠিয়া দাড়াইবার শক্তিও হার ছিল না। ছোট শিশুর মত হামাগুড়ি দিয়া সে দাওয়ার দিকে অগ্রসর হইল। দারুণ তৃষ্ণায় গলা পর্যন্ত শুকাইয়া গিয়াছে।
–কে রইছ গো ঘরে? ওগো!
জলে-পচা নরম মরা-ডালের মত বৃদ্ধা বাকিয়া-চুরিয়া দাওয়ার একধারে পড়িয়া ছিল। মানুষের কণ্ঠস্বর শুনিয়া কোনোমতে মাথা তুলিয়া সে বলিল, কে?
ধূলিধূসর দেহে শুষ্ক পাণ্ডুর মুখ একটি যুবতী মেয়ে বুকের ভিতর কোনো একটা বস্তু কাপড়ের আবরণে ঢাকিয়া বহুকষ্টে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। মেয়েটি বোধ হয় ছাতি-ফাটার মাঠ পার হইয়া আসিল। কণ্ঠস্বর অনুসরণ করিয়া বৃদ্ধাকে দেখিয়া মেয়েটি সভয়ে শিহরিয়া উঠিল, এক পা এক পা করিয়া পিছু হাঁটিতে হাঁটিতে বলিল, একটুকুন জল।
মাটির উপর হাতের ভর দিয়া বৃদ্ধা এবার অতিকষ্টে উঠিয়া বসিল। মেয়েটির শুষ্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আহা-হা বাছা রে! আয়, আয়। বস।
সভয়ে সন্তর্পণে দাওয়ার একপাশে বসিয়া মেয়েটি বলিল, একটুকুন জল দাও গো!
মমতায় বৃদ্ধার মন গলিয়া গেল, সে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর ঢুকিয়া বড় একটা ঘটি পূর্ণ করিয়া জল ঢালিয়া এক টুকরা পাটালির সন্ধানে হাঁড়িতে হাত পুরিয়া বলিল, আহা মা, এই রোদে ঐ রাব্লুসী মাঠে কি বলে বের হলি তুই?
বাহিরে বসিয়া মেয়েটি তখনও হাঁপাইতেছিল, কম্পিত শুষ্ক কণ্ঠে সে বলিল, আমার মায়ের বড় অসুখ মা। বেরিয়েছিলাম রাত থাকতে। মাঠের মাথায় এসে, আমার পথ ভুল হয়ে গেল, মাঠের ধারে ধারে আমার পথ, কিন্তু এসে পড়লাম একেবারে মধ্যিখানে।।
জলের ঘটি ও পাটালির টুকরাটি নামাইয়া দিয়া বৃদ্ধা শিহরিয়া উঠিল— মেয়েটির পাশে একটি শিশু! গরম জলে সিদ্ধ শাকের মত শিশুটি ঘর্মাক্ত দেহে নেতাইয়া পড়িয়াছে। বৃদ্ধা ব্যস্ত হইয়া বলিল, দে, দে বাছা, ছেলেটার চোখেমুখে জল দে! মেয়েটি ছেলের মুখে-চোখে জল দিয়া আঁচল ভিজাইয়া সর্বাঙ্গ মুছিয়ী দিল।
বৃদ্ধা দূরে বসিয়া ছেলেটির দিকে তাকাইয়া রহিল; স্বাস্থ্যবতী যুবতী মায়ের প্রথম সন্তান বোধ হয়, হৃষ্টপুষ্ট নধর দেহ-কচি লাউডগার মত নরম, সরস। দন্তহীন মুখে কম্পিত জিহ্বার তলে ফোয়ারাটা যেন খুলিয়া গেল, নরম-গরম লালায় মুখটা ভরিয়া উঠিতেছে।
এঃ, ছেলেটা কি ভীষণ ঘামিতেছে! দেহের সমস্ত জল কি বাহির হইয়া আসিতেছে! চোখ দুইটা লাল হইয়া উঠিয়াছে! তবে কি—? কিন্তু সে তাহার কি করিবে? কেন ও তাহার সামনে আসিল? কেন আসিল? ঐ কোমল নধরদেহ শিশু ময়দার মত ঠাসিয়া চটকাইয়া তাহার শুষ্ক কঙ্কাল বুকে চাপিয়া নিঙড়াইয়া। জীর্ণ জরজর তুকের উপর একটা রোমাঞ্চিত শিহরণ ক্ষণে ক্ষণে বহিয়া যাইতেছে, সর্বাঙ্গ তাহার থরথর করিয়া কাপিতেছে। এ ঘামে ছেলেটার দেহের সমস্ত রস নিঙড়াইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে, মুখের লালার মধ্যে স্পষ্ট তাহার রসাস্বাদ! যাঃ! নিতান্ত অসহায়ের মত আর্তস্বরে সে বলিয়া উঠিল, খেয়ে ফেললাম—ছেলেটাকে খেয়ে ফেললাম রে। পালা পালা, তুই ছেলে নিয়ে পালা বলছি।
শিশুটির মা ঐ যুবতী মেয়েটি দুই হাতে ঘটি তুলিয়া ঢকঢক করিয়া জল খাইতেছিল তাহার হাত হইতে ঘটিটা খসিয়া পড়িয়া গেল; সে আতঙ্কিত বিবর্ণ মুখে বৃদ্ধার বিস্ফারিত-দৃষ্টি ক্ষুদ্র চোখের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, এটা তবে রামনগর? তুমি সেই——সে ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া ছেলেটিকে ছোঁ মারিয়া কুড়াইয়া লইয়া যেন পক্ষিণীর মত ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
কিন্তু সে কি করিবে? আপনার বুকখানাকে তাহার নিজের জীর্ণ আঙুলের নখ দিয়া চিরিয়া ঐ লোভটাকে বাহির করিয়া দিতে ইচ্ছা করে। জিভটাকে কাটিয়া ফেলিতে পারিলে সে পরিত্রাণ পায়। ছি ছি ছি! কাল সে গ্রামের পথে বাহির হইবে কোন্ মুখে? লোকে কেহ কিছু বলিতে সাহস করিবে না, সে তাহা জানে; কিন্তু তাহাদের মুখে চোখে যে কথা ফুটিয়া উঠিবে তাহা সে চোখে দেখিবে কি করিয়া? ছেলেমেয়েরা এমনিই তাহাকে দেখিলে পলাইয়া যায়, কেহ কেহ কাদিয়াও উঠে; আজিকার ঘটনার পর তাহারা বোধ হয় আতঙ্কে জ্ঞান হারাইয়া পড়িয়া যাইবে। ছি ছি ছি!
