কাজের ছেলেটা বলল, আসলে তো আমাদের সামনেই থাকত। পত্রিকা কি আমি বাড়ি নিয়া যাই?
বড় মামা বললেন, একটা সহজ প্রশ্ন করেছি, সহজ উত্তর দিবি। সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং। যা, তোর চাকরি নট।
কাজের ছেলে বলল, নট হইলে নট। সে ঘর ঝাট দেওয়া শেষ করে বলল, চা আনব?
আন।
দুধ-চা, না রং-চা?
বড় মামা বিরক্ত গলায় বললেন, আমি যে রং-চা খাই তুই জানিস। প্রতিদিন রং-চা এনে দিস। কেন জিজ্ঞেস করলি, রং-চা, না দুধ-চা?
প্রতিদিন রং-চা খাইলেও আইজ দুধ-চা খাওনের ইচ্ছা হইতে পারে, এই জন্য জিগাইছি।
তোর চাকরি নট, বেতন নিয়ে চলে যা।
আপনের চা-টা দিয়া তারপর যাই।
কাজের ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই টেলিফোন বাজা শুরু করল। আমি বুঝতে পারছি, কাদের টেলিফোন করেছে। সে আমার মৃত্যুসংবাদ দিতে শুরু করেছে। এটা তার প্রথম টেলিফোন। জীবিত মানুষের কোনো টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই, মৃতদের আছে। সবার আছে কি না জানি না, অন্তত আমার আছে। আমি বড় মামা ও কাদেরের টেলিফোনের কথাবার্তায় মন দিলাম। হতভম্ব বড় মামা বললেন, কখন মারা গেছে?
শেষ রাতে।
ডেডবড়ি কি হাসপাতালে?
জ্বে না। দেশের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।
কখন রওনা হয়েছে?
সকাল সাতটায়।
আমি কিছুই জানলাম না, ডেডবডি দেশের বাড়িতে রওনা হয়ে গেছে?
রুবিনা কোথায়?
উনি রেস্টে আছেন।
রেস্টে আছেন মানে কী?
শোবারঘরে দরজা বন্ধ করে আছেন।
রুবিনাকে টেলিফোন দাও।
ক্যামনে দিব? দরজা বন্ধ।
দরজা ভাঙ। কুড়াল দিয়ে দরজা কেটে ফেল।
কী বলছেন?
হারামজাদা ঠসা, কানে শুনস না? কুড়াল দিয়ে দরজা কাট।
এই বলেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুকে হাত দিয়ে কাউন্টারের পেছনে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নিশ্চয়ই। অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা। আমি শুধু দেখছি, সাহায্য করতে পারছি না। আমি অবজার্ভার।
কোয়ান্টাম ফিজিকসের ক্লাসে ছাত্রদের অবজার্ভার কী, তা অনেকবার পড়িয়েছি। অবজার্ভার হচ্ছে এমন একজন, যার উপস্থিতি ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটবে না। কিংবা ঘটনা ঘটবে কি না, তা অবজার্ভারের ওপর নির্ভর করবে। মনে করো, আকাশে পূর্ণচন্দ্র। চন্দ্রের পাশেই বড় এক খণ্ড মেঘ। কোয়ান্টাম মেকানিকস বলছে, আকাশের চাঁদ একই সঙ্গে মেঘে ঢাকা এবং মেঘমুক্ত। একজন অবজার্ভার যখন চাঁদের দিকে তাকাবে, তখনই শুধু নির্ধারিত হবে চাঁদ মেঘমুক্ত, না মেঘে ঢাকা।
প্রথম দিন যখন এই বক্তৃতা করি, তখন এক ছাত্রী ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার, পুরো ব্যাপারটা ভুয়া বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম, কোয়ান্টাম ফিজিকস হচ্ছে সম্ভাবনার জগৎ। সেখানে এই পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সিরও ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়।
আমি এখন কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আশপাশের সব কর্মকাণ্ড সে শুধু দেখবে। কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে না। বড় মামা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছেন। পড়ার সময় কাঠের চেয়ারে বাড়ি খেয়ে তার থুতনি কেটে গেছে। সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। এতক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দ করছিলেন, এখন সেই শব্দও নেই। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কে নেবে? আমি কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আমার কাজ শুধু দেখা।
কাজের ছেলেটা ফিরেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। বগলে খবরের কাগজ। এই খবরের কাগজ সে কিনে এনেছে। ছেলেটা বড় মামার স্বভাব খুব ভালোমতো জানে। বড় মামা চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে পারেন না।
কাউন্টারে চায়ের কাপ ও খবরের কাগজ রেখে সে বলল, গেল কই! বলেই সে ঝাঁটা নিয়ে ফার্মেসির পেছনে চলে গেল। সেখানে ছোট একটা ঘর আছে। মাঝে মাঝে এই ঘরে শুয়ে মামা বিশ্রাম নেন, কাজের ছেলেটা তখন মামার পা টিপে দেয়।
ফার্মেসির পেছনে ঘর ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে, তার শব্দ পাচ্ছি। যে ঝাঁট দিচ্ছে, সে এখনো আমার চোখের আড়ালে। চোখের আড়াল’ কথাটা ঠিক হলো না। চোখ নেই, তখন আবার চোখের আড়াল কী?
পুরোনো স্মৃতি কীভাবে কীভাবে যেন থেকে যায়। আমরা এখনো বলি, বাটা দপ করে ফিউজ হয়ে গেল। অতি প্রাচীনকালে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপ নেভার সময় দপ করে শব্দ হতো। সেই ‘দপ’ শব্দ এখনো আমাদের স্মৃতিতে আছে। আমরা বলছি, বাল্বটা দপ করে নিভে গেছে।
জীবিত মানুষের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মস্তিষ্কে। একজন মৃতের স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়? আমার স্মৃতি এখন কোথায় জমা?
কাজের ছেলেটা ঘর ঝাঁট দিয়ে ফিরে এসেছে। সে আবারও বলল, মানুষটা গেল কই? চা ঠান্ডা হইতেছে।
ফার্মেসির পত্রিকা নিয়ে লোক এসেছে। সে বাইরে থেকে পত্রিকা ছুঁড়ে ফেলতেই কাজের ছেলেটি বলল, এত বেলা কইরা কাগজ দিলে আমরার পুষে না। স্যারের সক্কালবেলা কাগজ লাগে। আইজ থাইকা কাগজ বন। নগদ পয়সায় কাগজ খরিদ করব।
মামার কাজের ছেলেটা কাগজ ভাঁজ করে কাউন্টারে রাখতে গেছে, একটু উকি দিলেই সে তার স্যারকে দেখতে পাবে। মনে হচ্ছে, সে উকি দেবে। মামা কি মারা গেছেন? কোয়ান্টাম সূত্রে মামা এখন শ্ৰয়ডিংগারের বিড়াল। একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত। কাজের ছেলে উঁকি দেওয়ামাত্র বিষয়টির মীমাংসা হবে। মামা কোনো একটি রিয়েলিটি গ্রহণ করবেন। হয় মৃত রিয়েলিটি অথবা জীবিত রিয়েলিটি।