এই লজ্জায় একদা সে গভীর রাত্রে আপনার গ্রাম ছাড়িয়া পলাইয়াছিল, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে, তখন সে তো অনেকটা ডাগর হইয়াছে। তাহারই বয়সী তাহাদেরই স্বজাতীয়া সাবিত্রীর পূর্বদিন রাত্রে খোকা হইয়াছে। সকালেই সে দেখিতে গিয়াছিল। সাবিত্রী তখন ছেলেটিকে লইয়া বাহিরে রৌদ্রে আসিয়া বসিয়া গায়ে রোদ লইতেছে। ছেলেটি শুইয়া ছিল কাথার উপর। কালো চকচকে কি সুন্দর ছেলেটি!
ঠিক এমনি ভাবেই, ঠিক আজিকার মতই সেদিনও তাহার মনে হইয়াছিল, ছেলেটিকে লইয়া আপনার বুকে চাপিয়া নরম ময়দার তালের মত ঠাসিয়া, ঠোঁট দিয়া চুমায় চুমায় চুষিয়া তাহাকে খাইয়া ফেলে। তখন সে বুঝিতে পারিত না, মনে হইত, এ বুঝি কোলে লইয়া আদর করিবার সাধ।
সাবিত্রীর শাশুড়ী হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিয়া সাবিত্রীকে তিরস্কার করিয়াছিল, বলি ওলো, আক্কেলখাগী হারামজাদী, খুব যে ভাবীসাবীর সঙ্গে মস্করা জুড়েছিস! আমার বাছার যদি কিছু হয়, তবে তোকে বুঝব আমি—হ্যাঁ।
তারপর বাহিরের দিকে আঙুল বাড়াইয়া তাহাকে বলিয়াছিল, বেরো বলছি, বেরো। হারামজাদীর চোখ দেখ দেখি!
সাবিত্রী ছেলেটিকে তাড়াতাড়ি বুকে ঢাকিয়া দুর্বল শরীরে থরথর করিয়া কাপিতে কাপিতে ঘরের মধ্যে পলাইয়া গিয়াছিল। মর্মান্তিক দুঃখে আহত হইয়া সে চলিয়া আসিয়াছিল। বার বার সে মনে মনে বলিয়াছিল—ছি ছি! তাই নাকি সে পারে? হইলই বা সে ডাইনী, কিন্তু তাই বলিয়া কি সে সাবিত্রীর ছেলের অনিষ্ট করিতে পারে? ছি ছি! ভগবানকে ভাকিয়া সে বলিয়াছিল—তুমি ইহার বিচার করিবে। একশ বৎসর পরমায়ু দিও তুমি সাবিত্রীর খোকাকে, দয়া করিয়া প্রমাণ করিয়া দিও, সাবিত্রীর খোকাকে আমি কত ভালোবাসি!
কিন্তু অপরাহ্নবেলা হইতে-না-হইতেই তাহার অত্যুগ্র বিষময়ী দৃষ্টিক্ষুধার কলঙ্ক অতি নিষ্ঠুরভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়া গিয়াছিল।
সাবিত্রীর ছেলেটি নাকি ধনুকের মত বাঁকিয়া গিয়াছে আর এমনভাবে কাতরাইতেছে যে, ঠিক যেন কেহ তাহার রক্ত চুষিয়া লইতেছে।
লজ্জায় সে পলাইয়া গিয়া গ্রামের শশানের জঙ্গলের মধ্যে সন্তর্পণে আত্মগোপন করিয়া বসিয়াছিল। বার বার মুখের থুথু মাটিতে ফেলিয়া দেখিতে চাহিয়াছিল—কোথায় রক্ত। গলায় আঙুল দিয়া বমি করিয়াও দেখিতে চাহিয়াছিল, বুঝিতে চাহিয়াছিল। প্রথম বারদুয়েক বুঝিতে পারে নাই; কিন্তু তাহার পরই কুটি কুটি রক্তের ছিটা—শেষকালে একেবারে খানিকটা তাজা রক্ত উঠিয়া আসিয়াছিল। সেই দিন সে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছে আপনার অপার নিষ্ঠুর শক্তির কথা।
গভীর রাত্রে—সেদিন বোধ হয় চতুর্দশীই ছিল, যা চতুর্দশীই ভো-বাকুলের তারাদেবীতলায় পূজার ঢাক বাজিতেছিল। জাগ্রত মা তারাদেবী; পূর্ণিমার আগের প্রতি চতুর্দশীতে মায়ের পূজা হয়, বলিদান হয়। কিন্তু মা-তারাও তাহাকে দয়া করেন নাই। কতবার সে মানত করিয়াছে—মা, আমাকে ডাইনী হইতে মানুষ করিয়া দাও, আমি তোমাকে বুক চিরিয়া রক্ত দেব।কিন্তু মা মুখ তুলিয়া চাহেন নাই।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বৃদ্ধার মন দুঃখে হতাশায় উদাস হইয়া গেল। মনের সকল কথা ছিন্নসূত্র ঘুড়ির মত শিথিলভাবে দোল খাইতে খাইতে ভাসিয়া কোন্ নিরুদ্দেশলোকে হারাইয়া যাইতেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চোখের পিঙ্গল তারায় অর্থহীন দৃষ্টি জাগিয়া উঠিল। সে সেই দৃষ্টি মেলিয়া ছাতি-ফাটার মাঠের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। ছাতি-ফাটার মাঠ ধূলায় ধূসর, বাতাস স্তব্ধ; ধূসর ধূলায় গাঢ় নিস্তরঙ্গ আস্তরণের মধ্যে সমস্ত যেন বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
ঐ অপরিচিতা পথচারিণী মেয়েটির ছেলেটা এ গ্রাম হইতে খান দুই গ্রাম পার হইয়া পথেই মরিয়া গিয়াছে। যে ঘাম সে ঘামিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে ঘাম আর থামে নাই। দেহের সমস্ত রস নিঙড়াইয়া কে যেন বাহির করিয়া দিল! কে আবার? ঐ সর্বনাশী! মেয়েটি বুক চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলিয়াছে, কেন গেলাম গো—আমি ঐ ডাইনীর কাছে কেন গেলাম গো। আমি কি করলাম গো!
লোক শিহরিয়া উঠিল, তাহার মৃত্যু-কামনা করিল। একবার জনকয়েক জোয়ান ছেলে তাহাকে শাস্তি দিবার জন্য ঝরনাটার কাছে আসিয়াও জুটিল। বৃদ্ধা ডাইনী ক্রোধে সাপিনীর মত খুঁসিয়া উঠিল–সে তাহার কি করিবে? সে আসিল কেন? তাহার চোখের সম্মুখে এমন সরল লাবণ্যকোমল দেহ ধরিল কেন? অকস্মাৎ অত্যন্ত ক্রোধে সে একসময় চিলের মত চীৎকার করিয়া উঠিল তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে। সেই চীঙ্কার শুনিয়া তাহারা পলাইয়া গেল। কিন্তু সে এখনও ক্রুদ্ধা অজগরীর মত ফুঁসিতেছে, তাহার অন্তরের বিষ সে যেন উদগার করিতেছে, আবার নিজেই গিলিতেছে। কখনও তাহার হি-হি করিয়া হাসিতে ইচ্ছা হইতেছে, কখনও বা ক্রুদ্ধ চীৎকারে ঐ ছাতি-ফাটার মাঠটা কাপাইয়া তুলিবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠিতেছে, কখনও বা ইচ্ছা হইতেছে—বুক চাপড়াইয়া মাথার চুল ছিড়িয়ী পৃথিবী ফাটাইয়া হা-হা করিয়া সে কাঁদে। ক্ষুধাবোধ আজ বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, রান্নাবান্নারও আজ দরকার নাই। এঃ, সে আজ একটা গোটা শিশু-দেহের রস অদৃশ্য-শোষণে পান করিয়াছে।
ঝির ঝির করিয়া বাতাস বহিতেছিল। শুক্লা নবমীর চাঁদের জ্যোৎস্নায় ছাতিফাটার মাঠ একখানা সাদা ফরাশের মত পড়িয়া আছে। কোথায় একটা পাখী অশ্রান্তভাবে ডাকিয়া চলিয়াছে—চোখ গেল! চোখ গেল! আমগাছগুলির মধ্যে ঝিঝিপোকা ডাকিতেছে। ঘরের পিছনের ঝরনার ধারে দুইটা লোক যেন মৃদুগুঞ্জনে কথা কহিতেছে। আবার সেই ছেলেগুলা তাহার কোনো অনিষ্ট করিতে আসিয়াছে নাকি? অতি সন্তুর্পিত মৃদু পদক্ষেপে বৃদ্ধা ঘরের কোণে আসিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল। না, তাহারা নয়। এ বাউরীদের সেই স্বামী-পরিত্যক্তা উচ্ছলা মেয়েটা আর তাহারই প্রণয়মুগ্ধ বাউরী ছেলেটা।
মেয়েটা বলিতেছে, না, কে আবার আসবে এখুনি, আমি ঘর যাব।
ছেলেটা বলিল, হে! এখানে আসছে নোকে; দিনেই কেউ আসে না, তা রাতে।
—তা হোক। তোর বাবা যখন আমার সাথে তোর সাঙ্গা দেবে না, তখন তোর সাথে এখানে কেনে থাকব আমি?
ছি ছি ছি! কি লজ্জা গো! কোথায় যাইবে সে! যদি তাই গোপনে দুইজনে দেখা করিতে আসিয়াছে, তবে মরিতে ওখানে কেন? তাহার এই বাড়িতে আসিল না কেন? তাহার মত বৃদ্ধাকে আবার লজ্জা কি? কি বলিতেছে ছেলেটা?—বাবামা বিয়ে না দেয়, চল, তোতে আমাতে ভিনগয়ে গিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতব। তোকে নইলে আমি বাঁচব না।
আ মরণ ছেলেটির পছন্দের! ঐ কুপোর মত মেয়েটাকে উহার এত ভালো লাগিল! তাহার মনে পড়িয়া গেল, তাহাদের গ্রাম হইতে দশ ক্রোশ দূরের বোলপুর শহরের পানওয়ালার দোকানের সেই বড় আয়নাটা। আয়নাটার মধ্যে লম্বা ছিপছিপে চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ের ছবি। একমাথা রুক্ষ চুল, ছোট কপাল, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট। চোখ দুটি ছোট, তারা দুটি খয়রা রঙের; কিন্তু সে চোখের বাহার ছিল বৈকি। আয়নার দিকে তাকাইয়া সে নিজের ছবিই দেখিতেছিল। তখন আয়না তো তাহার ছিল না, আয়নাতে আপনার ছবি সে কখনো কোনোদিন দেখে নাই।—আরে, তুই আবার কে রে? কোথা থেকে এলি?– লম্বা-চওড়া এক জোয়ান পুরুষ তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় সে সবে বোলপুর আসিয়াছে। সাবিত্রীর ছেলেটাকে খাইয়া ফেলিয়া সেই চতুর্দশীর রাত্রেই গ্রাম ছাড়িয়া বোলপুরে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছিল। লোকটাকে দেখিয়া তাহার খারাপ লাগে নাই; কিন্তু তাহার কথার ঢঙটী বড় খারাপ লাগিয়াছিল। সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া বলিয়াছিল, কেনে, যেথা থেকে আসি না কেনে, তোমার কি?
—আমার কি? এক কিলে তোকে মাটির ভেতর বসিয়ে দেব। দেখেছিস কিল?
ক্রুদ্ধ হইয়া দাঁতে দাঁত চাপিয়া সে ঐ লোকটির দেহের রক্ত শোষণ করিবার কামনা করিয়াছিল। কালো পাথরের মত নিটোল শরীর। জিভের নীচে ফোয়ারা হইতে জল ছুটিয়াছিল। কোনো উত্তর না দিয়া তীব্র তির্যক ভঙ্গিতে লোকটার দিকে চাহিতে চাহিতে সে চলিয়া আসিয়াছিল।
সেদিন সূর্য উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বদিকে চুনে-হলুদে রঙের প্রকাণ্ড থালার মত নিটোল গোল চাদ উঠিতেছিল; বোলপুরের একেবারে শেষে রেল-লাইনের ধারে বড় পুকুরটার বাঁধা ঘাটে বসিয়া আঁচল হইতে মুড়ি খাইতে খাইতে সে ঐ চাঁদের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। চাঁদের আলো তখনও দুধবরণ হইয়া উঠে নাই। ঘোলাটে আবছা আলোয় চারিদিক ঝাপসা দেখাইতেছিল। সহসা কে আসিয়া তাহার সম্মুখে দাড়াইতেই সে চমকিয়া উঠিল। সেই লোকটা! সে হি হি করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল—অজিও বেশ মনে আছে- হাসির সঙ্গে সঙ্গে তাহার গালে দুইটা টোল খাইয়াছিল—হাসিলে তাহার গালে টোল খাইত সে বলিয়াছিল, কথার জবাব না দিয়ে পালিয়ে এলি যে?
সে বলিয়াছিল, এই দেখ, তুমি যাও বলছি, নইলে আমি চেঁচাব।
—চেঁচাবি? দেখছিস পুকুরের পাঁক, টুটি টিপে তোকে পুঁতে দোব ঐ পাকে।
তাহার ভয় হইয়াছিল, সে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, লোকটা অকস্মাৎ মাটির উপর ভীষণ জোরে পা ঠুকিয়া চীৎকার করিয়া একটা ধমক দিয়া উঠিয়াছিল, ধেৎ!
সে আঁতকাইয়া উঠিয়াছিল—আঁচল-ধরা হাতের মুঠিটা খসিয়া গিয়া মুড়িগুলি ঝরঝর করিয়া পড়িয়া গিয়াছিল। লোকটার হি-হি করিয়া সে কি হাসি! সে একেবারে কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল। লোকটা অপ্রস্তুত হইয়া বলিয়াছিল, দূর-রো, ফ্যাচকাঁদুনে মেয়ে কোথাকার! ভাগ!
তাহার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট স্নেহের আভাস ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সে কাঁদিতে কাঁদিতেই বলিয়াছিল, তুমি মারবা নাকি?
-না, না, মারব কেনে? তোকে শুধালাম—কুথায় বাড়ি তোর, তু একেবারে খ্যাক করে উঠলি। তাথেই বলি—
বলিয়া আবার সে হি-হি করিয়া হাসিতে লাগিল।
–আমার বাড়ি অ্যানেক ধুর, পাথরঘাটা।
-কি নাম বটে তোর? কি জাত?
—নাম বটে আমার সোরধনি, লোকে ডাকে সরা বলে। আমরা ডোম বটে।
লোকটা খুব খুশী হইয়া বলিয়াছিল, আমরাও ডোম।–তা ঘর থেকে পালিয়ে এলি কেনে?
তাহার চোখে আবার জল আসিয়াছিল; সে চুপ করিয়া ভাবিতেছিল, কি বলিবে?
-রাগ করে পালিয়ে এসেছিস বুঝি?
—না।
—তবে?
—আমার মা-বাবা কেউ নাই কিনা? কে খেতে পরতে দিবে? তাই খেটে খেতে এসেছি হেথাকে।
—বিয়ে করিস নাই কেনে—বিয়ে?
সে অবাক হইয়া লোকটার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল। তাহাকে—তাহার মত ডাইনীকে–কে বিবাহ করিবে? সে শিহরিয়া উঠিয়াছিল। তারপর হঠাৎ সে কেমন লজ্জায় অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।
বৃদ্ধা আজও অকারণে নতশিরে মাটির উপর ক্রমাগত হাত বুলাইয়া ধূলাকাঁকর জড়ো করিতে আরম্ভ করিল। সকল কথার সূত্র যেন হারাইয়া গিয়াছে, মালা গাঁথিতে গাঁথিতে হঠাৎ সুতা হইতে সঁচটা পড়িয়া গেল।
আঃ, কি মশা! মৌমাছির চাক ভাঙিলে যেমন মাছিগুলা মানুষকে ছাঁকিয়া ধরে, তেমনই করিয়া সর্বাঙ্গে ঘঁকিয়া ধরিয়াছে। কই? মেয়েটা আর ছেলেটার কথাবার্তা তো আর শোনা যায় না! চলিয়া গিয়াছে! সন্তর্পণে ঘরের দেওয়াল ধরিয়া ধরিয়া বৃদ্ধা আসিয়া দাওয়ার উপর বসিল। কাল আবার উহারা নিশ্চয় আসিবে। তাহার ঘরের পাশাপাশি জায়গার মত আর নিরিবিলি জায়গা কোখায়? এ চাকলার কেহ আসিতে সাহস করিবে না। তবে উহারা ঠিক আসিবে। ভালোবাসায় কি ভয় আছে।
অকস্মাৎ তাহার মনটা কিলবিল করিয়া উঠিল। আচ্ছ, ঐ ছেড়াটাকে সে খাইবে? শক্ত-সমর্থ জোয়ান শরীর!
সঙ্গে সঙ্গে শিহরিয়া উঠিয়া বার বার সে ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া উঠিল, না, না।
কয়েক মুহূর্ত পরে সে আপন মনে দুলিতে আরম্ভ করিল, তাহার পর উঠিয়া উঠানে ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতে শুরু করিয়া দিল। সে বাট বহিতেছে! আজ যে সে একটা শিশুকে খাইয়া ফেলিয়াছে, আজ তো ঘুমাইবার তাহার উপায় নাই। ইচ্ছা হয়, এই ছাতি-ফাটার মাঠটা পার হইয়া অনেক দূর চলিয়া যায়। লোকে বলে, সে গাছ চালাইতে জানে। জানিলে কিন্তু ভালো হইত। গাছের উপর বসিয়া আকাশ মেঘ চিরিয়া হু-হু করিয়া যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যাইত। কিন্তু ঐ মেয়েটা আর ছেলেটার কথাগুলো শোনা হইত না! উহারা ঠিক কাল আবার আসিবে।
হি হি হি! ঠিক আসিয়াছে! ছোঁড়াটা চুপ করিয়া বসিয়া আছে, ঘন ঘন ঘাড় ফিরাইয়া পথের দিকে চাহিতেছে। আসিবে রে, সে আসিবে!
তাহার নিজের কথাই তো বেশ মনে আছে। সারাদিন ঘুরিয়া ফিরিয়া সন্ধ্যাবেলায় সেই জোয়ানটা ঠিক পুকুরের ঘাটে আসিয়াছিল। তাহার আগেই আসিয়া বসিয়াছিল, পথের দিকে চাহিয়া বসিয়া আপন মনে পা দোলাইতেছিল। সে নিজে আসিয়া দাঁড়াইয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়াছিল।
—এসেছিস? আমি সেই কখন থেকে বসে আছি।
বৃদ্ধা চমকিয়া উঠিল। ঠিক সেই কথা, সে তাহাকে এই কথাটাই বলিয়াছিল। ওঃ, ঐ ছোঁড়াটাও ঠিক সেই কথাটিই বলিতেছে। মেয়েটি সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে; নিশ্চয় সে মুখ টিপিয়া হাসিতেছে।
সেদিন সে একটা ঠোঙাতে করিয়া খাবার আনিয়াছিল। তাহার সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, কাল তোর মুড়ি পড়ে গিয়েছিল। লে।
সে কিন্তু হাত বাড়াইতে পারে নাই। তাহার বুকের দুর্দান্ত লোভ সাপের মত তাহার ডাইনী মনটা বেদের বাঁশী শুনিয়া যেন কেবলই দুলিয়া দুলিয়া নাচিয়াছিল, ছোবল মারিতে ভুলিয়া গিয়াছিল।
তারপর সে কি করিয়াছিল?, মনে আছে। সে কি আর ইহারা জানে,
পারে? ও মাগো! ঠিক তাই। এ ছেলেটাও যে মেয়েটার মুখে নিজে হাতে কী তুলিয়া দিতেছে। বুড়ী দুই হাতে মাটির উপর মৃদু করাঘাত করিয়া নিঃশব্দ হাসি হাসিয়া যেন ভাঙিয়া পড়িল।
কিন্তু নিতান্ত আকস্মিকভাবেই হাসি তাহার থামিয়া গেল। সহসা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে শুব্ধভাবে গাছে হেলান দিয়া বসিল। তাহার মনে পড়িল, ইহার পরই সে তাহাকে বলিয়াছিল–আমাকে বিয়ে করবি সরা?
সে কেমন হইয়া গিয়াছিল। কিছু বলিতে পারে নাই, কিছু ভাবিতেও পারে নাই। শুধু কানের পাশ দুইটা গরম হইয়া উঠিয়াছিল, হাত-পা ঘামিয়া টসটস করিয়া জল ঝরিয়াছিল।
সে বলিয়াছিল, এই দেখ, আমি কলে কাজ করি, রোজগার করি অ্যানেক। তা জাতে পতিত বলে আমাকে বিয়ে দেয় না কেউ। তু আমাকে বিয়ে করবি?
ঝরনার ধারে প্রণয়ী যুবকটি বলিল, এই গাঁয়ে সবাই হাঁ-হাঁ করবে—আমার জাতগোষ্টিতেও করবে, তোর জ্ঞাতগোষ্টিতেও করবে। তার চেয়ে চল আমরা পালিয়ে যাই। সেইখানে দুজনায় সাপ্তা করে বেশ থাকব।
মৃদুস্বরে কথা, কিন্তু এই নিস্তব্ধ স্থানটির মধ্যে কথাগুলি যেন স্পষ্ট হইয়া ভাসিয়া আসিতেছে। বুড়ী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, তাহারাও পৃথিবীর লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ ছাড়িয়া বিবাহ করিয়া সংসার পাতিয়াছিল, মাড়োয়ারীবাবুর কলের ধারেই একখানা ঘর তৈয়ারি করিয়া তাহারা বাসা বাঁধিয়াছিল। বয়লা না কি বলে, সেই প্রকাণ্ড পিপের মত কলটা—সেই কলুটায় সে কয়লা ঠেলিত। তাহার মজুরি ছিল সকলের চেয়ে বেশি।
ঝরনার ধারে অভিসারিকা মেয়েটির কথা ভাসিয়া আসিল—উ হবে না। আগে আমায় রুপোর চুড়ি আর খুঁটে দশষ্টি টাকা তু বেঁধে দে, তবে আমি যাব। লইলে বিদেশে পয়সা অভাবে খেতে পাব না, তা হবে না।
ছি ছি, মেয়েটার মুখে ঝাটা মারিতে হয়। এত বড় একটা জোয়ান মরদ যাহার আঁচল ধরিয়া থাকে, তাহার নাকি খাওয়া-পরার অভাব হয় কোনোদিন! মরণ তোমার। রুপার চুড়ি কি, একদিন সোনার শাখা-বাধা উঠবে তোমার হতে। ছি!
ছেলেটি কথার কোনো জবাব দিল না, মেয়েটিই আবার বলিল, কি, রা কাড়িস না যি? কি বলছিস বল? আমি আর দাঁড়াতে লারব কিন্তুক।।
ছেলেটি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, কি বলব বল? টাকা থাকলে আমি তোকে দিতাম, রুপোর চুড়িও দিতাম, বলতে হত না তোক।
মেয়েটা বেশ হেলিয়া দুলিয়া রঙ্গ করিয়াই বলিল, তবে আমি চললাম।
–যা।
—আর যেন ডাকিস না।
—বেশ।
অল্প একটু দূর যাইতেই সাদা-কাপড়-পরা মেয়েটি ফুটফুটে চাঁদনীর মধ্যে যেন মিশিয়া গেল। ছেলেটা চুপ করিয়া ঝরনার ধারে বসিয়া রহিল। আহা! ছেলেটার যেমন কপাল! শেষ পর্যন্ত ছেলেটা যে কি করিবে কে জানে! হয়তো বৈরাগী হইয়া চলিয়া যাইবে, নয়তো গলায় দড়ি দিয়াই বসিবে। বৃদ্ধা শিহরিয়া উঠিল। ইহার চেয়ে তাহার রুপার চুড়ি কয়গাছা দিলে হয় না? আর টাকা? দশ টাকা সে দিতে পারিবে না। মোটে তো তাহার এক কুড়ি টাকা আছে, তাহার মধ্য হইতে দুইটা টাকা, না-হয় পাঁচটা সে দিতে পারে। তাহাতে কি হইবে? মেয়েটা আর বোধ হয় আপত্তি করিবে না! আহা! জোয়ান বয়স, সুখের সময়, শখের সময়—আহা! ছেলেটিকে ডাকিয়া রুপার চুড়ি ও টাকা সে দিবে, আর উহার সঙ্গে নাতি-ঠাকুরমার সম্বন্ধ পাইবে। গোটাকতক চোখা চোখা ঠাট্টা সে যা করিবে।
মাটিতে হাতের ভর দিয়া কুঁজীর মত সে ছেলেটির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ছেলেটা যেন ধ্যানে বসিয়াছে, লোকজন আসিলেও খেয়াল নাই। হাসিয়া সে ডাকিল, বলি, ওহে লাগর, শুনছ?
দন্তহীন মুখের অস্পষ্ট কথার সাড়ায় ছেলেটি চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া আতঙ্কে চীৎকার করিয়া উঠিল, পরমুহূর্তেই লাফ দিয়া উঠিয়া সে প্রাণপণে ছুটিতে আরম্ভ করিল।
মুহূর্তে বৃদ্ধারও একটা অভাবনীয় পরিবর্তন হইয়া গেল; ক্রুদ্ধা মার্জারীর মত ফুলিয়া উঠিয়া সে বলিয়া উঠিল, মর-মর তুই মর। সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা হইল, ক্রুদ্ধ শোষণে উহার রক্ত-মাংস মেদমজ্জা সব নিঃশেষে শুষিয়া খাইয়া ফেলে।
ছেলেটা একটা আর্তনাদ করিয়া বসিয়া পড়িল। পরমুহুর্তেই আবার উঠিয়া বেড়াইতে খোড়াইতে পলাইয়া গেল।
পরদিন দ্বিপ্রহরের পূর্বেই গামখানা বিস্ময়ে শঙ্কায় স্তম্ভিত হইয়া গেল। সর্বনাশী ডাইনী বাউরীদের একটা ছেলেকে বাণ মারিয়াছে। ছেলেটা সন্ধ্যায় গিয়াছিল ঐ ঝরনার ধারে; মানুষের দেহরসলোলুপা রাক্ষসী গন্ধে আকৃষ্টা বাঘিনীর মত নিঃশব্দে পদসঞ্চারে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। জানিতে পারিয়া ভয়ে ছেলেটি ছুটিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু রাক্ষসী তাহাকে বাণ মারিয়া ফেলিয়া দিয়াছে। অতি তীক্ষ্ণ একখানা হাড়ের টুকরা সে মন্ত্রপূত করিয়া নিক্ষেপ করিতেই সেটা আসিয়া তাহার পায়ে গভীর হইয়া বসিয়া গিয়াছে। টানিয়া বাহির করিয়া ফেলিতেই সে কি রক্তপাত! তাহার পরই প্রবল জ্বর; আর কে যেন তাহার মাথা ও পায়ে চাপ দিয়া তাহার দেহখানি ধনুকের মত বাকাইয়া দিয়া দেহের রস নিঙড়াইয়া লইতেছে!
কিন্তু সে তাহার কি করিবে?
কেন সে পলাইতে গেল? পলাইয়া যাইবে? তাহার সম্মুখ হইতে পলাইয়া যাইবে? সেই তাহার মত শক্তিমান পুরুষ—যে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করিত—শেষ পর্যন্ত তাহারই অবস্থা হইয়া গিয়াছিল মাংসশূন্য একখানি মাছের কাঁটার মত।
কে এক গুণীন নাকি আসিয়াছে। বলিয়াছে, এই ছেলেটাকে ভালো করিয়া দিবে। তিলে তিলে শুকাইয়া ফ্যাকাসে হইয়া সে মরিয়াছিল। রোগ—ঘুষঘুষে জ্বর, কাশি। তবে রক্তবমি করিয়াছিল কেন সে?
স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে উন্মত্ত অস্থিরতায় অধীর হইয়া বৃদ্ধা আপনার উঠানময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সম্মুখে ছাতি-ফাটার মাঠ আগুনে পুড়িতেছে নিস্পন্দ শবদেহের মত। সমস্ত মাঠটার মধ্যে আজ আর কোথাও এতটুকু চঞ্চলতা নাই। বাতাস পর্যন্ত স্থির হইয়া আছে।
যাহাকে সে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসিত, কোনোদিন যাহার উপর এতটুকু রাগ করে নাই, সেও তাহার দৃষ্টিতে গুকাইয়া নিঃশেষে দেহের রক্ত তুলিয়া মরিয়া গিয়াছে। আর তাহার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির আক্রোশ, নিষ্ঠুর শোষণ হইতে বাঁচাইবে ঐ গুণীটা!
হি-হি করিয়া অতি নিষ্ঠুরভাবে সে হাসিয়া উঠিল। উঃ, কি ভীষণ হাঁপ ধরিতেছে তাহার! দম যেন বন্ধ হইয়া গেল। কি যন্ত্রণা, উঃ-যন্ত্রণায় বুক ফাঁটাইয়া কাদিতে ইচ্ছা করিতেছে। ঐ গুণীনটা বোধ হয় তাহাকে মন্ত্রপ্রহারে জর্জর করিবার চেষ্টা করিতেছে। কর, তোর যথাসাধ্য তুই কর।
এখন হইতে কিন্তু পলাইতে হইবে। তাহার মৃত্যুর পর বোলপুরের লোকে যখন উহার গোপন কথাটা জানিতে পারিয়াছিল, তখন কি দুর্দশাই না উহার করিয়াছিল। সে নিজেই কথাটা বলিয়া ফেলিয়াছিল। কলের সেই হাড়ীদের শঙ্করীর সহিত তাহার ভাব ছিল, তাহার কাছেই সে একদিন মনের আক্ষেপে কথাটা প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছিল।
তাহার পর সে গ্রামের বাইরে একধারে লোকের সহিত সম্বন্ধ না রাখিয়া বাস করিতেছে! কত জায়গায় যে সে ফিরিল! আবার যে কোথায় যাইবে!
ও কি! অকস্মাৎ উত্তপ্ত দ্বিপ্রহরের তন্দ্রাতুর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া একটি উচ্চ কান্নার রোল চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বৃদ্ধা স্তব্ধ হইয়া শুনিয়া পাগলের মত ঘরে ঢুকিয়া খিল আঁটিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।।
সন্ধ্যার মুখে সে একটি ছোট পুঁটলি লইয়া ঐ ছাতি-ফাটার মাঠের মধ্যে নামিয়া পড়িল। পলাইবে—সে পলাইবে।
একটা অস্বাভাবিক গাঢ় অবকার ঘনাইয়া আসিতেছে। সমস্ত নিথর, স্তব্ধ। তাহারই মধ্যে পায়ে পায়ে ধূল উড়াইয়া বৃদ্ধা ডাইনী পলাইয়া যাইতেছিল। কতকটা দূর আসিয়া সে বসিল, চলিবার শক্তি যেন খুঁজিয়া পাইতেছে না।
অকস্মাৎ আজ বহুকাল পরে তাহার নিজেরই শোষণে মৃত স্বামীর জন্য বুক ফাটাইয়া সে কাঁদিয়া উঠিল, ওগো, তুমি ফিরে এস গো!
উঃ, তাহার নরুণ-দিয়া-চরা ছুরির মত চোখের সম্মুখে আকাশের বায়ুকোণটা তাহার চোখের তারার মতই খয়ের রঙের হইয়া উঠিয়াছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত পায়ের ধূলার আস্তরণের মধ্যে বিলুপ্ত করিয়া দিয়া কালবৈশাখীর ঝড় নামিয়া আসিল। সেই ঝড়ের মধ্যে বৃদ্ধা কোথায় বিলুপ্ত হইয়া গেল! দুর্দান্ত ঘূর্ণিঝড়। সঙ্গে মাত্র দুই-চারি ফোটা বৃষ্টি।
পরদিন সকালে ছাতি-ফাট র মাঠের প্রান্তে সেই বহুকালের কণ্টকাকীর্ণ খৈরী গুলোর একটা ভাঙা ডালব সচালো ডগার দিকে তাকাইয়া লোকের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না; শাখাটার তীক্ষ্ণাগ্র প্রান্তে বিদ্ধ হইয়া ঝুলিতেছে বৃদ্ধা ডাকিনী। আকাশ-পথে যাইতে যাইতে ঐ গুণীনের মন্ত্রপ্রহারে পঙ্গুপক্ষ পাখির মত পড়িয়া ঐ গাছের ডালে বিদ্ধ হইয়া মরিয়াছে। ডালটার নীচে ছাতিফাটার মাঠের খানিকটা ধূলা কালো কাদার মত ঢেলা বাঁধিয়া গিয়াছে। ডাকিনীর কালো রক্ত ঝরিয়া পড়িয়াছে।
অতীত কালের মহানাগের বিষের সহিত ডাকিনীর রক্ত মিশিয়া ছাতি-ফাটার মাঠ আজ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছিল। চারিদিকের দিকচক্ররেখার চিহ্ন নাই; মাটি হইতে আকাশ পর্যন্ত একটা ধূমাচ্ছন্ন ধূসরতা। সেই ধূসর শূন্যলোকে কালো কতকগুলি সঞ্চরমাণ বিন্দু ক্রমশ আকারে বড় হইয়া নামিয়া আসিতেছে।
নামিয়া আসিতেছে শকুনির পাল।